তাজের পদশব্দ চিনতো নূরী। ভোরের দিকে তন্দ্রা এসেছে, হঠাৎ অতি পরিচিত অশ্ব-পদশব্দ। নূরীর তন্দ্রা ছুটে গেল, দ্রুতপদে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।
বনহুর অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়াল, নূরী ছুটে এসে ওর হাত ধরলো–সত্যি হুর, আজ আমি তোমার জন্য খুব চিন্তিত ছিলাম। মেয়েটিকে রক্ষা করতে পেরেছ?
বনহুর চলতে চলতে জবাব দেয়—খোদার অশেষ কৃপায় পেরেছি।
তাহলে রহমান তোমাকে একেবারে সঠিক খবরই দিয়েছিল, কি বল?
হ্যাঁ নূরী, খবরটা ঠিক সময়ে পেয়েছিলাম বলেই মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারলাম। কিন্তু নূরী, ঐ শয়তান অত্যন্ত বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।
হেসে বলে নূরী—তোমার কাছে শয়তানি কতক্ষণ টিকবে? দাও না যমালয়ে বিদায় করে।
হ্যাঁ নূরী, অচিরেই ওর সঙ্গে আমার একটা বুঝা-পড়া হবে। নাথুরামকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব।
নাথুরাম যে একজন দুর্দান্ত শয়তান জানে নূরী। মনে মনে শিউরে ওঠে সে। অজানা এক আশঙ্কায় দুলে ওঠে তার হৃদয়।
উড়য়ে নীরবে এতে থাকে।
বনহুর বিশ্রামাগারে প্রবেশ করে। নূরী ওর দেহ থেকে দস্যুর কালো ড্রেস খুলে নেয়। শয্যায় গিয়ে বসে বনহুর। হঠাৎ নূরীর দৃষ্টি চলে যায় বনহুরের ললাটে। কপালের একপাশে কিছুটা অংশ কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আঁতকে ওঠে নূরী, একি হুর, তোমার ললাট কেটে গেছে। ইস… নূরী যত্নসহকারে হাত দিয়ে দেখতে লাগলো।
বনহুর হেসে বলেন—ও এমন কিছু নয় নূরী। সেরে যাবে।
নূরী রাগত কণ্ঠে বলেন—তোমার ও কিছু নয়। ইস কতটা কেটে গেছে। তাড়াতাড়ি ঔষধ এনে লাগিয়ে দেয় বনহুরের ললাটে তারপর অতি যত্নে বেধে দিতে থাকে কাপড় দিয়ে।
বনহুর নূরীর চিবুক ধরে উঁচু করে বলেনূরী, আমার জন্য তোমার কত দরদ। কিন্তু আমি তো তোমার জন্য এতটুকু ভাববার সময় পাইনে।
এজন্য আমি দুঃখিত নই, হুর। আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালবাস!
বনহুর নূরীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে বলে, এ বিশ্বাস যেন তোমার চিরদিন অটুট থাকে।
নূরী ধীরে ধীরে বনহুরের চুলের ফাঁকে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে–হুর, মনে পড়ে সে ছোটবেলার কথা, তুমি আর আমি যখন এক সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়াতুম তুমি তীর ধনু দিয়ে পাখি শিকার করতে, আর আমি ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে আনতাম। তুমি খুশি হয়ে বলতে নূরী, কোনদিন তোকে ছাড়া কাউকে ভালবাসব না। মনে পড়ে সে কথা।
বনহুরের চোখের সামনে ছোটবেলার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠে একের পর এক ছায়াছবির মত।
একদিনের দৃশ্য আজও বনহুরের মনে স্পষ্ট আঁকা আছে।
বনহুর আর নূরী ঝরনার পানিতে সাতার কাটছিল, হঠাৎ বেশি পানিতে পড়ে যায় নূরী। স্রোতের টানে বেসে যায় সে অনেকটা দূরে। বনহুর ভুলে যায় গোটা দুনিয়া, নূরী যে তার যথাসর্বস্ব নূরীকে হারালে তার চলবে না। নূরী ছাড়া বাঁচবে না বনহুর। নিজের জীবনের মায়া বিসর্জন দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল বনহুর স্রোতের বুকে। অনেক কষ্টে নূরীকে সেদিন বাঁচাতে পেরেছিল সে। নূরীকে সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পেরে তার সেদিন কি আনন্দ! সব কথা আজ মনে পড়তে লাগলো বনহুরের।
বনহুর নূরীর হাতখানা তার নিজের মুঠোয় চেপে ধরে বলে নূরী।
নুরী বনহুরের চুলে হাত বুলাচ্ছিল, জবাব দেয়বল। সত্যি তুমি কত সুন্দর!
