» » ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

যে শয্যা স্পর্শ করিতেও আজ অচলার ঘৃণা বোধ হওয়া উচিত ছিল, তাহাই যখন সে যথানিয়মে প্রস্তুত করিতে অপরাহ্নবেলায় ঘরে প্রবেশ করিল, তখন সমস্ত মনটা যে তাহার কোথায় এবং কি অবস্থায় ছিল—মানব-চিত্ত সম্বন্ধে যাঁহার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে তাঁহারই অগোচর রহিবে না।

যন্ত্র-চালিতের মত অভ্যস্ত কর্ম সমাপন করিয়া ফিরিবার মুখে পাশের ছোট টেবিলটির প্রতি অকস্মাৎ তার চোখ পড়িয়া গেল; এবং ব্লটিং প্যাডখানির উপর প্রসারিত একখানি ছোট্ট চিঠি সে চক্ষের নিমিষে পড়িয়া ফেলিল। মাত্র একটি ছত্র। বার, তারিখ নাই, মৃণাল লিখিয়াছে—সেজদামশাই গো, করছ কি? পরশু থেকে তোমার পথ চেয়ে চেয়ে তোমার মৃণালের চোখ-দুটি ক্ষয়ে গেল যে!

বহুক্ষণ অবধি অচলার চোখের পাতা নড়িল না। ঠিক পাথরে-গড়া মূর্তির পলকবিহীন দৃষ্টি সেই একটি ছত্রের উপর পাতিয়া সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এ চিঠি কবেকার, কখন, কে আনিয়া দিয়া গেছে—সে কিছুই জানে না। মৃণালের বাটী কোন্‌ দিকে, কোন্‌ মুখে তাহার বাড়ি ঢুকিতে হয়, কোন্‌ পথটার উপর, কিজন্য সে এমন করিয়া তাহার ব্যগ্র উৎসুক দৃষ্টি পাতিয়া রাখিয়াছে, তাহার কিছুই জানিবার জো নাই। সম্মুখের এই ক’টি কালির দাগ শুধু এই খবরটুকু দিতেছে যে, কোন্‌ এক পরশু হইতে একজন আর একজনের প্রতীক্ষায় পথ চাহিয়া চোখ নষ্ট করিবার উপক্রম করিয়াছে, কিন্তু দেখা মিলে নাই।

এদিকে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে একদৃষ্টে চাহিয়া চাহিয়া, তাহার নিজের চোখ-দুটি বেদনায় পীড়িত এবং কালো কালো অক্ষরগুলা প্রথমে ঝাপসা এবং পরে যেন ছোট পোকার মত সমস্ত কাগজময় নড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। তবুও এমনি একভাবে দাঁড়াইয়া হয়ত সে আর কতক্ষণ চাহিয়া থাকিত; কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারে এতক্ষণ ধরিয়া তাহার ভিতরে ভিতরে যে নিশ্বাসটা উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল, তাহাই যখন অবরুদ্ধ স্রোতের বাঁধ ভাঙ্গার ন্যায় অকস্মাৎ সশব্দে গর্জিয়া বাহির হইয়া আসিল, তখন সেই শব্দে সে চমকিয়া সম্বিৎ ফিরিয়া পাইল। দ্বারের বাহিরে মুখ তুলিয়া দেখিল, সন্ধ্যায় আঁধার প্রাঙ্গণতলে নামিয়া আসিয়াছে এবং যদু চাকর হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বালাইয়া বাহিরের ঘরে দিতে চলিয়াছে। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু ফিরে এসেছেন, যদু?

