» » চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

প্রায় অপরাহ্নবেলায় ভোজন সমাধা করিয়া রামবাবু তৃপ্তি ও প্রাচুর্যের একটা সশব্দ উদ্গার ছাড়িয়া যখন গাত্রোত্থান করিতে গেলেন, তখন অচলা অনেক কষ্টে একটুখানি হাসিয়া বলিল, কিন্তু জ্যাঠামশাই, যেদিন জানতে পারবেন, আজ আপনার জাত গেছে, সেদিন কিন্তু রাগ করতে পারবেন না, তা বলে দিচ্চি।

বৃদ্ধ সস্নেহে মৃদুহাস্যে ঘাড়টা একটু নাড়িয়া কহিলেন, আচ্ছা মা, তাই হবে, বলিয়া আচমন করিয়া বহির্বাটীতে চলিয়া গেলেন। তাঁহার খড়মের খট্‌খট্‌ শব্দ যতক্ষণ পর্যন্ত শোনা গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত অচলা সমস্ত দৃষ্টি দিয়া যেন ওই আওয়াজটাকেই অনুসরণ করিতে লাগিল, তার পর কখন যে সে শব্দ মিলাইল, কখন যে বাহিরের সংসার তাহার চেতনা হইতে বিলুপ্ত হইয়া তাহাকে পাথর করিয়া দিল, সে টেরও পাইল না।

অনেকদিনের হিন্দুস্থানী দাসীটি বাংলা কথার সঙ্গে বাঙালীর আচার-ব্যবহার কায়দা-কানুনও কতকটা আয়ত্ত করিয়াছিল, সে কি একটা কাজে এদিকে আসিয়া বহু-মার বসিয়া থাকার ভঙ্গী দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল এবং বয়োজ্যেষ্ঠার অধিকারে তাহার শেখা-বাংলা তর্জন-শব্দে বেলার দিকে অচলার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া প্রশ্ন করিল, আজ খাওয়া-দাওয়ার কোন প্রয়োজন আছে, না এমনভাবে চুপচাপ বসিয়া থাকিলেই চলিবে?

অচলা চমকিয়া চোখ মেলিয়া দেখিল, বেলা আর নাই, শীতের সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। একটা দীপ্তিহীন নিষ্প্রভতা শ্রান্তির মত আকাশের সর্বাঙ্গে ভরিয়া আসিয়াছে, লজ্জা পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং হাসিয়া কহিল, আমি যে একেবারে সন্ধ্যার পরেই খাব বলে ঠিক করেছি লালুর মা। আজ ক্ষিদে-তেষ্টা এতটুকু নেই।

লালুর মা বিস্মিত হইয়া কহিল, বড়বাবুর খাওয়া হয়ে গেলেই তুমি খাবে, একটু আগেই যে বললে বহু-মা?

নাঃ—একেবারে রাত্রিতেই খাবো, বলিয়া আর বেশি বাদানুবাদের অবসর না দিয়াই অচলা ত্বরিতপদে উপরে চলিয়া গেল।

একটু সময় পাইলেই সে উপরের বারান্দায় রেলিং-এর পার্শ্বে চৌকি টানিয়া লইয়া নদীর দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিত। আজিকার রাত্রেও সেইরূপ বসিয়াছিল, হঠাৎ রামবাবুর চটিজুতার শব্দ পাইয়া অচলা ফিরিয়া দেখিল, বৃদ্ধ একেবারে মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন এবং কিছু বলিবার পূর্বেই তিনি হাতের হুঁকাটা এককোণে ঠেস দিয়া রাখিয়া আর একখানা চেয়ার কাছে টানিয়া লইয়া বসিলেন। ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, সেই কথাটার একটা মীমাংসা করতে এলাম সুরমা, তোমার ব্রহ্মজ্ঞানী বাবাটি ঠিক, না এই বুড়ো জ্যাঠামশায়ের কথাটি ঠিক, তর্কটার যা হোক একটা নিষ্পত্তি না করে আজ আর নীচে যাচ্চিনে।

অচলা বুঝিল, এ সেই জাতিভেদের প্রশ্ন, শ্রান্তস্বরে বলিল, আমি তর্কের কি জানি জ্যাঠামশাই!

