ষোড়শ পরিচ্ছেদ

একি, সুরেশ যে! এস এস, বাড়ির ভেতরে এস। ভাল ত?

মহিমের স্বাগত-সম্ভাষণ সমাপ্ত হইবার পূর্বে সুরেশ সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হাতের গ্লাডস্টোন ব্যাগটা নামাইয়া রাখিয়া কহিল, হ্যাঁ, ভাল। কিন্তু কি রকম, একা দাঁড়িয়ে যে? অচলা বধূঠাকুরানী একমুহূর্তে সচলা হয়ে অন্তর্ধান হলেন কিরূপে? তাঁর প্রবল বিশ্রম্ভালাপ মোড়ের ওপর থেকে যে আমাকে এ বাড়ির পাত্তা দিলে।

বস্তুতঃ অচলার শেষ কথাটা রাগের মাথায় একটু জোরে বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক দ্বারের বাহিরেই তাহা সুরেশের কানে গিয়াছিল।

সুরেশ কহিল, দেখলে মহিম, বিদুষী স্ত্রী-লাভের সুবিধে কত? ক’দিনই বা এসেছেন, কিন্তু এর মধ্যেই পাড়াগাঁয়ের প্রেমালাপের ধরনটা পর্যন্ত এমনি আয়ত্ত করে নিয়েছেন যে, খুঁত বের করে দেয়, পাড়াগেঁয়ে মেয়েরও তা সাধ্য নেই।

মহিম লজ্জায় আকর্ণ রাঙ্গা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুরেশ ঘরের দিকে চাহিয়া অচলাকে উদ্দেশ করিয়া পুনরায় কহিল, অত্যন্ত অসময়ে এসে রসভঙ্গ করে দিলুম বৌঠান, মাপ কর। মহিম, দাঁড়িয়ে রইলে যে! বসবার কিছু থাকে ত নিয়ে চল, একটু বসি। হাঁটতে হাঁটতে ত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে—ভাল জায়গায় বাড়ি করেছিলে ভাই—চল, চল, কলকাতায় চল।

চল, বলিয়া মহিম তাহাকে বাহিরের বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইল।

সুরেশ কহিল, বৌঠান কি আমার সামনে বের হবেন না নাকি? পর্দানশীন?

মহিম জবাব দিবার পূর্বেই পাশের দরজা ঠেলিয়া অচলা প্রবেশ করিল। তাহার মুখে কলহের চিহ্নমাত্র নাই, নমস্কার করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল, এ যে আশাতীত সৌভাগ্য! কিন্তু এমন অকস্মাৎ যে?

তাহার প্রফুল্ল হাসিমুখ সুখ-সৌভাগ্যের প্রসন্ন বিকাশ কল্পনা করিয়া সুরেশের বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় যেন জ্বলিয়া উঠিল। হাত তুলিয়া প্রতি-নমস্কার করিয়া বলিল, এখন দেখচি বটে, এমন অকস্মাৎ এসে পড়া উচিত হয়নি। কিন্তু কাণ্ডটা কি হচ্চিল? Their first difference না,—আসা পর্যন্ত এইভাবে মতভেদ চলচে? কোন্‌টা?

অচলা তেমনি হাসিমুখে কহিল, কোন্‌টা শুনলে আপনি বেশ খুশি হন বলুন? শেষেরটা ত? তা হলে আমার তাই বলা উচিত—অতিথিকে মনঃক্ষুণ্ণ করতে নেই।

সুরেশের মুখ গম্ভীর হইল; কহিল, কে বললে নেই? বাড়ির গৃহিণীর সেই ত হল আসল কাজ—সেই ত তার পাকা পরিচয়।

অচলা হাসিতে হাসিতে কহিল, গৃহই নেই, তার আবার গৃহিণী! এই দুঃখীদের কুঁড়ের মধ্যে কি করে যে আজ আপনার রাত্রি কাটবে, সেই হয়েছে আমার ভাবনা। কিন্তু ধন্য আপনাকে, জেনে শুনে এ দুঃখ সইতে এসেছেন।

স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আচ্ছা, নয়নবাবুকে ধরে চন্দ্রবাবুর বাড়িতে আজ রাতটার মত ওঁর শোবার ব্যবস্থা করা যায় না? তাঁদের পাকা বাড়ি—বসবার ঘরটাও আছে, ওঁর কষ্ট হতো না!

