» » পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

মনসাপুরের জমিদার ব্রজবিহারী রায় কাঁচারী কক্ষে বসে ধূমপান করছিলেন। ললাটে তাঁর। গম্ভীর চিন্তারেখা। তাঁর একমাত্র কন্যার অসুস্থতার জন্য আজ সমস্ত মনসাপুরে একটা অশান্তির কালো ছায়া বিরাজ করছে। কত ডাক্তার কবিরাজ এলো, সবাই বিফল হয়ে ফিরে গেছে। কেউ সুভাষিণীকে আরোগ্য করতে সক্ষম হলো না।

ব্রজবিহারী রায়ের মনে শান্তি নেই। কন্যার অসুস্থতার জন্য তিনিও একরকম আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছেন। স্ত্রী জ্যোতির্ময়ী দেবীর অবস্থাও তাই। সুভাষিণীর জন্য তাঁরা অবিরত অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন।

আজ দুদিন হলো সুভাষিণীর অবস্থা আরও খারাপ। ব্রজবিহারী রায় কাঁচারী কক্ষে বসে কন্যা সম্বন্ধে চিন্তা করছিলেন, এমন সময় দারোয়ান এসে জানাল–বাবু, একজন ডাক্তার এসেছেন, দিদিমণিকে চিকিৎসা করতে চান।

ব্রজবিহারী বাবু প্রথমে কথাটা কানেই নিলেন না। কারণ তার কন্যার অসুস্থতার কথা শুনা পর্যন্ত মোটা টাকার লোভে কত ডাক্তারই এলেন আর গেলেন তার ঠিক নেই। তবু তাচ্ছিল্য করে বলেন–নিয়ে এসো।

একটু পরে ডাক্তারসহ দারোয়ান কক্ষে প্রবেশ করলো। ব্রজবিহারী বাবু দারোয়ানকে বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। দারোয়ান কুর্ণিশ জানিয়ে বেরিয়ে যেতেই ব্রজবিহারী বাবু সূতীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালেন ডাক্তারের দিকে।

ডাক্তারের উজ্জ্বল দীপ্ত চেহারা ব্রজবিহারী বাবুর মনে শ্রদ্ধার রেখা টানল। বিশেষ করে প্রৌঢ় ডাক্তারের গভীর নীল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে তাকে উপেক্ষা করতে পারলেন না রায়বাবু।

উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানিয়ে নিজের পাশে বসালেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার কন্যা সম্বন্ধে আপনি সব শুনেছেন?

আমি শুধু শুনেছি আপনার কন্যা অসুস্থ, তাকে আরোগ্য করার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন।

ওঃ আপনি তাহলে আমার কন্যার সম্বন্ধে না জেনেই এসেছেন?

হ্যাঁ, আমি আপনার কন্যার রোগ সম্বন্ধে কিছু জানি না। যদি দয়া করে তার অসুখ সম্বন্ধে আমাকে বলেন তাহলে আমার পক্ষে সুবিধা হবে।

তবে শুনুন।

বলুন?

ব্রজবিহারী বাবু কতটা আনমনা হয়ে পড়লেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলেন–ডাক্তার আমার ঐ একটা মাত্র মেয়ে। আজ সে মরণের পথে এগিয়ে চলেছে। যেমন করে হউক ওকে বাঁচাতেই হবে ডাক্তার। আপনি যত টাকা চান কন্যার জীবনের বিনিময়ে আমি আপনাকে তাই দেব।

তার অসুখ সম্বন্ধে জানতে চাইছি রায়বাবু।

বলছি, একটা ঢোক গিলেন ব্রজবিহারী রায়, চোখ দুটো তার ছলছল হয়ে ওঠে। ধীরকণ্ঠে বলেন–আজ প্রায় বছর হয়ে এলো আমার কন্যা পুষ্পগঞ্জে তার মাতুলালয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে আসতে তার রাত হয়ে যায়। পাল্কী করেই ফিরছিল সে। তার সঙ্গে ছিল কয়েকজন বন্দুকধারী পাহারাদার আর একজন ঝি। পথে দস্যুর কবলে পড়ে পাহারাদারগণ নিহত হয়। ঝিটাও মারা পড়ে কিন্তু ভগবানের অশেষ কৃপায় আমার কন্যাকে একজন পথিক রক্ষা করেন।

তারপর?

