সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর যুগের ঐতিহাসিকদের রচনাবলীতে সাইফুল্লাহ নামক এক ব্যক্তির উল্লেখ এভাবে পাওয়া যায়, ‘কেউ যদি সুলতান সালাহুদ্দীনের উপাসনা করে থাকে, তাহলে সে ছিল সাইফুল্লাহ।’ সুলতান সালাহুদ্দীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ডান হাত বলে খ্যাত বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদের ডাইরীতে যা আজও আরবী ভাষায় সংরক্ষিত আছে— সাইফুল্লাহর বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে কোন ইতিহাস গ্রন্থে এ লোকটির আলোচনা পাওয়া যায় না।
বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদের ডাইরীর ভাষ্যমতে সাইফুল্লাহ নামের এ লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ওফাতের পর সতের বছর জীবিত ছিল। জীবনের এই শেষ সতেরটি বছর অতিবাহিত করেছিল সে সুলতান সালাহুদ্দীনের কবরের পার্শ্বে। লোকটি অসিয়ত করেছিল, মৃত্যুর পর যেন তাকে সুলতান সালাহুদ্দীনের পার্শ্বে দাফন করা হয়। কিন্তু সাইফুল্লাহ ছিল একজন সাধারণ মানুষ। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার কোন বিশেষত্ব ছিল না। তাই মৃত্যুর পর তাকে সাধারণ গোরস্তানেই দাফন করা হয়। অল্প ক’দিন পরই তার সমাধি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়; মানুষ তার কবরের উপর ঘর তুলে বসবাস শুরু করে।
রোম উপসাগরের ওপার থেকে সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে এসেছিল সাইফুল্লাহ। তখন তার নাম ছিল ‘মিগনানা মারিউস’। ইসলামের নামটাই শুধু শুনেছিল সে। তার জানা ছিল না ইসলামের আসল পরিচয়। ক্রুসেডারদের প্রোপাগাণ্ডায় বিভ্রান্ত মিগনানা মারিউসের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ইসলাম একটি ঘৃণ্য ধর্ম, মুসলমানরা নারীলোলুপ ও নরখাদক এক হিংস্র জাতি। তাই মুসলমান শব্দটি কানে আসা মাত্র ঘৃণায় থু থু ফেলত মিগনানা মারিউস। কিন্তু পরম সাহসিকতা প্রদর্শন করে সালাহুদ্দীন আইউবী পর্যন্ত পৌঁছার পর মৃত্যু হয়ে গেল মিগনানা মারিউসের। তার নিষ্প্রাণ অস্তিত্ব থেকে জন্ম নিল ‘সাইফুল্লাহ্’।
ইতিহাসের পাতায় এমন রাষ্ট্রনায়কদের সংখ্যা কম নয়, শত্রুর হাতে যারা জীবন দিয়েছিলেন কিংবা আত্মঘাতী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ইতিহাসের সেই গুটিকতক ব্যক্তিত্বের একজন, যাদেরকে বারবার হত্যা করার চেষ্টা যেমন করেছে শত্রুরা, তেমন করেছে মিত্ররাও। সুলতান সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শত্রুদের তুলনায় বেশী করেছে মিত্ররা। তাঁর কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে একজন ঈমানদীপ্ত জানবাজ মুমিনের পাশাপাশি একদল বে-ঈমান গাদ্দারের নিদারুণ কাহিনীও উল্লেখ করতে হয় সমান তালে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। তাই সালাহুদ্দীন আইউবী বলতেন— ‘অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাস এমন একটি সময় প্রত্যক্ষ করবে, যখন পৃথিবীর বুকে মুসলমান থাকবে ঠিক; কিন্তু ঈমান তাদের বিক্রি হয়ে থাকবে কাফিরদের হাতে, তাদের উপর শাসন করবে খৃষ্টানরা।’
আমরা এখন ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকাল প্রত্যক্ষ করছি।
সালাহুদ্দীন আইউবী যখন ক্রুসেডারদের সম্মিলিত নৌ-বহরকে, রোম উপসাগরে আগুনে পুড়িয়ে, পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সাইফুল্লাহর কাহিনী শুরু হয় তখন থেকে। সালাহুদ্দীনের আক্রমণ থেকে ক্রুসেডারদের কয়েকটি জাহাজ রক্ষা পেয়েছিল। সাগরতীরে নিজ বাহিনীর সঙ্গে উপস্থিত থেকে সালাহুদ্দীন আইউবী সেই জীবন্ত রক্ষা পাওয়া ক্রুসেডারদের গ্রেফতার করতে থাকেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল সাতটি মেয়ে, যাদের বিস্তারিত কাহিনী ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
মিসরে বিদ্রোহ করেছিল সুদানী বাহিনী। সেই বিদ্রোহ দমন করে ফেলেন সুলতান। অপরদিকে সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীও এসে পৌঁছে তাঁর নিকট। এবার ক্রুসেডারদের প্রতিরোধ-পরিকল্পনা তৈরিতে মগ্ন হয়ে পড়েন তিনি।
রোম উপসাগরের ওপারে শহরের উপকণ্ঠে এক নিভৃত অঞ্চলে বৈঠক বসেছে খৃষ্টান কর্মকর্তাদের। শাহ অগাস্টাস, শাহ রেমাণ্ড, শাহেনশাহ সপ্তম লুই-এর ভাই রবার্টও সভায় উপস্থিত। পরাজয়ের গ্লানিতে বিমর্ষ সকলের মুখমণ্ডল। আলোচনা চলছে। এ সময়ে সভাকক্ষে প্রবেশ করে এক ব্যক্তি। নাম এম্লার্ক। ক্ষোভে-দুঃখে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে যেন তার দু চোখ থেকে। খৃষ্টানদের যে সম্মিলিত নৌ-বহরকে মিসর আক্রমণে প্রেরণ করা হয়েছিল, এম্লার্ক ছিল তার কমাণ্ডার। কিন্তু আকস্মিক ঝড়ের ন্যায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন সালাহুদ্দীন আইউবী। বহরের একজন সৈনিককেও সমুদ্র থেকে কূলে পা রাখতে দিলেন না তিনি। মিসরের মাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয়েছিল যেসব খৃষ্টসেনা, সালাহুদ্দীনের হাতে যুদ্ধবন্দীতে পরিণত হয় তারা।
সভাকক্ষে বসে আছে এম্লার্ক। ক্ষোভে থর থর করে কাঁপছে তার ওষ্ঠাধর। তার বহর ডুবে মরেছে আজ পনের দিন হল। ভাসতে ভাসতে আজই ইটালীর কূলে এসে পৌঁছেছে সে। সালাহুদ্দীন আইউবীর অগ্নিতীর নিক্ষেপকারী বাহিনী পাল-মাস্তুল জ্বালিয়ে দিয়েছে তার জাহাজের। ভাগ্যক্রমে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে প্রথমবারের মত জাহাজটিকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় তার নাবিক-সৈনিকেরা। পালবিহীন জাহাজ হেলে-দুলে ভাসতে থাকে মাঝ দরিয়ায়।
এক সময়ে দিক-চক্ৰবাল আচ্ছন্ন করে আকাশে জেগে উঠে ঘোর কালো মেঘ। শুরু হয় প্রবল ঝড়। ঝড়ের কবলে পড়ে অসংখ্য শিশু-কিশোর-নারীসহ পানির নীচে তলিয়ে যায় এম্লার্কের জাহাজটি। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় এম্লার্ক। প্রাণ নিয়ে পৌঁছে যায় ইটালীর তীরে।
