অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

কল্লোল যুগ

চার

কাঁচা মাটিতে নামের দাগ কতক্ষণ বেঁচে থাকবে?

গোকুলের পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বেরুল। কিন্তু তার পৃষ্ঠে ললাটে নিজেদের নাম লিখি কি দিয়ে? কলম? কারুরই কলম নেই। পেন্সিল? দাঁড়াও, বাড়ির ভিতর থেকে জোগাড় করছি একটা।

পেন্সিল দিয়ে সবাই সেই ভিজিটিং কার্ডের গায়ে নিজের নিজের নাম লিখে দিলাম। সেই ভিজিটিং কার্ডটি মুরলীদার কাছে এখনো নিটুট আছে।

মুরলীধর বসু ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের একজন সাদাসিদে সাধারণ ইস্কুল মাস্টার! নিরাড়ম্বর নিরীহ জীবন, হয়তো বা নিম্নগত। এমনিতে উচ্চকিত উৎসাহিত হবার কিছু নেই। কিন্তু কাছে এসে একটা মহৎ উপলব্ধির আস্বাদ পেলাম। অদম্য কর্ম বা উত্তঙ্গ চিন্তায় শুধু নয়—আছে সুদূরবিলাসী স্বপ্ন। দীনেশরঞ্জনের মত মুরলীধরও স্বপ্নদর্শী। তাই একজন D. R. আরেকজন মুরলীদা।

একদিকে “কল্লোল”, আরেক দিকে “সংহতি”।

ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দুটি মাসিক পত্রই একই বছরে একই মাসে এক সঙ্গে জন্ম নেয়। ১৩৩০, বৈশাখ। “কল্লোল” চলে প্রায় সাত বছর, আর “সংহতি” উঠে যায় দু বছর না পুরতেই।

“কল্লোল” বললেই বুঝতে পারি সেটা কি। উদ্ধত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা, সমস্ত বাধা-বন্ধনের বিরুদ্ধে নির্ধারিত বিদ্রোহ, স্থবির সমাজের পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আলোড়ন। কিন্তু “সংহতি” কি? সংহতি তো শিলীভূত শক্তি। সংঘ, সমূহ, গণগোষ্ঠী। যে গুণের জন্যে সমধর্মী পরমাণুসমূহ জমাট বাঁধে, তাই তো সংহতি। আশ্চর্য নাম। আশ্চর্য সেই নামের তাৎপর্য।

এক দিকে বেগ, আরেক দিকে বল। এক দিকে ভাঙন, আরেক দিকে সংগঠন, একীকরণ।

আজকের দিনে অনেকেই হয়তো জানেন না, সেই “সংহতি”ই বাংলাদেশে শ্রমজীবীদের প্রথমতম মুখপত্র, প্রথমতম মাসিক পত্রিকা। সেই ক্ষীণকায় স্বল্পায়ু কাগজটিই গণজয়যাত্রার প্রথম মশালদার। “লাঙল”, “গণবাণী” ও “গণশক্তি”—এরা এসেছিল অনেক পরে। “সংহতি”ই অগ্রনায়ক।

এই কাগজের পিছনে এমন একজনের পরিকল্পনা ছিল যার নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তিনি জিতেন্দ্রনাথ গুপ্ত। আসলে তিনিই এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা। অমৃতবাজার পত্রিকার ছাপাখানায় কাজ করেন। ঢোকেন ছেলেবয়সে, বেরিয়ে আসেন পঞ্চাশ না পেরোতেই, জরাজর্জর দেহ নিয়ে। দীর্ঘকাল বিষাক্ত টাইপ আর কদর্য কালি ঘেঁটে ঘেঁটে কঠিন ব্যাধির কবলে পড়েন। কিন্তু তাতেও মন্দা পড়েনি তার উদ্যমে-উৎসাহে, মুছে যায়নি তাঁর ভাবীকালের স্বপ্নদৃষ্টি।

একদিন চলে আসেন বিপিন পালের বাড়িতে। তাঁর ছেলে জ্ঞানাঞ্জন পালের সঙ্গে পরিচয়ের সুতো ধরে।

বিপিন পাল বললেন, ‘কি চাই?’