হুর! অস্কুট ধ্বনি করে ওঠে নূরী।
নূরী। আবেগভরা কষ্ঠ বনহুরের।
সেদিন নৌকা ভ্রমণে মনিরার উপর হামলার কথাটা পুলিশ মহলে সাড়া জাগিয়েছিল, তাদের একমাত্র সন্দেহ এ কাজ দস্যু বনহুরের ছাড়া আর কারও নয়। কারণ বনহুর যে মনিরাকে ভালবাসে, এ কথা সবাই জেনে নিয়েছে। পুলিশ ইনসপেকটার মিঃ হারুন এবং মিঃ রাও বসে এ বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলেন শঙ্কর রাও বলে উঠেন–ইন্সপেকটার, আপনার কি মনে হয় দস্যু বনহুরই মনিরার ওপর হামলা করেছিল?
হ্যাঁ, সে ছাড়া অন্য কেউ নয়। কারণ, মনিরাকে দস্যু বনহুর ভালবাসে, এ কথা একেবারে সত্য। পূর্বেও এ বিষয়ে অনেক প্রমাণ আমরা পেয়েছি।
শঙ্কর রাও বলে ওঠেন—তাহলে দস্যু বনহুরই তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল?
হ্যাঁ এবং সুস্থ অবস্থায় নিরাপদে তাকে পিতামাতার নিকটে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।
পিতা-মাতা নয়, মামা-মামী।
সরি, হ্যাঁ মামা-মামীর পাশে ফিরে এসেছে মনিরা এবং দস্যু বনহুর ছাড়া অন্য কোন বদমাইশ তাকে এভাবে সসম্মানে ফেরত পাঠাত না নিশ্চয়ই। এতেই বুঝা যায় এ দস্যু বনহুরের কাজ।
এ সম্বন্ধে কি মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করেছিল?
করেছিলাম, কিন্তু সন্তোষজনক কিছু জানতে পারিনি।
রাও গম্ভীর কণ্ঠে বলেন-ইনসপেকটার, সত্যিই যদি দস্যু বনহুর মনিরাকে ভালবেসে থাকে তবে তাকে গ্রেফতারের একটা সুযোগ করে নিতে পিরবো।
সেবার তাকে গ্রেফতারের সময় সো আমরা বিশেষভাবে জেনে নিয়েছি মিঃ রাও। আপনি সে পথ ধরেই এগুতে চেষ্টা করুন।
ঠিকই বলেছেন ইন্সপেকটার সাহেব, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে হলে ঐভাবেই এগুতে হবে এবং আমি আশা করি কৃতকার্য হবো।
থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ রাও, আপনি এবার সফল হবেন বলে আমার মনে হচ্ছে।
শঙ্কর রাও এবার কিছুক্ষণ গালে হাত রেখে ভাবলেন। তারপর বলেন ইন্সপেকটার, একটা প্রশ্ন আমার মনকে নাড়া দিচ্ছে।
বলুন?
মনিরাও দস্যু বনহুরকে ভালবাসে, এ কথা আপনি জানেন?
আপনি কি বলতে চান দস্যু বনহুরের কোনই প্রয়োজন ছিল না মনিরাকে হানা দিয়ে চুরি করা, কারণ মনিরা স্বেচ্ছায় তার পাশে যেত।
সে কথা মিথ্যে নয়, ইন্সপেকটার সাহেব।
না, আপনি এবং আমি যা মনে করছি তা নাও হতে পারে। এক সময় হয়ত মনিরা তাকে ভালবাসতো, কিন্তু যখন তার আসল রূপ ধরা পড়েছে, যখন মনিরা জানতে পারল যাকে সে ভালবাসে সে স্বাভাবিক মানুষ নয়, সে দস্যু; তখন হয়তো তার মন ভেঙ্গে গিয়ে থাকতে পারে। ঘৃণা হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
শঙ্কর রাও বলেন—তাহলে একটা কাজ করুন মিঃ হারুন, এতে আমার কিছুটা উপকার হবে, মানে কাজের সহায়তা হবে।
বলুন?
