রাত সাড়ে বারোটা। ইজি চেয়ারে শুয়ে পাতা ওল্টাচ্ছে রানা জন ব্লেকের ‘দ্য গোল্ড স্মাগলিং’ বইয়ের। স্বর্ণ-ইতিহাস থেকে আরম্ভ হয়েছে বইটা। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ মাটি খুঁড়ে চলেছে সোনার লোভে। কোথায় ঈজিপ্টের সোনা, মন্টেজুমা আর ইনকাসের খনি। মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্ণখনি নিঃশেষ করল মাইডাস আর ক্রোয়েসাস। ইউরোপে রাইন, পোর উপত্যকা, মালাগা, গ্রানাডার সমতলভূমি চষে ফেলা হলো। সোনা চাই, সোনা চাই, খেপে উঠল পৃথিবীর মানুষ। নিঃশেষ করল বালকান আর সাইপ্রাসের সোনা। ওদিকে রোমানরা সোনা তুলল ওয়েলস, ডেভন আর কর্নওয়াল থেকে। তারপর এল মেক্সিকো, পেরু। তারপর গোল্ড কোস্ট। উনবিংশ শতাব্দীতে লেনা এবং ইউরালে খনি আবিষ্কার করল রাশানরা। সে-ও শেষ। এখন সোনা উঠছে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটে।
কেবল ১৫০০ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আঠারো হাজার টন সোনা তোলা হয়েছে ভূগর্ভ থেকে। ১৯০০ থেকে আজ পর্যন্ত (১৯৬৩ খ্রি. সংস্করণ) তোলা হয়েছে একচল্লিশ হাজার টন। আগামী পঞ্চাশ বছরেই শেষ হয়ে যাবে গোটা পৃথিবীর স্বর্ণ-সঞ্চয়।
বিরক্ত হয়ে রেখে দিল রানা বইটা। বইখানা গছিয়ে দিয়েছেন ঢাকায় রাহাত খান। বলেছেন চমৎকার বই, খুব মজার। বুড়ো যে কীসে মজা পায় আর কীসে পায় না বোঝা মুশকিল। বিশ পাতা পড়ে রানা বুঝল, এর মধ্যে দাঁত ফোঁটানোর ক্ষমতা ওর নেই। এ আখের রস, তালের নয়। মজা পেতে হলে দাঁতের জোর চাই।
ইংরেজদের ওই দোষ। যা করবে একেবারে গোড়া বেঁধে নিয়ে করবে। আরে বাবা, লিখতে বসেছিস গোল্ড স্মাগলিং। গ্রিল সিরিজের মত লিখে যাবি। চমকপ্রদ সব ঘটনা। তা অত লেকচার মারছিস কেন? এই থিসিস সাবমিট করে দিলেই তো পিএইচডি মিলে যেত। তা না করে কেন মিছে আমাদের মত সাধারণ পাঠককে নাকানি চুবানি খাওয়ানো, বাবা? অত যদি বিদ্যের ভুড়ভুড়ি ওঠে পেটের মধ্যে তো কলেজে ঢুকে পড়ো না, চাঁদ। প্রচুর শ্রোতা পাবে।
মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে বইটা। টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আবার সজোরে রাখল রানা ওটাকে টেবিলের উপর। গায়ের ঝাল একটু কমল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল ও। শো শো একটানা সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। স্লিপিং গাউনটা পত পত উড়ছে পতাকার মত। নীচে সেইলরস ক্লাবের কাঁচের ওপাশে কালো পর্দা টানা। এক-আধ চিলতে উজ্জ্বল আলো এসে পড়ছে বাইরে। কালো আলখেল্লা গায়ে জাদুকরের মত লাগছে ঘরটাকে। ভিতরে তার অসীম রহস্য। আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির চমক।
এই আলখেল্লার জন্যেই ওয়ালী আহমেদ সন্ধ্যার পর খেলতে পারে না। খেলার কথায় রানার মনে পড়ল জিনাত সুলতানার কথা। অদ্ভুত মেয়ে। এত রূপই ওর কাল হয়েছে। বারবার প্রবঞ্চনা পেয়েছে সে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান পুরুষের কাছ থেকে। মমতা হয় রানার।
এখনও কি অপেক্ষা করে আছে ও রানার জন্যে? বোধহয় না। ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। কথা দিয়েও যায়নি রানা আজ ওর ঘরে। টাকার বিনিময়ে নারীদেহ ভোগ করবার কথা ভাবতেও পারে না ও। অসম্ভব। যদি রানাকে কেউ পশু মনে করে তার জন্য অপেক্ষা করে, তা হলে রানার কী করবার আছে?
