ঘাসের উপর শুয়ে যেন স্বপ্ন দেখছিলাম। টিউশনিটা ছাড়তে পারছি না। অথচ বড় ইজ্জতে লাগছে। চাকর-বাকরের মতো ব্যবহার। এমন কি এক কাপ চা পর্যন্ত দেয় না। সাহেবের বাপ কাছ থেকে নড়ে না। মেয়ে দুটো পড়ে, আমি বসে থাকি, অংক না পারলে বুঝিয়ে দিই, ইংরাজী ট্রান্সলেশন করবার সময় বুক কাঁপে। কোথায় কি ভুল করে না বসি। সব যে ঠিক হয়না বুঝতে পারি। তবে সাহেবের বাবাটির ইংরাজি জ্ঞান আমার চেয়ে প্রবল নয়। টাসক করাবার পর বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় সব ভুল না হয়ে যায়। একেবারে যে হয় না তা নয়। ছোটটির না হলেও বড়টির বেলায় হামেশাই হয়। বড়টির কেন জানি, মাষ্টার মশাইর প্রতি সামান্য মায়া জন্মেছে। স্কুলে ঠিকঠাক করে দিলে, স্কুলে বসেই ফেয়ার করে নেয়। দাদুকে বুঝতে দেয় না মাষ্টার মশাই ভুল শিখিয়ে গেছেন। দাদু খাতা দেখতে চাইলে ফেয়ার করা খাতাটি দেখায়। এই আকর্ষণটুকুর জন্যই এখনও টিউশনিটা ছাড়তে পারছি না। আর দেখছি বড় মেয়ে নমিতা মানে নমু, আমার দিকে চোখ তুলে কথা বলতে ভরসা পায় না। চোখে চোখ পড়ে গেলে নামিয়ে নেয়। দাদুটি কি বোঝেন কে জানে, নমুর দিকে তাকিয়ে বলেন, কোথাও অসুবিধা হলে বলবে। লজ্জার কি, ও তো কলোনির ছেলে!
আমিও বলি, সত্যি লজ্জার কি আছে। আমি তো তোমাদের মাষ্টার মশাই। কলোনিতে থাকি।
আসলে বুঝতে পারি, ফ্রক পরে সে আমার কাছে বসে থাকতে লজ্জা পায়। যতই আমি কলোনির ছেলে হই না কেন, তার কাছে আমার যেন কিছুটা মর্যাদা আছে। কেন যে এ বয়সে ফ্রক পরিয়ে রাখা তাও বুঝতে পারি না। একদিন দেখলাম নমিতা শাড়ি পরে সেজে গুজে আমার সামনে পড়তে বসেছে। এবং ক্রমে বেশ চোখে ধার উঠে যাচ্ছে। এতেও বুক কাঁপে। পরী অর্থাৎ মিমির চোখে এসব আমি লক্ষ্য করে জেনে গেছি—মেয়েদের চোখে একজন পুরুষের সম্পর্কে কখন কি দুর্বলতা দেখা দেয়—চোখের চাউনিতে তার আভাস থাকে। এসব কারণেও ভারি ডিপ্রেসড় থাকি। মুকুল তা টের পায়।
সে বলে, কি হয়েছে তোমার। কেবল চুপচাপ থাক। মাসিমা তো সেদিন কান্নাকাটি করল। তুমি নাকি বলেছ, টিউশনি ছেড়ে দেবে।
—ধুস, ভাল্লাগে বল। আমি যেন বেটা চোরের দায়ে ধরা পড়েছি। ওর দাদুটা কি ভাবে। কলোনিতে থাকি বলে আমরা কি মানুষ না। সব সময় সামনে বসে থাকে। নাতনিদের পাহারা দেয়। বল, খারাপ লাগে না?
—কিছু বলেছে?
—বলতে হয়! আমি কিছু বুঝি না মনে কর। দাদুটি সব সময় ঘরে থাকলে কেমন লাগে বল। মেয়ে দুটোই বা কি ভাবে। আমি তোর নাতনিকে ফুসলে ফাসলে পালাব ভাবছিস! অথচ দ্যাখ কি মজা, ছাড়িয়েও দিচ্ছে না।
–বাপটা কি বলে?
—উনি তো সাহেব মানুষ। পড়ার ঘরের ভিতর দিয়ে যান আসেন। কথা বলেন না। আমার সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত সম্মানে তাঁর বাধে। সব সময় ব্যস্ত। বাড়িতে লম্বা আলখেল্লার মতো সিল্কের কি এক বিদঘুটে পোশাক পরে থাকেন। মুখে চুরুট। আর দেখলে কি সব কথা। কলকাতা, দিল্লী, বোম্বাই—যেন শুনিয়ে দেওয়া বোঝ আমি কত দরের। কাপড়ের সেরা দোকান
—মা-টা আসে না?
—কখনও মুখ দেখিনি।
–মাসিমা যে বলল, তোমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
—ওটা মা-র কথা, বাবার কথা। বাদ দাও। লতাপাতায় কি সম্পর্ক আছে। মাস দুই হয়ে গেল, একবারও জানতে চায়নি আমার বাবামশায়টি কেমন আছেন।
—অদ্ভুত তো। আগে মেসোমশাইকে চিনত।
—বাবা তো বলেন, মনোমোহন কাকা।
—কাকা হয়ে ভাইপো সম্পর্কে এত নীরব!
—আর নীরব। একদিন বলে কি জান?
—কি বলেন?
—তোমার বাবা কি করেন? আমার ইচ্ছে হয়েছিল বলি হাতি বেচা কেনা করেন। বলতে বাধল, শত হলেও বাবার খুড়োমশাই। আচ্ছা, কি বলা যায় বলত। বাবা তো যজন যাজনে ব্যস্ত। বাবা পুরুতগিরি করে বলতে লজ্জা লাগে না! বাপ পুরুতগিরি করে জানলে মেয়ে দুটোই বা কি ভাববে!
মুকুল বলল, এ যে দেখছি খুবই বড় সংকট। সুতরাং সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবার একটাই পথ। যে করেই হোক কাগজটা বের করতে হবে। পরী এলে তুমি যাও। পরীর সঙ্গে নিখিলেরও ভাব আছে। ওরা দুজনেই যখন পার্টি করে তখন সংকট থেকে তারাই আমাদের উদ্ধার করতে পারে।
আমরা বুঝতে পারি আসলে দু’জনেই আমরা ভালবাসার সংকটে পড়ে গেছি। আমার বেলায় মিমি, কিংবা ম্যানেজার সাহেবের বড় মেয়ে নমিতা। আর মুকুলের বেলায় চৈতালি। মিমি আমাকে ভালবাসে না, বরং আমাকে নিয়ে মজা করতে ভালবাসে।
আর মুকুলের ভালবাসার সংকট আবার অন্যরকমের। চৈতালির সঙ্গে তার আলাপই নেই। আজ পর্যন্ত একদিনও সে কথা বলে নি। শুধু তার বৌদি চৈতালির দিদিকে চেনে। কলেজে একসঙ্গে পড়ত। শহরের ফাংশানে চৈতালি নেই ভাবা যায় না। উদ্বোধন সঙ্গীত কিংবা রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ওর প্রোগ্রাম ঠাসা। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা ওর গান শুধু শুনি। মুকুল কবিতা লেখে, চৈতালি রবীন্দ্রসঙ্গ তি শিল্পী আর দেখতেও ভারি সুন্দর। এই একটা জায়গায় মুকুলের মনে হয়েছে, পৃথিবীতে একজন পুরুষই তার সঙ্গী হতে পারে। সে স্বপ্নেও চৈতালিকে দেখে। বিকাল হলেই সে আর ঘরে থাকতে পারে না। মন নাকি তার উদাস হয়ে যায়। যে করেই হোক চৈতালিকে একবার দেখতে না পেলে দিনটা তার মাটি।
মুকুল ঠিক টের পায়। বলে, না নেই। চল টাউন হলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। রিক্সা করে ফিরতে পারে।
—কোথায় যায়?
—কে জানে! আসলে কি জান, ও ঠিক টের পেয়ে গেছে আমি ওকে ভালবাসি। চৈতালিকে লুকিয়ে রেখে মুকুলকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার কোনো মানে হয়। আমাদের এটাও ইজ্জতের প্রশ্ন এখন। একটা কাগজ বের করতে পারলে বোঝানো যাবে আমরা একেবারে ফ্যালনা লোক নই।
মুকুল বলল, প্রেসে গেছিলাম।
—প্রেস ঠিক করে ফেলেছ?
