» » আট : দিন পাঁচ-ছয় হইয়া গেল

আট : দিন পাঁচ-ছয় হইয়া গেল

দিন পাঁচ-ছয় হইয়া গেল, হেমাঙ্গিনীর জ্বর ছাড়ে নাই। কাল ডাক্তার বলিয়া গিয়াছিলেন, সর্দি বুকে বসিয়াছে। সন্ধ্যার দীপ সবেমাত্র জ্বালা হইয়াছিল, ললিত ভাল কাপড়-জামা পরিয়া ঘরে ঢুকিয়া কহিল, মা, দত্তদের বাড়ি পুতুল-নাচ হবে, দেখতে যাব?

মা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, হাঁ রে ললিত, তোর মা যে এই পাঁচ-ছ-দিন পড়ে আছে, একবারটি কাছে এসেও ত বসিস নে!

ললিত লজ্জা পাইয়া শিয়রের কাছে আসিয়া বসিল। মা সস্নেহে ছেলের পিঠে হাত দিয়া বলিলেন, এই অসুখ যদি না সারে, যদি মরে যাই, কি করিস তুই? খুব কাঁদিস?

যাঃ—সেরে যাবে, বলিয়া ললিত মায়ের বুকের উপর একটা হাত রাখিল। মা ছেলের হাতখানি হাতে লইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। জ্বরের উপর এই স্পর্শ তাহার সর্বাঙ্গ জুড়াইয়া দিতে লাগিল। ইচ্ছা করিতে লাগিল, এমন করিয়া বহুক্ষণ কাটান। কিন্তু একটু পরেই ললিত উসখুস করিতে লাগিল, পুতুল নাচ হয়ত এতক্ষণে শুরু হইয়া গিয়াছে মনে করিয়, ভিতরে ভিতরে তাহার চিত্ত অস্থির হইয়া উঠিল।

ছেলের মনের কথা বুঝিতে পারিয়া মা মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা যা, দেখে আয়, বেশী রাত করিস নে যেন।

না মা, এক্ষুণি ফিরে আসব, বলিয়া ললিত ঘরের বাহির হইয়া গেল। কিন্তু মিনিট-দুই পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মা একটা কথা বলব?

মা হাসিমুখে বলিলেন, একটা টাকা চাই ত? ঐ কুলুঙ্গিতে আছে, নিগে—দেখিস, বেশি নিসনে যেন।

না মা, টাকা চাইনে। বলি, তুমি শুনবে!

মা বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, টাকা চাইনে? তবে কি কথা রে?

ললিত আর একটু কাছে আসিয়া চুপি চুপি বলিল, কেষ্টমামাকে একবার আসতে দেবে?

ঘরে ঢুকবে না—ঐ দোরগোড়া থেকে একটিবার তোমাকে দেখেই চলে যাবে। কালকেও বাইরে এসে বসেছিল, আজকেও এসে বসে আছে।

হেমাঙ্গেনী ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বসিলেন, বলিলেন—যা যা ললিত, এক্ষুণি ডেকে নিয়ে আয়—আহা হা, বসে আছে, তোরা কেউ আমাকে জানাস নি রে?

ভয়ে আস্তে চায় না যে, বলিয়া ললিত চলিয়া গেল। মিনিট-খানেক পরে কেষ্ট ঘরে ঢুকিয়া মাটির দিকে ঘাড় বাঁকাইয়া দেয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইল।

হেমাঙ্গিনী ডাকিলেন, এস দাদা, এস।

কেষ্ট তেমনিভাবে স্থির হইয়া রহিল। তিনি নিজে তখন উঠিয়া আসিয়া কেষ্টর হাত ধরিয়া বিছানায় লইয়া গেলেন। পিঠে হাত বুলাইয়া দিয়া বলিলেন, হাঁ রে কেষ্ট, বকেছিলুম বলে তোর মেজদিদিকে ভুলে গেছিস বুঝি?

সহসা কেষ্ট ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। হেমাঙ্গিনী কিছু আশ্চর্য হইলেন, কারণ, কখনও কেহ তাহাকে কাঁদিতে দেখে নাই। অনেক দুঃখ-কষ্ট যাতনা দিলেও সে ঘাড় হেঁট করিয়া নিঃশব্দে থাকে, লোকজনের সুমুখে জল ফেলে না। তাহার এই স্বভাবটি হেমাঙ্গিনী জানিতেন বলিয়াই বড় আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, ছি, কান্না কিসের? বেটাছেলেকে চোখের জল ফেলতে আছে কি?

প্রত্যুত্তরে কেষ্ট কোঁচার খুঁট মুখে গুঁজিয়া প্রাণপণ চেষ্টায় কান্না রোধ করিতে করিতে বলিল, ডাক্তার বলে যে, বুকে সর্দি বসেচে?

হেমাঙ্গিনী হাসিলেন—এইজন্যে? ছি ছি! কি ছেলেমানুষ তুই রে! বলিতে বলিতে তাহার নিজের চোখ দিয়াও টপটপ করিয়া দু-ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল। বাঁ-হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া তাহার মাথায় একটা হাত দিয়া কৌতুক করিয়া বলিলেন, সর্দি বসেচে—বসলেই বা রে! যদি মরি, তুই আর ললিত কাঁধে করে গঙ্গায় দিয়ে আসবি—কেমন, পারবি নে?

