সুভাষিণী সেদিনের পর থেকে কেমন যেন ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। তার মুখের হাসি কোথায় যে মিলিয়ে গিয়েছে তার ঠিক নেই। সখীরা তাকে এমন বিষণ্ণ ভাবাপন্ন হয়ে পড়তে দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পিতামাতাও উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন, তাদের একমাত্র কন্যার হলো কি? বড় বড় ডাক্তার দেখানো হচ্ছে, কিন্তু কোন ডাক্তারই রোগ খুঁজে পাচ্ছে না। সুভাষিণীর মুখে তবু হাসি নেই। ঠিকভাবে নাওয়া খাওয়া নেই। সখীদের নিয়ে হাসি গল্প নেই, সদা সর্বদা কি যেন ভাবে সে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়—কিছু হয় নি আমার।

একদিন সখীরা ধরে বসলো-সুভাষিণী, আজ তোকে বলতেই হবে, সে দিনের পর থেকে তোর কি হয়েছে? ডাক্তার বলেছে অসুখ নেই। নিজেও বলিস কিছু হয়নি, তবে তোর হলো কি?

সুভাষিণী কারো কাছেই বলতে পারে না তার মনের কথা। সে একজন দস্যুকে ভালবেসে ফেলেছে তবু সে স্বজাতি নয় মুসলমান কিন্তু তার পক্ষে ওকে ভুলাও অসম্ভব। কেন—কেন তার।

মনে ওর প্রতিচ্ছবি এমন করে গেঁথে গেছে? সে তো সভ্য সমাজের কোন লোক নয়। সে একজন দস্যু।

সুভাষিণীকে নীরব থাকতে দেখে সখীদের একজন বলে ওঠে—কি ভাবছিস সুভা?

ভাবছি তোরা আমার মাথাটা খাবি। সত্যি তুই আমাদের প্রশ্নের জবাব দিবি না?

না।

বেশ, আজ থেকে আমরা তোকে বিরক্ত করব না। কিন্তু মনে রাখিস সুভা, তুই না বললেও আমরা বুঝতে পেরেছি, একটা কিছু তোর হয়েছে।

সেটুকুই জেনে রাখ তোরা, তাহলেই হলো।

একদিন সুভাষিণী বাগানে বসে ভাবছে এমন সময় তার বড় দাদার বৌ চন্দ্রা দেবী এসে বসলো তার পাশে।

সুভাষিণী ফিরে তাকিয়ে আবার সোজা হয়ে বসলো কোন কথা বলেন।। পূর্বে যে বৌদিকে দেখে তার খুশির অন্ত থাকে না আজ আর সঙ্গে কথাই বলে না সুভাষিণী। চন্দ্রা ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেন, তারপর সুভাষিণীর একখানা হাত মুঠায় চেপে ধরে বলেন–সুভা, আজ তোকে একটা কথা আমাকে বলতে হবে। বল বলবি?

স্থিরকণ্ঠে বলে সুভাষিণী বলার মত হলে, নিশ্চয়ই বলবো।

আচ্ছা সুভা, তুই যে বলেছিলি কে যেন তোকে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে ঘোড়ায় চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল?

হ্যাঁ সে এক ভদ্রলোক।

সুভা, এবার আমি বুঝতে পেরেছি, সে দিন ঐ ভদ্রলোক তোকে বাঁচিয়ে নিয়েছে সত্যি, কিন্তু তোর হৃদয় চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে।

যাও, ঠাট্টা করো না বৌদি।

ঠাট্টা নয় সুভা, এতদিন ঘরে সদা সর্বদা তোর বিষয় নিয়ে ভেবে দেখেছি ঠিক, এই রকম কিছু একটা হয়েছে। দেখ সুভা আমি তোর বৌদি। লক্ষী বোনটি আমার কাছে কোন কথা লুকোতে নেই।

জানি, কিন্তু বলে কোন লাভ হবে না বৌদি।

হবে, আমাকে বললে অনেক উপকার হবে তোর।

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে সুভাষিণী—তুমি যদি প্রতিজ্ঞা করো এ কথা কার কাছে বলবে না, তবে বলতে পারি।

বল, বলবো না।

বৌদি, তুমি যা অনুমান করেছে। তাই সত্য। যে সেদিন আমাকে ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, সে আমার গোটা মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারছিনে বৌদি।

সুভাষিণী, এ কথা আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু তার কোন পরিচয় জানা নেই—কে সে? কি তার নাম? সুভা, অজ্ঞাত একজনকে হঠাৎ এভাবে ভালবেসে, তুই ভুল করেছিস।

বৌদি, তার পরিচয় আমি পেয়েছি।

সত্যি?

