» » দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

বনহুরের রক্তে তাজের দেহটা ভিজে চুপসে উঠেছে। এক হস্তে তাজের লাগাম চেপে ধরে উবু হয়ে আছে বনহুর। তাজ প্রাণপণে ছুটে চলেছে।

প্রান্তরের বুক চিরে, গহন বনের ভিতর দিয়ে ছুটছে তাজ। নিস্তব্ধ ধরণীর বুকে তাজের খুরের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তুলছে খট খট খট……

বনহুরকে নিয়ে তাজ আস্তানায় পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুজন অনুচর মশাল হস্তে এগিয়ে এল তাজের পাশে। তাজের পিঠে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্তব্ধ হয়ে গেল। একজন তীব্র চিৎকার করে উঠলো।

নূরীও এতোক্ষণ বনহুরের প্রতীক্ষায় ছিল, তাজের খুরের শব্দে বেরিয়ে এলো সে। ছুটে গেলো তাজের পাশে, কিন্তু নিকটে পৌঁছেই আর্তনাদ করে উঠলো-উঃ! এ তোমার কি হয়েছে, হুর?

ততক্ষণে বনহুর অনুচরদ্বয়ের সাহায্যে নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে। নূরী তাড়াতাড়ি বনহুরের হাতের নিচে নিজের কাঁধটা এগিয়ে দিয়ে ধরে ফেলে-হুর, একি হলো?

মৃদু হেসে বলে বনহুর-সামান্য ঘায়েল হয়েছে মাত্র– সেরে যাবে।

সামান্য! রক্তে চুপসে গেছে তাজের দেহ, আর তুমি বলছো সামান্য ঘায়েল হয়েছে মাত্র? নূরীর সাহায্যে বনহুর নিজের বিশ্রামকক্ষে পৌঁছল।

বনহুরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসলো নূরী। নিজের ওড়না দিয়ে বেশ করে ওর হাতখানা বেঁধে দিল। নূরী যখন বনহুরের হাতে পট্টি বাঁধছিল তখন তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। বনহুরের কষ্টটা যেন নূরীর হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দিচ্ছিলো। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে–হুর, এবার বল কে তোমার এ অবস্থা করেছে?

শুনে কি হবে নূরী?

রহমানের সাহায্যে এবং তোমার সমস্ত অনুচর নিয়ে আমি তাকে উচিত শাস্তি দেব। আমি তার সর্বনাশ করবো। তোমাকে ঘায়েল করেছে যে, আমি তাকে হত্যা করবো।

সাবাস নূরী!

বলো, বলো! হুর, কে তোমার এ অবস্থা করেছে, বলো?

নূরী, তোমার দীপ্ত কণ্ঠ আমার ক্ষত অনেকটা আরোগ্য করে দিয়েছে। সত্য তুমি বীরাঙ্গনা। কিন্তু এ গুলী আমাকে কে করেছে ঠিক আমিই জানিনে। নইলে দস্যু বনহুর তাকে ক্ষমা করতো না। এখনও আমার দক্ষিণ হস্ত সম্পূর্ণ সুস্থ।

তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

মোটেই না নূরী, সামান্য কেটেছে মাত্র।

এ আঘাত তুমি সামান্য বলতে পার না বনহুর। এখনও যেভাবে রক্তপাত হচ্ছে, তাতে বিপদ ঘটতে পারে।

নূরী, জানি আমার শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, কিন্তু এতেও আমি দুর্বল হব না।

বল কি হুর, ডাক্তার নিয়ে আসি। খোদা না করুন তোমার কিছু হয়ে যায়। ডাক্তার! কথাটা উচ্চারণ করে হাসে বনহুর।

হ্যাঁ ডাক্তার। ডাক্তার না ডাকলে তোমার রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। দেখছো না ওড়নাখানা সম্পূর্ণ রাঙা হয়ে উঠেছে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা ঠিক নয় হুর।

বনহুর পিছু ডাকে-কোথায় যাচ্ছো নূরী, শোন।

নূরী ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে।

নূরী রহমানের নিকট গিয়ে বললো–রহমান, বনহুরের শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত ঘটেছে। এখনও রক্ত পড়ছে। শিগৃগীর কোন ডাক্তারের ব্যবস্থা কর।

ডাক্তার! সর্দার কি এখনই ডাক্তার ডাকতে বললো নূরী?

