কায়রো থেকে দেড়-দু মাইল দূরবর্তী একটি অঞ্চল। এখানকার একদিকে উঁচু-নীচু বালির টিলা। অপর তিনদিকে ধু-ধু বালুকা প্রান্তর।
আজ লাখো জনতার পদভারে মুখরিত-প্রকম্পিত এ অঞ্চলটি। চারদিক থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় এসে ভীড় জমিয়েছে অগণিত মানুষ। কেউ এসেছে উটে চড়ে, কেউ ঘোড়ায়, কেউ বা এসেছে গাধার পিঠে করে। পায়ে হেঁটে এসেছে অসংখ্য।
চার-পাঁচদিন ধরে মানুষ আসছে আর আসছে। সমবেত হচ্ছে বিশাল-বিস্তৃত এই মরুপ্রান্তরে। কায়রোর বাজারগুলোতে লোকের ভীড় বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে জৌলুস। সরাইখানাগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
দূর-দূরান্ত থেকে এরা এসেছে সরকারী এক ঘোষণা শুনে। মিসরী ফৌজের সামরিক মহড়া হবে এখানে। ঘোড়-সওয়ারী, শতর-সওয়ারী, ধাবমান উট-ঘোড়ার পিঠ থেকে তীরন্দাজি ইত্যাদি রণকৌশলের মহড়া প্রদর্শন করবে মিসরী সৈন্যরা।
ঘোষণাটি প্রচারিত হয়েছে মিসরের গভর্নর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পক্ষ থেকে। তাঁর উদ্দেশ্য দুটি। এক. এতে সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার উৎসাহ পাবে। দুই. এখনও যারা সামরিক শক্তিতে সুলতান সালাহুদ্দীনকে দুর্বল মনে করে, তাদের সংশয় দূর হবে।
এ সামরিক মহড়ার প্রতি জনসাধারণের এত আগ্রহ দেখে সুলতান সালাহুদ্দীন বেজায় খুশী। কিন্তু খানিকটা অস্থিরচিত্ত বলে মনে হচ্ছে আলী বিন সুফিয়ানকে। তিনি সুলতানের সামনে নিজের এ অস্থিরতার কথা ব্যক্ত করেছেন। জবাবে সুলতান সালাহুদ্দীন হাসিমুখে বললেন— ‘আরে, মহড়ায় অংশগ্রহণকারী লোকদের সংখ্যা যদি এক লাখ হয়, তাহলে তাদের মধ্য থেকে আমরা পাঁচ হাজার সৈন্যও তো পাব।’
‘আমীরে মুহতারাম! আমি তো বিষয়টাকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি। আপনার ধারণা অনুযায়ী মহড়ায় অংশগ্রহণকারী লোকদের সংখ্যা যদি এক লাখ হয়, তবে তাতে গুপ্তচর থাকবে অন্তত এক হাজার। পাড়া গাঁ থেকে অসংখ্য মহিলাও আসছে। তাদের বেশীর ভাগই সুদানী ও শ্বেতাঙ্গী। ফলে খৃষ্টান মহিলারা তাদের মধ্যে লুকিয়ে যেতে পারবে অনায়াসেই।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘এ সমস্যাটা আমিও ভাল করেই বুঝি। কিন্তু তুমি তো জান, আমি যে মেলার আয়োজন করেছি, তা কত জরুরী। তোমার গোয়েন্দা বিভাগকে তুমি আরও সতর্ক কর।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।
‘হ্যাঁ, তা আমি করব অবশ্যই। এই মেলা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার অস্থিরতার কথা আপনাকে পেরেশান করার জন্য বলিনি। এই মেলা কি বিপদ সঙ্গে নিয়ে আসছে, আমি আপনাকে তাই শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কায়রোতে অস্থায়ী পতিতালয় খোলা হয়েছে, যা কিনা আমোদীদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে সারা রাত। অনেকে শহরের বাইরে তাঁবু গেড়েছে। আমার গুপ্তচররা আমাকে তথ্য দিয়েছে, তাঁবুগুলোর মধ্যে জুয়াড়ী এবং বেশ্যা মেয়েদের আস্তানাও রয়েছে। আগামীকাল মেলার প্রথম দিন। নর্তকী-গায়িকারা মেলায় অংশ নেওয়া নিরীহ লোকদের পকেট উজাড় করে নিচ্ছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