—ঠিক হয় নি। তুমি তো জান, দিলীপদের প্রেস আছে, ওকে বললে কেমন হয়।
দিলীপ আমাদের কলেজের সহপাঠী। ওর বাবাকে দেখেছি। খাগড়া যেতে প্রেসটা পড়ে। বান্ধব প্রেস। একটা টেবিলে ওর বাবা চশমা চোখে বসে থাকে। সকাল বিকাল সব সময়। সন্ধ্যায়ও। ঝাঁটা গোঁফ। গোলগাল চেহারা। লোকটাকে দেখে খুব আমার ভাল লাগেনি। দিলীপ কলেজ ম্যাগাজিনে একটা গল্প দিয়েছিল। পরী সেটা ছাপেনি। সুতরাং কতটা সুবিধা মিলবে বোঝা মুশকিল।
দেখি পেছনে কখন নিখিল এবং সুধীনবাবু এসে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়টা আমরা গাছের নিচে গোল হয়ে বসে আড্ডা মারি। শহরের উঠতি যুবা আমরা। সবাই ভালবাসার ব্যাপারে নানারকম জটিলতায় ভুগছি। সুধীনবাবু ব্যর্থ প্রেমিক। নিখিল তার এক দূর সম্পর্কের পিসতুতো বোনের প্রেমে পড়ে গেছে। প্রণব পাশের বাড়ির মেয়ে অপর্ণার সঙ্গে ভাবটাব করছে। প্রণবের বাবা, নিচের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে বিকাল বেলাটায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন। যেমন লম্বা, তেমনি দশাসই চেহারা। মাসিমা এবং মেসোমশাই আমাদের দেখলেই বড় প্রীত হন। গেলেই, এক কথা, যাও, উপরে উঠে যাও। প্রণব আছে। ও লিখছে।
ছেলের জন্য এলাহি ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দোতলায় একটা বিশাল ঘর প্রণবের একান্ত নিজস্ব! সেখানে গেলে প্রায়ই দেখি, রায়বাবুর বড় মেয়ে প্রণবের চেয়ার টেবিল বই পত্র এবং বিছানা ঠিকঠাক করছে। একেবারে বাড়ির মেয়ের মতো। কিন্তু প্রণব মেয়েটি সম্পর্কে কোনো আভাসই আমাদের দেয় না। ভালবাসে, না, বাসে না তাও বলে না। আমরা যখন আমাদের সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করি সে তখন চুপচাপ থাকে। মাঝে মাঝে শুধু অর্ডার, অপু যাও, নিচে গিয়ে বল চার কাপ চা। অপু তখন নিচে চলে যায়। আর উপরে ওঠে না। বড় রক্ষণশীল পরিবারের মতো ব্যবহার। তবু একটা জায়গায় আমাদের মিল—সাহিত্য চর্চার আসর। সব এক একজন অংশীদার। গেলেই প্রণব, তার খাতা বের করে গল্প পাঠ করতে শুরু করবে। আমরা চায়ের লোভে, খাবারের লোভে গল্প পাঠ শেষ পর্যন্ত না শুনে উঠতে পারি না। ওঠার সময় বলি, চল — ঘুরব। বের হবার মুখে মেসোমশাইর একটাই কথা। টর্চটা নিয়ে যাও। জ্যোৎস্না রাত রাস্তায় আলো, খুব দূর অন্ধকারে যাবারও কথা নেই, তবু মেসোমশাই প্রণবকে হাতে টর্চ না ধরিয়ে ছাড়বেন না। সুতরাং সন্ধ্যায় আমাদের সঙ্গে প্রণব আছে, অথচ হাতে টর্চ নেই কোনদিন সেটা দেখিনি।
নিখিলের তখন এক কথা, তোর কিছু হবে না। জানিস তো লেখক কবিরা জীবনে খুব বেপরোয়া হয়। বেপরোয়া না হলে অভিজ্ঞতা হয় না। মহাস্থবির জাতক পড়ে ফেল। অসাধারণ, তুলনা নেই।
আমরা তখন কে কি পড়ছি, এটাও ছিল আড্ডার বিষয়। আমার অবশ্য কিছুই পড়া হয়ে ওঠে না। একটা চাকরির খুব দরকার। আর দরকার কলোনির গন্ধটা কিভাবে মুছে ফেলা যায়। পরী ঠিকই বলেছে, বিলু তুমি কবিতা লিখলে, গন্ধটা থাকবে না। তুমি একজন কবি। কবিরা কলোনিতেই থাকুক, আর শহরেই থাকুক তারা কবি।
আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। পায়ের কাছে নিখিল সুধীনবাবু বসে। মুকুল মাথার কাছে। আমার মন খারাপ। কলোনির ছেলে বললে, কাঁহাতক ভাল লাগে। কলোনিতে কোনো মানুষ থাকে না, এটা বোধহয় ওরা ভাবে। ওরা যত না ভাবে আমি তার চেয়ে বেশি ভাবি। সেদিন এই যে বলা, লজ্জা কি, ও তো কলোনির ছেলে,—সেটা আমাকে বড় কাবু করে রেখেছে।
সুধীনবাবুই বলল, কি, কতদূর এগোল!
আমি উঠে বসলাম। বললাম, পরী কানপুর থেকে কবে ফিরবে?
নিখিল বলল, কানপুর যায় নি। কাঁদি গেছে। ‘মহেশ’ নাটকে ওর পাঠ আছে। মুকুল বলল, যাই হোক কিছু করতে হবে। আর অপমান সহ্য করতে পারছি না।
—কিসের অপমান? বলে নিখিল একটা সিগারেট ধরাল।
—আছে, তোমরা বুঝবে না।
—কাগজের নাম ঠিক করে ফেলেছ?
আমি বললাম, ঠিক হয়ে গেছে!
—কি নাম হবে?
—চৈতালি।
সুধীনবাবু বলল, মন্দ না নামটা। এখন পরীর পছন্দ হয় কিনা দেখ।
পরীর পছন্দ না হলেও কিছু করার নেই। এই নামই থাকবে। কারণ বুঝতে পারছি, মুকুলের এ ছাড়া অন্য নাম পছন্দ হবে না। তবে একটা কথা, আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সম্পাদক আমি হতে পারব না। আমি সঙ্গে আছি।
মুকুল বলল, বেশ সঙ্গে থাকলেই হবে।
সুধীনবাবুই বলল, তোমার টিউশনির খবর কি? খুড়োমশাই তোমার বাবার কোনো খবর নিলেন?
—না।
ওরে বাপস্, দেখি পরী পেছনে। সাইকেল থেকে নেমে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে-তোমরা এখানে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বিলু, তোমার বাড়ি গেছিলাম।
—তুমি না কাঁদি গেছ!
—কে বলল?
–এই যে নিখিল বলল।
—যাঃ, আমি কখন বললাম। আমি জানিই না কিছু। নিখিল বেমালুম অস্বীকার করে ভাল মানুষ সেজে গেল।
—যাকগে, শোন। মেসোমশাই খুব দুঃখ করলেন। বিলুটার মতি গতি বুঝতে পারছি না! ওর যে কি হয়েছে। টিউশনিটা ছেড়ে দেবে বলছে কেবল।
ইস! বাবার কি মতিভ্রম হয়েছে—পরীকে সব কথা বলার কি দরকার। পরীকে তো বাবা এর আগে কখনও দেখেনি। নামও শোনে নি। আমি গুম মেরে থাকলাম।
পরী বলল, সত্যি টিউশনি ছেড়ে দিচ্ছ!
—জানি না।
—ছাড়লে ভাল হবে না। মেসোমশাই কি সুন্দর মানুষ। নিজে আম কেটে খাওয়ালেন। বললেন, বড় সৌভাগ্য মা, তুমি এয়েছ। তোমাকে তো দেখলে সাক্ষাৎ জগজ্জননী মনে হয়। বিলু তোমার সঙ্গে পড়ে।
আমি মিমির সঙ্গে পড়ি এটা আমার বাবার কত বড় সৌভাগ্য কথায় বার্তায় বুঝিয়ে দিয়েছেন।
–শোনো।
পরী এলে আমরা আর কেউ কথা বলতে পারি না। এমন জাঁহাবাজ মেয়ের সঙ্গে কেউ কথা বলে পারেও না। পরী পার্টির কর্মী বলে, এক দঙ্গল যুবার সঙ্গে যতক্ষণ খুশী বসে থাকতে পারে। তবে পরীকে আমরা বলে দিয়েছিলাম, তুমি সব বলতে পার। কিন্তু বিপ্লব ফিপ্লব নিয়ে কোনো কথা বলবে না। পার্টির ইস্তাহার হয়ে কথা বললে, তক্ষুনি আমরা চলে যাব। ফলে মিমি আমাদের সঙ্গেই একটু প্রাণ খুলে অন্যরকম কথা বলতে অভ্যস্ত।
—কি বলছি শুনতে পাচ্ছ না? পরী লাল রঙের লেডিজ সাইকেলটি এবারে ঝপাৎ করে মাটিতে ফেলে আমার মুখের সামনে এসে বলল, কি বলছি, শুনতে পাচ্ছ না। কেবল চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে জান। উঠে বসতে শেখনি।
—ধুস, ভাল্লাগে। উঠে বসলাম ঠিক, কিন্তু ভেতরের ক্ষোভ আরও বাড়ছে। বললাম, তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি কেন গেছিলে বল। তোমাকে বলেছি না আমাদের বাড়িতে যাবে না।
–করে বললে?
