» » মানুষের ঘরবাড়ি

বর্ণাকার

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

মানুষের ঘরবাড়ি

মানুষের ঘরবাড়ি

‘লেখক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ে’র ‘দেশভাগ সিরিজে’র প্রথম বই ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’। বইটাতে দেশ বিভাগের আগের গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজ ব্যবস্থা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, একক ও যৌথ পরিবারের সুখ দুঃখের এক অভূতপূর্ব অনুভূতির ছোঁয়া রেখে গেছে।

‘দেশভাগ সিরিজে’র দ্বিতীয় বই ‘মানুষের ঘরবাড়ি’ প্রথম পর্বের চরিত্র গুলো আস্তে আস্তে এক অপরের থেকে ছিন্ন হয়ে গেছে এখানে এসে। যেখানে ছিন্ন মূল মানুষ গুলো আশ্রয়ের আশায় খুঁজে চলছে; মানুষের ঘরবাড়ি। সোনা চরিত্রটি এখানে এসে বিলুর মাঝে ঘুমিয়ে গেছে। সব কিছু ছেড়ে আসা মানুষ গুলো পথে পথে ঘুরে, স্টেশনে রাত কাটিয়ে একটা সময় এসে নিজেদের আবিষ্কার করে ‘মানুষের ঘরবাড়ি’র মাঝে।

দেশভাগ হয়ে গেলে নিজেদের ভিটে ছেড়ে দেশান্তরী হতে হয়েছিল বিলু আর তার পরিবারকে। বিশাল একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গিয়েছিল নতুন দেশে গিয়ে। অতঃপর বাবা, মা, ভাইবোনের সাথে বিলুর নতুন যাত্রা।

বিলুরা ব্রাহ্মণ, বাবা নিজ দেশে জমিদারের সেরেস্তায় কাজ করতেন। কিন্তু নতুন দেশে এসে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। পৌরোহিত্য করাই স্বাভাবিক কিন্তু রিফিউজিদের যে ঢল নেমেছে তার মাঝে অনেকেই নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে। সুতরাং নতুন দেশের মানুষেরা সহজে কাউকে বিশ্বাস করে না। তাই বিলুদের ভেসে যাওয়া চলে। কখনও কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায়, কখনও রেল স্টেশনে কেটে যায় তাদের কয়েকটা দিন। সে সময়ে বাবা তার চলে যায় কোথায়, কাউকে কিছু না বলে। সে সময় বিলুর ছোট ভাই পিলু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সবার জন্য খাবার চুরি করতেও দ্বিধা করে না।

এমন অবস্থায় অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে বিলুর বাবা কোথায় নিয়ে এলেন তাদের। এক বনের প্রান্তে এসে বললেন সে জমি কিনেছেন তিনি। ওখানেই হবে তাদের নতুন ঘরবাড়ি।

সে অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল কেবল বিলুদের জন্যই নয়। সাতচল্লিশ পরবর্তী অনেক মানুষের এই একই গতি হয়েছিল। তাদের প্রাথমিক গল্পটা অনেকটা এরকম। নিজ ভিটে, স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে হঠাৎ শেকড় ছাড়া হয়ে যাওয়া। তারপর থিতু হয়ে বসার চেষ্টা। সে চেষ্টায় সফল হয়েছিলেন বিলুর বাবা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হয়েছিল বিলুদের নতুন ঘরবাড়ি। এ পর্যন্ত গল্পটা কেবল বিলুর না, তার মতো অনেকেরই।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেশভাগ’ সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘মানুষের ঘরবাড়ি’। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসের সোনা, এখানে বিলু বা বিল্ব। দেশ ছেড়ে আসার পর কেমন করে তাদের দিন কেটেছিল, কেমন করে তাদের নতুন আবাস হলো সে গল্পই লেখক এখানে লিখেছেন। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে যেমন বিমূর্ত ছিল, এ উপন্যাস তেমন নয়। এখানে নিরেট একটা গল্প আছে, যেখানে ধীরে ধীরে একটি পরিবার বিকশিত হয়। ছিন্নমূল থেকে নিজেদের বসত গড়ে।

সেই সঙ্গে আছে অবশ্যম্ভাবী প্রকৃতির বর্ণনা। তবে এ পর্বে সে বর্ণনা বিলুদের বাড়ি এবং তার পারিপার্শ্ব কেন্দ্রিক। বিলুর বাবার মাধ্যমে, কখনও পিলুর মাধ্যমে তা লেখায় এসেছে।

