» » চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

সুভাষিনীকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় পড়লো চন্দ্রাদেবী। বাড়ির আর কেউ না জানুক চন্দ্রাদেবী জানে-সুভাষিনীর কি হয়েছে। আজ কতদিন হলো সুভাষিনী ধ্যানস্থার মত স্তব্ধ হয়ে গেছে।

সুভাষিনীর পিতা মনসাপুরের জমিদার বাবু কন্যার জন্য ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। মা জ্যোতির্ময়ী দেবীর অবস্থাও তাই। সমস্ত মনসাপুরে জমিদার কন্যার এই অদ্ভুত অসুস্থতার কথা ছড়িয়ে পড়লো। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লো। ডাক্তার বৈদ্য সুভাষিনীর কিছুই করতে পারলো না।

একদিন চন্দ্রাদেবী শাশুড়ির নিকটে গিয়ে বললো–মা, সুভার জন্য এতো চিন্তা ভাবনা করে কোন ফল হবে না। ওর অসুখ শরীরের নয়–মনের। কন্যার যদি মঙ্গল চান তবে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন।

জ্যোতির্ময়ী দেবী পুত্রবধুর কথাটা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেন–এ কথা মিথ্যে নয়। ডাক্তার বৈদ্য সবাই বলেছেন মেয়ের কোন রোগ নেই, অথচ দিন দিন সে এমন হয়ে যাচ্ছে কেন। এবার তিনি যেন অন্ধকারে আলোর সন্ধান পেলেন। হ্যাঁ, বিয়ে দিলে হয়তো ওর মনের অবস্থা ভালো হবে। স্বামীকে কথাটা তিনি জানালেন।

জমিদার বজ্ৰবিহারী রায় কথাটা ফেলতে পারলেন না। এতোদিন তিনি এ বিষয়ে চিন্তাই করেননি। পিতা মাতা মনে করতেন তাঁদের কন্যা এখনও বালিকা রয়েছে। অবশ্য এ ধারণার কারণ ছিল অনেক। একে একমাত্র কন্যা, তারপর সুভাষিনী ছিল খুব আদুরে এবং চঞ্চলা– পিতামাতার কাছে সে ছোট্ট বালিকার মতই আব্দার করত। যাক, এবার বজ্রবিহারী রায় সুপাত্রের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করলেন।

জমিদার কন্যা, উপরন্তু অপরূপ রূপবতী সুভাষিনীর জন্য সুপাত্রের অভাব হলো না। মাধবগঞ্জের জমিদার বিনোদ সেনের পুত্র মধু সেনের সঙ্গে সুভাষিনীর বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেল।

সেদিন দ্বিপ্রহরে চন্দ্রাদেবী নিজের ঘরে কোন কাজে ব্যস্ত ছিল, এমন সময় সুভাষিনী তার কক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল।

হেসে বললো চন্দ্রাদেবী–সুভা, ওকি হচ্ছে? আমাকে এভাবে ঘরে আটকাবার মানে কি?

সুভাষিনী গম্ভীর বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো–বৌদি, এসব তোমরা কি করছো?

তার মানে?

–ন্যাকামি কর না। আমি জানি, এসব তোমারই চক্রান্ত।

সুভা বস তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে। হাত ধরে সুভাষিনীকে পালঙ্কে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে চন্দ্রাদেবী তার পাশে। আচ্ছা সুভা, যাকে কোনদিন পাবিনে তার জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিবি?

এ প্রশ্ন কি তুমি আজ নতুন করছো বৌদি? তোমাকে আমি বলেছি, আমার গোটা অন্তর জুড়ে ঐ একটি মাত্র প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়ে রয়েছে যা কোনদিন মুছবার নয়।

সুভা, খামখেয়ালিপনার একটা সীমা আছে। বিয়ে তোকে করতেই হবে। তখন দেখবি সব ধীরে ধীরে ভুলে যাবি। তাছাড়া তুই যা তা ঘরের মেয়ে নস্–সামান্য একজন দস্যুকে ভালবাসা তোর শোভা পায় না।

বৌদি।

সুভা, বিয়ে তোকে করতেই হবে। বিনোদ সেনের পুত্র মধু সেনকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। চমৎকার চেহারা, স্বভাব চরিত্র ভালো…

চন্দ্রাদেবীর কথাগুলো সুভাষিণীর কানে পৌঁছাচ্ছিল না। সে নিশ্চুপ বসে রইল; দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা।

