» » অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

সকালবেলা দুটিখানি গরম মুড়ি দিয়া চা খাওয়া শেষ করিয়া কেদারবাবু একটা পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন। উচ্ছিষ্ট বাসনগুলি লইতে মৃণাল ঘরে ঢুকিতেই কহিলেন, মা, তোমার এই গরম মুড়ি আর পাথরের বাটির চা’র ভেতরে যে কি অমৃত আছে জানিনে, কিন্তু এই একটা মাসের মধ্যে আর নড়তে পারলুম না।

অচলার সম্পর্কে মৃণাল তাঁহাকে বাবা বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিল। কহিল, কেন তুমি পালাবার জন্যে এত ব্যস্ত হও বাবা, তোমার এ—আমি কি সেবা করতে জানিনে?

তোমার এ মেয়ে কি—এই কথাটাই মৃণাল অসাবধানে বলিতে গিয়াছিল; কিন্তু চাপিয়া গিয়া অন্যপ্রকারে প্রকাশ করিল। তাই বোধ করি, এ ইঙ্গিত কেদারবাবু বুঝিয়াও বুঝিতে চাহিলেন না। কিন্তু কণ্ঠস্বর তাঁহার সহসা করুণ হইয়া উঠিল, বলিলেন, কৈ আর পালাতে ব্যস্ত হই মা! তোমার তৈরি চা, তোমার হাতের রান্না, তোমার এই মাটির ঘরখানি ছেড়ে আমার স্বর্গে যেতেও ইচ্ছা করে না। ওই ছোট্ট জানালার ধারটিতে বসে আমি কতদিন ভাবি মৃণাল, আর দুটো বৎসর যদি ভগবানের দয়ায় বাঁচতে পাই ত কলকাতার মধ্যে থেকে সারা জীবন ধরে যত ক্ষতি নিজে করেচি, তার সবটুকু পূরণ করে নেব। আর সেই মূলধনটুকু হাতে নিয়েই যেন একদিন তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারি।

কত বড় বেদনার ভিতর দিয়া তিনি এই কথাগুলি বলিলেন এবং কিরূপ মর্মান্তিক লজ্জায় কলিকাতার আজন্মপরিচিত পল্লী ও বাসভবন ছাড়িয়া, চিরদিনের আশ্রিতসমাজ ত্যাগ করিয়া এই বনের মধ্যে পর্ণ-কুটিরে বাকি দিনগুলা কাটাইবার অভিলাষ ব্যক্ত করিলেন, মৃণাল তাহা বুঝিল, এবং সেইজন্যই কোন উত্তর না দিয়া চায়ের বাটিটা হাতে লইয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।

এইখানে একটু গোড়ার কথা প্রকাশ করিয়া বলা আবশ্যক। প্রায় মাস-খানেক হইল, কেদারবাবু আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন এবং সেই অবধি আর ফিরিতে পারেন নাই। মহিমের অসুখের সময় সুরেশের কলিকাতার বাটীতে এই বিধবা মেয়েটির সহিত তিনি প্রথম পরিচিত হন, কিন্তু এখানে তাহার নিজের বাটিতে আসিয়া যে পরিচয় ইহার পাইলেন, তাহাতে তাঁহার সমস্ত দেহ-মন যেন সোনার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িয়া গেল। এই বন্ধন হইতেই বৃদ্ধ কোনমতে আপনাকে মুক্ত করিতে পারিতেছিলেন না। অথচ অন্যত্র কত কাজই না তাঁহার বাকি পড়িয়া আছে।

মহিমের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই। তাঁহার আসার সংবাদ পাইয়াই সে ব্যস্ত হইয়া চলিয়া যায়। যাবার সময় মৃণাল ধরিয়া রাখিতে টানাটানি করে নাই, কারণ শিশুকাল হইতে সেজদার সংযম ও সহিষ্ণুতার প্রতি, বুদ্ধি-বিবেচনার প্রতি তাহার এত অগাধ বিশ্বাস ছিল যে, সে নিশ্চয় বুঝিয়াছিল, অচলার সহিত দেখা করা এখন উচিত নয় বলিয়াই কেবল মহিম এমন করিয়া পলায়ন করিতেছে। সে মনে করিয়াছিল, তাহার পত্র পাইয়া কেদারবাবু কন্যা-জামাতার একটা মিটমাট করিয়া দিতে এরূপ তাড়াতাড়ি করিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া আসিতেছেন। কিন্তু আসিলেন তিনি একাকী।