মেলা শেষ হয়ে গেলে এসব নোংরামিরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। এখনি এসবের উপর আমি কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাই না। মিসরের মানুষের বর্তমান নৈতিক অবস্থা ভাল নয়। নাচ-গান, বেশ্যাবৃত্তি দু-একদিনে নির্মূল করা যায় না। এ মুহূর্তে আমার প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী। আমার ফৌজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তুমি তো জান আলী! আমাদের সৈন্যের কত প্রয়োজন। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে স্পষ্ট করেই আমি একথা ঘোষণা দিয়েছি।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।
‘আপনার বক্তব্যে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমীরে মুহতারাম! আমার গুপ্তচরদের দৃষ্টিতে আমাদের সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অর্ধেকই আমাদের ওফাদার নয়। আপনি ভাল করেই জানেন, এদের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা আপনাকে এই গদিতে দেখতে চায় না। আর অবশিষ্ট যারা আছে, তাদের মনও সুদানীদের সঙ্গে। তাদের প্রত্যেকের পিছনে আমি একজন করে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছি। তারা আমাকে এদের তৎপরতা ও গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘আচ্ছা, কারও কোন ভয়ঙ্কর তৎপরতা চোখে পড়েছে কি?’ কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
‘এরা আপন ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে রাতের আঁধারে বিভিন্ন সন্দেহজনক তাঁবুতে এবং পতিতালয়ে চলে যায়। দুজন কর্মকর্তা সম্পর্কে আমি এমন রিপোর্টও পেয়েছি যে, তারা নিজ ঘরে নর্তকী ডেকে এনে আসর বসায়। এ যাবত এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে আমীরে মুহতারাম! দশদিন আগে রোম উপসাগরের কূলে যে রহস্যময় পালতোলা নৌকাটি দেখা গিয়েছিল, আমার সব চিন্তা এখন তাকে নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
ঘটনাটি বিস্তারিত জানতে চান সুলতান সালাহুদ্দীন। আলী বিন সুফিয়ান বললেন—
‘রোম উপসাগরের তীর থেকে আমাদের সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিয়ে আসার সময় সমুদ্রের প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য বিভিন্ন স্থানে দু দুজন করে সৈন্য মোতায়েন করে রাখা হয়েছিল। জেলে ও যাযাবর বেশে আমিও আমার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কয়েকজন লোক রেখে এসেছিলাম। খৃষ্টানরা ইচ্ছে করলেই যাতে হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসতে না পারে এবং ওদিক থেকে কোন খৃষ্টান চর যাতে মিসরে ঢুকতে না পারে, তার জন্যই ছিল আমার এ আয়োজন। কিন্তু সমুদ্রতীর অতি দীর্ঘ হওয়ার কারণে সর্বত্র নজর রাখা সম্ভব হয়নি। দশদিন আগে একস্থান থেকে একটি পালতোলা নৌকা বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল। সম্ভবত নৌকাটি কোন এক রাতের আঁধারে ঢুকে গিয়েছিল।