না, সে বলেনি, কিন্তু ডাক্তার ডাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। যাও রহমান, আর বিলম্ব কর, হুরকে বাঁচাতেই হবে।

কিন্তু…

আর কিন্তু নয়। তুমি দুটো অশ্ব নিয়ে এসো, আমিও যাব তোমার সঙ্গে। ডাক্তারকে কিভাবে আনতে হবে আমিই আনব।

বেশ। রহমান হাতে তালি দেয়-সঙ্গে সঙ্গে দুজন দস্যু এসে দাঁড়ায় সেখানে। রহমান বলে–দুটো অশ্ব তৈরি করে নিয়ে এসো।

দস্যু দুটি চলে যায়।

নূরী বলে–আমিও তৈরি হয়ে আসছি।

নূরী নিজের কক্ষে প্রবেশ করে, পূর্বের ড্রেসে সজ্জিত হয়। মাথায় পাগড়ি, নাকের নিচে সরু এক ফালি গোঁফ। প্যান্ট এবং আঁটসাট একটি কোট। প্যান্টের পকেটে একটি কালো রুমাল ও একটি রিভলবার লুকিয়ে নেয় সে। তারপর আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়, ঠিক তখন তাকে একটি একুশ বছরের যুবকের মত লাগছিল।

এবার নূরী বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করলো।

বনহুর তখন বিছানায় চীৎ হয়ে শুয়ে কিছু ভাবছিল। পদশব্দে চোখ মেলে তাকায়। হঠাৎ কক্ষে অপরিচিত এক যুবককে দেখে প্রথমে আশ্চর্য হয়, পর মুহূর্তেই মৃদু হাসে।

নূরী গম্ভীরভাবে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় বনহুরের সম্মুখে। কোন কথা বলে না সে।

বনহুর কিন্তু নূরীকে চিনে ফেলেছে, তবু মনোভাব গোপন করে বলে–যুবক, তোমার নাম?

নূরী তবু নিশ্চুপ।

বনহুর দক্ষিণ হস্তে নূরীর হাত ধরে টেনে নেয় কাছে।

নূরীর হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব শিহরণ বয়ে যায়। আজ পর্যন্ত বনহুর নূরীকে কোনদিন এভাবে আকর্ষণ করেনি। আনন্দ আপ্লুত নূরীর দু’চোখ ছাপিয়ে পানি আসে।

বনহুর স্নেহ-বিজড়িত কণ্ঠে বলে–এ ড্রেসে কোথায় যাচ্ছো নূরী?

ডাক্তার ডাকতে।

কিন্তু ডাক্তার এখানে এসে ফিরে যেতে পারবে?

ভয় নেই, তোমার আস্তানার সন্ধান সে জানতে পারবে না। ছেড়ে দাও হুর, দেরী হয়ে গেল।

বনহুর ওকে ছেড়ে দেয়। দ্রুত বেরিয়ে যায় নূরী। বাইরে গিয়ে দেখতে পায় রহমান দুটো অশ্ব নিয়ে অপেক্ষা করছে।

নূরী রহমানকে লক্ষ্য করে বলে–রহমান, খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। রাত ভোর হবার পূর্বেই ডাক্তার যেন তার নিজ বাড়ি ফিরে যেতে পারে।

আচ্ছা, তাই হবে।

দুটি অশ্বে দুজন চড়ে বসে। অন্ধকারে অশ্ব দুটি ছুটতে শুরু করে।

পথিমধ্যে রহমান ভেবে নেয় কোন ডাক্তারকে হলে তাদের ভালো হয়। তাই বিলম্ব হয় না। শহরের বিশিষ্ট ডাক্তার জয়ন্ত সেনের নিকটে যাওয়াই ঠিক করলো।

বনের শেষ প্রান্তে তাদের মোটর গাড়ি প্রতীক্ষা করছিল। ঘোড়া দুটি গোপন স্থানে বেঁধে রেখে গাড়িতে উঠে বসে ওরা দুজন।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গাড়ি ডাক্তার সেনের গাড়ি বারান্দায় গিয়ে পৌঁছল। রহমানই ড্রাইভ করছিল, রহমানের শরীরেও ছিল ড্রাইভারের ড্রেস। রহমান গাড়ি থেকে নেমে দরজার পাশে গিয়ে কলিং বেলে হাত রাখলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে সম্মুখে এসে দাঁড়াল একটি লোক। হয়তো বাড়ির চাকর-বাকর হবে। লোকটা জিজ্ঞাসা করলো–আপনারা কাকে চান?

নূরী ব্যস্তকণ্ঠে বললো–ডাক্তার বাবুকে ডেকে দাও। একটু তাড়াতাড়ি, বুঝলে?

কিন্তু তিনি তো রাতে কোন রোগী দেখেন না। লোকটি বললো।

ডাক্তার বাবুকে ডেকে দাও, তিনি যা করেন–করবেন।

কি বলবো? আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?