সত্যি কবে বলেছি মনে করতে পারি না। আদৌ বলেছি কিনা জানিও না। তবে পরী আমাদের বাড়ি গেলে আমরা কত হত দরিদ্র টের পাবে। একজন সহপাঠিনী শুধু কি সহপাঠিনী— জ্যোৎস্না রাতে মহা-অষ্টমীর দিনে পরী অমন একটা লোভে আমাকে ফেলে না দিলেই পারত। কালীবাড়িতে ওর কি যে দরকার ছিল জ্যোৎস্না রাতে রেল-লাইন ধরে হাঁটার।
নিখিল চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালিয়ে বলল, তোরা কি। দেখা হলেই ঝগড়া। এ কি রে বাবা। তা গিয়েছে তো কি হয়েছে। আমরা যাই না।
পরী লতাপাতা আঁকা শাড়ি পরেছে। হাত খালি। ডান হাতে সোনার ব্যান্ড দেওয়া ঘড়ি। পায়ে হলুদ রঙের স্লিপার। ওর রঙ শ্বেত চন্দনের মতো। বিকেলের লাল আভায় কোনো ফোটা পদ্মের মতো মনে হয়। পরীকে দেখলে, আমার মধ্যে বড় উষ্ণতার জন্ম হয়—কিন্তু পরী আমাকে বাড়ি গিয়ে আসলে হেয় করতে চেয়েছে, ওটাও কেন জানি ভুলতে পারছি না। কে জানে বাবা তখন গামছা পরে আমগাছ থেকে আম পাড়ছিলেন কি না। কে জানে পুনুটা কি করছিল। ওকে তো কিছুতেই প্যান্ট পরানো যায় না। উলঙ্গ হয়ে ঘোরে। আমি রাগ করলে বাবা বলবেন, ছেলেমানুষ, থাকুক। যতদিন শরীর খোলামেলা রাখা যায়। বন্ধন বড় কঠিন বিষয়। শরীর খোলামেলা থাকলে হাওয়া বাতাস লাগে। মানুষ দীর্ঘজীবী হয়। বাবা বাড়িতে খালি গায়ে থাকেন। মা বাড়িতে কোনোদিন ব্লাউজ পরে না। মায়াটা শাড়ি পরতে শিখেছে। কিন্তু শাড়ির সঙ্গে সায়া ব্লাউজ দরকার মা কিংবা বাবা কিছুতেই মানতে রাজি নয়। বাড়িতে আবার কে কবে সারা শরীর মুড়ে বসে থাকে। অসুস্থ হয়ে পরবে না। আর পিলুর কথা না বলাই ভাল। হাফ প্যান্ট পরে গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে সে হয়তো পরীকে দেখা মাত্র মাকে বলেছে, কে মা? আমাদের কে হয়? মা পিলুকে কি বলেছে কে জানে।
আমি গুম হয়ে আছি দেখে পরী বলল, অনেকদিন দেখা নেই। মনটা খারাপ লাগছিল তাই গেলাম। তুমি তো একবার দয়া করে যেতে পারতে। কোনো গুণ তো নেই। মুখ ভার করে বসে থাকা। বাপ জ্যাঠাদের মতো হুম। অত মুখ ভার করে থাকলে কাহাতক ভাল্লাগে।
আমি পায়ের উপর পা রেখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। পরীর কোন কথা শুনছি না এমন উদাস ভাব।
—মেসোমশাই দুঃখ করলেন, তোমার সঙ্গে পড়ে মা। ওকে একটু বুঝিয়ে বল। কুড়ি টাকা! সোজা কথা! কুড়ি টাকায় এক মণ চাল হয়। এভাবে লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে! তা খুড়োমশাই এ দেশে এসে আমাদের নাই চিনতে পারেন। ছেলে কত কৃতী বল। মিলের ম্যানেজার সোজা কথা। তাদের আত্মীয় কলোনিতে থাকে, এতে ওরা ছোট হয়ে যেতেই পারে। তুই গরীব বামুনের ছেলে, তোর কি এ সব নিয়ে মান-অভিমান সাজে। বলে পরী চুপ করে আমাকে কান্নি মেরে দেখল।
আমি মুখ বিকৃত করে বললাম, থামলে কেন। চালিয়ে যাও। মোটরে কি তেল ফুরিয়ে গেছে।
—তেল ফুরাবে কেন! সব ঠিকই আছে। টিউশন তুমি ছাড়বে না বলে দিলাম।
–আদেশ।
—আদেশ উপদেশ বুঝি না। মেসোমশাই কী সরল সোজা মানুষ। তুমি তাঁর ছেলে ভাবতে অবাক লাগে! বুঝলে নিখিল, এক একটা আম কেটে দিচ্ছেন, আর বলছেন, এটা শাদুল্লা, এটা রাণীপসন্দ, এটা বোম্বাই। সবই মা আমার হাতে লাগান। কেমন মিষ্টি না! সুস্বাদু না! গাছের কলম কোথা থেকে এনেছেন, মুর্শিদাবাদের কার বাগানের কলম, দশ ক্রোশ দূর থেকে নাকি একটা আমের কলম মাথায় বয়ে এনেছিলেন…
আর আমার সহ্য হচ্ছে না। বললাম, এই আমি উঠলাম।
সুধীনবাবু বলল, তার মানে। কথা ছিল, আজ কাগজের নাম, কে কি ভার নেবে ঠিক হবে চলে গেলে হবে কেন!
—নাম ঠিক করে ফেলেছি বললাম তো। আমি উঠতে গেলে পরী খপ করে হাত চেপে ধরল। বলল, তোমার মাথা খারাপ আছে বিলু।
—হ্যাঁ আছে। আমার মাথা এখনও ঠিক আছে ভাবলেই বরং কষ্ট পাই। তারপর পরীকে আঘাত করবার জন্য বললাম, যতই গণসংযোগ কর, কোনো লাভ হবে না। বাবাটি গান্ধী মহারাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না।
—কি বললে!
—বললাম তো গণসংযোগে কোনো কাজ হবে না।
—আমি গণসংযোগ করতে তোমাদের বাড়ি গেছিলাম ভাবছ!
—তাছাড়া কি!
—তুমি বিলু এটা বলতে পারলে।
আমি আচরণে কেমন আরও রূঢ় হয়ে উঠলাম। বললাম, এটা তোমাদের বিলাস পরী!
—বিলাস!
—হ্যাঁ বিলাস। হাত ছাড়। আমি এখন যাব।
হঠাৎ দেখি পরীর চোখ চিক্চক্ করছে। সে সহসা মুখ ঘুরিয়ে নিল, যেন কেউ আমরা ওর মুখ দেখতে না পাই। সে আমার হাত ছেড়ে দিল। কিন্তু আমি যেতে পারলাম না। পরীর মুখ ভাল করে ফের দেখা না পর্যন্ত আমি কেমন অস্থির হয়ে পড়ছি। পরীকে এভাবে অপমান করা বোধহয় আমার ঠিক হয়নি। এই নিয়ে পরী কতবার যে আমার অপমান সহ্য করেছে। অথচ পরী আজ পর্যন্ত আমাকে কোনোদিন অপমান করার চেষ্টা করেনি। বরং আমাকে বড় করে তোলার মধ্যে ওর কোথায় যেন একটা বিজয়ের ভাব আছে। অথচ আমি তাকে সব সময় পরাজিত দেখলে আনন্দ পাই।
মুকুল নিখিল প্রণব সবাই তটস্থ। সুধীনবাবু পরীকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে। সে বলল, এই মিমি, বোস, তোরা যে কি!
মুকুল বলল, বিলু বোস তো। বলে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। কিন্তু পরী তখনও দাঁড়িয়ে। লালদীঘির দিকে মুখ। রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে।
আমি একটা কথা বলতে পারছি না। বাবার সরল সহজ জীবন আমাকে এভাবে পীড়া দেবে বুঝতে পারিনি। বিশেষ করে পরীর কাছে এত সব বলার কী যে দরকার। বাবা কেন বুঝতে পারেন না, যারা আমাকে চাকর-বাকরের মতো দেখে, তাদের গুণগান পরীর কাছে কেন, কারো কাছেই করা ঠিক না। যারা আত্মীয় বলে আমাদের স্বীকার করে না, অথচ তাদেরই গর্বে বাবার মুখ কি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভাবতে কষ্ট লাগে। মাথাটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। বার বার বলেছি, আপনি কখনও কারো কাছে মিলের ম্যানেজার আপনার আত্মীয় বলে পরিচয় দেবেন না। কে শোনে কার কথা! পরী যেতেই শুনিয়ে দিয়েছে, আমাদের দিন এমন ছিল না মা। গত জন্মের পাপ ভোগ। যেন বাবা ছিন্নমূল না হলে পরীকে বৌমা করেও আনার ক্ষমতা ছিল তাঁর! বাবা তো জানেন না, পরীদের কি বিশাল বাড়ি, সদর দরজায় দারোয়ান। পরীর দাদু এই শহরের চেয়ারম্যান। পরীর দাদা বৌদিরা সব যেন অন্য গ্রহের জীব। পরীকে দেখেই সেটা বাবার টের পাওয়া উচিত ছিল। পরী কী একবারও বলেছে, তার দাদুর নাম এই, তারা এই শহরের সবচেয়ে বনেদী পরিবার। আহাম্মক না হলে কে এত সব বলে! বাবার সারল্য কেন জানি আজকাল আমার একদম পছন্দ না। বাবাকে আহাম্মক ভাবতে কষ্ট লাগে। চোখে জল চলে আসে। আমিও গুম মেরে গেছি। কারণ সবার কাছে দারিদ্র্যের জ্বালা কত বড় চোখের জলে না আবার ধরা পড়ে যাই।
পরী আমার সামনে বসে। আমি আর ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। সবাই আজকাল একটু বেশি সাহিত্য-পাগল হয়ে উঠেছি কাগজের নামে। মুখে যতই বলি না, আমি এর মধ্যে নেই খাটাখাটনিতে আছি, তবু জানি গোপনে কবিতা লেখার বাসনায় ভুগছি। আর এই বাসনা, আর কাউকে খুশি করার জন্য যেন লেখা। আমরা কেউ কথা বলছি না। দু-একটা গাছের পাতা আমাদের সামনে হাওয়ায় ওড়াউড়ি করছে। দূরে রেললাইন মাঠ পার হয়ে, একটা মালগাড়ি যাচ্ছে।
আমরা সবাই উসখুস করছি কথা বলার জন্য। কিন্তু কিভাবে আবার আড্ডার স্বাভাবিক প্রাণ ফিরে পাব বুঝতে পারছি না।
পরীই দেখলাম পারে। সহসা সে হেসে ফেলল।
পরীর হাসি আমাকে একেবারে হালকা করে দিল। আবার পরমুহূর্তেই মনে হল, এমন এক ঝড় ওঠার পর এত নির্মল আকাশ সহসা কে কবে আশা করে। পরী মুহূর্তে গম্ভীর, মুহূর্তে লঘু হয়ে যাওয়াটাও আমার কেন জানি পছন্দ না। বললাম, হাসির কি হল! এই প্রথম ওর দিকে ঝড়ের পরে চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম, চোখের জলের দাগ এখনও সজীব।
পরী বলল, হাসব না তো কি করব। কারো মুখে রা নেই। যেন সবাই বিষণ্ণ চিত্তে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ দেখছি। তোমাদের মুখ চোখ কি হয়ে গেছে!