নৌকাটি যেতে দেখে ঘোড়া ছুটায় আমাদের দুজন অশ্বারোহী। কিন্তু যে স্থান থেকে নৌকাটি বেরিয়েছিল, সেখানে গিয়ে তারা কিছুই দেখতে পেল না। তীরে কোন মানুষ নেই, নৌকা চলে গেছে মাঝ নদীতে। নৌকা ও পালের গঠনে তাদের মনে হয়েছে নৌকাটি মিসরী জেলেদের নয়— সমুদ্রের ওপারের হবে। আরোহীদ্বয় চারদিক ঘুরে-ফিরে কোন তথ্য বের করতে পারেনি। এ সংবাদ তারা কায়রোতে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল।’
ঘটনার বিবরণ দিয়ে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘মেলা অনুষ্ঠানের কথা আমরা দেড় মাস ধরে প্রচার করছি। দেড় মাসে এ সংবাদ ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং সেখান থেকে গুপ্তচর আগমন করা মোটেই বিচিত্র নয়। আমার তো প্রবল ধারণা, আমোদীদের সঙ্গে খৃষ্টানদের বহু গুপ্তচরও মেলায় ঢুকে পড়েছে।
কায়রোতে মেয়ে ক্রয়-বিক্রয় এখন একটি স্বতন্ত্র পেশা। সুলতানের বুঝতে নিশ্চয় কষ্ট হবে না যে, যারা এই মেয়েদের ক্রয় করে, তারা সমাজের সাধারণ মানুষ নয়। কায়রোর বড় বড় ব্যবসায়ী, আমাদের প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারাই হল মেয়েদের খরিদ্দার। আর বিক্রি হচ্ছে যেসব মেয়ে, তাদের মধ্যে যে খৃষ্টান গুপ্তচরও রয়েছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।’
এসব রিপোর্টে সুলতান সালাহুদ্দীন বিচলিত হলেন না মোটেই। রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের পরাস্ত করা হল প্রায় এক বছর কেটে গেছে। আলী বিন সুফিয়ান সমুদ্রোপকূলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বিছিয়ে রেখেছেন। তা শতভাগ নির্ভরযোগ্য না হলেও তিনি এ তথ্য পেয়ে গেছেন যে, খৃষ্টানরা মিসরে বহু গুপ্তচর ও সন্ত্রাসী ঢুকিয়ে রেখেছে। তবে মিসরে তাদের পরিকল্পনা কী, সে ব্যাপারে এখনও কিছু জানা যায়নি। বাগদাদ ও দামেশক থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টে জানা গেছে খৃষ্টানরা ওদিকেই বেশী চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। বিশেষত সিরিয়ায় তারা মুসলমান শাসকদের ভোগ-বিলাস ও মদ-নারীতে মত্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর বর্তমানে এখনই তারা সরাসরি সংঘাতে জড়িত করার সাহস পাচ্ছে না। রোম উপসাগরে যখন সুলতান সালাহুদ্দীন হাজার হাজার সৈন্যসহ খৃষ্টানদের নৌবহরকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন, ঠিক তখন নুরুদ্দীন জঙ্গী আরবে খৃষ্টানদের সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ করে তাদেরকে সন্ধিচুক্তিতে বাধ্য করেছিলেন এবং জিযিয়া উসুল করে নিয়েছিলেন। সেই লড়াইয়ে বহু খৃষ্টান সুলতান জঙ্গীর হাতে বন্দী হয়েছিল। রেনাল্ট নামক এক খৃষ্টান সালারও ছিল তাদের মধ্যে। সুলতান জঙ্গী তাদেরকে মুক্তি দেননি। কারণ, ইতিপূর্বে খৃষ্টানরা মুসলমান কয়েদীদের শহীদ করেছিল। তাছাড়া একে একে অনেক প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করে চলেছে খৃষ্টানরা।