কিছু বলতে হবে না; শুধু বলবে, একটি যুবক আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

এবার লোকটা একবার যুবকের মুখে আর একবার তার গাড়িখানার দিকে তাকিয়ে চলে যায়।

অল্পক্ষণেই পুনরায় লোকটি ফিরে এসে বলে–আসুন, ভিতরে এসে বসুন।

নূরী লোকটার পিছু পিছু হলঘরে গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর করুণ কণ্ঠে বলে–দেখ, একটু তাড়াতাড়ি ডাক্তার বাবুকে ডেকে দাও।

এই যে এলেন বলে–আপনি বসুন। তারপর নিজ মনেই বলে চলে লোকটা-এই রাত দুপুরে রোগী। বাপরে বাপ, রাতেও একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেবে না বাবা।

ততক্ষণে কক্ষে প্রবেশ করেন ডাক্তার সেন। মধ্যবয়স্ক গম্ভীর প্রকৃতির লোকটি। স্লিপিং গাউনের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে এসেছেন তিনি। নূরীকে দেখে বলেন–যুবক, তুমি কি জানো না

আমি রাতে রোগী দেখি না?

জানি, কিন্তু এক্সিডেন্ট হয়েছে….

এক্সিডেন্ট! যুবক, তুমি তো দিব্যি দাঁড়িয়ে আছ– তোমার কি হয়েছে?

ডাক্তারবাবু, আমার নয়-আমার বড় ভাই এক্সিডেন্ট হয়েছে। না গেলেই নয়, দয়া করে একটিবার চলুন-চলুন ডাক্তার বাবু…নূরীর গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

কি বললে, তোমার এক্সিডেন্ট নয়? তোমার ভাই-এর-আমি যাব এই রাতদুপুরে বাইরে রোগী দেখতে!

নূরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ডাক্তার বাবু, না গেলেই নয়। নইলে ওকে বাঁচানো যাবে না। ডাক্তার বাবু চলুন, দয়া করে চলুন। ডাক্তার বাবু…

অসম্ভব। রাতে আমি কোথাও যাই না।

আপনার পায়ে পড়ি ডাক্তার বাবু, চলুন…নূরী কাঁদতে থাকে। ডাক্তারের মনে হয়তো মায়ার উদ্রেক হয়। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলেন–এখন রাত চারটে; আর ঘণ্টা দুই কিংবা তিন পরে গেলে চলবে না?

না, ডাক্তার বাবু না, আপনি দয়া করে এক্ষুণি চলুন। আপনার পায়ে পড়ি ডাক্তার বাবু।

ডাক্তার সেন দেখলেন না গেলেই নয়, যুবকটি নাছোড়বান্দা হয়ে ধরেছে। এবার বলেন তিনি-রাতে কোথাও রোগী দেখি না বা কলে যাই না। ফি কিন্তু ডবল দিতে হবে।

তাই দেব, তাই দেব ডাক্তার বাবু, কত চান আপনি?

দু’শো টাকা দিতে হবে।

বেশ, তাই পাবেন।

ডাক্তার সেন বলেন, রোগীর শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে?

হ্যাঁ ডাক্তার বাবু, রোগীর শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।

তাহলে তো রক্তের প্রয়োজন?

রক্ত-সে চিন্তা করবেন না ডাক্তার বাবু, আমি-আমিই দেব রক্ত।

কিন্তু রোগীকে এখানে আনতে পারলে সব বিষয়ে সুবিধা হতো।

না না, সে রকম কোন উপায়ই নেই। রোগী অত্যন্ত কঠিন। যা-যা প্রয়োজন নিয়ে চলুন। ডাক্তার বাবু, আমার গাড়িতেই আপনাকে পৌঁছে দেব।

বেশ, তাই হবে। কিন্তু অনেক কিছু নিতে হচ্ছে।

তাই নিন, কোন অসুবিধা হবে না।

ডাক্তার সেন তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং ঔষধাদি নিয়ে নূরীর গাড়িতে চড়ে বসলেন।

ডাক্তার সেনকে নিয়ে নূরীর গাড়ি ডবল স্পীডে ছুটে চলেছে। রহমান গাড়ি চালাচ্ছে।

ডাক্তার সেন বললেন-কত দূর হবে?

নূরী জবাব দিল-একটু দূরেই হবে ডাক্তার বাবু। আপনি নিশ্চিন্ত হউন, কোন ভয় নেই।

ডাক্তার সেন একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে ভালোভাবে ঠেস দিয়ে বসেন।

গাড়ি তখন আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে চলেছে।

নূরী ধীরে ধীরে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে রিভলবার খানা বের করে নেয়। তারপর হঠাৎ অতর্কিতভাবে চেপে ধরলো ডাক্তার সেনের পাঁজরে-ডাক্তার বাবু, ভয় নেই, কিন্তু এবার আপনার চোখে রুমাল বাধতে হবে।

ডাক্তার সেনের হাত থেকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা খসে পড়লো। দুহাত তুলে ধরলো উপরের দিকে। ভয়াতুর চোখে তাকালেন নূরীর মুখের দিকে, ঢোক গিলে বলেন–যুবক, তোমার মতলব?

