জসীম উদ্দীন
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
অবন ঠাকুরের দরবারে
কলিকাতা গেলেই আমি কল্লোল-আফিসে গিয়া উঠিতাম। সেবার কলিকাতা গেলে কল্লোলের সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ আমাদের সকলকার দীনেশদা বলিলেন অবনীন্দ্রনাথ তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। কাল তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। কল্লোলে প্রকাশিত তোমার মুর্শিদা-গান প্রবন্ধটি পড়ে তিনি খুশি হয়েছেন।–
পরদিন সকালে আমরা ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। ঠাকুরবাড়ির দরজায় আসিয়া দীনেশদা কার্ডে নাম লিখিয়া দরওয়ানের হাতে উপরে পাঠাইয়া দিলেন। আমি উপরে ওঠার সিঁড়ির সামনে দাঁড়াইয়া নানা কথা ভাবিতে লাগিলাম। এই সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি—প্রবাসীতে যার ‘শেষ বোঝা’ চিত্র দেখিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়া দিয়াছি। সীমাহীন মোহময় মরুপ্রান্তরে একটি উট বোঝার ভারে নুইয়া পড়িয়া আছে। সেই করুণ গোধুলির আসমানের রঙ আমার মনে কেমন যেন এক বিরহের উদাসীনতা আঁকিয়া দিত। রঙের আর রেখার জাদুকর সেই অবন ঠাকুরের সঙ্গে আজ আমার দেখা হইবে। উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ির দুই ধারে রেলিংয়ের উপর কেমন সুন্দর কারুকার্য। নানা রকমের ছবি। একপাশে একটি ঈগলপাখি। এরা যেন আমার সেই কল্পনাকে আরও বাড়াইয়া দিল।
কিছুক্ষণ পরে চাকর আসিয়া আমাদিগকে সেই সিঁড়ি-পথ দিয়া উপরে লইয়া গেল। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া একখানা ঘর পার হইয়া দক্ষিণ ধারের বারান্দা। সেখানে তিনটি বৃদ্ধলোক ডান ধারের তিনটি জায়গায় আরামকেদারায় বসিয়া আছেন। কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কোথাও টু-শব্দটি নাই। দুই জন ছবি আঁকিতেছেন, আর একজন বই পড়িতেছেন। প্রত্যেকের সামনে একটি করিয়া আলবোলা। খাম্বিরা তামাকের সুবাসে সমস্ত বারান্দা ভরপুর। ডানধারে উপবিষ্ট শেষ বৃদ্ধ লোকটির কাছে আমাকে লইয়া গিয়া দীনেশদা বলিলেন, ‘এই যে জসীম উদ্দীন। আপনি এর সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলেন।’
ছবি আঁকা রাখিয়া ভদ্রলোকটি বলিলেন, ‘এসো, এসো, সামনের মোড়টা টেনে নিয়ে বস।’
আমরা বসিলাম। দীনেশা আমার কানে কানে বলিলেন, ইনিই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর ওপাশে বসে ছবি আঁকছেন, উনি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি বই পড়ছেন, উনি সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরা তিনজনে সহোদর ভাই।
হুঁকোর নল হইতে মুখ বাহির করিয়া অবন ঠাকুর বলিলেন, ‘তোমার সংগৃহীত গানগুলি পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার প্রবন্ধে এর একটা গান উদ্ধৃত করেছি, এই যে–
এক কালা দতের কালি
যাদ্যা কলম লিখি,
আরো কাল চক্ষের মণি
যাদ্যা দৈনা দেখি—
এ গুলি ভাল, আরও সংগ্রহ কর। এক সময় আমি এর কতকগুলি সংগ্রহ করিয়েছিলাম।’
এই বলিয়া তিনি তার বইপত্র খুলিয়া একখানা নোট বই বাহির করিলেন। আমি দেখিয়া আশ্চর্য হইলাম, কত আগে অবনবাবু তার কোন ছাত্রের সাহায্যে যশোর ও নদীয়া জেলা হইতে অনেকগুলি মুর্শিদা-গান সংগ্রহ করাইয়াছেন।
দীনেশদা অবনবাবুকে, বলিলেন, ‘জসীমের মুর্শিদা-গানের সংগ্রহ আমার কাগজে ছাপিয়েছি। অনেকে বলে, এগুলো ছাপিয়ে কি হবে?’
অবনবাবু বলিলেন, ‘মশাই, ও সব লোকের কথা শুনবেন না। যত পারেন, এগুলো ছেপে যান। এর পরে এগুলো আর পাওয়া যাবে না।’
তারপর নানা রকমের গ্রাম-গানের বিষয়ে আলাপ হইল। কবিগান যাত্রাগান জারীগান কোথায় কি ভাবে গাওয়া হয়, কাহারা গায়, কোথায় কোন গাজীর গানের দল ভাল রূপকথা বলে, শিশুর আগ্রহ লইয়া তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। উত্তর দিতে আমার এমনই ভাল লাগিল!