‘শ্রমজীবীদের জন্যে বাংলায় একটা মাসিকপত্র বের করতে চাই।’

এমন প্রস্তাব শুনবেন বিপিনচন্দ্র যেন প্রত্যাশা করেন নি। তিনি মেতে উঠলেন। এর কিছুকাল আগে থেকেই তিনি ধনিক-শ্রমিক সমস্যা নিয়ে লেখা আর বলা শুরু করেছেন। ইন্টারন্যাশন্যাল গ্রুপ-এর ম্যানিফেস্টোর (পৃথিবীর অন্যান্য মনীষীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও রোঁলারও দস্তখৎ আছে) ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর “World situation and Ourselves” বক্তৃতায়; ইংরিজিতে প্রবন্ধ লিখেছেন মানুষের বাঁচবার অধিকার—“Right to Live” নিয়ে। তিনি বলে উঠলেন : ‘নিশ্চয়ই। এই দণ্ডে বের করুন, আর কাগজের নাম দিন “সংহতি”।’

কিন্তু কাগজ কি চলবে?

কেন চলবে না? জিতেনবাবু কলকাতার প্রেস-কর্মচারী সমিতির উদ্যোক্তা, সেই সম্পর্কে তাঁর সহকর্মী আর সহ-সদস্যেরা তাকে আশ্বাস দিয়েছে, কাগজ বের হওয়া মাত্রই বেশ কিছু গ্রাহক আর বিজ্ঞাপন জুটিয়ে আনবে। সকলে মিলে রথের রশিতে টান দেব, ঠিক চলে যাবে।

‘কিন্তু সম্পাদক হবে কে?’

‘সম্পাদক হবে জ্ঞানাঞ্জন পাল আর তার বন্ধু মুরলীধর বসু।’

‘আর আফিস?’

‘আফিস হবে ১ নম্বর শ্রীকৃষ্ণ লেন, বাগবাজার।’ কুণ্ঠিত মুখে হাসলেন জিতেনবাবু।

‘সেটা কি?’

‘সেটা আমারই বাসা। একতলার দেড়খানা ঘরের একখানি।’

সেই একতলায় দেড়খানা ঘরের একখানিতে ‘সংহতি’র আফিস বসল। দক্ষিণচাপা গলি, রাস্তার দিকে উত্তরমুখো লম্বাটে ঘর। আলো-বাতাসের সংস্পর্শ নেই। একপাশে একটি ভাঙা আলমারি, আরেক পাশে একখানি ন্যাড়া তক্তপোশ। টেবিল চেয়ার তো দূরের কথা, তক্তপোশের উপর একখানা মাদুর পর্যন্ত নেই। শুধু কি দরিদ্রতা? সেই সঙ্গে আছে কালান্তক ব্যাধি। তার উপর সদ্য স্ত্রী হারিয়েছেন। তবু পিছু হটবার লোক নন জিতেনবাবু। ঐ ন্যাড়া তক্তপোশের উপর রাত্রে ছেলেকে নিয়ে শোন আর দিনের বেলা কাশি ও হাঁপানির ফাঁকে “সংহতি”র স্বপ্ন দেখেন।

সম্পাদকের সঙ্গে রোজ তার দেখাও হয় না। তারা লেখার জোটপাট কবেন ভবানীপুরে বসে, প্রুফ দেখেন ছাপাখানায় গিয়ে। কিন্তু ছুটির দিন অফিসে এসে হাজিরা দেন। সেদিন জিতেনবাবু অনুভব করেন তার রথের রশিতে টান আছে। মুঠো থেকে খসে পড়েনি আলগা হয়ে। অস্বাস্থ্যকে অস্বীকার করেই আনন্দে ও আতিথেয়তায় উদ্বেল হয়ে ওঠেন। আসে চা, আসে পরোটা, আসে জলখাবার। আপত্তি শোনবার লোক নন জিতেনবাবু।

কাগজ তো বেরুলো, কিন্তু লেখক কই?

