প্রথম পরিচ্ছেদ

স্বদেশ–কল্যাণ–সঙ্ঘের মাসিক অধিবেশন বসবে সন্ধ্যা সাতটায়, এখন ঘড়িতে বাজল চারটে। অনেক দেরি। এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট এককড়ি। প্রদীপে আলো জ্বালাবার লোকের অভাব হয়নি, কিন্তু তেল যোগাতে হয় একাকী তাকেই। তার গৃহেই সঙ্ঘের অফিস, তার বসবার ঘরেই বসে সঙ্ঘের বৈঠক। মেঝের আগাগোড়া সতরঞ্চি পাতা, তার উপর ফরসা চাদর এবং দেয়ালের ধারে ধারে রাখা অনেকগুলি তাকিয়া। এরই একটা অধিকার করে এককড়ি গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়ে চোখ বুজে বোধ করি বা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, এমন সময় নিঃশব্দ পদক্ষেপে প্রবেশ করল জলধি। আসন গ্রহণ করে ডাকলে, এককড়িদা কি ঘুমিয়ে পড়লেন?

এককড়ি চোখ মেলে উঠে বসলো। হাই তুলে তুড়ি দিয়ে গম্ভীর মুখে বললে, গভীর চিন্তামগ্ন ছিলাম। তার পরেই একটু হেসে ফেলে বললে, ঘুমিয়ে পড়লেও দোষ নেই রে জলধি, বয়স ত হলো। এখন এইটেই স্বধর্ম।

জলধিও হাসলে, বললে, ইস! ভারী ত বয়েস!

যৌবনের প্রথম দিকটা এককড়ির শেষ হয়–হয়। রগের কাছটায় চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু সুগঠিত দেহে শক্তি ও উদ্যমের অবধি নেই। এককড়ি বিপত্নীক। প্রকাণ্ড বাড়ির মধ্যে আছে শুধু তার বছর-দশেকের মেয়ে আর এক বিধবা পিসী। পাটের ও তিসির ব্যবসায়ে পিতা এত অর্থসম্পদ রেখে গেছেন যে, তাকে প্রভূত বলাও চলে। পরে পরে অনেকগুলি ভাই-বোন মরার পরে এককড়ির জন্ম, তাই ছেলেবেলায় এত সাবধানে তাকে রক্ষা করা হয় যে, সে প্রায় একপ্রকার পাগলামির অন্তর্গত। পিতা স্কুলে পর্যন্ত কখনো ছেলেকে পাঠান নি,—বাড়িতেই নিযুক্ত ছিল মাস্টার ও পন্ডিত, নামজাদা ও উচ্চ বেতনের। ছাত্রের সম্বন্ধে তাদের সার্টিফিকেটের ভাষা ছিল উদার, কিন্তু বিদ্যার পরীক্ষা যাকে দিতে হয়নি তার বাজার-দর কত এবং বাগ্‌দেবী সত্যই তাকে বর দিলেন কি পরিমাণ, এ তথ্য নিরূপণ করা আজ কঠিন। পাঠ সাঙ্গ হ’লো, শিক্ষকগণ বিদায় নিলেন, তবু লাইব্রেরি ঘরেই দিন কাটতো তার এতদিন। পিসীমার বহু অশ্রুপাত অগ্রাহ্য করেও সে যে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেনি, বইয়ের শেলফগুলো ছাড়া এ রহস্য আর কেউ জানে না। এমনি করেই তার দিন কাটতে পারতো, কিন্তু পারলো না। হঠাৎ বন্দেমাতরমের বিরাট কঠিন ধ্বনি কোটর থেকে টেনে তাকে বার করলে। তার পরে জেলে গেলো, দলাদলির আবর্তে পড়ে নাকে-মুখে পাঁক ঢুকলো; দৈনিক ও সাপ্তাহিক প্রদত্ত নানা বিচিত্র বিশেষণের মালা শিরোপা পেলে, শেষে একদিন যাদের সংসার চালিয়েছিল তারাই চোর বলে যখন কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলে, তখন সে আর সইলো না, পলিটিক্সে জলাঞ্জলি দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে আবার তার লাইব্রেরি-ঘরে এসে আশ্রয় নিলে।

