» » পণ্ডিত মশাই

বর্ণাকার

পণ্ডিত মশাই

১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ ও শ্রাবণ সংখ্যা ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রে ‘পণ্ডিত মশাই’ প্রথম প্রকাশিত হয়। অতঃপর, একই অব্দের ভাদ্রের শেষ বা আশ্বিনের শুরুতে (১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৪ খৃষ্টাব্দ) গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯১৪ সালের প্রাক্কালে, যখন বঙ্গের সন্তানেরা মোটামুটি পড়ালেখা শিখে আধুনিক জীবনের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে, সেই সময়ের গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পণ্ডিত মশাই’ উপন্যাস। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বৃন্দাবন অধিকারী, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বৃন্দাবন মূলত সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষের পড়ালেখার নিমিত্তে তার নিজের খরচে নিজ গৃহে একটি পাঠশালা খুলে বসে। এই পাঠশালার বাচ্চাদের লেখাপড়ার সরঞ্জামাদির টাকাও যোগাত বৃন্দাবন নিজে। দেশমাতৃকার জন্যে গভীর দায়িত্ববোধসম্পন্ন এই স্ব-প্রণোদিত ‘পন্ডিতমশাই’য়ের নামেই উপন্যাসের নাম। উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র, কার্যত উপন্যাসেরও প্রধান চরিত্র পঞ্চদশী কিশোরী কুসুম।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যান্য উপন্যাসের নারী চরিত্রের সাথে কুসুমের কিঞ্চিৎ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কুসুমের বাল্য ইতিহাস তার অজানা, সেই অজানা ইতিহাস সে সময়কার গ্রাম-সমাজ এমন নোংরামিতে ভরপুর করে রেখেছে যে উপন্যাসের শেষদিকে কুসুমের মাঝে তীব্র অস্তিত্ব-সংকট দেখা দেয়। কুসুম মূলত দৃঢ়চেতা এবং নিজ খেয়ালকে গুরুত্ব দেওয়া এক কিশোরী। নিজেকে নিয়ে সে সদা পরিষ্কার থাকলেও তার আত্মাভিমান তাকে উপন্যাসের শুরুতেই মিলনাত্মক পরিণতিতে পৌঁছাতে দেয়নি। অবশ্য, এই তীব্র রূপের অধিকারী কিশোরীর এমন আত্মাভিমান জন্ম না নিলে খুব সম্ভবত এই উপন্যাসটি এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেত না।

কুসুমের ভাই কুঞ্জ। কুঞ্জের চরিত্রে উপন্যাসে তিন ধরণের পরিবর্তন চোখে পড়ে। প্রথমদিকে সে ছোটবোনের স্নেহানুগত হলেও মাঝামাঝি দিকে তার মাঝে চিরায়ত বাঙালি সমাজের একটা ছাপ আমরা দেখতে পাব। মানুষ অর্থযশ আর খ্যাতিতে বদলে যায়, কুঞ্জের ক্ষেত্রেও তার কোনরকম নড়চড় হয়নি। যদিও তার ছোটবোনের প্রতি তীব্র স্নেহ তাকে শেষ দিকে উপস্থাপন করেছে অন্যভাবে।

এই তিন প্রধান চরিত্র নিয়ে উপন্যাসটি গড়ে উঠলেও এতে আরো কিছু শক্তিশালী চরিত্রের আনাগোনা দেখা যায়। কিন্তু সেগুলো নিতান্তই গড়ে উঠেছে উপন্যাসের প্রয়োজনে।

উপন্যাসটির আরও গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাব পুরো কাহিনীতে কুঞ্জনাথ চরিত্রটি সর্বদা থেকে গেলেও মূল উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে কুসুম ও বৃন্দাবনকে ঘিরেই। এটুকুতে যদি কেউ এটিকে রোমান্টিক জনরার উপন্যাস বলে মনে করেন, অবশ্যই ভুল করবেন। এটি মোটেও রোমান্টিক উপন্যাস নয়, আবার পুরোদস্তুর সামাজিক উপন্যাসও নয়। মূলত পুরো উপন্যাস জুড়েই বৃন্দাবন ও কুসুমের জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলা করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রথমেই কুসুম ও বৃন্দাবনের মধ্যে যে সম্পর্ক উল্লেখ করা হয়েছে সেটিও পুরো উপন্যাসে অনিশ্চয়তার দোলাচলে পাক খেয়েছে। পাঁচ বছর বয়সে কুসুমের সাথে বৃন্দাবনের বিয়ে হবার পর যে তা অনাকাঙ্ক্ষিত এক কারণে মাত্র কিছুদিন পরই ভেঙে যায়। এরপরই কুসুমের জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটে যেটি কিনা সত্যি সত্যিই ঘটেছিল কিনা জানতে অপেক্ষা করতে হবে উপন্যাসের শেষ অব্দি।

এ উপন্যাসে কুসুমের অপরিসীম মাতৃহৃদয়ের একগল্প আমরা জানতে পারব। তবে সেটি কার জন্যে জানতে হলে আমাদের পড়তে হবে আস্ত উপন্যাসটি। কুসুমের আত্মাভিমান কিংবা পর্বতপ্রমাণ অভিমানের সাথে বৃন্দাবনের মোড় খাওয়া চরিত্রটি উপন্যাসের সাথে বেশ ভালভাবেই যাচ্ছিল। শেষ অব্দি উপন্যাসটিকে বিরহের ছকে ফেলে দিলেও মিলনাত্মক বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে। খুব সম্ভবত এর দায়ভার শরৎচন্দ্র পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