প্রথম সংখ্যার প্রথমেই কামিনী রায়ের কবিতা—“নিদ্রিত দেবতা জাগো”। সেই সঙ্গে বিপিন পাল ও পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ। জ্ঞানাঞ্জন লিখলেন “সংহতি”র আদর্শ নিয়ে। তারই ছাপানো নকল আগুড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল ব্রজেন্দ্র শীল আর রবীন্দ্রনাথকে। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ টেলিগ্রামে আশীর্বাণী পাঠালেন, তার বাংলা অনুবাদ ছাপা হলো পত্রিকার প্রচ্ছদে। আর রবীন্দ্রনাথ? এক পরমাশ্চর্য সন্ধ্যায় পরম-অপ্রত্যাশিত ভাবে তার এক অপূর্ব প্রবন্ধ এসে পৌঁছুল। সেই প্রবন্ধ ছাপা হল জ্যৈষ্ঠের সংখ্যাতে।

কিন্তু তারপর? গল্প কই?

বাংলাসাহিত্যের বীণায় যে নতুন তার যোজনা করা হল সে সুরের লেখক কই? সে অনুভূতির হৃদয় কই? কই সেই ভাবের সূত্রধর?

বিপিনচন্দ্র বললেন, ‘নারান ভটচাজকে লেখ। টাকা চায় ভি-পি করে যেন পাঠায়।’

নারায়ণ ভট্টাচার্য গল্প পাঠালেন, “দিন মজুর”।

একবার শরৎচন্দ্রের কাছে গেলে হয় না? শোষিত মানবতার নামে কিছু খুদকুড়া মিলবে না তাঁর কাছে?

কে জানে! তবু দুই বন্ধু জ্ঞানাঞ্জন আর মুরলীধর একদিন রওনা হলেন শিবপুরের দিকে।

বাড়ির মধ্যে আর ঢুকতে পাননি। শরৎচন্দ্রের কুকুর ভেলির তাড়া খেয়েই দোরগোড়া থেকে ফিরে এলেন দুই বন্ধু।

এমন সময় শৈলজার লেখা গল্প “কয়লাকুঠি” নজরে পড়ল।

কে এই নবাগত? মাটির উপরকার শোভনশ্যামল আন্তরণ ছেড়ে একেবারে তার নিচে অন্ধকার গহ্বরে গিয়ে প্রবেশ করেছে? সেখান থেকে কয়লার বদলে তুলে আনছে হীরামণি?

ঠিকানা জানা হল—রূপসীপুর, জেলা বীরভুম। চিঠি পাঠানো হল গল্প চেয়ে। শৈলজা তার মুক্তোর অক্ষর সাজিয়ে লিখে পাঠাল গল্প। নাম “খুনিয়ারা”।

এ গল্প “সংহতি”র তারে ঠিক সুর তুলল না। মুরলীধর শৈলজার সঙ্গে পত্রালাপ চালাতে লাগলেন।

শৈলজা লিখে পাঠাল : ‘নতুন উপন্যাসে হাত দিয়েছি। কারখানায় সিটি বেজেছে আর আমার আখ্যানও সুরু হল।’

মুরলীধর জবাব দিলেন : ‘ছুটির সিটি বাজবার আগেই লেখাটা পাঠিয়ে দিন। অন্তত প্রথম কিস্তি। পত্রপাঠ।’

“বাঙ্গালী ভাইয়া” নাম দিয়ে শৈলজার সেই উপন্যাস বেরুতে লাগল “সংহতি”তে; পরে সেটা “মাটির ঘর” নামে পুস্তকাকৃত হয়েছে।

শৈলজা তো হল। তারপর? আর কোনো লেখক নেই? যজ্ঞের আর কোনো পুরোধা?

“শুধু কেরানী” আর “গোপনচারিণী” তখন প্রেমেনকে অতিমাত্রায় চিহ্নিত করেছে। মুরলীধর তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। বীরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় নামে কলেজের এক ছাত্র (বর্তমান দিল্লীতে অধ্যাপক) “সংহতি”র দলের লোক। ইস্কুলে আমাদের তিনি অগ্রজ, চিনতেন প্রেমেনকে। বললেন, ‘আরে, প্রেমেন তো এ পাড়ারই বাসিন্দে, কোথায় খুঁজছেন তাকে মফঃস্বলে? আর এ শুধু হাতের কাছের লোক নয়, তার লেখাও মনের কাছেকার। সম্প্রতি সে বস্তিজীবন নিয়ে উপন্যাস লিখছে—নাম “পাঁক”।’

মুরলীধর লাফিয়ে উঠলেন। কোথায় ধরা যায় প্রেমেনকে?