সৌজন্যের আবরণে উভয়ের শ্লেষের এই-সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মহিম মনে মনে অধীর হইয়া উঠিতেছিল; কিন্তু কি করিয়া থামাইবে, ভাবিয়া পাইতেছিল না, এমনি অবস্থায় সুরেশ নিজেই তাহার প্রতিকার করিল; সহসা হাতজোড় করিয়া বলিল, আমার ঘাট হয়েচে বৌঠান, বরং একটু চা-টা দাও, খেয়ে গায়ে জোর করে নিয়ে তার পরে নয়নবাবুকে বল, শ্রবণবাবুকে বল—চন্দ্রবাবুর পাকা ঘরে শোবার জন্যে সুপারিশ ধরতে রাজি আছি। কিন্তু যাই বল মহিম, এর ওপর এত টান সত্যি হলে, খুশি হবার কথা বটে।

মহিমের হইয়া অচলাই তাহার উত্তর দিল; সহাস্যে কহিল, খুশি হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের হাতে; কিন্তু এ আমার শ্বশুরের ভিটে, এর ওপর টান না জন্মে বড়লাটের রাজপ্রাসাদের ওপর টান পড়লে সেইটে ত হত মিথ্যে। যাক, আগে গায়ে জোর হোক, তার পর কথা হবে। আমি চায়ের জল চড়াতে বলে এসেচি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এনে হাজির করে দিচ্চি—ততক্ষণ মুখ বুজে একটু বিশ্রাম করুন; বলিয়া অচলা হাসিয়া প্রস্থান করিল।

সে চলিয়া যাইতেই সুরেশের বুকের জ্বালাটা যেন বাড়িয়া উঠিল। নিজেকে সে চিরদিনই দুর্বল এবং অস্থিরমতি বলিয়াই জানিত, এবং এজন্য তাহার লজ্জা বা ক্ষোভও ছিল না। ছেলেবেলায় বন্ধুবান্ধবেরা যখন মহিমের সঙ্গে তুলনা করিয়া তাহাকে খেয়ালী প্রভৃতি বলিয়া অনুযোগ করিত, তখন সে মনে মনে খুশি হইয়া বলিত, সে ঠিক যে, তাহার সঙ্কল্পের জোর নাই, সে প্রবৃত্তির বাধ্য; কিন্তু হৃদয় তাহার প্রশস্ত—সে কখনও হীন বা ছোট কাজ করে না। সে নিজের আয় বুঝিয়া ব্যয় করিতে জানে না, পাত্রাপাত্র হিসাব করিয়া দান করিতে পারে না—মন কাঁদিয়া উঠিলে গায়ের বস্ত্রখানা পর্যন্ত বিসর্জন দিয়া চলিয়া আসিতে তাহার বাধে না—তা সে যাহাকে এবং যে কারণেই হোক; কিন্তু এ কথা কাহারও বলিবার জো নেই যে, সুরেশ কাহাকেও দ্বেষ করিয়াছে, কিংবা স্বার্থের জন্য এমন কোন কাজ করিয়াছে, যাহা তাহার করা উচিত ছিল না। সুতরাং আজন্মকাল হৃদয়ের ব্যাপারে যাহার একান্ত দুর্বল বলিয়াই অখ্যাতি ছিল এবং নিজেও যাহা সে সত্য বলিয়াই বিশ্বাস করিত, সেই সুরেশ যখন অকস্মাৎ অচলার সম্পর্কে শেষ-মুহূর্তে আপনার এত বড় কঠোর সংযমের পরিচয় পাইল, তখন নিজের মধ্যে এই অজ্ঞাত শক্তির দেখা পাইয়া কেবল আত্মপ্রসাদই লাভ করিল না, তাহার সমস্ত হৃদয় গর্বে বিস্ফারিত হইয়া উঠিল।অচলার বিবাহের পরে দুটো দিন সে আপনাকে নিরন্তর এই কথাই বলিতে লাগিল—সে শক্তিহীন অক্ষম নয়—সে প্রবৃত্তির দাস নয়; বরঞ্চ আবশ্যক হইলে সমস্ত প্রবৃত্তিটাকেই সে বুকের ভিতর হইতে সমূলে উৎপাটন করিয়া ফেলিয়া দিতে পারে। বন্ধুত্ব যে কি, তাহার সুখের জন্য একজন যে কতখানি ত্যাগ করিতে পারে, এইবার বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী বুঝুন গিয়া।

