পতি

ললিত

একবার দেখি আর,             দেখি দেখি এইবার,
দেখি ফিরে বিধুমুখ,            দেখি আঁখি ভরি লো।
আজিকার নিশি ভোরে          লয়ে যাবে কোথা মোরে,
কত দিন তোমা বিনে           রহিব কি করি লো ||
বিদরে বিদরে বুক,             হেরিব না বিধুমুখ,
বিধুমুখ হাসি ভরা,             রব স্বপ্নে স্মরি লো।
আসি কি না আসি ফিরে,      হেরি কি না প্রেয়সীরে,
জানি নে জানি নে কিছু,         বাঁচি কি না মরি লো ||
হেরি কি না হেরি আর,        শশিমুখে ফিরে বার,
জনমের মত তাই             হেরি ভাল করি লো।
সেই শেষ সুখ মরি,           বিধি বুঝি লয় হরি,
বুঝি নিশি পোহাইল,           তাই হৃদে ডরি লো ||
কি শুনি কি শুনি ধনি          কুহু কুহু করি ধ্বনি,
হৃদয়ে শিহরি মরি,            যে শুনেছি কাণে রে।
বুঝেছি বুঝেছি মরি,           পোহাইল বিভাবরী,
পোহাইল পোহাইল,            মন তা না মানে রে ||
হা রজনি একবার,            রহ রহ রহ আর,
একবার চাহি আমি,           চন্দ্রমুখী পানে রে।
মুখ পানে চেয়ে রই,          নয়নে নয়নে রই,
একবার দীর্ঘশ্বাস,             সলিল নয়নে রে ||
একবার মরি মরি,            হৃদয়ে হৃদয়ে করি,
অধরে অধর ধরি,            জুড়াইব প্রাণে রে।
ধরি হৃদি হৃদি পরে,          কত দিবসের তরে,
জনমের মত কি না,           কে জানে কে জানে রে ||
না লো না লো মিছে বলি    যামিনী গিয়াছে চলি,
ফিরিবে না ফিরিবে না,      ফিরিবার নয় লো।
ওই দেখ নীল নিশি          মৃদু আলো সনে মিশি
ফিরিছে বিঘোর আলো,      চারিদিক ময় লো ||

অসীম আকাশে পশি,         নাহি রবি নাহি শশী,
গগনে নিভেছে যেন,          যত তারচয় লো।
কি বলি গগনোপরে,          একাকী মধুর করে,
প্রভাতের সুখতারা,           কিবা শোভা হয় লো ||
এখনি আকাশোপর,           প্রকাশিবে প্রভাকর,
এখনি যাইব কোথা,           ভেবে হৃদি দয় লো।
আসি লো আসি লো  প্রিয়ে, আসি লো বিদায় নিয়ে,
চলিলাম কতদূরে             কি কপালে রয় লো ||
যথা যাব তথা রব,           প্রেমডোরে বাঁধা তব,
অন্তরে অন্তরে বাঁধা,         প্রণয়েরি পাশে লো।
স্বপনে নয়নে মনে,           হেরিব সে চন্দ্রাননে,
হেরিব সে বিধুমুখ,           মৃদু মৃদু হাসে লো ||
তোমা চিন্তা সর্ব্বক্ষণে,       শয়নে স্বপনে মনে,
এক আশে রবে প্রাণ,        ফিরি দেখা আশে লো।
সুখ শশী হলে হারা,         একা প্রভাতের তারা,
হবে মোর অন্ধকার,         হৃদয় আকাশে লো ||