হ্যাঁ।

কে সে?

বৌদি, তুমি শুনলে চমকে উঠবে, ভয়ে শিউরে উঠবে। আমাকে রক্ষাকারী সে লোকটি স্বাভাবিক লোক নয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, দস্যু বনহুর।

বিস্ময়ভরা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে। চন্দ্রা-দস্যু বনহুর!

বৌদি, প্রথমেই বলেছি, এ কথা তুমি কাউকে বলবে না।

সুভা, একি বলছিস তুই।

বৌদি, আমি গোটা অন্তর দিয়ে ওকে ভালবেসে ফেলেছি।

সুভা, একটা দস্যু, একটা কুৎসিত জঘন্য ব্যক্তিকে…

না, না, বৌদি, তুমি তাকে জানো না বৌদি, তুমি তাকে জান না। বৌদি! একটি বার যদি তুমি তাকে দেখতে। দস্যু বনহুর সে মানুষ নয়দেবতা!

এসব কি বলছিস সুভাষিণী?

তোমাকে কি বলবো, বৌদি। আমি কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছিনে। সুভাষিণী চন্দ্রার হাত চেপে ধরে—বৌদি, বলো কি করবো আমি?

চন্দ্রার মুখমণ্ডল গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবে। তারপর বলে—সুভা, যাকে কোনদিন আর দেখার সুযোগ পর্যন্ত পাবি না, তাকে ভালবেসে নিজেকে বিসর্জন দিসনে।

সুভাষিণী চন্দ্রার কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বৌদি! বৌদি। চন্দ্র সস্নেহে সুভাষিণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

হাঙ্গেরী কারাগার পরিদর্শন করার পর পুলিশ সুপার মিঃ আহমদ স্বয়ং দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে অবতীর্ণ হয়েছেন। ইন্সপেক্টার মিঃ হারুন অন্য কয়েকজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারসহ গোপনে মিঃ চৌধুরীর বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছেন। সবাই আড়ালে থেকে লক্ষ্য করছেন। তারা গোপনে সন্ধান নিয়ে জানতে পেয়েছেন, দস্যু বনহুর হঠাৎ কোন কোন দিন চৌধুরী বাড়িতে আগমন করে এবং মনিরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

বেশ কয়েক রাত এভাবে তারা গোপনে পাহারা চালিয়ে চলেছে। ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছেন মিঃ আহমদ। দস্যু বনহুরের দেখা পাওয়াতে দূরের কথা, একটি প্রাণীও দেখতে পাননি তারা রাতের অন্ধকারে।

আজ অমাবস্যা। গোটা পৃথিবী অন্ধকার। এই রাতের প্রতীক্ষায় আছে মনিরা। প্রতি অমাবস্যা রাতেই বনহুর আসতো তার কাছে। আজও আসবে সে।

ওদিকে গুলিভরা রাইফেল আর রিভলভার নিয়ে প্রতীক্ষা করছে পুলিশ বাহিনী। মিঃ আহমদের চোখ দুটো অন্ধকারে আগুনের ভাটার মত জ্বলছে। আর জ্বলছে তার হাতের রিভলভারটি।

গভীর রাত। মনিরা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। আজ আসবে মনিরা। বার বার ওর ছবিখানা নিয়ে দেখছে সে। ফুলের একটি মালা সুন্দর করে গেঁথে রেখেছে, এই মালাখানা পরিয়ে দিয়ে ওকে সাদর সম্ভাষণ জানাবে মনিরা।

এমন সময় দূরে শুনা যায় অশ্বপদশব্দ।

মনিরার হৃদয়ে দোলা লাগে। মালাটা হাতে তুলে নিয়ে প্রতীক্ষা করে সে। বুকের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব আনন্দের অনুভূতি নাড়া দিয়ে চলেছে।

মিঃ আহমদের দলবলের কানেও গিয়ে পৌঁছলো এই অশ্বপদ শব্দ। প্রত্যেকেই রিভলভার আর রাইফেল উদ্যত করে প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

অশ্বপদশব্দ ক্রমে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে।

ওদিকে মনিরার হাতে ফুলের মালা—

আর এদিকে পুলিশ বাহিনীর হাতে উদ্যত রিভলভার…

হাস্যোজ্জল দীপ্ত মুখে তাজের পিঠে এগিয়ে আসছে দস্যু বনহুর।