এদিকে মুরলীধর প্রেমেনকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আর প্রেমেন তার বাড়ির দরজা থেকে নিরাশ মুখে ফিরে যাচ্ছে।

কিন্তু ফিরবে কোথায়? গোকুল আর ধীরাজ চলে গেল যে যার দিকে, কিন্তু আমাদের তিন জনের পথ যেন সেদিন আর শেষ হতে চায় না। একবার শৈলজার মেস, শাখারীপাড়া রোড, পরে প্রেমেনের মেস গোবিন্দ ঘোষাল লেন, শেষে আমার বাসা বেলতলা রোড—বারে-বারে ঘোরাফিরা করতে লাগলাম। যেন এক দেশ থেকে তিন পথিক একই তীর্থে এসে মিলেছি।

বিকেলে আবার দেখা। বিকেলে আর আমরা “আপনি” নেই, “তুমি” হয়ে গিয়েছি। শৈলজা তার গল্প বলা শুরু করল:

‘আমার আসল নাম কি জানো? আসল নাম শ্যামলানন্দ। ডাকনাম শৈল। ইস্কুলে সবাই ডাকত শৈল বলে। সেই থেকে কি করে যে শৈলজা হয়ে গেলাম—’

প্রায় নীহারিকার অবস্থা!

‘বাড়ি রূপসীপুর, জন্মস্থান অণ্ডাল মামাবাড়ি, আর—বিয়ে করেছি ইকড়া—বীরভূম জেলায়—’

বিয়ে করেছ এরি মধ্যে? কত বয়স? এই তেইশ-চব্বিশ। জন্মেছি ১৩০৭ সালে। তোমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড় হব।

‘বাবা ধরণীধর মুখোপাধ্যায়।  সাপ ধরেন, ম্যাজিক দেখান—’

তাকালাম শৈলজার হাতের দিকে। তাইতেই তার হাতের এই ওস্তাদি। এই ইন্দ্রজাল।

‘বিশেষ কিছুই করতে পারলেন না জীবনে। মাকে হারিয়েছি যখন তিন বছর বয়স। বড় হয়েছি মামার বাড়িতে। দাদামশায় আমার মস্ত লোক। জাদরেল রায়সাহেব।’

তাঁর নাতির এই দীনদশা! আছে এই একটা থুত্থুরো ভাঙা মেসে! হাঁটতে-চলতে মনে হয় এই বুঝি পড়ল হুড়মুড় করে। দোতলা বাড়ি, পূর্ব পশ্চিমে লম্বা, দোতলায় মুখের দিকে কাঠের রেলিং দেওয়া একফালি বারান্দা, প্রায় পড়ো-পড়ো, জায়গায়-জায়গায় রেলিং আলগা হয়ে ঝুলে পড়েছে। উপরতলায় মেস, নিচে সাড়ে বত্রিশ ভাজার বাসিন্দে। হিন্দুস্থানী ধোপা, কয়লা-কাঠের ডিপো, বেগুনি-ফুলুরির দোকান, চীনেবাদামওয়ালা কুলপিবরফওয়ালার আস্তানা। বিচিত্র রাজ্য। সংহতির সংকেত!

‘দাদামশায় তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। “বাঁশরী”তে গল্প লিখেছিলাম “আত্মঘাতীর ডায়রি” বলে। গল্প কি কখনো আত্মকাহিনী হতে পারে? তবু ভুল বুঝলেন দাদামশায়, বললেন, পথ দেখ।’

মেসের সেই ঘরের চারপাশে তাকালাম আশ্চর্য হয়ে। শৈলজার মত আরো অনেকে মেঝের উপর বিছানা মেলে বসেছে। চারধারে জিনিস পত্রের হাবজা-গোবজা। কারু-বা ঠিক শিয়রে দেয়ালে-বেঁধা পেরেকের উপর জুতা ঝুলানো। পাশ-বালিশের জায়গায় বাক্স-প্যাঁটরা। পোড়াবিড়ির জগন্নাথক্ষেত্র। দেখলেই মনে হয় কতগুলি যাত্রী ট্রেনের প্রতীক্ষায় প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। কোথাকার যাত্রী? “ধ্বংসপথের যাত্রী এরা।”

নিজেরা যদিও অভাবে তলিয়ে আছি, তবু শৈলজার দুঃস্থতায় মন নড়ে উঠল। কী উপায় আছে, সাহায্য করতে পারি বন্ধুকে?

বললাম, ‘কি করে তবে চালাবে? সম্বল কি তোমার?’

‘সম্বল?’ শৈলজা হাসল : ‘সম্বলের মধ্যে লেখনী, অপার সহিষ্ণুতা আর ভগবানে বিশ্বাস।’

তারপর গলা নামাল : ‘আর স্ত্রীর কিছু অলঙ্কার, আর “হাসি” আর “লক্ষ্মী” নামে দুখানা উপন্যাস বিক্রির তুচ্ছ ক’টা টাকা।’

‘কিন্তু “কল্লোলে” এলে কি করে?’

“‘কল্লোলে” আসব না?’ শৈলজার দৃষ্টি উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘“কল্লোলে” না এসে পারি? আজকের দিনে যত নতুন লেখক আছে স্তব্ধ হয়ে, সবাইর ভাষাই ঐ “কল্লোল”। সৃষ্টির কল্লোল, স্বপ্নের কল্লোল, প্রাণের কল্লোল। বিধাতার আশীর্বাদে তাই সবাই একত্র হয়েছি। মিলেছি এক মানসতীর্থে। শুধু আমরা ক’জন নয়, আরো অনেক তীর্থঙ্কর।’

‘শোনো, কেমন করে এলাম।’ হঠাৎ কথা থামিয়ে প্রশ্ন করল শৈলজা : ‘পবিত্রকে চেন? পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়?’

‘চিনি না, আলাপ নেই। অনুবাদ করেন, দেখেছি মাসিকপত্রে।’

‘চিনবে শিগগির। বিশ্বজনের বন্ধু এই পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। বুড়ো হোক, কচি হোক, বনেদী হোক, নির্বনেদ হোক, সকল সাহিত্যিকের সে স্বজন-বান্ধব। শুধু মনে মনে নয়, পরিচয়ের অন্তরঙ্গ নিবিড়তায়। শুধু উপর-উপর মুখ-চেনাচেনি নয়, একেবারে হাঁড়ির ভিতরের খবর নিয়ে সে হাঁড়ির মুখের সরা হয়ে বসবে। একেবারে ভিতরের লোক, আপনার জন। বিশ্বাসে অনড়, বন্ধুতায় নির্ভেজাল। এদল-ওদল নেই, সব দলেই সমান মান। পূর্ববঙ্গে বর্ষার সময় পথ-ঘাট খেত-মাঠ উঠান-আঙিনা সব ডুবে যায়, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হলে নৌকো লাগে। পবিত্র হচ্ছে সেই নৌকো। নানারকম ব্যবধানে সাহিত্যিকরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন এক সাহিত্যিকের ঘর থেকে আরেক সাহিত্যিকের ঘরে একমাত্র এই একজনই অবাধে যাওয়া আসা করতে পারে। এই একজনই সকল বন্দরের সদাগর।

আসল কথা কি জানো? লেশমাত্র অভিমান নেই, অহংকার নেই। নিষ্ঠুর দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে, তবু সব সময়ে পাবে নির্ধারিত হাসি। আর, এমন মজার, ওর হাত-পা চোখ-মুখ সব আছে, কিন্তু ওর বয়স নেই। ভগবান ওকে বয়স দেননি। দিন যায়, মানুষ বড় হয়, কিন্তু পবিত্র যে-পবিত্র সেই পবিত্র। নটনড়নচড়ন। আজ যেমন ওকে দেখছি, পঁচিশ বছর পরেও ওকে তেমনি দেখব। অন্তরে কী সম্পদ, কী স্বাস্থ্য থাকলে এই বয়সের ভার তুচ্ছ করা যায় ভেবে দেখো।’

‘নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।’

‘রহস্যের মধ্যে আমার যেমন বিড়ি ওর তেমনি খইনি। আর তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’

সবাই হেসে উঠলাম।

সেই পবিত্র “প্রবাসী”তে কাজ করে। “প্রবাসী” চেন তো?

“প্রবাসী” চিনি না? বাংলা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা।

‘কিন্তু নজরুল বলে, প্রকৃষ্টরূপে বাসি—প্রবাসী।’

চারু বন্দ্যোপাধ্যায় “প্রবাসী”র তখন প্রধান কর্ণধার, এদিকে-ওদিকে আরো আছেন ক’জন মাঝিমাল্লা। আমার গল্প পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে উৎসুক। থাকি বাদুড়বাগান রো-র এক মেসে, চললাম কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট। সাধারণ ব্রাহ্মমন্দিরের পাশের গলিতে “প্রবাসী”-আপিস, গলির মাঝখানে ঝুলছে কাঠের ঢাউস সাইনবোর্ড। সেখান থেকে যাব বত্রিশ কলেজ স্ট্রিটের দোতলায়, “মোসলেম-ভারত” আপিসে, নজরুলের কাছে। সঙ্গে সর্বপ্রিয় পবিত্র। আমহার্স্ট স্ট্রিটে পড়েছি, অমনি পবিত্র সামনে কাকে দেখে “গোকুল” “গোকুল” বলে চেঁচিয়ে উঠল। আর যাই কোথা, ধরা পড়ে গেলাম। কথা কম বলে বটে কিন্তু অদম্য তার আকর্ষণ। যেন মন্ত্রবলে টেনে নিয়ে গেল আমাকে “কল্লোল” আপিসে, সেই “এক মুঠো” ঘরে। “কল্লোল” সবে সেই প্রথম বেরুবে, আদ্ধেক প্রেসে, আদ্ধেক কল্পনায়। সাহিত্যের জগতের এক আগন্তুক পত্রিকার জগতের এক আগন্তুকের দুয়ারে এসে দাঁড়ালাম। আজ তারিখ কত?

বাইশে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১, বৃহস্পতিবার।

সেদিনটা চৈত্রের মাঝামাঝি, ১৩২৯ সাল। এক বছরের কিছু বেশি হল। ঘরে ঢুকে দেখি একটি ভদ্রলোক কোণের টেবিলের কাছে বসে নিবিষ্ট মনে ছবি আঁকছে। পরিচয় হতে জানলাম ও-ই দীনেশরঞ্জন। বললে, “কল্লোল” আপনার পত্রিকা, যে আসবে এ-ঘরে তারই পত্রিকা। লিখুন—লেখা দিন।’ এমন প্রশস্তচিত্ততার সঙ্গে সংবর্ধিত হব ভাবতেও পারিনি। প্রবাসীর জন্যে লুকিয়ে পকেটে করে একটি গল্প নিয়ে চলেছিলাম। দ্বিরুক্তি না করে সেটি পৌঁছে দিলাম দীনেশের হাতে। দীনেশ একটি লাইনও না পড়ে লেখাটা রেখে দিলে তার দেরাজের মধ্যে। বললে, ‘লেখা পেলাম বটে, কিন্তু তার চেয়েও বড় জিনিস পেলাম। পেলাম লেখককে। “কল্লোলে”র বন্ধুকে। “কল্লোলে”র সেই প্রথম সংখ্যার প্রথম গল্প আমার “মা”। আমি আছি সেই প্রথম থেকে।

বললাম, “প্রবাসী” আপিসে গেলে না আর সেদিন?

কোথায় “প্রবাসী” আপিস! নজরুলও বুঝি খারিজ হবার জোগাড়। চারজনে তখন আড্ডায় একেবারে বিভোর। তারপরে, সোনায় সোহাগার মত, এসে পড়ল রুটি, আলুর দম আর চা। এমন আড্ডার জয়জয়কার।

পবিত্র বললে, ‘এই শুভসংযোগ নিত্যকারের ঘটনা। দীনেশের এই মুক্ত দ্বার আর মেজবৌদির এই মুক্ত দাক্ষিণ্য।’

একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে তবু থেকে যাচ্ছিল। বললাম, ‘নজরুলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি? ওকে কি করে চিনলে?’

‘বা রে, ও যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আর সবাই ডাকবে আমাকে শৈলজা বলে, ও ডাকবে শৈল বলে। পাশাপাশি দুই ইস্কুলে একই ক্লাশে পড়েছি আমরা। আমি রানিগঞ্জে, নজরুল শিয়াড়শোল রাজার ইস্কুলে। মাইল দুয়েকের ছাড়াছাড়ি। থার্ড ক্লাশে এসে মিললাম দুজনে, আমি হিন্দু ও মুসলমান, আমি লিখি কবিতা—আশ্চর্য হচ্ছ—ও লেখে গল্প। তবু মিললাম দুজনে। সেই টানে মিললাম, যে টানে ধর্মাধর্ম নেই বর্ণাবর্ণ নেই—সৃষ্টির টান, সাহিত্যের টান। দুইজনে রোজ একসঙ্গে মিলি, ঘুরে বেড়াই, গল্প করি, কোনোদিন বা স্কুল পালাই। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরি, ধরি ই-আই-আরের লাইন, কোনোদিন বা চলে যাই শিশু-শালের অরণ্যে। তখন ইংরেজ-জার্মানিতে প্রথম লড়াই লেগেছে। আমরা দুজনে ম্যাট্রিক ক্লাশে উঠে প্রি-টেস্ট দিচ্ছি। শহরে-গাঁয়ে চলেছে তখন সৈন্যজোগাড়ের তোড়জোড়। হাতে-গরম মুখে-গরম বক্তৃতা। সবাই এগিয়ে গেল বীরত্বের ঘোড়দৌড়ে, বাঙালি হিন্দু মুসলমানই শুধু পিছিয়ে থাকবে? বলো, বীর, চির-উন্নত মম শির! বলো বন্দে মাতরম্!

দুই বন্ধু খেপে উঠলাম। পরীক্ষা দিয়েই দুজনে চুপিচুপি পালিয়ে গেলাম আসানসোল। সেখান থেকে এস-ডি-ওর চিঠি নিয়ে সটান কলকাতা। আসানসোলে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা—তার কাছে কিছু বাহাদুরি করতে গিয়েছিলাম কিনা মনে নেই—সে-ই বাড়ি ফিরে গিয়ে সব ভণ্ডুল করে দিলে। ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি রেজিমেন্টে ঢোকার সব ঠিকঠাক, ডাক্তার বললে, তোমার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আরেকবার মাপতে হবে। দ্বিতীয়বারের মাপজোকে নামঞ্জুর হয়ে গেলাম। কেন যে নামঞ্জুর হলাম জানলেন শুধু ভগবান আর সেই রায়সাহেব দাদামশায়। নজরুলকে যুদ্ধে পাঠিয়ে সাথীহারা হয়ে ফিরে এলাম গৃহকোণে—

তারপর কলেজে ঢুকলাম, অর্থাভাবে কলেজ ছাড়লাম। শিখলাম শর্টহ্যাণ্ড-টাইপরাইটিং। চাকরি নিলম কয়লকুঠিতে। পোষাল না। শেষে এই সাহিত্য।

পাশা উলটো পড়েছিল ভাগ্যিস। তাই নজরুল কবি, তুমি হলে গল্পলেখক।

এমন সময় মুরলীদার আবির্ভাব।

প্রথম আলাপ-পরিচয়ের উত্তাল ঢেউ। কেটে যাবার পর মুরলীদা বললে, ‘আসছে রবিবার, পঁচিশে জ্যৈষ্ঠ, কাজীর ওখানে আমাদের সবাইর নেমন্তন্ন–’

‘আমাদের সবাইকার।’ আমি আর প্ৰেমেন একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। যার সঙ্গে আলাপ নেই, তার ওখানে নেমন্তন্ন কি করে হতে পারে!

‘হ্যাঁ, সবাইকার।’ বললে মুরলীদা। ‘সমস্ত “কল্লোলে”র নেমন্তন্ন।’

তা হলে তো আমাদেরও নেমন্তন্ন। নিঃসংশয়রূপে নিশ্চিন্ত হলাম। কল্লোলে তখনও লেখা এক আধটা ছাপা না হোক, তবু আমরা মনেপ্রাণে “কল্লোলে”র।

বললাম, ‘কোথায় যেতে হবে?’

‘হুগলিতে। হুগলিতেই কাজী নজরুলের বাসা।’

এই হুগলির বাসা উপলক্ষ্য করেই বুঝি কবি গোলাম মোস্তাফা লিখেছিল :

“কাজী নজরুল ইসলাম

বাসায় একদিন গিছলাম।

ভায়া লাফ দেয় তিন হাত

হেসে গান গায় দিন রাত।

প্রাণে ফুর্তির ঢেউ বয়

ধরায় পর তার কেউ নয়।”

এর পাল্টা-জবাবে নজরুল কি বলেছিল জানো?

“গোলাম মোস্তফা

দিলাম ইস্তফা।”