পুত্রশোকে চৌধুরী মাহমুদ খান আর মরিয়ম বেগম অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। এতদিন তারা জানতেন মনির মরে গেছে। আর সে কোন দিন ফিরে আসবে না। হঠাৎ সে পুত্রকে অভাবনীয় অবস্থায় ফিরে পেলেন চৌধুরী সাহেব আর মরিয়ম বেগম। কিন্তু এমন পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াই ছিল তাদের পক্ষে ভালো।

মরিয়ম বেগম তো নাওয়া-খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন, সদাসর্বদা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে চললেন। যে পুত্র ছিল তার জীবনের নয়নের মণি, যাকে হারিয়ে তিনি নিজেকে সর্বহারা মনে করতেন, সে হৃদয়ের নয়নের মণি, মনিরকে ফিরে পেয়ে আবার হারালেন। শুধু হারালেন নয়, নিজের হাতে তাকে বিসর্জন দিল।

স্ত্রীর অবস্থা দর্শনে চিন্তিত হয়ে ছিল চৌধুরী সাহেব। তিনি নিজেও মনিরের জন্য অত্যন্ত কাতর ছিল। কিন্তু মনের ব্যথা মনে চেপে নিশ্চুপ রয়ে গেল। কোন উপায় নেই ওকে বাঁচাবার। চৌধুরী সাহেব সবচেয়ে বড় দুঃখ পেলেন, তাঁর পুত্র আজ ডাকু। সভ্য সমাজে তার কোন স্থান নেই।

মনিরা যে বনহুরকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল, এ কথা বুঝতে পেরেছিল মামুজান আর মামী মা। বনহুর গ্রেপ্তার হওয়ায় মনিরার হৃদয়েও যে ভীষণ আঘাত লেগেছে জানেন তারা। চৌধুরী সাহেব লক্ষ্য করেছেন সেদিনের পর থেকে মনিরার মুখের হাসি কোথায় যেন অন্তর্ধান হয়ে গেছে। সর্বদা বিষণ্ণ হয়ে থাকে সে।

অহরহ মনিরা নিজের কক্ষে শুয়ে শুয়ে শুধু বনহুরের কথা ভাবে, কিছুতেই সে বনহুরকে ঘৃণার চোখে দেখতে পারে না। নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকে মনিরা বনহুরের ছোটবেলার ছবিখানার দিকে। নির্মল দীপ্ত দুটি চোখ কি সুন্দর। আজও ঐ দুটি চোখের চাহনি মনিরার হৃদয়ে গেঁথে আছে। বনহুর বন্দী হয়েছে সত্য কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্য মনিরা তাকে বিস্তৃত হতে দেখেনি।

চৌধুরী সাহেব পুত্রশোকে মুহ্যমান। মরিয়ম বেগম শয্যাশায়ী, মনিরার অবস্থাও তাই। গোটা চৌধুরী বাড়ি একটা নিস্তব্ধতা ও বিষাদে ভরে উঠেছে। কোথাও যেন এ বাড়িটার এতটুকু আনন্দ নেই।

চৌধুরী সাহেব সেদিন নিজের কক্ষে শুয়ে শুয়ে পুত্র সম্বন্ধেই চিন্তা করছিল। নৌকাডুবির পর মনির কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল, কেমন করে সে জীবনে বেঁচে আছে,কে তাকে লালন-পালন করলো, লেখাপড়া শিখে মানুষ না হয়ে, কেমন করে হলো সে ডাকু–

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করেন মরিয়ম বেগম। বিষণ্ণ মলিন মুখ মণ্ডল। স্বামীর পাশের সোফায় বসে বলেন–ওগো, বাছাকে উদ্ধারের কোনই কি উপায় নেই?

চৌধুরী সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল–না।

তারপর উভয়েই নীরব, গোটা কক্ষে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

মরিয়ম বেগম পুনরায় স্বামীকে লক্ষ্য করে বলেন–কিন্তু আমার মন যে কিছুতেই মানছে না।

জানি, কিন্তু কোন্ উপায় নেই।

নাগো ও কথা বলল না। তুমি একবার ইন্সপেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে

অসম্ভব। একটা ডাকাতের জন্য আমি নিজেকে হেয় করবো?

ডাকাত হলেও সে আমাদের সন্তান।

তুমি কি পাগল হলে মরিয়ম? আমার পুত্র বলে দোষীকে তারা ছেড়ে দেবে না। ন্যায্য বিচারে তার যে দণ্ড হবে, তাই মেনে নিতে হবে।

ওগো, আমি তা সহ্য করতে পারবো না। আমার মনিরের যদি যাবৎ। জীবন কারাদণ্ড হয়….