বলি মেজবৌ, কেমন আছ আজ? বলিয়া বড়বৌ দোরগোড়ায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। ক্ষণকাল কেষ্টর পানে তীক্ষ্ণ-দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, এই যে ইনি এসে হাজির হয়েছেন। আবার ও কি? মেজগিন্নীর কাছে কেঁদে সোহাগ করা হচ্ছে যে! ন্যাকা আমার, কত ফন্দিই জানে!

ক্লান্তিবশতঃ হেমাঙ্গিনী এইমাত্র বালিশে হেলান দিয়া কাত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তীরের মত সোজা উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, দিদি, আমার ছ-সাতদিন জ্বর, তোমার পায়ে পড়ি, আজ তুমি যাও।

কাদম্বিনী প্রথমটা থতমত খাইয়া গেলেন। কিন্তু পরক্ষণে সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, তোমাকে ত বলিনি মেজবৌ। নিজের ভাইকে শাসন কচ্ছি, তুমি এমন মারমুখী হয়ে উঠচ কেন?

হেমাঙ্গিনী বলিল, শাসন ত রাত্রিদিনই চলচে—বাড়ি গিয়ে করো, এখানে আমার সামনে করবার দরকার নেই, করতেও দেব না।

কেন, তুমি কি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে না কি?

হেমাঙ্গিনী হাতজোড় করিয়া বলিল, আমার বড় অসুখ দিদি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, হয় চুপ কর—নয় যাও।

কাদম্বিনী বলিলেন, নিজের ভাইকে শাসন করতে পাব না?

হেমাঙ্গিনী জবাব দিল, বাড়ি গিয়ে কর গে।

সে আজ ভাল করেই হবে। আমার নামে লাগান-ভাঙান আজ বার করব—বজ্জাত মিথ্যুক কোথাকার! বললুম গরুর দড়ি নেই কেষ্ট, দু-আঁটি পাট কেটে দে,—না দিদি, তোমার পায়ে পড়ি, পুতুলনাচ দেখে আসি—এই বুঝি পুতুলের নাচ হচ্চে রে? বলিয়া কাদম্বিনী গুমগুম করিয়া পা ফেলিয়া চলিয়া গেলেন।

হেমাঙ্গিনী কতক্ষণ কাঠের মত বসিয়া থাকিয়া শুইয়া পড়িয়া বলিল, কেন তুই পুতুলনাচ দেখতে গেলিনি কেষ্ট? গেলে ত আর এইসব হ’ত না। আসতে যখন তোকে ওরা দেয় না ভাই, তখন আর অসিস নে আমার কাছে।

কেষ্ট আর কথাটি না কহিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আমাদের গাঁয়ের বিশালাক্ষী ঠাকুর বড় জাগ্রত মেজদি, পূজো দিলে অসুখ সেরে যায়। দাও না মেজদি!

এইমাত্র নিরর্থক ঝগড়া হইয়া যাওয়ায় হেমাঙ্গিনীর মনটা ভারী বিগড়াইয়া গিয়াছিল, ঝগড়াঝাঁটি ত হয়ই—সেজন্যও নয়। এমন একটা রসাল ছুতা পাইয়া এই হতভাগার দুর্দশা যে কিরূপ হইবে, আসলে সেই কথাটা মনে মনে তোলাপাড়া করিয়া তাহার বুকের ভিতরটা ক্ষোভে ও নিরুপায় আক্রোশে জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। কেষ্ট ফিরিয়া আসিতেই হেমাঙ্গিনী উঠিয়া বসিল এবং কাছে বসাইয়া গায়ে হাত বুলাইয়া দিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। চোখ মুছিয়া বলিল, আমি ভাল হয়ে তোকে লুকিয়ে পূজো দিতে পাঠিয়ে দেব। পারবি একলা যেতে?

কেষ্ট উৎসাহে দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, একলা যেতে খুব পারব। তুমি আজকে আমাকে একটা টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দাও না, মেজদি—আমি কাল সকালেই পূজো দিয়ে তোমাকে প্রসাদ এনে দেব। সে খেলে তক্ষুণি অসুখ সেরে যাবে! দাও না মেজদি আজকেই পাঠিয়ে।

হেমাঙ্গিনী দেখিলেন, তাহার আর সবুর সয় না। বলিলেন, কিন্তু কাল ফিরে এলে তোকে যে এরা ভারী মারবে! মারধরের কথা শুনিয়া প্রথমটা কেষ্ট দমিয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই প্রফুল্ল হইয়া কহিল, মারুক গে। তোমার অসুখ সেরে যাবে ত।

আবার তাঁহার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। বলিলেন, হ্যাঁ রে কেষ্ট, আমি তোর কেউ নই, তবে আমার জন্যে তোর এত মাথাব্যথা কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর কেষ্ট কোথায় পাইবে? সে কি করিয়া বুঝাইবে, তাহার পীড়িত আর্ত হৃদয় দিবারাত্র কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার মাকে খুঁজিয়া ফিরিতেছে। একটুখানি মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার অসুখ যে সারচে না মেজদি—বুকে সর্দি বসেচে যে!