মুকুল বলল, বিলুটা ও রকমই।
পরী বলল, শুধু বিলু হবে কেন, তোমরা সবাই। এত করে বললাম, কাগজের নাম ঠিক করে ফেল, বাকিটা আমি দেখছি। কাগজের নাম ঠিক করতেই দেখছি বাবুরা সব হিমসিম খাচ্ছেন।
আমি বললাম, কাগজের নাম ঠিক হয়ে গেছে।
—আমাকে জানাও নি তো! পরী আঁচল জড়িয়ে আরও পা ঢেকে বসল।
—শুনলাম তুমি কানপুর যাচ্ছ। বাড়ি থাকবে না।
—কানপুর যাবার কথা ছিল। তোমাদের কাগজের কথা ভেবেই যাইনি।
—তুমি কানপুর যাচ্ছ শুনেই, আমাদের আর তোমার কাছে যাওয়ার দরকার আছে মনে হয়নি।
—তোমার কবে আমাকে দরকার মনে হয়েছে জানি না তো।
মুকুল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আবার। তোমরা এমন করলে এক্ষুনি উঠে পড়ব। পরীকে দেখলেই তুমি যে কেন এত রেগে যাও বুঝি না।
মুকুলের দিকে তাকিয়ে পরী বলল, বাদ দাও তো। ও ওরকমই। কবে থেকেই ঠাকুর চিনে বসে আছি। এখন যা বলছি শোনো—কি নাম ঠিক করলে? সুধীনদা তোমার মাথায় কোনো নাম আছে?
—আমি তো বলেছিলাম, ‘ইংগিত’ নাম হবে।
—আর পারা যায় না। বললাম, নাম ঠিক হয়ে গেছে বলছি না।
—কি নাম?
—চৈতালি নামটাই আমাদের পছন্দ।
মুকুল বলল, ইংগিত নামে একটা কাগজ মেদিনীপুর থেকে বের হয়।
প্রণব বলল, স্মরণ নামটা কিন্তু দারুণ।
এবারে সত্যি উঠতে হয়। কাগজ বের করার পরিকল্পনা মুকুলের। কাগজ বের করতে পারলে আর কিছু না হোক যাকে ভালবাসে তার একটা নিদর্শন থাকবে। নামের মধ্যে সেটা সে প্রকাশ করতে চায়। চৈতালির দিদিরা তাকে এত হেলাফেলা করে, কাগজ বের করতে পারলে বোঝাতে পারবে রুচি তার কত উঁচু। গোপন ভালবাসা কত মধুর মুকুলের মুখ না দেখলে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু চৈতালি নামটাই যদি না রাখা গেল তবে কাগজ বের করার দরকার কি। বললাম, আমি যাই। তোমরা নাম ঠিক কর।
মুকুলের মুখটা ভারি বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। পরী যখন কাগজের দায়িত্ব নিতে চাইছে, তখন কাগজ বের হবেই। কিন্তু যদি নামটাই বাতিল হয়ে যায় তবে আমরা এতে নেই। আমরা দু’জনে যে করে পারি, এক দেড় ফরমার কাগজ হলেও বের করব এবং তার নাম রাখব চৈতালি।
আমাকে উঠতে দেখে পরী বলল, তুমি যে বললে নাম ঠিক করে ফেলেছ। নামটা বলবে তো।
মুকুল চুপচাপ। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। সাঁজ লেগে গেছে কখন। চারপাশের আলোক উজ্জ্বল শহরের এই নিরিবিলি মাঠে বসে সে যেন একা এখন আকাশের তারা গুণছে।
—বললাম তো, আমার ইচ্ছে কাগজের নাম চৈতালি রাখি।
—বা সুন্দর নাম! সুধীনদা, তুমি কি বলছ?
—খারাপ না।
নিখিল বলল, এরা দুজনেই ক্ষ্যাপা আছে। চটিয়ে লাভ নেই। পরীরও যখন পছন্দ, চৈতালি নামই থাকুক।
রাত বাড়ছে।
পরী বলল, টাকার জন্য ভাবতে হবে না। আট-দশটা বিজ্ঞাপন যোগাড় হয়ে যাবে। ওতে কাগজের খরচ উঠেও কিছু থাকবে। এখন দয়া করে লেখাগুলি তোমরা দিয়ে দাও। আমি যাচ্ছি, পরী উঠে দাঁড়াল।
আমরাও সবাই উঠে দাঁড়ালাম। পরী এই প্রথম আমাদের আড্ডায় এসেছে। পরীর সম্মানার্থেই যেন আমাদেরও এবার আড্ডা ভঙ্গের দরকার। আমার ভাঙ্গা সাইকেলখানায় পা রেখে যাবার সময় পরীকে কাছে ডাকলাম। কাছে এলে বললাম, তুমি আর আমাদের বাড়ি যাবে না।
—কেন। পরী কেমন বিস্ময়ের গলায় কথাটা বলল।
—গেলে অপমানিত বোধ করব। মনে রেখো। তারপরও বলতে পারতাম, আাগে বাবার ছিল দিনেশবাবু। এখন মিলের ম্যানেজার ভূপাল চৌধুরী। বিপদে আপদে কিংবা পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে, তখন দিনেশবাবুর দোহাই। দিনেশবাবুকে চেনেন না—ঢাকার এত বড় জমিদার, আমি তার সেরাস্তার লোক, কত বড় কথা! এখন এসে দাঁড়িয়েছে মিলের ম্যানেজারে। আমার ভয়, পরী গেলে বাবা যে দেশবাড়িতে গোমস্তা ছিলেন, সেটাও না প্রকাশ হয়ে পড়ে। বলে ফেলেন, আমরা দেশে তো মা এমন ছিন্নমূল ছিলাম না। ঘর বাড়ি জমি জমা, তারপর জমিদার বাড়িতে আদায়ের কাজ, কত কিছু ছিল। কারণ আমার বাবার কাছে কিছুই হেলা ফেলার নয়। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় এক বিষয়ে পাশ করতে পারি নি, কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছি—তাতে আমি দমে গেলেও বাবা দমেন নি। বলেছিলেন, দশটা বিষয়ের মধ্যে নটা বিষয়ে পাস সোজা কথা। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাস করে। বুঝলে, পরী বিলু দশটা বিষয়ের মধ্যে নটা বিষয়ে পাস করেছে। সুতরাং এ হেন বাবাটি পরীর কাছে, তার পুত্র-গৌরব শেষ পর্যন্ত কোথায় কতদূর নিয়ে যাবে কে জানে। আমি কম্পার্টমেন্টালে পাস পরী জানলে আমার যে মাথা কাটা যাবে, তা আর ভালমানুষ বাবাটিকে বোঝাই কি করে।
পরী কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর দুম করে বলে বসল, আমি যাব। আমি গেলে তোমার অপমান। দেখি সেটা কতদূর। বলেই সে বেগে সাইকেলে উঠে টাউন হলের রাস্তায় উঠে গেল। পরীকে আর দেখা গেল না। অন্ধকারে আমি একা। পরী আমার সঙ্গে কথা বলছে বলে মুকুল কাছে আসছে না। পরী চলে যেতেই সে এসে বলল, পরী চলে গেল!
আমি বললাম, না চলে যায় নি। আবার যাবে বলে গেল।
পৃথিবীতে কি যে দারুণ দাবদাহ —ক্রমে টের পাচ্ছি। বড় হওয়ার এই সংকট থেকে কি করে পরিত্রাণ পাব জানি না। বাড়ি ফিরে যেতে হয় যাই। কেমন ক্রমে স্বার্থপর হয়ে উঠছি। আগেকার সম্পর্কগুলি ক্রমে কেমন আলগা হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে একদম মন টেকে না। কেমন উড়ো স্বভাব গড়ে উঠছে আমার মধ্যে।
পরী যখন বলেছে, যাবে, সে যাবেই।
আমরা দুজনে সাইকেল চড়ে কারবালার রাস্তার দিকে যাচ্ছি। মুকুল আমাকে রেল-লাইন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসে। অবশ্য রেল-লাইনের গুমটি ঘরের কাছে এলেই আমাদের মনে হয় এখনও ফেরার সময় হয়নি। ফিরে কিই বা করব। ফিরলেই দেখব বাবা বসে আছেন জলচৌকিতে—মা দরজায় ঠেস দিয়ে। আমি না ফিরে গেলে যে মা খাবে না, মা জেগে থাকবে—এটা যেন আর এখন কোনো ব্যাপারই না। বরং মা আমার জন্য জেগে থাকে বলে রাগ হয়। মা বাবা খেয়ে নেয় না বলে রাগ হয়। ওদের জন্যই আমার দেরি করা চলে না। মনটা উসখুস করে। মুকুলের অনুরোধ রাখতে পারি না।
এই আর একটু বোসো না। এমন বললে কেন জানি উঠতে ইচ্ছে হয় না। আশ্চর্য সব স্বপ্নের মধ্যে আমরা কাছাকাছি মানুষ। আমাদের স্বপ্নের কথা কেউ জানে না। আমরা নিজেরাও জানি না সেই স্বপ্নটা কি! যেখানে পরীরা ঘুরে বেড়ায় চৈতালিরা জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে — সমবয়সী সব যুবতীরা তাড়া করছে আমাদের এটুকু শুধু বুঝতে পারি। ওদের নিয়ে আমরা কতদূর যেতে পারি জানি না। শেষ পর্যন্ত তো সেই মা বাবা, এবং জীবনে এত সব উদ্বেগের শরিক — যেমন আমার মা বাবা এখনও জেগে বসে আছেন।
মুকুল বলল, কি ব্যাপার একেবারে চুপ মেরে গেলে!