সুলতান সালাহুদ্দীনের স্বপ্ন, খৃষ্টানদের হাত থেকে ফিলিস্তীন উদ্ধার করতে হবে। এবং আরব ভূখণ্ডকে ক্রুসেডারদের নাপাক পদচারণা থেকে পবিত্র করতে হবে। পাশাপাশি তিনি মিসরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও মজবুত করতে চান। তাই একই সময়ে নানামুখী সেনা অভিযান পরিচালনা এবং শত্রুদের চতুর্মুখী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক সৈন্য।
সুলতানের পরিকল্পনা অনুপাতে মিসরের সেনাবাহিনীতে নতুন সেনাভর্তির গতি অনেক ধীর। এর কারণ, বিলুপ্ত সুদানী বাহিনীর সালাহুদ্দীন বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা।
সুলতান সালাহুদ্দীনের যে বাহিনীটি এখন আছে, তার কিছু সৈন্য মিসর থেকে সংগৃহীত। কিছু সুলতান জঙ্গীর পাঠানো। কিছু আছে, যারা ওফাদারীর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিলুপ্ত সুদানী বাহিনী থেকে এসে যোগ দিয়েছে।
মিসরের জনগণ এখনও এ বাহিনীটিকে চোখে দেখেনি। সুলতান সালাহুদ্দীনকেও দেখেনি তারা। তাই মেলার আয়োজন করে সুলতান তার সামরিক কর্মকর্তা ও কমাণ্ডারদের আদেশ দিয়েছেন, যেন তারা মেলায় আগত সাধারণ লোকদের সঙ্গে মিশে যায় এবং সদাচার ও ভালবাসা দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করে। সুলতান তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, তোমরা জনসাধারণেরই একজন। আমাদের উদ্দেশ্য, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রাজত্বকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করা এবং তাকে খৃষ্টানদের অরাজকতা থেকে মুক্ত করা।
মেলা শুরু হওয়ার আগের দিন থেকে আলী বিন সুফিয়ান সুলতানকে গুপ্তচরদের বিপদ সম্পর্কে অবহিত করতে থাকেন। তিনি বললেন, ‘আমীরে মুহতারাম! আমার মূলত গুপ্তচরদের কোন ভয় নেই। আমার আসল শঙ্কা সেই মুসলমান ভাইদের, যারা কাফিরদের গোপন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে। এই গাদ্দাররা না থাকলে আমাদের বিরুদ্ধে খৃষ্টানদের কোন পরিকল্পনাই সফল হত না। আমি মেলায় যেসব নর্তকীদের দেখতে পাচ্ছি, তাদেরকে আমি ক্রুসেডারদের এক একটি ফাঁদ বলে মনে করি। তবু আমার লোকেরা দিন-রাত সারাক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।’
‘তোমাদের লোকদের বলে দাও, যেন কোন গুপ্তচরকে খুন না করে। যাকেই সন্দেহ হবে, জীবন্ত ধরে নিয়ে আসবে। গুপ্তচর হল দুশমনের চোখ-কান। আর আমাদের জন্য তারা জবান। ধরে এনে কায়দা মত চাপ সৃষ্টি করতে পারলে খৃষ্টানদের অজানা পরিকল্পনার তথ্য বের করা যাবে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।
○ ○ ○
মেলা দিবসের ভোরবেলা। বিশাল-বিস্তৃত মাঠের তিন দিক দর্শনার্থীদের ভীড়ে গমগম করছে। সমরডঙ্কা বাজতে শুরু করেছে। অশ্বখুরধ্বনি এমন শোনা যাচ্ছে, যেন তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ঊর্মিমালা ধেয়ে আসছে। ধুলোয় ছেয়ে গেছে আকাশ।