রামবাবু মাথা নাড়িয়া কহিলেন, ওরে বাস্‌ রে, তুমি কি সোজা লোকের বেটি নাকি মা! তবে কথাটা নাকি একেবারে মিথ্যে, তাই যা রক্ষা, নইলে ও-বেলায় ত হেরে গিয়েছিলাম আর কি!

অচলার কোন বিষয় লইয়াই আলোচনা করিবার মত মনের অবস্থা নয়; সেই এই তর্কযুদ্ধ হইতে আত্মরক্ষার একটুখানি ফাঁক দেখিতে পাইয়া কহিল, তা হলে আর তর্ক কি জ্যাঠামশাই! আপনারই ত জিত হয়েছে! একটুকু থামিয়া বলিল, যে হেরে গেছে, তাকে আবার দু’বার করে হারিয়ে লাভ কি আপনার?

রামবাবু তৎক্ষণাৎ কোন প্রত্যুত্তর দিলেন না। তাঁহার বয়স অনেক হইয়াছে, সংসারে তিনি অনেক জিনিস দেখিয়াছেন; সুতরাং, এই অবসন্ন কণ্ঠস্বরও যেমন তাঁহার অগোচর রহিল না, এই মেয়েটি যে সুখে নাই, ইহার মনের মধ্যে কি যে একটা ভয়ানক বেদনা পাঁজার আগুনের মত অহর্নিশি জ্বলিতেছে, ইহাও তেমনি এই শ্রান্ত-পাণ্ডুর মুখের উপরে আর একবার স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া হঠাৎ একটা হাসিবার চেষ্টা করিয়া অত্যন্ত স্নেহের সহিত বলিলেন, নাঃ—ছুতো খাটল না মা! বুড়ো মানুষ, বকতে ভালবাসি—সন্ধ্যাবেলা একলাটি প্রাণটা হাঁপিয়ে ওঠে; তাই ভাবলুম, মিথ্যে-টিথ্যে বলে মাকে একটু রাগিয়ে দিয়ে দুটো গল্প করি গে, কিন্তু ছল ধরা পড়ে গেল। বলিয়া তিনি ঝুঁকিয়া পড়িয়া হুঁকাটার জন্য একবার হাতটা বাড়াইয়া দিলেন।

তিনি যে যাইবার জন্য এটি সংগ্রহ করিতেছেন, অচলা তাহা বুঝিল এবং নীচে গিয়া একাকী এই বৃদ্ধের যে অনেক দুঃখেই সময় কাটিবে, তাহা উপলব্ধি করিয়া তাহার চিত্ত ব্যথিত হইয়া উঠিল। তাই সে চকিতের ন্যায় চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া নিজেই তাহা তুলিয়া লইয়া বৃদ্ধের প্রসারিত হস্তে দিতে দিতে বলিল, আপনি যত খুশি তামাক খেতে চান, এইখানে বসে খান, কিন্তু এখন উঠে যেতে আপনাকে আমি কিছুতে দেব না।

বৃদ্ধ হুঁকা হাতে লইয়া হাসিয়া বলিলেন, ওরে বাপ্‌ রে, একদম অতখানি রাশ ঢিল দিও না মা, আখের সামলাতে পারবে না। আমার মুখ-বুজে তামাক খাওয়া যে কি ব্যাপার, তা ত দেখনি! তার চেয়ে বরঞ্চ একটু-আধটু বলতে দাও যে—

মানুষের দম আটকে না যেতে পায়, না জ্যাঠামশাই? আচ্ছা, তাই ভাল। কিন্তু কি নিয়ে বকুনি শুরু করবেন বলুন ত?