কিন্তু কোন মিথ্যা দিয়াই দীর্ঘকাল একটা ফাঁক ভরাইয়া রাখা যায় না। আত্মসংযম তাহার সত্য বস্তু নয়, ইহা আত্মপ্রতারণা। সুতরাং একটা সম্পূর্ণ সপ্তাহ না কাটিতেই এই মিথ্যা সংযমের মোহ তাহার বিস্ফারিত হৃদয় হইতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হইয়া তাহাকে সঙ্কুচিত করিয়া আনিতে লাগিল, মন তাহার বারংবার বলিতে লাগিল, এই স্বার্থত্যাগের দ্বারা সে পাইল কি? ইহা তাহাকে কি দিল? কোন্‌ অবলম্বন লইয়া সে আপনাকে এখন খাড়া রাখিবে? পিসিমা বলিলেন, বাবা, এইবার তুই এমনি একটি বৌ ঘরে আন্‌, আমি নিয়ে সংসার করি।

একদিন সমাজের দোরগোড়ায় কেদারবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তিনি স্পষ্টই বলিলেন, কাজটা তাঁহার ভাল হয় নাই। মহিমের সহিত বিবাহ দিতে ত গোড়াগুড়িই তাঁহার ইচ্ছা ছিল না—শুধু সে নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল বলিয়াই তিনি অবশেষে মত দিলেন। ঘরে আসিয়া তাহার মনের মধ্যে অভিশাপের মত জাগিতে লাগিল, এই বিবাহ দ্বারা তাহাদের কেহই যেন সুখী না হয়। নিজের অবস্থাকে অতিক্রম করার অপরাধ বন্ধুও অনুভব করুন, অচলাও যেন নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হইয়া মরে। কিন্তু তাই বলিয়া মন তাহার ছোট নয়। এই অকল্যাণ কামনার জন্য নিজেকে সে অনেকরকম করিয়া শাসিত করিতে লাগিল। কিন্তু তাহার পীড়িত প্রতারিত হৃদয় কিছুতেই বশ মানিল না—নিতান্ত একগুঁয়ে ছেলের মত নিরন্তর ঐ কথাই আবৃত্তি করিতে লাগিল। এমনি করিয়া মাস-খানেক সে কোনমতে কাটাইয়া দিয়া একদিন কৌতূহল আর দমন করিতে না পারিয়া অবশেষে ব্যাগ হাতে মহিমের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

সুরেশ বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া কহিল, এখন দেখতে পাচ্চো মহিম, আমার কথাটা কতখানি সত্যি?

মহিম জিজ্ঞাসা করিল, কোন্‌ কথাটা?

সুরেশ বিজ্ঞের মত বলিল, আমার পল্লীগ্রামে বাস নয় বটে, কিন্তু এর সমস্তই আমি জানি। আমি তথাপি কি সাবধান করে দিইনি যে, গ্রামের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে একটা ঘোরতর বিরোধ বাধবে?

মহিম সহজভাবে কহিল, কৈ, তেমন বিরোধ ত কিছু হয়নি।

বিরোধ আর বল কাকে? তোমার বাড়িতে কেউ খেলে কি? সেইটেই কি যথেষ্ট অশান্তি অপমান নয়?

আমি খেতে কাউকে বলিনি।

বলনি? আচ্ছা, কৈ, বৌভাতে আমাকে ত নেমন্তন্ন করনি মহিম?

