১১৭৫ সালের এপ্রিল মাস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আপন চাচাতো ভাই খলীফা সালেহের গভর্নর সাইফুদ্দীনকে লিখলেন—
‘তোমরা খাঁচায় বন্দী রঙ-বেরঙের পাখি নিয়ে ফুর্তি কর। নারী আর সুরার প্রতি যাদের এত আসক্তি, তাদের জন্য সৈনিক জীবন খুবই বেমানান।’
খলীফা সালেহ আর তার বংশজ গভর্নর সাইফুদ্দীন গোপনে মুসলিম খেলাফতের চিরশত্রু ক্রুসেডারদের চক্রান্তে ফেঁসে গেলেন। খেলাফতের রাজভাণ্ডার—মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত, দিনার-দিহরাম দিয়ে এই দুই শাসক ক্রুসেডারদের প্ররোচিত ও সহযোগিতা করতে লাগলেন সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার চক্রান্ত আঁটা হল।
একদিন ঠিক কাঙ্ক্ষিত সুযোগটি এসে গেল ক্রুসেডারদের হাতে। তাঁরা মুসলিম শাসকদের মধ্যেই তালাশ করছিল দোসর। খলীফা সালেহ স্বেচ্ছায় ক্রুসেডারদের সেই ভয়ানক চক্রান্তে পা দিলেন। খলীফা ও ক্রুসেডারদের সমন্বিত চক্রান্তে দু’ দুবার হত্যার উদ্দেশ্যে সালাহুদ্দীনের উপর আঘাত হানা হল। দুবারই সৌভাগ্যবশত বেঁচে গেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তছনছ করে দিলেন ঘাতকদের সব চক্রান্ত। আঘাতে-প্রত্যাঘাতে পরাস্ত করলেন শত্রুদের। ফাঁস হয়ে গেল গভর্নর সাইফুদ্দীনের চক্রান্তের খবর।
গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে ক্রুসেডারদের দোসর গাদ্দার সাইফুদ্দীন ঘর-বাড়ি, বিত্ত-বৈভব ফেলে পালিয়ে গেল। গভর্নরের আবাস থেকে উদ্ধার হল বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ, বিলাস-ব্যসন। গভর্নরের বাড়িতে পাওয়া গেল দেশী-বিদেশী অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী, তরুণী, রক্ষিতা। এদের কেউ ছিল নর্তকী, কেউ গায়িকা, কেউ বিউটিশিয়ান, কেউ ম্যাসেঞ্জার। সবই ছিল সাইফুদ্দীনের মনোরঞ্জনের সামগ্রী ও ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের জঘন্য উপাদান।
সাইফুদ্দীনের বাড়িতে আরও পাওয়া গেল নানা রঙের নানা প্রজাতির অসংখ্য পাখি। দেওয়ালে দেওয়ালে ঝুলানো ছিল বিভিন্ন ভঙ্গিমার নগ্ন, অর্ধনগ্ন নারীদের উত্তেজক অশ্লীল ছবি। সুরাভর্তি অসংখ্য পিপা।
সালাহুদ্দীন খাঁচার বন্দী পাখিদের মুক্ত করে দিলেন। গভর্নরের বাড়িতে বন্দী সেবিকা, নর্তকী, বিউটিশিয়ান ও শিল্পী-তরুণীদের আপনজনদের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তারপর সাইফুদ্দীনকে লিখলেন—
‘তোমরা দুজনে কাফের-বেঈমানদের দ্বারা আমাকে হত্যা করাবার অপচেষ্টায় মেতেছ। কিন্তু একবারও ভেবে দেখনি, তোমাদের এই চক্রান্ত মুসলিম খেলাফতের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তোমরা আমাকে হিংসা কর। তাই আমাকে তোমরা ধ্বংস করে দিতে চাও। দু’ দুইবার আমাকে হত্যা করার জন্যে লোক পাঠিয়েছ; কিন্তু সফল হতে পারনি। আবার চেষ্টা করে দেখ, হয়ত সফল হবে। তোমরা যদি আমাকে এ নিশ্চয়তা দাও যে, আমার মৃত্যুতে ইসলামের উন্নতি হবে, মুসলমানদের কল্যাণ হবে, তাহলে কাবার প্রভুর কসম করে বলছি, আমি তোমাদের তরবারী দিয়ে আমার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করিয়ে তোমাদের পদতলে উৎসর্গ করতে অসিয়ত করে যাব। আমি তোমাদের শুধু একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কাফের-বেঈমানরা কখনও মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে না। ইতিহাস তোমাদের চোখের সামনে। আমাদের সোনালী অতীতের দিকে একবার ফিরে দেখ। আশ্চর্য, রাজা ফ্রাংক-রেমণ্ডের মত প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিম শাসকরা তোমাদের সাথে একটু বন্ধুত্বের অভিনয় করল, আর অমনি তোমরা তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহস যুগিয়েছ! ওরা যদি সফল হত, তাহলে ওদের পরবর্তী প্রথম শিকার হতে তোমরাই। এরপর হয়ত দুনিয়া থেকে ইসলামী খেলাফত মুছে ফেলার কাজটিও সমাধা হত।
তোমরা তো যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য ও যুদ্ধ পরিচালনা তোমাদের ঐতিহ্যের অংশ। অবশ্য প্রত্যেক মুসলমানই আল্লাহর সৈনিক আর আল্লাহর সৈনিক হওয়ার পূর্বশর্ত ঈমান ও কার্যকর ভূমিকা।
তোমরা খাঁচার পাখি নিয়ে ফুর্তি কর। মদ-নারীর প্রতি যাদের এত আসক্তি, সৈনিক জীবন ও যুদ্ধ পরিচালনা তাদের জন্যে খুবই বেমানান। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, তোমরা আমাকে সহযোগিতা কর। আমার সাথে জিহাদে শরীক হও। যদি না পার, অন্তত আমার বিরুদ্ধাচারণ থেকে বিরত থাক। আমি তোমাদের অপরাধের কোন প্রতিশোধ নেব না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আমীন।
—সালাহুদ্দীন আইউবী
গভর্নর সাইফুদ্দীন গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন চক্রান্তে মেতে উঠল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর চিঠি পড়ে তার মধ্যে দ্বিগুণ প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। যোগ দিল ইহুদী হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক স্কোয়াডের সাথে। শুরু হল নতুন চক্রান্ত। হাসান ইবনে সাব্বাহর স্কোয়াড দীর্ঘ দিন ধরে ফাতেমী খেলাফতের আস্তিনের নীচে কেউটে সাপের মত বিরাজ করছিল।
* * *
হাসান ইবনে সাব্বাহ্ একজন স্বভাব-কুচক্রী। ফাতেমী খেলাফতের শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে সে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তৎপর। শুভাকাঙ্ক্ষীর পোশাকে সর্বনাশী ষড়যন্ত্রের হোতা সে। অতি সংগোপনে ইসলামী খেলাফতকে ধ্বংস করতে গোপনে গড়ে তোলে ঘাতক বাহিনী। বিস্ময়কর যাদুময়তায় সাধারণ মানুষের কাছে সজ্জন হিসেবে আসন গেড়ে নেয় তার বাহিনী। অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীর মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম দেয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস।