হেমাঙ্গিনী এবার একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আমার সর্দি বসেচে তাতে তোর কি? তোর এত ভাবনা হয় কেন?

কেষ্ট আশ্চর্য হইয়া বলিল, ভাবনা হবে না মেজদি, বুকে সর্দি বসা যে বড় খারাপ। অসুখ যদি বেড়ে যায়, তা হলে?

তা হলে তোকে ডেকে পাঠাব। কিন্তু না ডেকে পাঠালে আর আসিস নে ভাই।

কেন মেজদি?

হেমাঙ্গিনী দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, তোকে আর আমি এখানে আসতে দেব না। না ডেকে পাঠালেও যদি আসিস তা হলে ভারী রাগ করব।

কেষ্ট মুখপানে চাহিয়া সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে বল, কাল সকালে কখন ডেকে পাঠাবে?

কাল সকালেই আবার তোর আসা চাই?

কেষ্ট অপ্রতিভ হইয়া বলিল, আচ্ছা, সকালে না হয় দুপুরবেলায় আসব—না মেজদি? তাহার চোখেমুখে এমনই একটা ব্যাকুল অনুনয় ফুটিয়া উঠিল যে, হেমাঙ্গিনী মনে মনে ব্যথা পাইলেন। কিন্তু আর ত তাঁহার কঠিন না হইলে নয়। সবাই মিলিয়া এই নিরীহ একান্ত অসহায় বালকের উপর যে নির্যাতন শুরু করিয়াছে, কোন কারণেই আর ত তাহা বাড়াইয়া দেওয়া চলে না। সে হয়ত সহিতে পারে, মেজদির কাছে আসা-যাওয়া করিবার দন্ড যত গুরুতর হোক সে হয়ত সহ্য করিতে পিছাইবে না; কিন্তু, তাই বলিয়া তিনি নিজে কি করিয়া সহিবেন?

হেমাঙ্গিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল; তথাপি তিনি মুখ ফিরাইয়া রুক্ষস্বরে বলিলেন, বিরক্ত করিস নে কেষ্ট, যা এখান থেকে। ডেকে পাঠালে আসিস, নইলে যখন তখন এসে আমাকে বিরক্ত করিস নে।

না বিরক্ত করিনি ত, বলিয়া ভীত লজ্জিত মুখখানি হেঁট করিয়া তাড়াতাড়ি কেষ্ট উঠিয়া গেল।

এইবার হেমাঙ্গিনীর দুই চোখ বাহিয়া প্রস্রবণের মত জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। তিনি সুস্পষ্ট দেখিতে লাগিলেন, এই নিরুপায় অনাথ ছেলেটা মা হারাইয়া তাঁকেই মা বলিয়া আশ্রয় করিতেছে। তাঁহারই আঁচলের অল্প একটুখানি মাথায় টানিয়া লইবার জন্য কাঙালের মত কি করিয়াই না বেড়াইতেছে।

হেমাঙ্গিনী চোখ মুছিয়া মনেমনে বলিলেন, কেষ্ট, মুখখানি অমন করে গেলি ভাই, কিন্তু তোর এই মেজদি যে তোর চেয়েও নিরুপায়! তোকে জোর করে বুকে টেনে আনবে সে ক্ষমতা যে তার নেই ভাই।

উমা আসিয়া কহিল, মা, কাল কেষ্টমামা তাগাদায় না গিয়ে, তোমার কাছে এসে বসেছিল বলে জ্যাঠামহাশয় এমন মার মারলেন যে, নাক দি—

হেমাঙ্গিনী ধমকিয়া উঠিলেন—আচ্ছা—হয়েচে—হয়েচে—যা তুই এখান থেকে।

অকস্মাৎ ধমকানি খাইয়া উমা চমকাইয়া উঠিল। আর কোন কথা না কহিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া যাইতেছিল; মা ডাকিয়া বলিলেন, শোন রে! নাক দিয়ে কি খুব রক্ত পড়েছিল?

উমা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, না খুব নয়, একটুখানি।

আচ্ছা তুই যা।

উমা কবাটের কাছে আসিয়াই বলিয়া উঠিল, মা, এই যে কেষ্টমামা দাঁডিয়ে রয়েচে।

কেষ্ট শুনিতে পাইল। বোধ করি ইহাকে অভ্যর্থনা মনে করিয়া মুখ বাড়াইয়া সলজ্জ হাসি হাসিয়া কহিল, কেমন আছ মেজদি?

ক্ষোভে দু:খে, অভিমানে হেমাঙ্গিনী ক্ষিপ্তবৎ চিৎকার করিয়া উঠিলেন,—কেন এসেচিস এখানে? যা, যা বলচি শিগ্‌গির। দূর হ’ বলচি—

কেষ্ট মূঢ়ের মত ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল,—হেমাঙ্গিনী অধিকতর তীক্ষ্ণ তীব্রকণ্ঠে বলিলেন, তবু দাঁড়িয়ে রইলি হতভাগা—গেলিনে?