—না ভাবছি।
—কি ভাবছ?
—আচ্ছা পরী কেন যাবে?
—গেলে কি হয়! তুমি এই নিয়ে মাথা গরম করছ কেন বুঝি না। পরী তোমাকে ভালবাসে।
–ধুস ভালবাসা। ও আসলে আমাকে অপমান করতে চায়। তুমি একদম পরীর কথা বলবে না।
মুকুল বুঝতে পারে কোথায় আমার লেগেছে। আমরা গুমটি ঘরের কাছাকাছি এসে গেছি। এদিকটায় খুবই নির্জন। কেবল বোস্টাল জেলের আলো জ্বলছে রাস্তায়। বড় বড় সব রেন ট্রি রাস্তার দু-পাশে। দু-একজন সাঁওতাল বাদুড় ধরার জন্য গাছের নিচে ওৎ পেতে বসে আছে। হাতে সরু লম্বা বাঁশ। বাঁশের ডগায় পাখি ধরার খাঁচা।
সামনে ঘাসের একটি চটি মতো আছে। গরমকাল বলে সাপখোপের উপদ্রব। টর্চ জ্বেলে মুকুল এগিয়ে গেলে বললাম, আজ আর বসব না। চলি।
—গিয়েই তো মুখ ভার করে মেসোমশাইকে এক চোট নেবে।
—আচ্ছা তুমিই বল, বাবার কি দরকার বলার ম্যানেজার আমাদের আত্মীয় হয়। তুমি জান, এই যে যাই, একদিন বলে না, মাস্টারমশাই আপনার চা! পড়াই আর দেখি আমার সামনে দিয়ে চা জলখাবার যাচ্ছে বসার ঘরে। সব বন্ধু-বান্ধব ম্যানেজারের। ক্লাবের মেম্বার। শহরের এস ডি ও। পুলিশ সাহেব কত সব মহামান্য ব্যক্তি যে আসেন সকাল সন্ধ্যায়। নিজেকে তখন এত ছোট মনে হয় যে সব ভাঙচুর করে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। সেই লোকটাকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে আমি লজ্জা বোধ করি। আর দেখ বাবা পরীকে পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছে। বল, মাথা গরম হবে না!
মুকুল পাজামা পাঞ্জাবী পরে আছে। আমি পরেছি প্যান্ট শার্ট। বাড়িতে ঘটি গরম করে একই জামা প্যান্ট ইস্ত্রি করে নিই। মুকুলের জামা প্যান্ট ধোপা বাড়ি থেকে ধুয়ে আসে। আমার পাশে যেন কাউকেই মানায় না। এরা যে আমাকে এত কাছের ভাবে সে শুধু কলেজ ম্যাগাজিনে আমার লেখা অসাধারণ কবিতার জন্য। হবু সব কবি মহলে এই নিয়ে বেশ একটা আলোড়ন চলছে। মুকুলকে বললাম, কাগজটা বের না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।
মুকুল বলল, আমিও না।
—কিন্তু আমাকে যে দেখছি কবিতাই লিখতে হবে।
–কবিতাই লেখ না। কলেজ ম্যাগাজিনে তো তুমি দারুণ লিখেছিলে। পরী সবাইকে বলেছে আমার অবিষ্কার! পরীর এই নিয়ে একটা গর্ব আছে।
—তা’লে কবিতাই লিখছি। তবে শোন, মুকুলের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললাম, তুমি দয়া করে পরীকে বলবে চায়।
—কি বলব?
—না, এই মানে, পরী না হলেও চলছে না। কি যে করি। আচ্ছা, পরী খুব ওকগুঁয়ে, না?
–সে তো তুমি আমার চেয়ে ভাল জানো।
—কিন্তু পরীকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এতদিনেও ঠিক জানি না পরী আমার কাছে কি
—বললাম, পরী যখন দায়িত্ব নিয়েছে, তখন মনে হয় পত্রিকাটি আমাদের সত্যি বের হবে।
—বের করতেই হবে। বের না করলে ইজ্জত থাকবে না। চৈতালি জেনে গেছে আমরা কাগজ বের করছি। ঠাট্টা করে বলেছে, তা’লেই হয়েছে। মেয়েদের পেছনে ঘুর ঘুর করা যাদের স্বভাব- তারা বের করবে পত্রিকা। আমাদের চরিত্রে নাকি দৃঢ়তা নেই।
—কে বলল! অবাক হয়ে বললাম।
—অপু!
—মানে প্রণবের প্রণয়ী?
–হুঁ, সেই রানী। প্রণব আমায় বলেছে, কেউ যেন জানতে না পারে। চৈতালির দিদিরা মনে করে আমরা সব উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। আমাদের দিয়ে কিছু হবে না। কাগজ বের করছি শুনে কী হাসাহাসি! নীতার দেওরটার মাথা খারাপ আছে বলেছে। আর সঙ্গে যে থাকে তার তো আরও বেশি। আমরা নাকি লালু ভুলু। পরীকে আমাদের মক্ষীরানী বলেছে।
—আচ্ছা!
অন্ধকারেও দেখলাম, মুকুল গম্ভীর। চৈতালি প্রসঙ্গে আর বেশি কথা বলা ঠিক হবে না। আমাদের তো আরও সংকট সামনে। পরীক্ষার রেজাল্ট কি হবে কিছুই জানি না। রেজাল্ট বের হতেও খুব দেরি নেই। পাস করতে পারব কি না তা নিয়েও সংশয়। যদি ফেল করি তখন কি হবে। টিউশন কি তখনও চালিয়ে যেতে পারব। একজন ফেল ছাত্রের পক্ষে ম্যানেজারের দুই মেয়েকে পড়ানো কি যে মর্মান্তিক হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত বাবার এক মণ চালের আয়টা যাবেই। তার আগে কাগজটা বের করতে পারলে বেশ হবে। ফেল করলে আমাদের কার কি মতি হবে কে জানে। তবে পরী পাশ করবেই। সে দু বিষয়ে লেটার পাওয়া ছাত্রী। আমার মতো কম্পার্টমেন্টালে পাস নয়। ওর সায়েন্স, আমার কমার্স। পরিচয় কালীবাড়ির সূত্রে। কলেজে সে আমাকে কখনও দেখেছে প্রথম আলাপে বিশ্বাস করতে পারে নি।
নিখিল মুকুল এরা আমাকে তবু বিংশ শতাব্দীর বিদ্যাসাগর ভাবে। সেটা যে পাণ্ডিত্যের জন্য নয়, আমার কিছু আচার নিষ্ঠা, এবং বাড়িতে খালি গায়ে পৈতা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বুঝতে কষ্ট হয় না। আমাকে বিদ্যাসাগর বলে ওরা আনন্দ পায়। আমিও ওদের এক একজনের নাম দিয়ে ফেলেছি – যেমন মুকুলকে আমরা ডাকি বিহারীলাল। তার কাব্যে নাকি বিহারীলালের প্রভাব আছে। সুধীনবাবু আমাদের এ কালের মোহিতলাল। দেখা হলেই, সম্ভাষণ, এই যে মোহিতলাল মশাই, আধুনিক গদ্যরীতি সম্পর্কে আর কিছু ভাবলেন?
আসলে আমরা সামনের এক গভীর কয়াশার দিকে হেঁটে যাচ্ছি— কিংবা প্রহেলিকা বলা যায়। সংসারে যে নিশ্চিত আয়ের খুবই দরকার হয়ে পড়েছে বুঝতে পারি। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় হওয়া কত কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভাই-বোনগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। তাদের পরবার মতো ভাল জামাকাপড় পর্যন্ত নেই। বললাম, জামাইবাবু আর কিছু বললেন?
