চৌদ্দ : গঙ্গামাটির বাটীতে
গঙ্গামাটির বাটীতে আসিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর। দ্বারের উভয় পার্শ্বে কদলীবৃক্ষ ও মঙ্গলঘট বসান। উপরে আম্রপল্লবের মালা দোলানো। বাহিরে অনেকগুলি লোক বসিয়া জটলা করিয়া তামাক খাইতেছে। গরুর গাড়ির শব্দে তাহারা মুখ তুলিয়া চাহিল। বোধ হয় ইহারই মধুর শব্দে আকৃষ্ট হইয়া আর একজন যিনি অকস্মাৎ সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, দেখি, তিনি স্বয়ং বজ্রানন্দ। তাঁহার উল্লসিত কলরব উদ্দাম হইয়া উঠিল, এবং কে একজন ছুটিয়া ভিতরে খবর দিতেও গেল।স্বামীজী বলিতে লাগিলেন যে, তিনি আসিয়া সকল বিবরণ জানানো পর্যন্ত চারিদিকে লোক পাঠাইয়া তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টারও যেমন বিরাম নাই, বাড়িসুদ্ধ সকলের দুশ্চিন্তারও তেমনি অবধি নাই। ব্যাপার কি? অকস্মাৎ কোথায় ডুব দিয়েছিলেন বলুন ত? গাড়োয়ান ছোঁড়াটা ত গিয়ে বললে আপনাকে গঙ্গামাটির পথে নামিয়ে দিয়ে সে ফিরে গেছে।
রাজলক্ষ্মী কাজে ব্যস্ত ছিল, আসিয়া পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল, বলিল, বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কি শাস্তিই তুমি দিলে! বজ্রানন্দকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, কিন্তু দেখ আনন্দ, আমার মন জানতে পেরেছিল যে আজ উনি আসবেনই।
হাসিয়া বলিলাম, দোরে কলাগাছ আর ঘটস্থাপনা দেখেই আমি বুঝেচি যে, আমার আসার খবরটি তুমি পেয়েচ।
কবাটের আড়ালে রতন আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, সে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, আজ্ঞে সেজন্যে নয়। আজ বাড়িতে ব্রাহ্মণভোজন হবে কিনা। বক্রেশ্বর দেখে এসে মা—
রাজলক্ষ্মী ধমক দিয়া তাহাকে থামাইয়া দিল, তোকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না রতন, নিজের কাজে যা।
তাহার আরক্ত মুখের প্রতি চাহিয়া বজ্রানন্দ হাসিয়া ফেলিল, কহিল, কি জানেন দাদা, কোন একটা কাজে লেগে না থাকলে মানসিক উৎকণ্ঠা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়, সহা যায় না। ভোজের আয়োজনটা কেবল এইজন্যেই। না দিদি?
রাজলক্ষ্মী জবাব দিল না, রাগ করিয়া বাহির হইয়া গেল। বজ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, ভয়ানক রোগা দেখাচ্চে দাদা, ইতিমধ্যে কাণ্ডটা কি ঘটেছিল বলুন ত? বাড়ি না ঢুকে হঠাৎ গা-ঢাকা দিলেন কেন?
গা-ঢাকা দিবার হেতু সবিস্তারে বর্ণনা করিলাম। শুনিয়া আনন্দ কহিল, ভবিষ্যতে এরকম করে আর পালাবেন না। কিভাবে যে ওঁর দিনগুলো কেটেচে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
তাহা জানিতাম। সুতরাং চোখে না দেখিয়াও আমি বিশ্বাস করিলাম। রতন চা ও তামাক দিয়া গেল। আনন্দ কহিল, আমিও বাইরে যাই দাদা। এখন আপনার কাছে বসে থাকলে আর একজন হয়ত ইহজন্মে আমার মুখ দেখবেন না। এই বলিয়া সে হাসিয়া প্রস্থান করিল।
খানিক পরে রাজলক্ষ্মী প্রবেশ করিয়া অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, ও ঘরে গরম জল গামছা কাপড় সমস্ত রেখে এলাম, শুধু গা-মাথা মুছে কাপড় ছেড়ে ফেল গে। জ্বরের ওপর খবরদার যেন মাথায় জল ঢেলো না বলচি।
কহিলাম, কিন্তু স্বামীজী তোমাকে ভুল বলেছে, জ্বর আমার নেই।
রাজলক্ষ্মী বলিল, না-ই থাক, কিন্তু হতে কতক্ষণ?
কহিলাম, সে খবর তোমাকে সঠিক দিতে পারব না, কিন্তু গরমে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে, স্নান করা দরকার।
রাজলক্ষ্মী কহিল, দরকার নাকি? তাহ’লে একা হয়ত পেরে উঠবে না, চল আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। এই বলিয়া সে নিজেই হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, কেন আড়ি ক’রে আমাকেও কষ্ট দেবে, নিজেও কষ্ট পাবে? এত অবেলায় নেয়ো না, লক্ষ্মীটি।
এই ধরনের কথা বলায় রাজলক্ষ্মীর জোড়া কোথাও দেখি নাই। নিজের ইচ্ছাকেই জোর করিয়া পরের স্কন্ধে চাপাইয়া দিবার কটুতাটুকু সে স্নেহের মাধুর্যরসে এমনিই ভরিয়া দিতে পারিত যে, সে জিদের বিরুদ্ধে কাহারও কোন সঙ্কল্পই মাথা তুলিতে পারিত না। এ ব্যাপারটা তুচ্ছ, স্নান না করিলেও আমার চলিয়া যাইবে, কিন্তু চলিয়া যায় না এমন ব্যাপারও বহুবার দেখিয়াছি। তাহার ইচ্ছাশক্তিকে অতিক্রম করিয়া চলিবার শক্তি শুধু কেবল আমিই পাই নাই তাহা নয়, কাহাকেও কোনদিনই খুঁজিয়া পাইতে দেখি নাই। আমাকে তুলিয়া দিয়া সে খাবার আনিতে গেল।
বলিলাম, তোমার ব্রাহ্মণভোজনের পালাটা আগে শেষ হোক না!