আজিও পরিষ্কার কিছুই হয় নাই, শুধু সংশয়ের বোঝায় উত্তরোত্তর ভারাক্রান্ত দিনগুলি একটির পর একটি করিয়া নীরবে বহিয়াছে। কেবল উপরের দিকে চাহিয়া একটু বুঝা গিয়াছে যে, আকাশে দুর্ভেদ্য মেঘের স্তর যদি কোনদিন কাটে ত কাটিতে পারে, কিন্তু তাহার পিছনে অন্ধকারই সঞ্চিত হইয়া আছে, চাঁদের জ্যোৎস্না নাই।

সুরেশের পিসীমা নিরুদ্দিষ্ট ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্য ব্যাকুল হইয়া মৃণালকে পত্র লিখিয়াছেন, সে পত্র কেদারবাবুর হাতে পড়িয়াছে। মহিম কোন একটা বড় জমিদার-সরকারের গৃহশিক্ষকের কর্ম লইয়াছে জানাইয়া যে সংবাদ দিয়াছে, সে চিঠিখানিও তিনি বার বার পাঠ করিয়াছেন, কোথাও কোনও পক্ষ হইতে তাঁহার কন্যার উল্লেখমাত্র নাই, তথাপি চিঠি দু’খানির প্রতি ছত্র, প্রত্যেক বর্ণ, দুর্ভাগ্য পিতার কর্ণে কেবল একটা কথাই এক শ’বার করিয়া বলিয়াছে, যাহাকে সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিবার মত শক্তিই তাঁহার নাই।

অচলা শুধু যে তাঁহার একমাত্র সন্তান, তাই নয়, শিশুকালে যখন তাহার মা মরে, তখন হইতে তিনিই জননীর স্থান অধিকার করিয়া বুকে করিয়া এই মেয়েটিকে মানুষ করিয়া এতবড় করিয়া তুলিয়াছেন। সেই মেয়ের গভীর অকল্যাণের শঙ্কায় তাঁহার শরীর দিন দিন শীর্ণ এবং তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায় বর্ণ কালি হইয়া আসিতেছিল, অথচ অমঙ্গল যে পথ ইঙ্গিত করিতেছিল, সে পথ সকল পিতার পক্ষেই জগতে সর্বাপেক্ষা অবরুদ্ধ।

গ্রামের দুই-চারিজন বৃদ্ধ প্রতিবেশী মাঝে মাঝে তাঁহার সহিত আলাপ করিতে আসিত, কিন্তু তিনি নিজে কখনও সঙ্কোচে কাহারও গৃহে যাইতেন না। মৃণাল অনুরোধ করিলে হাসিয়া বলিতেন, কাজ কি মা! আমার মত ম্লেচ্ছের কারও বাড়ি না যাওয়াই ত ভাল।

মৃনাল কহিত, তা হলে তাঁরাই বা আসবেন কেন?

বৃদ্ধ এ কথার আর কোন জবাব না দিয়া ছাতাটি মাথায় দিয়া মাঠের পথে বাহির হইয়া পড়িতেন। সেখানে চাষীদের সঙ্গে তিনি যাচিয়া আলাপ করিতেন। তাহাদের সুখ-দুঃখের কথা, গৃহস্থালীর কথা, ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্যের কথা—এমনি কত কি আলোচনা করিতে বেলা বাড়িয়া উঠিলে তবে ঘরে ফিরিতেন। প্রত্যহ সকালে চা খাওয়ার পরে এই ছিল তাঁর কাজ।