বৈঠক চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, খৃষ্টান বাহিনীকে এত বড় ধোঁকা কে দিল? কার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এত শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হল তাদের? সংশয় ব্যক্ত করা হয় সুদানী সালার নাজির উপর। তারই পত্রের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিল এ নৌ-অভিযান। নাজির সঙ্গে খৃষ্টানদের পত্ৰ-যোগাযোগ চলছিল পূর্ব থেকেই। এ যাবৎ বেশ কটি পত্র দিয়েছে সে খৃষ্টানদের। খৃষ্টানরা নাজির সর্বশেষ যে পত্রটির উপর ভিত্তি করে এ অভিযানে নেমেছিল, পূর্বের পত্রগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হল সেটি। কিছুটা অমিল পাওয়া গেল। নাজির প্রতি সন্দেহ আরও গাঢ় হল। কায়রোতে গুপ্তচরও ঢুকিয়ে রেখেছিল তারা। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকেও কোন সংবাদ পায়নি খৃষ্টানরা। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে বিশ্বাসঘাতক নাজি ও কুচক্রী সালারদের গোপনে হত্যা করে রাতের আঁধারে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন, সে সংবাদ খৃষ্টানদের কানে পৌঁছানোর ছিল না কেউ। খৃষ্টানদের সম্রাট-কর্মকর্তাগণ কল্পনাও করতে পারেননি, যে পত্রের উপর ভিত্তি করে তারা মিসর অভিমুখে নৌ-বহর প্রেরণ করেছিলেন, সে পত্রখানা নাজিরই ছিল বটে; কিন্তু তার আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে অন্য তারিখ লিখে দিয়েছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। এসব তথ্য সংগ্রহ করা ছিল খৃষ্টান গোয়েন্দাদের সাধ্যের বাইরে।
দীর্ঘ আলাপ-পর্যালোচনার পরেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারল না এ বৈঠক। কথা সরছে না এম্লার্কের মুখ থেকে। পরাজয়ের গ্লানিতে লোকটি যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি ক্লান্ত। পরদিনের জন্য মুলতবী করে দেওয়া হয় বৈঠক।
রাতের বেলা। মদের আসর জমে উঠেছে খৃষ্টান কর্মকর্তাদের। নেশায় বুঁদ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলতে চাইছে তারা। হঠাৎ সে আসরে আগমন ঘটে এক ব্যক্তির। রেমণ্ড ছাড়া কেউ চেনে না তাকে।
লোকটি রেমণ্ডের নির্ভরযোগ্য গুপ্তচর। হামলার দিন সন্ধ্যায় মিসরের তীরে এসে নেমেছিল সে। তারই খানিক পর এসে পৌঁছে ক্রুসেডারদের নৌ-বহর। বহরটি সালাহুদ্দীন আইউবীর ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়েছিল তারই চোখের সামনে।
বেশ কিছু তথ্য নিয়ে এসেছে লোকটি। রেমণ্ড সকলের নিকট পরিচয় করিয়ে দেয় তাকে। রিপোর্ট জানবার জন্য তাকে ঘিরে ধরে সবাই। খৃষ্টান কর্মকর্তাগণ সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার জন্য রবিন নামক এক সুশিক্ষিত অভিজ্ঞ গুপ্তচরকে সমুদ্রোপকূলে প্রেরণ করেছিল এবং তার সঙ্গে পাঁচজন পুরুষ ও সাতটি রূপসী যুবতীকে প্রেরণ করেছিল, এ গুপ্তচর তাদের সম্পর্কে অবহিত।
আগন্তুক জানায়— ‘রবিন জখমের বাহানা দেখিয়ে আহতদের সঙ্গে সালাহুদ্দীন আইউবীর ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছিল। তার পাঁচ পুরুষ সঙ্গী ছিল বণিকের বেশে। তাদের একজন—ক্রিস্টোফর যার নাম—নেপথ্য থেকে তীর ছুঁড়ে সালাহুদ্দীনের গায়ে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তার তীর। ধরা পড়ে যায় পাঁচজনের সকলে। মেয়ে সাতটিকেও ধরে ফেলেন সালাহুদ্দীন। বেশ চমৎকার কাহিনী গড়ে নিয়েছিল মেয়েরা। সালাহুদ্দীনকে শোনায় সে কাহিনী। মেয়েগুলোকে আশ্রয়ে রেখে পুরুষ পাঁচজনকে ছেড়ে দিয়েছিলেন সালাহুদ্দীন। কিন্তু তাঁর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান হঠাৎ এসে পড়ে গ্রেফতার করে ফেলেন তাদেরকে। পাঁচজনের একজনকে সকলের সামনে হত্যা করে অন্যদের থেকে কথা আদায় করেন তিনি।’
গোয়েন্দা আরও জানায়, ‘ধরা পড়ি আমিও। সালাহুদ্দীনের নিকট আমি নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেই। তাই তিনি আমার উপর আহতদের ব্যাণ্ডেজ চিকিৎসার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেই সুযোগে আমি জানতে পারলাম, সুদানীরা বিদ্রোহ করেছিল বটে; কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী সে বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে ফেলেন। তিনি বিদ্রোহী অফিসার ও নেতাদের গ্রেফতার করেন।
রবিন, তার সহযোগী চার পুরুষ ও মেয়ে ছয়টি এখন সালাহুদ্দীনের হাতে বন্দী। তবে সপ্তম মেয়েটির— যে ছিল সবচেয়ে বেশী বিচক্ষণ— তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিখোঁজ মেয়েটির নাম মুবিনা এরতেলাস, সংক্ষেপে মুবী।’
গোয়েন্দা জানায়, ‘বন্দী রবিন ও তার সহকর্মীরা এখনও উপকূলীয় শিবিরেই রয়েছে। সালাহুদ্দীন ক্যাম্পে নেই। তার গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানও অনুপস্থিত। আমি বড় কষ্টে ওখান থেকে বের হয়ে এসেছি। ঘাটে এসে একটি নৌকা পেয়ে গেলাম। দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে দ্রুত নদী পার হয়ে চলে আসি। রবিন ও তার সহকর্মী পুরুষ ও মেয়েরা মৃত্যুমুখে পতিত। পুরুষদের চিন্তা না হয় নাই করলাম; কিন্তু মেয়েগুলোকে উদ্ধার করা তো একান্ত আবশ্যক। ওরা সকলেই যুবতী এবং আমাদের বাছা বাছা রূপসী মেয়ে। উদ্ধার করতে না পারলে মুসলমানরা ওদের কী দশা ঘটাবে, তাতে আপনারা বুঝতেই পারছেন।’
‘এ ত্যাগ আমাদের দিতেই হবে।’ বললেন অগাস্টাস।
‘আপনি যদি আমাকে এ নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, সালাহুদ্দীন আইউবী আমাদের মেয়েদেরকে প্রাণে শেষ করেই ক্ষান্ত হবে; অন্য কোন নির্যাতনের শিকার তাদের হতে হবে না, তাহলে এ ত্যাগ স্বীকার করতে আমিও প্রস্তুত। কিন্তু এমনটি আশা করা বৃথা; মুসলমানরা ওদের সঙ্গে পশুর মত আচরণ করবে আর তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মেয়েগুলো আমাদেরকে অভিসম্পাত করবে। আমি তাদেরকে মুক্ত করে আনার চেষ্টা করব।’ বললেন রেমণ্ড।
‘এমনও হতে পারে, মুসলমানরা মেয়েগুলোর সঙ্গে ভাল আচরণ দেখিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করবে। তখন আমাদের মারাত্মক, সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এ কারণে ওদেরকে মুক্ত করে আনা একান্ত আবশ্যক। এর জন্য আমি আমার ভাণ্ডারের অর্ধেক সম্পদও উজাড় করতে প্রস্তুত আছি।’ বললেন রবার্ট।