রাজলক্ষ্মী আশ্চর্য হইয়া কহিল, রক্ষে কর তুমি, সে পালা শেষ হতে যে সন্ধ্যে হয়ে যাবে।
গেলই বা।
রাজলক্ষ্মী সহাস্যে কহিল, তাই বটে। ব্রাহ্মণভোজন আমার মাথায় থাক, তার জন্যে তোমাকে উপোস করালে আমার স্বর্গের সিঁড়ি উপরের বদলে একেবারে পাতালে মুখ করে দাঁড়াবে। এই বলিয়া সে আহার্য আনিতে প্রস্থান করিল।
অনতিকাল পরে কাছে বসিয়া আজ সে আমাকে যাহা খাওয়াইতে বসিল তাহা রোগীর পথ্য। কর্মবাটীর যাবতীয় গুরুপাক বস্তুর সহিত তাহার সম্বন্ধ ছিল না; বুঝা গেল, আমার আসার পরেই সে স্বহস্তে প্রস্তুত করিয়াছে। তথাপি আসা পর্যন্ত তাহার আচরণে, তাহার কথা কহার ধরনে এমনই কি একটা অনুভব করিতেছিলাম যাহা শুধুই অপরিচিত নয়, অত্যন্ত নূতন। ইহাই খাওয়ানোর সময়ে একেবারে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। অথচ কিসে এবং কেমন করিয়া যে সুস্পষ্ট হইল, কেহ জিজ্ঞাসা করিলে আমি অস্পষ্ট করিয়াও বুঝাইতে পারিতাম না। হয়ত এই কথাটাই প্রত্যুত্তরে বলিতাম যে, মানুষের অত্যন্ত ব্যথার অনুভূতি প্রকাশ করিবার ভাষা বোধ হয় আজিও আবিষ্কৃত হয় নাই। রাজলক্ষ্মী খাওয়াইতে বসিল, কিন্তু খাওয়া-না-খাওয়া লইয়া তাহার আগেকার দিনের সেই অভ্যস্ত জবরদস্তি ছিল না, ছিল ব্যাকুল অনুনয়। জোর নয়, ভিক্ষা। বাহিরের চক্ষে তাহা ধরা পড়ে না, পড়ে শুধু মানুষের নিভৃত হৃদয়ের অপলক চোখ-দুটির দৃষ্টিতে।
খাওয়া শেষ হইল। রাজলক্ষ্মী কহিল, আমি এখন যাই?
অতিথি-সজ্জন বাহিরে সমবেত হইতেছিলেন, বলিলাম, যাও।
আমার উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি হাতে লইয়া সে যখন ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, তখন বহুক্ষণ পর্যন্ত আমি অন্যমনে সেইদিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিলাম। মনে হইতে লাগিল, রাজলক্ষ্মীকে যেমনটি রাখিয়া গিয়াছিলাম, এই কটা দিন পরে তেমনটি ত আর ফিরিয়া পাইলাম না। আনন্দ বলিয়াছিল, কাল হইতেই দিদির একপ্রকার অনাহারে কাটিয়াছে, আজ জলস্পর্শ করেন নাই, এবং কাল কত বেলায় যে তাঁহার উপবাস ভাঙ্গিবে তাহার কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নাই। অসম্ভব নয়।
চিরদিনই দেখিয়া আসিয়াছি, ধর্মপিপাসু চিত্ত তাহার কোনদিন কোন কৃচ্ছ্রসাধনেই পরাঙ্মুখ নয়। এখানে আসিয়া অবধি সুনন্দার সাহচর্যে সেই অবিচলিত নিষ্ঠা তাহার নিরন্তর বাড়িয়াই উঠিতেছিল। আজ তাহাকে অল্পক্ষণমাত্রই দেখিবার অবকাশ পাইয়াছি, কিন্তু যে দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় পথে সে এই অবিশ্রান্ত দ্রুতবেগে পা ফেলিয়া চলিয়াছে, মনে হইল, তাহার নিন্দিত জীবনের সঞ্চিত কালিমা যত বড়ই হোক আর তাহার নাগাল পাইবে না। কিন্তু আমি? আমি যে তাহার পথের মাঝখানে উত্তুঙ্গ গিরিশ্রেণীর মত সমস্ত অবরোধ করিয়া আছি!
কাজকর্ম সারিয়া নিঃশব্দপদে রাজলক্ষ্মী যখন গৃহে প্রবেশ করিল তখন রাত্রি বোধ হয় দশটা। আলো কমাইয়া, অত্যন্ত সাবধানে আমার মশারি ফেলিয়া দিয়া সে নিজের শয্যায় গিয়া শুইতে যাইতেছিল, আমি কথা কহিলাম। বলিলাম, তোমার ব্রাহ্মণভোজনের পালা ত সন্ধ্যার পূর্বেই শেষ হয়েচে, এত রাত হ’ল যে?