কিন্তু দেশোদ্ধারের নেশা তখন পাকা করে ধরেচে, তাই পুরোনো বইয়ের মধ্যে আর তার মৌতাতের খোরাক মিললো না, আবার তাকে অস্থির করে তুললে। এবার কতকগুলি ছেলেমেয়ে জুটলো—তারাও তখন পলিটিক্সে তোবা করে বেকার হয়ে পড়েচে—বললে, এককড়িদা, রাজনীতি আর না, কিন্তু জীবনটাকে কি নিতান্তই ব্যর্থ করে আনবো, দেশের একটা কাজেও লাগবে না? এ দুর্গতি থেকে বাঁচাও—যাতে হোক লাগিয়ে আমাদের দিয়ে তুমি কাজ করিয়ে নাও।

এককড়ি রাজী হ’লো। স্থির হ’লো এবারের প্রোগ্রাম সোশাল সার্ভিস। গ্রামে, নগরে, পল্লীতে—সর্বত্র কেন্দ্র সংস্থাপন করা। জলধি বললে, বিদ্যায়, জ্ঞানে, চরিত্রে, অর্জনে, সঞ্চয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে সচেতন করতে না পারলে ঘরে-পরে কেবল বিদ্বেষ আর কলহ দিয়েই সঙ্কট মোচন হবে না। যোগ্য না হলে যোগ্যতার পুরস্কার পাবে কার কাছে? পেলেই বা থাকবে কেন? ধনীর কুপুত্রের মতো বিত্ত-সম্পদ যে দেখতে দেখতে লোপ পাবে—চক্ষের পলক সইবে না,—কমলা অন্তর্হিত হবেন। এ-সব যুক্তি শাশ্বত সত্য—অকাট্য। এর বিরুদ্ধে তর্ক চলে না।

অতএব প্রতিষ্ঠিত হলো কল্যাণ-সঙ্ঘ। গ্রামে গ্রামে প্রসারিত হলো শাখা-প্রশাখা। অধ্যক্ষ এককড়ি, সচিব জলধি। নানা শাখার সদস্য সংখ্যা দু’শোর বেশী। আজকের দিনে মাসিক অধিবেশনের বৈঠকে সাধারনতঃ হাজির যারা হয় সেও জন-পঞ্চাশের কম নয়। দূরের সদস্যদের ট্রেনভাড়া দেবার ব্যবস্থা আছে।

নীচের যে ঘরটায় সঙ্ঘের অফিস সেখানে বসে যে মেয়েটি অবিশ্রাম কেরানীর কাজ করে তার নাম মণিমালা। মাসিক ত্রিশ টাকায় সে ভর্তি হয়, সম্প্রতি খুশি হয়ে এককড়ি মাইনে বাড়িয়েছে পঞ্চাশ টাকায়। গোড়ায় এককড়ি তাকে বাড়িতে থাকতেই বলেছিল, কারণ ঘরের অভাব নেই, কিন্তু সে রাজী হয়নি। কাছেই কোথায় তার বাসা—সেখানে নিজে রেঁধে খায়। একলা থাকে। একটা দিনের জন্যে তার কামাই নেই, একটা কাজে তার শৈথিল্য প্রকাশ পায় না। একদা অসহযোগের প্রবল বন্যায় ভাসতে ভাসতে ঠেকতে ঠেকতে সে এ-অঞ্চলে এসে পড়ে। সঙ্গে বাবা ছিলেন, কিন্তু বুড়ো বয়সে জেলের দুঃখ তাঁর সইলো না—বাইরে এসে যশোর না কোথায় উদরাময়ে মারা গেলেন। মণিমালার প্রাক্তন ইতিবৃত্ত এর বেশী কেউ জানে না। স্বল্পভাষী মেয়ে,—নিজের মুখে প্রায়ই কিছু বলে না। দেখতে সে সুন্দরী নয়, মুখের ’পরে একটা পুরুষালি ভাব, কাউকে টানে, কাউকে দূরে ঠেলে।