ওটা হয়নি বলেই করিনি।

সুরেশ বিস্মিত হইয়া বলিল, বৌভাত হয়নি? ওঃ—তোমাদের যে আবার—কিন্তু এমন করে ক’টা উপদ্রব এড়ানো যাবে মহিম? আপদ-বিপদ আছে, ছেলেমেয়ের কাজ-কর্ম আছে—সংসার করতে গেলে নেই কি? আমি বলি—

যদুর হাতে চায়ের সরঞ্জাম এবং নিজে থালায় করিয়া মিষ্টান্ন লইয়া অচলা প্রবেশ করিল। সুরেশের শেষ কথাটা তাহার কানে গিয়াছিল; কিন্তু তাহার মুখের ভাবে সুরেশ তাহা ধরিতে পারিল না। দুই বন্ধুর জলযোগ এবং চা-পান শেষ হইলে মহিম কাঁধের উপর চাদরটা ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। গ্রামের জমিদার মুসলমান, তাঁহার ছেলেটিকে মহিম ইংরাজি পড়াইত। জমিদারসাহেব নিজে লেখাপড়া না জানিলেও তাঁহার ঔদার্য ছিল, মহিমের সহিত সদ্ভাবও যথেষ্ট ছিল। এইজন্য গ্রামের লোক সমাজের দোহাই দিয়া আজও তাহার উপর উপদ্রব করিতে সাহস করে নাই।

অচলা কহিল, আজ পড়াতে না গেলেই কি হতো না?

মহিম কহিল, কেন?

অচলার মনের জোর ও অন্তরের নির্মলতা যত বড়ই হোক, সুরেশের সহিত তাহার সম্বন্ধটা যেরূপ দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাতে তাহার আকস্মিক অভ্যাগমে কোন রমণীই সঙ্কোচ অনুভব না করিয়া থাকিতে পারে না। সুরেশকে সে ভাল করিয়াই চিনিত, তাহার হৃদয় যত মহৎই হোক, সে হৃদয়ের ঝোঁকের উপর তাহার কোন আস্থা ছিল না—এমন কি, ভয়ই করিত। এই সন্ধ্যায় তাহারই সহিত তাহাকে একাকী ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাবে সে মনে মনে উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল; কিন্তু বাহিরে তাহার লেশমাত্র প্রকাশ না করিয়া হাসিয়া কহিল, বাঃ, সে কি হয়? অতিথিকে একলা ফেলে—

মহিম কহিল, তাতে অতিথি সৎকারের কোন ত্রুটি হবে না। তা ছাড়া তুমি ত রইলে—

অচলা ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, কিন্তু আমিও থাকতে পারব না। সুরেশের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমাদের উড়ে বামুনটি এমনি পাকা রাঁধুনী যে, তার সঙ্গে না থাকলে কিছুই মুখে দেবার জো থাকবে না। আমি বলি, তুমি বরঞ্চ—

মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তা হয় না। ঘণ্টা-দুই বৈ ত নয়। বলিয়া ঘরের কোণ হইতে সে লাঠিটা তুলিয়া লইল। একে ত মহিমের কাজের ধারা সহজে বিপর্যস্ত হয় না, তাহাতে এই একটা সামান্য কারণ লইয়া বারংবার নির্বন্ধ প্রকাশ করিতেও অচলার লজ্জা করিতে লাগিল, পাছে ভয়টা তাহার সুরেশের চোখে ধরা পড়িয়া লজ্জাটা শতগুণ হইয়া উঠে।

মহিম ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। তাহাকে শুনাইয়া সুরেশ অচলাকে হাসিয়া কহিল, কেন নিজের মুখ হেঁট করা! চিরকাল জানি, ও সে পাত্রই নয় যে, কারও কথা রাখবে।

তুমি বরং যা হোক একখানা বই আমাকে দিয়ে নিজের কাজে যাও—আমার দিব্যি সময় কেটে যাবে।

কথাটা হঠাৎ অচলাকে বাজিল যে, বাস্তবিকই মহিম কোনদিন কোন অনুরোধই তাহার রক্ষা করে না। হউক না ইহা তাহার সুমহৎ গুণ, কিন্তু তবুও সুরেশের মুখ হইতে স্বামীর এই আজন্ম কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় তাহারই সম্মুখে আজ তাহাকে অপমানকর উপেক্ষার আকারে বিঁধিল। কোন কথা না কহিয়া, সে নিজের ঘরে গিয়া, যদুকে দিয়া একখানা বাংলা বই পাঠাইয়া দিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

অনেক রাত্রে শয়ন করিতে গিয়া মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ কতদিন এখানে থাকবে তোমাকে বললে?