তারপর সুভাকে সেই ভদ্রলোকই বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। কি জানি ডাক্তার, তারপর থেকে আমি লক্ষ্য করেছি–আমার সুভা যেন কেমন হয়ে গেছে। তার মুখে হাসি নেই, সময়মত নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। সব সময় কেমন যেন আনমনা ভাব। অনেক চিকিৎসা করলাম কিন্তু মেয়ের আমার কোন পরিবর্তন হয় না। আমার পুত্রবধূর পরামর্শে বিয়ে দেব ঠিক করলাম কিন্তু কি হল জানেন?

বলুন?

যেদিন বিয়ে তার আগের রাতে সুভা পালাল।

ডাক্তার স্তব্ধ নিঃশ্বাসে শুনে যাচ্ছেন। ব্রজবিহারী রায়ের কথাগুলো তিনি মনে মনে গভীরভাবে তলিয়ে দেখছেন, ব্যথিত পিতার অন্তরের ব্যথা ডাক্তারের হৃদয়ে আঘাত করতে লাগলো বলেন–বলুন তারপর?

কদিন তার কোন সন্ধান পেলাম না। ওর মা তো ভীষণ কান্নাকাটি শুরু করলো। হঠাৎ একদিন তাকে পেলাম। কে এক জন ভদ্রলোক তাকে অজ্ঞান অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে ছিলেন। খবর পেয়ে তাকে নিয়ে এলাম বাড়িতে কিন্তু আসার পর সে আর কারও সঙ্গে কথা বলে না। জোর করে দুটি খাওয়াতে হয়, জোর করে স্নান করাতে হয়। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন বলে বুঝা যায় না।

ডাক্তার সোজা হয়ে বসলেন, আগ্রহভরা কন্ঠে বলেন–এখনও সে ঐ রকম অবস্থায় আছে?

হ্যাঁ, ডাক্তার, এখনও ঠিক ঐ অবস্থায় রয়েছে। চলুন তাকে দেখবেন।

ব্রজবিহারী রায় উঠে অন্দরবাড়ির দিকে এগুলেন। ডাক্তার তাঁকে অনুসরণ করলেন। কিন্তু মনে তার এক গভীর চিন্তা জোট পাকাচ্ছিল। এসব কথা মানে কি? জমিদার বাবু যা বলছেন তা যেন অত্যন্ত জটিল রহস্যজনক।

ডাক্তার জমিদার ব্রজবিহারী রায়ের সঙ্গে সুভাষিণীর কক্ষে প্রবেশ করলেন।

আঁচলে মুখ ঢেকে বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে একটি মহিলা। ডাক্তার বুঝতে পারলেন মহিলাটি অন্য কেউ নয়–জমিদার কন্যা সুভাষিণী।

ব্রজবিহারী রায় এবং ডাক্তার সুভাষিণীর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। পদশব্দে মুখের আঁচল সরালো না সুভাষিণী। যেমন শুয়ে ছিল তেমনি রইল। ডাক্তার একটু কেশে শব্দ করলেন মনে করলেন রোগী এবার নিশ্চয়ই মুখের অবারণ উন্মোচন করবে কিন্তু কই, যেমনকার তেমনি রইল সুভাষিণী।

রায়বাবু বলেন–জোর করে তার মুখের কাপড় সরাতে হয় নইলে ও নিজে কখনও সরায় না।

ডাক্তার বলেন–ডেকে দেখুন একবার।

রায়বাবু কন্যার গায়ে হাত রেখে ডাকলেন–সুভা, সুভা! মা এই দেখ কে এসেছেন।

এতটুকু নড়লো না সুভাষিণী।

জমিদার বাবু কন্যার মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেললেন।

চমকে উঠলেন ডাক্তার। মুখের আবরণ উন্মোচিত হওয়ায় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল সুভাষিণী। কেমন উদাস করুন চাহনি।