‘আমাদের এ মেয়েগুলো শুধু এ কারণেই মূল্যবান নয় যে, এরা নারী। এরা প্রশিক্ষিত গুপ্তচর। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এদের মত মেয়ে আর পাব কোথায়? এমন মেয়ে আমরা কোথায় পাব, যারা জাতি ও ধর্মের স্বার্থে—ক্রুশের স্বার্থে নিজেকে দুশমনের হাতে তুলে দেবে, দুশমনের ভোগ-বিলাসিতার উপকরণে পরিণত হবে এবং গুপ্তচরবৃত্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকবে। এ মিশনে তাদের সর্বপ্রথম বিলাতে হয় সম্ভ্রম। তদুপরি গুপ্তচর হিসেবে ধরা পড়ে গেলে কঠোর নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন হারাবার ভয় থাকে পদে পদে। এ মেয়েগুলোকে আমাদের বিপুল অর্থের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। তারপর প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় কষ্টে মিসর ও আরবের ভাষা শেখানো হয়েছে। আমি মনে করি, এভাবে একত্রে সাতটি মেয়ে হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’ বলল আগন্তুক গোয়েন্দা।
‘আচ্ছা, তুমি কি নিশ্চয়তা দিতে পার, মেয়েগুলোকে সালাহুদ্দীনের ক্যাম্প থেকে বের করে আনা যাবে?’ জিজ্ঞেস করেন অগাস্টাস।
‘যাবে। এর জন্য প্রয়োজন বেশ কজন দুঃসাহসী সৈন্য। তবে হয়ত দু-একদিনের মধ্যে রবিন এবং তার সহকর্মী পুরুষ ও মেয়েদেরকে কায়রো নিয়ে যাওয়া হবে। তাই যদি হয়, তবে সেখান থেকে তাদেরকে বের করে আনা কঠিন হবে। সময় নষ্ট না করে উপকূলীয় ক্যাম্প থেকেই তাদেরকে মুক্ত করে আনা দরকার। আপনি বিশজন লোক দিন; আমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু তারা হতে হবে এমন লোক, যারা জীবন নিয়ে খেলতে জানে।’ বলল গোয়েন্দা।
‘যে কোন মূল্যে মেয়েগুলোকে উদ্ধার করে আনা দরকার।’ গর্জে উঠে বলল এম্লার্ক।
খৃষ্টান বাহিনী রোম উপসাগরে যে শোচনীয় পরাজয় ও মর্মান্তিক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছিল, তার প্রতিশোধ-স্পৃহায় পাগলের মত হয়ে গেছে এম্লার্ক। লোকটি ক্রুসেডারদের সম্মিলিত নৌ-বহর এবং তার আরোহী সৈন্যদের সুপ্রীম কমাণ্ডার হয়ে এ আশা বুকে নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছিল যে, মিসর দখলের পর জয়মাল্য তারই গলায় ঝুলবে। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের তীরেই ঘেঁষতে দিলেন না তাকে। বেচারা জ্বলন্ত জাহাজে জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েও পড়ে গেল ঝড়ের কবলে। সেখান থেকে বেঁচে এসেছে মরতে মরতে। এখন কথা বলতে ঠোঁট কাঁপছে তার। কথায় কথায় টেবিল চাপড়িয়ে, নিজের উরুতে হাত মেরে মনের জ্বালা প্রশমিত করছে লোকটি। অবশেষে বলল—
‘আমি মেয়েগুলোকেও মুক্ত করে আনব, সালাহুদ্দীনকেও হত্যা করাব। উদ্ধার করে এনে এ মেয়েগুলোকে মুসলমানদের সাম্রাজ্যের মূলোৎপাটনে ব্যবহার করব।’
‘আমি মনে-প্রাণে তোমাকে সমর্থন করি এম্লার্ক! এমন সুশিক্ষিত মেয়েদেরকে আমিও এত সহজে নষ্ট হতে দিতে চাই না। আপনাদের সকলেরই জানা আছে, সিরিয়ার হেরেমগুলোতে আমরা কি পরিমাণ মেয়ে ঢুকিয়ে রেখেছি। বেশ কজন মুসলমান গভর্নর ও আমীর তাদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। বাগদাদে আমাদের মেয়েরা আমীরদের হাতে এমন বেশ কজন লোককে হত্যা করিয়েছে, যারা ক্রুসেডের বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলেছিল। নারী আর মদ দিয়ে মুসলমানদের খেলাফতকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছি, তাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছি। খেলাফত এখন ত্রিধাবিভক্ত। আমোদ-বিলাসিতায় ডুবে যেতে শুরু করেছেন খলীফারা। অবশিষ্ট আছে শুধু দুটি লোক। যদি তারা দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকে, তাহলে তারা আমাদের জন্য স্বতন্ত্র এক বিপদ হয়ে থাকবে। একজন সালাহুদ্দীন আইউবী, অপরজন নুরুদ্দীন জঙ্গী। এদের একজনও যদি বেঁচে থাকে, তাহলে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি সুদানীদের বিদ্রোহ দমন করেই থাকে, তাহলে তার অর্থ হল, লোকটি আমাদের ধারণা অপেক্ষাও বেশী ভয়ঙ্কর। তার বিরুদ্ধে ময়দানে মোকাবেলা করার পাশাপাশি নাশকতামূলক কার্যক্রমও আমাদের চালু করতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ-দলাদলি এবং অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ মেয়েগুলোকে আমাদের একান্ত প্রয়োজন।’ বললেন রেমণ্ড।
‘আমাদের সকল অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। আমরা আরবে মুসলমানদের দুর্বলতা থেকে স্বার্থ উদ্ধার করেছি। মুসলমান নারী, মদ আর ঐশ্বর্য পেলে অন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের নিঃশেষ করার উত্তম পন্থা হল, এক মুসলমান দিয়ে আরেক মুসলমানকে হত্যা করানো। হাতে ক’টি টাকা গুঁজে দাও, দেখবে, অর্থের লোভে তারা তাদের সাধের দ্বীন ও ঈমান ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে না। চেষ্টা করলে তোমরা অতি অনায়াসে মুসলমানের ঈমান ক্রয় করতে পার।’ বললেন রবার্ট।
মুসলমানদের দুর্বলতা নিয়ে আলাপ চলে দীর্ঘক্ষণ। তারপর বন্দী মেয়েদের মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে কথা ওঠে। শেষে সিদ্ধান্ত হয়, বিশজন দুঃসাহসী সেনা প্রেরণ করা হবে এ কাজে। আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রওনা হয়ে যাবে তারা।
তৎক্ষণাৎ তলব করা হয় চারজন কমাণ্ডার। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাদের বলা হল, ‘তোমাদের সহযোগিতার জন্য বিশজন সৈনিক বেছে নাও।’
আলোচনায় বসে চার কমাণ্ডার। এ অভিযানে তারা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। এক কমাণ্ডার বলল, ‘আমাদের এমন একটি ফোর্স গঠন করতে হবে, যারা মুসলমানদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে কমাণ্ডে আক্রমণ চালাতে থাকবে এবং রাতে তাদের পেট্রোল বাহিনীর উপর হামলা করে তাদেরকে অস্থির করে রাখবে। এ ফোর্সের জন্য দক্ষ ও বিচক্ষণ লোক বেছে নিতে হবে।’
‘কিন্তু তারা হতে হবে শতভাগ বিশ্বস্ত। এ ফোর্স আমাদের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করবে। এমনও হতে পারে, তারা কিছুই না করে ফিরে এসে শোনাবে আমরা অনেক কিছু করে এসেছি।’ বললেন অগাস্টাস।