মিস মনিরাসহ তার মামা চৌধুরী সাহেবকে একবার এখানে আসতে বলুন। আমি তাদের মুখে এ ব্যাপারে কয়েকটা কথা শুনতে চাই।
বেশ, আমি এক্ষুণি ফোন করছি।
ধন্যবাদ।
মিঃ হারুন উঠে গিয়ে রিসিভারটা হাতে উঠিয়ে নিলেন—
হ্যালো?
ওপাশ থেকে ভেসে এলো চৌধুরী সাহেবের কণ্ঠকে কথা বলছেন?
স্পিকিং মিঃ হারুন। হ্যাঁ, আমি পুলিশ অফিস থেকে বলছি। শুনুন মিঃ চৌধুরী, আপনি আপনার ভাগনী মিস মনিরাসহ দয়া করে যদি একটিবার আসেন! হা পুলিশ অফিসে…।
চৌধুরী সাহেব বলেন নিশ্চয়ই আমি আসছি ইন্সপেক্টর। আপনি দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন। আমি মা মনিরার কাছে জেনে নেই সে এখন আমার সঙ্গে আপনার ওখানে যেতে পারবে কিনা। কারণ, ওর এক বান্ধবীর ওখানে যাবার কথা আছে। রিসিভারের মুখে হাত রেখে ডাকেন চৌধুরী সাহেব-মনিরা, মা মনিরা, একটিবার এদিকে শুনো তো?
পাশের কক্ষ থেকে ভেসে আসে মনিরার কণ্ঠ—আসছি মামুজান।
অল্পক্ষণেই মনিরা এসে হাজির হয়-মামুজান আমায় ডাকছো?
হ্যাঁ মা, ইন্সপেক্টর মিঃ হারুন বলছেন এক্ষুণি তোমাকে সঙ্গে করে যেতে। তারা পুলিশ অফিসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ঠিক সে মুহূর্তে একটি দাড়িওয়ালা লোক কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, চৌধুরী সাহেবের কথাগুলো কান পেতে শুনলো সে।
মনিরা মামুর কথায় জবাব দেয়—বেশ ভালই হলো, সেখান থেকে ফেরার পথে মাধুরীর বাড়ি হয়ে আসবো।
যাও মা, চট করে তৈরি হয়ে নাও তবে।
মনিরা বেরিয়ে যায়।
চৌধুরী সাহেব রিসিভারে মুখ রাখেন-হ্যালো, হ্যাঁ মনিরা যাবে। নিশ্চয় আসছি। থ্যাঙ্ক ইউ।
দাড়িওয়ালা লোকটি কক্ষে প্রবেশ না করে পিছু হটে বেরিয়ে গেল।
মনিরা চলে গেল নিজের কক্ষে।
অল্পক্ষণেই তৈরি হয়ে মনিরা মামুজানের পাশে এসে দাঁড়ায়। চৌধুরী সাহেব মনিরাকে লক্ষ্য করে বলেন—মা মনিরা, তোমার হয়ে গেছে। দেখছি।
হ্যাঁ মামুজান, চলো।
গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন চৌধুরী সাহেব এবং মনিরা ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে ধরে।
চৌধুরী সাহেব আর মনিরা গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভার ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দেয়।
পুলিশ অফিসে পৌঁছতেই মিঃ হারুন নিজে এসে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নামিয়ে নিলেন।
মিঃ হারুন হাত বাড়ালেন—হ্যালো চৌধুরী সাহেব, বিশেষ কয়েকটি কথার জন্য আপনাকে ডেকেছি। আসুন মিস্ মনিরা।
ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে ধরলল, চৌধুরী সাহেব আর মনিরা নেমে
অফিস রুমে প্রবেশ করলো।
অফিসরুমে প্রবেশ করতেই শঙ্কর রাও উঠে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
পাশাপাশি কয়েকখানা চেয়ারে বসলেন তাঁরা।
মিঃ হারুন মনিরাকে জিজ্ঞেস করলেন মিস মনিরা, আপনাকে একটু কষ্ট দেব। কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই?
বেশ করুন, এতে আমার কষ্ট কি! হেসে বলেন মনিরা।
মিঃ হারুন মনিরার দিকে একটু ঝুকে বসলেন, তারপর বলেন—মিস মনিরা, আপনাকে যে প্রশ্ন করা হবে আশা করি তার সঠিক জবাব পাব। আচ্ছা বলুন তো যেদিন আপনি আপনার বান্ধবীগণসহ নৌকা-ভ্রমণে যান, সেদিন মাঝিদের মধ্যে কোন সন্দেহজনক ভাব লক্ষ্য করেছিলেন কি?