ডাক্তার বিস্ময়াবিষ্টের মত তাকিয়ে রইলেন।

ব্রজবিহারী বাবু কন্যার অবস্থা দর্শনে মুখ ফিরিয়ে নিলেন পিতৃহৃদয় ব্যথায় খান খান হয়ে যেতে লাগল। একমাত্র কন্যা এ অবস্থায় রায়বাবু অস্থির হয়ে পড়েছেন। ডাক্তারকে লক্ষ্য করে। বলেন–ডাক্তার বাবু সুভা সেরে উঠবে তো?

ডাক্তার গভীরভাবে যেন কি চিন্তা করছিলেন। রায়বাবুর কথায় সম্বিৎ ফিরে পান, বলেন– উঃ কি বলেন?

বললাম আমার সুভা সুস্থ হবে তো?

হবে রায়বাবু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আপনাকে কথা দিলাম আপনার কন্যা সুভাকে সুস্থ করবই।

ডাক্তার! অস্কুট ধ্বনি করে ওঠেন ব্রজবিহারী রায়।

হ্যাঁ রায়বাবু, আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।

ডাক্তার আপনি যা চাইবেন তাই আপনাকে দেব। আমার কন্যাকে সুস্থ করে তুলুন।

সুভাষিণী তখন আবার মুখের আবরণ টেনে দিয়েছিল।

ডাক্তার নিস্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করলেন, তারপর বলেন–আপনার মেয়ের কাছে সব সময় কে বেশি থাকেন বলতে পারেন?

আমার বৌমা থাকে ওর পাশে।

একবার যদি তাঁকে ডাকতেন আমি কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব।

বেশ ডাকছি। রায়বাবু কিঞ্চিৎ উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন–বৌমা, বৌমা, একবার এদিকে এসো তো মা।

অল্পক্ষণেই দরজার ওপাশে চুড়ির মৃদু শব্দ হলো। পর মুহূর্তেই কক্ষে প্রবেশ করেন এক বধূ। পরনে লাল চওড়া পেড়ে শাড়ি। ললাটে সিঁদুরের ফোঁটা। স্থিরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ মা। ইনি ডাক্তার সুভাকে দেখতে এসেছেন। তোমাকে ইনি কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবেন। তারপর ডাক্তারকে লক্ষ্য করে বলেন–আমার পুত্রবধূ চন্দ্রাদেবী। আপনি এর কাছে যা জানতে চান জানতে পারেন।

চন্দ্রাদেবী নতদৃষ্টি তুলে তাকাল ডাক্তারের মুখের দিকে। ডাক্তার ব্রজবিহারী রায়কে লক্ষ্য। করে বলেন– আপনি দয়া করে একটু বাইরে যেতে পারেন কি? আমি উনাকে….

বেশ বেশ, আমি বাইরে যাচ্ছি। ব্রজবিহারী বাবু বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

ডাক্তার এবার তাকালেন চন্দ্রাদেবীর মুখের দিকে। তারপর গম্ভীর মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব, তার ওপর নির্ভর করছে সুভাষিণী দেবীর চিকিৎসা। আশা করি আপনি সঠিক জবাব দেবেন।

নিশ্চয়ই দেব।

সুভাষিণী দেবীর নিকটে বেশি সময় আপনিই থাকেন, তাই না?

হ্যাঁ।

এর অবস্থা কদিন হলো এরকম হয়েছে?

একদিন এক ডাকাতের হাতে পড়ে…

ওসব কাহিনী আমি রায়বাবুর মুখে শুনেছি। এবার জানতে চাই, আপনার কি মনে হয় এর সম্বন্ধে?