যতই বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগলো, ততই সুভাষিণী মরিয়া হয়ে উঠলো। বনহুরের মুখখানা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে লাগলো তার হৃদয়পটে। সুভাষিণী এ বিয়ে কিছুতেই করবে না–যেমন করে হোক, বিয়ে তাকে বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কি করে বন্ধ করবে সে।

বাড়ির সবাই একমত। একমাত্র বৌদি ছিল তার ভরসা সেও এখন তার বিপক্ষে। কি করে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

সুভাষিণী জানে যাকে নাকি ধ্যান করা যায়, একদিন না একদিন তার দর্শনলাভ ঘটে। সুভাষিণী কিছু চায় না, শুধু আর একটি দিন তার দেখা পাবে, এই আশায় বুক বেঁধে প্রতীক্ষা করছে সে। সুভাষিণী বলেছিল, আবার কবে আপনার দেখা পাব? জবাবে বলেছিল বনহুর ঈশ্বর

করুন আবার যদি এমনি কোন বিপদে পড়েন তখন ..মুহূর্তে সুভাষিণীর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠে। বিপদই তাকে বেছে নিতে হবে। পালাবে সুভাষিণী। যেদিকে তার দুচোখ যায় পালাবে সে। তাহলে এ বিয়ে থেকে ও পরিত্রাণ পাবে। …

সুভাষিণী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। দুর্ভেদ্য অন্ধকার গোটা পৃথিবীটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আকাশে মেঘ জমাট বেঁধে রয়েছে–এই বুঝি আকাশটা ভেংগে বৃষ্টি নামবে।

সুভাষিণী বেরিয়ে পড়লো। কোনদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। দ্রুত এগিয়ে চললো সে। ভোর হবার পূর্বেই পিতার জমিদারী ছেড়ে পালাতে হবে, নইলে তার রেহাই নেই।

কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো অবিরাম বৃষ্টি। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সুভাষিণীর শরীরে সঁচের মত বিধতে লাগলো। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুভাষিণী দু’হাতে বুক চেপে ধরে ছুটতে লাগলো।

জমিদারের আদুরে কন্যা সুভাষিণী কোনদিন এতোটুকু দুঃখ সহ্য করেনি। এই রাতদুপুরে দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সব দুঃখ ভুলে ছুটে চলেছে সে। কতদূর এসেছে কোন দিকে চলেছে, কোথায় চলেছে, কিছুই জানে না সুভাষিণী। বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে সে। আবার উঠছে, আবার ছুটছে; ভাবছে কই সে যে বলেছিল, বিপদমুহূর্তে আবার তুমি আমার দেখা পাবে। কই-কই সে, কোথায় তার দেখা পাব।

কতদূর যে এসে পড়েছে সুভাষিণী নিজেই জানে না। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। হয়ে এসেছে। সুভাষিণী ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে একটা গাছের তলায় বসে পড়ে। অতি পরিশ্রমে বৃষ্টি আর ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে দেহটা তার অবশ হয়ে এসেছিল, অল্পক্ষণেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সুভাষিণী।

যখন জ্ঞান ফিরলো চোখ মেলে দেখলো সে একটি বেডে শুয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে একটি নারী ও একটি পুরুষ কি সব কথাবার্তা বলছে। তাকে চোখ মেলতে দেখে মেয়েটা বলে উঠল– ডক্টর ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে।

এবার সুভাষিণী বুঝতে পারে–সে যেখানে এখন শুয়ে রয়েছে, সেটা একটা হসপিটাল। মেয়েটার শরীরে নার্সের ড্রেস আর ভদ্রলোকটি ডাক্তার, এ কথা সে একটু পূর্বেই নার্সের মুখের কথায় জানতে পেরেছে।

সুভাষিণী খুশি হতে পারলো না। সে তো বাঁচতে চায়নি চেয়েছিল মরতে, কিন্তু এখানে সে এলো কি করে!

ততক্ষণ ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করেছেন। পরীক্ষা শেষ করে বলেন– আর কোন ভয় নেই। আপনি ওকে গরম দুধ খেতে দিন।

নার্স গেলাসে খানিকটা গরম দুধ এনে সুভাষিণীকে খেতে দিল।

সুভাষিণী মুখ ফিরিয়ে নিলো না, আমি খাব না।

নার্স আশ্চর্য কণ্ঠে বললো–কেন খাবেন না?

না, আমি কিছু খাবো না।

নার্স হেসে বলে–ও বুঝতে পেরেছি। স্বামীর উপর অভিমান হয়েছে।

স্বামী!