—হবে। সারকুলার এলেই তুমি এপ্লাই করবে। হয়ে যাবে মনে হয়।
—বাড়ি থেকে দূরে হবে না তো।
—কাছাকাছি কোনো স্কুলে দিতে বলব। ছোড়দি বলেছে, বিলুটার জন্য কষ্ট হয়।
মুকুলের ছোড়দির আমার জন্য কষ্ট হবারই কথা। বিকেল বেলায় একবার ছোড়দির বাসায়ও আমরা রাউণ্ড দিয়ে আসি। অনেকদিন গেছে, ছোড়দির বাসায়ও আমাকে মুকুলকে থাকতে হয়েছে। জামাইবাবুর টার থাকে। মাঝে মাঝেই রাতে তাঁর ফেরা হয়ে ওঠে না। তখন আমাকে আর মুকুলকে ছোড়দির বাড়িতে রাত কাটাতে হয়। আমার জন্য সেদিন ছোড়দি বেশ ভাল মন্দ রান্না করে রাখে। আমরা খেয়ে পরিতৃপ্ত হলে, ছোড়দি খুব খুশি হয়। সুতরাং আমার জন্য ছোড়দির কষ্ট হতেই পারে। ছোড়দি নাকি বলেছে, আর কারো না হলেও যেন বিলুর কাজটা হয়। সুতরাং সার্কুলার এলে আমার চাকরি হয়ে যাবে এই একটা আশায় বুক বেঁধে আছি। তখন আর কে যায় টিউশনি করতে। আশি টাকা মাইনে—ভাবা যায়। বাবার হাতের কাছে স্বর্গ ঝুলে আছে বাড়ি গেলেই টের পাই। আমার চেয়ে বাবার বেশি উদ্বেগ এ ব্যাপারে। বাড়ি গেলেই বলবে, মুকুল কিছু বলল।
কিছু বলল, মানে, চাকরির কথা জানতে চান। বাবা তখন এমন নিরুপায় চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন যে তাঁকে নিরাশ করতে কষ্ট হয়। বলি, হবে। সার্কুলার এলেই হয়ে যাবে।
রাত বাড়ে। আকাশে নক্ষত্র ফুটে থাকে। গাছপালা কেমন অন্ধকারে নিথর। সোজা পাকা সড়ক চলে গেছে। আগে এই বাদশাহী সড়কটা ছিল খোয়া বাঁধানো। এখন সরকার থেকে পিচ ঢেলে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাটা গেছে লালবাগের দিকে। রেল গুমটি পার হলে দু’ দিকে দুটো সড়ক। কারবালা দিয়ে গেলে রাস্তা সংক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু বড় বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে কবরখানা পার হয়ে রাস্তাটা আমাদের বাড়ির দিকে চলে গেছে। আগে কালীবাড়ি থাকতে এই রাস্তায় কতবার গেছি। ইঁটের ভাটা পার হয়ে নবমী বুড়ির কুঁড়ে ঘর পার হয়ে ঝোপ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিছুটা মাঠ ভাঙলে আমাদের বাড়ি। দিনের আলোয় সাহস পেলেও, রাতে ঐ রাস্তা ধরে একা যেতে ভয় করে। বাদশাহী সড়ক ধরে যাবারও একটা ল্যাটা আছে। সড়ক থেকে নেমে পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুঁকে যেতে হয়। রাত বেশি হলে, সিপাই হল্ট বলে চিৎকার করবেই। তখন বলতে হয় আমি পিলুর দাদা। ব্যস, এই যে কথা, পিলুর দাদা, এতেই হয়ে যায়। পিলুর খ্যাতি সর্বত্র।
তারপরই ট্রেনিং ক্যাম্পের আর্মারি। আমারি পার হলে মাঠ। মাঠে কাঁটা তারের বেড়া। মাঠে নামলেই আমাদের পাড়াটা চোখে পড়ে। বেড়ার গেট পার হলে দেখতে পাই লম্ফ জ্বলছে ঘরে ঘরে। অন্ধকার রাতে এগোনো কঠিন। গাছপালার ছায়ায়, নিজেকে পর্যন্ত দেখা যায় না। তবু পথটা এত চেনা যে, যেতে কোনো কষ্ট হয় না। কুকুর বেড়াল কিংবা মানুষের গায়ে না পড়ি এ জন্য অনবরত ক্রিং ক্রিং বেল বাজাই। যারা আছে সরে যাও বলি। বাবা মা এমন কি পিলু দূর থেকেই তখন টের পায় তার কলেজে পড়া দাদাটি ফিরছে। দেশের জন্য আর কারো তেমন কোনো মায়া-মমতা নেই। যেন চলে এসে আত্মরক্ষা করা গেছে। এবং মান মর্যাদা বিপন্ন হবার আর ভয় নেই। আমাদেরও আর মনে হয় না, আমরা ছিন্নমূল। বরং এই যেন আমাদের দ্বিতীয় জন্মভূমি। এমন কি কোথাও গিয়ে আজকাল আর ভালও লাগে না। বাড়িতে মন টেকে না, সে অন্য কারণ। যদি কাজ হয়, বাড়ির কাছে হলে ভাল হয়। বাড়ির কাছে না হলে কাজটা নেওয়া ঠিক হবে কি! কারণ এই বাড়ি ঘরের সঙ্গে বাবার মতো আমিও এক গভীর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। বাড়ির গাছপালা, সাইকেলে চেপে উধাও হওয়ার মধ্যে কি যেন এক গভীর আনন্দ খুঁজে পাই। কাজটা দূরে হলে বাড়ির সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। মনে হয় বাড়ি ছেড়ে বেশিদূর কোথাও গিয়ে থাকতেই পারব না। আর এ হেন বাড়িতে, পরী এসে আমাকে কিছুটা বিপদে ফেলে দিয়েছে। বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটি থেকে মান অভিমান জন্মাতে কতক্ষণ। বাড়িতে ঢোকার মুখে এ সব ভাবছিলাম।
বাড়ি ফিরে দেখি মা বাবা শুধু জেগে নেই। সবাই জেগে বসে আছে। এত রাতে এমন তো হয় না।
সাইকেল তোলার সময় পিলু বলল, জানিস দাদা, আজ না কী সুন্দর একটা মেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল সাইকেলে চেপে। এসেই বলল, বিলু আছে?
আমি গম্ভীর হয়ে আছি।
পিলুর সব বিষয়ে কৌতূহল একটু বেশি। বলল, মেয়েটা তোর সঙ্গে পড়ে বলল।
—মিছে কথা বলেছে।
বাবা বোধ হয় ও ঘর থেকে শুনতে পেয়েছেন কথাটা। পুত্রের সঙ্গে এমন এক আধুনিকার পরিচয় আছে ভাবতেই বোধহয় বাবার বুক গর্বে ভরে গেছে।
বাবা বললেন, মেয়েটি আচরণে বড় লক্ষ্মীমতী। মৃন্ময়ী তোমার সঙ্গে পড়ে বলনি তো!
—আমার সঙ্গে পড়বে কেন! -মৃন্ময়ী তো তাই বলল।
—আমাদের কলেজে পড়ে।
—সে একই কথা। বাড়িটা দেখে কি খুশি!
—বলল, কী সুন্দর বাড়ি। একেবারে আশ্রমের মতো মেসোমশাই।
বাড়িটা আশ্রমের মতো বললে বাবা খুব খুশি হন। তা কিছুটা আশ্রমের মতোই বলা যায়। পরী বাবাকে খুশি করার জন্য বলেনি। রাস্তার ধারে বড় একটা আমলকি গাছ। পাশে স্থল-পদ্ম, শ্বেত জবা, রাঙ্গা জবা, অতসী-অপরাজিতা এবং গৃহদেবতার পূজার জন্য যতরকম ফুলের দরকার। বাবা বাড়িটার সামনে সবই লাগিয়েছেন। গাছগুলির যে পরিচর্যা একটু বেশি বেশিই বাবা করে থাকেন দেখলেই টের পাওয়া যায়। এক পাশে একটু আলগা জায়গায় গোয়াল ঘর। দক্ষিণের ভিটেতে একটা বাছারি ঘর। বাবা একটা কাঠের টেবিলও বানিয়েছেন। আরও একখানা চেয়ার বানাবার পরিকল্পনা আছে। আমার কাজ হয়ে গেলে এ সবে হাত দেবেন। মা’র রান্নাঘরটি খুব ছোট। মেটে হাঁড়ি কলসিতে ঘরটা ভর্তি। সংসার করতে গেলে কত কিছুর দরকার হয় মা’র রান্নাঘরে গেলে টের পাওয়া যায়। খড়কুটো থেকে আরম্ভ করে বাবা সব সংগ্রহ করে রেখেছেন। বর্ষায় এ সবে হাত দেওয়া হবে! গ্রীষ্মে রান্নার জন্য জ্বালানি, বাড়ির গাছপালার ঝরা পাতাই যথেষ্ট। গাছের নিচ থেকে শুধু ঝাঁট দিয়ে তুলে আনা। পরী মার রান্নাঘরটি না দেখে গেছে আমার মনে হয় না।
মা’র গলা পেলাম। আমি ঘরে ঢুকেই সাইকেল তুলে চুপচাপ আমার তক্তপোষে বসে আছি টের পেয়েছে। ঘরের টেবিলে হারিকেন জ্বলছে। আমার আর কোন সাড়াশব্দ নেই। মায়া দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলল, মিমিদি কি ভাল! আমাকে থুতনিতে ধরে আদর করল!
ভিতরে ক্ষোভ রয়েছে। অথচ বোনটার নিষ্পাপ চোখ আমাকে কেমন সহজ করে তুলেছে। বললাম, এত রাত অবদি জেগে আছিস! কি ব্যাপার!
মিমিদি বলেছে আবার আসবে। আমার হাত খালি দেখে বলেছে, তোমাকে সুন্দর কাঁচের চুড়ি এনে দেব। আমাকে একটা পুঁতির মালাও দেবে বলেছে।
মায়ার হাতে একগাছা করে পেতলের চুড়ি আছে। সেই কবে একবার রাজবাড়ির রাশ থেকে মা কিনে দিয়েছিল। রাজবাড়ির রাস মেলায় ‘মা’র সঙ্গে মায়া গিয়েছে। আমরাও যাই রাসমেলায়। তবে আমি পাড়ার সুবোধ তাফুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পছন্দ করি। মা বাবার সঙ্গে কিংবা ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে যেতে কেন জানি না লজ্জা হয়। রাস থেকে কাঁচের চুড়ি কিনবে মায়া বায়না ধরেছিল, পুঁতির মালা, কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হয়নি। টাকা-পয়সার টানাটানি। মা বলেছিল পরে কিনে দেবে। মায়া মিমির আদর খেয়ে যদি আবদার করে থাকে—বিষয়টা মাথার মধ্যে কাজ করতেই ক্ষোভের গলায় বললাম, তুই আবার চাসনি তো!