যদু কহিল, না মা, কৈ এখনও ত তিনি ফেরেন নি।

এতক্ষণে অচলার মনে পড়িল, দুপুরবেলার সেই লজ্জাকর অভিনয়ের একটা অঙ্ক শেষ হইলে, সেই যে তিনি বাহির হইয়া গিয়াছেন, এখনও ফিরেন নাই। স্বামীর প্রাত্যহিক গতিবিধি সম্বন্ধে আজ তাহার তিলমাত্র সংশয় রহিল না। সুরেশের আসা পর্যন্ত এমনই একটা উৎকট ও অবিচ্ছিন্ন কলহের ধারা এ বাটীতে প্রবাহিত হইয়াছিল যে তাহারই সহিত মাতামাতি করিয়া অচলা আর সব ভুলিয়াছিল। সে স্বামীকে ভালবাসে না, অথচ ভুল করিয়া বিবাহ করিয়াছে, সারাজীবন সেই ভুলেরই দাসত্ব করার বিরুদ্ধে তাহার অশান্ত চিত্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া অহর্নিশি লড়াই করিতেছিল। মৃণালের কথাটা সে একপ্রকার বিস্মৃত হইয়াই গিয়াছিল, কিন্তু আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে সে মৃণালের একটিমাত্র ছত্র তাহার সমস্ত পুরাতন দাহ লইয়া যখন উল্টা-স্রোতে ফিরিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন একমুহূর্তে প্রমাণ হইয়া গেল, তাহার সেই ভুল-করা স্বামীরই অন্য নারীতে আসক্তির সংশয় হৃদয় দগ্ধ করিতে সংসারে কোন চিন্তার চেয়েই খাটো নয়।

লেখাটুকু সে আর একবার পড়িবার জন্য চোখের কাছে তুলিয়া ধরিতে হাত বাড়াইল, কিন্তু নিবিড় ঘৃণায় হাতখানা তাহার আপনি ফিরিয়া আসিল। সে চিঠি সেইখানেই তেমনি খোলা পড়িয়া রহিল, অচলা ঘরের বাহিরে আসিয়া, বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়া, স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

হঠাৎ তাহার মনে হইল—সব মিথ্যা। এই ঘরদ্বার, স্বামী-সংসার, খাওয়া-পরা, শোওয়া-বসা কিছুই সত্য নয়—কোন কিছুর জন্যেই মানুষের তিলার্ধ হাত-পা বাড়াইবার পর্যন্ত আবশ্যকতা নাই। শুধু মনের ভুলেই মানুষে ছটফট করিয়া মরে, না হইলে পল্লীগ্রাম শহরই বা কি, খড়ের ঘর রাজপ্রাসাদই বা কি, আর স্বামী-স্ত্রী, বাপ-মা, ভাই-বোন সম্বন্ধই বা কোথায়! আর কিসের জন্যেই বা রাগারাগি, কান্নাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি করিয়া মরে! দুপুরবেলা অত বড় কাণ্ডের পরেও যে স্বামী স্ত্রীকে একলা ফেলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চিন্ত হইয়া বাহিরে কাটাইতে পারে, তাহার মনের কথা যাচাই করিবার জন্যেই বা এত মাথাব্যথা কেন? সমস্ত মিথ্যা! সমস্ত ফাঁকি! মরীচিকার মতই সমস্ত অসত্য! কিন্তু সংসার তাহার কাছে এতদূর খালি হইয়া যাইতে পারিত না, একবার যদি সে মৃণালের ঐ ভাষাটুকুর উপরে তাহার সমস্ত চিত্ত ঢালিয়া না দিয়া, সেই মৃণালকে একবার ভাবিবার চেষ্টা করিত। অন্য নারীর সহিত সেই পল্লীবাসিনী সদানন্দময়ীর আচরণ একবার মনে করিয়া দেখিলে তার নিজের মনটাকে ঐ ক’টা কথার কালিমাই এমন করিয়া কালো করিয়া দিতে বোধ করি পারিত না।

যদু ফিরিয়া আসিয়া কহিল, বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, চায়ের জল গরম হয়েছে কি?

অচলা ঠিক যেন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিল, কহিল, কোন্‌ বাবু?