কেষ্ট মুখ নামাইয়া শুধু ‘যাচ্ছি’ বলিয়াই চলিয়া গেল। সে চলিয়া গেলে হেমাঙ্গিনী নির্জীবের মত বিছানার একধারে শুইয়া পড়িয়া অস্ফুটে ক্রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিলেন, এক শ’বার বলি হতভাগাকে, আসিস্‌ নে আমার কাছে—তবু ‘মেজদি’! শিবুকে বলে দিস ত উমা, ওকে না আর ঢুকতে দেয়।

উমা জবাব দিল না। ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

রাত্রে হেমাঙ্গিনী স্বামীকে ডাকাইয়া আনিয়া কাঁদ-কাঁদ গলায় বলিল, কোনদিন ত তোমার কাছে কিছু চাইনি—আজ এই অসুখের উপর একটা ভিক্ষা চাইচি, দেবে?

বিপিন সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, কি চাই?

হেমাঙ্গিনী বলিল, কেষ্টকে আমাকে দাও—ও বেচারী বড় দুঃখী—মা-বাপ নেই—ওকে ওরা মেরে ফেলচে,—এ আর আমি চোখে দেখতে পারচি নে।

বিপিন মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তা হলে চোখ বুজে থাকলেই ত হয়।

স্বামীর এই নিষ্ঠুর বিদ্রূপ হেমাঙ্গিনীকে শূল দিয়া বিঁধিল, অন্য কোন অবস্থায় সে ইহা সহিতে পারিত না, কিন্তু আজ নাকি তাহার দুঃখে প্রাণ বাহির হইতেছিল, তাই সহ্য করিয়া লইয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, তোমার দিব্যি করে বলচি, ওকে আমি পেটের ছেলের মত ভালবেসেচি। দাও আমাকে—মানুষ করি—খাওয়াই-পরাই—তার পরে যা ইচ্ছে হয় তোমাদের তাই ক’রো। বড় হলে আমি একটি কথাও কবো না।

বিপিন একটুখানি নরম হইয়া বলিলেন, ও কি আমার গোলার ধান-চাল যে তোমাকে এনে দেব? পরের ভাই, পরের বাড়ি এসেচে—তোমার মাঝখানে পড়ে এত দরদ কিসের জন্যে?

হেমাঙ্গিনী কাঁদিয়া ফেলিল। খানিক পরে চোখ মুছিয়া বলিল, তুমি ইচ্ছে করলে বঠ্‌ঠাকুরকে বলে, দিদিকে বলে, স্বচ্ছন্দে আনতে পার। তোমার দুটি পায়ে পড়চি, দাও তাকে।

বিপিন বলিলেন, আচ্ছা, তাই যদি হয়, আমিই বা এত বড়মানুষ কিসে যে, তাকে প্রতিপালন করব?

হেমাঙ্গিনী বলিল, তুমি আগে আমার একটা তুচ্ছ কথাও ঠেলতে না, এখন কি অপরাধ করেচি যে, যখন এমন করে জানাচ্ছি,—বলচি, সত্যিই আমার প্রাণ বার হয়ে যাচ্চে—তবু এই সামান্য কথাটা রাখতে চাইচ না? সে দুর্ভাগা বলে কি তোমরা সকলে মিলে তাকে মেরে ফেলবে? আমি তাকে আমার কাছে আসতে বলব, দেখি ওঁরা কি করেন।

বিপিন এবার রুষ্ট হইলেন। বলিলেন, আমি খাওয়াতে পারব না।

হেমাঙ্গিনী কহিল, আমি পারব। আমি কি বাড়ির কেউ নই যে, নিজের ছেলেকে খাওয়াতে পারব না। আমি কালই তাকে আমার কাছে এনে রাখব। দিদিরা জোর করেন ত আমি তাকে থানায় দারোগার কাছে পাঠিয়ে দেব।

স্ত্রীর কথা শুনিয়া বিপিন ক্রোধে অভিমানে ক্ষণকাল অবাক হইয়া থাকিয়া বলিলেন, আচ্ছা, সে দেখা যাবে, বলিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

পরদিন প্রভাত হইতেই বৃষ্টি পড়িতেছিল, হেমাঙ্গিনী জানালাটা খুলিয়া দিয়া আকাশের পানে চাহিয়াছিলেন, সহসা পাঁচুগোপালের উচ্চ কণ্ঠস্বর কানে গেল। সে চেঁচাইয়া বলিতেছিল, মা, তোমার গুণধর ভাই জলে ভিজতে ভিজতে এসে হাজির হয়েচে।

খ্যাংরা কোথায় রে? যাচ্ছি আমি, বলিয়া কাদম্বিনী হুঙ্কার দিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া মাথায় গমছা দিয়া দ্রুতপদে সদর-বাড়িতে ছুটিয়া গেলেন।

হেমাঙ্গিনীর বুকটা যেন কাঁপিয়া উঠিল। ললিতকে ডাকিয়া বলিলেন, যা ত বাবা, ও-বাড়ির সদরে। দেখত, তোর কেষ্টমামা কোথা থেকে এল?

ললিত ছুটিয়া চলিয়া গেল এবং খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, পাঁচুদা তাকে নাডুগোপাল করে মাথায় দুটো থান ইট দিয়ে বসিয়ে রেখেচে।

হেমাঙ্গিনী শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি করেছিল সে?