না। কাউকে সন্দেহ হয় নি বা সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করিনি।
হ্যাঁ। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় যারা আপনার ওপর হামলা করেছিল তারা দস্যু বনহুরের দল?
মনিরা বলে ওঠে—এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি, দস্যু বনহুর আমার ওপর হামলা করেনি।
শঙ্কর রাও বলে ওঠেন–আমি প্রথমেই অনুমান করেছিলাম, এ কাজ দস্যু বনহুরের নয়। নিশ্চয়ই এ অন্য একটি দল।
মিঃ হারুন গভীরভাবে কিছু চিন্তা করেন, তারপর বলেন—আচ্ছা মিস মনিরা আপনাকে যে মাঝি দস্যুদল থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিল, তাকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন কি?
না, তাকে আমি কোনদিন দেখিনি। কিন্তু সে ব্যক্তি অত্যন্ত মহৎ এবং তার দয়াতেই আমি দস্যুর হাত থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছি। মনিরা বনহুরের নাম গোপন করে বলল।
মিস মনিরা, সে লোকটি যদি সত্যই মহৎঞ্জন হবে, তাহলে সে কখনও দস্যুদলে যোগ দিত না।
চৌধুরী সাহেব বলেন—অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে অভাবের তাড়নায় মানুষ অনেক জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়।
হ্যাঁ, সে কথা অবশ্য মিথ্যা নয়। বলেন মিঃ রাও।
আরও কিছুক্ষণ মনিরাকে নানা প্রশ্ন করওে সন্তোষজনক কিছু জানতে পারেন না তারা।
মিঃ হারুন এবার চৌধুরী সাহেবকে বলেন—চৌধুরী সাহেব, আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, দস্যু বনহুর আপনার পুত্র জেনেও আমরা তাকে রেহাই দিতে পারছিনে।
চৌধুরী সাহেবের মনে যত ব্যথাই থাক গোপনে চেপে বলেন তিনি সে দোষী, কাজেই আইনের চোখে সে অপরাধী। আমার পুত্র হলেও সে ক্ষমার পাত্র নয়।
থ্যাঙ্ক ইউ চৌধুরী সাহেব, এটাই হচ্ছে সত্য কথা। অপরাধী যতই মেহের পাত্র হউক, তাকে ক্ষমা করা চলে না। বলেন শঙ্কর রাও।
মিঃ হারুন বলেন, এবার আসল কথা বলি চৌধুরী সাহেব।
বলুন?
দস্যু বনহু হাঙ্গেরী কারাগার হতে পালিয়েছে এ কথা আপনি নিশ্চয়ই জানেন?
হ্যাঁ জানি।
যদিও আপনি তার পিতা, তবু আপনার কর্তব্য তাকে ধরিয়ে দেওয়া।
একটা ঢোক গিলে বলেন চৌধুরী সাহেব-হ্যাঁ।
এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনার সাহায্য পাব।
চৌধুরী সাহেব একটু থেমে বলেন–হ্যাঁ পাবেন।
এমন সময় ড্রাইভার একখানা কাগজ এনে মনিরার হাতে দেয়আপামণি আপনার যে কোন বান্ধবীর বাড়ি যাবার কথা ছিল সে এই চিঠিখানা পাঠিয়ে দিয়েছে।
মনিরা কাগজখানা হাতে নিয়ে ভাজ খুলে মেলে ধরলো চোখের সামনে। মুহূর্তে মনিরার চোখ দুটো উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে ওঠে। কাগজে লেখা আছে–“মনিরা, আমি তোমার জন্য লেকের ধারে অপেক্ষা করছি”–বনহুর।
মনিরা কাগজখানা ভাজ করে বলে ওঠে-মামুজান, আমার বান্ধবী এক্ষুণি আমাকে যেতে বলেছে, না গেলেই নয়। উঠে দাঁড়ায় মনিরা।
চৌধুরী সাহেবও বলে ওঠেন—আমিও তাহলে চলি ইন্সপেকটার সাহেব।
মিঃ হারুন বলেন—আপনার সঙ্গে আরও কিছু আলাপ আছে চৌধুরী সাহেব। মিস মনিরা, আপনি যেতে পারেন। আপনার মামুজানকে আমাদের অফিসের গাড়ি পৌঁছে দেবে।