হাসান ইবনে সাব্বাহর গুপ্ত বাহিনীতে রয়েছে চৌকস নারী ইউনিট। ওরা যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ। প্রাঞ্জল ভাষা ও বাকপটুতায় দক্ষ তারা। তাদের সংস্পর্শে গেলে যে কোন কঠিন মনের অধিকারী আর আদর্শিক পুরুষও মোমের মত গলে যায়। চক্রান্ত বাস্তবায়নে মাদক, নেশা, আফিম, হাশীশ, নাচ-গান ও ম্যাজিকের আশ্রয় নেয় তারা। এমনকি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হাসান বাহিনীর নারী গোয়েন্দারা নিজেদের দেহ বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দীর্ঘ কঠোর প্রশিক্ষণ—অনুশীলনের মাধ্যমে উপযুক্ত হওয়ার পর শুরু হয় তাদের মূল কাজ। হাসান বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ ইসলামী খেলাফতকে নির্মূল করতে এমন একটি ঘাতক বাহিনীর জন্ম দেয় যে, এই বাহিনীর প্রশিক্ষিত গোয়েন্দারা বেশ-ভূষা ও ভাষা বদল করে কৌশলী আচার ব্যবহার দ্বারা ফাতেমী খেলাফতের শীর্ষ ব্যক্তিদের একান্ত বডিগার্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও হাত করে নেয়। এর ফলে বড় বড় সামরিক কর্মকর্তারা গুপ্ত হত্যার শিকার হতে থাকেন। কিন্তু ঘাতকের কোন নাম-নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অল্পদিনের মধ্যেই হাসান বাহিনীর গুপ্তদল ফেদায়ী নামে সারা মুসলিম খেলাফতে ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়। এদের প্রধান কাজ রাজনৈতিক হত্যা। এ কাজে এরা বেশী ব্যবহার করে সুন্দরী যুবতী আর মদ। শরাবে উচ্চমানের বিষ মিশিয়ে আসর গরম করার পর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে তারা। কিন্তু তাদের মদ-নারী সালাহুদ্দীন আইউবীর বেলায় অকার্যকর। অবৈধ নারী সম্ভোগ আর হারাম মদ-সুরায় সালাহুদ্দীনের আজন্ম ঘৃণা। সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার একমাত্র উপায় অতর্কিত আক্রমণ। কিন্তু এটা মোটেও সহজসাধ্য নয়। সুলতান সালাহুদ্দীন সবসময় থাকেন প্রহরী-পরিবেষ্টিত। তাছাড়া তিনি নিজেও খুব সতর্ক।
দু দুটি আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর সালাহুদ্দীন আইউবী ভেবেছিলেন, আমীর সালেহ ও গভর্নর সাইফুদ্দীন হয়ত তাঁর চিঠি পেয়ে তওবা করেছে। ওরা হয়ত আর তার সাথে দুশমনি করবে না। কিন্তু না, ওরা প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে আছে। নতুন করে তৈরী করল সালাহুদ্দীনকে খতম করার সুগভীর চক্রান্তের ফাঁদ।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ক্রুসেডার ও সাইফুদ্দীনের হামলা প্রতিহত করে বিজয়োল্লাসের পরিবর্তে পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। অগ্রণী আক্রমণ করে শত্রুপক্ষের আরও তিনটি এলাকা দখল করে নিলেন তিনি। বিজিত এলাকার অন্যতম একটি হল গাঁজা।
গাঁজার প্রশাসক জাদুল আসাদীর তাঁবুতে এক দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছেন সালাহুদ্দীন আইউবী। মাথায় তার শিরস্ত্রাণ। শিরস্ত্রাণের নীচে মোটা কাপড়ের পাগড়ী।
তাঁবুর বাইরে প্রহরারত দেহরক্ষী দল। সালাহুদ্দীনের দেহরক্ষীরা যেমন লড়াকু, তেমনি চৌকস।
রক্ষী দলের কমাণ্ডার কেন যেন প্রহরীদের রেখে একটু আড়ালে চলে গেল। এক দেহরক্ষী সালাহুদ্দীনের তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিল। ইসলামের অমিততেজী সিপাহসালার তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। দু চোখ তার মুদ্রিত। চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন সালাহুদ্দীন। প্রহরী চকিত নেত্রে খাস দেহরক্ষীদের একবার দেখে নিল। দেহরক্ষীদের তিন-চারজন দেখল ওই প্রহরীর উঁকি মারার দৃশ্য। চোখাচোখি হল পরস্পর। তারা বিষয়টি আমলে নিল না। অন্যান্য প্রহরীদের নিয়ে গল্প-গুজবে মেতে উঠল। বাইরের প্রহরী এই সুযোগে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করল। কোমরে তার ধারাল খঞ্জর। বের করে এক নজর দেখে নিল সেটা। বিড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা সালাহুদ্দীনের দিকে।
ঠিক তখনই পার্শ্ব পরিবর্তন করলেন সালাহুদ্দীন। খঞ্জর বিদ্ধ হল সালাহুদ্দীন আইউবীর মাথার খুলি ঘেঁষে মাটিতে।
এই মুহূর্তে পার্শ্ব পরিবর্তন না করলে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে যেত তার খুলি। সালাহুদ্দীন আইউবী বিদ্যুদ্বেগে ধড়মড় করে শোয়া থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বুঝে ফেললেন, কী ঘটছে। ইতিপূর্বে দুবার একই ধরনের আক্রমণ হয়ে গেছে তার উপর। কালবিলম্ব না করে ঘাতকের চিবুকে পূর্ণ শক্তিতে একটা ঘুষি মারলেন সালাহুদ্দীন। চিবুকের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার মট মট শব্দ শোনা গেল। পিছনের দিকে ছিটকে পড়ে ভয়ানক আর্তচীৎকার দিল ঘাতক।
এই ফাঁকে সালাহুদ্দীন খঞ্জর তুলে নিলেন হাতে। প্রহরীর ভয়ার্ত চিৎকারে দৌড়ে আরও দুই দেহরক্ষী তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করল। তাদের হাতে খোলা তরবারী। সুলতান বললেন, ‘ওকে গ্রেফতার কর।’ কিন্তু সালাহুদ্দীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরাও। সালাহুদ্দীন নিজের খঞ্জর দিয়েই দুই তরবারীর মোকাবেলা করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে গেল ঘাতক দল।