জন্মকাল হইতে তাঁহারা চিরদিন কলিকাতাবাসী। শহরের বাহিরে যে অসংখ্য পল্লীগ্রাম, তাহার সহিত যোগসূত্র তাঁহাদের বহুপুরুষ পূর্বেই ছিন্ন হইয়া গিয়াছে—আত্মীয়-কুটুম্বও ধর্মান্তর-গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তিরোহিত হইয়াছে, অতএব অধিকাংশ নাগরিকের ন্যায় তিনিও যে কিছুই না জানিয়াও ইহাদের সম্বন্ধে বিবিধ অদ্ভুত ধারণা পোষণ করিবেন, তাহাও বিচিত্র নয়। যে অশিক্ষিত অগণিত কৃষিজীবী সুদূর পল্লীতেই সারাজীবন কাটাইয়া দেয়, শহরের মুখ দেখা যাহাদের ভাগ্যে কদাচিৎ ঘটে, তাহাদিগকে তিনি একপ্রকার পশু বলিয়াই জানিতেন এবং সেই সমাজটাকেও বন্যসমাজ বলিয়াই বুঝিয়া রাখিয়াছিলেন; কিন্তু আজ দুর্ভাগ্য যখন তাহার তীক্ষ্ণ বিষদাঁত দুটো তাঁহার মর্মের মাঝখানে বিদ্ধ করিয়া সমস্ত মনটাকে নিজের সমাজ হইতে বিমুখ করিয়া দিল, তখন যতই এই-সকল লেখাপড়া-বিহীন পল্লীবাসী দরিদ্র কৃষকদের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিতে লাগিল, ততই একদিকে যেমন তাঁহার প্রীতি ও শ্রদ্ধা উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে লাগিল, অন্যদিকে তেমনিই তাঁহার আপনার সমাজ, তাহার আচার ও আচরণ, তাহার শিক্ষা ও সংস্কার, তাহার ধর্ম, তাহার সভ্যতা, তাহার বিধি-বিধান সমস্তর বিরুদ্ধেই তাঁহার অন্তর বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।

তিনি স্পষ্টই দেখিতে লাগিলেন, ইহারা লেখাপড়া না জানা সত্ত্বেও অশিক্ষিত নয়। বহুযুগের প্রাচীন সভ্যতা আজিও ইহাদের সমাজের অস্থিমজ্জায় মিশিয়া আছে। নীতির মোটা কথাগুলা ইহারা জানে। কোন ধর্মের বিরুদ্ধেই ইহাদের বিদ্বেষ নাই, কারণ জগতের সকল ধর্মই যে মূলে এক, এবং তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীকে অমান্য না করিয়াও যে একমাত্র ঈশ্বরকে স্বীকার করা যায়, এই জ্ঞান তাহাদের আছে এবং কাহারও অপেক্ষাই কম নাই। হিন্দুর ভগবান ও মুসলমানের আল্লাও যে একই বস্তু, এ সত্যও তাহাদের অবিদিত নাই।

তাঁহার মন লজ্জা পাইয়া বার বার বলিতে থাকে, ইহারা কিসে আমাদের চেয়ে ছোট? ইহাদের চেয়ে কোন্‌ কথা আমি বেশী জানি? কিসের জন্য ইহাদের সমাজ, ইহাদের সংস্রব ত্যাগ করিয়া আমরা দূরে চলিয়া গিয়াছি? আর সে দূর এত বড় দূর যে, এই-সব আপনজনের কাছে আজ একেবারে ম্লেচ্ছ হইয়া উঠিয়াছি।

এমনিধারা মন লইয়া যখন বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন, তখন বেলা প্রায় দশটা। মৃণাল আসিয়া বলিল, কাল তোমার শরীর ভাল ছিল না বাবা, আজ যেন আবার পুকুরে স্নান করতে যেয়ো না। তোমার জন্যে আমি গরম জল করে রেখেছি।

একেবারে করে রেখেচ। বলিয়া কেদারবাবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