চৌধুরী সাহেব ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলেন-ড্রাইভার, মনিরাকে সাবধানে নিয়ে যেও এবং হুশিয়ার থেক।
ড্রাইভার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেন—বহুৎ আচ্ছা হুজুর।
মনিরা প্রফুল্ল চিত্তে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে ধরে।
মনিরা উঠে বসে বলে–লেকের ধারে চল।
বহুৎ আচ্ছা আপামণি। কথাটা বলে গাড়িতে স্টার্ট দেয় ড্রাইভার। গাড়ি উকাবেগে ছুটতে শুরু করে।
একি! গাড়ি যে লেকের পথে না গিয়ে অন্য পথে মোড় ফিরল। মনিরা শিউরে উঠলো, তীব্রকণ্ঠে বলেন—ড্রাইভার, কোথায় যাচ্ছ।
ড্রাইভার আসন থেকে বলে ওঠে—আপামণি, ও পথ বহুৎ খারাপ আছে। ইধার বাঁকা পথে যেতে হবে।
মনিরা চুপ করে রইলো, ড্রাইভার তাদের নতুন লোক নয়, তাকে অবিশ্বাসের কিছু নেই। কারণ সে জন্মাবধি এই শিখ ড্রাইভারকে দেখে আসছে। ওর কোলে কাঁধেই মানুষ হয়েছে মনিরা।
কিন্তু একি! লেকের ধারে না গিয়ে একেবারে নির্জন নদীতীরে এসে গাড়ি থেমে ছিল। ড্রাইভার আসন থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো-আসুন আপামণি!
মনিরা রাগে গজ গজ করে বলে-ড্রাইভার, এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে? এটাই বুঝি লেকের ধার?
হঠাৎ ড্রাইভার হেসে ওঠে–হাঃ হাঃ হাঃ মনিরা এখনও তুমি আমাকে চিনতে পারনি?
কে! কে তুমি?
নেমে এসো বলছি।
না, আমি কিছুতেই নামবো না। নিশ্চয়ই তুমি সে শয়তান, নৌকায় তুমি আমাকে চুরি করে…
হ্যাঁ আমিই সে, যাকে তুমি-ড্রাইভার মনিরার হাত ধরে ফেলে।
মনিরা তীব্রকণ্ঠে বলে—যাকে আমি ঘৃণা করি। শয়তান! এখনও তুমি আমার পিছু লেগে রয়েছ?
হ্যাঁ, কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি। নেমে এসো। যদি তোমার মঙ্গল চাও তবে নেমে এসো।
নির্জন নদী তীর একটি প্রাণী ও নেই আশেপাশে। মনিরার প্রাণ কেঁপে ওঠে। বার বার কত বার বনহুর তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে, এবার আর তার রক্ষা নেই। তবু দৃঢ় কঠিন কণ্ঠে বলে সে—শয়তান আমি গাড়ি থেকে নামবো না।
ড্রাইভার মনিরার হাত চেপে ধরে–তোমাকে নামতে হবে। বলেই মনিরার হাত ধরে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলে।
মনিরার চোখেমুখে অসহায়ের চাহনি। আজ আর তার রক্ষা নেই। কেন সে ঐ চিঠিখানা বিশ্বাস করলো? কেন সে ড্রাইভারকে বিশ্বাস করলো? কেন তার সঙ্গে একা এলো?
ড্রাইভারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো সে। কিন্তু ড্রাইভারের বলিষ্ঠ হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতখানা মুক্ত করে নিতে পারলো না।
ড্রাইভার মনিরাকে নিবিড়ভাবে টেনে নিল কাছে।
মনিরা সে মুহূর্তে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিল ড্রাইভারের গালে। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের গাল থেকে তার নকল দাড়ি আর গোঁফ খসে ছিল। মনিরা বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো—মনির তুমি!
ড্রাইভারের ছদ্মবেশী দস্যু বনহুর হেসে বলেন—হ্যাঁ আমি। এই বুঝি তোমার সাবধানে চলাফেরা, না?