হ্যাঁ, আপনার স্বামীই তো এখানে রেখে গেছেন আপনাকে।

সুভাষিণী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নার্সের মুখের দিকে।

নার্স বলে–আপনি দুধটুকু খেয়ে ফেলুন, কোন চিন্তা করবেন না। আপনার স্বামী এলে যাবেন।

এবার সুভাষিণী দুধটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে হাতের পিঠে মুখ মুছে বলে–আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনে।

সব বুঝতে পারবেন। আপনার স্বামী একটা চিঠি দিয়ে গেছেন আপনাকে দেবার জন্য। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে চিঠিটা দেব।

সুভাষিণী ব্যাকুল কণ্ঠে বলে–আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছি। কই চিঠি দিন।

এখন নয়, পরে পাবেন।

না, না এখনই দিন।

কিন্তু এখন তো দেওয়া চলবে না।

দিন আমার অনুরোধ, আপনি দিন…

বুঝেছি স্বামীর চিঠি কিনা….দাঁড়ান এনে দিচ্ছি।

নার্স চলে যায়। একটু পরে একটা গভীর সবুজ রং-এর মুখ আঁটা খাম এনে সুভাষিণীর হাতে দেয়।

দুরু দুরু বক্ষে সুভাষিণী খামখানার মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে মেলে ধরলো চোখের সামনে। মাত্র দু’লাইনে লেখা সুভাষিনী এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললো–

তোমাকে এভাবে দেখবো ভাবতে পারিনি। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেও।

–দস্যু বনহুর।

সুভাষিণীর চোখ দুটো দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বার বার পড়ছে সে চিঠির দু’ছত্র লেখা। তার ডাকে এসেছিল সে। সাড়া দিয়েছিল..

নার্স বিস্ময় বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। হেসে বললো– আপনার স্বামীর সঙ্গে রাগারাগি হয়েছে বুঝি?

সুভাষিণী নার্সের প্রশ্নে তাকালো তার মুখে। তারপর আনমনা হয়ে যায়।

নার্স হেসে বলে–সত্যি আপনার স্বামী-ভাগ্য। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমন তার ব্যবহার।

অবিবাহিত নার্সের মনে হয়তো জানার বাসনা জাগে। জিজ্ঞাসা করে–চিঠিতে কি লিখেছেন উনি?

সুভাষিণী কাগজখানা ভাঁজ করে রেখে বলে–লিখেছেন, আসতে বিলম্ব হলে আমি যেন ঘাবড়ে না যাই।

অমন রাজপুত্রের মত স্বামী, একদণ্ড না দেখলে ঘাবড়াবার যে কথাই…

সুভাষিণী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে–হুঁ।

বনহুর এসে পৌঁছতেই নূরী তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল–হুর, তুমি না বলেছিলে রাতেই ফিরে আসবে?

সে এক অদ্ভুত কাণ্ড নূরী! চলো বলছি।

কি এমন কাণ্ড হল? তোমার কাছে তো দিন-রাত অদ্ভুত কাণ্ডের সীমা নেই।

ঝর্ণার ধারে গিয়ে পাশাপাশি বসে নূরী আর বনহুর। নূরী হেসে বলে–এবার বলো তোমার অদ্ভুত কাণ্ডের কথা।

গত রাতে আমি কোথায় গিয়েছিলুম জান?

জানি, তুমি সেই শয়তান ডাকুর সন্ধানে জম্বুর বনে গিয়েছিলে।

হ্যাঁ, আমি নাথুরামের আড্ডার সন্ধানে জম্বুর বনে গিয়েছিলুম, কিন্তু গত রাতে সেখানে আড্ডা বসেনি। হয়তো শহরের কোন গোপন স্থানে সমবেত হয়েছে ওরা। ফিরে আসছিলুম, পথিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। পথ সঙ্কীর্ণ করার অভিপ্রায়ে জম্বুর বনের ভিতর দিয়ে তাজকে চালনা করছিলুম। বন পেরিয়ে মনসা গ্রামের পাশ কাটিয়ে আসছিলুম–তখন বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে; মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে গ্রামের ভিতর দিয়ে আসা ঠিক হবে না, তাজের খুরের শব্দে গ্রামবাসীর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই মনসাপুরের ওপাশে নাড়ুন্দি বনের ভিতর দিয়ে এগুতে লাগলুম। কিছুদূর এগিয়েছি হঠাৎ বিদ্যুতের আলোতে দৃষ্টি গিয়ে পড়লো একটা গাছের নিচে। কি যেন পড়ে রয়েছে। এগিয়ে গেলুম গাছটার দিকে। পুনরায় বিদ্যুৎ চমকালো, আশ্চর্য হলুম-বিদ্যুতের আলোতে দেখলুম একটি নারীমূর্তি পড়ে রয়েছে ভূতলে।

তারপর?