যদু জোর দিয়া বলিল, আমাদের বাবু। এইমাত্র তিনি ফিরে এলেন যে। চায়ের জল ত অনেকক্ষণ গরম হয়ে গেছে মা।

চল যাচ্ছি, বলিয়া অচলা রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল। খানিক পরে চা এবং জলখাবার চাকরের হাতে দিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, মহিম অন্ধকার বারান্দায় পায়চারি করিতেছে এবং সুরেশ ঘরের মধ্যে লণ্ঠনের কাছে মুখ লইয়া একমনে খবরের কাগজ পড়িতেছে। যেন কেহই কাহারো উপস্থিতি আজ জানিতেও পারে নাই। এই যে অত্যন্ত লজ্জাকর সঙ্কোচ দুটি চিরদিনের বন্ধুর মাঝখানে আজ সহজ শিষ্টাচারের পথটা পর্যন্ত রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে, তাহার উপলক্ষটা মনে পড়িতেই অচলার পা-দুটি থামিয়া গেল।

অচলাকে দেখিয়া মহিম থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, সুরেশকে চা দিতে এত দেরি হ’ল যে?

অচলার মুখ দিয়া কিছুতেই কথা বাহির হইল না। সে মুহূর্তকাল মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া, নীরবে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল।

যদু চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বাহির হইয়া গেলে, সুরেশ কাগজখানা রাখিয়া দিয়া মুখ ফিরাইল; কহিল, মহিম কৈ, সে এখনো ফেরেনি নাকি?

সঙ্গে সঙ্গেই মহিম প্রবেশ করিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল, কিন্তু সে যে মিনিট-দশেক ধরিয়া তাহারই কানের কাছে বারান্দার উপরে হাঁটিয়া বেড়াইতেছিল, এই বাহুল্য কথাটা মুখ দিয়া উচ্চারণ করার প্রয়োজন বোধ করিল না।

তার পরেই সমস্ত চুপচাপ। অচলা নিঃশব্দে অধোমুখে দু বাটি চা প্রস্তুত করিয়া এক বাটি সুরেশকে দিয়া, অন্যটা স্বামীর দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া নীরবেই উঠিয়া যাইতেছিল, মহিমের আহ্বানে সে চমকিয়া দাঁড়াইল।

মহিম কহিল, একটু অপেক্ষা কর, বলিয়া নিজেই চট করিয়া উঠিয়া কবাটে খিল লাগাইয়া দিল। চক্ষের নিমেষে তাহার ছয়-নলা পিস্তলটার কথাই সুরেশের স্মরণ হইল; এবং হাতের পেয়ালা কাঁপিয়া উঠিয়া খানিকটা চা চলকাইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। সে মুখখানা মড়ার মত বিবর্ণ করিয়া বলিল, দোর বন্ধ করলে যে?

তাহার কণ্ঠস্বর, মুখের চেহারা ও প্রশ্নের ভঙ্গীতে অচলারও ঠিক সেই কথাই মনে পড়িয়া মাথার চুল পর্যন্ত কাঁটা দিয়া উঠিল। বোধ করি বা একবার যেন সে চিৎকার করিবারও প্রয়াস করিল, কিন্তু তাহার যে চেষ্টা সফল হইল না। মহিম ক্ষণকালমাত্র অচলার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া সমস্ত বুঝিল। তার পরে সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া বলিল, চাকরটা এসে পড়ে, এই জন্যেই—নইলে পিস্তলটা আমার চিরকাল যেমন বাক্সে বন্ধ থাকে, এখনো তেমনি আছে। তোমরা এত ভয় পাবে জানলে আমি দোর বন্ধ করতাম না।

সুরেশ চায়ের পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া হাসিবার মত মুখের ভাব করিয়া বলিল, বাঃ, ভয় পেতে যাবো কেন হে? তুমি আমার উপর গুলি চালাবে—বাঃ—প্রাণের ভয়! আমি? কবে আবার তুমি দেখলে? আচ্ছা যা হোক—