স্নানান্তে মৃণাল আহ্নিক করিতে বসিয়াছিল, তাঁহার সাড়া পাইয়া এইমাত্র উঠিয়া আসিয়াছে। ভিজা চুল পিঠের উপর ছড়ান, পরনে পট্টবস্ত্র, মুখখানি প্রসন্ন, তাহার সর্বাঙ্গ ঘেরিয়া যেন অত্যন্ত নির্মল শুচিতা বিরাজ করিতেছে—তাহার প্রতি চোখ রাখিয়া বৃদ্ধ পুনশ্চ বলিলেন, এ কষ্ট কেন করতে গেলে মা, এত ত দরকার ছিল না। একটুখানি থামিয়া কহিলেন, আমি ত কলকাতার মানুষ, কলের জলই আমার চিরকালের অভ্যাস। কিন্তু তুমি আমাকে এমন আশ্রয় দিয়েছ মৃণাল যে তোমার এঁদো পুকুর পর্যন্ত আমার খাতির না করে পারেনি। ওর জলে আমার কোনদিন অসুখ করে না—আমি পুকুরেই নাইতে যাবো মা।

মৃণাল মাথা নাড়িয়া বলিল, না বাবা, সে হতে পারবে না। কাল তোমার অসুখ করেছিল, আমি ঠিক জানি, আমি জল নিয়ে আসি গে—তুমি তেল মাখতে বসো। বলিয়া সে যাইবার উদ্যোগ করিতেই কেদারবাবু হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, সে যেন হলো, কিন্তু আজ এই কথাটা আমাকে বল দেখি মৃণাল, পরকে এমন সেবা করার বিদ্যাটা তুমি এটুকু বয়সের মধ্যে কার কাছে কেমন করে শিখলে? এমনটি যে আর আমি কোথাও দেখিনি মা।

লজ্জায় মৃণালের মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কিন্তু জোর করিয়া হাসিয়া কহিল, কিন্তু তুমি কি আমার পর বাবা?

কেদারবাবু বলিলেন, না, পর নই—আমি তোমার ছেলে। কিন্তু এমন এড়িয়ে গেলেও চলবে না, জবাব আজ দিয়ে তবে যেতে পাবে।

মৃণাল ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তেমনি সলজ্জ হাসিমুখেই উত্তর দিল, এ আর কি এমন শক্ত কাজ যে, চেষ্টা করে শিখতে হবে? এ ত আমাদের জন্মকাল থেকেই শেখা হয়ে থাকে। কিন্তু তোমার জল যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বাবা—

তা যাক, বলিয়া কেদারবাবু গম্ভীর হইয়া কহিলেন, ঠিক এই কথাটাই আমি কিছুদিন থেকে ভাবচি মৃণাল। মানুষ শিখে তবে সাঁতার কাটে, কিন্তু যে পাখি জলচর, সে জন্মেই সাঁতার দেয়। এই শেখাটা তার কেউ দেখতে পায় না বটে, কিন্তু কাজটাকে ফাঁকি দিয়ে কেবল ফলটুকু ত পাবার জো নেই মা! এ ত ভগবানের নিয়ম নয়। কোথাও না কোথাও, কোন না কোন আকারে শেখার দুঃখ তাকে বইতেই হবে। তাই ওই জলচরটার মত যে নীড়ের মধ্যে তুমি জন্মকাল থেকে অনায়াসেই এত বড় বিদ্যে আয়ত্ত করে নিয়েচ, তোমাদের এই বিরাট-বিপুল সমাজ-নীড়টার কথাই আমি দিনরাত ভাবচি। আমি ভাবি এই যে—কিন্তু তোমার জল যে একেবারে—

থাক না মা জল। পুকুর ত আর শুকিয়ে যাচ্চে না। আমি ভাবি এই যে, তোমার বুড়ো ছেলেটি শিশুর মত তার মায়ের কাছে গোপনে কত কথাই শিখে নিচ্ছে, সে ত আর তাঁর খবর নেই! আজও ঠাকুর-দেবতা, মন্ত্রে-তন্ত্রে কানাকড়ির বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু তবু যখনি মাকে দেখি, স্নানান্তে সেই পাঁশুটে রঙের মটকার কাপড়খানি পরে আহ্নিক করতে যাচ্ছেন, তখনি ইচ্ছা করে, আমিও আবার পৈতে নিয়ে অমন করে কোষাকুষি নিয়ে বসে যাই।