ইত্যবসরে বাইরের দেহরক্ষী দলের সবাই ঢুকে পড়ল তাঁবুতে। লড়াই বেঁধে গেল প্রচণ্ড। সালাহুদ্দীন দেখলেন, তাঁর নির্বাচিত দেহরক্ষীরা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত। বোঝার উপায় ছিল না, এদের মধ্যে কে তার অনুগত আর কে শক্রর এজেন্ট। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে অবস্থা নিরীক্ষণ করলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিপক্ষের তরবারীর আঘাতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ল উভয় পক্ষের কয়েকজন। আর কিছুসংখ্যক মারাত্মক আহত হয়ে কাতরাতে লাগল। আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল বাকিরা।
লড়াই থেমে যাওয়ার পর অনুসন্ধানে ধরা পড়ল, সালাহুদ্দীনের একান্ত দেহরক্ষীদের মধ্যে সাতজনই হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক সদস্য। যে ঘাতক প্রথম আঘাত হেনেছিল, তাকে সালাহুদ্দীন নিজেই দেহরক্ষী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। ওই নরাধম তাঁবুতে প্রবেশ করার পর ভিতরের পরিস্থিতি পরিকল্পনার বিপরীত হয়ে গেল। ওর আর্তচিৎকারে বাকিরাও তাঁবুতে প্রবেশ করলে প্রকৃত প্রহরীরাও ঘটনা আঁচ করতে পেরে দ্রুত প্রতিরোধে এগিয়ে এল। শত্রুদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল। এ যাত্রায়ও বেঁচে গেলেন সালাহুদ্দীন।
ঘাতকের বুকে তরবারী রেখে সালাহুদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন— ‘কে তুমি? কোত্থেকে কিভাবে এখানে এসেছ? আর কে তোমাকে এ কাজে পাঠিয়েছে?’ সত্য স্বীকারোক্তির বিনিময়ে সালাহুদ্দীন ঘাতকের প্রাণ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ঘাতক বলে দিল, সে ফেদায়ী, আমীর সালেহের এক কেল্লাদার গভর্নর গোমস্তগীন এ কাজে নিযুক্ত করেছে তাকে।
সালাহুদ্দীন আইউবী মুসলিম মিল্লাতের একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। খৃষ্টানদের কাছেও কখনই বিস্মৃত হবার নন তিনি।
সালাহুদ্দীন আইউবীর কীর্তি-কাহিনী ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাসে সংরক্ষিত। তবে তাঁর জীবন ও কর্মের বাঁকে বাঁকে আপনজন ও স্বগোত্রীয়দের হিংসাত্মক শত্রুতা, চরিত্র হনন, চারপাশের মানুষদের দ্বারা বিছানো বহু বিস্তৃত ভয়ংকর চক্রান্তজাল, শত্রুপক্ষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আঘাত আর তাঁর মিশন ব্যর্থ করতে খৃষ্টান-ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ও সুন্দরী নারীদের পাতা ফাঁদের কথা ইতিহাসের পাতায় বিস্তারিত বিবৃত হয়নি। সে সব অজানা ইতিহাস আমি বলার ইচ্ছা রাখি।
* * *
১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। সালাহুদ্দীন আইউবী সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করলেন। ফাতেমী খেলাফতের কেন্দ্রীয় খলীফা তাঁকে এ পদে নিযুক্ত করে বাগদাদ থেকে প্রেরণ করেন।
মিসরের সেনাপ্রধান ও শাসকের গুরুত্বপূর্ণ পদে সালাহুদ্দীনের মত তরুণের নিযুক্তি স্থানীয় প্রশাসকদের দৃষ্টিতে ছিল অনভিপ্রেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকদের দৃষ্টিতে সালাহুদ্দীন হলেন যথোপযুক্ত ব্যক্তি। বয়সে তরুণ হলেও সালাহুদ্দীন শাসক বংশের সন্তান। বাল্যকাল থেকেই কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে রপ্ত করেছেন যুদ্ধবিদ্যা। অল্প বয়সেই যুদ্ধের ময়দানে প্রমাণ করেছেন নিজের বিরল প্রতিভা ও অসামান্য দূরদর্শিতা।
সালাহুদ্দীন আইউবীর দৃষ্টিতে দেশ শাসন বাদশাহী নয়—জনসেবা। জাতির ইজ্জত-সম্মান, সমৃদ্ধি-উন্নতি এবং সেবার মাধ্যমে নাগরিকদের সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই শাসকদের দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু তিনি ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা—অনৈক্য, একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্যে আমীর-ওমরার মধ্যে খৃষ্টানদের সাথে ভয়ংকর বন্ধুত্ব স্থাপনের আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা।
শাসকদের সিংহভাগ জাগতিক বিলাস-প্রমোদে মত্ত। মদ, নারী আর নাচ-গানে শাসক শ্ৰেণী আকণ্ঠ ডুবন্ত। জীবনকে জাগতিক আরাম-আয়েশের বাহারী রঙে সাজিয়ে রেখেছে কর্তারা। মিল্লাতের ঐতিহ্য, মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনাকে শাসক শ্রেণী নিক্ষেপ করেছে অতল-গহ্বরে।
আমীর, উজীর, উপদেষ্টা ও বড় বড় আমলার হেরেমগুলো বিদেশী খৃষ্টান সুন্দরী তরুণীদের নৃত্য-গীতে মুখরিত। শাসকদের হেরেমগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে খৃষ্টান-ইহুদীদের প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা কিশোরীরা। শাসকদের বোধ ও চেতনা সব ওদের হাতের মুঠোয়। খৃষ্টান গোয়েন্দা মেয়েরা মুসলিম শাসকদের হেরেমে অবস্থান করে মদ-সুরা, নাচ-গান আর দেহ দিয়ে শুধু শাসকদের কব্জায়-ই রাখছে না—মুসলিম খেলাফতের প্রাণরস ভিতর থেকে উঁই পোকার মত খেয়ে খেয়ে অসাড় করে দিচ্ছিল তারা।
খৃষ্টান রাজারা ইসলামী সালতানাতগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। মুসলিম শাসকদের মধ্যে বপণ করছে সংঘাত ও প্রতিহিংসার ধ্বংসাত্মক বীজ। এ কাজে খৃষ্টানরা এতই সাফল্য অর্জন করল যে, কিছুসংখ্যক মুসলিম শাসক খৃষ্টান সম্রাট ফ্র্যাংককে বাৎসরিক ট্যাক্স দিতে শুরু করলেন। পরস্পর প্রতিহিংসাপরায়ণ মুসলিম শাসকদের ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলোতে গোপন সন্ত্রাস ও হামলা চালিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত করে নিরাপত্তা চাঁদা আদায় করছিল খৃষ্টান রাজারা। প্রজাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেও ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করতে প্রজাদের রক্ত শুষে ট্যাক্স আদায় করে খৃষ্টান রাজাদের বাৎসরিক সেলামী আদায় করছিল মুসলিম শাসকরা।