নূরী স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো…আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না। শুধু চোখে রুমাল বাঁধতে হবে।

তার মানে?

মানে, আমি আপনাকে যেখানে নিয়ে যাব সে স্থানটি অতি গোপনীয়। কাজেই আপনাকে চোখে রুমাল বাঁধতে হবে। এতে আপত্তি করলে বিপদে পড়বেন। এতে আপনার কোন অমঙ্গল হবে না।

ডাক্তার সেনের ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন তিনি-বেশ, তাই হবে।

নূরী একটি কালো পুরু রুমাল বের করে ডাক্তার সেনের চোখে মজবুত করে বাঁধলো। তারপর বললো–আপনি চুপ করে থাকুন, যা করতে হয় আমরাই করবো। তারপর রোগীর নিকটে পৌঁছে আপনার কাজ।

বনের পাশে এসে গাড়ি থামলো। রহমান গুপ্তস্থান হতে অশ্ব দুটি নিয়ে এলো। তারপর একটিতে ডাক্তার এবং ঔষধের বাক্স ও রহমান চেপে বসলো। অন্যটিতে নূরী।

ডাক্তারকে নিয়ে একেবারে বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করলো নূরী। তারপর ওর চোখের রুমাল  খুলে দিয়ে বললো–ডাক্তার বাবু, এই যে রোগী।

প্রায় অর্ধঘণ্টা কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা থাকায় কেমন যেন ধা ধা মেরে গিয়েছিলেন ডাক্তার সেন। প্রথমে চোখ দুটো একটু রগড়ে নিলেন, তারপর তাকালেন সম্মুখে। দেখতে পেলেন সম্মুখে শয্যায় শায়িত এক যুবক। বনহুরের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাকালেন কক্ষের চারিদিকে। এ কোথায় এসেছেন কিছুই বুঝতে পারলেন না।

নূরী বলে উঠে-ডাক্তার বাবু, এবার দয়া করে ওকে দেখুন।

বনহুর একবার নূরী আর একবার রহমানের মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারকে লক্ষ্য করে বললো–বসুন।

ডাক্তার সেন এবার বনহুরের বিছানার পাশে বসলেন। বনহুরকে পরীক্ষা করে বলেন–এটা গুলীর আঘাত বলে মনে হচ্ছে?

বনহুর জবাব দিল–হ্যাঁ, রিভলবারের গুলী লেগেছিল। তবে গুলীটা ভেতরে নেই, বেরিয়ে গেছে।

হ্যাঁ, সেরকমই দেখছি; কিন্তু যেভাবে ক্ষত হয়েছে, প্রচুর রক্তের প্রয়োজন।

রক্ত?

হাঁ, প্রচুর রক্ত লাগবে।

কিন্তু রক্ত কোথায় পাওয়া যাবে? একটু চিন্তিত কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে বনহুর।

নূরী বলে উঠে-কেন, আমার শরীরে এখনও প্রচুর রক্ত জমা আছে। ডাক্তার বাবু, আপনি আমার রক্ত তুলে নিয়ে ওকে বাঁচান।

তা হয় না। ডাক্তার বাবু, আপনি রক্ত ছাড়া যতটুকু পারেন করুন। রক্ত আমার লাগবে না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে বনহুর।

ডাক্তার সেন বলে উঠেন-তা হয় না, রক্ত লাগবেই।

নূরী পুনরায় বলে–আমার রক্ত না নিলে আমি এক্ষুণি নিজকে বিসর্জন দেব।

ডাক্তার সেন বলেন–বেশ, তাই হোক। এই যুবকের রক্তেই আমি আপনাকে…।

এবার শুরু হলো চিকিৎসা।

নূরীকে পাশের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বনহুরের শরীরে দেওয়া হলো।

ডাক্তার সেন মনোযোগ সহকারে কাজ করে চললেন।

হাতখানায় সুন্দর করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। আর রক্তপাত হচ্ছে না।

কিন্তু ডাক্তার সেনের কাজ যখন শেষ হলো তখন রাত আর বেশি নেই। বনহুরের ইংগিতে রহমান একটা থলে এনে ডাক্তার সেনের হাতে দিলেন।