মনির, আমি ভাবতেও পারিনি শিখ ড্রাইভারের বেশে তুমি! সত্যি তোমার চিঠি পেয়ে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম।
কিন্তু যেখানেই যাও, সাবধানে যেও! আমার নামে অন্য কোন দুষ্ট লোকও তো চিঠি লিখতে পারতো।
সত্যি আমি বড় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বুকটা এখনও টিপ টিপ করছে।
এখন?
সব ভয় আমার দূর হয়ে গেছে।
চলো নদীর ধারে গিয়ে বসি। বনহুর কথাটা বলে এগুতে থাকে। মনিরা চলে তার পাশে পাশে।
নদীর কিনারে গিয়ে বসে ওরা।
মনিরা বনহুরের হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে বলে—আজ কতদিন আসনি কেন বল তো?
কত কাজ আমার।
মনির, এখনও তুমি মানুষ হলে না। পুলিশমহলে তোমাকে গ্রেপ্তার করতে সাড়া পরে গেছে, তোমাকে জীবিত কি বা মৃত এনে দিতে পারলে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
জানি মনিরা, সব জানি। কিন্তু আমি তো সব সময় সকলের সামনেই বিচরণ করে বেড়াচ্ছি, ওরা কেন আমাকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় না?
মনির, ও কথা বল না। খোদা তোমাকে রক্ষা করুন। মনির, হাঙ্গেরী কারাগার তোমাকে আটকে রাখতে পরেনি, আর কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবেও না।
মনিরা!
সত্যি তুমি কত বড়! কত সুন্দর কত মহৎ….
অবশ্য তোমার কাছে। আচ্ছা মনিরা, তোমার যে বান্ধবীর বাড়ি যাবার কথা ছিল?
হ্যাঁ, মাধুরীর ওখানে, কিন্তু যাব না।
মাধুরী!
হ্যাঁ, মাধুরী, আমার এক পুরানো বান্ধবী। বড় অসহায় বেচারী…
কেন, কি হয়েছে তার? প্রশ্ন করে বনহুর।
সে এক অদ্ভুত ঘটনা। থাক, তোমার শুনে কাজ নেই।
মনিরা বলতে হবে, তোমার বান্ধবী যখন সে, তখন আমার বান্ধবী নিশ্চয়ই।
তবে শুন।
বল।
মাধুরীর বিয়ে হয়েছে কিন্তু ওর স্বামীকে সে একদিনের জন্যও পায়নি।
তার মানে?
বলছি শুন—তারপর মাধুরীর মুখে শুনা গল্পটা মনিরা সম্পূর্ণ খুলে বলে বনহুরের নিকটে।
স্তব্ধ নিঃশ্বাসে শুনে যায় বনহুর। মনের মধ্যে তখন তার প্রচণ্ড ঝড় বেয়ে চলেছে। মাধুরী, যার সঙ্গে তার একটি রাতের পরিচয়।
মনিরা বলে চলেছে—সত্যি মনি, মাধুরীর জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে…
বনহুরের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠেছে মাধুরীর ব্যথাভরা করুণ মুখখানা।
বনহুরকে চিন্তিত দেখে বলে মনিরা-কি ভাবছো মনির হঠাৎ তোমার কি হলো বলতো?
বনহুর গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় জবাব দেয়-উঁ।
কি ভাবছো?
ভাবছি তোমার সে বান্ধবীর কথা।
হ্যাঁ, ওর জন্য সত্যি বড় দুঃখ হয়। জান মনির, মাধুরী বলেছে, যে লোকটি ওর স্বামীর পরিচয় দিয়ে ওর কক্ষে রাত যাপন করে গেছে সে নাকি দেবতার চেয়েও মহৎ!
তাই নাকি?
হ্যাঁ দেখতেও সে নাকি অপূর্ব, মাধুরী বলে জীবনে সে ওকে ভুলতে পারবে না কোনদিন। যতক্ষণ সে তার কথা বলেছিল কেমন যেন অভিভূতের মত বলে চলেছিল—সে সত্যি। মাধুরী ওকে ভালবেসে ফেলেছে…
বনহুর বলে ওঠে-থাক মনিরা ও সব কথা, এবার চলল ফেরা যাক, কেমন?
কিন্তু আমার যে ফিরতে ইচ্ছে করছে না মনির!
হেসে বলে বনহুরবসলে ক্ষতি ছিল না মনিরা কিন্তু তোমাদের মোটর গ্যারেজের মধ্যে তোমাদের শিখ ড্রাইভার বেচারা ধুকে মরছে। মনিরা গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে—ওমা তাই নাকি! হ্যাঁ তার হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখে এসেছি।
সর্বনাশ!