কিছু ভাবতে থাকে চন্দ্রাদেবী। কারণ সে জানে, যে ভদ্রলোক তাকে সেদিন ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করেছিল সে স্বাভাবিক লোক নয়–দস্যু। একথা জেনেও এতদিন সে সকলের নিকটে গোপন করে এসেছে। কিন্তু আজ ডাক্তারের সামনে আর গোপন রাখতে পারলো না। আসল কথা না বললে হয়তো এর পরিণতি খারাপ হতে পারে। কি জানি কেন অন্যান্য ডাক্তারের চেয়ে এই ডাক্তারের প্রতি বিশ্বাস জন্মালো চন্দ্রাদেবীর। তাছাড়া কোন উপায় তো নেই। সুভাষিণীকে বাঁচাতে হলে কথাটা আর গোপন রাখা চলে না।

ডাক্তার চন্দ্রাদেবীকে নিপ দেখে জকুঞ্চিত করে বলেন–কি ভাবছেন? দেখুন, আমার নিকটে কিছু গোপন করতে চাইলে ভুল করবেন।

না না, আমি কিছু গোপন করব না–সব বলছি।

বসুন, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলেন ডাক্তার–বসুন, এইখানে বসে বলুন।

ডাক্তার নিজেও বসেন একটা চেয়ারে। ওপাশে তাকিয়ে দেখলেন তিনি সুভাষিণী পূর্বের ন্যায় চোখে মুখে কাপড় ঢাকা দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। এবার প্রশ্ন ভরা দৃষ্টি মেলে তাকালেন চন্দ্রাদেবীর মুখের দিকে, একি! চন্দ্রাদেবীর ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম চক চক করছে তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন বেশ ঘাবড়ে গেছে। হেসে বলেন ডাক্তার–আপনি স্বচ্ছন্দে বলুন, ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই।

বলছি, দেখুন ডাক্তার বাবু, আমার মনে হয় সুভা তাকে ভালবেসে ফেলেছে।

স্বচ্ছ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেন ডাক্তার–কাকে?

একটা ঢোক গিলে বলে চন্দ্রাদেবী–যিনি সেদিন সুভাকে ডাকাতের হাত থেকে বাঁচিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন।

মুহূর্তে ডাক্তারের হাস্যোজ্জ্বল মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে গেল। চমকে উঠলেন ডাক্তার। স্থিরকণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন কাকে ভালবেসে ফেলেছে সুভাষিণী?

ঐ যে বললাম, সেদিন যে ভদ্রলোক ওকে ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তাকে।

এ কথা আপনি কেমন করে জানলেন?

আমাকে সুভা বলেছিল।

চন্দ্রাদেবী, সুভাষিণী আপনাকে যা বলেছে খুলে বলুন দেখি?

বলতে পারি কিন্তু …

কিন্তু নয়–বলুন, কিছু গোপন করবেন না।

চন্দ্রাদেবী একবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল। তারপর গলার স্বর খাটো করে নিয়ে বলতে শুরু করলো–ডাক্তার বাবু সুভা বলেছে যাকে সে ভালবাসে সে স্বাভাবিক লোক নয়। সে নাকি থেমে যায় চন্দ্রাদেবী।

ডাক্তার ব্যাকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন–বলুন বলুন?

সে নাকি দস্যু বনহুর।

ডাক্তারের দৃষ্টি ধীরে ধীরে নত হয়ে যায়।

চন্দ্রাদেবী বলে কি, এও কি সম্ভব। অস্ফুট কন্ঠে বলে ওঠেন ডাক্তার-না না, এ হতে পারে না–দস্যু বনহুরকে ভালবাসা অসম্ভব।

চন্দ্রাদেবী ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে–বিস্ময়ভরা নয়নে তাকায় তার দিকে তারপর বলে সে–ডাক্তার বাবু আমিও ওকে একথা বারবার বলেছি যা সম্ভব নয়, তা চিন্তা করাও উচিত নয়। কিন্তু কিছুতেই সুভা তাকে ভুলতে পারছে না। ওর গোটা অন্তর জুড়ে ঐ একটি ছবি আঁকা রয়েছে–সে ঐ বনহুর। জেগেও সে তাকে স্বপ্নে দেখে। অস্ফুট স্বরে তারই নাম উচ্চারণ করে। ডাক্তার বাবু, আমি এতদিন সকলের কাছে কথাটা গোপন রেখেছিলাম কিন্তু আজ আপনার কাছে না বলে পারলাম না। আপনি যদি দয়া করে কিছু করতে পারেন।