ললিত বলিল, কাল দুপুরবেলা তাকে তাগাদা করতে পাঠিয়েছিল গয়লাদের কাছে, তিন টাকা আদায় করে নিয়ে পালিয়েছিল, সব খরচ করে এই আসচে।

হেমাঙ্গিনী বিশ্বাস করিলেন ‘না। বলিলেন, কে বললে, সে টাকা আদায় করেছিল?

লক্ষ্মণ গয়লা নিজে এসে বলে গেছে, বলিয়া ললিত পড়িতে চলিয়া গেল।

ঘন্টা দুই-তিন আর কোন গোলযোগ শোনা গেল না। বেলা দশটার সময় রাঁধুনী খান-কতক রুটি দিয়া গিয়াছিল, হেমাঙ্গিনী বসিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, এমনি সময় তাঁহারই ঘরের বাহিরে কুরুক্ষেত্র বাধিয়া গেল। বড়গিন্নীর পশ্চাতে পাঁচুগোপাল কেষ্টর কান ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া আনিতেছে, সঙ্গে বড়কর্তাও আছেন। মেজকর্তাকেও আনিবার জন্য দোকনে লোক পাঠান হইয়াছে।

হেমাঙ্গিনী শশব্যস্তে মাথায় কাপড় দিয়া ঘরের একপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইতেই বড়কর্তা তীব্র কটুকন্ঠে শুরু করিয়া দিলেন, তোমার জন্যে আর ত আমরা বাড়িতে টিকতে পারিনে মেজবৌমা। বিপিনকে বল, আমাদের বাড়ির দামটা ফেলে দিক, আমরা আর কোথাও উঠে যাই।

হেমাঙ্গিনী বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া নিঃশব্দে দাঁড়ইয়া রহিলেন। তখন বড়গিন্নী যুদ্ধপরিচালনার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করিয়া দ্বারের ঠিক সুমুখে সরিয়া আসিয়া, হাত-মুখ নাড়িয়া বলিলেন, মেজবৌ, আমি বড়-জা, তা আমাকেও কুকর-শিয়াল মনে কর—তা ভালই কর, কিন্তু হাজার দিন বলেচি, মিছে লোক-দেখান আহ্লাদ দিয়ে, আমার ভায়ের মাথাটি খেয়ো না—কেমন এখন ঘটল ত? ওগো, দু’দিন সোহাগ করা সহজ়, কিন্তু চিরকালের ভারটি ত তুমি নেবে না—সে ত আমাকেই সইতে হবে?

ইহা যে কটুক্তি এবং আক্রমণ তাহাই শুধু হেমাঙ্গিনী বুঝিল—আর কিছু নয়। মৃদুকন্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হয়েচে?

কাদম্বিনী আরো বেশী হাত-মুখ নাড়িয়া কহিলেন, বেশ হয়েচে—খুব চমৎকার হয়েছে। তোমার শেখানোর গুণে আদায়ী টাকা চুরি করতে শিখেচে—আর দু’দিন কাছে ডেকে আরো দুটো শলাপরামর্শ দাও, তা হলে সিন্দুক ভাঙ্গতে, সিঁদ কাটতেও শিখবে।

একে হেমাঙ্গিনী পীড়িত, তাহার উপর এই কদর্য বিদ্রূপ ও মিথ্যা অভিযোগ—আজ সে জ্ঞান হারাইল। ইতিপূর্বে কখনও কোন কারণে ভাশুরের সুমুখে কথা কহে নাই; কিন্তু আজ আর থাকিতে পারিল না। মৃদুকন্ঠে কহিল, আমি কি তাকে চুরি-ডাকাতি করতে শিখিয়ে দিয়েছি দিদি?

কাদম্বিনী স্বচ্ছন্দে বলিলেন, কেমন করে জানব, কি তুমি শিখিয়ে দিয়েচ, না দিয়েচ। এ স্বভাব তার ত আগে ছিল না, এখনই বা হ’ল কেন? এত লুকোচুরির কথাবার্তাই বা তোমাদের কি, আর এত আহ্লাদ দেওয়াই বা কি জন্যে? কতদিনের পুঞ্জীভূত আবদ্ধ বিদ্বেষরাশি যে এই একটু পথ পাইয়া বাহির হইয়া আসিল, তাহা যিনি সব দেখেন, তিনি দেখিতে পাইলেন।