তাহার অসংলগ্ন কৈফিয়ত শেষ হইবার পূর্বেই মহিম কহিল, সত্যই কখনো ভয় পেতে তোমাকে দেখিনি। প্রাণের মায়া তোমার নেই বলেই আমি জানতাম। সুরেশ, আমার নিজের দুঃখের চেয়ে তোমার এই অধঃপতন আমার বুকে আজ বেশি করে বাজল। যাতে তোমার মত মানুষকেও এত ছোট করে আনতে পারে—না, সুরেশ কাল তুমি নিশ্চয় বাড়ি যাবে। কোন ছলে আর দেরি করা চলবে না।

সুরেশ তবুও কি একটা জবাব দিতে চাহিল; কিন্তু এবার তাহার গলা দিয়া স্বরও ফুটিল না, ঘাড়টাও সোজা করিতে পারিল না; সেটা যেন তাহার অজ্ঞাতসারেই ঝুঁকিয়া পড়িল।

তুমি ভেতরে যাও অচলা, বলিয়া মহিম খিল খুলিয়া পরক্ষণেই অন্ধকারের মধ্যে বাহির হইয়া গেল।

এইবার সুরেশ মাথা তুলিয়া জোর করিয়া হাসিয়া কহিল, শোন কথা। অমন কত গণ্ডা বন্দুক-পিস্তল রাতদিন নাড়াচাড়া করে বুড়ো হয়ে এলুম, এখন ওর একটা ভাঙ্গা ফুটো রিভলভারের ভয়ে মরে গেছি আর কি! হাসালে যা হোক, বলিয়া সুরেশ নিজেই টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। সে হাসিতে যোগ দিবার মত লোক ঘরের মধ্যে অচলা ছাড়া আর কেহ ছিল না। সে কিন্তু যেমন ঘাড় হেঁট করিয়া এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল, তেমনি ভাবেই আরও কিছুকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে পাশের দরজা দিয়া ভিতরে চলিয়া গেল।

ঘণ্টা-খানেক পরে মহিম নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, কেহ নাই। পাশের ঘরে গিয়া দেখিল, মাটিতে মাদুর পাতিয়া, হাতের উপর মাথা রাখিয়া অচলা শুইয়া আছে। স্বামীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সে উঠিয়া বসিল। পাশে একটা খালি তক্তপোশ ছিল, মহিম তাহার উপর উপবেশন করিয়া বলিল, কেমন, কাল তোমার বাপের বাড়ি যাওয়া ত ঠিক?

অচলা নীচের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, কোন জবাব দিল না।

মহিম অল্পক্ষণ অপেক্ষা করিয়া পুনশ্চ কহিল, যাকে ভালবাস না, তারই ঘর করতে হবে, এত বড় অন্যায় উপদ্রব আমি স্বামী হলেও তোমার ওপর করতে পারব না।

কিন্তু অচলা তেমনি পাষাণ-মূর্তির মত নিঃশব্দ স্থির হইয়া রহিল দেখিয়া মহিম বলিতে লাগিল, কিন্তু তোমার ওপর আমার অন্য নালিশ আছে। আমার স্বভাব ত জানো। শুধু বিয়ের পর থেকেই ত নয়, অনেক আগেই ত আমাকে জানতে যে, আমি সুখ-দুঃখ যাই হোক, নিজের প্রাপ্য ছাড়া একবিন্দু উপরি পাওনা কখনো প্রত্যাশা করিনে—পেলেও নিইনে। ভালবাসার ওপর ত জোর খাটে না অচলা। না পারলে হয়ত তা দুঃখের কথা, কিন্তু লজ্জার কথা ত নয়। কেন তবে এতদিন কষ্ট পাচ্ছিলে? কেন আমাকে না জানিয়ে ভেবে নিয়েছিলে, আমি জোর করে তোমাকে আটক রাখবো? কোনদিন কোন বিষয়েই ত আমি জোর খাটাই নি। তাঁরা তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলে, তবে তোমার প্রাণ বাঁচবে—আর আমাকে জানালে কি কোন উপায় হতো না? তোমার প্রাণের দামটা কি শুধু তাঁরাই বোঝেন?

