এবার আর বিস্ময় গোপন করতে পারল না রানা। সম্ভ্রমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার লক্ষ্য করল প্রাণবন্ত মুখটা।
এই সেই দুর্দান্ত খান মোহাম্মদ জান। বৃটিশের রাজত্বকালে যে কিনা ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। যার নাম বললেই পশ্চিম পাকিস্তানের ছেলে-বুড়ো সবাই চেনে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে যার নাম ভীতির সঙ্গে স্মরণ করা হয়। এই সেই খান মোহাম্মদ জান!
এই লোক তাকে বন্দি করে এনেছে কেন? এর নামে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে আলাদাভাবে একটা ফাইল রাখা আছে। সবাই জানে আফগানিস্তান, ইরান আর সোভিয়েট রিপাবলিকের দুর্বৃত্তদের সাথে এর মস্ত চোরাচালানী কারবার আছে। কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে লোকটা এই উপায়ে। বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কে জমা আছে এর অগাধ সম্পদের বেশ-অনেকখানি অংশ। অথচ কেউ কখনও আইনের প্যাঁচে ধরতে পারেনি একে বেকায়দা অবস্থায়। তার এলাকায় সে সম্রাট। পাকিস্তান সরকারও তাকে সব সময়ে ঘাটাতে সাহস পায় না।
এই কি তা হলে সোনা চোরাচালানকারীদের অদৃশ্য সর্দার? একেই খুঁজে বের করবার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে ঢাকা থেকে?
‘কই, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, মি. মাসুদ রানা?’ বসুন।
একটা সোফায় বসে পড়ল রানা। গুলির শব্দে ছুটে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন। মোহাম্মদ জান হাতে তালি দিতেই ঘরের ভিতর ঢুকে সালাম করল একজন; পশতু ভাষায় কিছুক্ষণ অনর্গল কথা বলল মোহাম্মদ জান। লোকটার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই রানাকে বলল, ‘আপনার জন্যে পাশের বাথরুমে সব কিছু তৈরি আছে, মিস্টার রানা। টুথব্রাশ, সাবান, টাওয়েল, সবই নতুন। আপনাকে বলেছি, আমি আপনার শত্রু নই। আপনি নিশ্চিন্ত মনে মুখ-হাত ধুয়ে আসুন। ততক্ষণে নাস্তা এসে যাবে। প্লিজ!’
‘জিনাতকে কোথায় রেখেছেন?’
মৃদু হাসল মোহাম্মদ জান। বলল, ‘চিন্তা করবেন না। ওকেও যত্নে রাখা হয়েছে।’
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রানা দেখল একটা টেবিল লাগানো হয়েছে ঘরের মধ্যে। তার দুপাশে দুটো চেয়ার। মস্ত একটা থালায় পাউরুটি টোস্টের পাহাড়। একটা বাটিতে মাখন। সাদা দুটো প্লেটে পাশাপাশি শুয়ে আছে প্রকাণ্ড সাইজের দুটো করে ধূমায়িত ওমলেট—চারটে ডিম দিয়ে তৈরি প্রতিটা। পাতলা করে কাটা টিনের পনির আছে একটা তস্তরির উপর। একটা দামি ফ্রুট সেটে উঁচু করে আঙুর, নাশপতি, আপেল আর মাল্টা—কিছু কাজুবাদাম আর আখরোট। সব মিলে টেবিলটা প্রায় ভরে যাবার যোগাড়। দশজন একসাথে চেষ্টা করলেও শেষ করতে পারবে না সব। মুখোমুখি বসল দুজন দুটো চেয়ারে।
‘মেজর মাসুদ রানা। আপনার সাথে যা আলোচনা করব তা গোপন রাখবেন বলে কথা দিতে হবে। একেবারে টপ সিক্রেট। রাজি?’