সামাজিক সংঘাত, আত্মকলহ ও শ্রেণীগত বিরোধে তখন মুসলমানদের একতা-সংহতি বিলীন। ধর্মীয় দলাদলি, মাযহাবী মতবিরোধে মুসলিম সম্প্রদায় শতধা বিভক্ত। হাসান ইবনে সাব্বাহ নামের এক ভণ্ড ইহুদী-পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে মিসরের সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরূপে আভির্ভূত হয়। গোপনে গড়ে তোলে নিজস্ব গোয়েন্দা, সেনা ও সুইসাইড বাহিনী। এরা জঘন্য গুপ্ত হত্যায় এই প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, হাশীশ বাহিনী রূপে সারা মিসরে এরা খ্যাত।
এই সাব্বাহ বাহিনীর সাথে সালাহুদ্দীনের পরিচয় বাগদাদে। মাদরাসা নিজামুল মুলুকে পড়াশোনাকালীন সময়ে সালাহুদ্দীন জানতে পারেন; সাব্বাহ বাহিনীর গুপ্তঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল নিজামিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা নিজামুল মুল্ককে।
নিজামুল মুল্ক ছিলেন মুসলিম খেলাফতের একজন যশস্বী গভর্নর। সুশাসক ও গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন তিনি। মুসলমানদের সর্বাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে এবং ইহুদী-খৃষ্টানদের বিপরীতে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতেই গভর্নর নিজামুদ্দীন গড়ে তোলেন মাদরাসা নিজামিয়া। অল্পদিনের মধ্যে নিজামিয়া মাদরাসা বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষায় খ্যাতি লাভ করে। ওখানকার শিক্ষার্থীরা ইসলাম বিরোধীদের উপযুক্ত মোকাবেলা করার যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠে। মাদরাসা নিজামিয়ায় আবশ্যিক রাখা হয় সামরিক প্রশিক্ষণ ও সমরকলা।
খৃষ্টানদের কাছে এ বিষয়টি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠে তাদের অস্তিত্বের জন্যে। তাই ওরা চক্রান্ত আঁটে। ওদের যোগসাজশে নিজামুল মুলকের দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয় সাব্বাহ বাহিনী। সাব্বাহ বাহিনীকে হাত করে খৃষ্টান চক্রান্তকারীরা হত্যা করে নিজামুল মুলককে। এ ঘটনা সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্মের প্রায় শত বছর আগের।
নিজামুল মুল্কের মৃত্যু হলেও মাদরাসা নিজামিয়া বন্ধ হয়ে যায়নি। অব্যাহত থাকে ইসলামের সৈনিক তৈরীর প্রচেষ্টা। ওখানেই জাগতিক ও ধর্মীয় বিশেষ করে যুদ্ধ-বিদ্যায় প্রশিক্ষণ নেন সালাহুদ্দীন। রাজনীতি, কূটনীতি, ভূগোল, ইতিহাস ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধ কৌশলের উপর সালাহুদ্দীনের গভীর আগ্রহের কারণে নুরুদ্দীন জঙ্গী ও চাচা শেরেকোই তার জন্যে স্পেশাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষা অবস্থায়ই তাকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের জন্যে। সর্বক্ষেত্রেই দেখা যেত সালাহুদ্দীনের অসাধারণ যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা। অনুপম কর্মকৌশলে মুগ্ধ হয়ে জঙ্গী তাকে মিসরের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এখান থেকেই সালাহুদ্দীনের সংগ্রামী জীবনের সূচনা।
* * *
সেনাপ্রধান ও গভর্নর হয়ে মিসরে পদার্পণ করলেন সালাহুদ্দীন আইউবী। রাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল তার সম্মানে। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা করল জমকালো অনুষ্ঠানের। সার্বিক আয়োজনের নেতৃত্ব দিলেন সেনা অধিনায়ক নাজি।
নাজি মিসরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান, পঞ্চাশ হাজার নিয়মিত বাহিনীর অধিনায়ক। মিসরে নাজি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি। মুকুটহীন সম্রাট। ভবিষ্যত গভর্নর হিসেবে নিজেকেই একমাত্র ফাতেমী খেলাফতের যোগ্য উত্তরসূরী মনে করেন তিনি। সালাহুদ্দীন আইউবীর নিয়োগে স্বপ্নভঙ্গ হল তাঁর। তবে দমে গেলেন না তিনি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে দেখেই নাজি আশ্বস্ত হলেন, এই বালক তাঁর জন্যে মোটেও সমস্যা হবে না। নিজের দাপট যথারীতি বহাল রাখতে পারবেন তিনি।
সালাহুদ্দীনের আগমনে বড় বড় সেনা অফিসার ও গুরুত্বপূর্ণ আমলাদের অনেকেরই ভ্রু কুঞ্চিত হল। অনেকেই নিজেকে ভাবছিল মিসরের ভাবী গভর্নররূপে। তরুণ সালাহুদ্দীনকে দেখে চোখাচোখি করল তারা। অনেকের দৃষ্টিতে ছিল তাচ্ছিল্যের ভাব। তারা জানত না সালাহুদ্দীন আইউবীর যোগ্যতা। শুধু জানত, সালাহুদ্দীন শাসক পরিবারের ছেলে। তাঁকে চাচা শেরেকোহর স্থলাভিষিক্ত করে পাঠানো হয়েছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর সাথে তাঁর আত্মীয়তা রয়েছে।
এক প্রবীণ অফিসার টিপ্পনী কাটল—‘ছেলে মানুষ আমরা তাকে গড়ে নেব।’
অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন আর অফিসারদের সমাবেশে সালাহুদ্দীন প্রথমে কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন। নাজির কটাক্ষ চাহনি আর কর্মকর্তাদের বিদ্রূপ সালাহুদ্দীন উপলব্ধি করলেন কি-না বলা মুশকিল। তবে বয়স্ক, অভিজ্ঞ ও প্রবীণ কর্মকর্তাদের ভীড়ের মধ্যে নিজেকে নিতান্তই বালক মনে হচ্ছিল তাঁর। দ্রুত নিজেকে সামলে অফিসারদের প্রতি মনোযোগী হলেন সালাহুদ্দীন। পিতার বয়সী জেনারেল নাজির প্রতি হাত বাড়িয়ে দিলেন মোসাফাহার জন্যে। তোষামোদে সিদ্ধহস্ত নাজি পৌত্তলিকদের মত মাথা নীচু করে কুর্নিশ করল সালাহুদ্দীনকে। তারপর কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল—