এক কমাণ্ডার বলল, ‘আপনি শুনে অবাক হবেন, আমাদের বাহিনীতে এমন কিছু সৈনিক আছে, যাদেরকে আমরা বিভিন্ন কারাগার থেকে এনে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করেছি। তাদের কেউ ছিল ডাকাত, কেউ সন্ত্রাসী, কেউবা ছিল ছিনতাইকারী। তারা দীর্ঘ মেয়াদী সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী ছিল। ওরা কারাগারের বদ্ধ প্রকোষ্ঠেই ধুকে ধুকে মরত। আমাদের প্রস্তাব পেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। শুনলে হয়ত আপনি বিস্মিত হবেন, আমাদের ব্যর্থ নৌ-অভিযানে এই সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী সৈনিকরা বড় বীরত্বের সাথে সালাহুদ্দীনের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কয়েকটি জাহাজকে রক্ষা করেছে। বন্দী মেয়েদেরকে মুক্ত করার অভিযানে আমি এদের তিনজনকে প্রেরণ করব।’
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন— ‘মুসলমানদের মধ্যে বিলাস-প্রিয়তা বেড়ে যায় এবং তাদের ঐক্য নিঃশেষ হতে শুরু করে। মুসলমানের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য খৃষ্টানরা তাদের ঘরে ঘরে বিলাস-সামগ্রী ঢুকিয়ে দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের মনে আশা জাগে, আর এক ধাক্কায়ই তারা মুসলমানদের ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম হবে। এবার খৃষ্টানরা বিশ্বময় ইসলাম ও মুসলিম-বিরোধী ঘৃণা ছড়াতে শুরু করে এবং সকলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানায়। জবাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ খৃষ্টান বাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করে। পাদ্রী থেকে আরম্ভ করে পেশাদার অপরাধীরা পর্যন্ত পঙ্কিল পথ ত্যাগ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। যেসব সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী দীর্ঘমেয়াদী সাজা ভোগ করছিল, বিভিন্ন কারাগার থেকে এনে তাদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়। এ কয়েদীদের প্রতি খৃষ্টানদের বেশ আস্থা ছিল। যার কারণে সালাহুদ্দীনের বন্দীদশা থেকে মেয়েদের মুক্ত করা এবং সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার জন্য এক কমাণ্ডার কয়েদী সৈনিকদের নির্বাচন করেছিল।’
সকাল পর্যন্ত অতীব দুঃসাহসী ও বিচক্ষণ বিশজন সৈনিক বেছে নেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। মিগনানা মারিউসও ছিল তাদের একজন, যাকে বের করে আনা হয়েছিল রোমের একটি কারাগার থেকে। যে গোয়েন্দা লোকটি ডাক্তার বেশে সুলতান সালাহুদ্দীনের ক্যাম্পে ছিল এবং তথ্য সংগ্রহ করে পালিয়ে এসেছিল, অভিযানের কমাণ্ডার নিয়োগ করা হল তাকে।
এ বাহিনীর প্রথম দায়িত্ব হল, মেয়েগুলোকে মুসলমানদের বন্দীদশা থেকে বের করে আনা এবং সম্ভব হলে রবিন ও তার চার সহকর্মীকেও মুক্ত করা। সহজে সম্ভব না হলে রবিনদের জন্য ঝুঁকি নিতে নিষেধ করে দেওয়া হয় তাদের। দ্বিতীয় দায়িত্ব, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা।
এ বাহিনীটিকে নতুন করে প্রাকটিক্যাল কোন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি; শুধু মৌখিক জরুরী নির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি দিয়ে একটি পালতোলা নৌকায় করে মৎস শিকারীর বেশে রওয়ানা করান হয় সে দিনই।
○ ○ ○
যে সময়ে এ নৌকাটি ইতালীর সমুদ্রতীর থেকে পাল তুলে রওনা হয়, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ততক্ষণে সুদানীদের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দমন করে ফেলেছেন। অনেক সুদানী কমাণ্ডার তার বাহিনীর হাতে মারা গেছে, আহত হয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে অনেকে। অনেকে আবার দাঁড়িয়ে আছে গভর্নর হাউজের সম্মুখের চত্বরে। অস্ত্র ত্যাগ করে সুলতান সালাহুদ্দীনের আনুগত্য মেনে নিয়েছে তারা। এখন তারা সুলতানের নির্দেশের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান।
হাউজের ভেতরে বসে সালারদের নির্দেশনা দিচ্ছেন সুলতান। আলী বিন সুফিয়ানও তাঁর সামনে উপবিষ্ট। হঠাৎ সুলতান সালাহুদ্দীনের একটি বিষয় মনে পড়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ানকে উদ্দেশ করে বললেন— ‘আলী! গ্রেফতারকৃত গোয়েন্দা মেয়েগুলো এবং তাদের সঙ্গীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা তো ভুলেই গেলাম! এখনও তো ওরা সমুদ্রোপকূলীয় কয়েদী ক্যাম্পেই রয়েছে। তুমি এক্ষুনি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর এবং পাতাল কক্ষে ফেলে রাখ।’
‘ঠিক আছে, এক্ষুনি নির্দেশ পাঠিয়ে আমি তাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি সুলতান! আর সপ্তম মেয়েটির কথা বোধ হয় আপনি ভুলে গেছেন। মেয়েটি বালিয়ান নামক এক সুদানী কমাণ্ডারের নিকট ছিল। কিন্তু বালিয়ান হাউজের বাইরে দণ্ডায়মান আত্মসমর্পণকারী কমাণ্ডারদের মধ্যেও নেই। আহতদের মধ্যেও নেই, নেই নিহতদের মধ্যেও। আমার সন্দেহ হচ্ছে, গোয়েন্দা মেয়েদের সপ্তম মেয়েটি—যার নাম মুবী—বালিয়ানের সঙ্গে কোথাও আত্মগোপন করে আছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘ঠিক আছে, তোমার সন্দেহ দূর কর আলী! আপাতত এখানে তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। বালিয়ান যদি নিখোঁজই হয়ে থাকে, তাহলে বেটা রোম উপসাগরের দিকেই পালিয়ে থাকবে। খৃষ্টানদের ছাড়া তাকে আর আশ্রয় দেবে কে? এখানে নিয়ে সে তুমি গোয়েন্দাদের পাতাল কক্ষে আটকে রাখে এবং এক্ষুনি সমুদ্রোপকূল অভিমুখে গুপ্তচর প্রেরণ কর।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
‘মহামান্য সুলতান! আমার তো মনে হয়, আমাদের গুপ্তচরদেরকে নিজেদেরই দেশে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।’ পরামর্শ দেন সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীর সালার। তিনি আরও বললেন—
‘খৃষ্টানদের দিক থেকে আমাদের তত আশঙ্কা নেই, যত আশঙ্কা আমাদেরই মুসলিম আমীরদের পক্ষ থেকে। আমাদের গুপ্তচরদেরকে তাদের হেরেমে ঢুকিয়ে দিন, দেখবেন, বহু অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে, ফাঁস হয়ে যাবে অনেক ষড়যন্ত্র।’ এ বলে তিনি এই স্বঘোষিত শাসকরা কিভাবে খৃষ্টানদের হাতে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন এবং বলেন, ‘সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী অনেক সময় ভেবে অস্থির হয়ে যান—কোন্টা করব? বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করব, নাকি নিজ গৃহকে নিজেরই প্রদীপের আগুন থেকে রক্ষা করব!’
জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীর এ সালারের বক্তব্য গভীর মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেন সালাহুদ্দীন। বললেন— ‘যদি তোমরা অর্থাৎ যাদের কাছে অস্ত্র আছে, যদি তারা দ্বীন-ধর্মের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান থাকতে পার, একনিষ্ঠভাবে যদি তোমরা ইসলাম, দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে যাও, তাহলে বাইরের আক্রমণ আর ভিতরের ষড়যন্ত্র কোনটিই জাতির এতটুকু ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা দৃষ্টিকে প্রসারিত কর, সীমান্ত ছাড়িয়ে দৃষ্টিকে নিয়ে যাও আরও অনেক দূরে বহু দূরে। মনে রেখো, সালতানাতে ইসলামিয়ার কোন সীমান্ত নেই। যেদিন তোমরা নিজেদেরকে এবং আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলামকে সীমান্তের বেড়ায় আটকে ফেলবে, সেদিন থেকেই তোমরা নিজেদেরই কারাগারে বন্দী হয়ে যাবে। আর ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকবে তোমাদের তুনীরের সীমানা। রোম উপসাগর অতিক্রম করে তোমরা আরও দূরে দৃষ্টি ফেল। সমুদ্র রোধ করতে পারবে না তোমাদের পথ। আর ঘরের আগুনকে ভয় কোরো না। আমাদের এক ফুৎকারে নিভে যাবে ষড়যন্ত্রের সব মশাল তার স্থানে আমরা ঈমানের আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ প্রজ্বলিত করব।’
‘আমরা আশাবাদী যে, আমরা বেঈমানদের প্রতিহত করতে পারব মুহতারাম সুলতান! আমরা নিরাশ নই।’ বললেন সালার।
‘মাত্র দুটি অভিশাপ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা কর, আমার প্রিয় বন্ধুগণ! এক, নৈরাশ্য। দুই, বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা। মানুষ প্রথমে নিরাশ হয়। তারপর বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতার আশ্রয়ে পালাবার পথ খুঁজে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছেন আলী বিন সুফিয়ান। তৎক্ষণাৎ তিনি রোম উপসাগরের ক্যাম্প অভিমুখে এ পয়গাম দিয়ে দূতকে রওয়া করিয়ে দেন যে, রবিন, তার চার সহযোগী এবং মেয়েদেরকে ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চড়িয়ে বিশজন রক্ষীর প্রহরায় রাজধানীতে পাঠিয়ে দাও।
দূতকে রওনা করিয়েই আলী বিন সুফিয়ান ছয়-সাতজন সিপাহী নিয়ে কমাণ্ডার বালিয়ানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। তার আগে বাইরে দণ্ডায়মান সুদানী কমাণ্ডারদের নিকট বালিয়ান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানিয়েছিল, লড়াইয়ের সময় তাকে কোথাও দেখা যায়নি এবং সুলতানের বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্য যে বাহিনীটিকে রোম উপসাগরের দিকে প্রেরণ করা হয়েছিল, বালিয়ান তাদের সঙ্গেও যায়নি।
বালিয়ানের ঘরে যান আলী বিন সুফিয়ান। দুজন বৃদ্ধা চাকরানী ছাড়া আর কাউকে পেলেন না সেখানে। চাকরানীরা জানায়, বালিয়ানের ঘরে পাঁচটি মেয়ে ছিল। তার নিয়ম ছিল, যখনই কোন মেয়ের বয়স একটু বেড়ে যেত, তাকে হাওয়া করে ফেলত এবং তার স্থলে আসত নতুন এক টগবগে যুবতী। তারা আরও জানায়, বিদ্রোহের আগে বালিয়ানের ঘরে একটি ফিরিঙ্গী মেয়ে এসেছিল। মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনি বিচক্ষণ। দুদিন যেতে না যেতে বালিয়ান মেয়েটির গোলাম হয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহের একদিন পরে যেদিন সুদানীরা অস্ত্রসমর্পণ করে, সেদিন রাতে বালিয়ান নিজে একটি ঘোড়ায় চড়ে এবং সেই ফিরিঙ্গী মেয়েটিকে অপর একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে অজানার উদ্দেশ্যে উধাও হয়ে যায়। সাতজন অশ্বারোহীও ছিল তার সঙ্গে। হেরেমের মেয়েদের ব্যাপারে বৃদ্ধারা জানায়, যে যা হাতে পেয়েছে, তুলে নিয়ে সবাই চলে গেছে।
ফিরে আসেন আলী বিন সুফিয়ান। হঠাৎ একটি ঘোড়া দ্রুত ছুটে এসে থেমে যায় তার সামনে। ফখরুল মিসরী তার আরোহী। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নীচে নামে সে। হাঁফাতে হাঁফাতে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘আমিও আপনারই ন্যায় নরাধম বালিয়ান ও কাফির মেয়েটিকে খুঁজছি। আমি তার থেকে প্রতিশোধ নেব। এদের দুজনকে হত্যা না করা পর্যন্ত আমার মনে শান্তি আসবে না। আমি জানি, সে কোন দিক গেছে। আমি তাকে ধাওয়াও করেছি। কিন্তু সঙ্গে তার সাতজন সশস্ত্র রক্ষী। আমি ছিলাম একা। রোম উপসাগরের দিকে যাচ্ছে লোকটা। কিন্তু যাচ্ছে সে সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে।’
আলী বিন সুফিয়ানের হাত চেপে ধরে ফখরুল মিসরী বলল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি আমায় চারজন সিপাহী দিন; ধাওয়া করে আমি ওকে শেষ করে আসি।’
আলী বিন সুফিয়ান তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, ‘চারজন নয়, আমি তোমাকে বিশজন সিপাহী দেব। এখনও সে উপকূল অতিক্রম করতে পারেনি। তুমি আমার সঙ্গে চল।’ বালিয়ান কোনদিক গেল সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন আলী বিন সুফিয়ান।
○ ○ ○
মুবীকে নিয়ে বালিয়ান উপকূল অভিমুখে বহুদূর এগিয়ে গেছে। উপকূলগামী সাধারণ পথ ছেড়ে অন্য পথে এগুচ্ছে সে। এসব অঞ্চল-পথ-ঘাট বালিয়ানের চেনা। তাই নির্বিঘ্নে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে সে।
কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে আত্মসমর্পণকারী সুদানী সৈন্য ও কমাণ্ডারদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, বালিয়ান তা জানে না। বালিয়ান পালাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথমত তার আশঙ্কা, ধরা পড়লে সুলতান সালাহুদ্দীন তাকে খুন করে ফেলবেন। দ্বিতীয়ত মুবীর ন্যায় রূপসী মেয়েকে হাতছাড়া করতে চাইছে না সে। যে কোন মূল্যে নিজের জীবন রক্ষা করতে হবে এবং মুবীকেও হাতে রাখতে হবে, এই তার প্রত্যয়। বালিয়ান মনে করত, জগতের রূপসী মেয়েরা শুধু মিসর আর সুদানেই জন্মায়। কিন্তু ইতালীর এই ফিরিঙ্গী মেয়েটির চোখ-ধাঁধানো রূপ তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। মুবীর জন্য নিজের মান-সম্মান, দ্বীন-ধর্ম ও দেশ-জাতি সব বিসর্জন দিয়েছে বালিয়ান। কিন্তু এখন মুবী যে তার থেকে মুক্তি লাভ করার চেষ্টা করছে, তা বালিয়ানের অজানা। যে উদ্দেশ্যে মুবীর এ দেশে আগমন, তা নস্যাৎ হয়ে গেছে সব। তবে মুবী তার কর্তব্য পালনে ত্রুটি করেনি বিন্দুমাত্র। লক্ষ্য অর্জনে নিজের দেহ ও সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছে মেয়েটি। এখনও নিজের দ্বিগুণ বয়সী এক পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে আছে সে।