অন্যমনস্কভাবে ডাক্তার বলেন–হুঁ।

চন্দ্রাদেবী তখন বলে চলে–ডাক্তার বাবু সুভার মনের যে অবস্থা, তাতে মনে হয় ও আর বাঁচবে না।

ডাক্তার এবার দৃষ্টি তুলে ধরেন চন্দ্রাদেবীর মুখের দিকে। গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করেন। তিনি। তারপর উঠে দাঁড়ান। আচ্ছা, আজকের মত তাহলে চলি।

ততক্ষণে ব্রজবিহারী রায় কক্ষে প্রবেশ করেন সব শুনেছেন তো?

শুনেছি।

আমার কন্যা আরোগ্য লাভ করবে তো?

পরে জানাব। ডাক্তার দরজার দিকে পা বাড়ান।

ব্রজবিহারী রায় পেছন থেকে পুনরায় বলে ওঠেন–শুনুন ডাক্তার বাবু সুভাকে কেমন দেখলেন বললেন না তো।

থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালেন ডাক্তার। তারপর ইতস্তত করে বলেন–পরে জানতে পারবেন।

আজ কিছুই বলবেন না?

না।

আবার কবে আসবেন? ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন ব্রজবিহারী রায়।

ডাক্তার আবার ফিরে এলেন চন্দ্রাদেবী আর ব্রজবিহারী রায়ের পাশে। স্থিরকণ্ঠে বললেন– সময় হলেই আবার আসব।

ব্রজবিহারী রায় পকেট থেকে একশ টাকার একখানা নোট বের করে বাড়িয়ে ধরলেন– এই নিন আপনার ফিস।

ডাক্তার হেসে বলেন–আজ কিছুই লাগবে না। আপনার কন্যাকে সুস্থ করতে পারলে দেবেন। কথাটা শেষ করে বেরিয়ে যান ডাক্তার।

ব্রজবিহারী রায় আশ্চর্য কণ্ঠে বলেন–অদ্ভুত লোক! ফিস পর্যন্ত নিল না।

চন্দ্রাদেবীও ডাক্তারের ব্যবহারে কম অবাক হয়নি। অন্যান্য ডাক্তারের চেয়ে এ ডাক্তার যেন আলাদা। ওর দৃষ্টির কাছে চন্দ্রাদেবী নিজকে সঙ্কোচিত মনে করছিল। কেন যেন একটা কথাও তার কাছে গোপন করতে পারল না। কথাটা বলা ঠিক হলো কিনা বুঝতে পারে না চন্দ্রাদেবী। শ্বশুরের কথায় কোন জবাব দিতে পারলো না সে।

মনিরা গভীরভাবে চিন্তা করে সন্ন্যাসী তাকে এভাবে এখানে আটকে রেখেছে কেন? এতে কি লাভ তার? এখানে তাকে আটকে রাখার উদ্দেশ্য কি?

মনিরা এখানে আসার পর এতটুকু অসুবিধা হয়নি তার। সে কিছু না চাইতেই হাতের কাছে সব পেয়েছে। এমনকি মনিরা বীণা বাজাতে পারত–একটা বীণাও সাজানো রয়েছে সেই কক্ষে। মনিরার মনে যখন অসহ্য ব্যথা জেগে উঠত তখন সে বীণা নিয়ে বসত।

প্রায়ই নিশীথ রাতে সে বীণায় ঝংকার তুলত। এক করুণ সুরে গোটা পোড়াবাড়ি আচ্ছন্ন হয়ে যেত গহন বনের পাতায় পাতায় ঝড়ে পড়া শিশির বিন্দুর টুপটাপ শব্দের সঙ্গে বীণার সুর মিশে এক অপরূপ মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হত।