‘তেমন কোনও কথা আমি দেব না। রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কোনও কথা আমাকে বললে সেটা আমার পক্ষে গোপন রাখা সম্ভব হবে না।’
‘সেটা আমি ভাল করেই জানি, মিস্টার মাসুদ রানা।’ হাসল মোহাম্মদ জান। ‘আপনার সম্পর্কে সব রকম রিপোর্ট নিয়েছি আমি। আপনার মত নীতিবান দেশপ্রেমিকের কাছে তেমন কোনও কথা আমি বলতেই বা যাব কোন সাহসে? আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলাপ করতে চাই। এই ধরুন, আমার একমাত্র কন্যা, জিনাত সম্পর্কে।’
এইবার সত্যিই চমকে উঠল রানা। জিনাতের বাবা এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ট্রাইবাল চিফ? এতক্ষণে রানা বুঝল কেন হঠাৎ ফ্রন্টিয়ারের ক্ষমতাশালী এক সর্দার তার সাথে আলাপ করতে চায়। হাসিটাও চিনতে পারল রানা এখন—অবিকল জিনাতের হাসি। রীতিমত নাটক জমে উঠেছে মনে হচ্ছে!
‘তা হলে রাজি,’ মৃদু হেসে বলল রানা।
‘অনেক ধন্যবাদ। আপনার সম্পর্কে সরকারি রিপোর্টে বলে আপনি দায়িত্বশীল বিশ্বস্ততমদের একজন। রিপোর্ট না পড়েও আপনার মুখ দেখেই সে কথা অনায়াসে বলে দিতে পারতাম আমি। সত্যিকার মানুষ বলতে আমি যা বুঝি, আপনি তাই। সব কথা খুলেই বলব আমি আপনাকে। তার আগে আসুন নাস্তার পালাটা শেষ করে নেয়া যাক।’
নাস্তার পর কফি এল। একটা চেস্টারফিল্ড প্যাকেট থেকে নিজে একটা নিয়ে রানার দিকে বাড়িয়ে ধরল মোহাম্মদ জান। রানা একটা নিল। দুটোতেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে আরম্ভ করল মোহাম্মদ জান:
‘আজ বারো বছর আমি বিপত্নীক। আর বিয়ে থা করিনি। মর্দানের সেরা সুন্দরীকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে এসে বিয়ে করেছিলাম আমি এবং ভালবেসেছিলাম।
‘মায়ের অভাবে আমার একমাত্র সন্তান এই জিনাত বখে যেতে পারে সেই ভয়ে ওকে লাহোরের শ্রেষ্ঠ বোর্ডিং স্কুলের হোস্টেলে রেখেছিলাম। ছুটি ছাটায় বাড়ি আসত। ওদের শিক্ষা-দীক্ষায় আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। সিনিয়ার কেজি পর্যন্ত ভালই ছিল কিন্তু কলেজে উঠে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বংশ-মর্যাদাবিহীন বড়লোকদের আলট্রা-মডার্ন সব ছেলেমেয়েদের সাথে মেলামেশা আরম্ভ করল জিনাত। খারাপ সংসর্গের এমনই গুণ, এক মাসের মধ্যেই লাজুক পাহাড়ি মেয়েটা বদলে গেল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। চক্রবৃদ্ধি হারে খারাপ লোক এসে ভিড় করল ওর আশপাশে। একেবারেই বখে গেল মেয়েটা। ফিল্ম লাইনে ঘোরাফেরা আরম্ভ করল। অনেক রাতে ফেরে হোস্টেলে। মাঝে মাঝে দু’একদিন ফেরেও না। হোস্টেলের সুপারের চিঠি আসতে আরম্ভ করল আমার কাছে। প্রথমে আমি বিশ্বাসই করিনি ওদের নালিশ। নিজ সন্তানের ওপর সব পিতারই এমন অন্ধ বিশ্বাস থাকে।
‘কিন্তু ফোর্থ ইয়ারে উঠে কলেজের এক ছোকরা প্রফেসরের সাথে বাথরুমে ধরা পড়ায় রাসটিকেট করা হলো ওকে।
