জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

নজরুল

পদ্মানদীর তীরে আমাদের বাড়ি। সেই নদীর তীরে বসিয়া নানা রকমের কবিতা লিখিতাম, গান লিখিতাম, গল্প লিখিতাম। বন্ধুরা কেউ সে সব শুনিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন, কেউ-বা সামান্য তারিফ করিতেন। মনে মনে ভাবিতাম, একবার কলিকাতায় যদি যাইতে পারি, সেখানকার রসিক-সমাজ আমার আদর করিবেনই। কতদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখিয়াছি, কলিকাতার মোটা মোটা সাহিত্যিকদের সামনে আমি কবিতা পড়িতেছি। তাহারা খুশি হইয়া আমার গলায় ফুলের মালা পরাইয়া দিতেছেন। ঘুম হইতে জাগিয়া ভাবিতাম, একটিবার কলিকাতা যাইতে পারিলেই হয়। সেখানে গেলেই শত শত লোক আমার কবিতার তারিফ করিবে। কিন্তু কি করিয়া কলিকাতা যাই। আমার পিতা সারা জীবন ইস্কুলের মাস্টারী করিতেন। ছেলেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে এইরূপ আকাশকুসুম চিন্তা করে, তিনি জানিতেন। কিছুতেই তাহাকে বুঝানো গেল না, আমি কলিকাতা গিয়া একটা বিশেষ সাহিত্যিক খ্যাতি লাভ করিতে পারি। আর বলিতে গেলে প্রথম প্রথম তিনি আমার কবিতা লেখার উপরে চটা ছিলেন। কারণ পড়াশুনার দিকে আমি বিশেষ মনোযোগ দিতাম না, কবিতা লিখিয়াই সময় কাটাইতাম। তাতে পরীক্ষার ফল সব সময়ে ভাল হইত না।

তখন আমি প্রবেশিকার নবম শ্রেণীতে কেবলমাত্র উঠিয়াছি। চারিদিকে অসহযোগ-আন্দলনের ধুম। ছেলেরা ইস্কুল-কলেজ ছাড়িয়া স্বাধীনতার আন্দোলনের নামিয়া পড়িতেছে। আমিও স্কুল ছাড়িয়া বহু কষ্ট করিয়া কলিকাতা উপস্থিত হইলাম।

আমার দূর সম্পর্কের এক বোন কলিকাতায় থাকিতেন। তাঁর স্বামী কোন অফিসে দপ্তরীর চাকুরী করিয়া মাসে কুড়ি টাকা বেতন পাইতেন। সেই টাকা দিয়া অতি কষ্টে তিনি সংসার চালাইতেন। আমার এই বোনটিকে আমি কোনদিন দেখি নাই। কিন্তু অতি আদরের সঙ্গেই হাসিয়া তিনি আমাকে গ্রহণ করিলেন। দেখিয়াই মনে হইল, যেন কত কালের স্নেহ আদর জমা হইয়া আছে আমার জন্য তাঁহার হৃদয়ে। বৈঠকখানা রোডের বস্তিতে খোলার ঘরের সামান্য স্থান লইয়া তাঁহাদের বাসা। ঘরে সঙ্কীর্ণ জায়গা, তার মধ্যে তাদের দুইজনের মতন চৌকিখানারই শুধু স্থান হইয়াছে। বারান্দায় দুই হাত পরিমিত একটি স্থান, সেই দুই হাত জায়গা আমার বোনের রান্নাঘর। এমনি সারি সারি সাত-আট ঘর লোক পাশাপাশি থাকিত। সকাল-সন্ধ্যায় প্রত্যেক ঘরে কয়লার চুলা হইতে যে ধূম বাহির হইত, তাহাতে ওইসব ঘরের অধিবাসীরা যে দম আটকাইয়া মরিয়া যাইত না—এই বড় আশ্চর্য মনে হইত। পুরুষেরা অবশ্য তখন বাহিরে খোলা বাতাসে গিয়া দম লইত, কিন্তু মেয়েরা ও ছোট ছোট বাচ্চাশিশুরা ধুয়ার মধ্যেই থাকিত। সমস্তগুলি ঘর লইয়া একটি পানির কল। সেই কলের পানিও স্বল্প-পরিমিত ছিল। সময়মত কেহ স্নান না করিলে সেই গরমের দিনে তাহাকে অস্নাত থাকিতে হইত। রাত্রে এঘরে-ওঘরে কাহারও ঘুম হইত না। আলো-বাতাস বঞ্চিত ঘরগুলির মধ্যে যে বিছানা-বালিস থাকিত, তাহা রৌদ্রে দেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। সেই অজুহাতে বিছানার আড়ালে রাজ্যের যত ছারপোকা অনায়াসে রাজত্ব করিত। রাত্রে একে তো গরম, তার উপর ছারপোকার উপদ্রব। কোন ঘরেই কেহ ঘুমাইতে পারি না। প্রত্যেক ঘর হইতে পাখার শব্দ আসিত, আর মাঝে মাঝে ছারপোকা মারার শব্দ শোনা যাইত। তা ছাড়া প্রত্যেক ঘরের মেয়েরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে পরদা মানিয়া চলিত, অর্থাৎ পুরুষেরাই যার যার ঘরে আসিয়া পর্দায় আবদ্ধ হইত। প্রত্যেক বারান্দায় একটি করিয়া চটের আবরণী। পুরুষলোক ঘরে আসিলেই সেই আবরণী টাঙাইয়া দেওয়া হইত। দুপুরবেলা যখন পুরুষেরা অফিসের কাজে যাইত, তখন এঘরের ওঘরের মেয়েরা একত্র হইয়া গাল-গল্প করিত, হাসি-তামাসা করিত, কেহ-বা সিকা বুনিত, কেহ কাঁথা সেলাই করিত। তাদের সকলের হাতে রঙবেরঙের সূতাগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া নক্সায় পরিণত হইত। পাশের ঘরের সুন্দর বউটি হাসিয়া হাসিয়া কখন ও বিবাহের গান করিত, বিনাইয়া বিনাইয়া মধুমালার কাহিনী বলিত। মনে হইত, আল্লার আসমান হইতে বুঝি এক ঝলক কবিতা ভুল করিয়া এখানে ঝরিয়া পড়িয়াছে।

এ হেন স্থানে আমি অতিথি হইয়া আসিয়া জুটিলাম। আমার ভগ্নীপতিটি ছিলেন খাঁটি খোন্দকার বংশের। পোলাও-কোর্মা না খাইলে তাহার চলিত না। সুতরাং মাসের কুড়ি টাকা বেতন পাইয়া তিনি পাঁচটাকা ঘরভাড়া দিতেন। তারপর তিন-চার দিন ভাল গোস্ত-ঘি কিনিয়া পোলাও-মাংস খাইতেন। মাসের অবশিষ্ট কোন কোন দিন খাইতেন, কোন দিন বা অনাহারে থাকিতেন।