রাজলক্ষ্মী প্রথমে চমকিত হইল, পরে হাসিয়া কহিল, আ আমার কপাল! আমি ভয়ে ভয়ে আসচি পাছে তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিই। এখনো জেগে আছ, ঘুমোও নি যে বড়?
তোমার আশাতেই জেগে আছি।
আমার আশায়? তবে ডেকে পাঠাও নি কেন? এই বলিয়া সে কাছে আসিয়া মশারির একটা ধার তুলিয়া দিয়া আমার শয্যার শিয়রে আসিয়া বসিল। বরাবরের অভ্যাসমত আমার চুলের মধ্যে তাহার দুই হাতের দশ আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া দিয়া বলিল, ডেকে পাঠাও নি কেন?
ডেকে পাঠালেই কি তুমি আসতে? তোমার কত কাজ!
হোক কাজ। তুমি ডাকলে না বলতে পারি এমন সাধ্যি আছে আমার?
ইহার উত্তর ছিল না। জানি, আমার আহ্বান সত্যই উপেক্ষা করিবার সাধ্য তাহার নাই। কিন্তু আজ এই সত্যকেই সত্য বলিয়া মানিয়া লইবার সাধ্য আমার কৈ?
রাজলক্ষ্মী কহিল, চুপ করে রইলে যে?
ভাবচি।
ভাবচো? কি ভাবচো? এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে আমার কপালের উপরে তাহার মাথাটি ন্যস্ত করিয়া চুপি চুপি বলিল, আমার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলে যে বড়?
রাগ করে গিয়েছিলাম তুমি জানলে কি করে?
রাজলক্ষ্মী মাথা তুলিল না, আস্তে আস্তে বলিল, আমি রাগ করে গেলে তুমি জানতে পার না?
কহিলাম, বোধ হয় পারি।
রাজলক্ষ্মী বলিল, তুমি বোধ হয় পার, কিন্তু আমি নিশ্চয় পারি, আর তোমার পারার চেয়েও ঢের বেশি পারি।
হাসিয়া কহিলাম, তাই হোক। এ নিয়ে বিবাদ করে জয়ী হতে আমি চাইনে লক্ষ্মী, নিজে হারার চেয়ে তুমি হেরে গেলেই আমার ঢের বেশি লোকসান।
রাজলক্ষ্মী কহিল, যদি জান তবে বল কেন?
কহিলাম, বলিনে ত আর! কিন্তু বলা যে অনেকদিন বন্ধ করেচি সেই খবরটাই তুমি জান না।
রাজলক্ষ্মী নীরব হইয়া রহিল। পূর্বে হইলে সে আমাকে সহজে অব্যাহতি দিত না, লক্ষ কোটি প্রশ্ন করিয়া ইহার কৈফিয়ত আদায় করিয়া ছাড়িত, কিন্তু এখন সে মৌনমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল। বহুক্ষণ পরে সে মুখ তুলিয়া অন্য কথা পাড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, তোমার নাকি এর মধ্যে জ্বর হয়েছিল? কোথায় ছিলে? বাড়িতে আমাকে খবর পাঠালে না কেন?
খবর না পাঠাইবার হেতু বলিলাম। একে ত খবর আনিবার লোক ছিল না, দ্বিতীয়তঃ যাঁহার কাছে খবর পাঠাইব, তিনি যে কোথায় জানিতাম না। কিন্তু কোথায় এবং কিভাবে ছিলাম তাহা সবিস্তারে বর্ণনা করিলাম। চক্রবর্তীগৃহিণীর নিকট আজই সকালে বিদায় লইয়া আসিয়াছি। সেই দীনহীন গৃহস্থ পরিবারে যেভাবে আশ্রয় লাভ করিয়াছিলাম এবং যেমন করিয়া অপরিসীম দৈন্যের মধ্যেও গৃহকর্ত্রী অজ্ঞাতকুলশীল রোগগ্রস্ত অতিথিকে পুত্রাধিক স্নেহে শুশ্রূষা করিয়াছেন তাহা বলিতে গিয়া কৃতজ্ঞতা ও বেদনায় আমার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল।
রাজলক্ষ্মী হাত দিয়া মুছাইয়া দিয়া কহিল, যাতে তাঁরা ঋণমুক্ত হন, কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও না কেন?
বলিলাম, থাকলে দিতাম, কিন্তু টাকা ত আমার নেই।
আমার এই-সকল কথায় রাজলক্ষ্মী মর্মান্তিক দুঃখিত হইত, আজও সে মনে মনে তেমনই দুঃখ পাইল, কিন্তু তাহার টাকা যে আমারও টাকা এ কথা সজোরে প্রতিপন্ন করিতে আগেকার দিনের মত আর কলহে প্রবৃত্ত হইল না, চুপ করিয়া রহিল।
এই জিনিসটা তাহার নূতন দেখিলাম। আমার এই কথার উপরে ঠিক এম্নি শান্ত নিরুত্তরে বসিয়া থাকা আমাকেও বিঁধিল। কিছুক্ষণ পরে সে নিশ্বাস ফেলিয়া সোজা হইয়া বসিল, যেন দীর্ঘশ্বাসের বাতাস দিয়া সে তাহার চারিদিকে ঘনায়মান বাষ্পাচ্ছন্ন মোহের আবরণটাকে ছিঁড়িয়া ফেলিতে চাহিল। ঘরের মন্দ আলোকে তাহার মুখের চেহারা ভাল দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু যখন সে কথা কহিল, তাহার কণ্ঠস্বরের আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করিলাম। রাজলক্ষ্মী বলিল, বর্মা থেকে তোমার চিঠির জবাব এসেচে। অফিসের বড় খাম, হয়ত জরুরী কিছু আছে ভেবে আনন্দকে দিয়ে পড়িয়ে নিলাম।
তার পরে?