শীত শীত করছে। দোসরা মার্চ। বাংলায় ফাল্গুন মাস। কিন্তু শীতের আমেজ যায়নি। একটু বেশি রাতে তো রীতিমত শীত। ঘরের ভেতর চলে এল রানা। ওদিকের দরজাটা বন্ধ করে দিল। দুটো কামরা নিয়ে ওর সুইট। ড্রইং রুমের মধ্য দিয়ে বেরোতে হয় বাইরে। দরজা বন্ধ আছে কি না আরেকবার পরীক্ষা করে তিন ওয়াটের সবুজ বাতিটা জ্বেলে দিয়ে বাকি সব বাতি নিভিয়ে দিল রানা। দামি কম্বলের তলায় ঢুকে পাশ ফিরতে যাবে এমন সময় কান খাড়া হয়ে গেল ওর, দরজায় মৃদু টোকা। আবার শব্দটা হতেই বুঝল কানের ভুল নয়।
মদু সাবধানী টোকা। কে হতে পারে? সোহেল? না শত্রুপক্ষ? নিঃশব্দ পায়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল। অপর পারে ঠুন করে একটা হাল্কা আওয়াজ হতেই মৃদু হেসে বাতি জ্বালল রানা। চুড়ির আওয়াজ। দরজা খুলতেই ঘরে প্রবেশ করল জিনাত সুলতানা। আলুথালু বেশ। খোলা এলো চুল। বোঝা গেল এই মাত্র বিছানা থেকে উঠে এসেছে।
‘কী ব্যাপার, জিনাত?’
কোনও উত্তর না দিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল জিনাত। তারপর ঘুরে দাঁড়াল রানার মুখোমুখি। রানার ওপর একবার আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল সে। যেন নিজের বাড়ি। রানাও এল পিছন পিছন। ম্লান সবুজ আলো জ্বলছে, সুইচ টিপে উজ্জ্বল বাতি জ্বেলে দিল সে।
‘কথা দিয়েও এলে না কেন?’ জিনাতের কণ্ঠে তিরস্কার। মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ও রানার।
‘আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
‘টাকা দিয়েছ, সুযোগ নেবে না কেন? মানুষে এমনিতেই ভোগ করতে চায়!’
‘দেখো, জিনাত, মানুষের কথা ছেড়ে দাও। আমি কোনওদিন পুরোপুরি মানুষ হতে পারিনি। টাকার বিনিময়ে তোমার দেহের অধিকার আমি চাই না। সত্যিই চাই না।’
‘বক্তৃতা আরম্ভ করে দিয়েছ দেখছি। তা হলে টাকা দিলে কেন?’
‘ওটা দিয়েছি অন্য কারণে।’
‘দয়া? না পবিত্র প্রেম?’ জিনাতের কণ্ঠে বিদ্রূপ।
‘না। দয়া নয়, প্রেমও নয়—মমতা। তোমার মত আমিও অনেক আঘাত পেয়েছি, জিনাত। আমি জানি তোমার বেদনার জ্বালা। তোমার দেহের লোভেই যদি টাকা দিতাম তা হলে এত টাকা দিতে যাব কেন বলো। এর বিশ ভাগের এক ভাগ দিয়েই তো ইচ্ছে করলে আমি সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারতাম অন্যত্র। ভুল বুঝো না আমাকে, প্লিজ। আমি তোমাকে কৃপা বা দয়া করিনি।’
‘তোমার মমতার কোনও প্রয়োজন নেই আমার, রানা। কারও মমতা, আর আমাকে ফেরাতে পারবে না। একটা কথার সোজা উত্তর দেবে?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘তুমি অপমান করতে চাও আমাকে?’ বিছানার উপর বসল জিনাত।
‘না। ঢের অপমান পেয়েছ তুমি মানুষের কাছে। আর না।’
‘তবে চলে এসো। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। টাকার কথা ভুলে যাও। টাকা না পেলেও আমি আসতাম। তোমার স্পর্শের স্মৃতি আমার জীবনের শেষ স্মৃতি হোক।’
‘তার মানে?’