তারপর যখন তার আরও নিকটে পৌঁছলুম তখন আরও আশ্চর্য হলুম।

কেন?

মেয়েটি আমার পরিচিত।

তার মানে?

মানে, মনসাপুরের জমিদার কন্যা সুভাষিণী …

সেই যুবতী, যাকে তুমি একদিন ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

তারপর কি করলে?

দেখলুম, সুভাষিণী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে।

তুমি বুঝি বসে রইলে তার পাশে?

না, তাকে তাজের পিঠে উঠিয়ে নিলুম।

সত্যি?

তা নয়তো কি মিথ্যে? তারপর বন থেকে বেরিয়ে এলুম। ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাকে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে এসেছি।

এই বুঝি তোমার অদ্ভুত কাণ্ড?

কেন অদ্ভুত নয়? রাত দুপুরে বনের মধ্যে একটি যুবতী মেয়ে…

আর রক্ষাকর্তা হিসেবে হঠাৎ তোমার আবির্ভাব …

কি জানি নূরী, সবই যেন কেমন বিস্ময়কর ব্যাপার!

বনহুর আর নূরী কথাবার্তা বলছিল, এমন সময় রহমান আসে সেখানে–সর্দার।

বনহুর রহমানকে দেখে বলে–এসেছো; চলো।

নূরী প্রশ্ন করে–আবার কোথায় চললে হুর?

পরে জানতে পারবে। এসো রহমান।

বনহুর আর রহমান চলে যায়।

বনহুরের দরবার কক্ষ।

সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট দস্যু বনহুর। তার প্রধান সহচর রহমান পাশে দাঁড়িয়ে, এবং অন্যান্য অনুচর সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে–তোমরা সবাই জান আজ আমাদের দেশ এক মহাসঙ্কটময় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রতিবেশী রাজ্য আমাদের রাজ্যের উপর জঘন্য হামলা চালিয়েছে।

জানি সর্দার।

যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। আজ আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য জান-প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষা করা। শত্রুর কবল থেকে আমাদের মাতৃভূমিকে বাঁচিয়ে নেওয়া। আমরা জীবন পণ সমপর্ণ করে দেশকে রক্ষা করবো।

হ্যাঁ সর্দার।

আমরা সব কিছু ত্যাগ করতে পারি, মাতৃভূমি রক্ষার্থে আমরা শরীরের শেষ রক্তবিন্দুও বিসর্জন দিতে পারি। বিশেষ করে আমাদের মুসলমান ভাইরা আজ মাতৃভূমি রক্ষার্থে আমরণ প্রচেষ্টা চালিয়ে চলেছে। মাতৃভূমি রক্ষার দায়িত্ব শুধু সৈনিকদের নয়, প্রত্যেকটা নাগরিকের কর্তব্য আমাদের দেহের শেষ শক্তি দিয়ে শত্রুকে হটিয়ে দেওয়া।

সর্দার, আমরা সবাই প্রস্তুত।

তোমাদের বেশি করে বলতে হবে না; এই দেশের সন্তান তোমরাও। তোমাদের এখন কি কর্তব্য নিজেরাই জান। আমি এই মুহূর্তে তোমাদের ছুটি দিলুম। তোমরা সবাই ইচ্ছামত মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মনিয়োগ করতে পারো।

সর্দার!

হ্যাঁ, যত টাকা তোমাদের প্রয়োজন হয়, রহমানের নিকট চেয়ে নিও। এখন আর দস্যুতা নয়, দেশরক্ষার জন্য এখন তোমরা সকলেই ভাই ভাই। তোমাদের কারো দ্বারা কোন নাগরিকের শান্তি ভঙ্গ হবে না–এটাই আমি চাই।

সর্দার, আপনার আদেশ শিরোধার্য।

বনহুর কখন উঠে দাঁড়িয়েছিল, এবার দক্ষিণ পা খানা তার আসনের উপর তুলে দাঁড়ায়– এখন আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য আছে, দায়িত্ব আছে-তোমরা যে যতটুকু পারবে, দেশের জন্য উৎসর্গ করবে। আল্লাহ আমাদের সহায়।

সমস্ত অনুচরবৃন্দ সমস্বরে চিৎকার করে উঠে–মারহাবা!