বড়সাহেব তোমার দরখাস্ত মঞ্জুর করেচেন। জানিয়েচেন, তুমি গেলেই তোমার সাবেক চাকরি আবার ফিরে পাবে।
বটে!
হাঁ। আনবো চিঠিখানা?
না থাক। কাল সকালে দেখবো।
আবার দুজনেই চুপ করিয়া রহিলাম। কি যে বলিব, কেমন করিয়া যে এই নীরবতা ভাঙ্গিব ভাবিয়া না পাইয়া মনের ভিতরটায় কেবল তোলপাড় করিতে লাগিল। হঠাৎ একফোঁটা চোখের জল টপ্ করিয়া আমার কপালের উপরে আসিয়া পড়িল। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েচে, এ ত খারাপ সংবাদ নয়। কিন্তু তুমি কাঁদলে কেন?
রাজলক্ষ্মী আঁচলে নিজের চোখ মুছিয়া বলিল, তুমি বিদেশে চাকরি নিয়ে আবার চলে যাবার চেষ্টা করচ, আমাকে এ কথা জানাও নি কেন? তুমি কি ভেবেছিলে আমি বাধা দেব?
কহিলাম, না। বরঞ্চ জানালে তুমি উৎসাহই দিতে। কিন্তু সেজন্য নয়—বোধ হয় ভেবেছিলাম এ-সব তুচ্ছ ব্যাপার শোনবার তোমার সময় হবে না।
রাজলক্ষ্মী নির্বাক হইয়া রহিল। কিন্তু তাহার উচ্ছ্বসিত নিশ্বাস চাপিবার প্রাণপণ চেষ্টাও আমার কাছে গোপন রহিল না। কিন্তু ক্ষণকাল মাত্র। ক্ষণেক পরেই সে মৃদুকন্ঠে কহিল, এ কথার জবাব দিয়ে আর আমার অপরাধের বোঝা বাড়াব না। তুমি যাও, তোমাকে আমি কিছুতেই বারণ করব না। এই বলিয়া সে পুনরায় মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকিয়া বলিতে লাগিল, এখানে না এলে বোধ হয় আমি কোনদিন বুঝতে পারতাম না, তোমাকে কত বড় দুর্গতির মধ্যে টেনে এনেচি।
এই গঙ্গামাটির অন্ধকূপে মেয়েমানুষের চলে, কিন্তু পুরুষের চলে না। এখানকার এই কর্মহীন উদ্দ্যেশ্যহীন জীবন ত তোমার আত্মহত্যার সমান। এ আমি চোখের উপর স্পষ্ট দেখেতে পেয়েচি।
জিজ্ঞাসা করিলাম, কেউ কি তোমায় দেখিয়ে দিয়েচে?
রাজলক্ষ্মী বলিল, না। আমি নিজেই দেখেচি। তীর্থযাত্রা করেছিলাম, কিন্তু ঠাকুর দেখতে পাইনি। তার বদলে কেবল তোমার লক্ষ্যহারা বিরস মুখই দিনরাত্রি চোখে পড়েচে। আমার জন্যে তোমাকে অনেক ছাড়তে হয়েচে, কিন্তু আর না।
এতক্ষণ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে একটা জ্বালার ভাবই ছিল; কিন্তু তাহার কন্ঠস্বরের অনির্বচনীয় করুণায় বিভোর হইয়া গেলাম। বলিলাম, তোমাকেই কি কম ছাড়তে হয়েচে লক্ষ্মী? গঙ্গামাটি ত তোমারও যোগ্য স্থান নয়; কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই সঙ্কোচে মরিয়া গেলাম। কারণ, অনবধানতাবশতঃ যে গর্হিত বাক্য আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল, তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী এই রমণীর কাছে তাহা গোপন রহিল না। কিন্তু আমাকে আজ সে ক্ষমা করিল। বোধ হয় কথার ভালমন্দ লইয়া মান-অভিমানের জাল বুনিয়া সময় নষ্ট করার মত সময় আর তাহার ছিল না। বলিল, বরঞ্চ আমিই গঙ্গামাটির যোগ্য নই। সকলে এ কথা বুঝবে না, কিন্তু তোমার বোঝা উচিত যে সত্যিই আমাকে কিছু ছাড়তে হয়নি। পাষাণের মত যে ভার একদিন লোকে আমার বুকে চাপিয়ে দিয়েছিল, কেবল তাই আর একদিন আমার ঘুচেচে। আর শুধু কি তাই! আজীবন তোমাকেই চেয়েছিলাম, তোমাকে পেয়ে ছাড়ার অসংখ্য গুণ যে ফিরে পেয়েচি, সে কি তুমিই জান না?