মুহূর্তকালের জন্য হেমাঙ্গিনী হতজ্ঞানের মত স্তম্ভিত হইয়া রহিল। এমন নিষ্ঠুর আঘাত, এত বড় নির্লজ্জ অপমান, মানুষ মানুষকে যে করিতে পারে, ইহা যেন তাহার মাথায় প্রবেশ করিল না। কিন্তু ঐ মুহূর্তকালের জন্য। পরক্ষনেই সে মর্মান্তিক আহত সিংহীর মত দুই চোখে আগুন জ্বালিয়া বাহির হইয়া আসিল। ভাশুরকে সুমুখে দেখিয়া মাথায় কাপড় আর একটু টানিয়া দিল, কিন্তু রাগ সামলাইতে পারিল না। বড়-জাকে সম্বোধন করিয়া মৃদু অথচ কঠোরস্বরে বলিল, তুমি এতবড় চামার যে, তোমার সঙ্গে কথা কইতেও আমার ঘৃণা বোধ হয়। তুমি এতবড় বেহায়া মেয়েমানুষ যে, ঐ ছোঁড়াটাকে ভাই বলেও পরিচয় দিচ্চ। মানুষ জানোয়ার পুষলে তাকেও পেট ভরে খেতে দেয়, কিন্তু ঐ হতভাগাটাকে দিয়ে যত-রকমের ছোট কাজ করিয়ে নিয়েও তোমরা আজ পর্যন্ত একদিন পেট ভরে খেতে দাও না। আমি না থাকলে এতদিন ও না খেতে পেয়েই মরে যেত। ও পেটের জ্বালায় শুধু ছুটে আসে আমার কাছে, সোহাগ-আহ্লাদ করতে আসে না।

বড়-জা বলিলেন, আমরা খেতে দিইনে, শুধু খাটিয়ে নিই, আর তুমি ওকে খেতে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেচ?

হেমাঙ্গিনী জবাব দিল, ঠিক তাই। আজ পর্যন্ত কখনও ওকে দু’বেলা তোমরা খেতে দাওনি——কেবল মারধর করেচ, আর যত পেরেচ খাটিয়ে নিয়েচ। তোমার ভয়ে আমি হাজার দিন ওকে আসতে বারণ করেচি, কিন্তু খিদে বরদাস্ত করতে পারে না, আর আমার কাছে পেট ভরে দুটো খেতে পায় বলেই ছুটে ছুটে আসে——চুরি-ডাকাতির পরামর্শ নিতে আসে না। কিন্তু তোমরা এতবড় হিংসুক যে, তাও চোখে দেখতে পার না।

এবার ভাশুর জবাব দিলেন। কেষ্টকে সুমুখে টানিয়া আনিয়া তাহার কোঁচার খুঁট খুলিয়া একটা কলাপাতার ঠোঙ্গা বাহির করিয়া সক্রোধে বলিয়া উঠিলেন, হিংসুক আমরা! কেন যে ওরে ভাল চোখে দেখতে পারিনে, তা তুমি নিজের চোখে দ্যাখো। মেজবৌমা, তোমার শেখানর গুণেই ও আমার টাকা চুরি ক’রে তোমার ভালোর জন্যে কোন্‌ একটা ঠাকুরের পূজো দিয়ে প্রসাদ এনেচে——এই নাও; বলিয়া তিনি গোটা-দুই সন্দেশ ও ফুল বেলপাতা ঠোঙ্গার ভিতর হইতে বাহির করিয়া দেখাইলেন।

কাদম্বিনী চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন, মা গো! কি মিটমিটে শয়তান, কি ধড়িবাজ ছেলে! বেশ ত মেজবৌ, এখন তুমি বল না, কি মতলবে ও চুরি করেচে? ও কি আমার ভালোর জন্যে?

হেমাঙ্গিনী ক্রোধে জ্ঞান হারাইল। একে তাহার অসুস্থ শরীর, তাহাতে এই সমস্ত মিথ্যা অভিযোগ, সে দ্রুতপদে কেষ্টর সম্মুখীন হইয়া তাহার দুই গালে সশব্দে চড় কষাইয়া দিয়া কহিল, বদমাইস চোর, আমি তোকে চুরি করতে শিখিয়ে দিয়েচি? কতদিন তোকে আমার বাড়ি ঢুকতে বারণ করেচি, কতবার তোকে তাড়িয়ে দিয়েচি। আমার নিশ্চয় বোধ হচ্চে, তুই চুরির মতলবেই যখন তখন এসে উঁকি মেরে দেখতিস।

ইতিপূর্বেই বাড়ির সকলে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। শিবু কহিল, আমি নিজের চক্ষে দেখেছি মা, পরশু রাত্তিরে ও তোমার ঘরের সুমুখে আঁধারে দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখেই ছুটে পালিয়ে গেল। আমি এসে না পড়লে নিশ্চয় তোমার ঘরে ঢুকে চুরি করত।

পাঁচুগোপাল বলিল, জানে মেজখুড়ীমার অসুখ শরীর—সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়েন—ও কি কম চালাক!

মেজবৌয়ের কেষ্টর প্রতি আজকার ব্যবহারে কাদম্বিনী যেরূপ প্রসন্ন হইলেন, এই ষোল বৎসরের মধ্যে কখনও এরূপ হন নাই। অত্যন্ত খুশি হইয়া কহিলেন, ভিজে বেড়াল! কেমন করে জানবো মেজবৌ, তুমি ওকে বাড়ি ঢুকতে বারণ করেচ। ও বলে বেড়ায়, মেজদি আমাকে মায়ের চেয়ে ভালবাসে। ঠোঙ্গাসুদ্ধ নির্মাল্য টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, টাকা তিনটে চুরি করে কোথা থেকে দুটো ফুলটুল কুড়িয়ে এনেচে।