‘মানে বুঝবার কোনও প্রয়োজন নেই তোমার।’ উঠে দাঁড়িয়ে দুই পা এগিয়ে এল জিনাত। দু’চোখ ধিক্ ধিক্ জ্বলছে তার।
‘দেখ, জিনাত। যে মিলনে প্রেম নেই…’
‘প্রেম আছে!’ বাধা দিল জিনাত দৃপ্ত কণ্ঠে। ‘এক্ষুণি তোমার মনের মধ্যেও জ্বলে উঠবে প্রেমের আগুন। তুমি পুরুষ, আমি নারী। দুজনে চাইব দুজনকে একান্ত করে। এরই নাম প্রেম।’
‘কিন্তু…’
‘কোনও কিন্তু নয়। কোনও কথাই শুনব না আমি।’
রানার আপত্তি দেখে আবার বলল জিনাত, ‘তোমার টাকাটা আমি ধার হিসেবে গ্রহণ করলাম। টাকার বিনিময়ে সুযোগ গ্রহণ করতে হবে না তোমাকে।’
‘আমি যদি না-ও থাকি ও টাকা ফেরত পাবে তুমি।’
রানা ভাবল, না-ও থাকি মানে? কোথাও চলে যাচ্ছে নাকি মেয়েটা? নাকি আত্মহত্যা করতে চায়? ফেরত দেবেই বা কে?
অপলক চোখে চেয়ে রইল রানা এই অদ্ভুত মেয়েটির দিকে। কী হয়েছে ওর? কিসের প্রচণ্ড ধাক্কায় চুরমার হয়ে গেছে মেয়েটির হৃদয়? সহ্যের শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে সে, যেন এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। কিন্তু কেন?
মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল রানা মেয়েটির অতুলনীয় সৌন্দর্য। যৌবন ধন্য হয়েছে ওই দেহকে আশ্রয় করে। উদ্যত ফণা শঙ্খিনীর মত টেনে আনল রানাকে জিনাত অমোঘ এক আকর্ষণে। ঠিক চুম্বকের মত এগিয়ে গেল রানা। একটা হাত রাখল জিনাতের কাঁধে।
‘জিনাত! তুমি…’
‘কোনও কথা নয়।’
একটা আঙুল রাখল ও রানার ঠোঁটের উপর। এক হাতে উজ্জ্বল বাতির সুইচটা নিভিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকের উপর। সবুজ স্বপ্নিল আলোটা জ্বলছে ঘরের ভিতর। রেশমের মত সসৃণ এলোচুল থেকে বিদেশি ক্রিমের সূক্ষ্ম একটা মিষ্টি সুবাস এসে আবেশে আচ্ছন্ন করল রানাকে। হাত ধরে টেনে নিয়ে এল ওকে জিনাত বিছানার পাশে। একটা একটা করে দুজনের দেহ থেকে খসে মেঝেতে পড়তে থাকল ওদের পরনের কাপড়। সবশেষে ঝুপ করে গোল হয়ে মেঝেতে পড়ল পেটিকোটটা।…
চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে জিনাত রানার প্রেম। মুখে মৃদু হাসি, ম্লান সবুজ আলোয় অপরূপ লাগছে ওর হাসি। ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠল জিনাতের মুখটা। নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে কেঁপে কেঁপে উঠল দেহ, কপালের একটা শিরা দপদপ করে লাফাল কয়েকবার।
হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। এলিয়ে পড়ল দেহটা বিছানায়। ওর-স্বেদ সিক্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে গেল রানা—সরিয়ে দিল ও হাতটা।
‘জিনাত! লক্ষ্মী মেয়ে, শোনো। তুমি দেবে না আমাকে কোনও রকম সাহায্যের সুযোগ? জীবনে হয়ত অনেক দুঃখ পেয়েছ তুমি। তেমনি আমিও পেয়েছি, সবাই পায়। কিন্তু জীবনটা অনেক বড়–সামনে হয়তো…’
‘চুপ। এসব কথা শুনতে চাই না আমি। তুমি ঘুমোও তো!’