জবাব দিতে পারিলাম না। অন্তরের অজানা অভ্যন্তর হইতে কে যেন এই কথাই আমাকে বলিতে লাগিল, ভুল হইয়াছে, তোমার মস্ত ভুল হইয়াছে। না বুঝিয়া তাহাকে অত্যন্ত অবিচার করিয়াছ। রাজলক্ষ্মী ঠিক এই তারেই আঘাত করিল, বলিল, ভেবেছিলাম তোমার জন্যেই এ কথা কখনো তোমাকে জানাব না, কিন্তু আজ আর আমি থাকতে পারলুম না। এই কষ্টটাই আমার সবচেয়ে বেশি লেগেচে যে, তুমি অনায়াসে ভাবতে পেরেচ যে পুণ্যের লোভে আমি এমনি উন্মাদ হয়ে গেছি যে, তোমাকেও অবহেলা করতে শুরু করেচি। রাগ করে চলে যাবার আগে এ কথা তোমার একবারও মনে হয়নি যে, ইহকালে পরকালে রাজলক্ষ্মীর তোমার চেয়ে লোভের বস্তু আর কি আছে! বলিতে বলিতেই তাহার চোখের জল ঝরঝর করিয়া আমার মুখের উপর ঝরিয়া পড়িল।
কথা বলিয়া সান্ত্বনা দিবার ভাষা মনে পড়িল না, শুধু মাথার উপর হইতে তাহার ডান হাতটি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইলাম। রাজলক্ষ্মী বাঁ হাত দিয়া তাহার অশ্রু মুছিয়া বহুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া রহিল; তাহার পরে কহিল, প্রজাদের সব খাওয়া শেষ হ’ল কিনা আমি দেখে আসি গে। তুমি ঘুমোও। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে হাতখানি টানিয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল। তাহাকে ধরিয়া রাখিলে হয়ত রাখিতে পারিতাম, কিন্তু সে চেষ্টা করিলাম না। সেও আর ফিরিয়া আসিল না—আমারও যতক্ষণ না ঘুম আসিল শুধু এই কথাই ভাবিতে লাগিলাম, জোর করিয়া রাখিয়া লাভ হইত কি? আমার পক্ষ হইতে ত কোনদিন কোন জোরই ছিল না, সমস্ত জোরই আসিয়াছিল তাহার দিক দিয়া। আজ সে-ই যদি বাঁধন খুলিয়া আমাকে মুক্তি দিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে চায় ত আমি ঠেকাইব কোন্ পথে?
সকালে জাগিয়া উঠিয়া প্রথমেই ওদিকের খাটের প্রতি চাহিয়া দেখিলাম, রাজলক্ষ্মী ঘরে নাই। রাত্রে সে আসিয়াছিল, কিংবা অতি প্রত্যূষে বাহির হইয়া গেছে তাহা বুঝিতে পারিলাম না। বাহিরের ঘরে গিয়া দেখি, সেখানে একটা কোলাহল উঠিয়াছে। রতন কেটলি হইতে গরম চা পাত্রে ঢালিয়াছে এবং তাহারই অদূরে বসিয়া রাজলক্ষ্মী একটা স্টোভে করিয়া সিঙ্গাড়া কিংবা কচুরি ভাজিয়া তুলিতেছে, এবং বজ্রানন্দ তাহার সন্ন্যাসীর নিস্পৃহ নিরাসক্ত দৃষ্টি দিয়া এই-সকল খাদ্যবস্তুর প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। আমাকে ঢুকিতে দেখিয়া রাজলক্ষ্মী তাহার ভিজা চুলের উপর আঁচল টানিয়া দিল এবং বজ্রানন্দ কলরব করিয়া উঠিল, এই যে দাদা! আপনার দেরি দেখে ভাবছিলাম বুঝি বা সমস্ত জুড়িয়ে জল হয়ে যায়।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিল, হাঁ, তোমার পেটের মধ্যে গিয়ে জুড়িয়ে জল হ’ত।
আনন্দ কহিল, দিদি, সন্ন্যাসী ফকিরকে খাতির করতে শিখুন। ও-রকম কড়া কথা বলবেন না। আমাকে বলিল, কৈ, তেমন ভাল দেখাচ্ছে না ত ! হাতটা একবার দেখব নাকি?
রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া উঠিল, রক্ষে কর আনন্দ, তোমার আর ডাক্তারিতে কাজ নেই, উনি বেশ আছেন।
আনন্দ বলিল, সেইটাই নিশ্চয় করবার জন্যে হাতটা একবার
রাজলক্ষ্মী কহিল, না, তোমাকে হাত দেখতে হবে না। এখ্খুনি হয়ত সাগুর ব্যবস্থা করে দেবে।
আমি বলিলাম, সাগু আমি ঢের খেয়েচি, সুতরাং ও ব্যবস্থা করে দিলেও আর শুনব না।
শুনেও তোমার কাজ নেই। এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী প্লেটে করিয়া খানকয়েক গরম কচুরি ও সিঙ্গাড়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিল। রতনকে কহিল, তোর বাবুকে চা দে।
বজ্রানন্দ সন্ন্যাসী হইবার পূর্বে ডাক্তারি পাশ করিয়াছিল, অতএব সহজে হার মানিবার পাত্র নয়; সে ঘাড় নাড়িয়া বলিতে গেল, কিন্তু দিদি, এতটা দায়িত্ব আপনার
রাজলক্ষ্মী তাহার কথার মাঝখানেই থামাইয়া দিল, শোন কথা! ওর দায়িত্ব আমার নয় ত কি তোমার? আজ পর্যন্ত যত দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ওঁকে খাড়া রাখতে হয়েচে সে যদি শুনতে ত দিদির কাছে আর ডাক্তারি করতে যেতে না। এই বলিয়া সে বাকী সমস্ত খাবার একটা থালায় ঢালিয়া তাহার দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া সহাস্যে কহিল, এখন খাও এগুলো, কথা বন্ধ হোক।
আনন্দ হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল, আরে এত খাওয়া যায়!