বনহুর বললো–ওটাতে আপনার পারিশ্রমিক আছে; নিয়ে যান।

ডাক্তার সেন থলে হাতে নিয়ে একটু অবাক হলেন। কারণ তাকে দু’শ টাকা বন্দোবস্ত করে নিয়ে আসা হয়েছে। দু’খানা একশত করে টাকার নোট দিলেই চলত। এখানে গুণে দেখাটাও ভদ্রতা হবে না। কাজেই থলেটা পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

রহমান হঠাৎ তার চোখের সম্মুখে কালো রুমালখানা ধরে বললো–আসুন এটা বেঁধে দি।

ডাক্তার সেন দেখলেন, না বেঁধে যখন কোন উপায় নেই তখন নীরবই রইলেন।

রহমান ডাক্তারের চোখ বেঁধে হাত ধরলো-আসুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

ডাক্তার সেন চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে বলেন–আপনার নামটা তো বললেন না?

বনহুর হেসে বললো–ঐ থলের মধ্যেই আমার পরিচয়। তারপর রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–ডাক্তার সেনের যেন কোন অসুবিধা না হয় লক্ষ্য রেখ রহমান।

আচ্ছা রাখবো।

রহমানের হাত ধরে চলতে চলতে ডাক্তার সেনের মনে নানা কথার উদ্ভব হচ্ছে। নিশ্চয়ই এটা কোন গোপন স্থান হবে। নইলে তার চোখ এমন করে বাঁধবে কেন। যাক গে যে স্থানই হোক তার এতো মাথা ঘামিয়ে লাভ কি! টাকা দু’শ পেলেই হলো। তাছাড়া রোগীর ব্যবহার চমৎকার! কথাবার্তাগুলোও তেমনি মনোমুগ্ধকর। কিন্তু কে এই যুবক-যার চেহারা এতো সুন্দর, যার ব্যবহার এতো মহৎ, যার হৃদয় এতো উন্নত!

ডাক্তার সেনকে নিয়ে রহমান অশ্বযোগে একেবারে ট্যাক্সির নিকটে পৌঁছল, তারপর ট্যাক্সিতে বসিয়ে প্রায় পনেরো মিনিট ডবল স্পীডে চলার পর ডাক্তার সেনের চোখের রুমাল খুলে দিলো রহমান। তখন পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে।

অল্পক্ষণেই গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি পৌঁছে গেল।

ডাক্তার গাড়ি থেকে নেমে চট করে গাড়ির নাম্বার লিখে নিলেন। কিন্তু একি! এযে তারই গাড়ির নাম্বার। গাড়ির দিকে ভালো করে তাকালেন-তাই তো, এ যে তারই গাড়ি! কিন্তু ডাইভার কই! ডাক্তার সেন চিৎকার করে দারোয়ানকে ডাকতে লাগলেন-গুরু সিং, গুরু সিং…

ততক্ষণে রহমান গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যায়।

ইতোমধ্যে দারোয়ান এসে সেলুট ঠুকে দাঁড়ালেন–হুজুর, হামকো বোলাতে; হ্যায়!

বেটা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলি, না? দ্যাখ তো আমার গাড়ি গ্যারেজে আছে?

হুজুর, গাড়ি তো আভি ড্রাইভার আপকে লে আনে গেয়া।

বল কি!

হ্যাঁ হুজুর।

ড্রাইভার! কোথায় ড্রাইভার? রজত, রজত….রজত ড্রাইভারের নাম।

মনিবের ডাকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে আসে রজত-স্যার, আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ, তোমাকে ডাকবো না তো আর কেউ রজত আছে?

বলুন স্যার?

গাড়ি নিয়ে আমাকে আনতে গিয়েছিলে?

সেকি স্যার, আমি তো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছি, আপনাকে কখন আনতে গেলুম!

দারোয়ান গুরু সিং বলে উঠে-হাময়ারা চোখ আন্ধা হুয়া নেহি। তুমি গাড়ি লে-কর গিয়া নেহি?

রজত ক্ষেপে উঠে-নেহি নেহি; আমি ঘুমিয়েছিলুম স্যার, কোথাও যাইনি। সেই সন্ধ্যায় আপনাকে রোগীর গাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। তারপর রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়েছি। রাতে একটিবার ঘুম পর্যন্ত ভাংগেনি স্যার।

তাহলে তুমি গাড়ি নিয়ে যাওনি?

না স্যার, আমি যাইনি।

যাও দেখো তো আমার গাড়ি গ্যারেজে আছে কিনা?

কেন থাকবে না স্যার, আমি শোবার পূর্বে গাড়ি গ্যারেজে বন্ধ করে তবেই তো শুয়েছি।

বললুম যাও।

রজত বেরিয়ে যায়। একটু পরে ফিরে এসে বলে–স্যার গাড়ি তো গ্যারেজে নেই।

ডাক্তার সেন আপন মনেই বলে উঠেন-একি অদ্ভুত কাণ্ড। সব যে দেখছি ভূতুড়ে ব্যাপার!