আবার রানার মুখে হাত চাপা দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল জিনাত! পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল। রানারও প্রায় চোখ লেগে এসেছিল, হঠাৎ সচেতন হয়ে চোখ না খুলেই অনুভব করল ওর কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে নেমে গেল জিনাত বিছানা থেকে। জামা কাপড় পরে নিয়ে চলে গেল সে নিজের ঘরে।
ঘুম আসছে না কিছুতেই। ঘুরে ফিরে কেবল জিনাতের কথা ভাবছে রানা। কে এই মেয়েটি? ভেঙে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পৌঁছে গেছে বেচারী। ওকে ফেরানো যায় না? রানার কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য গ্রহণ করতে রাজি নয় ও। কিন্তু… কিছুই কি করবার নেই রানার? বালিশে জিনাতের চুলের সুবাস, চাদরে গায়ের ক্রিমের গন্ধ। বিছানায় ওর অনুপম দেহের উত্তাপ। কেন জানি নিজেকে বড় অযোগ্য মনে হলো ওর।
শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবছে রানা। তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে টেরই পায়নি ও। ভোর হয়ে এসেছে। সাড়ে চারটে বাজে। মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে এবার ঘুমাবার চেষ্টা করল ও। কম্বলটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুলো। সমস্ত শরীর ঢিল করে দিয়ে ডাকল ঘুমের সুষুপ্তিকে।
এমনি সময় বাইরে করিডোরে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। কেউ হেঁটে চলে গেল ওর ঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে। এত ভোরে কে যায়? জিনাত না তো! দরজাটা নিঃশব্দে খুলে একটু ফাঁক করে দেখল রানা। সত্যি, জিনাত। করিডোরের, মোড় ঘুরে সিঁড়ির দিকে চলে গেল সে। চুলগুলো তেমনি আলুথালু। হাঁটার ভঙ্গিটা ক্লান্ত, অবসন্ন। যেন স্বপ্নের ঘোরে হাঁটছে শ্লথ পায়ে।
কাক-পক্ষীও ওঠেনি এখন। এই ভোর রাতে কোথায় চলেছে জিনাত? হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর কথা মনে আসতেই চমকে উঠল রানা। ছুটে গিয়ে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে স্যাণ্ডেল পায়ে বেরিয়ে এল ও ঘর থেকে।
রানা যখন রাস্তায় নামল জিনাত তখন চলে গেছে অর্ধেক পথ। সেইলরস ক্লাবের পাশ দিয়ে সোজা সাগরের দিকে চলেছে সে। রাস্তা ছেড়ে বালিতে নামল জিনাত। আশপাশে যদ্দূর দেখা যায় একটা জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। পূর্ব দিকের আকাশটায় একটু ফরসা হয়ে আসার আভাস। আবছা কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যায় না। দ্রুত হাটছে রানা। ওর চোখ দুটো স্থির ভাবে নিবদ্ধ সামনের মূর্তিটার উপর। মাথার মধ্যে দ্রুত চিন্তা। তাই একবারও ভাবল না ও পিছন ফিরে চাইবার কথা। চাইলে দেখতে পেত ঠিক বিশ গজ পিছন পিছন আসছে তিনজন ষণ্ডামার্কা লোক। সেই তিনজন।
নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতে চলেছে জিনাত। রানা ভাবছে, কী বলা যায়? এ কী করছ, জিনাত? বললে সোজা উত্তর আসবে, তোমার মাথাব্যথা কিসের? তোমার নোংরা নাকটা না গলালে চলে না? যদি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘আরে, তুমি এখানে? তুমিও খুব ভোরে স্নান কর বুঝি!’ কিংবা ‘হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। ভালই হলো, দেখা হয়ে গেল। চলো না আজ, কোথাও আউটিং এ যাই!’ তা হলে অতিরিক্ত নাটকীয় হয়ে যায়। তা ছাড়া ও যে পরিষ্কার মিথ্যে কথা বলছে, বুঝবে জিনাত। গায়ে পড়ে উপকারের চেষ্টা দেখে বিতৃষ্ণায় ভরে যাবে ওর মন।
তার চেয়ে সত্যি কথাটাই বলবে। তোমার পায়ের শব্দ শুনে পিছু নিয়েছি আমি, জিনাত। কিছুতেই মরতে দেব না আমি তোমাকে। আমার জন্যে বাঁচতে হবে তোমাকে। চলো আমার সঙ্গে। যদি না আসে তা হলে কি জোর করে ধরে নিয়ে আসবে? কিন্তু তাতে বিপদের আশঙ্কা আছে। চিৎকার আর ধস্তাধস্তি করলে লোকজন জমা হয়ে পিটিয়ে লাশ করবে ওকে। কেলেঙ্কারী কারবার হয়ে যাবে। দেখা যাক, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।
সাগরের একেবারে কাছে চলে গেছে জিনাত। দৌড়াতে আরম্ভ করল রানা। ওর পায়ের তালে তালে পিছনের তিনজনও দৌড়াচ্ছে এখন। হাঁটু পানিতে নেমে গেছে জিনাত।
‘জিনাত!’ রানা ডাকল।
চমকে ফিরে চাইল জিনাত। দুই গাল বেয়ে পানি পড়ছে ওর অঝোর ধারায়। আবছা কণ্ঠে বলল, ‘কে! কী চাও তুমি?’
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা, ‘উঠে এসো জিনাত। এভাবে মরতে পারবে না তুমি। কিছুতেই মরতে দেব না আমি তোমাকে।’
কী যেন বিড় বিড় করে বলল জিনাত, রানা বুঝতে পারল না। রানার কাঁধের ওপর দিয়ে ওর দৃষ্টিটা চলে গেছে পিছনে। কী দেখছে পিছনে ভেবে যেই রানা পিছন ফিরতে যাবে ওমনি কথা বলে উঠল একজন উর্দুতে। আদেশের সুর সে কণ্ঠে।
‘খবরদার! মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও। এক ইঞ্চিও নড়বে না!’
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। যমদূতের মত দাঁড়িয়ে আছে সেই তিনজন পাঠান। স্থির, নিশ্চল। খালি হাতে থাকলে হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারত রানা। কিন্তু দেখল তিনজনের হাতেই তিনটে চকচকে রিভলভার, ওর দিকে ধরা। ধীরে হাত তুলল রানা মাথার উপর।
ব্যাপার কী? কারা এরা? সাধারণ চোর হ্যাঁচোড় তো নিশ্চয়ই নয়। আজ তিনদিন ধরে লক্ষ্য রাখছে এরা ওর ওপর। ওর পরিচয় কি প্রকাশ পেয়ে গেল শত্রুপক্ষের কাছে? আজ এই ভোর রাতে যখন ধাওয়া করে এসেছে পেছন পেছন তখন নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে ওদের। নারী দেহের লোভে যে এসেছে তা মনে হয় না। এটা তার উপযুক্ত সময় নয়। তা হলে? কী চায় এরা? ওকে ধরিয়ে দেবার জন্য মেয়েটিকে ওর জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি তো?