রাজলক্ষ্মী বলিল, যায় না ত সন্ন্যাসী হতে গিয়েছিলে কেন? আরও পাঁচজন ভদ্রলোকের মত গেরস্ত থাকলেই ত হ’ত!
আনন্দের দুই চক্ষু সহসা বাষ্পাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, কহিল, আপনার মত দিদির দল এই বাঙ্গলা মুলুকে আছে বলেই ত, নইলে দিব্যি ক’রে বলচি, আজই এই গেরুয়া-টেরুয়াগুলো অজয়ের জলে ভাসিয়ে দিয়ে ঘরে চলে যেতাম। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে দিদি। পরশু থেকেই একরকম উপোস করে আছেন, আজ আহ্নিক-টাহ্নিকগুলো একটু সকাল সকাল সেরে নিন। এগুলোতে এখনও স্পর্শদোষ ঘটেনি, বলেন ত নাহয়, এই বলিয়া সে সম্মুখের ভোজ্যবস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
রাজলক্ষ্মী ভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, বল কি আনন্দ, কাল আমার সমস্ত ব্রাহ্মণ এসে উঠতে পারেন নি!
আমি বলিলাম, আগে তাঁরা এসে উঠুন। তার পরে
আনন্দ কহিল, তাহলে আমাকেই উঠতে হ’ল। তাদের নাম ও ঠিকানা দিন, পাষণ্ডদের গলায় গামছা দিয়ে এনে ভোজন করিয়ে ছাড়ব। এই বলিয়া সে উঠার পরিবর্তে থালা টানিয়া লইয়া নিজেই ভোজনে মন দিল।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া বলিল, সন্ন্যাসী কিনা, দেবদ্বিজে অতিশয় ভক্তি।
এইরূপে আমাদের সকালের চা-খাওয়ার পালাটা যখন সাঙ্গ হইল তখন বেলা আটটা। বাহিরে আসিয়া বসিলাম। শরীরেও গ্লানি ছিল না, হাসি-তামাশায় মনও যেন স্বচ্ছ, প্রসন্ন হইয়া উঠিল। রাজলক্ষ্মীর বিগত রাত্রির কথাগুলার সহিত তাহার আজিকার কথা ও আচরণের কোন ঐক্যই ছিল না। সে যে অভিমান ও বেদনায় ব্যথিত হইয়াই ওরূপ কহিয়াছিল তাহাতে আর সন্দেহ নাই। বস্তুতঃ রাত্রির স্তব্ধ আঁধার আবরণের মধ্যে তুচ্ছ ও সামান্য ঘটনাকে বৃহৎ ও কঠোর কল্পনা করিয়া যে দুঃখ ও দুশ্চিন্তা ভোগ করিয়াছি, আজ দিনের আলোকে তাহা স্মরণ করিয়া মনে মনে লজ্জাও পাইলাম, কৌতুকও অনুভব করিলাম।
কল্যকার মত আজ আর উৎসবের ঘটা ছিল না, তথাপি মাঝে মাঝে আহূত ও অনাহূতের ভোজনলীলা সমস্ত দিনমান ব্যাপিয়াই অব্যাহত রহিল। বেলা গেল। আর একবার আমরা চায়ের সাজসরঞ্জাম লইয়া ঘরের মেঝেতে আসন করিয়া বসিলাম। সন্ধ্যার কাজকর্ম কতকটা সারিয়া লইয়া রাজলক্ষ্মী ক্ষণকালের জন্য আমাদের ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল।
বজ্রানন্দ কহিল, দিদি, স্বাগত !
রাজলক্ষ্মী তাহার প্রতি হাসিমুখে চাহিয়া বলিল, সন্ন্যাসীর বুঝি দেবসেবা শুরু হ’ল, তাই এত আনন্দ?
আনন্দ কহিল, মিথ্যে বলেন নি দিদি। সংসারে যাবতীয় আনন্দ আছে তার মধ্যে ভজনানন্দ ও ভোজনানন্দই শ্রেষ্ঠ এবং শাস্ত্রে বলেচেন, ত্যাগীর পক্ষে দ্বিতীয়টিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
রাজলক্ষ্মী কহিল, হাঁ, সে তোমার মত ত্যাগীর পক্ষে।
আনন্দ উত্তর দিল, এও মিথ্যে নয় দিদি। আপনি গৃহিণী বলেই এর মর্মগ্রহণ করতে পারেন নি। নইলে আমরা ত্যাগীর দল যখন আনন্দে মশগুল হয়ে আছি, আপনি তখন তিন দিন ধরে কেবল পরকে খাওয়াচ্ছেন, আর নিজে মরছেন উপবাস করে।
রাজলক্ষ্মী বলিল, মরচি আর কৈ ভাই? দিনের পর দিন ত দেখচি এ দেহটার কেবল শ্রীবৃদ্ধি হয়ে চলচে।
আনন্দ কহিল, তার কারণ, হতে বাধ্য। সেবারেও আপনাকে দেখে গিয়েছিলাম, এবারেও এসে দেখচি। আপনার পানে চাইলে মনে হয় না যে পৃথিবীর জিনিস দেখচি, এ যেন দুনিয়া ছাড়া আর কিছু।
রাজলক্ষ্মীর মুখখানি লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। আমি তাহাকে হাসিয়া কহিলাম, তোমার আনন্দর যুক্তির প্রণালীটা দেখলে?