দু হাজারেরও অধিক ঘোড়া। প্রথমটি এইমাত্র প্রবেশ করল মাঠে। আরোহী সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। তাঁর দুপার্শ্বে দুজন পতাকাবাহী। পিছনে রক্ষী বাহিনী। ঘোড়াগুলোর পিঠে ফুলদার চাদর বিছানো। প্রতিটি ঘোড়ার আরোহীর হাতে একটি করে বর্শা। বর্শার চকমকে ফলার সঙ্গে বাধা রঙিন কাপড়ের ছোট একটি ঝাণ্ডা। প্রত্যেক আরোহীর কোমরে ঝুলছে তরবারী। দুলকি চালে চলছে ঘোড়াগুলো। ঘাড় উঁচু করে বুক ফুলিয়ে বসে আছে আরোহীরা। চেহারায় তাদের বীরত্বের ছাপ। তাদের ভাবভঙ্গিতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে দর্শনার্থীদের মধ্যে। প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সকলের উপর।
দর্শনার্থীদের একদল সম্মুখের বৃত্তের উপর দণ্ডায়মান। তাদের পিছনে একদল ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট। তাদের পিছনে যারা আছে, তারা উটের পিঠে বসা। এক একটি উট ও ঘোড়ায় দু তিনজন করে লোক বসা।
তাদের সম্মুখে এক স্থানে একটি শামিয়ানা টানানো, যার নীচে রাখা আছে কতগুলো চেয়ার। এখানে বসেছেন উঁচু স্তরের দর্শনার্থীবৃন্দ। বড় বড় ব্যবসায়ীও আছেন এদের মধ্যে। আছেন সালাহুদ্দীন সরকারের পদস্থ অফিসার ও দেশের সম্মানীত ব্যক্তিবর্গ। কায়রোর বিভিন্ন মসজিদের ইমামদেরও দেখা যাচ্ছে এখানে। ইমামগণকে বসান হয়েছে সকলের সামনে। কারণ, সুলতান সালাহুদ্দীন ধর্মীয় নেতৃবর্গ এবং আলেমদের এতই শ্রদ্ধা করেন যে, তিনি তাদের উপস্থিতিতে তাদের অনুমতি ছাড়া বসেনও না।
এক পার্শ্বে উপবিষ্ট সুলতান সালাহুদ্দীনের উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আল-বার্ক। তারই পাশে বসা অতিশয় রূপসী এক তরুণী। মেয়েটির সঙ্গে বসা ষাটোর্ধ্ব বয়সের এক বৃদ্ধ। দেখতে তাকে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বলে মনে হয়। আল-বার্ক একাধিকবার তাকান মেয়েটির প্রতি। মেয়েটিও একবার তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে মুখ টিপে হাসে। বাঁকা চোখে দৃষ্টিপাত করে বৃদ্ধের প্রতি, সঙ্গে সঙ্গে উবে যায় তার মুখের হাসি।
দর্শনার্থীদের সম্মুখে অশ্বারোহীদের মহড়া শেষ হয়ে যায়। আসে উষ্ট্রারোহী বাহিনী। উটগুলোও ঘোড়ার ন্যায় রঙিন চাদর দ্বারা সজ্জিত। প্রত্যেক আরোহীর হাতে একটি করে লম্বা বর্শা, যার ফলার সামান্য নীচে বাঁধা পতাকার ন্যায় তিন ইঞ্চি চওড়া এবং দু ফিট লম্বা দু রঙা কাপড়। প্রত্যেক আরোহীর কাঁধে ঝুলছে একটি করে ধনুক। উটের যিনের সঙ্গে বাঁধা আছে রঙিন তূণীর। অপূর্ব এক আকর্ষণীয় ঢঙে বসে আছে আরোহীরা। অশ্বারোহীদের দৃষ্টিও সম্মুখপানে নিবদ্ধ। ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে না একজনও। দর্শনার্থীদের উট আর এই বাহিনীর উট দেখতে এক রকম হলেও সামরিক বিন্যাস, ফৌজী চলন ইত্যাদির কারণে এদেরেকে ভিন্ন জগতের ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে হচ্ছে।
পার্শ্বে উপবিষ্ট রূপসীর প্রতি আবার চোখ ফেলে আল-বার্ক। এবার পূর্ণ চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনে। একজনের আঁখিযুগল আটকে গেছে যেন অপরজনের চেহারায়। যাদুময়ী মেয়েটির দু চোখে বিদ্যুতের ঝলক অনুভব করে যেন আল-বার্ক।