‘আমার বুকের শেষ রক্তফোঁটা দিয়ে হলেও তোমাকে হেফাজত করব। তুমি আমার কাছে শেরেকোহ ও জঙ্গীর পবিত্র আমানত।’
‘আমার জীবন ইসলামের মর্যাদার চেয়ে বেশী মূল্যবান নয় সম্মানিত জেনারেল! নিজের প্রতি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। ক্রুসেডারদের চক্রান্ত কালো মেঘের মত আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।’ নাজির হাতে চুমো খেয়ে বললেন সালাহুদ্দীন।
জবাবে মুচকি হাসলেন নাজি, যেন সালাহুদ্দীন তাকে মজার কোন কৌতুক শোনালেন।
নাজি অভিজ্ঞ অধিনায়ক। মিসরের সেনাবাহিনীর অধিপতি। তার বাহিনীতে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার সুদানী, যারা সবাই প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। নাজির মুচকি হাসির রহস্য সালাহুদ্দীন বুঝতে না পারলেও এতটুকু অনুধাবন, করলেন যে, এ কৌশলী ও বিজ্ঞ সেনাপতিকে তাঁর বড় প্রয়োজন।
নাজি মিসরেই শুধু নয়—গোটা ইসলামী খেলাফতের মধ্যে একজন ধুরন্ধর প্রকৃতির সেনাপতি। নিজ দক্ষতায় পঞ্চাশ হাজার সুদানী বাহিনী দিয়ে স্পেশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার অধীন সৈন্যরাই পালন করত শাসকদের দেহরক্ষীর দায়িত্ব। মিসরের গভর্নরের দেহরক্ষীর দায়িত্বও ন্যস্ত ছিল নাজির স্পেশাল বাহিনীর হাতে। স্পেশাল বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক নাজির অনুগত। তার নির্দেশে অকাতরে জীবন দিতে সামান্যতম দ্বিধা করে না কেউ। বিরাট বাহিনীর কর্তৃত্বের বদৌলতে নাজি মিসর ও আশ-পাশের অন্যান্য শাসকদের জন্য ছিলেন একটি ত্রাস। শক্তিশালী সেনাবাহিনী আর কূটচালে নাজি এ অঞ্চলের মুকুটবিহীন সম্রাট। তাকে চ্যালেঞ্জ করে এমন শক্তি কারও নেই। কূটকৌশলে নাজি এমনই দক্ষ যে, সরাসরি সিংহাসনে আসীন না হলেও তাকে মনে করা হত মসনদের কারিগর। নিজের কূটচালে নাজি ইচ্ছেমত শাসকদের ক্ষমতায় আসীন করতেন আর ইচ্ছে হলে সরিয়ে দিতেন। প্রশাসনে নাজিকে বলা হত সকল দুষ্টবুদ্ধির আধার। সালাহুদ্দীন আইউবীর কথার জবাবে নাজির মুচকি হাসির রহস্য অন্যরা হয়ত ঠিকই বুঝে নিল। সালাহুদ্দীন অতসব গভীর চিন্তা না করলেও এতটুকু ঠিকই ধরে নিলেন, এই শক্তিধর সেনাপতিকে তার বড় বেশি প্রয়োজন।
‘অনেক পথ সফর করে এসেছেন মহামান্য গভর্নর! খানিক বিশ্রাম করে নিন।’ বলল প্রবীণ এক অফিসার।
‘আমার মাথায় যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, আমি সে গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য নই। এই দায়িত্ব আমার ঘুম আর আরাম কেড়ে নিয়েছে। আপনারা আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন, যেখানে কর্তব্যসমূহ আমার অপেক্ষা করছে।’ বললেন সালাহুদ্দীন।
‘দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগে আহারটা সেরে নিলে ভাল হয় না?’ সালাহুদ্দীনের উদ্দেশে বলল নাজির সহকারী।
একটু কী যেন চিন্তা করলেন সালাহুদ্দীন। তারপর হাঁটা দিলেন সামনের দিকে।
বিশাল এক হলরুম। সালাহুদ্দীনের ডানে নাজি, বাঁয়ে নাজির সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড ঈদরৌস। আগে পিছনে সশস্ত্র দেহরক্ষী। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গার্ড অব অনার দিচ্ছে নাজির স্পেশাল বাহিনীর নির্বাচিত সদস্যরা। স্পেশাল বাহিনীর সৌকর্য, সুঠামদেহ, উন্নত হাতিয়ার, অভ্যর্থনা আর গার্ড অব অনারের বিন্যস্ত আয়োজন দেখে সালাহুদ্দীনের চোখ আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠল। এমন একটি সুগঠিত বাহিনীর স্বপ্ন-ই দেখছিলেন তিনি।
কিন্তু হলের গেটে গিয়ে সালাহুদ্দীন স্তম্ভিত হলেন। চিন্তায় ছেদ পড়ল তাঁর। থমকে দাঁড়ালেন তিনি।
সুরম্য হলঘর। প্রবেশ পথে উন্নত গালিচা বিছানো।
দরজায় পা রেখেই মলিন হয়ে গেল সালাহুদ্দীনের চেহারা। নেমে এল বিষাদ। চার উর্বশী তরুণী তাকে দেখেই নৃত্যের ভঙ্গিতে শরীর দুলিয়ে ঝুঁকে অভিবাদন জানাল। তাদের হাতে ঝুড়িভর্তি তাজা ফুল। ফুলগুলো শৈল্পিক ভঙ্গিতে ছিটিয়ে দিতে থাকল সালাহুদ্দীনের পদতলে, তার যাত্রা পথে।
তরুণীদের পরনে মিহি রেশমের সাদা ধবধবে ঘাগরী। পিঠে ছড়ানো সোনালী চুল। তাদের ঝুলেপড়া জুলফি বাড়িয়ে তুলেছে চেহারার রওনক। তরুণীদের শরীরের দ্যুতি সূক্ষ্ম কাপড়ের বাইরে ঠিকরে পড়ছে যেন। ওদের নৃত্য-ভঙ্গিমার তালে বেজে উঠল তবলা। সানাইয়ের সুর। সঙ্গীতের মূৰ্ছনা।
তাজা ফুল পায়ের কাছে নিক্ষিপ্ত হতেই দ্রুত পা পিছিয়ে নিলেন সালাহুদ্দীন। ডানে নাজি আর বাঁয়ে নাজির সহকারী। সালাহুদ্দীনকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালেন তারা।
‘মোলায়েম ফুল-পাপড়ি মাড়াতে আসেনি সালাহুদ্দীন।’ ঠোঁটে রহস্যময় হাসির আভা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন সালাহুদ্দীন। এমন নির্মল রহস্যময় হাসি আর দেখেননি কখনও নাজি।
‘আমরা জনাবের চলার পথে আসমানের তারা এনেও বিছিয়ে দিতে পারি মাননীয় গভর্নর!’ বললেন নাজি।
‘আমার যাত্রা পথে শুধু একটা জিনিস বিছানো থাকলে তা আমাকে সন্তুষ্ট করবে।’ বললেন সালাহুদ্দীন।
‘আদেশ করুন হুজুর কেবলা!’–গদগদ চিত্তে বলল নাজির সহকারী— ‘কোন্ সে জিনিস, যা আপনার পায়ের তলায় ছড়িয়ে দিলে আপনাকে আনন্দ দেয়?’