কিন্তু মূলত এ গল্প বিলুর। ইংরেজিতে ‘কামিং অফ এজ’ বলে একটা কথা আছে যার মানে, কৈশোর থেকে কারও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। এ উপন্যাসে বিলুর সেই সময়টার চিত্র খুব সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। ঘরবাড়ি তৈরি হওয়ার পর তার পরীক্ষা দেওয়া এবং পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ সত্ত্বেও যখন তাকে কাজে লাগানো হয় তখন বাড়ি ছেড়ে পালায় বিলু। পিতার স্বভাব বর্তেছে পুত্রে। কেবল বিলু একা না, পিলুও ঘরে থাকে না। চলে যায় এদিক সেদিক।

বিলুর বড় হয়ে ওঠা, নিজের সাথে নিজের সংঘাত, সেই সঙ্গে পরিবার পরিবেশের সাথে ঘটে যাওয়া দ্বিধা দ্বন্দ্ব এ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। আর তা পরিণতি পায় যখন উপন্যাসে লক্ষ্মীর আগমন হয়। বিলুর প্রথম টিউশন পড়ে যে বাড়িতে তা মূলত কালী মন্দির। সে বাড়িতে আশ্রিতা মেয়ে লক্ষ্মী। বিধবা মেয়েটির সঙ্গে বিলুর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে না চাইতেই। আর লক্ষ্মীর কারণেই বিলুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে মিমির। যে মিমির আসল নাম মৃন্ময়ী। বিলুরই কলেজের সহপাঠিনী। এক পুরুষকে দুই নারী অধিকার করতে পারে না। লক্ষ্মীর বেলায় বিলুকে পাওয়া তার সম্ভব ছিল না।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসে দেখিয়েছেন, ক্রমাগত দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠা একটি ছেলের মানসিক দ্বন্দ্ব। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের কাছ থেকে তার দূরে সরে যাওয়া। যাকে মনে মনে ভালোবাসে, তাকে কাছে টেনে নিতে না পারার দহন আর নিজে কিছু হয়ে ওঠার এক প্রচেষ্টা। কৈশোরের শুরু থেকে যৌবনের প্রারম্ভ পর্যন্ত তার সে টানাপড়েন তাকে ধীরে ধীরে একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। মানুষের ঘরবাড়িতে বসে আমরাও সে যাত্রার সঙ্গী হই।

লেখক-পাঠক সর্বসম্মতিক্রমে এ উপন্যাস অতীনের সিরিজের দ্বিতীয় বই হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি লেখা হয়েছে পরে। লেখকের মনে হয়েছিল একটা অংশ বাদ পড়ে গেছে। সেটি তিনি লিখেছিলেন। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র মতো এ উপন্যাস বহুমুখী ও জটিল নয়। এ উপন্যাসের গল্পটা সরল। কিন্তু মানসিক জতিলতার সাথে সামাজিক অবস্থা মিলে জীবনটা সেখানে কিছুটা জটিল।

সম্ভবত লেখক এ উপন্যাসের নানা অংশ নানা সময়ে অনেকদিন ধরে লিখেছেন। তাই পুনরুক্তি আছে অনেক জায়গায়। সিরিজের অংশ হলেও এ বই স্বতন্ত্র উপন্যাস। লেখনী সহজ সরল। তবে কৈশোরের মানসিক দ্বন্দ্ব এতোটাই গোলমেলে যে মাঝে মাঝে বিলুকে ধরে মারতে মনে চাইতে পারে পাঠকের।

উপন্যাসের এক অসামান্য চরিত্র পিলু। বিলুর এ ছোট ভাইটির কোন ভালো নাম লেখক আমাদের বলেননি। কিন্তু পিলু নামেই সে প্রিয় হয়ে উঠবে সকলের। বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটির বড় মায়া। তাই সে কখনও একটা কুকুর ধরে আনে, কখনও হনুমানের বাচ্চা। আবার পরিত্যাক্ত জঙ্গলেই সে খুঁজে পায় এক বুড়ির ঠিকানা। নবমী নামে সে বুড়ি বুঝি হয়ে ওঠে ইন্দির ঠাকরুন। বিলুর মা হয়ে ওঠেন সর্বজয়া আর বিলুর বাবা হরিহর। অন্তত বিলুর বাবা চরিত্রটি কিছুটা হরিহরের মতোই। অদৃষ্টে-দেবতায় বিশ্বাসী মানুষটি কিছুটা বাউন্ডুলে স্বভাবের। অন্তত স্ত্রীর মতো তিনি বিষয়ী নন। অথচ কি মমতা দিয়েই না তৈরি করেছেন মানুষের ঘরবাড়ি। যেখানে বিলুর মতো অন্তর্মুখী ছেলের টানে ছুটে আসে রায় বাহাদুরের নাতনী মিমি। অথচ বিলু পালিয়ে বেড়ায়। পিলু খুঁজে বেড়ায় তার দাদাকে।

উত্তম পুরুষে বর্ণিত তিন খণ্ডের এ উপন্যাসের মূল চরিত্র বিলু হলেও পুরোটা জুড়ে পিলু বুঝি তার ছায়া হয়ে থাকে। আর মাঝে মাঝে সে ডেকে ওঠে, ‘দাদারে…’। সে ডাক, যে কোন পাঠকের কলজে কামড়ে ধরবে।

নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে সিরিজ লেখার পর অতীন বাবুর মনে হলো, জীবনের আসল পর্বটা বাদ পড়ে গেছে সিরিজ থেকে। সেই পর্বটা পরবর্তীতে লিখে সিরিজের মাঝে আনা হয়। প্রথম পর্বের চরিত্ররা এ পর্বে অনুপস্থিত। সোনা এ পর্বে ঘুমিয়ে আছে বিলুর মধ্যে।

নামটাতেই অভিমান জড়িয়ে আছে। মানুষের ঘরবাড়ি থাকে। আমাদের তাও নেই। দেশভাগের পর ছিন্নমূল এক পরিবারের সংগ্রাম শুরু হয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যাত্রা। বিনা টিকিটে। আজ এখানে, তো কাল সেখানে। এক সময় তারা দুবেলা পেটপুরে খেয়েছে, গোলাভরা ধান,‌ গাই-গরু কিছুরই অভাব ছিল না। এদেশে এসে তাদের শেষ সম্বলটুকু ক্ষুধার নিমিত্তে আহারে পরিণত করতে হয়েছে। আর বাকি সম্বল‌ এটুকুই—তারা সৎ ব্রাহ্মণ।

পরিবারের বড় ছেলে বিলু। উপন্যাসের একটি বড় খণ্ড বিলুর ভাষ্যে বর্ণিত। বয়সন্ধিকালে আত্মসম্মানবোধ সবার মধ্যে বেশি কাজ করে। পরিবারের আর্থিক অবনতি, জলে পড়ে যাওয়া, তারা যে আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রিত, এদেশের মানুষের কাছে রিফুজি, বারো-তেরো বছরের বিলুর মনে তা ভীষণ পীড়া দেয়।

ঘুরেফিরে একসময় ঘরবাড়ি মেলে তাদের। দারুণ গর্বের বিষয় ছিন্নমূল পরিবারটির জন্য। থাকা খাওয়া হলে তখন বড় ছেলেটির পড়াশোনায় মন দিতে হয়। বিলুর আলাদা একটা জগত গড়ে ওঠে পরিবারের বাইরে।

বাবা সরল মানুষ—কার বাড়িতে ঠাকুর পূজা, কোথায় বামুন ভোজের জোগাড় চাই—এসব করে তার দিন যায়। মা বড্ড সাংসারিক—বাগানের বাড়তি সবজিটুকু, গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম বেঁচে যা সামান্য আয়, তা থেকে সঞ্চয়। একসময় সবই হয়ে যায়— ঘরবাড়ি হয়, দুটো তক্তপোশ, বাইরের ঘরে একটা জলচৌকি। বড় পুত্র মাধ্যমিকে দশটা বিষয়ের ন’টাতে পাশ। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাশ করে। নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত হওয়ার আশাবাদী যাত্রা।

শহর ঘুরে আসে বিলু। পরিবারের আচার-আচরণে যথেষ্ট সচেতন সে। বিব্রত হয় ভাইয়ের খাই খাই স্বভাবে, বাবা-মায়ের সীমাহীন পুত্রগর্বে। কৈশোর তারুণ্যের মাঝামাঝি সময়টাই বুঝি এমন। বড্ড ছোট মনে হয় তখন পরিবারের গণ্ডীটা। যে পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা তার জন্যই বিব্রত হওয়া। ভিতরে তাদের জন্য যে গভীর টান, তা প্রকাশ করতেও কুণ্ঠা।

ছিন্নমূল পিতার সন্তান—যেকোনভাবে পারি তার থেকে পরিত্রাণ চাইছি।

এভাবে বিলু বড় হয়। জীবনের একটা অচেনা পর্ব তার সামনে প্রকাশ হতে থাকে। বিলুর মাথায় ঘোরে ছোড়দি, লক্ষ্মী, পরী। ভালই তো বেড়ে উঠছিল বিলু, তখনই জীবনের এই অদম্য পর্বে তার প্রবেশ। জানালায় তাকালে সে দেখে ছোড়দির নীল খাম, সাইকেলের ক্যারিয়ারে তাকে উঠিয়ে ছোড়দির দুরন্তপনা। অন্যমনস্ক হয়ে যায় বিলু জীবনের এই গোপন রহস্য অনুধাবন করতে।

মাথার ভীষণ যন্ত্রণা কবিতায় রূপ নিতে থাকে। জীবনানন্দের সুর সেই কবিতায়।

ভূমিকায় লেখক লিখেছেন খুব চাপ সৃষ্টি না হলে তাঁর লেখা হয় না। উপন্যাসের বিলু কি লেখক নিজেই— বন্ধুদের চাপে যে কবিতা লেখে।