অচলা অশ্রু-বিকৃত অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর যতদূর সাধ্য সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া চুপি চুপি বলিল, তুমিও ত ভালোবাসো না।

মহিম আশ্চর্য হইয়া কহিল, এ কথা কে বললে? আমি ত কখনো বলিনি।

অচলার উত্তপ্ত হইয়া উঠিতে বিলম্ব হইল না; কহিল, শুধু কথাই কি সব? শুধু মুখের বলাই সত্যি, আর সব মিথ্যে? রাগের মাথায় মনের কষ্টে যা কিছু মানুষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাকেই কেবল সত্যি ধরে নিয়েই তুমি জোর খাটাতে চাও? তোমার মতন নিক্তির ওজনে কথা বলতে না পারলেই কি তার মাথায় পা দিয়ে ডুবিয়ে দিতে হবে? বলিতে বলিতেই তাহার গলা ধরিয়া প্রায় রুদ্ধ হইয়া আসিল।

মহিম কিছুই বুঝিতে না পারিয়া কহিল, তার মানে?

অচলা উচ্ছ্বসিত রোদন চাপিয়া বলিল, মনে করো না—তোমার মত সাবধানী লোকেও মিথ্যেকে চিরকাল চাপা দিয়ে রাখতে পারে! তোমারও কত ভুল হতে পারে—দেখ গে চেয়ে, তোমারই টেবিলের ওপর। শুধু আমাদেরই—

মহিম প্রায় হতবুদ্ধি হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি আমার টেবিলের ওপর?

অচলা মুখে আঁচল গুঁজিয়া মাদুরের উপর উপুড় হইয়া পড়িল। তাহার কাছে আর কোন জবাব না পাইয়া মহিম আস্তে আস্তে তাহার টেবিল দেখিতে গেল। তাহার পড়ার ঘরের টেবিলের উপর খান-কতক বই পড়িয়াছিল; প্রায় দশ মিনিট ধরিয়া সেইগুলা উলটিয়া-পালটিয়া দেখিয়া, তাহার নীচে, আশেপাশে সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া স্ত্রীর অভিযোগের কিছুমাত্র তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া, বিমূঢ়ের ন্যায় ফিরিয়া আসিবার পথে শোবার ঘরটার প্রতি দৃষ্টি পড়ায়, ভিতরে একটা পা দিয়াই মৃণালের সেই চিঠিখানার উপর তাহার চোখ পড়িল। সেখানা হাতে তুলিয়া লইয়া পড়িবামাত্রই, অকস্মাৎ অন্ধকারে বিদ্যুৎহানার মতই আজ একমুহূর্তে মহিম পথ দেখিতে পাইল। অচলা যে কি ইঙ্গিত করিয়াছে, আর বুঝিতে বিলম্ব হইল না। সেটুকু হাতের মধ্যে লইয়া মহিম বিছানার উপর বসিয়া শূন্যদৃষ্টিতে বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। যেমন করিয়া সে প্রথম দিনটিতে আসিয়াছিল, যেভাবে সে চলিয়া গিয়াছিল, সতীন বলিয়া সে অচলাকে যত পরিহাস করিয়াছে—একটি একটি করিয়া তাহার সমস্ত মনে পড়িতে লাগিল।