‘ক্রুসেডারদের লাশ।’ ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সুরে মুচকি হেসে বললেন সালাহুদ্দীন। নিমিষেই তাঁর চেহারা কঠিন হয়ে গেল। চোখ থেকে ঠিকরে বেরুতে থাকল অগ্নিদৃষ্টি। ভর্ৎসনামাখা অনুচ্চ আওয়াজে বললেন—
‘মুসলমানদের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয় জেনারেল।’
মুহূর্তের মধ্যে পার হয়ে গেল অফিসারের মুখমণ্ডল।
সালাহুদ্দীন বললেন— ‘আপনারা কি জানেন না, খৃষ্টানরা মুসলিম সালতানাতকে ইঁদুরের মত কুরে কুরে টুকরো টুকরো করছে? বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে আমাদের? জানেন কি, কেন সফল হচ্ছে ওরা? যে দিন থেকে আমরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে ফুলের পাপড়ী মাড়াতে শুরু করেছি, নিজেদের যুবতী কন্যাদের নগ্ন করে ওদের সম্ভ্রম ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছি, সেদিন থেকে ব্যর্থতা-ই হয়ে গেছে আমাদের বিধিলিপি। আমরা মাতৃত্বের মর্যাদা আর নারীর ইজ্জত রক্ষা করতে পারছি না। আপনারা জেনে রাখুন, আমার দৃষ্টি ফিলিস্তিনে নিবদ্ধ। আপনারা আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিসরেও কি ইসলামের পতাকা ভূলুণ্ঠিত করতে চান?’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা এক নজর দেখে জলদগম্ভীর কণ্ঠে গর্জে উঠলেন সালাহুদ্দীন—
‘আমার পথ থেকে ফুলগুলো সরিয়ে নাও। ফুল মাড়িয়ে গেলে ও-ফুলের কাটা আমার হৃদয়টাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমার পথের তরুণীদের হটাও। আমি চাই না ওদের রেশমী চুলে আটকে পড়ে আমার তরবারী অকেজো হয়ে যাক।’
‘আর আমাকে কখনও ‘হুজুর কেবলা’ বলে সম্বোধন করবেন না। কঠোর ঝাঁঝের স্বরে বললেন সালাহুদ্দীন। তাঁর তিরস্কারে যেন অফিসারদের দেহ থেকে মাথাগুলো সব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
‘হুজুর কেবলা’ তো তিনি, যার আনীত কালেমা পড়ে আমরা সবাই মুসলমান হয়েছি। এই অধম তার নগণ্য অনুগত উম্মত মাত্র। আমি তার পয়গাম বুকে ধারণ করেই মিসর এসেছি। তার আদর্শ রক্ষায় আমি আমার জীবন কোরবান করেছি। খৃষ্টানরা আমার বুক থেকে এই পবিত্র পয়গাম ছিনিয়ে নিতে চায়, মদের জোয়ার রোম সাগরে ডুবিয়ে দিতে চায় ইসলামের ঝাণ্ডা। আমি আপনাদের বাদশা হয়ে আসিনি—এসেছি ইসলামের একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক হয়ে।’
নাজির ইশারায় তরুণীরা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আড়াল হয়ে গেল। দ্রুতপায়ে হলরুমে প্রবেশ করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
রাজকীয় দরবার হল। মাঝখানে এক লম্বা টেবিলে থোকা থোকা ফুলের তোড়া। দীর্ঘ চওড়া টেবিলের চারপাশে সাজানো রাজসিক খাবার। আস্ত মুরগী, খাসির রান, দুম্বার বক্ষদেশের মোলায়েম গোশতের রকমারী আয়োজন। কক্ষময় খাবারের মৌতাত গন্ধ।
টেবিলের এক পার্শ্বে রক্ষিত সালাহুদ্দীনের জন্যে বিশেষ আসন। সালাহুদ্দীন দৃঢ়পদে আসনের পাশে দাঁড়ালেন। পাশের এক অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন—
‘মিসরের সব নাগরিক কি এ ধরনের খাবার খেতে পায়?’
‘না, সম্মানিত গভর্নর। সাধারণ মানুষ তো এ ধরনের খাবার স্বপ্নেও দেখে না।’
‘তোমরা কি সে জাতির সদস্য নও, যে জাতির সাধারণ মানুষ এমন খাবার স্বপ্নেও দেখে না?’