এমনি ত নানা কারণে আজ সারাদিনই স্বামীর উপর তাহার মন প্রসন্ন ছিল না; তাহাতে এই প্রশ্নের মধ্যে একটা কুৎসিত বিদ্রূপ নিহিত আছে কল্পনা করিয়া সে চক্ষের নিমেষে জ্বলিয়া উঠিল; কঠোর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তার মানে?

মহিম অবাক হইয়া গেল। সে সোজাভাবেই কথাটা জানিতে চাহিয়াছিল, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিছুই করে নাই। তাহাদের এতক্ষণের আলাপের মধ্যে এ প্রশ্নটা সে বন্ধুকে সঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই এবং সুরেশ নিজে হইতে তাহা বলে নাই। কিন্তু তাহার আশা ছিল, সুরেশ নিশ্চয়ই অচলাকে তাহা বলিয়াছে।

মহিমকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া অচলা নিজেই বলিল, এ কথার মানে এত সোজা যে, তোমাকে জিজ্ঞাসা করবারও দরকার নেই। তোমার বিশ্বাস যে, সুরেশবাবু কোন সঙ্কল্প নিয়েই এখনে এসেছেন, এবং তা সফল হতে কত দেরি হবে সে আমি জানি। এই ত?

মহিম আরও ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে বলিল, আমার ও-রকম কোন বিশ্বাস নেই। কিন্তু মৃণালের ব্যবহারে আজ তোমার মন ভাল নেই, তুমি কিছুই ধীরভাবে বুঝতে পারবে না। আজ শোও, কাল সে কথা হবে। বলিয়া নিজেই বিছানায় শুইয়া পাশ ফিরিয়া নিদ্রার উদ্যোগ করিল।

অচলাও শুইয়া পড়িল বটে, কিন্তু কিছুতেই ঘুমাইতে পারিল না। তাহার মনের মধ্যে সারাদিন যে বিরক্তি উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল, সামান্য একটা কলহের আকারে তাহা বাহির হইয়া যাইতে পারিলে হয়ত সে সুস্থ হইতে পারিত; কিন্তু এমন করিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়ায় সে নিজের মধ্যেই শুধু পুড়িতে লাগিল। অথচ যে প্রসঙ্গ বন্ধ হইয়া গেল, তাহাকে অশিক্ষিত সাধারণ স্ত্রীলোকের মত গায়ে পড়িয়া আন্দোলন করায় যে লজ্জা এবং ইতরতা আছে, তাহাও তাহার দ্বারা সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে শুধু কল্পনায় স্বামীকে প্রতিপক্ষ দাঁড় করাইয়া, জ্বালাময়ী প্রশ্নোত্তরমালায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত বিনিদ্র থাকিয়া শয্যায় ছটফট করিতে লাগিল।

একটু বেলায় ঘুম ভাঙ্গিয়া অচলা ধড়মড় করিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, যদু কেৎলি হাতে করিয়া রান্নাঘরে চলিয়াছে। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু কিছু বলে গেছেন যদু?

যদু কহিল, এক প্রহর বেলার মধ্যেই ফিরে আসবেন বলে গেছেন।

মহিম প্রত্যহ প্রত্যুষে উঠিয়া নিজের ক্ষেতখামার দেখিতে যাইত; ফিরিয়া আসিতে কোনদিন বা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া যাইত।

অচলা প্রশ্ন করিল, নতুনবাবু উঠেছেন?

যদু কহিল, উঠেছেন বৈ কি! তিনিই ত চা তৈরি করতে বলে দিলেন।

অচলা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, সুরেশ বহুক্ষণ পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া ঘরের সমস্ত জানালা খুলিয়া দিয়া, খোলা দরজার সুমুখে একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া কালকের সেই বইখানা পড়িতেছে। অচলার পদশব্দে সুরেশ বই হইতে মুখ তুলিয়া চাহিল। অচলার মুখের উপর রাত্রিজাগরণের সমস্ত চিহ্ন দেদীপ্যমান। চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে, গণ্ড পাংশু, ওষ্ঠ মলিন—সে যত দেখিতে লাগিল, ততই তাহার দুই চক্ষু ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হইতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই দৃষ্টি আর ফিরাইতে পারিল না।

তাহার চাহনির ভঙ্গীতে অচলা বিস্মিত হইল, কিন্তু অর্থ বুঝিতে পারিল না; কহিল, কখন উঠলেন? আমার উঠতে আজ দেরি হয়ে গেল।