স্ত্রী

ত্রিপদী

কেন আরে বিভাবরি,      পোহাইল মরি মরি,
পোহাইল দিবারে যাতনা।
কেন রে যামিনী ভাগে,    স্বপ্নে জানিবার আগে,
কেন কেন মরণ হলো না ||
জেনেছি জেনেছি আগে,    যখন যামিনী ভাগে,
হৃদি মোর হইল চঞ্চল।
তখন জেনেছি মনে,       পাইব প্রাণের জনে
যাবে মোর যা আছে সকল ||
তখনি ভেবেছি মনে    কেন কেন কি কারণে,
হৃদি চঞ্চল বিকল।
কেন রে অস্থির হিয়া,     ক্ষণে উঠি শিহরিয়া,
কেঁদে কেঁদে উঠিছে কেবল ||

প্রাণনাথ হৃদি পরে,        হৃদি পরশিলে পরে,
অস্থির হৃদয় হব স্থির।
স্বর্গসুখ সম হিয়ে,         তদুপরে হৃদি দিয়ে,
কত সুখে ঘুমাই গভীর ||
মরি মরি সে প্রকার,     যাইতে পাব না আর,
নিদ্রা তব হৃদির উপর।
হৃদিপরে হৃদি দিয়ে,      পয়োধরে পরশিয়ে,
জুড়াব না কাতর অন্তর?
সেখানে যতেক জ্বালা,   নাহি করে ঝালাপালা,
শুধু যত সুখের স্বপন।
আর কি মধুরাকার,     হেরিব না ফিরে বার,
শশধর সমান বদন ||
নয়নে নয়নে করি,         অধর অধরোপরি,
করিব না কি আর চুম্বন।
আর কি হে করে করে,    মিলাব না পরস্পরে,
স্কন্ধে কর করিয়ে ধারণ ||
না হে না হে সুখকাল,         হয়েছে অতীত।
বিরহ বারিধি মাঝে,            হয়েছে পতিত ||
জানি জানি সেই জ্বালা,      অহরহ ঝালা পালা,
করিবে আমারে মনে মনে।
না দেখে প্রিয়ের মুখ,        একেলা দহিবে বুক,
মনাগুনে গোপনে গোপনে ||
শুধু প্রাণনাথ আশা,        রবে এক হৃদে আশা,
সপ্রবল শয়নে স্বপনে।
আসা দিন অনুরাগী,       রব প্রাণে তার লাগি,
শুধু সেই দিন আশামনে ||
যেন রবে বিভাবরী,         তমসা বসন পরি,
শশধর না করে প্রকাশ।
যদ্যপি তাহারোপরে,         ভয়ঙ্কর জলধরে,
তাহা সহ ঢাকয়ে আকাশ ||

নিবিড় তিমিরময়,            শুধু দরশন হয়,
শশী তারা নাহিক আকাশে।
শুধু ভেদি জলধর,          যদি হয় ক্ষীণ কর,
এক তারা একাকী বিকাসে ||
তেমতি আমার বুকে,       অন্ধকার দুখে দুখে,
গেছে যত আশা যত সুখ।
শুধু প্রাণনাথ আসা        তারি প্রাণ ভরা আশা,
একাকী বিহরে মোর বুক ||
সে সুখ বাসর কবে,        বল বল কবে হবে,
কবে হবে ফিরে দরশন।
করি তাহা জপমালা          ভুলিব বিরহ জ্বালা
যদি পারি ভুলিতে রতন ||

পতি

চৌপদী

যদি দেহে প্রাণ ধরি        আসিব হে ত্বরা করি,
তোরে ফেলে প্রাণে মরি,   রহে না লো রহে না।
অন্তরে প্রণয় ডোরে,       যে দৃঢ় গেঁথেছে মোরে,
প্রাণেতে ত্যজিতে তোরে,  সহে না লো সহে না।
কিন্তু লো তরুণ করে,     প্রকাশিল প্রভাকরে,
আর কথা পরস্পরে       কহে না লো কহে না।
তবে যাই সুনয়নি,         যাইলো হৃদয় মণি,
যাই কিন্তু পদ ধনি,        বহে না লো বহে না ||
-‘সংবাদ প্রভাকর’, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৩

Leave a Reply