মায়া চুপ করে থাকল।
মা ডাকছে, কিরে হাত মুখ ধুয়ে নে। কত রাত করবি। খাবি না।
আর খাওয়া! মিমি বাড়িতে এসে এইসব অভাব অনটনের মধ্যে আমরা বড় হচ্ছি টের পেয়ে গেছে। বললাম, খাব না, খেতে ইচ্ছে করছে না।
বাবা এবার আর ও ঘরের বারান্দায় বোধ হয় চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। বললেন, হয়েছে, খাবে না কেন, শরীর খারাপ। মিমি আবার আসবে বলে গেছে। বড় ভাল মেয়ে। সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইল। ও ঘরে কে থাকে? বললাম, ওটা ঠাকুর ঘর।
বাবা বলে যাচ্ছেন। আমি শুনছি না, জামা প্যান্ট ছাড়ছি। একটা দড়িতে জামা প্যান্ট ঝোলানো থাকে। ধুতি টেনে নিলাম একটা। খালি গা। খুব ঘামছি। ঘরের জানালা ঝাঁপের। সামান্য হাওয়া ঢুকছে ঘরে। বাবা ঝাঁপটা আরও তুলে দিয়ে বললেন, মিমি নিজেই শেকল খুলে ঠাকুর ঘর দেখল। চরণামৃত দিলাম। কি ভক্তিমতী মেয়ে। হাঁটু গেড়ে দু-হাতের অঞ্জলিতে চরণামৃত নিয়ে খেল, বুকে মাথায় মাখল। আজকাল তো শহরের মানুষজনদের মধ্যে ঠাকুর-দেবতার প্রতি কোনো নিষ্ঠা নেই। যা খেয়ে নে!
এবারে আর পারা গেল না। বললাম, আচ্ছা বাবা আপনি কেন বলতে যান, মিলের ম্যানেজার আপনার আত্মীয় হয়?
বাবা কেমন যেন থতমত খেয়ে গিয়ে বললেন, কি হয়েছে তাতে। আত্মীয়কে অনাত্মীয় ভাবতে তোমাদের কষ্ট হয় না? এমনিতেই তো মানুষ আজকাল কেমন একা হয়ে যাচ্ছে। একা হয়ে যাওয়াটা সংসারের পক্ষে মঙ্গল নয় জান। সব মানুষই পরিচয় সূত্রে গাঁথা—তাকে ছিন্ন করতে হয় না। বেঁচে থাকার পথে এগুলো জরুরী। তোমরাও যে একদিন বড় হবে না কে বলতে পারে। তোমার আত্মীয় স্বজন তোমার পরিচয় দিলে, তুমি খাটো হয়ে যাবে, না তারা খাটো হয়ে যাবে।
আমি জানি বাবার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। এতে যে মানুষ মজা পেতে পারে বাবা বুঝতেই পারেন না। বাবার কোনো খোঁজ-খবর নেয় না, এমন কি একবার আজ পর্যন্ত আমাদের পরিবার সম্পর্কে কোনো আগ্রহও প্রকাশ করে নি, এমন কি বাবার খুড়োমশায়টি তো আমাদের কলোনির লোক ভেবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। না হলে বলতে পারে নাতনিকে, কলোনির ছেলে, লজ্জা কি! যেন মানুষ না। একজন উঠতি বয়সের কিশোরী একজন সদ্য যুবার দিকে চোখ তুলে তাকাতে লজ্জা পেতেই পারে। সেটাও খুঁড়োমশায়টির বিশ্বাস করতে কষ্ট। বললাম, মিমিকে আপনি চেনেন না। আমি চিনি।
বাবা অত্যন্ত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন কথাটাতে। বললেন, মিমির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?
–হয়েছে।
—সে কি আমাদের নিন্দা করেছে?
–না।
—তবে।
—তবে আবার কি। ওরা কত বড়লোক আপনি জানেন না। ম্যানেজার আত্মীয় বললে ও খুব আমাদের বড় মনে করবে না। আমরা যা আছি তাই।
—যাই বল, বড় সরল সাদাসিধে মেয়েটি। আমার বয়স হয়েছে, আমি দেখলে বুঝতে পারি কার মনে কি আছে। পরিচয় সূত্রে মিমি তোমার খুবই উপকারে আসতে পারে। এ দেশে এসে আমরা আগেকার সব হারিয়েছি—এখন আবার নতুন করে আমাদের জীবন শুরু। যেখানে যেটুকু পাবে সবটাই গ্রহণ করবে। অবহেলা করা ঠিক না। যাও হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। তোমার সঙ্গে পড়ে মেয়েটি, তোমার প্রতি ওর টান আছে।
বাবা কি তবে সব টের পেয়ে গেছেন। বলতে ইচ্ছে হল, আচ্ছা বাবা, আপনি বোঝেন না কেন, এ সব বড় ঘরের মেয়েদের এগুলি এক ধরনের মজা। আমি বলতে পারলাম না, মিমি পার্টি করে, মিমি গণসংযোগ করে বেড়ায়। আমার মতো তার অজস্র পুরুষ বন্ধু আছে। সে আমাকে আর পাঁচজনের মতোই দেখে। তার বাইরে কিছু নয়। কথা বাড়ালে বাড়বে। পিলু আমাদের কথা চুপচাপ শুনছিল। সে দাদার মিমি-সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা বোধহয় পছন্দ করছে না। সে বলল, আমাকে মিমিদি বলে গেছে ওদের বাড়ি যেতে। মিমিদিদের বাড়ি আমি চিনি। একটা কাকাতুয়া আছে বাড়িটাতে।
—তা’লৈ আর কি! ড্যাং ড্যাং করে চলে যাও। তোর তো মান-সম্মান বোধ এতটুকু নেই। মিমি বলে গেছে বলেই যেতে হবে। একদম যাবে না।
—বারে, আমাকে যে বলল, পিলু তুমি সকালের দিকে যেও। অন্য সময় গেলে পাবে না।
—গিয়ে কি করবি শুনি।
—কি করব আবার। কাকাতুয়া পাখিটা দেখব। রাস্তা থেকে ভাল দেখা যায় না। ওটা নাকি কথা বলে!
পিলুর পাখি এবং জীবজন্তুর প্রতি এমনিতেই একটা আগ্রহ আছে। বাড়ির পোষা কুকুরটি পিলুরই সংগ্রহ করা। পিলু একটা বাঁদরের বাচ্চাও সংগ্রহ করে এনেছে। এটা এখন এ-বাড়ির আর একজন। কেউ এলেই পিলু ওটা কাঁধে নিয়ে হাজির। একটা ঠ্যাং খোঁড়া বাদরটার। পা টেনে টেনে হাঁটে। মার খুব ন্যাওটা। মিমিকে ঠিক পিলু বাঁদরটার কাছে নিয়ে গেছে। এ সব যত ভাবছি তত মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। খেতে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না। হাত মুখ ধুয়ে এসে বললাম, মায়াকে তো বলেছে, কাঁচের চুড়ি এনে দেবে, পুঁতির মালা দেবে। তোকে কিছু দেবে বলেনি?
—আমাকে দেবে বলেছে।
—কি দেবে?
—ওদের বাড়ির কাকাতুয়া দেবে।
—তার মানে!
—মানে কি আবার! মিমিদি বলল, খাগড়ার বাজারে যেতে বড় বাড়িটা দেখনি? সামনে বাগান দাঁড়ে একটা কাকাতুয়া, ওটাই আমাদের বাড়ি।
বাড়িটা আমি পিলু কবে থেকে চিনি! তখন জানতামই না মিমি বলে এক তরুণী এ বাড়িতে বড় হচ্ছে। কাজেই মিমি তার বাড়ির কথা বললে, এক নিমেষে পিলু টের পেয়ে গেছে সেই বাড়িটা, ওরে ব্বাস! তার একবার ইচ্ছেও হয়েছিল বাগানের ভিতর ঢুকে সাদা রঙের অতিকায় পাখিটা দেখে। কিন্তু সাহসে কুলায় নি। শত হলেও কলোনির লোক আমরা। বাড়ির কলাটা মুলোটা বাজারে বিক্রি করে ফেরার পথে ঢুকতে চাইলে, দারোয়ান যে তেড়ে আসবে না, সেটা সে বোঝে। এখন সাক্ষাৎ জননী নিজে হাজির। পিলুর অনেকদিনের বাসনার কথা জেনে কাকাতুয়াটি যে দেবে না সেটাও বলা যায় না। দিতে পারে। কারণ সে তো যতভাবে পারে আমাকে জব্দ করার তালে আছে। আমাকে জব্দ করার জন্য কাকাতুয়াটি উপহার দেবে সেটা আর বেশি কি। খেতে বসে বাবাকে বললাম, আপনি পিলুকে বারণ করে দেবেন, ও যেন মিমিদের বাড়ি না যায়। মিমিদের বাড়ির কাকাতুয়াটি নাকি ও নিয়ে আসবে বলেছে!
