পরিণাম-পর্ব
প্রথম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলামের পরবর্তী জীবনের ঘটনা বর্ণনা করিবার পূর্বে, বেলগাঁও বন্দরের একটি চিত্র এস্থলে পাঠকগণের হৃদয়ঙ্গম করিয়া দেওয়ার আবশ্যক হইয়াছে।
স্রোতোবাহিনী-সরিতের সৈকতসমন্বিত পশ্চিম তটে অর্ধবৃত্তাকারে বেলগাঁও বন্দর অবস্থিত। বন্দরের দক্ষিণ উপকণ্ঠে কোম্পাণির পাটের কারখানা ও অফিস ঘর। নাতিবৃহৎ অফিস-গ্রহ করগেট টিনে নির্মিত, দুই প্রকোষ্ঠে বিভক্ত; সদর দরজা দক্ষিণ মুখে। পশ্চিমের প্রকোষ্ঠে বড়বাবু নুরল এসলাম, পূর্ব-প্রকোষ্ঠে ছোটবাবু রতীশচন্দ্র সরকার কার্য করেন। প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুকে কোম্পানির মূলধন থাকে, তাহা পশ্চিম প্রকোষ্ঠে বড়বাবুর জিম্মায়। গ্রীষ্মকালে তটিনীর সৈকতসীমা পূর্বদিকে বহুদূর বিস্তৃত হয়, এইজন্যে এই সময় বন্দরে পানির বড়ই কষ্ট হয়। সদাশয় জুট ম্যানেজার সাহেব সর্বসাধারণের এই পানির কষ্ট নিবারণের জন্যে কোম্পানির অর্থে, অফিস ঘরের পশ্চিমাংশে একটি পুষ্করিণী খনন করিয়া দিয়াছেন। পুষ্করিণীর পূর্বে ও উত্তরে দুইটি শানবাঁধা ঘাট। পূর্বের ঘাট দিয়া অফিসের লোক ও উত্তরের ঘাট দিয়া সাধারণ লোক পানির জন্যে যাতায়াত করে। পশ্চিম পাড় নানাবিধ আগাছা লতাগুল্মে পূর্ণ, দক্ষিণ দিকে কোম্পানির ফলবান বৃক্ষের বাগান। অফিস ঘরের উত্তর দিকে অনতিদূরে বড়বাবুর বাসা। বাসার উত্তর প্রান্তে জুম্মা মসজিদ। মসজিদের বায়ু-কোণে বাজার, সোম ও শুক্রবারে বন্দরে হাট বসে। বন্দরের পশ্চিম অংশে থানার ঘর। তাহার পশ্চিম দক্ষিণে কিছু দূরে বারাঙ্গনা-পল্লী। রতীশবাবুর বাসা বন্দরের উপর সদর রাস্তার ধারে। তাঁহার চরিত্র মন্দ;—এক রক্ষিতা রাখিয়াছেন। উপার্জিত অর্থ তাহার সেবাতেই ব্যয়িত হয়। রতীশবাবু বড়বাবু অপেক্ষা কিছু বেশিদিনের চাকর। তিনি ধূর্তের শিরোমণি অসৎকার্যে তাঁহার অদম্য সাহস; মাসিক বেতন ১৫ টাকা। বড়বাবুর নিযুক্তির পূর্বে তিনি অসদুপায়ে ৫০, ৬০ টাকা উপার্জন করিতেন। যাচনদার দাগু বিশ্বাস পুরাতন চাকর। সে শয়তানের ওস্তাদ; মাসিক বেতন ৯ টাকা। বড়বাবু আসিবার পূর্বে তাহারও ৩০, ৩৫ টাকা আয় হইত। নিম্নপদে আরও ৩/৪ জন চাকর আছে। তাহাদের উপরি আয়ও ঐ অনুপাতে হইত। ভিজা পাট শুক্না বলিয়া চালাইয়া, ১০০ মণে একমণ করিয়া পাইকার বেপারীগণের নিকট দস্তুরী ও ঘুষ লইয়া দুষ্টেরা উল্লিখিতরূপে উপরি আয় করিত। এইরূপ করিয়া তাহারা কোম্পানির সমূহ টাকা ক্ষতি করিত। আবার ভিজা পাট চালান দেওয়ার দরুন অনেক সময় কলিকাতার ক্রয়মূল্য অপেক্ষা কমদরে কোম্পানির পাট বিক্রয় হইত। ইহাতেও কোম্পানির অনেক টাকা লোকসান হইত। নুরল এসলাম কার্যে নিযুক্ত হইয়া অল্পদিনেই ব্যবসায়ের অবস্থা বুঝিয়া উঠিলেন। নিমকহারাম চাকরদিগের বিশ্বাসঘাতকতায় কোম্পানি যে আশানুরূপ লাভ করিতে পারে না তিনি তাহা টের পাইয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন এবং দুষ্টদিগের কার্যের প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাতে অল্পদিনেই দুষ্টদিগের উপরি আয় বন্ধ হইয়া আসিল। বুভুক্ষিত আহারনিরত হিংস্র পশুর মুখের গ্রাস সরাইলে তাহারা যেমন রুখিয়া উঠে, ভৃত্যগণ নুরল এসলামের প্রতি প্রথমত সেইরূপ খড়গহস্ত হইল। শেষে তাঁহাকে জব্দ ও পদচ্যুত করিবার জন্য নানা ফন্দী পাকাইতে লাগিল। সেই সময় হইতে সামান্য খুঁটিনাটি ধরিয়া তাহারা তাঁহার বিরুদ্ধে আলোচনা আরম্ভ করিল। কিন্তু গত তিন বৎসরের মধ্যে নীচাশয়দিগের বাসনা পূর্ণ হইল না। এদিকে বিশ্বস্ততা ও ব্যবসায়নৈপুণ্যে উত্তরোত্তর নুরল এসলামের পদোন্নতি হইতে লাগিল। তিনি ছয়মাস কাতর থাকায় রতীশবাবু তাঁহার স্থলে কার্য করিয়াছিলেন। এই সময়ের মধ্যে অফিসের সমস্ত চাকরের উপরি আয়ের পুনরায় বিশেষ সুবিধা হইল, এজন্যে তাহারা রতীশবাবুর একান্ত অনুগত হইয়া পড়িল। ছয়মাস পরে রোগমুক্ত হইয়া নুরল এসলাম যখন পুনরায় কার্য গ্রহণ করিলেন, তখন অর্থ-পিশাচ ভৃত্যগণের মাথায় যেন আবার বজ্র পড়িল। তাহারা এখন হইতে প্রাণপণ চেষ্টায় নুরল এসলামের ছিদ্রান্বেষণে ও অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হইল।