রজত আর্তকণ্ঠে বলে উঠে-কি বলেন স্যার, সব ভূতুড়ে ব্যাপার? এ্যা, এসব স্বপ্ন দেখছি না তো?

দারোয়ান গুরু সিং বাংলা ভালো বলতে পারে না সত্য, কিন্তু বাংলা বুঝে সে সব। ভূতের নাম শুনে আঁতকে উঠে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠে-হুজুর, কাহা ভূত?

ডাক্তার সেন রাগতভাবে বলেন–ভূত নেহি, ভূত নেহি, তুম লোগ ভূত…

হাম লোগ ভূত। হাম লোগ তো বহুৎ আচ্ছা আদমী। হুজুর, হাম লোগ ভূত নেহি-আদম।

ডাক্তার সেন কারো কথা কানে না নিয়ে ল্যাবরেটরীতে প্রবেশ করেন।

তখন পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় হয়েছে।

দারোয়ান এবং ড্রাইভার কোন কিছু বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নেয়।

ডাক্তার সেন কক্ষে প্রবেশ করে কোটের পকেট থেকে টাকার থলেটা বের করে খুলে ফেলেন, সত্যই ওতে টাকা আছে, না অন্য কিছু। থলে খুলে বিস্ময়ে হতবাক হন, কোথায় দু’শ টাকা-এক শ’ করে প্রায় পঞ্চাশখানা নোট তাড়া করে বাঁধা রয়েছে। ডাক্তার সেনের চোখ দুটো উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠেছে। থলেটা আর একবার হাতড়ে দেখলেন– একি! ছোট্ট এক টুকরা কাগজ ভাঁজ করা রয়েছে। কাগজের টুকরাখানা মেলে ধরেন চোখের সামনে। কাগজে লেখা রয়েছে–

ডাক্তার সেন, আপনার পারিশ্রমিক

বাবদ পাঁচ হাজার টাকা রইল। গাড়ি

ঠিক সময় ফেরত পাবেন।

–দস্যু বনহুর

ডাক্তার সেন অস্ফুট শব্দ করে উঠেন-দস্যু বনহুর। তার হস্তস্থিত থলেটা খসে পড়ে ভূতলে। তিনি চিৎকার করে ডাকেন-দারোয়ান, দারোয়ান-পুলিশ-পুলিশ…..

ছুটে আসে দারোয়ান গুরু সিং, ছুটে আসে ড্রাইভার, আরও অনেকে। সবাই একবাক্যে বলে–কি হলো স্যার? কি হলো?

ডাক্তার সেনের দু’চোখ তখন কপালে উঠেছে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন–দস্যু বনহুর-দস্যু বনহুর…

সবাই পিছু ফিরে ছুটতে শুরু করে, কেউ বা বলে–ওরে বাবা-দস্যু বনহুর!

এক মুহূর্তে গোটা বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে যায়। যে যে দিকে পারে ছুটছে আর চলছে-দস্যু বনহুর! দস্যু বনহুর!

কার গায়ে কে পড়ছে ঠিক নেই। উঠছে আর পড়ছে, আর বলছে-দস্যু বনহুর….দস্যু বনহুর….

ডাক্তার সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র মি. হেমন্ত সেনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ধড়ফড় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো-ব্যাপার কি? কি হয়েছে?

এমন সময় ডাক্তার সেনের স্ত্রী ছুটে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেন–বাবা কি হবে! ল্যাবরেটরীতে দস্যু বনহুর এসেছে, দস্যু বনহুর এসেছে!

বলো কি মা, দস্যু বনহুর!

হ্যাঁ বাবা, এখন উপায়?

মা, তুমি ঘাবড়িও না, আমি এক্ষুণি পুলিশ অফিসে ফোন করছি। হেমন্ত পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়; নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে রিসিভারটা হাতে উঠিয়ে নেয়-হ্যালো, পুলিশ অফিস?

মি. হারুন এবং মি. হোসেন তখন পুলিশ সুপার মি. আহম্মদের ওখানে ছিলেন।

ডিটেকটিভ মি. শঙ্কর রাও তখন কোন কাজে পুলিশ অফিসে এসেছিলেন, তিনিই ফোন ধরলেন-হ্যালো!

ওপাশ থেকে ভেসে এলো মি. হেমন্ত সেনের কম্পিত কণ্ঠস্বর-আপনি কি ইন্সপেক্টর মি. হারুন কথা বলছেন?