এখানেই ওকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে ওদের নেই বোঝা গেল। আওয়াজ শুনে হোটেল থেকে লোকজন বেরিয়ে আসবে, সেজন্যেই হয়ত দুজন রিভলভার ধরে থাকল, আর তৃতীয়জন তার রিভলভারটা পকেটে পুরে দ্রুত পরীক্ষা করল রানার সাথে কোনও অস্ত্র আছে কি না। কিছু নেই। রানা বুঝল। এই সুযোগ। অন্তত কিছুক্ষণ দেরীও যদি করানো যায় তা হলে ভাগ্য প্রসন্ন। থাকলে কোনও না কোনও সাহায্য এসে যেতে পারে। গুলি ওরা নেহাত নিরুপায় না হলে ছুঁড়বে না। খপ করে লোকটার ডান হাতটা কব্জির কাছে ধরেই বাম হাতে কনুইটা ঠেলে ওপর দিকে ওঠাল রানা। এটা যুযুৎসুর খুব সহজ একটা প্যাঁচ। বেকায়দা অবস্থায় পিঠের দিকে চলে এল হাত-শরীরের উপর দিক ঝুঁকে পড়ল সামনে। মাঝারি রকমের একটা চাপ দিতেই মুখ দিয়ে আল্লার নাম বেরিয়ে পড়ল লোকটার। আরেকটু জোরে চাপ দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে কাঁধের হাড়। এমন সময় দেখা গেল একটা জিপ এগিয়ে আসছে বালুর উপর দিয়ে।
রানা ভাবল, এইবার ব্যাটাদের দেখে নেবে। সোজা শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে বাছাধনেরা। জিপের আরোহী যে-ই হোক না কেন, নিশ্চয়ই ওর এই বিপদে সাহায্য করবে। কিন্তু মেয়েটা সম্পর্কে কী গল্প বানিয়ে বলবে ও? এই ভোর। রাতে সাগর পারে কেন আসে একজন ভদ্রমহিলা? তার ওপর এমন আলুথালু বেশ।
ওদের দেখতে পেয়েছে জিপের ড্রাইভার। সোজা এগিয়ে আসছে এদিকে। জয়ের উল্লাসে রানা বলল, ‘এখনও সময় আছে, বাপ। তোমরা দুজন কেটে পড়তে পার ইচ্ছে করলে–কিন্তু এই শালাকে ছাড়ছি না।’
কোনও রকম ভাবান্তর হলো না রিভলভারধারীদের চেহারায়। একজন শুধু কাছে এসে চট করে তৃতীয়জনের রিভলভারটা তুলে নিল ওর পকেট থেকে। তারপর আবার কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নির্বিকার চিত্তে। জিপটা কাছে এসে থামতেই লাফিয়ে নামল আরও দুজন। চুপসে গেল রানার সব উৎসাহ। চেহারা দেখেই বোঝা গেল একই দলের লোক।
এবার পরিষ্কার ইংরেজিতে একজন বলল, ‘বাধা দিলে বেহুদা জখম হবে, মিস্টার। হাতটা ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে এসে বসো।’
রিভলভার দিয়ে ইঙ্গিত করতেই জিনাত গিয়ে উঠে পড়ল জিপের পিছনে। রানা বুঝল বাধা দিয়ে এখন লাভ নেই। ও-ও ভালমানুষের মত গিয়ে বসল জিনাতের পাশে। রানার কাবু করে ফেলা তৃতীয়জন ড্রাইভারের পাশে বসল ডান কাঁধটা ডলতে ডলতে। বাকি চারজনও উঠে বসল গাড়ির পেছনে ঠাসাঠাসি করে। জিনাতকে অভয় দেয়ার জন্যে ওর উরুতে একটু চাপ দিল রানা এক হাতে। আর একটু কাছে ঘেঁষে এল, জিনাত প্রত্যুত্তরে।
একটা ব্যাপার রানা লক্ষ্য করল যে জিনাতের প্রতি এতটুকু অশ্লীল ইঙ্গিত করল না একটি লোকও। এমনকী ওর দিকে চোখ তুলেও চাইছে না কেউ। সাধারণত স্ত্রীলোককে হাতের মুঠোয় পেলে পুরুষ দুর্বৃত্ত যে ব্যবহার করে থাকে তার কিছুমাত্র প্রকাশ পেল না ওদের ব্যবহারে। দ্বিতীয়বার ভাবল রানা, জিনাত কি টোপ হিসেবে কাজ করল? ওরা একজনকে বন্দি করল, না দুজনকেই? ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে কেউ? না, কি কোনও প্রেমিক বা স্বামীর ক্রুদ্ধ প্রতিশোধ? এর শেষ কী? নির্যাতন? খুন?