বাড়ি লইয়া গিয়া বড়কর্তা চোরের শাস্তি শুরু করিলেন। সে কি নির্দয় প্রহার! কেষ্ট কথাও কহে না, কাঁদেও না। এদিকে মারিলে ওদিকে মুখ ফিরায়, ওদিকে মারিলে এদিকে মুখ ফিরায়। ভারী গাড়িসুদ্ধ গরু কাদায় পড়িয়া যেমন করিয়া মার খায়, তেমনি করিয়া কেষ্ট নিঃশব্দে মার খাইল। এমন কি, কাদম্বিনী পর্যন্ত স্বীকার করিলেন, হাঁ মার খাইতে শিখিয়াছিল বটে! কিন্তু ভগবান জানেন, এখানে আসার পূর্বে নিরীহ স্বভাবের গুণে কখন কেহ তাহার গায়ে হাত তুলে নাই।

হেমাঙ্গিনী নিজের ঘরের ভিতর সমস্ত জানালা বন্ধ করিয়া দিয়া কাঠের মূর্তির মত বসিয়াছিলেন। উমা মার দেখিতে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া বলিল, জ্যাঠাইমা বললেন, কেষ্টমামা বড় হলে ডাকাত হবে। ওদের গাঁয়ে কি ঠাকুর আছে—

উমা—?

মায়ের অশ্রুবিকৃত ভগ্ন কণ্ঠস্বরে উমা চমকাইয়া উঠিল। কাছে আসিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কেন মা?

হাঁ রে, এখনো কি তাকে সবাই মিলে মারচে? বলিয়াই তিনি মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

মায়ের কান্না দেখিয়া উমাও কাঁদিয়া ফেলিল। তার পর কাছে বসিয়া, নিজের আঁচল দিয়া জননীর চোখ মুছাইয়া দিতে দিতে বলিল, পেসন্নর মা কেষ্টমামাকে বাইরে টেনে নিয়ে গেছে।

হেমাঙ্গিনী আর কথা কহিলেন না, সেইখানে তেমনি করিয়াই পড়িয়া রহিলেন। বেলা দু-তিনটার সময় সহসা কম্প দিয়া ভয়ানক জ্বর আসিল। আজ অনেকদিন পর পথ্য করিতে বসিয়াছিলেন—সে খাবার তখনও একধারে পড়িয়া শুকাইতে লাগিল।

সন্ধ্যার পর বিপিন ও-বাড়িতে বৌঠানের মুখে সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া ক্রোধভরে স্ত্রীর ঘরে ঢুকিতেছিলেন, উমা কাছে আসিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল, মা জ্বরে অজ্ঞান হয়ে আছেন।

বিপিন চমকাইয়া উঠিলেন—সে কি রে, আজ তিন-চারদিন জ্বর ছিল না ত!

বিপিন মনে মনে স্ত্রীকে অতিশয় ভালবাসিতেন। কত যে বাসিতেন, তাহা বছর চার-পাঁচ পূর্বে দাদাদের সহিত পৃথক হইবার সময় জানা গিয়াছিল। ব্যাকুল হইয়া ঘরে ঢুকিয়াই দেখিলেন, তখনও তিনি মাটির উপর পড়িয়া আছেন। ব্যস্ত হইয়া শয্যায় তুলিবার জন্য গায়ে হাত দিতেই হেমাঙ্গিনী চোখ মেলিয়া, একমুহূর্ত স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া, অকস্মাৎ দুই পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন—কেষ্টকে আশ্রয় দাও, নইলে, এ জ্বর আমার সারবে না। মা দুর্গা আমাকে কিছুতে মাপ করবেন না।

বিপিন পা ছাড়াইয়া লইয়া, কাছে বসিয়া স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাইয়া সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, দেবে?

বিপিন সজল চক্ষু হাত দিয়া মুছিয়া বলিলেন, তুমি যা চাও তাই হবে, তুমি ভাল হয়ে ওঠ।

হেমাঙ্গিনী আর কিছু বলিলেন না, বিছানায় উঠিয়া শুইয়া পড়িলেন।

জ্বর রাত্রেই ছাড়িয়া গেল, পরদিন সকালে উঠিয়া বিপিন ইহা লক্ষ্য করিয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন। হাত-মুখ ধুইয়া কিছু জলযোগ করিয়া দোকানে বাহির হইতেছিলেন, হেমাঙ্গিনী আসিয়া বলিলেন, মার খেয়ে কেষ্টার ভারী জ্বর হয়েচে, তাকে আমি আমায় কাছে নিয়ে আসছি।

বিপিন মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, তাকে এ-বাড়িতে আনবার দরকার কি? যেখানে আছে সেখানেই থাক না।

হেমাঙ্গিনী ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া থাকিয়া বলিলেন, কাল রাত্রে যে তুমি কথা দিলে, তাকে আশ্রয় দেবে।

বিপিন অবজ্ঞাভরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন হাঁ—সে কে যে, তাকে ঘরে এনে পুষতে হবে! তুমি যেমন!