তাই ত দেখছি, বলিয়া সুরেশ ধীরে ধীরে মাথা নাড়িল। সুমুখের দেওয়ালের গায়ে বহুদিনের পুরাতন একটা বড় আরশি টাঙ্গান ছিল; ঠিক সেই সময়েই অচলার দৃষ্টি তাহার উপরে পড়ায়, সুরেশের চাহনির অর্থ একমুহূর্তেই তাহার কাছে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল এবং নিজের শ্রীহীনতার লজ্জায় যেন সে একেবারে মরিয়া গেল। এই মুখখানা কেমন করিয়া লুকাইবে, কোথায় লুকাইবে, সুরেশের মিথ্যা ধারণার কি করিয়া প্রতিবাদ করিবে—কিছুই ভাবিয়া না পাইয়া সে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল—বলিতে বলিতে গেল, যাই, আপনার চা নিয়ে আসি গে।

সুরেশ কোন কথা বলিল না, শুধু একটা প্রচণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে শূন্যের পানে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

মিনিট-দশেক পরে চায়ের সরঞ্জাম সঙ্গে লইয়া অচলা পুনরায় যখন প্রবেশ করিল, তখন সুরেশ আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়াছিল। চা খাইতে খাইতে সুরেশ কহিল, কৈ, তুমি চা খেলে না?

অচলা হাসিয়া কহিল, আমি আর খাইনে।

কেন খাও না?

আর ভাল লাগে না। তা ছাড়া, এ জায়গাটা গরম না কি, খেলে ঘুম হয় না। কাল ত প্রায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। হাসিয়া বলিল, একটা রাত ঘুম না হলে চোখমুখের কি যে শ্রী হয়—পোড়া-মুখ যে আর লোকের সামনে বার করা যায় না। বলিয়া লজ্জিত মুখে হাসিতে লাগিল।

সুরেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু এ তোমার ছেলেবেলার অভ্যাস, চা খেতে মহিম অনুরোধ করে না?

অচলা হাসিয়া বলিল, অনুরোধ করলেই বা শুনবে কে? তা ছাড়া এ আর এমন কি জিনিস যে না খেলেই নয়?

এ হাসি যে শুষ্ক হাসি সুরেশ তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইল। আবার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, তুমি ত জানই, ভুমিকা করে কথা বলা আমার অভ্যাসও নয়, পারিও নে। কিন্তু স্পষ্ট করে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে কি তুমি রাগ করবে?

অচলা হাসিমুখে কহিল, শোন কথা! রাগ করব কেন?

সুরেশ কহিল, বেশ। তা হলে জিজ্ঞাসা করি, তুমি এখানে সুখে আছ কি?

অচলার হাসিমুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; বলিল, এ প্রশ্ন আপনার করাই উচিত নয়।

কেন নয়?

অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, না। আমি সুখে নেই—এ কথা আপনার মনে হওয়াই অন্যায়।

সুরেশ একটুখানি ম্লানহাসি হাসিয়া বলিল, মনটা কি ন্যায়-অন্যায় ভেবে নিয়ে তবে মনে করে অচলা? কেবল মাস-দুই পূর্বে এ ভাবনা শুধু যে আমার উচিত ছিল তাই নয়, এ ভাবনায় অধিকার ছিল। আজ দু’মাস পরে সব অধিকার যদি ঘুচে থাকে ত থাক, সে নালিশ করিনে, এখন শুধু সত্যি কথাটা জেনে যেতে চাই। এসে পর্যন্ত একবার মনে হচ্ছে জিতেছ, একবার মনে হচ্ছে হেরেছ। আমার মনটা ত তোমার অজানা নেই—একবার সত্যি করে বল ত অচলা, কি?