বালিয়ান এই আত্মতৃপ্তিতে বিভোর যে, মুবী তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার প্রতি মুবীর প্রচণ্ড ঘৃণা। একাকী পালাতে পারছে না বলে বাধ্য হয়ে এখনও বালিয়ানের সঙ্গ দিচ্ছে মুবী। মনে তার একটিই ভাবনা, কী করে রোম উপসাগর পার হওয়া যায় কিংবা কিভাবে রবিনের নিকটে পৌঁছে যাওয়া যায়।
মুবী জানে না, রবিন এবং তার বণিকবেশী সঙ্গীরা এখন সুলতান সালাহুদ্দীনের হাতে বন্দী। মুবী বারবার বালিয়ানকে বলছে, দ্রুত চল, পথে অবস্থান কম কর, অন্যথায় ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু বে-ঈমান নারীলোলুপ বালিয়ান কোথাও ছায়াঘেরা একটু জায়গা পেলেই থেমে যায়, বিশ্রামের নামে বসে পড়ে। তারপর মেতে উঠে মদ আর মুবীকে নিয়ে।
এক রাতে একটি কৌশল আঁটে মুবী। অতিরিক্ত মদপান করিয়ে অচেতন করে শুইয়ে রাখে বালিয়ানকে। রক্ষীরা শুয়ে পড়ে খানিকটা দূরে একটি গাছের আড়ালে। রক্ষীদের একজন বেশ টগবগে, সুঠাম সুদেহী এক বলিষ্ঠ যুবক। অত্যন্ত বিচক্ষণও বটে। পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলে মুবী। হাতের ইশারায় নিয়ে যায় খানিক দূরে অন্য একটি গাছের আড়ালে। বলে, ‘তুমি ভাল করেই জান, আমি কে, কোত্থেকে এসেছি, কেন এসেছি। আমি তোমাদের জন্য সাহায্য নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর মত একজন ভিনদেশী শাসকের কবল থেকে মুক্তি পেতে পার। কিন্তু তোমাদের এই কমাণ্ডার বালিয়ান এত বিলাস-প্রিয় লোক যে, মদপান করে মাতাল হয়ে সর্বক্ষণ আমার দেহটা নিয়েই খেলা করতে ভালবাসে। আমার সহযোগিতায় বুদ্ধিমত্তার সাথে বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে বিজয় অর্জনের চেষ্টা করার পরিবর্তে লোকটি আমাকে হেরেমের দাসী বানিয়ে রেখেছিল। তারপর নির্বোধের মত বাহিনীটিকে দুভাগে বিভক্ত করে এমন বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করাল যে, এক রাতেই তোমাদের এত বিশাল বাহিনীটি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেল!
তোমরা হয়ত জান না, তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লোকটিই দায়ী। এখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে শুধুই ফুর্তি করার জন্য। আমাকে সে বলছে, আমি যেন তাকে সমুদ্রের ওপারে নিয়ে গিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীতে মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদ দিই আর আমি তাকে বিয়ে করি। কিন্তু ওসব হবে না; আমি ওকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। আমি স্থির করেছি, আমার যদি বিয়ে করতেই হয়, নিজের দেশে নিয়ে যদি কাউকে দেশের সেনাবাহিনীতে মর্যাদাসম্পন্ন স্থান দিতেই হয়, তবে তার জন্য আমার মনঃপূত একজন লোক বেছে নিতে হবে। আর সে হলে তুমি। তুমি যুবক, সাহসী ও বুদ্ধিমান। প্রথমবার যখন আমি তোমাকে দেখেছি, তখন থেকেই আমার হৃদয়ে তোমার ভালবাসা সৃষ্টি হয়ে আছে। তুমি এ বৃদ্ধের কবল থেকে আমাকে রক্ষা কর। আমি এখন তোমার। সমুদ্রের ওপারে চল, মর্যাদা, ধনৈশ্বর্য আর আমি সব তোমার পদচুম্বন করব। কিন্তু তার জন্য আগে এ লোকটিকে এখানেই শেষ করে যেতে হবে। লোকটি অচেতন ঘুমিয়ে আছে; তুমি যাও, ওকে খুন করে এস। তারপর চল, রওনা হই।’
রক্ষীর ঘাড়ে হাত রাখে মুবী। মুবীর রূপের মোহ-জালে আটকা পড়ে যায় রক্ষী। দুবাহু দ্বারা জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। প্রেমের যাদু দিয়ে পুরুষ বশ করায় অভিজ্ঞ মুবী। পূর্বের অবস্থান থেকে সরে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটি। রক্ষীও অগ্রসর হয়ে হাত বাড়ায় তার প্রতি।
এমন সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে একটি বর্শা ছুটে এসে বিদ্ধ হয় রক্ষীর পিঠে। আহ! বলে চীৎকার করে ওঠে লোকটি। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। দূর থেকে ছুটে আসে একজন। রক্ষীর পিঠ থেকে বর্শাটি টেনে বের করতে করতে বলে— ‘বেটা নিমকহারাম, তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
চীৎকার দেয় মুবী। বলে, ‘লোকটিকে তুমি খুন ……..।’ এর বেশী বলতে পারল না সে। পিছন থেকে অপর একজন তার বাহু ধরে ঝটকা এক টান দিয়ে ছুঁড়ে মারে বালিয়ানের দিকে। বলে, ‘আমরা তার পোষ্য বন্ধু। আমাদের জীবন তার উপর নির্ভরশীল। তোমরা আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। বিভ্রান্ত যে হয়েছে, সে তার প্রায়শ্চিত্ত পেয়ে গেছে।’
মদের নেশায় অচেতন পড়ে আছে বালিয়ান।
‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ জিজ্ঞেস করে মুবী।
‘যাচ্ছি সমুদ্রে ডুবে মরতে। তোমার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে নিয়ে যায়, আমরা সেখানেই যাব।’ এই বলে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ে তারা।
পরদিন বেশ বেলা হলে ঘুম থেকে জাগ্রত হয় বালিয়ান। রক্ষীরা রাতের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে তাকে। মুবী বলে, ‘প্রাণের ভয় দেখিয়ে সে আমাকে, নিয়ে গিয়েছিল।’ বালিয়ান শাবাশ দেয় তার রক্ষীদের। কোন ঘটনায় নিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক খুন হল, তার জন্য কোন ভাবনাই জাগল না তার মনে। মুবীর রূপ আর মদে বুঁদ হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মত হয়ে গেছে বালিয়ান। মুবী তাকে বলে, ‘ওঠ, দ্রুত রওনা হও।’ কিন্তু বালিয়ানের কোন ভাবনা নেই। নিজেকে হারিয়েই ফেলেছে যেন সে। মুবী ভাবে, এরা কত নির্দয়, কত নির্বোধ জাতি; সামান্য কারণে, হীন স্বার্থে আপন লোকদেরও হত্যা করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না!