পল্লীগ্রামের এইসকল রহস্যালাপের সহিত যে মেয়ে পরিচিত নয়, প্রতিদিন তাহার যে কিরূপ বিঁধিয়াছে, এবং যে নিজেও যখন কোনদিন এই পরিহাসে খোলা মনে যোগ দিতে পারে নাই, বরঞ্চ স্ত্রীর সম্মুখে লজ্জা পাইয়া বারংবার বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছে—তাহার সেই লজ্জা যদি এই উচ্চশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী রমণীর ধারণায় অপরাধীর সত্যকার লজ্জা বলিয়া ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হইয়া উঠিয়া থাকে ত আজ তাহার মূলোচ্ছেদ করিবে সে কি দিয়া? বাহিরের অন্ধকারের ভিতর হইতেই আজ অনেক সত্য তাহাকে দেখা দিতে লাগিল। কেমন করিয়া অচলার হৃদয় ধীরে ধীরে সরিয়া গিয়াছে, কেমন করিয়া স্বামীর সঙ্গ দিনের পর দিন বিষাক্ত হইয়াছে, কেমন করিয়া স্বামীর আশ্রয় প্রতিমুহূর্তে কারাগার হইয়া উঠিয়াছে—সমস্তই সে যেন স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। এই প্রাণান্তকর অবরোধের মধ্যে হইতে পরিত্রাণ পাইবার সেই যে আকুল প্রার্থনা সুরেশের কাছে তখন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল—সে যে তাহার অন্তরের কোন্‌ অন্তরতম দেশ হইতে উত্থিত হইয়াছিল, তাহাও আজ মহিমের মনশ্চক্ষের সম্মুখে প্রচ্ছন্ন রহিল না। অচলাকে সে যথার্থই সমস্ত হৃদয় দিয়া ভালবাসিয়াছিল। সেই অচলার এতদিন এত কাছে থাকিয়াও, তাহার এত বড় মনোবেদনার প্রতি চোখ বুজিয়া থাকাটাকে সে গভীর অপরাধ বলিয়া গণ্য করিল। কিন্তু এমন করিয়া আর ত একটা মুহূর্তও চলিবে না! স্ত্রীর হৃদয় ফিরিয়া পাইবার উপায় আছে কি না, তাহা কোথায় কত দূরে সরিয়া গিয়াছে, অনুমান করাও আজ দুঃসাধ্য। কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াও স্বামী বলিয়া যাহাকে সে একদিন আশ্রয় করিয়াছিল, তাহারই কাছে অপমান এবং লাঞ্ছনা পাইয়া যে আজ তাহাকে ফিরিতে হইতেছে, এত বড় ভুল ত তাহাকে জানানো চাই।

মহিম ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া অচলার দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখিল, কবাট রুদ্ধ এবং ঠেলিয়া দেখিল, তাহা ভিতর হইতে বন্ধ। আস্তে আস্তে বার-দুই ডাকিয়া যখন কোন সাড়া পাইল না, তখন শুধু যে জোর করিয়া শান্তিভঙ্গ করিবারই তাহার প্রবৃত্তি হইল না, তাহা নহে, একটা অতি কঠিন পরীক্ষার দায় হইতে আপাততঃ নিষ্কৃতি পাইয়া নিজেও যেন বাঁচিয়া গেল।

মহিম ফিরিয়া আসিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িল; কিন্তু যাহার অভাবে পার্শ্বের স্থানটা আজ শূন্য পড়িয়া রহিল, ও-ঘরে সে অনশনে মাটিতে পড়িয়া আছে মনে করিয়া কিছুতেই তাহার চক্ষে নিদ্রা আসিল না। উঠিয়া গিয়া ঘুম ভাঙ্গাইয়া তাহাকে তুলিয়া আনা উচিত কি না, ভাবিতে ভাবিতে দ্বিধা করিতে করিতে অনেক রাত্রে বোধ করি সে কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রামগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল, সহসা মুদ্রিত-চক্ষে তীব্র আলোক অনুভব করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল। শিয়রের খোলা জানালা দিয়া এবং চালের ফাঁক দিয়া অজস্র আলোক ও উৎকট ধূমে ঘর ভরিয়া গিয়াছে এবং অত্যন্ত সন্নিকটে এমন একটা শব্দ উঠিয়াছে যাহা কানে প্রবেশমাত্রই সর্বাঙ্গ অসাড় করিয়া দেয়। কোথায় যে আগুন লাগিয়াছে, তাহা নিশ্চয় বুঝিয়াও ক্ষণকালের জন্য সে হাত-পা নাড়িতে পারিল না। কিন্তু সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই তাহার মাথার ভিতর দিয়া যেন ব্রহ্মাণ্ড খেলিয়া গেল। লাফাইয়া উঠিয়া, দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, রান্নাঘর এবং যে ঘরে আজ অচলা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, তাহারই বারান্দার একটা কোণ বিদীর্ণ করিয়া প্রধূমিত অগ্নিশিখা উপরের সমস্ত জামগাছটাকে রাঙ্গা করিয়া ফেলিয়াছে।