না, তিনি বাইরে গেছেন, আমি শঙ্কর রাও কথা বলছি।

হেমন্তর গলা-আমাদের ল্যাবরেটরীতে দস্যু বনহুর হানা দিয়েছে।

শঙ্কর রাও আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠেন-দস্যু বনহুর আপনাদের ল্যাবরেটরীতে…. দাঁড়ান আমি এক্ষুণি মি. হারুনকে ফোন করছি।

একটু শীঘ্ন করুন…

পুলিশ সুপার মি. আহম্মদ এবং মি. হারুন ও মি. হোসেন চৌধুরী বাড়ি যাবার জন্য কেবলমাত্র দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন অমনি ফোনটা পিছনে বেজে উঠে-ক্রিং….ক্রিং….ক্রিং….

মি. আহম্মদ থমকে দাঁড়িয়ে রিসিভারটা হাতে উঠিয়ে নেন। রিসিভারে কান লাগিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠেন-কি বললে, দস্যু বনহুর! ডাক্তার সেনের বাড়িতে দস্যু বনহুর….. আচ্ছা আমরা এক্ষুণি আসছি। রিসিভার রেখে বলে উঠেন-ইন্সপেক্টর, দেখেছেন দস্য বনহুরের সাহস! সে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে ডক্টর সেনের ল্যাবরেটরীতে হানা দিয়েছে।

মি. হারুন বললেন-হানা সে দেয়নি। আমি পূর্বেই বলেছিলাম দস্যু বনহুর সাংঘাতিকভাবে ঘায়েল হয়েছে। এবার দেখুন সে চিকিৎসার জন্য লোকালয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

মি. আহম্মদ হুঙ্কার ছাড়েন-আর এক মুহূর্ত বিলম্ব নয়। চৌধুরীর ওখানে আর গিয়ে কাজ নেই। ইন্সপেক্টর, আপনি কিছু সংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ-ফোর্স নিয়ে এক্ষুণি ডক্টর সেনের ল্যাবরেটরীতে গিয়ে হাজির হন। আমি মি. হোসেনকে নিয়ে অন্য পথে চললুম। মি. আহম্মদ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে গাড়ি নিয়ে ছুটলেন।

অর্ধঘণ্টার মধ্যেই সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স নিয়ে মি. হারুন উপস্থিত হলেন। অন্য পথে এসে হাজির হলেন পুলিশ সুপার স্বয়ং এবং মি. হোসেন। মুহূর্তে ডাক্তার সেনের বাড়ি এবং ল্যাবরেটরী পুলিশ বাহিনী ঘেরাও করে ফেলল।

পুলিশ সুপার এবং মি. হারুন গুলীভরা রিভলভার হস্তে ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় ল্যাবরেটরীতে প্রবেশ করলেন। মি. আহম্মদ বললেন-কোথায় দস্যু বনহুর?

ডাক্তার সেন তো অবাক! তিনি হতভম্বের মত উঠে দাঁড়ালেন। সমস্ত বাড়ি এবং ল্যাবরেটরীর চারিদিকে পুলিশ বাহিনী দেখে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

মি. হারুন গম্ভীর কণ্ঠে গর্জে উঠলেন-দস্যু বনহুর কই?

ডাক্তার সেন উভয়ের উদ্যত রিভলবারের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলেন–কে বললো এখানে দস্যু বনহুর আছে?

শঙ্কর রাও-ও এসেছিলেন মি. হারুনের সঙ্গে, তিনি বলেন–আপনার পুত্র মি. হেমন্ত সেন পুলিশ অফিসে ফোন করেছিলেন।

কিন্তু….কিন্তু এখানে তো দস্যু বনহুর আসেনি ইন্সপেক্টর।

মি. আহম্মদ বজ্রকঠিন স্বরে বলেন–সেকি!

স্যার, আপনারা বসুন, আমি সব বলছি।

আমরা বসতে আসিনি ডাক্তার সেন, বলুন কোথায় দস্যু বনহুর? রাগত কণ্ঠে কথাটা বলেন মি. আহম্মদ।

অবশ্য তার রাগ হবার কারণও আছে। তাঁর মত উচ্চপদস্থ অফিসার কোনদিন কোন দস্যুর পিছনে ধাওয়া করেছেন কিনা সন্দেহ। শুধু দস্যু বনহুর তাকে এভাবে ঘাবড়ে তুলেছে। ঐ শয়তানটাকে ধরার জন্য আজ তিনি নিজে নেমে পড়েছেন।

মি. আহম্মদের চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। ডাক্তার সেন ভড়কে গেলেন, কণ্ঠে মিনতি মেখে বলেন–বসুন, আমি সব খুলে বলছি।

মি. হারুন, মি. আহম্মদকে লক্ষ্য করে বলেন–স্যার, ব্যাপারটা রহস্যজনক মনে হচ্ছে।

মি. আহম্মদ আসন গ্রহণ করলেন। ডাক্তার সেনও আর একটি চেয়ারে বসে রুমালে মুখ মুছতে লাগলেন।

মি. হারুন, মি. হোসেন এবং অন্যান্য সকলে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ডাক্তার সেন রাতের ঘটনা বিস্তারিত সব বলে গেলেন এবং দস্যু বনহুরের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা এবং সেই ছোট্ট কাগজের টুকরাখানা বের করে দেখালেন।

সব শুনে এবং দেখে বিস্ময়ে থ’ বনে গেলেন সবাই। মি. আহম্মদ বলেন–ডক্টর সেন, আপনি কোন ক্রমেই সেই পথ চিনে নিতে পারেন নি?