রামবাবু মুখ হইতে একগাল ধূঁয়া-উপরের দিকে মুক্ত করিয়া দিয়া কহিলেন, তবেই মুশকিলে ফেললে মা। মহা-বক্তার লোককেও এ প্রশ্ন করলে তার মুখ বন্ধ হয়ে আসে যে!

আচ্ছা জ্যাঠামশায়, কোনদিন যদি জানতে পারেন, জোর করে যার হাতে আজ ভাত খেয়েচেন, তার চেয়ে নীচ, তার চেয়ে ঘৃণিত পৃথিবীতে আর কেউ নেই, তখন কি করবেন? প্রায়শ্চিত্ত? আর শাস্ত্রে যদি তার বিধি পর্যন্ত না থাকে, তা হলে?

বৃদ্ধ বলিলেন, তা হলে ত ল্যাঠা চুকেই গেল মা, প্রায়শ্চিত্ত আর করতে হবে না।

কিন্তু আমার উপর তখন কি-রকম ঘৃণাই না আপনার হবে!

কখন মা?

যখন টের পাবেন, আমার একটা জাত পর্যন্ত নেই।

রামবাবু হুঁকাটা মুখ হইতে সরাইয়া লইয়া সেই অস্পষ্ট আলোকেই ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, তোমাদের এই কথাটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনে মা। আর ‘তোমাদের’ বলি কেন, জানো সুরমা, আমার নিজের ছেলের মুখ থেকেও এ নালিশ শুনেচি। সে ত স্পষ্টই বলে, এই খাওয়া-ছোঁয়ার বাচ-বিচার থেকেই সমস্ত দেশটা ক্রমাগত সর্বনাশের দিকে তলিয়ে যাচ্চে। কারণ, এর মূলে আছে ঘৃণা, এবং ঘৃণার ভিতর দিয়ে কোন বড় ফল পাওয়া যায় না।

অচলা মনে মনে অতিশয় বিস্মিত হইল। এ বাড়িতেও যে এ-সকল আলোচনা কোন্‌ অবকাশ দিয়া পথ পাইতে পারে, এ তাহার ধারণাই ছিল না। কহিল, কথাটা কি তবে মিথ্যে?

রামবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, মিথ্যে কি না, সে জবাব নাই দিলাম মা। কিন্তু সত্যি নয়। শাস্ত্রের বিধিনিয়ম মেনে চলি, এইমাত্র। যারা আরও একটু বেশি যায়—এই যেমন আমার গুরুদেব, তিনি নিজে রেঁধে খান, মেয়েকে পর্যন্ত হাত দিতে দেন না। তাই থেকে কি এই স্থির করা যায়, তিনি তাঁর একমাত্র সন্তানকে ঘৃণা করেন!

অচলা জবাব দিতে না পারিয়া মৌন হইয়া রহিল।

বৃদ্ধ হুঁকাটায় আর গোটা-কতক টান দিয়া বলিলেন, মা, যৌবনে আমি অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েচি। কত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, আর কতরকমের লোক, কতরকমের আচার-ব্যবহার, সে-সব নাম হয়ত তোমরা জান না—কোথাও খাওয়া-ছোঁয়ার বিচার আছে, কোথাও বা তার আভাস পর্যন্ত শোনেনি, তবু ত মা, তারা চিরদিন তেমনি অসভ্য, তেমনি ছোট। বলিয়া দগ্ধ হুঁকাটায় পুনরায় গোটা-দুই নিষ্ফল টান দিয়া বৃদ্ধ শেষবারের মত সেটাকে থামের কোণে ঠেস দিয়া রাখিলেন। অচলা যেমন নিঃশব্দে বসিয়াছিল, তেমনি নীরবেই বসিয়া রহিল।

রামবাবু নিজেও খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া সোজা হইয়া বসিয়া বলিলেন, আসল কথা জান সুরমা, তোমরা সাহেবদের কাছে পাঠ নিয়েছ। তারা উন্নত, তারা রাজা, তারা ধনী। তাদের মধ্যে যদি পা উঁচু করে হাতে চলার ব্যবস্থা থাকত, তোমরা বলতে, ঠিক অমনি করে চলতে না শিখলে আর উন্নতির কোন আশা-ভরসাই নেই।

এই সকল তর্ক-যুক্তি অচলা বাংলা দৈনিক কাগজে অনেক পড়িয়াছে, তাই কোন কথা না বলিয়া শুধু একটু হাসিল। হাসিটুকু বৃদ্ধ দেখিলেন, কিন্তু যেন দেখিতে পান নাই, এই ভাবে নিজের পুনরাবৃত্তিস্বরূপ কহিতে লাগিলেন, শ্রীধাম শ্রীক্ষেত্রে যখন যাই, তখন জানা-অজানা কত লোকের মধ্যে গিয়েই না পড়ি। ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার সেখানে নেই, করবার কথাও কখনো মনে হয় না; কিন্তু ঘৃণার মধ্যে এর জন্ম হলে কি এত সহজে সে কাজ পেরে উঠতাম! এই ত আমি কারও হাতেই প্রায় খাইনি, কিন্তু পথের অতিবড় দীন-দুঃখীকেও যে কখনো মনে মনে ঘৃণা করেচি—

অচলা ব্যগ্র-ব্যাকুলকণ্ঠে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, আমি কি আপনাকে জানিনে জ্যাঠামশাই? এত দয়া সংসারে আর কার আছে?

দয়া নয় মা, দয়া নয়,—ভালবাসা। তাদেরই আমি যেন বেশী ভালবাসি। কিন্তু আসল কথা কি জানো মা, একটা জাতই বা কি, আর একটা মানুষই বা কি, ধীরে ধীরে যখন সে হীন হয়ে যাবে, তখন সবচেয়ে তুচ্ছ জিনিসটার ঘাড়েই সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে সে সান্ত্বনা লাভ করে। মনে করে, এই সহজ বাধাটুকু সামলে নিয়েই সে রাতারাতি বড় হয়ে উঠবে। আমাদেরও ঠিক সেই ভাব। কিন্তু যেটা কঠিন, সেটা মূল শিকড়—

কথাটা শেষ করিবার আর সময় পাইলেন না। সিঁড়িতে জুতার শব্দ শুনিয়া মুখ ফিরাতেই সুরেশকে দেখিতে পাইয়া একেবারেই প্রশ্ন করিয়া বসিলেন, আচ্ছা সুরেশবাবু, আপনি ত হিন্দু, আপনি ত আমাদের জাতিভেদ মানেন?

সুরেশ থতমত খাইয়া গেল—এ আবার কি প্রশ্ন? যে চোরাবালির উপর দিয়া তাহারা পথ চলিয়াছে, তাহাকে প্রতি হাত যাচাই না করিয়া হঠাৎ পা বাড়াইলে যে কোন্‌ অতলের মধ্যে তলাইয়া যাইবে, তাহার ত স্থিরতাই নাই। এখানে সত্যটাই সত্য কি না সাবধানে হিসাব করিতে হয়। তাই সে ভয়ে ভয়ে কাছে আসিয়া একবার অচলার মুখের প্রতি চাহিয়া তাৎপর্য বুঝিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু মুখ দেখিতে পাইল না। তখন শুষ্ক একটু হাসিয়া দ্বিধাজড়িতস্বরে কহিল, আমরা কি, সে ত আপনি বেশ জানেন রামবাবু।