‘বিশ্বাস করুন, মি. রানা, এই একটি মাত্র মেয়ের দুঃখ হবে বলে বয়স থাকতেও আর বিয়ে করিনি আমি। ওকে চোখের মণি করে রেখে ওর মায়ের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করতাম। যা চাইত, তাই পেত সে। এদিকে আমাকে সেই সময়টা দৌড়াদৌড়ির ওপর থাকতে হত। কয়েকটা কেসে গোলমাল হয়ে যাওয়ায় ধরা পড়বার উপক্রম হয়েছিল। ওর দিকে নজর দেবার সময় পেতাম না। নিজেকে শেষ করে ফেলল ও। সব ব্যাপারে দেখে-শুনে এবার আমি কঠিন হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। আরও অবাধ্য হয়ে উঠল ও। হাত খরচের টাকা কমিয়ে দিলাম। তার ফলে আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যই বোধহয় ও প্রেমিকদের কাছে টাকা নিতে আরম্ভ করল, যেখানে সেখানে ধার করতে আরম্ভ করল।’
সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে চুপচাপ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল মোহাম্মদ জান। বোধহয় গুছিয়ে নিল কথাগুলো মনের মধ্যে।
‘কিন্তু যত যা-ই করুক, ওর মনের একটা দিক নিরন্তর চাবুক মারত ওকে। হাজার হোক, ভাল বংশের মেয়ে। বিবেক দংশন আরম্ভ হলো ওর মধ্যে। নিজেকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করল ও। ঠিক সেই সময়েই বোধহয় আত্মহত্যার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ওর মধ্যে। নিজেকে শুধরাবার চেষ্টা করল জিনাত। জীবনে শান্তি পাওয়ার আশাতেই বোধহয় বিয়ে করে বসল হঠাৎ আমাকে না জানিয়ে এক ফিল্মস্টারকে। ফিল্ম-লাইন পছন্দ না করলেও আমি খুশি হয়েছিলাম ওর এই পরিবর্তন দেখে। এক কোটি টাকার উপঢৌকন পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বছর দুয়েক হলো ওর সমস্ত টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি চুরি করে পালিয়ে গেছে সেই হিরো বোম্বেতে নাম করবার আশায়। জিনাতের কোলে তখন তিন মাসের একটা শিশু।’
চুপচাপ মন দিয়ে শুনছে রানা রহস্যময়ী মেয়েটার পূর্ব ইতিহাস। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসল ও।
‘অনেক টাকা পয়সা খরচ করে এবং ভয় দেখিয়ে আমি তালাক আদায় করি সেই হিরোর কাছ থেকে। মারীতে একটা বাড়ি কিনে দিলাম জিনাতকে। মনে হলো যেন শান্তি পেল মেয়েটা। বেশ ছিল বাচ্চাকে নিয়ে বিভোর হয়ে। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়। আজ আট মাস হলো হঠাৎ একসাথে ডাবল নিউমোনিয়া আর ব্যাসিলারি ডিসেনট্রি হয়ে মারা গেছে বাচ্চাটা।’
‘আপনাকে কী বলব, মিস্টার রানা। আমার একমাত্র আদুরে জিদ্দি মেয়েটার কপালে খোদা ভাল যেটুকু লিখেছিল, সে-সময় বোধহয় কলমে তার কালি ছিল না।’
‘এই চরম আঘাত পেয়ে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে খেপে গেল মেয়েটা। কিছুতেই আর আপোষ করবে না। ধ্বংস করে ফেলবে নিজেকে। আবার ফিরে গেল ও তার আগের জীবনে। আজ এখানে কাল ওখানে পাগলের মত ও জীবনটা চেখে নিতে চাইল শেষ বিদায়ের আগে। আমি অনেক চেষ্টা করলাম ওর সাথে দেখা করবার, কথা বলবার। কিন্তু হলো না! বারবার এড়িয়ে চলে গেল ও। কিছুতেই সন্ধি করবে না ও নিষ্ঠুর জীবনের সাথে। আমিও পাগলের মত খুঁজে বেড়াতে থাকলাম ওকে। লোক লাগালাম