মৃণাল কহিল, কেন বাবা, তোমার নিজের ধর্ম, নিজের সমাজ ছেড়ে অন্য আচার পালন করতে যাবে? তাকেও ত দোষ কেউ দিতে পারে না।

কেদারবাবু বলিলেন, কেউ পারে কিনা আলাদা কথা, কিন্তু আমি তার গ্লানি করতে বসব না। সে ভাল হোক, মন্দ হোক, এ বয়সে তাকে ত্যাগ করবার সামর্থ্য নেই, বদলাবারও উদ্যম নেই। এই রাস্তা ধরেই জীবনের শেষ পর্যন্ত চলতে হবে। কিন্তু তোমাকে যখন দেখি—যখন দেখি, এইটুকু বয়সে এত বড় আত্মবিসর্জন, যিনি স্বর্গে গেছেন, তাঁর প্রতি এই নিষ্ঠা, তাঁর মাকেই মা জেনে—আচ্ছা, থাক থাক, আর বলব না। কিন্তু আমিও যার মধ্যে মানুষ হয়ে বুড়ো হয়ে গেলুম মা, তাকেও ত মনে মনে তুলনা না করে থাকতে পারিনে। সমাজ ছাড়া যে ধর্ম, তার প্রতি আর যে আস্থা কোন মতেই টিকিয়ে রাখতে পারিনে মৃণাল।

মৃণাল মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইল। তাহার ব্যক্তিগত জীবনের দুর্ভাগ্যকে যে তিনি এমনি করিয়া নিজের সামাজিক শিক্ষাদীক্ষার উপরেই আরোপ করিবেন, ইহা তাহার কাছে অত্যন্ত অবিচার বলিয়া মনে হইল। বলিল, বাবা, ঠিক এমনি করে যখন আমাদের সমাজটাকে দেখতে পাবেন, তখন এর মধ্যেও অনেক ত্রুটি, অনেক দোষ আপনার চোখে পড়বে। দেখবেন আমরাও নিজেদের দোষগুলো আপনার কাঁধের বদলে সমাজের কাঁধেই তুলে দিতে ব্যস্ত। আমরাও—

কিন্তু কথাটা শেষ না হইতে কেদারবাবু বাধা দিয়া উঠিলেন। কহিলেন, কিন্তু আমি ত ব্যস্ত নই মা! তোমাদের সমাজে থাক না দোষ, থাক না ত্রুটি—কিন্তু তুমি ত আছ। এইটিই যে আমি মাথা খুঁড়ে মলেও খুঁজে পাব না।

আবার মৃণালের মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল, বলিল, এমন করে আমাকে যদি তুমি এক শ’বার লজ্জা দাও বাবা, তা হলে এমনি পালাব যে, কিছুতেই আর আমাকে খুঁজে পাবে না, তা কিন্তু আগে থেকে বলে রাখছি।

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ কোন কথা কহিলেন না, নিঃশব্দে ম্লানমুখে তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। তার পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, আমিও তোমাকে আজ বলে রাখছি মা, এই কাজটিই তোমাকে কিছুতে করতে দেব না। তুমি আমার চোখের মণি, তুমি আমার মা, তুমি আমার একমাত্র আশ্রয়। এই অনাথ অকর্মণ্য বুড়োটার ভার থেকে ছুটি নেবার দিন যেদিন তোমার আসবে মা, সে হয়ত বেশি দূরে নয়, কিন্তু সে আমাকে চোখে দেখতে হবে না, তাও আমি বেশ জানি। বলিতে বলিতেই তাঁহার চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল।

জামার হাতায় মুছিয়া ফেলিয়া কহিলেন, আমার একটা কাজ এখনো বাকী রয়েচে, সেটা মহিমের সঙ্গে দেখা করা। কেন সে পালিয়ে বেড়াচ্চে, একবার স্পষ্ট করে তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। এমনও ত হতে পারে, সে বেঁচে নেই?

কেন বাবা, তুমি ও-সব ভয় করচ?

ভয়? বৃদ্ধের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল, কহিলেন, সন্তানের মরণটাই বাপের কাছে সবচেয়ে বড় নয় মা!