কাল রাত্রে স্ত্রীকে অত্যন্ত অসুস্থ দেখিয়া যাহা স্বীকার করিয়াছিলেন, আজ সকালে তাঁহাকে সুস্থ দেখিয়া তাহাই তুচ্ছ করিয়া দিলেন। ছাতাটা বগলে চাপিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, পাগলামি ক’র না,—দাদারা ভারী চটে যাবেন।

হেমাঙ্গিনী শান্ত দৃঢ়কন্ঠে কহিলেন, দাদারা চটে গিয়ে কি তাকে খুন করে ফেলতে পারেন, না, আমি নিয়ে এলে সংসারে কেউ তাকে আটকে রাখতে পারে? আমার দুটি সন্তান ছিল, কাল থেকে তিনটি হয়েচে। আমি কেষ্টর মা।

আচ্ছা, সে তখন দেখা যাবে, বলিয়া বিপিন চলিয়া যাইতেছিলেন, হেমাঙ্গিনী সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, এ-বাড়িতে তাকে আনতে দেবে না?

সর, সর,—কি পাগলামি কর? বলিয়া বিপিন চোখ রাঙ্গাইয়া চলিয়া গেলেন।

হেমাঙ্গিনী ডাকিলেন, শিবু, একটা গরুর গাড়ি ডেকে আন, আমি বাপের বাড়ি যাব।

বিপিন শুনতে পাইয়া মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, ইস! ভয় দেখানো হচ্চে! তার পর দোকানে চলিয়া গেলেন।

কেষ্ট চণ্ডীমণ্ডপের একধারে ছেঁড়া মাদুরের উপর জ্বরে, গায়ের ব্যথায় এবং বোধ করি বুকের ব্যথায় আচ্ছন্নের মত পড়িয়া ছিল। হেমাঙ্গিনী ডাকিলেন, কেষ্ট।

কেষ্ট যেন প্রস্তুত হইয়া ছিল—এইবারে তড়াক করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, মেজদি।

পরক্ষণে সলজ্জ হাসিতে তাহার সমস্ত মুখ ভরিয়া গেল। যেন তাহার কোন অসুখ-বিসুখ নাই, এই ভাবে মহা-উৎসাহে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, কোঁচা দিয়া ছেঁড়া মাদুর ঝাড়িতে ঝাড়িতে বলিল, ব’স।

হেমাঙ্গিনী তাহার হাত ধরিয়া বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া বলিলেন, আর ত বসব না দাদা, আয় আমার সঙ্গে। আমাকে বাপের বাড়ি আজ তোকে পৌঁছে দিতে হবে যে।

চল, বলিয়া কেষ্ট তাহার ভাঙ্গা ছড়িটা বগলে চাপিয়া লইল এবং ছেঁড়া গামছাখানা কাঁধে ফেলিল।

নিজেদের বাড়ির সদরে গোযান দাঁড়াইয়াছিল, হেমাঙ্গিনী কেষ্টকে লইয়া চড়িয়া বসিলেন। গাড়ি যখন গ্রাম ছাড়াইয়া গিয়াছে, তকন পশ্চাতে ডাকাডাকি চিৎকারে গাড়োয়ান গাড়ি থামাইল। ঘর্মাক্ত কলেবরে আরক্ত মুখে বিপিন আসিয়া উপস্থিত হইলেন; সভয়ে প্রশ্ন করিলেন, কোথায় যাও মেজবৌ?

হেমাঙ্গিনী কেষ্টকে দেখাইয়া বলিলেন, এদের গ্রামে।

কখন ফিরবে?

হেমাঙ্গিনী গম্ভীর দৃঢ়কন্ঠে উত্তর দিল, ভগবান যখন ফেরাবেন, তখনই ফিরব।

তার মানে?

হেমাঙ্গিনী পুনরায় কেষ্টকে দেখাইয়া বলিল, কখনও যদি কোথাও এর আশ্রয় জোটে, তবেই ত একা ফিরে আসতে পারব, না হয়, একে নিয়েই থাকতে হবে।

বিপিনের মনে পড়িল, সেদিনেও স্ত্রীর এমনি মুখের ভাব দেখিয়াছিলেন এবং এমনি কন্ঠস্বরই শুনিয়াছিলেন, যেদিন মতি কামারের নিঃসহায় ভাগিনেয়ের বাগানখানি বাঁচাইবার জন্য তিনি একাকী সমস্ত লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন। মনে পড়িল, এ মেজবৌ সে নয়, যাহাকে চোখ রাঙ্গাইয়া টলান যায়।

বিপিন নম্রস্বরে বলিলেন, মাপ কর মেজবৌ, বাড়ি চল।

হেমাঙ্গিনী হাতজোড় করিয়া কহিলেন, আমাকে তুমি মাপ কর—কাজ না সেরে আমি কোনমতেই বাড়ি ফিরতে পারব না।

বিপিন আর একমুহূর্ত স্ত্রীর শান্ত দৃঢ় মুখের পানে নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর সহসা সুমুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কেষ্টর ডান-হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিলেন, কেষ্ট, তোর মেজদিকে তুই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আয় ভাই; শপথ করচি, আমি বেঁচে থাকতে তোদের দুই ভাই-বোনকে আজ থেকে কেউ পৃথক করতে পারবে না। আয় ভাই, তোর মেজদিকে নিয়ে আয়।

সমাপ্ত