তা নাহলে এই দিনের আলোয় তোমাকে পেতাম কি করে?
মনিরা উঠে দাঁড়িয়ে বলে—এত বুদ্ধি তোমার! চললা তবে।
চলো।
বনহুর আর মনিরা গাড়ির দিকে এগোয়।
মাধুরীর স্বামী নিমাই বাবুর কক্ষ।
নিজের ঘরে শুয়ে একটা বই পড়ছিল সে, রাত একটা দেড়টা হবে। নিমাইয়ের মনে নানা দুশ্চিন্তার ঝড় বইছে। চোখে ঘুম নেই, তাই একটা বই নিয়ে তাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিল।
বাইরে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়াও বইছে। গোটা বিশ্ব অন্ধকার। আজ নিমাইয়ের মনে মাধুরীর কথাই জাগছিল। এমন দিনে স্ত্রীকে কাছে পেতে কার না মন চায়। কিন্তু নিমাই ওকে গ্রহণ করতে পারে না। একটা সন্দেহের দোলা তার সমস্ত অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বই রেখে আলোটা কমিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিমাই, জানালাটা বন্ধ করে শোবে, ঠিক সে মুহূর্তে জানালা দিয়ে লাফিয়ে ছিল একটি কালো মূর্তি। হাতে তার উদ্যত রিভলভার নিমাই যেমনি চিৎকার করতে যাবে, অমনি কালো মূর্তি রিভলভার চেপে ধরলো ওর বুকে—খবরদার!
নিমাই ঢোক গিলে বলে—কে তুমি!
ছায়ামূর্তি চাপাকণ্ঠে গর্জে ওঠে-দস্যু বনহুর!
ভয়ার্তকষ্ঠে অস্ফুট শব্দ করলো নিমাই দস্যু বনহুর?
হ্যাঁ।
তুমি–তুমিই আমার স্ত্রীর কক্ষে….
হ্যাঁ আমিই, কিন্তু নিমাই বাবু আপনার স্ত্রী মাধুরীর কি অপরাধ?
নিমাই ভয়কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে—তুমিই তো তার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছ শয়তান!
বনহুর দৃঢ়মুষ্টিতে চেপে ধরলো নিমাইয়ের গলা—শয়তান আমি নই তুমি, মিথ্যা সন্দেহে নিজের স্ত্রীকে যে ত্যাগ করতে পারে, সে শয়তানের বড়। শয়তান!
নিমাই যন্ত্রণায় আর্তকণ্ঠে বলে ওঠে—–উঃ ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমার গলা! নিমাইয়ের চোখ দুটো বেরিয়ে আসে। মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে।
বনহুর বলে—আগে বল তোমার স্ত্রীকে আর অবিশ্বাস করবে না? গলা ছেড়ে দেয় বনহুর।
নিমাই গলায় হাতবুলিয়ে বলে—কেমন করে তাকে আমি বিশ্বাস করবো?
দস্যু বনহুর কোনদিন মিথ্যা বলে না। তোমার স্ত্রী অতি পবিত্র, নির্মল। তাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার।
নিমাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বনহুরের রুমাল বাধা মুখের দিকে।
বনহুর নিজের মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেলে।
নিমাই কল্পনাও করতে পারেনি দস্যু বনহুরের চেহারা এত সুন্দর হবে, মুহূর্তে ওর মন থেকে ভয়ভীতি দূর হয়ে যায়। বনহুরের স্বর্গীয় দ্বীপ্তিময় দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে আর অবিশ্বাস করতে পারে না। তাকিয়ে থাকে নির্বাক নয়নে।
হেসে বলে বনহুর—আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলে।
অস্ফুট কণ্ঠে বলেন নিমাই—হ্যাঁ।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তবে কালই তুমি মাধুরীর হাতে ধরে ক্ষমা চেয়ে ওকে নিয়ে এসো। যদি এর অন্যথা হয় তবে মনে রেখ-হাতের রিভলভারটা উদ্যত করে ধরে–এর একটা গুলি তোমাকে হজম করতে হবে।
ভয়ার্ত চোখে নিমাই একবার বনহুরের মুখে আর একবার তার হাতে রিভলভারটার দিকে তাকায়।
বনহুর তাকে ভাবার সময় না দিয়ে এক লাফে মুক্ত জানালা দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।