কিশোর বয়স্ক একটি ছেলে আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। এক বৎসর আগে এর সঙ্গে আমার আলাপ হইয়াছিল। দীনেশদা প্রেসিডেন্সী কলেজে রবীন্দ্রনাথের “মুক্তধারা” বইখানার অভিনয় পরিচালনা করিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে আমি প্রেসিডেন্সী কলেজে গিয়া অভিনয় দেখি। আমার পাশে একটি ছোট্ট খোকা আসিয়া বসিল। অপরের সঙ্গে আলাপ করিবার তাহার কী আগ্রহ! সে-ই আমার সঙ্গে প্রথম কথা বলিল। আমি কোথা হইতে আসিয়াছি, কি করি ইত্যাদি। হয়ত সেই আলাপে নিজের পরিচয়ও দিয়াছিল। তার কথা একদম ভুলিয়া গিয়াছিলাম। খোকা আসিয়া আমার সঙ্গে আলাপ করিয়া সেই পরিচয়ের সূত্রটি ধরাইয়া দিল। অবনবাবুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া কল্লোল-অফিসে ফিরিয়া আসিলাম।
অবনবাবুর বাড়িতে যে গল্পটি বলিব ঠিক করিয়াছিলাম, সারাদিন মনে মনে তাহা আওড়াইতে লাগিলাম। এই গল্প আমি কতবার কত জায়গায় বলিয়াছি। সুতরাং গল্পের কোন কোন জায়গা শুনিয়া ঠাকুরবাড়ির শ্রোতারা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া যাইবেন, তাহা ভাবিয়া মনে মনে রোমাঞ্চিত হইতে লাগিলাম।
বিকালবেলা দীনেশদার জরুরী কাজ ছিল। আমাকে সঙ্গে লইয়া অবনবাবুর বাড়ি চলিলেন পবিত্রদা। সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়। অবনবাবুর বাড়ি আসিয়া দেখি—সে কী বিরাট কাণ্ড! রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রা-ঘরের হলে গল্পের আসর বসান হইয়াছে। বাড়ির যত ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী সকলে আসিয়া সমবেত হইয়াছে গল্প শুনিতে। অবনবাবুর দুই ভাই গগনেন্দ্রনাথ আর সমরেন্দ্রনাথ আগেই আসিয়া আসন গ্রহণ করিয়াছেন। আরও আসিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের সকল সুরের কাণ্ডারী আর সকল গানের ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ। গল্পের আসরের উপলক্ষ করিয়া হলটিকে একটু সাজান হইয়াছে। কথক ঠাকুরদের মত সুন্দর একটি আসনও রচিত হইয়াছে আমার জন্য।
এসব দেখিয়া আমার চোখ ত চড়কগাছ! সুদূর গ্রামদেশের লোক আমি। জীবনে দুই-এক বারের বেশী কলিকাতা আসি নাই। শহরে হাঁটিতে চলিতে কথা কহিতে জড়তায় জড়াইয়া যাই। আজ এই আসরে আমি গল্প বলিব কেমন করিয়া? আমার বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ করিতে লাগিল। আমার ভয়ের কথা পবিত্রদাকে বলিলাম। তিনি বলিলেন, “তুই কোন চিন্তা করিসনে। যা জানিস বলে যাবি। এঁরা খুব ভাল শ্রোতা।”
পবিত্রদা সাহস দিলেন। কিন্তু আমার ভয় আরও বাড়িয়া গেল। সভা-স্থলে অবনবাবু আসিলেন। তিনি সহাস্যে বলিলেন, “দেখ, তোমার গল্প শোনার জন্য কত লোক এনে জড় করেছি। রবিকাকেও ধরে আনতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি একটি কাজে অন্যত্র চলে গেলেন। এবারে তবে তুমি আরম্ভ কর।”
বলির পাঁঠার মত আমি সেই আসনে গিয়া বসিলাম। পবিত্রদা আমার পাশে। কিন্তু থাকিলে কি হইবে? সামনের দিকে চাহিয়া দেখি—রঙিন শাড়ীর ঝকমকি, সুগন্ধি গুঁড়ো আর সেণ্টের গন্ধ। আমার বুকের দুরুদুরু আরও বাড়িয়া গেল।
অবনবাবু তাড়া দিলেন, “এবার তবে আরম্ভ হোক রূপকথা।”