চারদিকে। কিন্তু আমি পেশোয়ার পৌঁছতে ও চলে যায় পিণ্ডি, পিণ্ডি পৌঁছলে খবর পাই চলে গেছে লাহোর। কিছুতেই ধরতে পারি না ওকে। কিছুদিন একেবারে গায়েব হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ খবর এল ও করাচির বিচ লাগজারি হোটেলে একটা রুম রিজার্ভ করেছে। ছুটে এলাম করাচি। পাহাড়ি দেশের মানুষ আমরা, সাগরকে সব সময় ভয় পাই। যখন শুনলাম ও সাগর পারের হোটেলে উঠেছে তখন থেকে আধমরা হয়ে আছি আমি, মিস্টার রানা। জানলাম, দ্রুত সময় ফুরিয়ে আসছে। যে কোনও মুহূর্তে আমার হাত ফসকে চলে যাবে ও নাগালের বাইরে, চিরতরে।’
একটানা এতক্ষণ কথা বলায় দুই কষায় ফেনা জমেছে মোহাম্মদ জানের। রুমাল দিয়ে মুছে নিল সেটা। আরেকটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ টানল সিগারেটটা।
‘আপনাকে আজ আমার এতদিনকার বুকে চেপে রাখা গোপন কথা বলতে পেরে মনটা যে কতখানি হাল্কা হয়ে গেল, মিস্টার রানা, বোঝাতে পারব না! যাক, যা বলছিলাম, কড়া নজর রাখলাম আমি ওর ওপর।’
হোটেলের সেই তিনজন লোকের কথা মনে পড়ল রানার।
‘ওর প্রতিটা পদক্ষেপ আমার লোক লক্ষ্য করেছে। এবং প্রতি দশ মিনিট পর পর টেলিফোনে জানিয়েছে আমাকে। আপনাকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি এখনও। জিনাতকে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করবার জন্যে আমি আপনার কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞ।’
‘সাহায্য তো নয়, বরং ক্ষতিই হয়েছে। সব টাকা হেরেছে,’ বলল রানা।
‘কিছু বলা যায় না, মেজর। কিছুই বলা যায় না। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তা এক ওপরওয়ালাই জানেন। আমরা তার কী বুঝি? যাক, যা বলছিলাম। এই বাড়িতে বসেই ওর গতিবিধি আমার নখদর্পণে ছিল। সব খবরই জানি আমি। বমি করে ঘর ভাসানো, আপনার সাহায্য করতে এগিয়ে আসা থেকে নিয়ে রাত পোনে একটায় আপনার ঘরে জিনাতের প্রবেশ এবং দেড়টায় প্রস্থান—কিছুই আমার অজানা নেই।’
অস্বস্তি বোধ করল রানা। একটু নড়ে চড়ে উঠল। হাত উঠিয়ে যেন অভয় দিল ওকে সর্দার।
‘এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই, মেজর রানা। ব্যাটা-ছেলের এতে লজ্জার কিছুই নেই। আর আমার মেয়েও কচি খুকি নয়। তা ছাড়া কে জানে, হয়ত…যাক, সে কথায় পরে আসছি। এমনও হতে পারে গত রাতের ঘটনাটাই ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। হয়ত এটা একটা চিকিৎসার কাজই করল ওর জন্যে।’
এইবার খানিকটা আঁচ করতে পারল রানা কেন ওকে ধরে আনা হয়েছে। এর আসল রহস্যটা কোথায়। কেন জানি একবার শিউরে উঠল ওর সর্বশরীর। যেন কেউ হেঁটে চলে গেল ওর কবরের ওপর দিয়ে।
‘গত দুই দিনেই আমি আপনার সম্পর্কে সব তথ্য জোগাড় করে ফেললাম।’
‘কিভাবে?’ চট করে জিজ্ঞেস করল রানা।
হাসল খান মোহাম্মদ জান ওর সেই সংক্রামক হাসি।
‘সেটা যদিও আমার বলা উচিত না, তবু বলব আপনাকে। কারণ আমি যদি খবর বের করতে পেরে থাকি, অন্যেও পারবে। এটা আপনার নিরাপত্তার ওপর স্পষ্ট হুমকি। কিন্তু এসব কথা পরে হবে। আগে আমার গল্প শেষ করে নিই।’