আলী বিন সুফিয়ান কেন যেন বালিয়ানের পশ্চাদ্ধাবন না করে ফিরে গেলেন। বিদ্রোহের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনিও।
○ ○ ○
সমুদ্রোপকূলের ক্যাম্প থেকে রবিন, তার চার সঙ্গী এবং ছয়টি মেয়েকে পনেরজন রক্ষার প্রহরায় কায়রো অভিমুখে রওনা করা হয়েছে। দূত রওনা হয়ে গেছে তাদেরও আগে। বন্দীরা সকলে উটের পিঠে আর রক্ষীরা ঘোড়ায়। তারা স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলছে এবং পথে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্রাম নিচ্ছে। তাড়া নেই, শঙ্কা নেই। পথে বিপদের কোন ভয় নেই। নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় পথ চলছে তারা। কয়েদীরা নিরস্ত্র, তদুপরি তাদের ছয়জনই নারী। কারোর পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।
কিন্তু রক্ষীরা ভুলে গেছে, তাদের কয়েদীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। তীর-তরবারী ব্যবহারে সকলেই অভিজ্ঞ। তাদের দলের যাদেরকে বণিকবেশে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা রীতিমত যোদ্ধা। আর মেয়েগুলোও সেই মেয়ে নয়, যাদেরকে মানুষ অবলা নারী মনে করে থাকে। তাদের দেহ ও রূপের আকর্ষণ, মধুভরা যৌবন আর চপলতা এমন এক অস্ত্র, যা প্রবল প্রতাপশালী রাজা-বাদশাহদেরও কুপোকাত করে ফেলতে, বড় বড় বীর যোদ্ধাকেও মুহূর্তে নিরস্ত্র করতে সক্ষম।
রক্ষীদের কমাণ্ডার মিসরী। তার নজরে পড়ে, মেয়ে ছয়টির একজন বার বার তার প্রতি চোখ তুলে তাকাচ্ছে। চোখাচোখি হয়ে গেলে মিষ্টি-মধুর হাসি ভেসে ওঠে মেয়েটির ঠোঁটে। মেয়েটি যাদুর মত আকর্ষণ করছে কমাণ্ডারকে। তার রাঙ্গা ঠোঁটের মুচকি হাসি মোমের মত গলিয়ে ফেলছে তাকে।
সন্ধ্যার সময় এই প্রথমবার একস্থানে যাত্রা বিরতি দেয় কাফেলা। খাবার দেওয়া হয় সকলকে। কিন্তু খাবারে হাত দিল না মেয়েটি। কমাণ্ডারকে জানান হল। কমাণ্ডার কথা বলল মেয়েটির সঙ্গে। খাবার না খাওয়ার কারণ জানতে চায় সে। জবাবে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার দুচোখ থেকে। কিছুক্ষণ নতমুখে দাঁড়িয়ে থেকে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে আপনার সঙ্গে আমি নিভৃতে কথা বলতে চাই।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসে। ঘুমিয়ে পড়ে কাফেলার সকলে। শুয়ে পড়ে কমাণ্ডারও। কিছুক্ষণ পর সে বিছানা থেকে উঠে মেয়েটিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। নিয়ে যায় আড়ালে। বলে, কি যেন বলবে বলেছিলে, এবার বল। কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে মেয়েটি বলল, আমি একটি মজলুম মেয়ে। আমাকে খুষ্টান সৈন্যরা অপহরণ করে একটি জাহাজে তুলে নিয়ে এসেছে। আমি এক অফিসারের রক্ষিতা হয়ে থাকতে বাধ্য হই।
অন্য মেয়েদের সম্পর্কে সে জানায়, তাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় জাহাজে। তাদেরকেও আনা হয়েছে অপহরণ করে। অগ্নিগোলার শিকার হয়ে জাহাজগুলো আগুনে পুড়তে শুরু করলে একটি নৌকায় তুলে আমাদেরকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ভাসতে ভাসতে আমরা কূলে এসে পৌঁছি। তারপর গুপ্তচর সন্দেহে বন্দী হই আপনাদের হাতে।
বণিকবেশী গোয়েন্দারাও মেয়েগুলোর ব্যাপারে সুলতান সালাহুদ্দীনকে এ কাহিনীই শুনিয়েছিল। মিসরী রক্ষী কমাণ্ডারের জানা ছিল না এ কাহিনী, এই প্রথমবার শুনছে সে। তার প্রতি নির্দেশ, এরা ভয়ঙ্কর গুপ্তচর; কঠোর নিরাপত্তার সাথে এদেরকে কায়রো নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীনের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে তুলে দিতে হবে। কাজেই মেয়েদের, বিশেষ করে এই মেয়েটির কোন সাহায্য করার সাধ্য তার নেই। তাই সে নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে দেয় মেয়েটিকে। তার জানা নেই, মেয়েটির তূণীরে আরও অনেক তীর অবশিষ্ট আছে। এক এক করে সেই তীর ছুঁড়তেই থাকবে সে।
এবার মেয়েটি বলল, ‘আমি তোমার নিকট কোন সাহায্য চাই না। তুমি কোন সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেও আমি তা গ্রহণ করব না। কারণ, তোমাকে আমার এতই ভাল লাগছে যে, আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তোমাকে ভালবাসি বলেই আমি মনের বেদনার কথাগুলো তোমার কাছে ব্যক্ত করেছি।’ এমন একটি রূপসী মেয়ের মুখে এ জাতীয় কথা শুনে আত্ম-সংবরণ করতে পারে কোন পুরুষ! তাছাড়া কমাণ্ডারের হাতে মেয়েটি নিতান্ত অসহায়ও বটে। তদুপরি নিঝুম রাতের নির্জন পরিবেশ। ধীরে ধীরে বরফের মত গলতে শুরু করে মিসরী কমাণ্ডারের পৌরুষ। বন্ধুসুলভ প্রেমালাপ জুড়ে দেয় সে মেয়েটির সঙ্গে। এবার মেয়েটি নিক্ষেপ করে তূণীরের আরেকটি তীর। সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পূত-পবিত্র চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করতে শুরু করে। বলে— ‘আমি তোমার গভর্নর সালাহুদ্দীন আইউবীকে আমার নির্যাতনের কাহিনী শুনিয়েছিলাম। আশা ছিল, তার মত একজন মহৎ ব্যক্তি আমার প্রতি দয়াপরবশ হবেন। কিন্তু আশ্রয়ের নামে তিনি আমায় নিজের তাঁবুতে নিয়ে রাখলেন এবং মদপান করে হায়েনার মত রাতভর আমার সম্ভ্রম লুট করলেন। পশুটা আমার হাড়গোড় সব ভেঙ্গে দিয়েছে। মদপান করে তিনি এমনই অমানুষ হয়ে যান যে, তখন তার মধ্যে মানবতা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।’
মাথায় খুন চেপে যায় মিসরীর। দাঁত কড়মড় করে বলে ওঠে, ‘এ্যাঁ, আমাদের শোনান হয়, সালাহুদ্দীন একজন পাক্কা ঈমানদার, এক্কেবারে ফেরেশতা। মদ-নারীর প্রতি নাকি তাঁর প্রচণ্ড ঘৃণা। আর তলে তলে করে বেড়াচ্ছেন এসব, না?’