বর্ণ কালোর দিকে, কিন্তু মেদ-মাংসের বাহুল্যবর্জিত দীর্ঘ-ছন্দের দেহ কর্মঠ ও কষ্টসহিষ্ণু, তা দেখামাএই বুঝা যায় এবং জন্মভূমি যে পূর্ববাঙলার কোন এক স্থলে সে পরিচয়ও ধরা পড়ে তার উচ্চারণে। মনে হয় একদিন কলেজে পড়েছিল সে নিশ্চিত, হয়ত বা কিছু কিছু পরীক্ষা পাসও করেছে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে বলে না, শুধু হাসে। তার ইংরাজী ও বাংলা লেখার শুদ্ধতা ও ক্ষিপ্রতা দেখে এককড়ি অবাক হয়ে যায়। সঙেঘর পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে প্যাম্‌ফ্লেট ছেপে প্রচার করার বিধি আছে। আগে রচনার ভার ছিল জলধির, এখন পড়েছে মণিমালার ’পরে। পূর্বে এই লেখাটা আদায় করতে এককড়ি গলদ্ঘর্ম হ’তো, এখন বলামাত্র লেখা আপনি আসে। জলধি সেক্রেটারি, কাটকুট না করে, কলম না চালিয়ে তার মান বাঁচে না। এককড়ি বিরক্ত হয়ে মণিমালাকে আড়ালে ডেকে বলে, ফুলের ক্ষেতে ফাল চালাবার যদি ওর শখ, কিন্তু উলুবনের ত অভাব নেই,—আমাকে বললে একটা দেখিয়ে দিতেও পারতাম,—তাতে কাজ না হোক অকাজ ঘটতো না। কিন্তু এ লেখাটা যে দশজনে পড়বে মণি, একে নাম-সই করে ছাপাতে দেবো কি করে? ওকে বলো এবার থেকে ও-ই যেন দস্তখত করে।

মণিমালা জলধির হয়ে সলজ্জে বলে, কিছু খারাপ হয়নি এককড়িদা, প্রেসে পাঠিয়ে দিন। সংশোধনগুলো আমার ভালই লেগেচে।

সেই ভাল, বলে এককড়ি ছাপাতে পাঠিয়ে দেয়। সঙেঘর বাইরের চেহারার একটা নমুনা দিলাম, ভিতরের মূর্তিটা ক্রমশঃ প্রকাশ পাবে।

জলধি হাতঘড়িটা মিলিয়ে দেখে বললে, চারটে পনেরো—ভিড় জমতে ঘণ্টা-তিনেক দেরি। সঙেঘর সেক্রেটারি আমি, সকাল সকাল আসাই আমার উচিত। খেয়েদেয়েই আসবো ভেবেছিলাম, কিন্তু ঘটে উঠলো না। পথের মধ্যে ভাবলাম সুরেন আর তারিণীকে ডেকে নিই, কিন্তু পরের কাছে আপনি পাছে মন না খোলেন সেই ভয়ে বিরত হলুম।

এককড়ি বললে, সুরেন, তারিণী পর হলো? তবে আপনার বলো কাকে?

বলি, শুধু আমার নিজেকে। ওদের সামনে মন খুললেও আমি মুখ খুলতে পারতাম না। ইতিমধ্যে গোটা-দুই অনুরোধ আছে দাদা।

কিসের অনুরোধ?

একটা এই যে সঙেঘর আপনিই দেহ, আপনিই প্রাণ। আত্মার আলোচনা করবো না, অচিন্তনীয় পদার্থ হয়ে তিনি চিন্তার অনধিগম্যই থাকুন। আমরা শুধু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তিনটে বছর ত এই দেহযন্ত্রটা টেনে টেনে বেড়ালাম, এবার অনুমতি করুন পরের হাতে ঠেলে ফেলবার আগেই এর গঙ্গাযাত্রাটা সমাধা করে যাই। দোহাই দাদা, অমত করবেন না, হুকুমটি দিন।

প্রার্থনার রসটা এককড়ি বুঝলো না, সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, কার গঙ্গাযাত্রা করতে চাও, আমাদের সঙ্ঘের?

জলধি বললে, ঠিক তাই। মরবেই ত, শুধু নিশ্বাসটুকু বেরোবার পূর্বে একটু সমারোহে ঘাটে নিয়ে যাওয়া।

এককড়ি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।

জলধি বলতে লাগলো, অফিস-ঘরে খাতাপত্রগুলো আছে। সংখ্যায় নিতান্ত কম নয়। তা হোক, ওগুলো শুধু মুমূর্ষুর গায়ের নোংরা কাপড়-চোপড়। দাম কানাকড়িও নয়, বরঞ্চ রোগের বীজাণু ছড়াবার আশঙ্কা আছে। চলুন, সদস্যবৃন্দ সমাগত হবার পূর্বে দেশলাই জ্বালিয়ে সৎকার করে ফেলা যাক।

এককড়ি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলে, আজ তোমার হলো কি জলধি?