সলাজ হাসির রেখা ফুটে উঠে মেয়েটির ওষ্ঠাধরে। হঠাৎ যেন তার সম্বিৎ ফিরে আসে। তাকায় অপর পার্শ্বে উপবিষ্ট বৃদ্ধের প্রতি মুহূর্তে তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
ঘরে বউ আছে আল-বার্কের। চার সন্তানের বাবা। কিন্তু এ মুহূর্তে বউয়ের কথা মনে নেই লোকটির। দিব্যি ভুলে গেছে সব। মেয়েটি তার এতই কাছে বসা যে, তার রেশমী ওড়না উড়ে এসে আল-বার্কের বুকে ঝাঁপটা দেয় কয়েকবার। একবার নিজের হাতে সরিয়ে নিয়ে মাফ করবেন বলে ক্ষমা প্রার্থনাও করে মেয়েটি। আল-বার্ক মুখ টিপে হাসে—বলে না কিছুই।
উষ্ট্রারোহীদের পিছন দিয়ে আসছে পদাতিক বাহিনী। এদের মধ্যে আছে তীরন্দাজ ও তরবারীধারী ইউনিট। এদের সকলের চলার ঢঙ এক তালের, একই রকম অস্ত্র এবং একই ধরনের পোশাক দর্শনার্থীদের মধ্যে সেই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, যা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীনের কামনা। সৈন্যদের দেখতে শক্ত-সামর্থ, সুঠাম-সুদেহী, উৎফুল্ল ও শান্ত-সুবোধ বলে মনে হচ্ছে।
পদাতিক বাহিনীর পিছনে আসছে মিজানীক। অনেকগুলো ঘোড়া টেনে নিয়ে আসছে সেগুলো। প্রতিটি মিনজানীক ইউনিটের পিছনে আছে একটি করে ঘোড়াগাড়ী। তাতে রাখা আছে বড় বড় পাথর ও পাতিলের মত বড় বড় বরতন। বরতনগুলো তেলের মত এক ধরনের তরল পদার্থে ভরা। মিনজানীক দ্বারা নিক্ষেপ করা হয় এগুলো। মিনজানীকের সাহায্যে একটি বরতন ছুঁড়ে মারলে তা দূরে গিয়ে ভেঙ্গে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায় এবং তরল পদার্থগুলো চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার উপর নিক্ষেপ করা হয় অগ্নিতীর। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন জ্বলে উঠে দাউ দাউ করে।
সুলতান সালাহুদ্দীনের নেতৃত্বে উপবিষ্ট ও দণ্ডায়মান দর্শনার্থীদের সম্মুখ দিয়ে সামনে বেরিয়ে আসে এসব আরোহী ও পদাতিক বাহিনী। রাস্তা থেকে মোড় ঘুরে আবার মাঠে ফিরে এসেছেন সুলতান। সম্মুখে তার পতাকাবাহীদের ঘোড়া। ডানে-বাঁয়ে ও পিছনে রক্ষীবাহিনী। তাদের পিছনে নায়েব ও সালারদের বাহন।
মাঠে এসেই হঠাৎ থেমে যান সুলতান সালাহুদ্দীন। এক লাফে নেমে পড়েন ঘোড়ার পিঠ থেকে। হাত নেড়ে দর্শনার্থীদের সালাম ও অভিনন্দন জানাতে জানাতে চলে যান শামিয়ানার নীচে। দাঁড়িয়ে যায় সকলে। সুলতান সালাহুদ্দীন সবাইকে সালাম করে বসে পড়েন নির্দিষ্ট আসনে।
আরোহী ও পদাতিক বাহিনী মাঠ পেরিয়ে খানিক দূর অতিক্রম করে অদৃশ্য হয়ে যায় টিলার আড়ালে। দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে মাঠে প্রবেশ করে এক অশ্বারোহী। এক হাতে তার ঘোড়ার লাগাম, অপর হাতে উটের রশি। ঘোড়ার গতির সঙ্গে তাল রেখে একটি উটও ছুটে আসছে তার পিছনে। মাঠের মধ্যখানে এসে আরোহী হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যায় ঘোড়াটির পিঠে। লাফ দিয়ে চলে যায় উটের পিঠে। দাঁড়িয়ে থাকে সটান। আবার লাফিয়ে চলে আসে গোড়ার পিঠে। সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে। ঘোড়া ও উটসহ এগিয়ে যায় কয়েক পা। লাফিয়ে চড়ে বসে ঘোড়ার পিঠে। তার ঘোড়া ও উট ছুটে চলছে সমান তালে। ঘোড়ার পিঠ থেকে চলে যায় উটের পিঠে। ছুটে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় একদিকে।