কারও পক্ষ থেকে কোন জবাব এল না।
‘এখানে ডিউটিরত যত কর্মচারী আছে, সবাইকে ডেকে ভিতরে নিয়ে এস। এ খাবার তারা সবাই খাবে।’ নির্দেশের স্বরে বললেন সালাহুদ্দীন।
সালাহুদ্দীন একটি রুটি হাতে নিয়ে তাতে দু টুকরো গোশত যোগ করে খেয়ে নিলেন। দ্রুত আহারপর্ব শেষ করে নাজিকে নিয়ে গভর্নরের দফতরে চলে গেলেন।
জাঁকজমকপূর্ণ গভর্নর হাউজ। দফতর নয়, যেন এক জান্নাতি বালাখানা। দাফতরিক প্রয়োজনের চেয়ে আয়েশী আয়োজন—উপকরণ-ই বেশী। দফতরের বিন্যাসে মারাত্মক বৈষম্য। গভর্নর হাউজের দাফতরিক পরিস্থিতি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন সালাহুদ্দীন। তার আগেই এখানে চলে আসা আলী বিন সুফিয়ান ততক্ষণে দেখে নিয়েছেন গভর্নর হাউজের খুঁটিনাটি। সালাহুদ্দীন নাজির কাছ থেকে জেনে নিলেন বিভিন্ন বিষয়।
দু ঘন্টা পর গভর্নর হাউজ থেকে বেরিয়ে এল নাজি। দ্রুতপায়ে নিজের ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এক লাফে ঘোড়ায় আরোহণ করে লাগাম টেনে ধরলেন। প্রশিক্ষিত ঘোড়া ক্ষিপ্রগতিতে চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।
নিঝুম রাত। নাজির খাস কামরায় জমে উঠেছে মদের আসর। মদপানে যোগ দিয়েছে নাজির একান্ত সহযোগী দুই কমাণ্ডার। আজকের আসরের আমেজ ভিন্ন। কোন নৃত্যগীত নেই। সবার চেহারা রুক্ষ। গ্লাসের পর গ্লাস ঢেলে দিচ্ছে সাকী। গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে তিনজন।
নীরবতা ভঙ্গ করে নাজি বললেন—
‘এসব যৌবনের তেজ, বুঝলে? ক’ দিনের মধ্যেই দেখবে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’
‘অভাগা কথায় কথায় বলে “কাবার প্রভুর কসম!” ইসলামী সালতানাত থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত না করে আমি বিশ্রাম নেব না।’
‘হু! সালাহুদ্দীন আইউবী!’—তাচ্ছিল্যভরে উচ্চারণ করল এক কমাণ্ডার— ‘সে জানে না, ইসলামী সালতানাতের নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। এখন হুকুমত চালাবে সুদানীরা।’
‘আপনি কি বলেননি, স্পেশাল বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সব সুদানী?’—নাজিকে জিজ্ঞেস করল অপর কমাণ্ডার— ‘বলেননি, যাদেরকে তিনি নিজের সৈন্য মনে করছেন, ওরা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ঈদরৌস! আমি বরং তাকে আশ্বাস দিয়েছি, এই পঞ্চাশ হাজার সুদানী শার্দুল তাঁর আঙুলের ইশারায় খৃষ্টানদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ওদের নিশানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। অচিরেই ওদের বিশ্বাসের প্রতীক ক্রুশ ভূলুণ্ঠিত হবে। কিন্তু—’
থেমে গেলেন নাজি।
‘কিন্তু আবার কি?’ আগ্রহের সাথে জানতে চাইল উভয় কমাণ্ডার।
নাজি বললেন, ‘কিন্তু সে আমাকে বলল, মিসরের নাগরিকদের নিয়ে একটি সেনা ইউনিট গড়ে তুলুন। বলল, এক এলাকার মানুষের উপর সৈন্যবাহিনীকে সীমিত রাখা উচিত নয়। সে আমাদের বাহিনীর সাথে মিসরীয়দের মিশ্রণ ঘটাতে চায়।’
‘তা, আপনি কী বললেন?’
‘আমি তাকে বলেছি, শীঘ্রই আপনার হুকুম তামিল করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আমি কখনই এমনটি করব না।’ বললেন নাজি।
‘সালাহুদ্দীন আইউবীর মেজাজ-মর্জি কেমন দেখলেন?’ নাজিকে জিজ্ঞেস করল ঈদরৌস।
‘দেখেই বোঝা যায়, খুব জেদী।’
‘আপনার অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কাছে সালাহুদ্দীন কোন ফ্যাক্টর নয়। নতুন গভর্নর হল তো, তাই কিছুটা গরম গরম ভাব। দেখবেন, অল্প দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ বলল অন্য কমাণ্ডার।
‘আমি তাঁর মনোভাব বদলাতে দেব না। আমি তাকে ঘোরের মধ্যেই রাখতে চাই। ক্ষমতার নেশায় বুঁদ করে রেখেই তাকে শায়েস্তা করব।’ বললেন নাজি।
নাজির খাস ভবনে গভীর রাত পর্যন্ত সুরাপান আর সালাহুদ্দীন আইউবী সম্পর্কে নানা আলোচনা হল। নাজি সহকর্মীদের নিয়ে ঠিক করলেন যদি সালাহুদ্দীন আইউবী তার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে ওঠে, তবে তারা কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হল।
একদিকে চলছে নাজির চক্রান্ত। অপরদিকে সালাহুদ্দীন আইউবী গভর্নর হাউজে অফিসারদেরকে তার নিয়োগ ও কর্মকৌশলের কথা ব্যাখ্যা করছেন। সালাহুদ্দীন অফিসারদের জানালেন— ‘আমি মিসরের রাজা হয়ে আসিনি আর আমি কাউকে অন্যায় রাজত্ব করতেও দেব না।’
সালাহুদ্দীন অফিসারদের বললেন সামরিক শক্তিবৃদ্ধি ছাড়া ইসলামী খেলাফতের দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এখানকার সেনাবাহিনীর কাঠামো ও বিন্যাস তার পছন্দ নয়, তা-ও অবহিত করলেন। বললেন— ‘পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের স্পেশাল বাহিনীতে সবাই সুদানী নাগরিক। ব্যাপারটি ঠিক নয়। কোন কাজে আঞ্চলিকতার প্রাধান্য থাকা অনুচিত। আমরা সব অঞ্চলের মানুষকেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে চাই। সবাই যাতে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী দেশের সেবায় কাজ করতে পারে। তাতে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যও দূর হবে। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতিকল্পে এ পদক্ষেপ ফলপ্রসূ অবদান রাখবে।’
সালাহুদ্দীন অফিসারদের জানালেন— ‘আমি জেনারেল নাজিকে বলে দিয়েছি, তিনি যেন মিসরের লোকদেরকে সেনাবাহিনীতে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করেন।’
‘আপনি কি বিশ্বাস করেন, নাজি আপনার নির্দেশ পালন করবে?’ সালাহুদ্দীনের কাছে জানতে চাইলেন একজন প্রবীণ সচিব।
‘কেন? সে আমার নির্দেশ অমান্য করবে নাকি?’