শুনিয়া আনন্দও হাসিল, কহিল, এ ত যুক্তি নয়, স্তুতি। দাদা, সে দৃষ্টি থাকলে কি আর বর্মায় যেতেন চাকরির দরখাস্ত করতে? আচ্ছা দিদি, কোন্ দুষ্টবুদ্ধি দেবতাটি দিয়েছিলেন এই অন্ধ মানুষটিকে আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে? তাঁর কি আর কাজ ছিল না?
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিল। নিজের কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, দেবতার দোষ নেই ভাই, দোষ এই ললাটের। আর ওঁর দোষ ত অতিবড় শত্রুতেও দিতে পারবে না। এই বলিয়া সে আমাকে দেখাইয়া কহিল, পাঠশালে উনি ছিলেন সর্দার-প’ড়ো, যত না দিতেন পড়া ব’লে তার ঢের বেশি দিতেন বেত। তখন পড়ি ত সবে বোধোদয়, বইয়ের বোধ ত খুবই হ’ল, বোধ হ’ল আর একরকমের। ছেলেমানুষ, ফুল পাব কোথায়, বনের বঁইচিফলের মালা গেঁথে ওঁকে করলাম বরণ। এখন ভাবি, তার সঙ্গে তার কাঁটাগুলোও যদি গেঁথে দিতাম! বলিতে বলিতে তাহার কুপিত কন্ঠস্বর চাপাহাসির আভায় অপরূপ হইয়া উঠিল।
আনন্দ কহিল, উঃকি ভয়ানক রাগ !
রাজলক্ষ্মী বলিল, রাগ নয়ত কি? কাঁটা তুলে দেবার আর কেউ থাকলে নিশ্চয় দিতাম। এখনো পাই ত দি। এই বলিয়া সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া যাইতেছিল, আনন্দ ডাকিয়া কহিল, পালাচ্ছেন যে বড়?
কেন, আর কাজ নেই নাকি? চায়ের বাটি হাতে নিয়ে ওঁর কোঁদল করবার সময় আছে, কিন্তু আমার নেই।
আনন্দ বলিল, দিদি, আমি আপনার অনুগত ভক্ত। কিন্তু এ অভিযোগে সায় দিতে আমারও লজ্জা করচে। উনি একটা কথাও কইলে নাহয় পাকিয়ে তোলবার চেষ্টা করা যেত, কিন্তু একদম বোবা মানুষকে ফাঁদে ফেলা যায় কি করে? করলেও ধর্মে সইবে না।
রাজলক্ষ্মী বলিল, ঐ ত হয়েছে আমার জ্বালা। বেশ, ধর্মে যা সয়, তাই না হয় কর। চায়ের বাটিগুলো সব জুড়িয়ে জল হয়ে গেলআমি ততক্ষণ রান্নাঘরটা একবার ঘুরে আসি গে। বলিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
ব্জ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, দাদার কি বর্মা যাবার সঙ্কল্প এখনও আছে নাকি? কিন্তু দিদি কখ্খনো সঙ্গে যাবেন না তা আমাকে বলেছেন।
সে আমি জানি।
তবে?
তবে একলাই যেতে হবে।
ব্জ্রানন্দ কহিল, এই দেখুন আপনার অন্যায়। অর্থোপার্জনের আবশ্যক আপনাদের নেই, তবে কিসের জন্যে যাবেন পরের গোলামি করতে?
বলিলাম, অন্ততঃ অভ্যেসটা বজায় রাখতে।
এটা রাগের কথা দাদা।
কিন্তু রাগ ছাড়া কি মানুষের আর কোন হেতু থাকতে নেই আনন্দ?
আনন্দ কহিল, থাকলেও অপরের পক্ষে বোঝা কঠিন।
ইচ্ছা হইল বলি, এ কঠিন কাজ অপরের করিবারই বা প্রয়োজন কি, কিন্তু বাদানুবাদে জিনিসটা পাছে তিক্ত হইয়া পড়ে, এই আশঙ্কায় চুপ করিয়া গেলাম।
এম্নি সময়ে রাজলক্ষ্মী বাহিরের কাজ সারিয়া গৃহে প্রবেশ করিল এবং দাঁড়াইয়া না থাকিয়া এবার ভালমানুষের মত আনন্দের পার্শ্বে গিয়া স্থির হইয়া বসিল। আনন্দ আমাকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, দিদি, উনি বলছিলেন, অন্ততঃ গোলামির অভ্যাস বহাল রাখবার জন্যেও ওঁর বিদেশ যাওয়া চাই। আমি বলছিলাম, তাই যদি চাই, আসুন না, আমার কাজে যোগ দেবেন। বিদেশে না গিয়ে দেশের গোলামিতেই দুই ভাইয়ে জীবন কাটিয়ে দেব।
রাজলক্ষ্মী বলিল, কিন্তু উনি ত ডাক্তারি জানেন না আনন্দ?
আনন্দ কহিল, আমি কি শুধু ডাক্তারিই করি? ইস্কুল করি, পাঠশালা করি, তাদের দুর্দশা যে কত দিক দিয়ে কত বড় তা অবিশ্রাম বোঝাবার চেষ্টা করি।
তারা বোঝে?
আনন্দ কহিল, সহজে বোঝে না। কিন্তু মানুষের শুভ-ইচ্ছা যখন বুক থেকে সত্য হয়ে বার হয়, তখন সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় না দিদি।
রাজলক্ষ্মী আমার মুখের দিকে কটাক্ষে চাহিয়া ধীরে ধীরে মাথা নাড়িল। বোধ হয় সে বিশ্বাস করিল না, বোধ হয় সে আমার জন্য মনে মনে শঙ্কিত হইয়া উঠিল, পাছে আমিও সায় দিয়া বসি, পাছে আমিও—
আনন্দ প্রশ্ন করিল, মাথা নাড়লেন যে বড়?