না, একে অন্ধকার রাত, তদুপরি আমার চোখ কালো কাপড়ে মজবুত করে বাঁধা ছিল। সে বাড়ি যে শহরের কোন প্রান্তে বা কোন স্থানে, আমি কিছুই বলতে পারবো না। গাড়ি থেকে নামিয়ে ওরা আমাকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সে এক অদ্ভুত বাড়ি। বিরাট রাজপ্রাসাদের মত বাড়িটা। অমন সুন্দর বাড়ি আমি কোনদিন দেখিনি।

মি. আহম্মদ বলেন–ডক্টর সেন, দস্যু বনহুরের চিঠিতে জানতে পেরেছি, সে আপনার গাড়ি ফেরত দিতে আসবে।

শঙ্কর রাও বলে উঠেন-স্যার, সে তো নিজে আসবে না।

হ্যাঁ, সে নিজে আসবে না; আর আসবেই বা কেমন করে; সে তো আহত। নিশ্চয়ই তার কোন অনুচর আসবে।

শঙ্কর রাও পুনরায় বললেন-কৌশলে সেই অনুচরটিকে যদি বন্দী করা যায় তাহলে ওর মুখেই দস্যু বনহুরের আস্তানার খবর বের করে নেওয়া যাবে।

এমন সময় বাইরে মোটরের হর্ণ শোনা যায়।

অল্পক্ষণেই কক্ষে প্রবেশ করেন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর মি. মাকসুদ। লম্বা সেলুট ঠুকে বললেন-স্যার, আপনি আমাকে ডেকেছেন?

মি. হারুন বললেন-না তো, আপনাকে ডাকা হয়নি!

তবে যে ডাক্তার সেনের ড্রাইভার তার গাড়ি নিয়ে আমাকে আনতে গিয়েছিল?

ডাক্তার সেন বিস্ময়ভরা চোখে নিজের পাশে তাকিয়ে বলেন–এই তো আমার ড্রাইভার রজত।

মি. আহম্মদ উঠে দাঁড়ান-দেখুন ইন্সপেক্টর, শীঘ্র গাড়ির ড্রাইভারকে গ্রেপ্তার করে ফেলুন। নিশ্চয়ই ড্রাইভারের ছদ্মবেশে দস্যু বনহুরের অনুচর।

সবাই ছুটলেন গাড়ির পাশে।

কিন্তু গাড়ির নিকটে পৌঁছে সবাই হতবাক, গাড়িতে কোন ড্রাইভার বা কোন লোক নেই।

কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ বাইরে তখনও গুলীভরা রাইফেল হস্তে দণ্ডায়মান ছিল। মি. হারুন তাদের জিজ্ঞাসা করলেন-এ গাড়ির ড্রাইভার কোথায় গেল দেখেছো তোমরা?

ওদের একজন বললো–হ্যাঁ হুজুর আভি থা, লেকেন ওধার গেয়া…পেসাব-ওসাব করনে কে লিয়ে….

কিন্তু কোথায় কে-সব জায়গা তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো-কোথায় দস্যু বনহুরের অনুচর!

ডাক্তার সেন সকলের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন।

মি. হারুন জিজ্ঞাসা করলেন-এটাই আপনার গাড়ি?

ডাক্তার সেন স্থির স্বাভাবিক গলায় বললেন– হ্যাঁ, এটাই আমার গাড়ি।

সকলের মুখেই হতাশার ছায়া ফুটে উঠে।

দস্যু বনহুরের নিকটে এ একটি দারুণ পরাজয়।

মি. আহম্মদ নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন।

মি. হারুন এবং মি. হোসেন তাঁদের নিজ নিজ গাড়িতে ফিরে চললেন। সকলের মুখই গম্ভীর থমথমে, আষাঢ়ে মেঘের মতই অন্ধকার।

এতোক্ষণে ডাক্তার সেনের মুখে হাসি ফুটলো। এক রাতেই পাঁচ হাজার টাকা আর গাড়িখানাও ফেরত পেলেন-এ কম কথা নয়!