‘এড়িয়ে যেতে পারেন’ —সচিব বললেন— ‘এ ফৌজী কার্যক্রমে তার একক আধিপত্য। তিনি এ ব্যাপারে কারও হুকুম পালন করেন না, বরঞ্চ অন্যকে পালন করতে বাধ্য করেন।’
সালাহুদ্দীন চুপ হয়ে গেলেন। যেন কথাটি তিনি বুঝতেই পারেননি। সচিবের কথায় তার কোন ভাবান্তর হল না। কিছুক্ষণ ভাবলেশহীন নীরবে বসে থেকে তিনি সবাইকে গভর্নর হাউজ থেকে বিদায় করে দিলেন।
আলী বিন সুফিয়ান খানিকটা দূরে বসে আছেন। সালাহুদ্দীন তাঁকেই শুধু থাকতে ইশারা করলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর তাঁকে কাছে ডাকলেন।
আলী একজন দক্ষ গোয়েন্দা। বয়সে সালাহুদ্দীনের বড়। কিন্তু শরীরের শক্ত গাঁথুনি, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা আর দীর্ঘ প্রশিক্ষণ আলীকে যুবকে পরিণত করেছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিশ্বস্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও দূরদর্শী কমাণ্ডার হিসেবে আলীর অবস্থান সবার উপরে। মিসরের স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতি আর অবিশ্বস্ততার দিকটি বিবেচনায় রেখে জঙ্গী আলীকে সালাহুদ্দীনের সহকর্মী হিসেবে মিসর প্রেরণ করেন। সালাহুদ্দীনের অধীনে শুধু আলী নিজেই আসেননি, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার হাতেগড়া সুদক্ষ এক গোয়েন্দা ইউনিট। এরা কমাণ্ডো, গেরিলা অভিযান ও গোয়েন্দাকর্মে পটু। প্রয়োজনে আকাশ থেকে তারকা ছিনিয়ে আনতেও এর দ্বিধা করে না।
আলীর সবচেয়ে বেশী প্রশংসনীয় গুণটি হল, তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর একই আদর্শে বিশ্বাসী। ইসলামী খেলাফত ও মুসলমানদের কল্যাণে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে আলী সালাহুদ্দীনের মত সদা প্রস্তুত।
‘তুমি কি লক্ষ্য করেছ আলী! ওই অফিসার বলে গেল, নাজি কারও হুকুম তামিল করে না, অন্যদেরকে সে নির্দেশ মানতে বাধ্য করে শুধু।’
‘জী, শুনেছি। আমার মনে হয়, স্পেশাল বাহিনীর প্রধান নাজি নামের এই লোকটি খুবই কুটিল। এ লোক সম্পর্কে আগে থেকেই আমি অনেক কথা জানি। পঞ্চাশ হাজার সৈন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নেয়; অথচ প্রকৃত পক্ষে ওরা নাজির ব্যক্তিগত বাহিনী। ব্যক্তিস্বার্থে লোকটি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোটিই নষ্ট করে দিয়েছে। প্রশাসনের পদে পদে অনুগত চর বসিয়ে রেখেছে।’
‘সেনাবাহিনীতে সব এলাকার লোকের অনুপ্রবেশ ঘটানোর সিদ্ধান্তে আপনার সাথে আমি একমত। অচিরেই আমি এ ব্যাপারে আপনাকে বিস্তারিত জানাব। সুদানী সৈন্যরা খেলাফতের আনুগত্যের বিপরীতে নাজির আনুগত্য করে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেনাবাহিনীর কাঠামোটাই আমাদের বদলে ফেলতে হবে কিংবা এ পদ থেকে নাজিকে সরিয়ে দিতে হবে।’
‘আমি প্রশাসনে আমার শত্রু তৈরী করতে চাই না আলী! নাজি আমাদের হাড়ির খবর রাখে। এ মুহূর্তে ওকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজেদের রক্ত ঝরাতে আমি তরবারী হাতে নেইনি। আমার তরবারী শত্রুর রক্তের পিয়াসী। আমি সদাচারণ ও ভালবাসা দিয়ে নাজিকে বাগে আনার চেষ্টা করছি। তুমি ওর সৈন্যদের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে আমাকে জানাও বাহিনীটা আমাদের কতটুকু অনুগত।’
‘নাজি আনাড়ী লোক নয়। ভালবাসা আর মমতা দিয়ে ওর দুষ্ট মানসিকতা বদলানোর অবকাশ নেই। নাজি এ-সবের অনেক ঊর্ধ্বে। বেটা একটা সাক্ষাত শয়তান। ক্ষমতা, চালবাজী, দুষ্কর্মই তার পেশা এবং নেশা । লোকটা এত-ই ধূর্ত ও চালাক যে, তোষামোদ দ্বারা সে পাথরকেও মোমের মত গলিয়ে দিতে পারে।’
সালাহুদ্দীন আইউবীকেও ঘায়েল করার জন্যে চালবাজী শুরু করলেন নাজী। সামনে কখনও তিনি নিজের আসনে পর্যন্ত বসেন না। ‘জী, হ্যাঁ’, ‘খুব ভাল’, ‘সব ঠিক’ রাজ্যের যত তোষামোদ ও চাটুকারিতার উপযোগী শব্দ-বাক্য আছে, সবই তিনি সালাহুদ্দীনের সঙ্গে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। সালাহুদ্দীনের আস্থা অর্জনের জন্যে মিসরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীতে লোক রিক্রুট করতে শুরু করলেন তিনি।
ধূর্তামিপূর্ণ আচরণে সালাহুদ্দীন নাজির প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেন। নাজি সালাহুদ্দীনকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, স্পেশাল বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক খেলাফতের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত। সুদানী ফৌজ আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। তারা আপনাকে পেয়ে খুবই গর্বিত। আপনার সম্মানে তারা একটি সংবর্ধনার আয়োজন করার জন্যে আমার কাছে আবেদন করেছে। ওরা আপনাকে সম্মান জানাতে চায়; আপনাকে নিজেদের মত করে কাছে পেতে ওরা খুব-ই উদ্গ্রীব।
সালাহুদ্দীন আইউবী নাজির প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। বললেন— ‘আমি আপনার ফৌজের দেওয়া সংবর্ধনায় যাব।’
কিন্তু দাফতরিক কাজের ঝামেলায় সালাহুদ্দীন নাজির অনুষ্ঠানের জন্যে সময় বের করতে পারছিলেন না। তাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি পিছিয়ে গেল কয়েক দিনের জন্য।
* * *