টাওয়ার ছাড়িয়ে ম্যাকলিওড রোডে পড়ল জিপ। নিউ স্টেট ব্যাঙ্ক বিল্ডিং পার হয়ে ঢুকল উডস্ট্রিটে, তারপর বার্নস রোড। নাজিমাবাদের দিকে চলেছে ওরা।
চমৎকার একটা দোতলা বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল জিপ। আরও চারজন পাঠান বেরিয়ে এল। একটিও বাক্য বিনিময় হলো না। চারদিক থেকে ঘিরে রানা এবং জিনাতকে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ির ভিতর। লোকগুলোর চলাফেরা হাবভাব ঠিক চাবি দেয়া যন্ত্রের মত।
কিছুদূর গিয়েই বাঁয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। রানাও জিনাতের পিছু পিছু উঠতে যাচ্ছিল ওপরে। বাধা দিল একজন।
‘তুম ইস্তারাফ।’
ডানধারের দরজা দিয়ে ভারী একটা পর্দা তুলে ঢোকানো হলো রানাকে। চমৎকার সুসজ্জিত একটা ওয়েটিং রুম। অতিথিদের অপেক্ষা করবার জন্য। ঘরের চারকোণে পা-লম্বা টেবিলের উপর চারটে ফ্লাওয়ার ভাসে তাজা ফুলের তোড়া। ওপাশে আরেকটা ঘর। বোধহয় ড্রইং-রুম। সেই দরজাতেও দামি পর্দা ঝোলানো।
রানাকে সম্পূর্ণ আওতার মধ্যে পেয়ে ওদের সতর্কতায় একটু ঢিল পড়েছিল। তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল রানা। পিছনে না চেয়েই ডান কনুইটা রেল ইঞ্জিনের পিস্টনের মত সজোরে চালিয়ে দিল ও পিঠের সাথে ঘেঁষে থাকা লোকটার পেটের উপর সোলার প্লেক্সাসে।
‘ঘোঁৎ’ করে একটা শব্দ বেরোল ওর মুখ দিয়ে। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে টান দিয়ে রিভলভারটা বের করে নিল রানা ওর ওয়েস্টব্যাণ্ড থেকে। কেউ কিছু বুঝবার আগেই একলাফে হাত চারেক পিছিয়ে এল সে।
‘হ্যাণ্ডস আপ! দুই হাত ঘাড়ের পিছনে তুলে দাঁড়াও সবাই।’
বুড়ো আঙুল দিয়ে হ্যামারটা তুলল রানা রিভলভারের। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে একজন। বাকি তিনজন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে হাত তুলে দাঁড়াল। আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেল রানা। এমন সময় ঠিক কানের কাছে একটা মোলায়েম পুরুষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘সাবাস, মাসুদ রানা! কিন্তু পেছন দিকটাও একটু খেয়াল রাখতে হয়। কেবল সামনের দিকে নজর রাখলে কি চলে? চারদিক সামাল দিতে পারলেই না বলব সত্যিকারের হুঁশিয়ার।’
অত্যন্ত গুরু গম্ভীর, কিন্তু ভদ্র মার্জিত কণ্ঠস্বর। রানা বুঝল হেরে গেছে সে। ভাবল, ঘুরে দাঁড়িয়েই গুলি করবে, যা থাকে কপালে। ঠিক যেন ওঁর চিন্তাটা বুঝতে পেরেই আবার কথা বলে উঠল পিছনের লোকটি। উর্দুর মধ্যে ফ্রন্টিয়ারের টান।
‘আমাকে মেরে কোনও লাভ নেই, মিস্টার মাসুদ রানা। আমি আপনার শত্রু নই। তা ছাড়া ঘুরে দেখুন, আমি নিরস্ত্র। আপনি আমার মেহমান। কেউ কিছু বলবে না আপনাকে।’