শুধু কারাদণ্ড নয়, তার ফাঁসিও হতে পারে।

বাপ হয়ে তুমি এ কথা মুখে আনতে পারলে? ওগো, আমার মণিকে তুমি বাঁচিয়ে নাও।

মনিরা কখন আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে মামা-মামীমার কথাবার্তা শুনছিল কেউ জানে না। চৌধুরী সাহেবের শেষ কথায় মনিরা দু’হাতে বুক চেপে বসে পড়ে মেঝেতে। বনহুরের ফাসি হতে পারে

আর সহ্য করতে পারে না মনিরা। উঠে ধীরে ধীরে নিজের কক্ষে ফিরে যায়। দেয়াল থেকে বিছানা খানা নিয়ে দু’হাতে বুবে …. .. পিত কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলো সে–মনির, আবার কেন তুমি আমার জীবন পথে এসে দাঁড়িয়েছিলে?

মনিরার চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠে ফটোখানা।

বনহুর বন্দী হয়েছে জানতে পেরে নূরীর ধমনীর রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারে না দস্যু বনহুরকে কেউ বন্দী করতে পারে। তখনই নূরী পুরুষের ড্রেসে সজ্জিত হয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্যান্য অনুচরকে লক্ষ্য করে বলে–আমি বনহুরকে উদ্ধার করতে চাই। তোমরা আমাকে সাহায্য করো।

কিন্তু বনহুরের প্রধান অনুচর রহমান তাকে ক্ষান্ত করে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে-নূরী, উপায় থাকলে আমরা এখনও নিশ্চুপ থাকতাম না। হাঙ্গেরী কারাগার—তা অতি ভীষণ জায়গা। হাজার হাজার পুলিশ ফোর্স অবিরত কড়া পাহারা দিচ্ছে। প্রকাশ্যে সেখানে কোন কিছুই করতে পারা যাবে না। আমি গোপনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছি। তাছাড়া নূরী তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই, সর্দারকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না।

নূরীর চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কিন্তু একেবারে আশ্বস্ত হয় না সে, যতক্ষণ বনহুর ফিরে না আসছে ততক্ষণ নিশ্চিন্ত নয় নূরী।

একদিন দু’দিন কুরে পাঁচটা দিন চলে গেছে। যে নূরী একটি দিন বনহুরকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে, সে নূরী আজ কদিন বনহুরকে কাছে। পায়নি।

শুধু নূরীই নয়, বনহুরের অন্তর্ধানে তার সমস্ত অনুচরবর্গ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ঝিমিয়ে পড়েছে গোটা বনভূমি।

সবচেয়ে তাজের অবস্থা দুঃখজনক। বনহুর বন্দী হবার পর তাজ কেমন যেন হয়ে গেছে। ঘাস ছোলা কিছু সে মুখে নেয় না। বনহুর তাজকে নিজ হাতে ঘাস ছোলা খাওয়াতো। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতো। বনহুরের অনুপস্থিতিতে সে অবিরত সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করত। কথা বলতে পারে না তাজ, মনের অবস্থা সে এমনি করে ব্যক্ত করত।

বনহুরের অনুচরগণ তাজের জন্য চিন্তিত হয়ে ছিল। না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বে তাজ। এই অশ্বই হচ্ছে বনহুরের সবচেয়ে প্রিয়।

সেদিন নুরী অনেক চেষ্টায় গলায় পিঠে হাত বুলিয়ে একটু ছোলা আর ঘাস খাইয়েছে তাজকে, কিন্তু এমনি করে আর ক’দিন ওকে বাঁচানো যাবে।

সর্দারের বিনা অনুমতিতে দস্যুগণ কিছুই করতে পারবে না। তাই তারা নীরব হয়েছে।

নূরী ঝরনার ধারে বসে গান গায়। বনে বনে ঘুরে ঘুরে চোখের পানি ফেলে। যেদিকে তাকায় শূন্য বনভূমি খা খা করেছ। বনহুরকে নূরী নিজের প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসে। বনহুর ছাড়া আর কেউ যেন নেই ওর। অবশ্য সে কথা মিথ্যে নয়, এ বনে বনহুরই একমাত্র সঙ্গী—একমাত্র সম্বল।

বনহুরকে কেন্দ্র করে নূরী কত আকাশ-কুসুম গড়ে আর ভাঙে বনহুর তার স্বপ্ন–তার সব।

সেদিন নূরী তার নিজের কক্ষে বিছানায় শুয়ে কাঁদছিল। কই আজও তো বনহুর ফিরে এলো না। রহমান নিশ্চয়ই কোন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বনহুরকে না জানি হাঙ্গেরী কারাগারে কি কঠিন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে! নূরীর চিন্তার অন্ত নেই। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে নূরী।

ঠিক এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর, নূরীকে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ব্যথিত কণ্ঠে ডাকে—নূরী।

মুহূর্তে নূরী চোখ তুলে তাকায়। আনন্দে উজ্জল হয়ে ওঠে তার। মুখমণ্ডল। ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে সে বনহুরের বুকে হুর!