খাদেমুদ্দীন আল-বার্ক মাথাটা সামান্য এলিয়ে দেয় বাঁ দিকে। এখন তার মুখ আর মেয়েটির মাথার মাঝে ব্যবধান দু থেকে তিন ইঞ্চি। তার প্রতি তাকায় মেয়েটি। মুখ টিপে হাসে আল-বার্ক। লজ্জা পায় মেয়েটি। বৃদ্ধ তাকায় দু জনের প্রতি। কপালে ভাঁজ পড়ে যায় তার।
আচমকা ঘোড়াগাড়িতে করে নিয়ে আসা ডেকচির মত পাত্রগুলো টিলার পিছন থেকে উড়ে এসে নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে মাঠে। একের পর এক পাত্র এসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে আর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হচ্ছে। তেল ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। অন্তত একশত পাত্র নিক্ষিপ্ত হয় এবং তার তরল পদার্থগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এমন সময়ে টিলার উপর আত্মপ্রকাশ করে ছয়জন তীরন্দাজ। তারা জ্বলন্ত সলিতাওয়ালা তীর ছুঁড়ে। মাঠের বিক্ষিপ্ত তরল পদার্থের উপর এসে নিক্ষিপ্ত হয় তীরগুলো। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন জ্বলে ওঠে। মাঠের এক হাজার বর্গগজ জায়গা জুড়ে এখন আগুন জ্বলছে।
ঠিক এমন সময়ে একদিক থেকে তীরগতিতে ছুটে আসে চার অশ্বারোহী। কিন্তু কি আশ্চর্য! তারা আগুনের কাছে এসে থামল না। গতি হ্রাসও করল না। শাঁ শাঁ করে ঢুকে পড়ল জ্বলন্ত শিখার মধ্যে। নির্বাক অনিমেষ নয়নে তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে দর্শনার্থীরা। লোকগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে নিশ্চিত। কিন্তু না, তারা জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মধ্যে দিব্যি দৌড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যায় অন্যদিক দিয়ে। খুশীতে আত্মহারা হয়ে যায় দর্শনার্থীরা। আনন্দের আতিশয্যে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তারা তাকবীর ধ্বনি তোলে। আগুন ধরে গিয়েছিল দু আরোহীর কাপড়ে। তারা ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে পানির উপর লাফিয়ে পড়ে। গড়ানি খায় দু তিনবার। তাদের কাপড়ের আগুন নিভে যায়।
এই শোরগোল, আনন্দ-উল্লাস এবং অশ্বারোহীদের বীরত্ব প্রদর্শনের দৃশ্যের প্রতি আল-বার্কের মন নেই। সে এর থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন। পার্শ্বের রূপসী মেয়েটিকে নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে তার সব ভাবনা-চিন্তা। সে প্রেম-সাগরে হারিয়ে যায়।
আল-বার্কের প্রতি এক নজর তাকিয়ে মুচকি একটি হাসি দিয়েই আবার বৃদ্ধের প্রতি দৃষ্টিপাত করে মেয়েটি। এবার কেন যেন উঠে চলে গেল বৃদ্ধ। মেয়েটি তার গমন পথে তাকিয়ে থাকে। আল-বার্কের জানা ছিল, মেয়েটি বৃদ্ধের সঙ্গে এসেছে। তাই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে— ‘তোমার পিতা কোথায় চলে গেলেন?’