আবার দু’কাপ কফি এল। লোকটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকল খান মোহাম্মদ জান।
‘আপনার সম্পর্কে যা রিপোর্ট পেলাম এবং টেলিফোনে যা খবর পেলাম তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠলাম আমি। রাত দুটো পর্যন্ত চিন্তার পর ওদের জানালাম, আপনার সাথে দেখা করতে চাই আমি। আপনার অনেক সময় নষ্ট হলো, সেজন্যে এই জোড় হাত করে মাফ চাইছি আমি। আপনি হয়ত মনে করেছিলেন বিপদে পড়েছেন, সেজন্যেও ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এ ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না, মিস্টার রানা।’
‘আর কোনও উপায়ে কি আমার দেখা পাওয়া সম্ভব ছিল না?’ একটু রুষ্ট কণ্ঠে বলল রানা।
উঠে এসে রানার বাহুর ওপর হাত রাখল মোহাম্মদ জান।
‘সেজন্যে তো মাফই চাইছি, মেজর। একটা আকুল পিতৃ-হৃদয়ের উদ্বেগের সাথে পরিচয় হতে আপনার দেরী আছে অনেক। আরও পঁচিশটা বছর যাক, তখন বুঝবেন। তা ছাড়া একটু পরেই বুঝবেন ব্যাপারটা কত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডেকে আনতে বললে যে ওরা একেবারে বেঁধে নিয়ে আসবে তা অবশ্য আমার জানা ছিল না। কিন্তু এর প্রয়োজনও ছিল। এই চিঠিটা পড়লে আর আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। এই নিন, পড়ে দেখুন। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিল মোহাম্মদ জান। যেই জিনাত রওনা হয়েছে সাগরের দিকে ওমনি আমার লোক ওর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে এখানে। এই চিঠিটা ছিল ওর টেবিলের ওপর। আপনিও তো কিছু সন্দেহ করেছিলেন, তাই না? এখন দেখুন।’
ছোট্ট চিঠিটা উর্দুতে লেখা। রানা পড়ল:
আব্বাজী,
এ ছাড়া আমার আর কিছুই করবার ছিল না। শুধু একটু খারাপ লাগছে। একজনের জন্যেও আমাকে ভাল করতে চেয়েছিল। লোকটা বাঙালি। নাম মাসুদ রানা। ওকে খুঁজে বের করে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিও। আমি ধার নিয়েছিলাম। আর তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। বিদায়।
জিনা
চিঠি থেকে চোখ তুলে চাইল রানা। উদগ্রীব একজোড়া চোখ চেয়ে আছে ওর মুখের দিকে। ফেরত দিল রানা চিঠিটা। ভাঁজ করে পকেটে রাখল সেটা মোহাম্মদ জান। তারপর হঠাৎ রানার ডান হাতটা তুলে নিল নিজের দুই হাতে।
‘মাসুদ রানা। আপনি সমস্ত কাহিনী শুনলেন। প্রমাণও দেখলেন। খোদা জানে, এর মধ্যে একবিন্দু মিথ্যে কথা নেই। একটু দয়া করবেন আমার ওপর? মেয়েটাকে রক্ষা করতে একটু সাহায্য করবেন আমাকে? বলুন?’
করুণ মিনতি সর্দারের চোখে-মুখে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে টেবিলের উপর রাখল রানা। কপালে ঘাম দেখা দিল ওর। টেবিলের উপর রাখা হাতের দিকে চেয়ে রয়েছে ও—চোখ তুলল না। মনে মনে ভাবছে, এ কি ফ্যাকড়ায় পড়ল ও।
সে তো ডাক্তার নয়। সে কী সাহায্য করবে? যেন হাতের সাথে কথা বলছে। এমনি ভাবে বলল, ‘আমার মনে হয় না আমি তেমন কোনও সাহায্য করতে পারব। আপনার কী মনে হয়?’