জলধি বললে, কি হয়েছে সে বিবরণ আপনাকে সবিস্তারে দেবার নয়। মণিমালা উপস্থিত থাকলে সে হয়ত আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারতো।

এককড়ি আবার কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইলো, বোধ হয় মনে মনে কারণ বোঝবার চেষ্টা করলে, কিন্তু কিছুই স্পষ্ট হলো না। প্রশ্ন করলে, তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ?

জলধি বললে, এটা আরও বেশী দরকারি দাদা। আপনার মামা মস্ত লোক, তাঁকে ধরে করপোরেশনে হোক, মিউনিসিপালিটিতে হোক, জেলাবোর্ডে হোক, ইনসিওর কোম্পানিতে হোক,—অর্থাৎ আপনাদের স্বরাজ-পাণ্ডারা যেখানে বেশ একটু আসনপিঁড়ি হয়ে বসতে পেরেছেন, আমার চাকরি একটা করে দিন। যেন দু’মুঠো খেতে পরতে পাই।

এককড়ি ক্ষুব্ধ মুখে, কাতর স্বরে বললে, দু’মুঠো খেতে পরতে কি পাও না জলধি?

পাই বৈ কি দাদা, নইলে বেঁচে আছি কি করে? দেশের সেবা করি, একেবারে নিঃস্বার্থ। গোলামি করিনে বলে লোক ঠকিয়ে ইজ্জত বজায় করি—ডান-হাতটা ত রেখেচি দিনরাত বক্তার ঘুঁষিতে পাকিয়ে। তবু অলক্ষ্যে অগোচরে বাঁ-হাতের তেলোর পরে আপনার ছিটেফোঁটা মুষ্টিভিক্ষে যা এসে পড়ে তাতেই শোধ করি মেসের দেনা, খদ্দরের বিল। কুকুর-বিড়ালে যেভাবে বাঁচে প্রায় তেমনি। আপনি বড়লোক, বিশ-পঁচিশ-পঞ্চাশ আপনার হিসেবের মধ্যেই নয়। কিন্তু আর নয় দাদা, এর থেকে ছুটি দিন।

এককড়ি চুপ করে রইলো, কথা কইলে না। দেয়ালের ঘড়িতে পাঁচটা বাজলো। যে চাকরটা তামাক বদলে দিতে ঢুকেছিল তাকে বললে, গোপাল, নীচে থেকে মণিদিদিকে ডেকে দিয়ে যা ত। জলধি, পরের কাছে লজ্জাই যদি বোধ করো—

না না দাদা, পর কোথায়? যে-সব মহাত্মাদের মাঝে ঘোরাফেরা করি তাঁরা সবাই অন্তরঙ্গ, সবাই আত্মীয়। তাঁদের অজানা কিছুই নেই। বছর-দশেক স্বদেশসেবা-ব্রতে লেগে আছি, লজ্জা থাকলে বাঁচবো কেন?

চাকরটা গুড়গুড়ির মাথায় কলকে রেখে নীচে যাচ্ছিলো, জলধি তাকে বারণ করে বললে, গোপাল, তোর কাজে যা। একটু হেসে বললে, মণিমালা আসেনি এককড়িদা, মিছে সিঁড়ি ভাঙিয়ে ওকে লাভ কি?

আসেনি? এমনধারা ত কখনো হয় না।

হয় না বলেই হতে নেই দাদা? আজ তার দেহটা একটু বে-এক্তার—আমিই আসতে বারণ করে দিয়েছি।

কিন্তু অধিবেশনের কাগজপত্র?

কাগজপত্র আজ থাক গে। এককড়ি চিন্তিত সুরে বললে, যাদের কখনো কিছু হয় না, তাদের একটা কিছু হলে সহজে সারতে চায় না। ভয় হয় পাছে ওকে ভোগায়।

জলধি চুপ করে রইলো। এককড়ি বলতে লাগলো, চমৎকার মেয়ে। যেমন বিদ্যেবুদ্ধি, তেমনি চরিত্রের নির্মলতা, সাহসও তেমনি,—ভয় কাকে বলে জানে না।

জলধি সায় দিয়ে বললে, সাহস আছে তা মানি।

আমাদের গোপাল ওর বাসা চেনে। সন্ধ্যের পরে তাকে পাঠাবো। যদি ডাক্তারের দরকার হয়, দত্তসাহেবকে ডেকে নিয়ে যাবে।

ডাক্তার-বদ্যির দরকার হবে না এককড়িদা, বরঞ্চ গোপালকে দিয়ে বলে পাঠাবেন আর বেশী অত্যাচার না করে।

কিন্তু অত্যাচার ত সে করে না, জলধি।

আপনি বড় সেকেলে দাদা। সব তাতেই পূর্বকালের দোহাই পাড়েন, পরিবর্তন মানতে চান না। সে যা হোক গে, মণিমালা এখন যা শুরু করেছেন সাধারণ মানুষে তাকে অত্যাচার না বলে পারে না। ওঁর বাসায় গিয়ে দেখলাম বিছানায় শুয়ে, আর সেই বন্ধুটি শিয়রে বসে দিচ্ছে মাথা টিপে।

এককড়ি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, বন্ধু আবার কে? এ কথা ত কখনো শুনিনি!