রামবাবু কহিলেন, বেশ জানি বলেই ত জানতাম। কিন্তু আপনার গৃহিণীটি যে একেবারে আগাগোড়া ওলট-পালট করে দিতে চাচ্ছেন। বলছেন, জাতি-ভেদের মত এত বড় অন্যায়, এত বড় সর্বনাশকে তিনি কিছুতেই স্বীকার করতে পারেন না, ম্লেচ্ছর অন্ন আহার করতেও তাঁর আপত্তি নেই এবং এ শিক্ষা জন্মকাল থেকে তাঁর ব্রাহ্ম বাবার কাছেই পেয়েছেন। ওঁর হাতে খেয়ে আজ আমার জাত গেছে কি না এবং একটা প্রায়শ্চিত্ত করা প্রয়োজন কি না, এতক্ষণ সেই কথাই হচ্ছিল। আপনি কি বলেন?

সুরেশ নির্বাক্‌। অচলার মেজাজ তাহার অবিদিতও নয় এবং সেখানে বিদ্রোহের অগ্নি যে অহরহ জ্বলিয়াই আছে, এ খবরও তাহার নূতন নয়। কিন্তু সেই আগুন আজ অকস্মাৎ যে কিজন্য এবং কোথা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হইয়াছে, ইহাই অনুমান করিতে না পারিয়া সে আশঙ্কায় ও উদ্বেগে শুষ্ক হইয়া উঠিল; কিন্তু ক্ষণেক পরেই আত্মসংবরণ করিয়া পূর্বের মত আবার একটু হাসিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু এবার চেষ্টাটা শুধু হাসিকে আচ্ছন্ন করিয়া মুখখানাকে বিকৃত করিল মাত্র।

সুরেশ বলিল, উনি আপনাকে তামাশা করচেন।

রামবাবু গম্ভীর হইয়া মাথা নাড়িলেন, বলিলেন, উচিত না হলেও এ কথা ভাবতে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু স্বামীর কল্যাণেও যখন হিন্দুঘরের মেয়ে তাঁর কর্তব্য পালন করতে চাইলেন না—তুলসী দেওয়ার দিনটাতেও কিছুতে উপবাস করলেন না—ভাল, এ যদি তামাশা হয় ত কিছু কঠিন তামাশা বটে। আচ্ছা সুরেশবাবু, বিবাহ ত আপনার হিন্দু মতেই হয়েছিল?

সুরেশ কহিল, হ্যাঁ।

বৃদ্ধ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, কহিলেন, তা আমি জানি। অচলার প্রতি চাহিয়া বলিলেন, যদিচ তোমাকে আমার অনেক কথা বলবার আছে মা, কিন্তু তোমার বাবার ব্রাহ্ম হওয়ায় আর কোন দুঃখ নাই। এমন ব্রাহ্ম আমি অনেক জানি, যাঁরা সমাজে গিয়েও চোখ বোজেন, অল্প-স্বল্প অনাচারও করেন; কিন্তু মেয়ের বিয়ের বেলা আর হিসাবের গোল করেন না। যাক, আমার একটা ভাবনা দূর হল।

কিন্তু তাঁহার অপেক্ষাও অনেক বেশি ভাবনা দূর হইয়া গেল সুরেশের। সে তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধের সুরে সুর মিলাইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি ঠিক বলেছেন রামবাবু, আজকাল এই দলের লোকই বেশি। তাঁরা—

হঠাৎ উভয়েই চমকিয়া উঠিল। কথার মাঝখানেই অচলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ঠিক যেন গর্জন করিয়া উঠিল। সে সুরেশের মুখের উপর দুই চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিল, এত অপরাধের পরেও তোমার অপরাধ বাড়াতে লজ্জা হয় না? আবার তা আমারই মুখের উপরে? তুমি জানো, এ-সব মিথ্যে? তুমি জানো, বাবা ঠক নন, তিনি মনে-জ্ঞানে যথার্থই ব্রাহ্ম-সমাজের। তুমি জানো, তিনি—, বলিতে বলিতেই সে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

সুরেশ প্রথমটা থতমত খাইল, কিন্তু ঘাড় ফিরাইয়া বৃদ্ধের বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের প্রতি চাহিয়া অকস্মাৎ সেও যেন জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, মিছে কথা কিসের? তোমার বাবা কি হিন্দুঘরে তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না? তুমিও সত্যি কথা বলো!

অচলা আর প্রত্যুত্তর দিল না। বোধ হয় মুহূর্তকাল নিঃশব্দে থাকিয়া আপনাকে সামলাইয়া লইল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল, সে কথা আজ আমাকে জিজ্ঞাসা করচ কেন? তার হেতু কি সংসারে সকলের চেয়ে বেশী তুমি নিজেই জানো না? তুমি ঠিক জানো আমি কি, আমার বাবা কি, কিন্তু এই নিয়ে তোমার সঙ্গে বচসা করতে আমার শুধু যে প্রবৃত্তি হয় না তাই নয়, আমার লজ্জা করে। তোমার যা ইচ্ছে হয়, ওঁকে বানিয়ে বল, কিন্তু আমি শুনতে চাইনে। বল—আমি চললুম। বলিয়া সে একরকম দ্রুতপদেই পাশের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।

সে চলিয়া গেল, কিন্তু কিছুক্ষণের নিমিত্ত উভয়েই যেন নিশ্চল পাথরের মত হইয়া গেল।

বৃদ্ধ বোধ করি নিতান্তই মনের ভুলে একবার তাঁর হুঁকাটার জন্য হাত বাড়াইলেন, কিন্তু তখনই হাতটা টানিয়া লইয়া একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়া, একবার কাসিয়া গলাটা পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, আজকাল শরীরটা কেমন আছে সুরেশবাবু?

সুরেশ অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, চকিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে, বেশ আছে; বলিয়াই বোধ হয় সত্য কথাটা স্মরণ হইল, কহিল, বুকে এইখানটায় একটুখানি ব্যথা—কি জানি কাল থেকে আবার বাড়লো না—

রামবাবু বলিলেন, তবেই দেখুন দেখি সুরেশবাবু, এই ঠাণ্ডায় এত রাত্রি পর্যন্ত কি আপনার বাইরে ঘুরে বেড়ান ভাল?

ঠিক ঘুরে বেড়াই নি রামবাবু! সেই বাড়িটার জন্যে আজ দু’হাজার টাকা বায়না দিয়ে এলুম।

রামবাবু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া শেষে বলিলেন, নদীর উপর বাড়িটি ভালই। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞেস করতেন, আমি হয়ত নিষেধ করতাম। সেদিন কথায় কথায় যেন বুঝেছিলাম, সুরমার এখানে বাস করার একান্ত অনিচ্ছা। হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁর মত নিয়েছেন, না কেবল নিজের ইচ্ছেতেই কিনে বসলেন?

সুরেশ এ প্রশ্নের জবাব না দিয়া শুধু কহিল, অনিচ্ছার বিশেষ কোন হেতু দেখিনে। তা ছাড়া বাস করবার মত কিছু কিছু আসবাবপত্রও কলকাতা থেকে আনতে দিয়েছি, খুব সম্ভব কাল-পরশুর মধ্যেই এসে পড়বে।

রামবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া সহসা কি ভাবিয়া ডাক দিয়া উঠিলেন, সুরমা!

অচলা সাড়া দিল না, কিন্তু ঘরের ভিতর হইতে নীরবে বাহির হইয়া ধীরে ধীরে তাহার চৌকিতে আসিয়া বসিল।

বৃদ্ধ স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, মা, তোমার স্বামী যে আমাদের দেশে মস্তবড় বাড়ি কিনে ফেললেন। এই বুড়ো জ্যাঠামশাইকে আর ত ফেলে চলে যেতে তুমি পারবে না মা।