ঘুরে দাঁড়িয়ে রানা দেখল ডান হাতে পর্দাটা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রৌঢ় পাঠান। পরিষ্কার করে গোঁপ-দাড়ি কামানো। মুখে স্মিত হাসি। প্রশস্ত কপালে বুদ্ধির ছটা। কানের কাছে চুলগুলোতে পাক ধরেছে। লম্বায় রানার চেয়ে ইঞ্চি চারেক ছোট হবে। কিন্তু প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল অসুরের শক্তি আছে ওই পেশিবহুল দেহে। আর বুকের মধ্যে আছে দুর্জয় সাহস। রানা ঘুরতেই পিছন থেকে এগিয়ে আসছিল দুইজন। হাত উঠিয়ে থামতে ইশারা করল ওদের দলপতি। পশতু ভাষায় কিছু বলল। মাটি থেকে টান দিয়ে তুলল ওরা আহত সঙ্গীকে। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
‘আসুন। ভেতরে আসুন, মিস্টার মাসুদ রানা। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার। কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে। আপনার হাতে রিভলভার আছে। ইচ্ছে করলেই আমাকে খতম করে দিতে পারেন আপনি। কাজেই নিজেকে বন্দি মনে করবেন না। আমিই বরং আপনার বন্দি।’
হাসল ভদ্রলোক। অদ্ভুত আকর্ষণীয় হাসি। রানার মনে হলো কোথায় যেন দেখেছে আগে এই হাসি। কিন্তু স্মৃতির পাতা হাতড়ে এই মুখটা কিছুতেই মনে পড়ল না ওর। হাসিটার অদ্ভুত একটা সংক্রামক গুণ আছে। রানাও না হেসে পারল না। বহুদিন পর এমন সজীব, প্রাণবন্ত, ক্ষমতাবান একজন মানুষের মুখোমুখি হলো ও। লোকটার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ আছে, মুখের মধ্যে একটা বাল্ব ধরলে দপ করে জ্বলে উঠবে। নিজের অজান্তেই প্রসন্ন হয়ে উঠল রানার মনটা।
লোকটার পিছনে দরজার গায়ে ক্যালেণ্ডার ঝুলছিল একটা। মার্চ আর এপ্রিল মাস পাশাপাশি। হঠাৎ ‘এপ্রিল ফুল’ বলেই গুলি ছুঁড়ল রানা। পয়লা এপ্রিলের ছোট্ট চারকোণা ঘরের মধ্যে গিয়ে লাগল গুলিটা দলপতির কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল পাঠান ক্যালেণ্ডারটা।
‘সাবাস! বাঙ্গাল কা শের হো তুম, মাসুদ রানা।’ অব্যর্থ লক্ষ্য দেখে তারিফ করল সে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার নাম খান মোহাম্মদ জান। শুনেছেন কখনও?’
‘না।’ ইটের মত শক্ত হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল রানা। নামটা চেনা চেনা লাগলেও মনে করতে পারল না ও কোথায় শুনেছে।
‘তাই নাকি? আশ্চর্য! কিন্তু আপনার নাম-ধাম পরিচয় সব আমার নখদর্পণে। আপনি পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এই ডিপার্টমেন্টে আসার আগে আপনি আর্মিতে মেজর ছিলেন। করাচি এসেছেন স্বর্ণমৃগ শিকার করতে। কি? ঠিক বলিনি?’
উজ্জ্বল হয়ে উঠল মোহাম্মদ জানের মুখ। মুখে সক্রামক হাসি।
রানা নিজের বিস্ময় গোপন করে জিজ্ঞেস করল, ‘আর আপনি কোথাকার জ্যোতিষ্ক, জানতে পারি?’
‘আমি মালাকান্দের ট্রাইবাল চিফ।’