নূরী আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, আরও ভালোভাবে কান পাতে।

এবার বনহুর আসন থেকে দক্ষিণ পা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তারপর বলে–তোমরা যেতে পার। আল্লাহ হাফেজ।

সমস্ত দস্যুগণ বেরিয়ে যায়।

রহমান দাঁড়িয়ে থাকে বনহুরের পাশে। কিছু যেন বলতে চায় সে।

বনহুর বলে–রহমান, আমরা কবে যাচ্ছি?

সর্দার, একটা কথা?

বল?

সর্দার আমরা সবাই যাচ্ছি, তাই বলছিলুম আপনি …

থামলে কেন বল?

আপনার না গেলে হয় না?

কেন?

কদিন আগে আপনার শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত ঘটেছে, তাই বলছিলুম ….

রহমান, তোমার হিত-উপদেশ শুনতে চাইনে। আমি দুর্বল নই।

সর্দার, আপনার কয়েক দিন বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল।

রহমান, তুমি না দস্যু বনহুরের সহচর? তোমার মুখে ও কথা শোভা পায় না। বনহুর বিশ্রাম বলে কিছু জানে না।

লজ্জিত কণ্ঠে বলে রহমান–মাফ করুন সর্দার।

রহমান, কালই আমি যেতে চাই।

কয়েক দিন পরে গেলে চলে না সর্দার?

হাসালে রহমান, যুদ্ধকালে কখনও সময়কাল বিচার চলে না। এখন প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।–রহমান?

সর্দার!

এ কথা নূরী যেন না জানে।

আচ্ছা।

বনহুর বেরিয়ে আসে দরবার কক্ষ থেকে।

নূরী আড়ালে দাঁড়িয়ে সবই শুনেছিল, রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রহর গুণছিল সে। বনহুর যুদ্ধে যাবে, হয়তো আর ফিরে নাও আসতে পারে। কিন্তু তা হয় না। নূরীও যাবে তার সঙ্গে যদি মরতে হয় দু’জন এক সঙ্গে মরবে। কিন্তু সে যে নারী, তাকে কি সঙ্গে নেবে বনহুর? যতই এই নিয়ে ভাবছে ততই নূরীর বুকের মধ্যে একটা ক্রন্দন জমাট বেঁধে উঠছে। এ গহন বনে তার একমাত্র সাথী এবং সম্বল ঐ বনহুর। দুনিয়ায় সে ওকে ছাড়া কিছু বুঝে না। বনহুরই যে তার সর্বস্ব।

নূরী দু’হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। এমন সময় বনহুর এসে তার পাশে বসলো। একটা কাঠি দিয়ে নূরীর মাথায় টোকা মেরে ডাকল–নূরী।

নূরী নিশ্চুপ।

বনহুর ওর মাথায় হাত রাখলো–নূরী।

নূরী এবার মুখ তুলে বললো–এতোবড় নিষ্ঠুর তুমি।

হেসে বললো বনহুর–এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

নূরী রাগতকণ্ঠে বলে উঠে–শুধু নিষ্ঠুর নও তুমি; তুমি পাথরের চেয়েও কঠিন।

তার চেয়েও শক্ত ….

বনহুর, আমি সব শুনেছি।

তাহলে তো বলার আর কিছু নেই।

পাষণ্ড! তোমার হৃদয় বলে কোন কিছু নেই।

হৃদয়…. হাঃ হাঃ হাঃ, দস্যুর আবার হৃদয় আছে নাকি?

বনহুর, আমি তোমাকে কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দেব না।

বনহুর মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে পড়ে–তাই বল। দরবার কক্ষের কথাগুলো তুমি তাহলে সব শুনে নিয়েছ?

নূরীর রুদ্ধ কান্না এততক্ষণে যেন পথ পায়, দু’হাতের মধ্যে মুখ ঢেকে উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠে সে।

বনহুর অবাক হয়ে ভাবে, একি মহাসঙ্কট। তবু সান্ত্বনার কণ্ঠে বলে–নূরী তুমি কি মাতৃভূমির সন্তান নও? তুমি কি চাও না দেশের মঙ্গল?

তুমি যেও না। এ গহন বনে তুমি ছাড়া আর যে আমার কেউ নেই…

নূরী, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন। দেশ আজ মহা সঙ্কটময় মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। এ সময় কারও উচিত নয় নিশ্চুপ হয়ে থাকা। যার যতটুকু সামর্থ্য দিয়ে দেশকে রক্ষা করা সকলের কর্তব্য।

তাহলে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

তা হয় না নূরী। তোমরা নারী, একেবারে সমর প্রাঙ্গণে যাওয়া তোমাদের চলে না। তুমি যদি মাতৃভূমি রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে চাও, অনেক পথ আছে। রহমান এ ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করবে।