পল্লীগ্রামে খড়ের ঘরে আগুন ধরিলে তাহা নিবাইবার কল্পনা করাও পাগলামি, সে চেষ্টাও কেহ করে না; পাড়ার লোক, যে যাহার জিনিসপত্র ও গরু-বাছুর সরাইতে ছুটাছুটি করে, এবং ভিন্ন পাড়ার লোক একদিকে মেয়েরা এবং একদিকে পুরুষেরা সমবেত হইয়া অত্যন্ত নিরুদ্বেগে হায় হায় করিয়া এবং কি পরিমাণের দ্রব্য-সম্ভার দগ্ধ হইতেছে এবং কি করিয়া এ সর্বনাশ ঘটিল, তাহারই আলোচনা করিয়া সমস্ত বাড়িটা ভস্মসাৎ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তার পরে ঘরে ফিরিয়া হাত-পা ধুইয়া বাকি রাত্রিটুকু বিছানায় গড়াইয়া লইয়া পুনরায় সকালবেলা একে একে গাড়ু-হাতে দেখা দেয়; এবং আলোচনার জেরটুকু সকালের মত শেষ করিয়া বাড়ি গিয়া স্নানাহার করে। কিন্তু একজনের গৃহপ্রাঙ্গণের বিরাট ভস্মস্তূপ আর একজনের জীবনযাত্রার লেশমাত্র ব্যাঘাত ঘটাইতে পারে না।

মহিম পল্লীগ্রামের লোক, সকল কথাই সে জানিত। তাই নিরর্থক চেঁচামেচি করিয়া অসময়ে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিল না। বিন্দুমাত্র প্রয়োজনও ছিল না, কারণ তাহার আম-কাঁঠালের এত বড় বাগানটা অতিক্রম করিয়া এই অগ্ন্যুৎপাত যে আর কাহারও গৃহ স্পর্শ করিবে, সে সম্ভাবনা ছিল না। বাহিরের সারের যে কয়টা ঘরে সুরেশ এবং চাকর-বাকরেরা নিদ্রিত ছিল, অগ্নিস্পৃষ্ট হইবার তখনও তাহাদের বিলম্ব ছিল। বিলম্ব ছিল না শুধু অচলার ঘরটার। সে তাহারই দ্বারে সজোরে করাঘাত করিয়া ডাকিল, অচলা!

অচলা ঠিক যেন জাগিয়াছিল, এমনিভাবে উত্তর দিল, কেন?

মহিম কহিল, দোর খুলে বেরিয়ে এস!

অচলা শ্রান্তকণ্ঠে জবাব দিল, কি হবে? আমি ত বেশ আছি!