বাবা বললেন, ভালবেসে দিলে নিতে হয়।
আর পারলাম না। বললাম, তাহলে নেবেন। আমি তবে বাড়ি থাকব না। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।
বাবা এতে টের পেলেন, আমি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে আছি। এর আগেও আমি একবার বাড়ি থেকে পলাতক হয়েছি বলে, বাবা খুব ঘাবড়ে গেলেন।
বাবা বললেন, তোমার আপত্তি থাকলে আনবে না। তোমরা বড় হয়েছ, যা ভাল বোঝ করবে। বাবা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পিতা পুত্রের মধ্যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বাবা আগেই বুঝতে পেরেছেন, আজ যেন সেটা আরও বেশি অনুভব করলেন। বাইরে বের হয়ে দেখলাম, বাবা ঠাকুরঘরের দরজা খুলে শালগ্রামশিলাটি দেখছেন। প্রদীপের নিষ্প্রভ আলোতে বাবার মুখ খুবই করুণ দেখাচ্ছে। এরপর আর ক্ষুব্ধ থাকা যায় না। হাত মুখ ধুয়ে ডাকলাম, মা খেতে দাও।
খেতে বসলে মা বলল, তোমার বাবাকে ডাক
হাত জলে ধুয়ে পঞ্চ দেবতার উদ্দেশে গণ্ডুষ করার আগে ডাকলাম, বাবা আপনার ভাত দিয়েছে।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে যেন হালকা বোধ করেন। মিমিকে নিয়ে যে ঝড় উঠেছিল পুত্রের সেটা কেটে গেছে ভেবে তিনি হৃষ্টচিত্তে ঘরে ঢুকে খেতে বসলেন। গণ্ডুষ করার সময় আমাকে গোপনে দেখছেন তাও টের পাচ্ছি। কিন্তু আমি তাকাতে পারছি না। বাবা বড় সরল মানুষ। এদেশে এসে স্ত্রী পুত্র সন্তান-সন্ততি নিয়ে অথৈ জলে পড়ে গেছিলেন। এখন ঘর বাড়ি করে স্থিতি লাভ করায় কিছুটা ‘সুখী গৃহকোণ বাজে গ্রামাফোন’ ভাব তাঁর। তিনি আমাকে নিয়ে বড় কিছু স্বপ্ন দেখতেই পারেন। একবার শুধু বললেন, মুকুলের জামাইবাবু কিছু খবর দিল?
—বলেছে হবে।
বাবার যেন আর কোনো দুঃখ থাকল না। খাবার পর তিনি বারান্দায় কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে তামাক টানলেন। শোবার আগে তাঁর স্বভাব, গোয়াল ঘরে একবার ঢোকা, তারপর লণ্ঠন হাতে নিয়ে সারা বাড়ি প্রদক্ষিণ করা। সব ঘরের দরজা বন্ধ কিনা, কিংবা ঠাকুর ঘরে শেকল তোলা আছে কিনা, সব দেখে শুনে সবাই শুলে তিনি শুতে যান। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করার সময় টের পেলাম, আমার বাবা সংসারের মঙ্গলার্থে এখন লণ্ঠন হাতে বাড়িটা প্রদক্ষিণ করছেন। কিছু স্তোত্র পাঠ করছেন। গভীর অন্ধকার নিশীথে বাড়িটা আবার কোনো অশুভ প্রভাবে না পড়ে যায়—এ সব কারণেই তাঁর এই স্তোত্র পাঠ। ঈশ্বর নির্ভর মানুষের এ ছাড়া যেন আর কোনো গতি নেই।
কটা দিন আমার খুবই অস্বস্তিতে কাটল। বাড়িতে কখন না মিমি এসে হাজির হয়। জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়ের গরম, খালি গায়েই থাকা যায় না, তার উপর যদি সারাদিন গায়ে জামা রাখি—কী যে কষ্ট! তবু উপায় নেই, হুট করে মিমি এসে হাজির হলে দেখতে পাবে আমি খালি গায়ে বারান্দায় কিংবা ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি। কিংবা নিজের ঘরে চুপচাপ বসে কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। কখন হুট করে ঢুকে যাবে, কেউ বলতে পারে না। কাজেই সকালে উঠেই জামা গায়, চান করে এসেও জামা গায়, বিকেলে বের হবার আগেও জামা গায়—বাবা এক দু-দিন লক্ষ্য করে বললেন, তোমার কি কোনো অসুখ বিসুখ হয়েছে!
বাবা মঙ্গল চণ্ডীর পূজা দিতে রওনা হবার আগে এমন কথা বললেন। বাবার খালি গা। নামাবলী চাদরের মতো জড়ানো। হাতে একটা গামছা। গামছাখানা সঙ্গে রাখেন, পূজা আর্চা হয়ে যাবার পর যজমানদের দেওয়া প্রসাদ এবং ভোজ্য সব গামছায় পুঁটুলিতে বেঁধে নিয়ে আসেন। বাবা এখন যত তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে চলে যান তত মঙ্গল। আমি চাই না, বাবার এই বামুন ঠাকুরের চেহারা মিমি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করুক। পা খালি। বোধহয় ক্রোশখানেক পথ যেতে হবে, এ জন্যে খড়ম পায়ে এতটা পথ যাবার তাঁর সাহস নেই। খালি পায়ে রওনা হয়েছেন। বাবার ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। ফেরার পর দেখা যাবে, ট্যাকে দুটো তামার পয়সা দক্ষিণা, আর গামছায় কিছু চাল কাঁচা হলুদ আলু এমন সব মিলে পোয়াটেক জিনিস। এরই জন্য সকাল সকাল স্নান সেরে গৃহদেবতার পূজা শেষ করে বের হয়ে পড়েছেন। পূজা আর্চার জন্য তিনি নিরম্বু উপবাসে অনেক কাল থেকে অভ্যস্ত। ফিরে এলে তাঁর আহার। মাও ততক্ষণ না খেয়ে বসে থাকবে। অসুখ-বিসুখ হয়নি বলেও পার পাওয়া যাবে না। আমার উত্তরের আশায় ডালিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। হাঁটা দিতে পারছেন না। বলতেই হয়, অসুখের কি দেখলেন!
—জ্বর জ্বালা যদি হয়। তবে তোমার চোখ তো পরিষ্কার। তোমার কি শীত শীত করে?
—শীত করবে কেন!
—ঠাণ্ডা লাগেনি তো?
—না, ঠাণ্ডা লাগেনি। ভালই আছি। আমার কিছু হয় নি।
—কিছু হয়নি তো গায়ে সারাক্ষণ জামা রাখছ কেন?
মহামুশকিল আমার এই বাবাটিকে নিয়ে। গায়ে কেন জামা রাখছি তারও কৈফিয়ত দিতে হবে।
—গরমে হাঁসফাস আর তুমি কি না গা থেকে জামা খুলছ না। ঘাম বসে বুকে কফ-টফ না বাধিয়ে ছাড়বে না দেখছি।
—আমার কিছু হবে না। বলে ঘরে ঢুকে গেলে বাবা বুঝতে পারলেন, এ নিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি না। তিনি চলে যাবার সময় বললেন, যা খুশি করো। আমার কি! আমি আর ক’দিন? তোমরা বড় হয়েছ, এখন তোমাদের মেজাজ-মর্জি আমি বুঝব কি করে। আমার কোনো কাজই তোমাদের পছন্দ না।
এতটা পর্যন্ত শুনেছি, পরে কি বলতে বলতে বের হয়ে গেলেন বুঝতে পারলাম না। পিলু পুকুর থেকে জল-শাক তুলে এনেছে এবং সঙ্গে যথেচ্ছ সাঁতার কাটা সহ, ডুব সাঁতারে পুকুর এ-পার ও- পার হওয়ার কাজটুকু সেরে আসায়, চোখ জবা ফুলের মতো লাল। বোধ হয় বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বাড়ি ঢুকতে সাহস পায়নি। চোখ দেখলেই বাবা টের পেতেন তাঁর মেজ সন্তানটি পুকুরের জলে সকাল থেকেই অদৃশ্য হয়েছিল। মাঠে গরু দিয়ে আসার নামে সে যে এতক্ষণ নিখোঁজ ছিল, তার একটাই কারণ, জল দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়া। গরম থেকে পরিত্রাণের এর চেয়ে যেন বড় উপায় তার হাতের নাগালে আর কিছু নেই!
জল-শাক তুলে এনেছে বলে মা’র কোনো আর অভিযোগ নেই পিলুর বিরুদ্ধে। মুসুরির ডালে বড়ি দিয়ে বাবা জল-শাক খেতে খুব পছন্দ করেন। সুতরাং পিলু মাকে কোঁচড় থেকে জল-শাক তুলে দেবার সময় বলল, মা, বাবা গজগজ করতে করতে যাচ্ছে। তুমি বাবাকে কিছু বলেছ?
মা বলল, আমি বলবার কে! আমার আর গুরুত্ব কি। আমি বললেই কে শোনে।
আসলে সবটাই আমাকে উপলক্ষ্য করে বলা।
—তা’লে দাদার সঙ্গে হয়েছে।
—জানি না। দাদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
পিলু মাথা মুছছিল গামছা দিয়ে। আর একটা গামছা পরনে। ভাল করে ঢাকাঢুকি নেই। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, দাদা তুই বাবাকে কিছু বলেছিস?
—কী বলব? কিছু বলিনি। সব তো দেখা যাচ্ছে। তুই কি রে!
পিলু নিচের দিকে তাকিয়ে জিভ কামড়ে ছুটে বের হয়ে গেল।
এ বাড়িতে আমার কত সমস্যা বাবা মা কেউ বুঝতে পারবে না। পিলু দৌড়ে গিয়ে বুঝিয়ে দিল, সে সত্যি একেবারে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছে। ঢাকাঢুকির ব্যাপারে কোনো সতর্কতা নেই। আমাদের পরিবারের সব কিছুই বড় খোলামেলা। মিমিকে দেখলে বুঝতে পারি কোথায় আমাদের সঙ্গে তার কতটা দূরত্ব। সে যেন যোজন প্রমাণ। এত বড় দূরত্ব অতিক্রম করার সাহস কিংবা সামর্থ্য আমার নেই। সুতরাং সে গায়ে পড়ে এলে, বুঝতে হবে আমায় অপমান করা ছাড়া সে আর কিছু চায় না। সে বোঝে আমি কেন তাকে এড়িয়ে চলি।