দুর্নিবার অশ্রুর ঢেউ অচলার কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনাইয়া উঠিল; কিন্তু প্রাণপণে তাহাদের শক্তি প্রতিহত করিয়া অচলা বেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি বেশ আছি।

সুরেশ ধীরে ধীরে কহিল, ভালই।

ইহার পরে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেহই যেন কোন কথা খুঁজিয়া পাইল না। সুরেশ অকস্মাৎ যেন চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, আর একটা কথা। তোমার জন্যে যে আমি কত সয়েচি, সে কি তোমার কখনো—

অচলা দুই কানে অঙ্গুলি দিয়া বলিয়া উঠিল, এ-সমস্ত আলোচনা আপনি মাপ করবেন।

সুরেশ খোলা দরজায় দুই হাত প্রসারিত করিয়া অচলার পলায়নের পথ রুদ্ধ করিয়া বলিল, না, মাপ আমি করতেই পারিনে, তোমাকে শুনতেই হবে।

তাহার চোখে সেই দৃষ্টি—যাহা মনে পড়িলে আজও অচলা শিহরিয়া ওঠে। একটুখানি পিছাইয়া গিয়া সভয়ে কহিল, আচ্ছা বলুন—

সুরেশ কহিল, ভয় নেই, তোমার গায়ে আমি হাত দেব না—আমার এখনো সে জ্ঞান আছে। বলিয়া পুনরায় চৌকির উপরে বসিয়া পড়িয়া কহিল, এই কথাটা তোমাকে মনে রাখতেই হবে যে, আমি তোমার ওপর সমস্ত অধিকার হারালেও, আমার ওপর তোমার সমস্ত অধিকার বর্তমান আছে।

অচলা বাধা দিয়া কহিল, এ মনে রাখায় আমার কোন লাভ নেই, কিন্তু—, বলিতে বলিতে দেখিতে পাইল, কথাটা যেন সজোরে আঘাত করিয়া সুরেশকে পলকের জন্য বিবর্ণ করিয়া ফেলিল এবং সেই মুহূর্তে নিজেও স্পষ্ট অনুভব করিল অনুতাপের কথা তাহার নিজের পিঠের উপর সজোরে আসিয়া পড়িল।

ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া এবার সে কোমলকণ্ঠে বলিল, সুরেশবাবু, এ-সব কথা আমারও শোনা পাপ, আপনারও বলা উচিত নয়। কেন আপনি এ-সব কথা তুলে আমাকে দুঃখ দিচ্চেন?

সুরেশ তাহার মুখের উপর দৃষ্টি রাখিয়া বলিল, দুঃখ কি পাও অচলা?

অচলার মুখ দিয়া অকস্মাৎ বাহির হইয়া গেল, আমি কি পাষাণ সুরেশবাবু?

সুরেশ তাহার সেই দৃষ্টি অচলার মুখের উপর হইতে নামাইল না বটে, কিন্তু অচলার দুই চক্ষু নত হইয়া পড়িল। সুরেশ ধীরে ধীরে বলিল, ব্যস্‌, এই আমার চিরজীবনের সম্বল রইল অচলা, এর বেশি আর চাইনে। বলিয়া এক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া কহিল, তুমি যখন পাষাণ নও, তখন এই শেষ ভিক্ষে থেকে আর আমাকে কিছুতে বঞ্চিত করতে পারবে না। তোমার সুখের ভার যার ওপর ইচ্ছে থাকুক, কিন্তু তোমার হাত থেকে দুঃখই যখন শুধু পেয়ে এসেছি, তখন তোমারও দুঃখের বোঝা আজ থেকে আমার থাক—এই বর আজ মাগি—আমাকে তুমি ভিক্ষা দাও। বলিতে বলিতেই অশ্রুভারে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। অচলার চোখ দিয়াও তাহার বিগত দিবারাত্রির সমস্ত পুঞ্জীভূত বেদনা তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এইবার গলিয়া ঝরঝর করিয়া পড়িতে লাগিল।

এমনি সময়ে ঠিক দ্বারের বাহিরেই জুতার শব্দ শোনা গেল এবং পরক্ষণেই মহিম ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে কহিল, কি হে সুরেশ, চা-টা খেলে?

সুরেশ সহসা জবাব দিতে পারিল না। সে কোনমতে মুখ নিচু করিয়া কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া ফেলিল, এবং অচলা আঁচলে মুখ ঢাকিয়া দ্রুতবেগে মহিমের পাশ দিয়া বাহির হইয়া গেল। মহিম চৌকাঠের ভিতর এক পা এবং বাহিরে এক পা দিয়া হতবুদ্ধির মত দাঁড়াইয়া রহিল।