বিয়ে তো সব পুরুষ করে, প্রকৃত প্রেমিক হয়ে ওঠে কয়জন! সব মেয়েতো বিয়ের পর আদর-সোহাগ পেয়ে থাকে, ভালোবাসার খোঁজ পায় কয়জন! পণ্ডিত মশাই পড়লে এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘোরপাক খাওয়া স্বাভাবিক। যুগযুগ হতে সমাজের রীতিনীতির জন্য কত মেয়েকে বঞ্চনা সহ্য করে আসতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। একজন পুরুষ চাইলে হাত ধরতে পারে তার প্রিয়তমার স্ত্রীর, তার জন্যে তার সাহস থাকা দরকার কিন্তু চাইলেও তো সমাজকে উপেক্ষা করা যায় না!

পুতুল খেলার বয়সে কুসুমের বিয়ে হয় বৃন্দাবনের সাথে। কুসুমের মা এবং বৃন্দাবনের বাবার কলহের জন্য কুসুমকে পতিগৃহ ছাড়তে হয়।বৃন্দাবনের বাবা তার ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দেন। অন্য দিকে কুসুমের মা হিন্দুদের কী নীতির মাধ্যমে (কণ্ঠী বদল) কুসুমের বিয়ে দেন এবং সে হয়ে যায় এক বৈরাগীর স্ত্রী, ছয়মাসের মাথায় সে অধম এই নরাধমের মায়া ত্যাগ করে। কুসুম হয়ে যায় বিধবা (যদি ও পরে জানা যায় এই কণ্ঠী বদল হয় নি।

শাস্ত্র মতে, সে এখনো বৃন্দাবনের স্ত্রী কিন্তু তখন অনেক বছর হয়ে গেছে।পরে হিন্দুধর্মের বৈধব্য রীতি মানতে হয়, যদিও সে সব মানে তা নয়। সে পড়ালেখা করেছে তার নিজস্ব মতামতের স্বাধীনতা রয়েছে; তারপরেও সে অবহেলিত। বৃন্দাবন এখন প্রাপ্তবয়স্ক, তার পিতা গত হয়েছেন। সে কুসুমকে দেখে, তার প্রেমে পরেছেন তাই সে তাকে ঘরে আনতে চান। সে এই কথা কুসুমের বড় ভাইকে বলে। এক দুপুরে বৃন্দাবন তার মা মরা ছেলেকে নিয়ে কুসুমদের গৃহে আসে। কুসুম তার ছেলেকে মাতৃস্নেহে গ্রহণ করে। বৃন্দাবনের মা তার পরিত্যাগ করা পুত্র -বধূকে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু অভিমানী কুসুম তা গ্রহণ করতে পারে নি।

সে চেয়েছিল তার স্বামী ভুলের জন্য ক্ষমা চাবে, বা তার বাবার ভুলের জন্য কুসুমের মনে যে অভিযোগ, সে অভিমান ভাঙবার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু তার কিছু হল না! তাদের মাঝে যোগাযোগ ছিল শুধু বৃন্দাবনের ছেলে চরণকে কেন্দ্র করে। চরণ, কুসুমকে মা ডাকে। কিন্তু কুসুমের যে ভালবাসা তার স্বামীকে ঘিরে অন্যদিকে বৃন্দাবনের যে আকুতি-উৎকণ্ঠা কুসুমকে নিয়ে তা প্রকাশ করে না। কুসুম আর বৃন্দাবনের বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না।

এর মধ্যে অনেক তিক্ততা, মহামারী, পুত্র-মা হারিয়ে বৃন্দাবন সংসার ত্যাগ করার বাসনা করে আর এই প্রথমবার কুসুম সব ভুলে তার স্বামীর ছায়া সঙ্গী হওয়ার জন্য প্রস্তুত। বৃন্দাবন আপত্তি করলে, কুসুম বলে সে তার ভুলে ছেলে হারিয়েছে, স্বামী হারাতে পারবে না।

সমাজে বিধবা নারীর কত কষ্ট লেখক তা কুসুম চরিত্রে তা তুলে ধরেছেন। সমাজে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য এবং নিচুস্তর লোকদের প্রতি তাদের মনোভাব তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। হয়তো বিধবাবিবাহ চালু হয়েছে, হয়তো ব্রাহ্মণদের দৃষ্টি-ভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু নারীদের অবস্থানের খুব বেশি কী পরিবর্তন হয়েছে? এখনো কী মেয়েদেরকে কথা শুনতে হয় না, অবহেলিত হতে হয় না, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে?আজও হাজার কুসুম রাগে, অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠে। হয়তো তার পরিস্থিতি ভিন্ন, কিন্তু তার পরিণাম একই।

পরিশেষে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বরাবরের মতই গভীর মমতা দিয়ে এঁকেছেন কুসুম চরিত্রটিকে। অসম্ভব হৃদয়াবেগ সম্পূর্ণ একটি উপন্যাস। মানুষের মহান চরিত্র ও নিষ্ঠুর চরিত্র–এই দুটি বিষয়েই খুব পরিস্ফুট ভাবে বোঝানো হয়েছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যেইরূপ ভালোবাসা এই উপন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে; তা চিরকাল অনবদ্য হয়ে থাকবে।