‘এখন তোমরা আমাকে তারই কাছে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যা বললাম, যদি তোমার বিশ্বাস না হয়ে থাকে, তাহলে রাতে দেখ, আমাকে কোথায় থাকতে হয়। তোমাদের সুলতান আমাকে কয়েদখানায় না রেখে রাখবেন তাঁর হেরেমে, সে কথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। লোকটার কথা মনে পড়লে আমার গা শিউরে ওঠে।’ বলল মেয়েটি।
এ জাতীয় আরও অনেক কথা বলে মিসরী কমাণ্ডারের মনে সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা সৃষ্টি করে মেয়েটি। মিসরী এখন সম্পূর্ণরূপে মেয়েটির হাতের মুঠোয়। সে তার মাথা কব্জা করে নিয়েছে। কিন্তু কমাণ্ডার জানে না, এসব হল গোয়েন্দা মেয়েদের অস্ত্র। সব শেষে মেয়েটি বলল— ‘তুমি যদি আমাকে এ লাঞ্ছনার জীবন থেকে উদ্ধার করতে পার, তাহলে আমি আজীবনের জন্য তোমার হয়ে যাব এবং আমার পিতা বিপুল স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তোমাকে পুরস্কৃত করবেন।’
তার পন্থাও জানিয়ে দেয় মেয়েটি। বলে, ‘তুমি আমার সঙ্গে সমুদ্র পার হয়ে পালিয়ে যাবে। নৌকার অভাব হবে না। আমার পিতা বড় ধনাঢ্য ব্যক্তি। আমি তোমাকে বিয়ে করে নেব আর আমার পিতা তোমাকে উন্নত একটি বাড়ি ও বিপুল ধন-সম্পদ প্রদান করবেন। নির্বিঘ্নে ব্যবসা করে আমাকে নিয়ে সুখে জীবন কাটাতে পারবে।’
মিসরীর মনে পড়ে যায়, সে মুসলমান। বলল, ‘কিন্তু আমি তো আমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারব না।’ মেয়েটি কিছুক্ষণ মৌন থেকে ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার জন্য আমিই আমার ধর্ম বিসর্জন দেব।’
পলায়ন ও বিয়ের পরিকল্পনা তৈরী করে দুজনে। মেয়েটি বলল, ‘তোমার উপর আমি কোন চাপ দিতে চাই না। ভালভাবে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও। আমি শুধু জানতে চাই, আমার মনে তোমার প্রতি যতটুকু ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে, ততটুকু হৃদ্যতা আমার প্রতিও তোমার অন্তরে জেগেছে কি না। আমাকে বরণ করতে যদি তুমি প্রস্তুত হয়েই থাক, তাহলে চেষ্টা কর, যেন কায়রো পৌঁছুতে আমাদের সফর দীর্ঘ হয়। ওখানে পৌঁছে গেলে তুমি আমার গন্ধও পাবে না।’
মেয়েটির উদ্দেশ্য, সফর দীর্ঘ হোক এবং তিন দিনের স্থলে ছয়দিন পথেই কেটে যাক। তার কারণ, রবিন ও তার সঙ্গীরা পালাবার চেষ্টা করছে। রাতে ঘুমন্ত রক্ষীদেরকে তাদেরই অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে তাদেরই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পালাবার পরিকল্পনা নিয়ে সুযোগের সন্ধান করছে তারা। এত মাত্র প্রথম মন্যিল, প্রথম অবস্থান। এরজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সফর, যাতে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে কাজ করা যায়।
এ উদ্দেশ্য সাধনেই মেয়েটিকে ব্যবহার করছে তারা। মিসরী কমাণ্ডারকে হাত করার দায়িত্ব অর্পণ করেছে তার উপর। মেয়েটি প্রথম সাক্ষাতেই ধরাশয়ী করে ফেলে মিসরী কমাণ্ডারকে।
মিসরী কমাণ্ডার তেমন ব্যক্তিত্ববান লোক নয়; একজন প্লাটুন কমাণ্ডার মাত্র। এমন সুন্দরী নারী স্বপ্নেও দেখেনি সে কখনও। অথচ এখন কিনা অনুপম এক অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী তার হাতের মুঠোয়। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তার হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে বসেছে মেয়েটি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কমাণ্ডার। ভুলে গেছে নিজের ধর্ম ও কর্তব্যের কথা। এখন সে ক্ষণিকের জন্যও মেয়েটি থেকে আলাদা হতে চাইছে না।
এ উন্মাদনার মধ্যে পরদিন ভোরবেলা কমাণ্ডার প্রথম আদেশ জারী করে, উট-ঘোড়াগুলো বেশ ক্লান্ত; কাজেই আজ আর সফর হবে না। রক্ষী ও উষ্ট্ৰচালকগণ এ ঘোষণায় বেশ আনন্দিত হয়। কারণ, রণক্ষেত্রে সীমাহীন পরিশ্রমে তাদেরও দেহ অবসন্ন। কায়রো পৌঁছবার কোন তাড়াও নেই তাদের।
বিশ্রাম ও গল্প-গুজবে কেটে যায় দিন। কমাণ্ডারও মেয়েটিকে নিয়ে উন্মাতাল। দিন গিয়ে রাত এল। ঘুমিয়ে পড়ল সকলে। কমাণ্ডার মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল খানিকটা দূরে। সকলের দৃষ্টির আড়ালে মেয়েটি রঙ্গিন স্বপ্নের নীলাভ আকাশে পৌঁছিয়ে দিল তাকে।
পরদিন তাঁবু তুলে যাত্রা করে কাফেলা। কিন্তু কমাণ্ডার সোজা রাস্তা ছেড়ে ধরে অন্য পথ। সঙ্গীদের বলল, এ পথে সামনে ছাউনি ফেলার জন্য বেশ মনোরম জায়গা আছে। একটি বসতিও আছে কাছে। ডিম-মুরগী পাওয়া যাবে। শুনে সঙ্গীদের আনন্দ আরও বেড়ে যায় যে, কমাণ্ডার আমাদের আয়েশের চিন্তা করছেন।
কিন্তু প্লাটুনের দুজন সৈনিক কমাণ্ডারের এসব আচরণের আপত্তি তোলে। তারা বলে, ‘আমাদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর কয়েদী। লোকগুলো শত্রুবাহিনীর গুপ্তচর। যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অযথা সফর দীর্ঘ করা ঠিক হচ্ছে না।’ কমাণ্ডার তাদের এই বলে থামিয়ে দিল যে, ‘সে দায়িত্ব আমার। গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছবো না বিলম্বে, সে তোমাদের ভাবতে হবে না। জবাবদিহি করতে হলে আমাকেই করতে হবে; তোমাদের এত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।’ তারা কমাণ্ডারের জবাবে চুপসে যায়।
এগিয়ে চলছে কাফেলা। দুপুরের পর কাফেলা যেখানে পৌঁছে, সেখানে আশপাশে অসংখ্য শকুন উড়তে ও মাটিতে নামতে-উঠতে দেখে তারা। বুঝা গেল, মৃত মানুষের লাশ আছে এখানে। চারদিকে মাটি ও বালির টিলা, বড় বড় বৃক্ষও আছে। টিলার ভেতরে ঢুকে পড়ে কাফেলা। ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠে গেছে পথ। একটি উঁচু স্থান থেকে বিশাল এক ময়দান চোখে পড়ে তাদের। তার এক স্থানে বৃত্তাকারে উঠানামা করছে অনেকগুলো শকুন। শোরগোল করে কিসে যেন মেতে আছে শকুনগুলো। কিছুদূর অগ্রসর হলে চোখে পড়ে, সেখানে কতগুলো লাশ। পচা লাশের দুর্গন্ধে বিষিয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।
এগুলো সেই সুদানীদের লাশ, যারা রোম উপসাগরের তীরে অবস্থানরত সুলতান সালাহুদ্দীনের বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে রওনা হয়েছিল। সুলতান সালাহুদ্দীনের জানবাজ সৈনিকরা রাতের বেলা পেছন থেকে হামলা চালিয়ে এখানেই থামিয়ে দিয়েছে তাদের অগ্রযাত্রা, ব্যর্থ করে দিয়েছে তাদের অশুভ তৎপরতা। আরও সামনে মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সুদানীদের অসংখ্য লাশ। সালাহুদ্দীন বাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর নিহতদের লাশগুলো পর্যন্ত তুলে নেওয়ার সুযোগ পায়নি তারা।
○ ○ ○