বনহুর নূরীর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে-নূরী, খুব কেঁদেছো বুঝি এ কদিন?

হুর, আমার মন বলেছে কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না, তোমাকে বন্দী করে রাখতে কেউ সক্ষম হবে না।

তোমার বিশ্বাস মিথ্যা নয় নূরী। বনহুকে আটকে রাখে কার সাধ্য। সামান্য পুলিশ বাহিনী বন্দী করে রাখবে আমাকে! হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে বনহুরহাঃ হাঃ হাঃ, হাঙ্গেরী কারগারও বনহুরকে আটকে রাখতে সক্ষম হলো না, নূরী।

নূরী দীপ্ত প্রফুল্ল মুখে বনহুরের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে তার মধ্যে দেখতে পায় এক নতুন রূপ।

চৌধুরী সাহেব, মরিয়ম বেগম এবং মনিরা চায়ের টেবিলের পাশে এসে বসে, সকলের মুখেই বিষণ্ণতার ছাপ।

বাবুর্চি চা-নাস্তা পরিবেশন করছিল, এমন সময় বয় খবরের কাগজ এনে টেবিলে রাখে।

একসংগে চৌধুরী সাহেবের এবং মনিরার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে পত্রিকা খানার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়মাখা আনন্দ ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করেন চৌধুরী সাহেব-হাঙ্গেরী কারাগার হতে দস্যু বনহুরের পলায়ন। শত শত পুলিশ বাহিনী তাকে আটকিয়ে রাখতে অক্ষম।

আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বলে উঠলেন মরিয়ম বেগম-সত্যি আমার মনির কারাগার থেকে পালিয়েছে? সত্যি বলছো?

হ্যাঁ গো, এই দেখ? চৌধুরী সাহেব পত্রিকার উপরের পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে লেখাগুলো দেখিয়ে দেন।

মরিয়ম বেগম ইংরেজি জানতেন না, তিনি স্বামীকে লক্ষ্য করে বলেন—সমস্তটা পড়ে আমায় বুঝিয়ে বল না গো। আমার মনির কারাগার থেকে পালিয়েছে। না জানি বাছা আমার কোথায় আছে কেমন আছে।

মনিরার চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। মনির কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে। ইস কি আনন্দ–কি শান্তি। নিশ্চয় সে আসবে। যেমন করে হউক সে আসবে তার কাছে। মনিরা আনন্দের আবেগে আর স্থির হয়ে বসতে পারে না, ছুটে বেরিয়ে যায় সে। নিজের ঘরে গিয়ে বনহুরের ছোটবেলার ফটোখানা খুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে–ওগো তুমি মুক্ত হয়েছ। জানি কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না। কেউ না…

চৌধুরী সাহেব নিজেই সমস্তটা পড়ে নিয়ে স্ত্রীকে মানে করে বুঝিয়ে বলেন। পুত্র-কন্যা যত দোষে দোষীই হউক না কেন, পিতা-মাতার নিকটে তারা স্নেহের পাত্র। কোন পিতামাতাই পুত্র কন্যার অমঙ্গল কামনা করতে পারে না। মনির আজ দস্যু জেনেও চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম তাকে ঘৃণা করতে পারে না। কারাগার থেকে পালিয়েছে জেনে মনে মনে খুশি হলেন তারা। কিন্তু একেবারে আনন্দ লাভ করতে পারলেন না। কারণ, কারাগার থেকে মনির পালিয়েছে সত্য কিন্তু সে নিরাপদ নয়। অহরহ তাকে পুলিশ বাহিনী খুঁজে ফিরছে। পুলিশ সুপার ঘোষণা করে দিয়েছে, যে দস্যু বনহুরকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় এনে দিতে পারবে তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তাছাড়াও তাকে একটা বীরত্বপূর্ণ উপাধিতে ভূষিত করা হবে।

মরিয়ম বেগম বার বার খোদার নিকট বনহুরের মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। চোর হউক, ডাকু হউক সে সন্তান। হে খোদা তুমি আমার মনিকে রক্ষা কর। মরিয়ম বেগমের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে ওঠেন—যে সন্তান মানুষ নামে কলঙ্ক, তার জন্য ভেবে কি হবে বল। মনে কর মনির বেঁচে নেই।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন মরিয়ম বেগম-বাপ হয়ে তুমি এ কথা বলতে পারলে?

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে বলেন চৌধুরী সাহেব—সবই আমাদের অদৃষ্ট, নইলে অমন ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে। পেয়েও আমরা সে রত্নকে পাইনি।

মরিয়ম বেগম বলেন—সত্যি আমার মনিরের মত কই কাউকে তো দেখিনি। ওগো আমি কেন এ শোক বইবার জন্য বেঁচে রইলাম। আমার হৃদয় যে চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছে। একটিবার ওকে দেখার জন্য মন যে আমার আকুলি বিকুলি করছে।

চৌধুরী সাহেব উঠে পায়চারী শুরু করলেন, হয়তো তার চোখ দুটি ও ঝাপসা হয়ে আসছিল।

গোটা দিনটা মনিরার উদগ্রীবভাবে কাটলো। কতবার আনন্দে অধীর। হয়েছে সে, কতবার চোখের পানিতে বুক ভাসলো। তার মনির আজ মুক্ত। তাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না নিশ্চয়ই সে আসবে। মন বলছে সে আসবে।

কিন্তু সন্ধ্যা গিয়ে রাত এলো। ক্রমে রাত বেড়ে চললো। কই সে তো এলো না। তবে কি মনির আসবে না। হয়তো সে অভিমান করেছে, পিতার ওপর রাগ করেই সে আর এ বাড়িতে আসবে না।

দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মনিরা।

এমন সময় তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর। চারদিক ঘন অন্ধকার। বনহুর সম্মুখস্থ জলের পাইপ বেয়ে দ্রুত উপরের দিকে এগিয়ে চললো।

শরীরে কালো ড্রেস, মুখে কালো রুমাল বাঁধা, মাথায় কালো পাগড়ী, পেছনে মুক্ত জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেতে লাফিয়ে ছিল সে।

চমকে মুখ তুলে মনিরা। বনহুরকে সে কোনদিন দস্যুর ড্রেসে দেখেনি। বিস্ময়ভরা গলায় বলে ওঠে-কে তুমি?

বনহুর এগিয়ে এসে নিজের মুখের বাধা পাগড়ী পরে আচল খুলে সঙ্গে সঙ্গে মনিরা আনন্দধ্বনি করে ওঠে-মনির!

উহু মনির নই, দস্যু বনহুর।

না, আমার কাছে তুমি দস্যু নও। তুমি আমার মনির..মনিরা ছুটে গিয়ে বনহুরের কণ্ঠবেষ্টন করে ধরে।

বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে, আবেগভরা গলায় ডাকে–মনিরা।

মনিরা বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে–মনির তুমি আমার।

কিন্তু আমি যে দস্যু?

না, আমি সে কথা মানব না। তুমি যে আমার সব।

বনহুর মনিরাসহ খাটে গিয়ে বসে। পাশাপাশি বসলো ওরা দুজনে। মনিরার হাতের মুঠায় বনহুরের একখানা হাত। ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরা তার মুখের দিকে। কালো ড্রেসে অপূর্ব সুন্দর লাগছে বনহুরকে। মনিরা তন্ময় হয়ে দেখছে। সে দেখার যেন শেষ নেই।

মনিরার বিস্ময়ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে বনহুর। তারপর মনিরার চিবুক ধরে উঁচু করে বলে—মনিরা, তুমি কেন আমায় মায়ার বন্ধনে বেঁধে ফেলছ বল তো?

মনিরার গণ্ড বেরিয়ে পড়ে ফোটা ফোটা অশ্রু। স্থির কণ্ঠে বলে সে দস্যু বনহুরকে যদি মায়ার বন্ধনে বাঁধতে পারি, তবে সে হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব।

বনহুর ওকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নেয়, তারপর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে–মনিরা।

মনিরা নিজেকে বিলিয়ে দেয় বনহুরের বাহুবন্ধনে।

বানহুর শান্তকণ্ঠে বলে–মনিরা, তুমিই একদিন বলেছিলে দস্যু বনহুর মানুষ নয়, সে মানুষ নামে কলঙ্ক। সে কথা তুমি অস্বীকার করতে পার?

মনির, তুমিও সেদিন বলেছিলে মনে পড়ে—দস্যু বলে সে কি মানুষ নয়। তার মধ্যে কি মানুষের হৃদয় নেই।

মনিরা, আমি জানি দস্যু বলে সবাই আমাকে ঘৃণা করলেও তুমি আমাকে ঘৃণা করতে পারবে না।

তুমি জানো না, তোমার আব্বা-আম্মার মনেও আজ কি ব্যথা গুমরে। কেঁদে মরছে। তুমি যে তাদের নয়নের মণি ছিলে, তোমাকে হারিয়ে তাদের প্রাণে যে কত আঘাত লেগেছিল, তা তুমি জানো না। আজও তারা তোমার সে শিশুকালের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। আজও তারা ভুলতে পারেননি তোমাকে। মামীমা প্রায়ই তোমার কথা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করেন। মামুজানের প্রাণেও কম ব্যথা নেই। তারপর তোমাকে আবার অভাবনীয়ভাবে ফিরে পেয়ে তখনই নির্মমভাবে হারালেন। মনির, তাদের অবস্থা অবর্ণীয়।

বনহুরের চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। ব্যথাভরা সুরে বলে—সব জানি মনিরা, সব বুঝি। কিন্তু আমি যে তাঁদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছি। মনিরা আমি বড়ই হতভাগ্য, তাই অমন দেবতুল্য পিতা-মাতা পেয়েও পাইনি।

মনির, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না। তা হয় না মনিরা।’

তুমি আমার গা ছুঁয়ে শপথ করেছিলে আর দস্যুতা করবে না। এরি মধ্যে তুমি ভুলে গেলে সব?

না ভুলে যে কোন উপায় নেই, মনিরা। একটা উম্মত্ত নেশা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমি নিজের জন্য আর দস্যুতা করবো না। কিন্তু শয়তানের শাস্তি, কৃপণের ধন, অহংকারীর দর্প চূর্ণ আমি করবোই। মনিরা শপথ আমি রক্ষা করতে পারলাম না বলে তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

মনির।

না, আমি দস্যু বনহুর। আমি দস্যু—এক লাফে বনহুর মুক্ত জানালা . দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

স্তব্ধ মনিরা পাথরের মূর্তির মত থ’মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, তার কণ্ঠ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো-মনির।

মুরাদের পিতা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে মুরাদকে জেল থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। কিন্তু মুরাদ মুক্ত হয়ে আবার দুর্দান্ত শয়তান হয়ে উঠলো। মনিরাই হলো তার একমাত্র লক্ষ্য। মনিরাকে তার চাই।

তার দলবল যারা একদিন হোটেল থেকে পালিয়েছিল আবার তারা ফিরে এসে যোগ দিল মুরাদের সঙ্গে। এবার তারা অন্য একটি গোপন স্থানে আস্তানা তৈরি করলো। শয়তান নাথুরাম হলো এই দলের নেতা।

সেদিন নাথুরামের আস্তানায় গোপন এক আলোচনা সভা বসেছিল। মুরাদ একটা উচ্চ আসনে বসেছিল। দলপতি নাথুরাম দাঁড়িয়ে আছে তার সম্মুখে আর অন্যান্য অনুচর কেউ বা দাঁড়িয়ে কেউ বা বসে আছে।

গম্ভীর কণ্ঠে বলে মুরাদ—যত টাকা চাও তাই দেব তবু মনিরাকে আমার চাই।

নাথুরাম গোঁফে হাত বুলিয়ে বলে—হুজুর, নাথু থাকতে মনিরাকে পাবেন না, এটা কথা হলো না। আমি ওকে এনে দেবই।

মুরাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে শয়তানের হাসি-তুমিই পারবে নাথু, মনিরাকে তুমিই এনে দিতে পারবে।

হ্যাঁ হুজুর, আমার দলের কেউ কমজোর নয়, আপনাকে খুশি করতে

আমরা কেউ পিছ পা হবো না।

ধন্যবাদ নাথুরাম। মুরাদ কথাটা বলে নাথুর পিঠ চাপড়ে দেয়। নাথুরামের ভয়ঙ্কর মুখে ফুটে ওঠে এক পৈশাচিক হাসি। নাথুর চেহারা দেখলে মানুষ এমনিতেই ভয় পায়। বলিষ্ঠ চেহারা। আকারে বেঁটে, মাথায়। খাটো করে ছাঁটা চুল। চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মত ক্ষুদে কুতকতে। বড় বড় দাঁত বেরিয়ে আছে ঠোটের ওপরে। সেকি ভয়ঙ্কর চেহারা দলপতি নাথুরামের।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো নাথুরামের প্রধান অনুচর গহর আলী, নাথুরামকে লক্ষ্য করে সালাম করলো।

মুরাদ হেসে বলেন—এত দেরী হলো কেন গহর আলী।

বিরাট একটি ঝাঁকি দিয়ে হেসে উঠলো গহর আলী—সব খবর নিয়ে তবেই ফিরছি হুজুর। চৌধুরী সাহেবের বেটি মনিরা তার বান্ধবীদের নিয়ে আগামী পূর্ণিমার রাতে নৌকা বিহারে যাবে।

মুরাদের চোখ দুটো ধক করে জ্বলে ওঠে, একটা আনন্দ সূচক শব্দ করে ওঠে সে-ঐ রাতের জন্য প্রস্তত থেক নাথুরাম, ঐ দিন আমি মনিরাকে চাই।

নাথুরাম হাতের মধ্যে হাত রগড়ায়-হুজুর, অগ্রিম কিছু টাকা…।

হ্যাঁ, এই নাও-পকেট থেকে একতোড়া নোট বের করে ছুঁড়ে দেয় মুরাদ নাথুরামের হাতে—এতে পাঁচ হাজার আছে। মনিরাকে পেলে আরও দেব।

সালাম হুজুর, আপনার অনুগত চাকর আমরা। যা বলবেন তাই করবো।

বেশ, তাহলে আমার সব কথা স্মরণ রেখে কাজ করো। নাথুরাম, মনে রেখো সিংহের মুখের আহার কেড়ে নিচ্ছো তোমরা। দস্যু বনহুর ভালবাসে.. মনিরাকে।

নাথুরামের বিদঘুটে মুখে একটা কুৎসিত হাসি ফুটে উঠলো। বলেন সে–দস্যু বনহুর তো দূরের কথা, ওর বাবা এসেও নাথুরামকে হটাতে পারবে। নাথুরাম হাত দিয়ে দু’বাহুতে চপেটাঘাত করে।

সমস্ত দলবল হর্ষধ্বনি করে উঠলো–সর্দার নাথুরাম কি জয়। সর্দার নাথুরাম কি জয়।

মুরাদ এবং অন্য সকলে এবার একটা বিরাট গোলটেবিলের চারিদিকে গিয়ে বসে, তারপর চললো বোতলের পর বোতল।

মুরাদ জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠেনাথুরাম, তোমাদের নৌকা তো ঠিক আছে।

হ্যাঁ হুজুর, নৌকা ছিপনৌকা, বজরা সব ঠিক আছে। আমাদের নৌকাটাই যাতে ওরা ভাড়া করে সে চেষ্টা করবো। আপনি কিছু ভাববেন হুজুর।

মুরাদ নাথুরামের পিঠ চাপড়ে দেয়—বহুৎ খোশ খবর। নাথু সত্যি তুমি কাজের লোক। কথার ফাঁকে হেউ হেউ করে ঢেকুর তোলে মুরাদ। তারপর সে কিন্তু আমার নিকটে ওকে কখন পোঁছাচ্ছ তাই বল?

সে চিন্তা করবেন না হুজুর! আগে সে দিনটা আসুক। আপনার টাকা আর আমাদের মনিরা–কিছু ভাববেন না হুজুর, কিছু ভাববেন না!

কিন্তু কি করে তোমরা তাকে আমার নিকটে পৌঁছাবে একটু শুনাও না, আমার যে বডড শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।

নাথুরাম এপাশে ওপাশে একটু দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলে–আপনার বজরাখানা সে তিন মাইল দূরে যে বাকটা আছে সেখানে বাধা থাকবে।

আমরা মাঝি সেজে চৌধুরী কন্যা এবং তার বান্ধবীগণকে নিয়ে ঝিনাইদাঁতে নৌকা ভাসাবো। তারপর আমাদের ছিপ প্রস্তুত থাকবে, সে ছিপ নৌকার মনিরাকে নিয়ে একেবারে আপনার বজরায়…

চমৎকার বুদ্ধি এটেছো নাথুরাম একেবারে বিউটিফুল আইডিয়া——কিন্তু খুব সাবধানে, বুঝেছো?

হ্যাঁ হুজুর আর বলতে হবে না। চলো নাথুরাম।

চৌধুরী সাহেব বসে বসে একটা পত্রিকা পড়ছিল। এমন সময় বৃদ্ধ সরকার ফয়েজ সাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন। চৌধুরী সাহেব চশমার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন——নৌকা ঠিক করেছেন সরকার সাহেব?

জ্বি হ্যাঁ, নৌকা ঠিক করে তবেই বাড়ি ফিরছি। নৌকা বেশ বড়সড় আর সুন্দর। ভাড়াটা একটু বেশি নেবে।

তা নিক, নৌকাটা তবে বেশ মন মতই পেয়েছেন? দেখুন ঝড় উঠলে কোন ভয়ের কারণে নেই তো?

না, তবে সবই খোদার হাত।

এমন সময় মনিরা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে-মামু জানের শুধু ঝড়ের ভয়।

হ্যাঁ মা, ঝড় আমার জীবনে এক চরম আঘাত দিয়ে গেছে। আচ্ছা মা মনিরা, কত বেড়ানোর জায়গা থাকতে তোমাদের কিনা নৌকা ভ্রমণের সখ চাপলো? আমার কিন্তু মন চায় না নৌকায় কোথাও যাওয়া।

একবার ভয় পেয়েছেন তাই আপনার মনে এ দুর্বল মামুজান। তাছাড়া আমি তো একা যাচ্ছিনে। আমরা অনেকগুলো মেয়ে যাব।

কিন্তু খুব সাবধানে থেক মা। খোদা না করুক কোন বিপদে না পড়ো।

মনিরা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। মনে তার অফুরন্ত আনন্দ। সেদিন বনহুরের নিবিড় আলিঙ্গন তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সমস্ত সত্তা যেন বিলীন হয়ে গেছে বনহুরের আলিঙ্গনের মধ্যে। আজও সে নিভৃতে বসে সেদিনের সুখস্মৃতি স্মরণ করে গভীর আনন্দ উপলব্দি করে। সেদিনের সে মুহূর্ত মনিরা জীবনে ভুলবে না। এত কাছে কোনদিন ওকে পায়নি সে যেমন করে সেদিন মনিরা তাকে পেয়েছিল।

মনিরা বিছানায় শুয়ে ডিমলাইটটা জ্বেলে দিল। হঠাৎ তার পাশের টেবিলে একটা তীরফলক এসে গেঁথে গেল, তীরফলকের সঙ্গে এক টুকরা কাগজ বাধা রয়েছে।

মনিরা তীরফলকটা হাতে তুলে কাগজখানা খুলে নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সামনে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো। কাগজের টুকরায় লেখা রয়েছে, “মনিরা, আজ রাতে আসবো আমি-বনহুর।”

একদিন এই নাম শুনলে হৃৎকম্প শুরু হত মনিরার। মুখমণ্ডল বিবর্ণ। হয়ে উঠতো, আর আজ এই নাম কত মধুর কত আনন্দদায়ক খুশিতে আত্মহারা মনিরা কি করবে যেন ভেবে পায় না। বনহুরের ছোটবেলার ছবিখানা নিয়ে বার বার দেখতে লাগলো সে। ফুলের মত শুভ্র একটি মুখ, মনিরা ছবিটা গালে-ঠোটে ঘষতে লাগলো।

ক্রমে রাত বেড়ে আসে। মনিরা উদগ্রীব হৃদয়ে প্রতীক্ষা করে দস্যু বনহুরের। মুক্ত জানালার পাশে গিয়ে বার-বার তাকায় অন্ধকারে। একসময় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে মনিরা, এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ। মনিরা ফিরে তাকিয়ে আনন্দ ধ্বনি করে উঠে-মনির এসেছো? ছুটে গিয়ে বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে—এসেছে। আজি ক’দিন থেকে তোমার জন্য ব্যাকুল চোখে পথ চেয়ে আছি।

কেন? কেন তুমি আমার জন্য ব্যাকুলভাবে প্রতীক্ষা করো মনিরা?

কেন তোমার প্রতীক্ষা করি আজও তুমি জানো না?

নিষ্ঠুর!

তার চেয়েও বেশি। দস্যু কোনদিন দয়া-মায়া জানে না মনিরা।

না না, ও কথা বলো না মনির। তুমি যে আমার কাছে সবচেয়ে উদার মহৎ, স্নেহময়-বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদে মনিরা।

বনহুর বিছানায় গিয়ে বসে।

মনিরা ওর পাশে গিয়ে মাথার পাগড়ী খুলে নিয়ে পাশে টেবিলে রাখে, তারপর নিজেও বসে পড়ে পাশে।

বনহুর ওর চিবুক ধরে নাড়া দিয়ে বলে—মনিরা, তুমি না বলেছিলে দস্যু বনহুরের নামে হৃদকম্প হয় আমার। আর আজবনহুরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে মনিরা—আজ তোমার নাম স্মরণে হৃদয় আমার আনন্দে আপুত হয়ে ওঠে। সত্যি মনিরা, তোমার নামে এত মধু….

তাই নাকি?

হ্যাঁ আচ্ছা, মনির আজ তোমাকে একটা জিনিস দেব, বল নেবে?

তোমার দেয়া কোন জিনিসকেই যে আমি অবহেলা করতে পারি না মনিরা।

বনহুরের একখানা হাত তুলে নেয় মনিরা নিজের হাতে। তারপর নিজ আংগুল থেকে সে হীরার আংটি খুলে নিয়ে পরিয়ে দেয় বনহুরের আংগুলে।

বনহুর বলে উঠে—একি করছো মনিরা?

হেসে বলেন মনিরা—একদিন তুমি এই হীরার আংটি হরণ করতে এসেই আমার হৃদয় চুরি করে নিয়েছ। আজ সে আংটি গ্রহণ করে তোমার হৃদয় আমাকে দান কর।

উহুঁ, দস্যু বনহুর হৃদয় দান করতে জানে না সে জানে গ্রহণ করতে। আংটি তুমি খুলে নাও মনিরা।

না।

সেদিন যা নেই নি, আজ তা আমি নিতে পারবো না।

মনির, আমার দান তুমি গ্রহণ করতে পারবে না।

আমি অক্ষম মনিরা।

দস্যু বনহুর জীবনে কোনদিন……

বনহুরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে মনিরা—দয়ার দান গ্রহণ করে, এই ভো?

হ্যাঁ, সে কথা মিথ্যে নয়।

মনির-এ আমার দয়ার দান? প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা এসব কিছুই নেই এর মধ্যে? মনিরার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে। গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দুফোটা অশ্রু।

মনিরার চোখের পানি দস্যু বনহুরকে বিচলিত করে তোলে।

প্যান্টের পকেট থেকে রুমালখানা বের করে মনিরার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।

মনিরা ওর হাতের উপরে হাত রাখে। অপরিসীম এক আনন্দ তার মনে দোলা দিয়ে যায়। ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকায় মনিরা দস্যু বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর অশ্রুসিক্ত মুখখানা তুলে ধরে বলে-মনিরা, বেশ আমি এটা গ্রহণ করলাম।

বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠে-মনির।

বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে বলে—মনিরা।

মনিরা এবার বনহুরের আংটিসহ হাতখানা নিয়ে নাড়াচড়া করতে করতে বলে—মনির, সত্যি তুমি অপূর্ব।

উভয়ের নীরবে কেটে চলে কিছুক্ষণ। মনিরা বলে ওঠে একসময়–জানো মনির, পরশু বিকেলে আমরা ঝিনাইদা নদীতে নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছি? সঙ্গে থাকবে আমার কয়েকজন বান্ধবী। সত্যি মনির তুমি যদি আমাদের সংগে থাকতে, ইস কত আনন্দ পেতাম।

কিন্তু তোমার সখীরা কি খুশি হত? যদি জানতো দস্যু বনহুর তাদের নৌকায় রয়েছে।

তারা তোমার আসল রূপ জানে না, তাই তোমার নামে তাদের এত আতঙ্ক। সত্যি মনির, একবার তারা যদি তোমায়..

এমন সময় দরজায় মামীমার কণ্ঠ শুনা গেল–মনিরা দরজা খোল দরজা খোল। ঘরে কার সাথে কথা বলছিস?

মনিরা চাপাকণ্ঠে বলে ওঠে-মামীমা টের পেয়েছেন।

বনহুর ঠোটে আংগুল চাপা দিয়ে বলে—চুপ। তারপর উঠে দাঁড়ায় সে। মনিরার হাতের মুঠা থেকে বনহুরের হাতখানা খসে আসে মৃদুস্বরে বলে—চললাম।

তারপর অন্ধকার জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায় দস্যু বনহুর।

মনিরা জানালা বন্ধ করে দিয়ে সরে এসে দরজা খুলে দেয়।

মরিয়ম বেগম কক্ষে প্রবেশ করে ব্যস্তকণ্ঠে বলেন—মনি, এ ঘরে কার কথা শুনলাম?

মনিরা চোখ রগড়ে বললোকই আমি তো এই মাত্র দরজা খুলে দিলাম।

মরিয়ম বেগম বলেন-আমি যে স্পষ্ট শুনলাম, কেউ যেন কথা বলছে?

মনিরা হেসে বলে–তুমি স্বপ্ন দেখছো মামীমা। আমার ঘরে কে আবার কথা বলবে? দুশ্চিন্তায় তোমার মনের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। চলো মামীমা, শোবে চলো।

কি জানি আমি তো জেগেই ছিলাম। হয়তো মনের ভুল সত্যি মা, মনি আমাকে পাগল করে দিয়ে গেছে। কথাগুলো বলতে বলতে বেরিয়ে যান মরিয়ম বেগম।

মনিরা হাফ ছেড়ে বাঁচে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয় সে।