মহিম কহিল, দেরি করো না, বেরিয়ে এসো—বাড়িতে আগুন লেগেছে।

প্রত্যুত্তরে অচলা একবার ভয়জড়িতকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল, তার পরে সমস্ত চুপচাপ! মহিমের পুনশ্চ ব্যগ্র আহ্বানে সে আর সাড়াও দিল না। ঠিক এই ভয়ই মহিমের ছিল; কারণ বাটীতে আগুন লাগা যে কি ব্যাপার, তাহার কোনপ্রকার ধারণাই অচলার ছিল না। মহিম ঠিক বুঝিল, ইতিপূর্বে সে চোখ বুজিয়াই কথা কহিতেছিল, কিন্তু চোখ মেলিয়া যে দৃশ্য তাহাকেও কিছুক্ষণের জন্য অবশ করিয়া ফেলিয়াছিল, সেই অপর্যাপ্ত আলোকে উদ্ভাসিত সমস্ত ঘরটা চোখে পড়িবামাত্র অচলারও সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার জন্য মহিম প্রস্তুত হইয়াই ছিল। সে একটা কবাট নাড়িয়া উঁচু করিয়া হাঁসকলটা খুলিয়া ফেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং মূর্ছিতা স্ত্রীকে বুকে তুলিয়া লইয়া অবিলম্বে প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইল।

এইবার সে বাটীর অন্য সকলকে সজাগ করিবার জন্য নাম ধরিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। সুরেশ পাংশুমুখে বাহির হইয়া আসিল, যদু প্রভৃতি অপর সকলেও দ্বার খুলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল, তাহার পরেই একটা প্রচণ্ড শব্দে অচলা সচেতন হইয়া দুই বাহু দিয়া স্বামীর কণ্ঠ প্রাণপণ-বলে জড়াইয়া ধরিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

মহিম সকলকে লইয়া যখন বাহিরের খোলা জায়গায় আসিয়া পড়িল, তখন বড় ঘরের চালে আগুন ধরিয়াছে। এইবার তাহার মনে পড়িল, অচলার অলঙ্কার প্রভৃতি দামী জিনিস যাহা কিছু আছে, সমস্তই এই ঘরে এবং আর মুহূর্ত বিলম্ব করিলে কিছুই বাঁচানো যাইবে না।

অচলা প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল; সে সজোরে স্বামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, না, সে হবে না। প্রতিশোধ নেবার এই কি সময় পেলে? কিছুতেই ওর মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। যাক, সব পুড়ে যাক।

না গেলে চলবে না, অচলা, বলিয়া জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া মহিম সেই জমাট ধূমরাশির মধ্যে দ্রুতবেগে গিয়া প্রবেশ করিল। যদু চেঁচাইতে চেঁচাইতে সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল।

সুরেশ এতক্ষণ পর্যন্ত অভিভূতের মত চাহিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া ছিল; অকস্মাৎ সংবিৎ পাইয়া, সে পিছু লইবার উপক্রম করিতেই অচলা তাহার কোঁচার খুঁট ধরিয়া ফেলিয়া কঠোরকণ্ঠে কহিল, আপনি যান কোথায়?

সুরেশ টানাটানি করিয়া বলিল, মহিম গেল যে—

অচলা তিক্তস্বরে বলিল, তিনি গেলেন তাঁর জিনিস বাঁচাতে। আপনি কে? আপনাকে যেতে আমি কোনমতেই দেব না।

তাহার কণ্ঠস্বরে স্নেহের লেশমাত্র সম্পর্ক ছিল না—এ যেন সে অনধিকারীর উৎপাতকে তিরস্কার করিয়া দমন করিল।

মিনিট দুই-তিন পরেই মহিম দুই হাতে দু’টা বাক্স লইয়া এবং যদু প্রকাণ্ড একটা তোরঙ্গ মাথায় করিয়া উপস্থিত হইল। মহিম অচলার পায়ের কাছে রাখিয়া কহিল, তোমার গহনার বাক্সটা যেন কিছুতে হাতছাড়া করো না, আমরা বাইরের ঘরে যদি কিছু বাঁচাতে পারি, চেষ্টা করি গে।

অচলার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মুঠোর মধ্যে তখনো সুরেশের কোঁচার খুঁট ধরা ছিল, তেমনি ধরা রহিল। মহিম পলকমাত্র সেদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া যদুকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় অদৃশ্য হইয়া গেল।