আবার সে পূর্বকালের নজির! কিন্তু তে হি ন দিবসাগতাঃ—বন্ধু কিছুদিন হলো এসেছেন। কোথায় নাকি আগে আলাপ হয়েছিল। চোখ রাঙ্গা, গলা ভেঙ্গেছে; জিজ্ঞেস করলাম, ঠাণ্ডা লাগালে কি করে মণি? মণি লোকটিকে দেখিয়ে বললে, কাল রমেনের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম বজবজে। বাস ছেড়ে গাঁয়ের পথ ধরে দু’জনে হাঁটলাম অনেক দূর। গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো বটগাছ, তার তলায় গিয়ে দু’জনে বসে পড়লাম। আকাশে চাঁদ উঠলো, পাতার ফাঁকে ফাঁকে নামালো জ্যোৎস্নার আলো, সুমুখে নদীর জলে দিলে স্বপ্ন মাখিয়ে—ভুলে গেলাম ওঠবার কথা। হঠাৎ খেয়াল যখন হলো তখন ঘড়িতে দেখি বারোটা বেজে গেছে। অত রাত্রি ফেরবার বাস পাওয়া যাবে কোথায়, কাজেই রাতটা কাটাতে হলো গাছতলায় দাঁড়িয়ে। জলের ধারে খোলা জায়গায় একটু ঠাণ্ডা লাগলো বটে, কিন্তু সময় কাটলো যে কি করে দু’জনের কেউ টেরই পেলাম না। কাব্যের চরম।

এককড়ি হতবুদ্ধি হয়ে বললে, বলো কি জলধি, এ কি সত্যি ঘটনা, না সে তামাশা করলে?

খামকা তামাশার ত কোন হেতু ছিল না দাদা। সে সত্যি কথাই বলেছে।

বলতে লজ্জা পেলে না?

না। বরঞ্চ শুনে আমিই লজ্জা পেলাম ঢের বেশী। আসবার সময় বললাম, এ বয়সে অ্যাডভেন্‌চারের রস আছে মানি, কিন্তু এককড়িদা শুনে এ্যাপ্রিসিয়েট করবেন বলে ভরসা করিনে। হয়ত বা অ-খুশীই হবেন। সে বললে, তাঁর অ-খুশী হবার কারণ ত নেই। আমি ছেলেমানুষ নই, এ তাঁর বোঝা উচিত।

এককড়ি আস্তে আস্তে বললে, বিলাতী গল্পের বইয়ে এ রকম ঘটনা পড়েছি কিন্তু দেশটাকে কি ওরা বিদেশ বানিয়ে তুলতে চায় নাকি?

জলধি ক্রূর হাসি হেসে বললে, ওরা মানে মণিমালা আর তার নতুন বন্ধু। কিন্তু দেশে ওরা ছাড়াও অন্য লোক আছে, তারা এ-সব পছন্দ করে না। অন্ততঃ আমি ত না। এর পরেও যদি আমাদের মধ্যে ওকে রাখতে হয়, আমাদের কল্যাণ-সঙ্ঘের নামটা একটুখানি পালটে নিতে হবে।

এককড়ি নিরুত্তরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।

জলধি বলতে লাগলো, এতাবৎ সঙ্ঘের বাবদে আপনার টাকা কম যায়নি। আমাদের টাকা নাই বটে, কিন্তু যা গেছে তার হিসেব নেই। হিসেব করতেও চাইনে। শুধু আবেদন, এবার এই বেকার যুবকটির একটা চাকরি করে দিন।

এককড়ি তেমনি নীরবেই বসে রইলো, জলধির কথাগুলো তার কানে গেল কি না সন্দেহ। দেয়ালের ঘড়িতে সাতটা বাজলো। গোপাল এসে খবর দিলে বাবুরা আসছেন।