অচলা চুপ করিয়া রহিল।

বৃদ্ধ পুনশ্চ কহিলেন, শুধু বাড়ি আর আসবাবপত্র নয়, আমি জানি, গাড়িঘোড়াও আসচে। আর তার চেয়েও বেশি জানি, সমস্তই কেবল তোমারি জন্যে। বলিয়া তিনি সহাস্যে একবার সুরেশ ও একবার অচলার মুখের প্রতি চাহিলেন। কিন্তু সেই গম্ভীর বিষণ্ণ মুখ হইতে আনন্দের এতটুকু চিহ্ন প্রকাশ পাইল না। এই অস্পষ্ট আলোকে হয়ত ইহা অপরের ঠিক লক্ষ্য না পাইতে পারিত, কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি বৃদ্ধের চক্ষু তাহা এড়াইল না। তথাপি তিনি প্রশ্ন করিলেন, কিন্তু মা, তোমার মতটা—

অচলা এইবার কথা কহিল, বলিল, আমার মতের ত আবশ্যক নেই জ্যাঠামশাই।

বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, সে কি একটা কথা মা! তুমিই ত সব, তোমার ইচ্ছেতেই ত—

অচলা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না জ্যাঠামশাই না, আমার ইচ্ছায় কিছুই আসে-যায় না। আপনি সব কথা বুঝবেন না, আপনাকে বোঝাতেও আমি পারব না—কিন্তু আর আমাকে দরকার না থাকে ত আমি যাই—

বৃদ্ধের মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না এবং তাহার আবশ্যকও হইল না; সহসা হিন্দুস্থানী দাসী একটা কড়ায় এক কড়া আগুন লইয়া উপস্থিত হইবামাত্র সকলের দৃষ্টি তাহারই উপর গিয়া পড়িল। রামবাবু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলেন; সুরেশ অপ্রতিভ হইয়া বলিল, আমি বেহারাটাকে আনতে হুকুম দিয়েছিলুম, সে আবার আর একজনকে হুকুম দিয়েছে দেখচি। আমার এই ব্যথাটায় একটু—

অগ্নির প্রয়োজনের আর বিশদ ব্যাখ্যা করিতে হইল না, কিন্তু তাহার জন্য ত আর একজন চাই। রামবাবু অচলার মুখের দিকে চাহিলেন, কিন্তু সে নিমিষে মুখ ফিরাইয়া লইয়া শ্রান্তকণ্ঠে বলিল, আমার ভারী ঘুম পেয়েছে, জ্যাঠামশাই, আমি চললুম। বলিয়া উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করিয়া চলিয়া গেল এবং পরক্ষণেই তাহার কপাট রুদ্ধ হওয়ার শব্দ আসিয়া পৌঁছিল।

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং দাসীর হাত হইতে আগুনের মালসাটা নিজের হাতে লইয়া বলিলেন, তা হলে চলুন সুরেশবাবু—

আপনি?

হ্যাঁ, আমিই। এ নতুন নয়, এ কাজ এ জীবনে অনেক হয়ে গেছে; বলিয়া একপ্রকার জোর করিয়াই তাহাকে ঘরে টানিয়া লইয়া গেলেন এবং মালসাটা ঘরের মেঝের উপর রাখিয়া দিয়া তাহার শুষ্ক ম্লান মুখের প্রতি ক্ষণকাল একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিয়া আর্দ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, না সুরেশবাবু, না, এ কোনমতেই চলতে পারে না—কোনমতেই না। আমি নিশ্চয় জানচি, কি একটা হয়েচে—আমি একবার আপনার—; কিন্তু থাক সে কথা—যদি প্রয়োজন হয় ত এ বুড়ো আর একবার—, বলিয়া তিনি সহসা নীরব হইলেন।

সুরেশ একটি কথাও কহিতে পারিল না। কিন্তু ছেলেমানুষের মত প্রথমটা তাহার ওষ্ঠাধর বারংবার কাঁপিয়া উঠিল, তারপর চোখের জল গোপন করিতে মুখ ফিরাইল।