নিঃসঙ্গ জীবন মনিরার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল। যদিও এখানে তাকে কেউ বিরক্ত করতে আসত না। মুরাদের লালসাপূর্ণদৃষ্টি থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, নাথুরামের কঠোর নির্যাতন থেকে অব্যাহতি পেয়েছে, তবু একটা ভয় ভীতি আর আশংকা মনিরার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এখনও সে বন্দিনী। মামা মামীমার এবং আত্মীয় স্বজনের নিকটে এখনও সে অজ্ঞাত রয়েছে। কেউ তার সন্ধান জানে না।

মনিরা ভাবে, সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই কোন পুলিশের লোক। নইলে সেদিন পুলিশ আসবে কোথা থেকে। শয়তান মুরাদকে গ্রেপ্তারই বা করে নিয়ে যাবে কেন। কিন্তু সে যদি পুলিশের লোকই হবে তবে তাকে মামা মামীর নিকটে পৌঁছে না দিয়ে এখানে আটক রাখার মানে কি! নিশ্চয়ই সে কোন অভিপ্রায়ে তাকে এই পোড়াবাড়ির মধ্যে এনে রেখেছে।

মনিরা অসহ্য বেদনায় দগ্ধিভূত হতে থাকে।

একদিন নিশীথ রাতে জানালার পাশে বসে করুণ সুরে বীণা বাজাচ্ছিল মনিরা। নিজের সুরে নিজেই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।

কখন যে তার পেছনে সন্ন্যাসী বাবাজী এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল নেই মনিরার। আনমনে সে বীণার তারে হাত বুলিয়ে চলেছে হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শে মনিরার ঝংকার স্তব্ধ হয়ে যায়। চমকে ফিরে তাকায় মনিরা। তাঁর কাঁধে হাত রেখে সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সন্ন্যাসীর মুখে হাসির রেখা।

মনিরা দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। তারপর কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে সন্ন্যাসীর দিকে। সে দৃষ্টিবাণ যেন সন্ন্যাসী বাবাজীর হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু কি আশ্চর্য। মনিরার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি বাণে সন্ন্যাসী এতটুকু বিচলিত হন না বরং তিনি আরও এগিয়ে আসেন মনিরার দিকে। হেসে বলেন বৎস ভয় পেয়েছ। এসো, আমার হাতের ওপর হাত রেখ।

না।

কেন?

মনিরা কোন জবাব দেয় না।

সন্ন্যাসী বলেন–তোমার বীণার সুর আমাকে টেনে এনেছে। আমার ধ্যান ভঙ্গ করে দিয়েছে। তোমার ঐ বীণার ঝংকার।

মনিরার দু’চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বের হয়। পিছু হটতে থাকে সে। মনে মনে নিজকে ধিক্কার দেয়–কেন সে বীণা বাজাতে গিয়েছিল? কেন সে সন্ন্যাসীর ধ্যান ভঙ্গ করল? সন্ন্যাসী তখন তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

মনিরা শিউরে ওঠে।

কিন্তু সন্ন্যাসী তখন এত কাছে এসে পড়েছেন যে, মনিরা আর নড়তে পারে না। চট করে মনিরার দক্ষিণ হাতখানা বলিষ্ঠ হাতের মুঠায় চেপে ধরেন সন্ন্যাসী। তারপর মৃদু হেসে বলেন– এখন?

মনিরা চিৎকার করে ওঠে–ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন আমার হাত।

সন্ন্যাসী হেসে বলেন–না, কিছুতেই না।

মনিরা রাগে অধর দংশন করে বলে–শয়তান। সন্ন্যাসী সেজে আমার সর্বনাশ করতে এসেছ? মনিরা দু’হাতে সন্ন্যাসীর জটাজুট টেনে ধরে।

সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসীর মাথা থেকে জটাজুট আর মুখ থেকে দাঁড়ি গোঁফ খসে পড়ে।

মনিরা অস্ফুটধ্বনি করে ওঠে–তুমি!