রাজলক্ষ্মী প্রথমে একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিল, পরে স্নিগ্ধ মধুরকণ্ঠে কহিল, দেশের দুর্দশা যে কত বড় তা আমিও জানি আনন্দ। কিন্তু তোমার একলার চেষ্টায় আর কি হবে ভাই? আমাকে দেখাইয়া কহিল, আবার উনি যাবেন সাহায্য করতে? তবেই হয়েছে। তাহলে আমার মত ওঁর সেবাতেই তোমার দিন কাটবে, আর কারও কিছু করতে হবে না। এই বলিয়া সে হাসিল।
তাহার হাসি দেখিয়া আনন্দ নিজেও হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, কাজ নেই দিদি ওঁকে নিয়ে, থাকুন উনি চিরকাল আপনার চোখের মণি হয়ে। কিন্তু একলা-দোকলার কথা এ নয়! একলা মানুষেরও আন্তরিক ইচ্ছাশক্তি এত বড় যে, তার পরিমাণ হয় না। ঠিক বামনদেবের পায়ের মত। বাইরে থেকে সে দেখতে ছোট, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র পদতলটুকু প্রসারিত হলে বিশ্ব আচ্ছন্ন করে দেয়।
চাহিয়া দেখিলাম, বামনদেবের উপমায় রাজলক্ষ্মীর চিত্ত কোমল হইয়াছে, কিন্তু প্রত্যুত্তরে সে কিছুই কহিল না।
আনন্দ বলিতে লাগিল, হয়ত আপনার কথাই ঠিক, বিশেষ কিছু করতে আমি পারিনে। কিন্তু একটা কাজ করি। সাধ্যমত দুঃখীর দুঃখের অংশ আমি নিই দিদি।
রাজলক্ষ্মী অধিকতর আর্দ্র হইয়া বলিল, সে আমি জানি আনন্দ। তোমাকে দেখে প্রথম দিনই আমি তা বুঝেছিলাম।
আনন্দ বোধ হয় একথায় কান দিল না, সে নিজের কথার সূত্র ধরিয়া কহিতে লাগিল, আপনাদের মত আমারও অভাব কিছুই ছিল না। বাবার যা আছে, বিপুল সুখে দিন কাটাবার পক্ষেও সে বেশি। আমার কিন্তু তাতে প্রয়োজন নেই। এই দুখীর দেশে সুখভোগের লালসাটাও যদি এ জীবনে ঠেকিয়ে রাখতে পারি সেই আমার ঢের।
রতন আসিয়া জানাইল, পাচক বলিতেছে খাবার প্রস্তুত।
রাজলক্ষ্মী তাহাকে ঠাঁই করিবার আদেশ দিয়া আমাদের কহিল, আজ তোমরা একটু সকাল সকাল সেরে নাও আনন্দ, আমি বড় ক্লান্ত।
সে যে ক্লান্ত তাহাতে সংশয় ছিল না, কিন্তু ক্লান্তির দোহাই দিতে তাহাকে কখনও দেখি নাই। উভয়ে নিঃশব্দে উঠিয়া দাঁড়াইলাম। রঙ্গ-রহস্যে আজিকার প্রভাত আরম্ভ হইয়াছিল আমাদের ভারী একটা প্রসন্নতার মধ্য দিয়া, সায়াহ্নের সভাও জমিয়াছিল হাস্যপরিহাসে উজ্জ্বল হইয়া। কিন্তু ভাঙ্গিল যেন নিরানন্দের মলিন অবসাদে। আহারের জন্য দুজনে যখন রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হইলাম তখন কাহারও মুখে কোন কথা ছিল না।
পরদিন সকালে বজ্রানন্দ প্রস্থানের উদ্যোগ করিল। কাহারও কোথাও যাইবার কথা উঠিলেই রাজলক্ষ্মী চিরদিন আপত্তি করে। দিনক্ষণের অজুহাতে আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করিয়া অত্যন্ত বাধা দেয়। কিন্তু আজ সে একটা কথাও বলিল না। শুধু বিদায় লইয়া যখন সে প্রস্তুত হইল, তখন কাছে আসিয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আনন্দ, আবার কবে আসবে ভাই?
আমি নিকটেই ছিলাম, স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম সন্ন্যাসীর চোখের দীপ্তি ঝাপসা হইয়া আসিল, কিন্তু সে মুহূর্তে আত্মসংবরণ করিয়া হাসিমুখে কহিল, আসব বৈকি দিদি! যদি বেঁচে থাকি, মাঝে মাঝে উৎপাত করতে হাজির হবই।
ঠিক ত?
নিশ্চয়।
কিন্তু আমরা ত শীঘ্রই চলে যাব। যেখানে থাকব যাবে সেখানে?
আদেশ করলে যাব বৈ কি দিদি।
রাজলক্ষ্মী কহিল, যেয়ো। তোমার ঠিকানা আমাকে লিখে দাও, আমি তোমাকে চিঠি লিখব।
আনন্দ পকেট হইতে কাগজ পেন্সিল বাহির করিয়া ঠিকানা লিখিয়া হাতে দিল। সন্ন্যাসী হইয়াও আমাদের উভয়কে দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া নমস্কার করিল এবং রতন আসিয়া তাহার পদধূলি গ্রহণ করিলে আশীর্বাদ করিয়া ধীরে ধীরে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল।