আমেনা তার স্বামীর কাছে চিঠি লিখছিলো তখন। আমি নিরাপদে এসে পেীছেছি। পথে কোন কষ্ট হয়নি। মামা আর মামী আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাতের ট্রেনে চাটগাঁয়ে চলে গেছেন। এখানে ভাবীরা আমার দিকে চেয়ে চেয়ে মুখ টিপে হাসছিলো। ভীষণ লজ্জা লাগছিলো আমার। জানো, ওরা কেউ ভাবতেই পারে নি।

এখানে এসে চিঠি লেখা বন্ধ করলো আমেনা। কি লিখেছে একবার পড়লো।

না। কিছু হয়নি। আবার লিখতে হবে।

নতুন কাগজ নিয়ে আবার বসলো আমেনা।

জানো, আজ রাতে আব্বা একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছেন। ওটা নাকি আমার দাদুও দেখেছিলেন। দেখার দুদিন পরে তিনি আর আমার মেজ চাচা মারা যান।

আব্বা বলছিলেন নিশ্চয়ই এবারও একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

জানো, আমার ভীষণ ভয় করছে। তুমি কাছে নেই। মুরব্বিরা বলেন, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত। তাঁদের কোন কথা অমান্য করলে গুনাহ্ হয়।

আজ মনে হচ্ছে ওরা ঠিকই বলেন।

তুমি এখানে আসতে নিষেধ করেছিলে। তোমার বাধা না মেনে আমি চলে এসেছি। দেখতে, এসে কি বিপদের মধ্যে পড়েছি।

ওগো। তুমি আর দেরি করো না। জলদি করে চলে এসো। যদি ছুটি না পাও তাহলে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করো। আমি আর কোনদিন তোমার কথা অমান্য করবো না।

ওগো। আমার ভীষণ ভয় করছে।

লিখতে গিয়ে আবার থামলো আমেনা।

পুরোটা পড়লো।

তারপর আবার লিখতে শুরু করলো সে।

ছোট ছেলে শামসু বেশ কিছুদিন ধরে অসুখে ভুগছে। পেটের অসুখ। তেমন সাংঘাতিক কিছু না হলেও দিনে দিনে শরীরটা ক্ষয়ে যাচ্ছে ওর। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে দেহটা।

অনেক কসরতের পর সবেমাত্র ঘুম এসেছে তার।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখছে।

বাবা যে মূর্তিগুলোর বর্ণনা দিয়েছিলেন তেমনি চারটি মূর্তি।

মূর্তিগুলো ধীরে ধীরে তার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ালো। আহা, আমাদের ছেলে এবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে। খোকন আমাদের।

মানিক আমাদের।

আতঙ্কে সমস্ত দেহ হিম হয়ে গেলো শামসুর।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো। মূর্তিগুলো একটা লম্বা ফিতে দিয়ে ওর দেহের মাপ নিচ্ছে। হ্যাঁ, কবরটা কত বড় হবে দেখে নাও।

দেখো, কবরের মাপ যেন আবার ভুল না হয়।

তীব্র একটা আর্তনাদের সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ওর। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো শামসু। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার ঘর খালি। তারপর চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে।

ও বাবাগো। আব্বা। আম্মারে। আমি তো মরে গেলাম। আব্বাগো আমি তো মরে গেলাম। ও আব্বা।

চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এলো সে ঘরে।

কি হয়েছে?

কি হলো?

কাঁদছো কেন?

কি হয়েছে আঁ?

বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে কাঁদতে শামসু জবাব দিলো, আমি মরে যাবো। মরে যাবো। এইমাত্র ওরা এসে আমার কবরের মাপ নিয়ে গেছে। আম্মা, আম্মাগো বলে মাকে

জড়িয়ে ধরলো সে।

মনসুর শুধালো, কারা তোর কবরের মাপ নিয়ে গেছে।

কান্নার মাঝখানে শামসু বললো, সেই সাদা সাদা মূর্তিগুলো আব্বা যাদের কথা বলছিলো।

ইয়া আল্লা। বুড়ো কর্তা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ধীরে ধীরে ছেলের পাশে বসলেন তিনি। তারপর এক এক করে ছেলেকে প্রশ্ন করতে লাগলেন।

মূর্তিগুলো কত লম্বা ছিলো। কোথায় দাঁড়িয়েছিলো। কেমন করে সামনে এলো। কি কথা ওরা বললো।