‘ইনি আমার পিতা নন— স্বামী।’ জবাব দেয় মেয়েটি।
‘স্বামী? তা এই বিয়ে কি তোমার বাবা-মা দিয়েছেন?’ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে আল-বার্ক।
‘না, তিনি আমায় কিনে এনেছেন।’ ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে জবাব দেয় মেয়েটি।
‘এখন গেলেন কোথায়?’ প্রশ্ন করে আল-বার্ক।
‘আমার প্রতি নারাজ হয়ে চলে গেছেন। তার সন্দেহ, আমি আপনার সঙ্গে প্রেম নিবেদন করছি।’ জবাব দেয় মেয়েটি।
‘আচ্ছা, সত্যিই কি তুমি আমার প্রতি ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছ?’ কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চায় আল-বার্ক।
সলাজ হাসি ফুটে উঠে মেয়েটির ওষ্ঠাধরে। ফিসফিস করে বলে, ‘বুড়োটাকে আমার আর ভাল লাগে না; এর ব্যাপারে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। এর থেকে যদি কেউ আমাকে মুক্ত না করে, তবে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোন পথ থাকবে না।’
সামরিক মহড়া ইতিপূর্বে কখনও দেখেনি দর্শনার্থীরা। তারা দেখেছিল শুধু সুদানী ফৌজ, যারা শ্বেতহস্তী হয়ে বসেছিল রাজকোষের উপর। তাদের কমাণ্ডাররা বাইরে বের হত রাজা-বাদশাহদের ন্যায়। সঙ্গে সেনাবহর থাকলে তারা পল্লীবাসীদের জন্য আপদ হয়ে দেখা দিত। জনগণের গরু-ছাগল ছিনিয়ে নিয়ে যেত। কারও নিকট উন্নত জাতের একটি ঘোড়া দেখলে সেটি কেড়ে নিয়ে যেত। মানুষ বুঝত, সরকার সৈন্য পুষে প্রজাদের উপর নিপীড়ন চালানোরই জন্য।
কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীনের বাহিনী সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সুলতানের বাহিনীর একটি অংশ মহড়ার মাধ্যমে আজ অনুপম বীরত্ব প্রদর্শন করল। অপর এক অংশ সুলতানের পরামর্শে একাকার হয়ে গেছে জনতার মধ্যে। উদ্দেশ্য, জনতার সঙ্গে মিশে, কথা বলে এই ধারণা সৃষ্টি করা যে, আমরা তোমাদের ভাই, তোমাদেরই একজন। তোমাদের কল্যাণেই আমাদের আবির্ভাব; জনগণের সঙ্গে দুর্ব্যবহারকারী অসৎ সৈন্যদের জন্য কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা করে রেখেছেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
সুলতান সালাহুদ্দীনের সামরিক উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রধান, একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিতু খাদেমুদ্দীন আল-বার্ক এই অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক। এদিকের কিছুই তার কানে ঢুকছে না। চোখেও পড়ছে না কিছুই। পার্শ্বস্থিত মেয়েটি যাদু হয়ে জেঁকে বসেছে তার মাথায়। মেয়েটির প্রেম-সাগরে তলিয়ে গেছে সে। মন দেওয়া-নেওয়ার খেলা জমে উঠেছে দুজনের মধ্যে। মেয়েটিকে একস্থানে এসে মিলিত হওয়ার কথা বলে আল-বার্ক। মেয়েটি বলে, ‘আমি বৃদ্ধের ক্রীতদাসী। আমি তার হাতে বন্দী হয়ে আছি। সে আমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে।’ মেয়েটি আরও জানায়, ‘বৃদ্ধের ঘরে চারটি স্ত্রী।’
নিজের পদমর্যাদার কথা ভুলে যায় আল-বার্ক। প্রেম-পাগল তরুণের ন্যায় মিলনের জন্য মেয়েটিকে এমন সব স্থানে আসতে প্রস্তাব করে, যেখানে বখাটেরা ছাড়া যায় না আর কেউ। একটি জায়গা পছন্দ হয়ে যায় মেয়েটির। শহরের বাইরে পরিত্যক্ত পুরনো এক জীর্ণ ভবন। মেয়েটিকে বৃদ্ধের কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেয় আল-বার্ক। সাক্ষাতের দিন-ক্ষণ ঠিক করে আলাদা হয়ে যায় দুজন।
○ ○ ○