উত্তেজনায় জান মোহাম্মদের কপালের দুটো শিরা ফুলে উঠেছে। গলার স্বরে একটা জরুরি ভাব আর সেইসাথে কাতর অনুনয় ফুটে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি চাই তুমি আমার মেয়ের সাথে প্রেম করো, ওকে বিয়ে করো। আমি তোমাকে তিন কোটি টাকা দেব যৌতুক হিসাবে।’
ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠল রানা।
‘বাজে বকছেন আপনি, সর্দার। মেয়েটি ভুগছে মানসিক ব্যাধিতে, ভাল ডাক্তার দেখান। কাউকে বিয়ে করব না আমি—আর কারও টাকারও আমার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট রোজগার করি আমি।’
একটু থেমে শান্ত গলায় আবার বলল, ‘জিনাতকে আমি পছন্দ করি। ওকে কোনও রকম সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু ও অসুখ থেকে সেরে উঠলেই কেবল ওর সাথে আমার প্রেম বা বিয়ের কথা উঠতে পারে। তার আগে নয়। আমি একজন দুরন্ত প্রকৃতির লোক—শত্রু আর বিপদ নিয়ে আমার কারবার, আপনি জানেন কারও সেবা-শুশ্রূষা করবার ধৈর্য আমার নেই। ওর চিকিৎসা দরকার, সর্দার। আপনি যেভাবে ওকে সাহায্য করতে চাইছেন তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বুঝতে পারছেন না আমার কথাটা?’
চুপচাপ শুনল কথাগুলো মোহাম্মদ জান রানার চোখের উপর চোখ রেখে। তারপর নরম গলায় বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। আপনার সাথে আমি তর্ক করব না। আপনি যেমন বললেন, ঠিক তাই করব আমি। কিন্তু দয়া করে শুধু একটা অনুগ্রহ করবেন?’
‘কী?’
‘আজ সারাটা দিন ওর সাথে কাটিয়ে ওকে শুধু এটুকু বুঝিয়ে দেবেন, ওকে পছন্দ করেন আপনি, ওর প্রয়োজন আছে বেঁচে থাকবার, আবার দেখা হবে আপনাদের। যদি আপনি ওকে একটু আশা, একটু ভরসা দিতে পারেন, তা হলে বাকিটা আমি পারব বোঝাতে। আমার জন্যে এটুকু করবেন না আপনি, মেজর রানা?’
ব্যস? এইটুকুতেই খুশি? রানার বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল একটা। তা হলে জোর করে ওর কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে চাইছে না এই ক্ষমতাশালী ট্রাইবাল চিফ?
‘নিশ্চয়ই!’ বলল রানা। এটুকু তো নিশ্চয়ই করব আমি। কিন্তু আমি মাত্র তিনদিন আছি করাচিতে। এরপর আপনাকে গ্রহণ করতে হবে ওর ভার।’
মোহাম্মদ জানের মুখে হাসি ফুটল আবার।
‘এতক্ষণ পর! উঃ! এতক্ষণ পর একটু আশার আলো দেখালে, বাবা। তিনদিন যথেষ্ট। তারপর নিশ্চয়ই আমি ওর ভার নেব। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল মোহাম্মদ জান। তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার কোনও ভাষা নেই আমার, মেজর রানা। তুমি বাঁচালে আমাকে কিন্তু তোমার জন্যে কিছু করবার সুযোগ দেবে না আমাকে? আমার অনেক বুদ্ধি, অনেক টাকা আর অ-নে-ক ক্ষমতা আছে। সবই এখন তোমার। এমনকী কিছুই নেই আমি তোমার জন্যে করতে পারি না।’
হঠাৎ রানার মনে পড়ল তার কাজের কথা।
‘একজন লোককে খুঁজছি আমি। লোকটা…’
‘বুঝেছি। স্বর্ণমৃগ। আজই রাত দশটায় হোটেলে থেকো—তোমাকে নিয়ে যাব এক জায়গায়। সেখানে ওর খবর মিলতে পারে। তা ছাড়া আমি এক্ষুণি চারদিকে লোক লাগিয়ে দিচ্ছি। এ কাজটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।’ উঠে দাঁড়াল মোহাম্মদ জান। রানাও উঠে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রানার দুই গালে চুমো খেল মোহাম্মদ জান। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘরে এসে ঢুকল জিনাত সুলতানা। জিনাতকে দেখেই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি রানাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল সর্দার।