হ্যাঁ। সব মিলে যাচ্ছে। হুবহু মিলে যাচ্ছে ওর দেখা স্বপ্নের সঙ্গে। শুধু একটা ব্যতিক্রম। এবার কবরের মাপ নিয়ে গেছে ওরা। ইয়া আল্লা। শিশুর মতো অসহায় দৃষ্টিতে অসুস্থ ছেলেটার দিকে তাকালেন তিনি। শামসু তখনো কাঁদছে।

গিন্নী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, কাঁদিস না। কাঁদিস না। কেঁদে কি হবে? আল্লা আল্লা কর। আল্লাকে ডাক।

আম্মা। আম্মাগো। বলে কাঁদতে থাকলো শামসু। গিন্নী তাকে মৃদু তিরস্কার করলেন। আমাকে ডেকে কি হবে, আল্লাকে ডাক।

শামসু এবার শব্দ করে আল্লাকে ডাকতে শুরু করলো।

বুড়ো আহমদ আলী শেখ তখনো কপালে হাত রেখে নীরবে বসে। অঘটন যে একটা ঘটবে এ সম্পর্কে তাঁর মনে আর কোন দ্বিধা নেই।

আজ বিশ বছর এ পরিবারে কেউ মরেনি।

মৃত্যুর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন আহমদ আলী শেখ।

আজ মৃত্যু এসে তাঁর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে।

মনে মনে আজরাইলের কথা ভাবলেন বুড়ো কর্তা।

পরলোকের কথা ভাবলেন।

হাশরের ময়দানের কথা ভাবলেন।

বেহেস্ত আর দোজখের কথা ভাবলেন।

তারপর পুত্রকন্যা সবার দিকে তাকালেন তিনি।

তোমরা যাও। ঘরে যাও। আল্লা যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। ঘরে গিয়ে আল্লা আল্লা করো। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। অনেকদিন হলো তিনি বুড়ো হয়েছেন। কিন্তু বার্ধক্যের অনুষঙ্গগুলো কোনদিন উপলব্ধি করেন নি। আজ মনে পড়েছে। দেহটা ভারভার লাগছে মনে হচ্ছে বুঝি লাঠি ছাড়া তিনি হাঁটতে পারবেন না।

মনসুর আর তার বউ। দুজনে বিছানায় শুয়ে, ঘুম আসছে না। খোলা দুজোড়া চোখ কড়িকাঠের দিকে চেয়ে।

সহসা নীরবতা ভাঙলো বড় বউ। শামসুটা বোধ হয় মারা যাবে। কমাস ধরেই তো অসুখে ভুগছে। হ্যাঁলো, সেবার স্বপ্ন দেখেছিলো তখন দুজন মারা গিয়েছিলো তাই না?

হ্যাঁ।

এবারো হয়ত দুজন মারা যাবে। স্বামীর দিকে আড়চোখে একবার তাকালো বড় বউ।

মনসুর কোন উত্তর দিলো না।

বড় বউ তার একখানা হাত স্বামীর গায়ের উপরে রাখলো।

কি, ঘুমিয়ে পড়েছো?

না। একটু নড়েচড়ে শুলো মনসুর তারপর আস্তে করে বললো, আব্বার শরীরটাও তো কদিন ধরে খুব ভালো যাচ্ছে না।

বুড়ো মানুষ। শরীরেরই বা কি দোষ। স্বামীর দিকে পাশ ফিরলো বড় বউ। হ্যালো, খোদা না করুক, উনি যদি আজ মারা যান তাহলে তোমাদের বিষয় সম্পত্তিগুলোর কি হবে?

কি আর হবে। সব ভাইরা সমান ভাগে পাবে।

এটা কিন্তু অন্যায় কথা। বড় বউ উসখুস করলো। তুমি হলে বাড়ির বড় ছেলে। তোমর ভাগে কিছুটা বেশি হওয়া উচিত। এসব নিয়মকানুন কারা করেছে গো?

যারা করেছে তাদের বিদ্যাবুদ্ধি নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। মনসুরের কষ্ঠে বিরক্তি।

বড় বউ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো। উ। বেশি ছিলো না ছাই। নিশ্চয়ই তারাও তাদের বাবার মেজো কিম্বা সেজো ছেলে ছিলো, তাই ও রকম নিয়ম-কানুন করেছে। যাই বলো, আগের দিনের নিয়ম-কানুনগুলো কিন্তু খুব ভালো ছিলো।

কি ছিলো? মনসুর স্ত্রীর দিকে তাকালো।

বড় বউ বললো। ওই যে, আগের দিনে শুনেছি বাজা-বাদশারা মারা গেলে তার বড় ছেলে রাজা হতো?

মনসুর আবার চোখজোড়া কড়িকাঠের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। অনেক দুশ্চিন্তার মাঝেও তার ঠোঁটের কোণে সহসা একটা হাসি জেগে উঠলো।