আমার তখনও কলিকাতার বুলি অভ্যস্ত হয় নাই। কিছুটা কলিকাতার কথ্য ভাষায়, আর কিছুটা আমার ফরিদপুরের ভাষায় গল্প বলিতে আরম্ভ করিলাম।
উত্তরে বন্দনা করলাম হিমালয় পর্বত,
যাহার হাওয়ায় কাঁপে সকল গাছের পাত।
পুবেতে বন্দনা করলাম পুবে ভানুশ্বর,
একদিকে উদয় গো ভানু চৌদিকে পশর।
পশ্চিমে বন্দনা করলাম মক্কা-মদিস্থান,
উদ্দেশ্যে জানায় গো সালাম মমিন মুসলমান।
দক্ষিণে বন্দনা করলাম ক্ষীরনদীর সাগর,
যেখানে বাণিজ্য করে চান্দ সওদাগর।
চার কোণা বন্দনা কইরা মধ্যে করলাম স্থিতি,
এখানে গাব আমি ওতলা সুন্দরীর গীতি।
গল্প বলিতে বলিতে গল্পের খেই হারাইয়া ফেলি। পরের কথা। আগে বলিয়া আবার সেই ছাড়িয়া-আসা কথার অবতারণা করি। দশ-পনের মিনিট পরে দিনুবাবু উঠিয়া গেলেন। সামনে শাড়ীর ঝকমকিতে দোলায়া কৌতুকমতীরা একে অপরের কানে কানে কথা বলিতে লাগিলেন। কেউ কেউ উঠিয়া গেলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতরেও পরিবর্তন হইতে লাগিল। কোন রকমে ঘামে নাহিয়া বুকের সমস্ত টিপটিপানি উপেক্ষা করিয়া গল্প শেষ করিলাম।
অবনবাবু বলিলেন, “বেশ হয়েছে।” কিন্তু কথাটা যে আমাকে শুধু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলিলেন, তাহা আর বুঝিতে বাকী রহিল না।
দেশে ফিরিয়া মোহনলালের কাছে পত্র লিখিলাম। আবার আমি তোমাদের বড়ি গিয়া গল্প বলিব। যতদিন খুব ভাল গল্প বলা না শিখিতে পারি, ততদিন কলিকাতা আসিব না।
গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া যেখানে যে যত ভাল গল্প বলিতে পারে, তাহাদের গল্প বলার ভঙ্গি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। ফরিদপুর ঢাকা তাহাদের ময়মনসিংহ জেলার যেখানে যে ভাল গল্প বলিতে পারে খবর পাইলাম, সেখানেই গিয়া উপস্থিত হইতাম। তারপর সেইসব গল্প বলার ভঙ্গি অনুকরণ করিয়া ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যে বসিয়া গল্প বলিবার অভ্যাস করিতে লাগিলাম। ছেলেদের খেলার মাঠের একধারে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আমার গল্পের আসর বসিত। অধুনা কবিখ্যাত আবু নইম বজলুর রশীদ আমার গল্পের আসরের একজন অনুরক্ত শ্রোতা ছিল। এইভাবে গল্পের মহড়া চলিতে লাগিল। দিনের পর দিন মাসের পর মাস। গল্প শুনিবার জন্য তখন কত জায়গায়ই না গিয়াছি। সুদূর ময়মনসিংহে ধনা গায়েনের বাড়ি গেলাম। কালীগঞ্জের মোজাফর গায়েনের বাড়ি গেলাম। টাকা খরচ করিয়া একদিন কালীগঞ্জের বাজারে তার গাজীর গানের আসর আহ্বান করিলাম।
মোজাফর গায়েনের গল্প বলার ভঙ্গিটি ছিল বড়ই চমৎকার। এক হাতে আশাসোটা আর একহাতে চামর লইয়া সে গল্পের গানের গোন গাইয়া দোহারদের ছাড়িয়া দিত। দোহারেরা সেই সুর লইয়া সমবেত কণ্ঠে সুরের-ধ্বনি বিস্তার করিত। তারপর ছড়ার মতো কাটাকাটা সুরে গল্পের কাহিনীগুলি বলিয়া যাইত। সুরে যে কথা বলিতে পারিত না, নানা অঙ্গভঙ্গী করিয়া চামর ঘুরাইয়া তাহা সে প্রকাশ করিত। দীনেশচন্দ্র সেন-সংকলিত ময়মনসিংহ-গীতিকায় সংগীত-রত সদলবলে মোজাফর গায়েনের একটি ফটো প্রকাশিত হইয়াছে। তাহা আমি কোন ব্যবসায়িক ফটোগ্রাফারকে দিয়া তোলাইয়া লইয়াছিল। এই ফটোতে তখনকার বয়সের আমারও একটি ছবি আছে।