সুলতান সালাহুদ্দীনের তাঁবুতে জোকির রাত যাপনের সংবাদ পৌঁছে গেছে নাজির গোপন হেরেমে। নাজির হেরেমের অন্যান্য মেয়েদের মনে জোকির বিরুদ্ধে হিংসার আগুন প্রজ্বলিত হয়ে আছে পূর্ব থেকেই। এই হেরেমে জোকির আগমন ঘটেছে মাত্র ক’দিন হল। কিন্তু প্রথম দিনটি থেকেই তাকে নিজের সঙ্গে রাখতে শুরু করেছেন নাজি। পলকের জন্য চোখের আড়াল করছেন না সে নবাগতা এই মেয়েটিকে। থাকতে দিয়েছেন আলাদা কক্ষ।
মহলের অন্য মেয়েদের জানা ছিল না, নাজি জোকিকে সালাহুদ্দীন আইউবীকে মোমে পরিণত করার এবং বড় রকম নাশকতামূলক পরিকল্পনায় কাজ করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। জোকি নাজিকে হাত করে নিয়েছে, এ দেখেই মহলের অন্য মেয়েরা জ্বলে-পুড়ে ছাই হচ্ছে।
হেরেমের দুটি মেয়ে জোকিকে হত্যা করার কথাও ভাবছিল। এবার তারা দেখল, স্বয়ং মিসরের গভর্নরও মেয়েটিকে এমন পছন্দ করে ফেলেছেন যে, জোকিকে তিনি রাতভর নিজের তাঁবুতে রাখলেন। এতে পাগলের মত হয়ে পড়েছে তারা।
জোকিকে হত্যা করার পন্থা দুটি। হয়ত বিষ খাওয়াতে হবে, অন্যথায় ভাড়াটিয়া ঘাতক দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে হবে। এর একটিও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, জোকি এখন নিজের কক্ষ থেকে বের হয় না এবং তার কক্ষে ঢুকে বিষ প্রয়োগও সম্ভব নয়।
হেরেমের সবচে চতুর চাকরানীটিকে হাত করে নিয়েছিল তারা। এবার দাবি অনুপাতে পুরস্কার দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে চাকরানীর কাছে। বিচক্ষণ চাকরানী বলল, ‘সালারের শয়নকক্ষে ঢুকে জোকিকে বিষপান করানো সম্ভব নয়। সুযোগমত খঞ্জর দ্বারা খুন করা যেতে পারে। তবে এর জন্য সময়ের প্রয়োজন।’
জোকির গতিবিধির প্রতি দৃষ্টি রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় চাকরানী। মহিলা এও বলে, ‘আমি কোন সুযোগ বের করতে না পারলে হাশীশীদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। তবে তারা বিনিময় নেয় অনেক। বিনিময় যত প্রয়োজন হয় দিবে বলে নিশ্চয়তা দেয় মেয়ে দু’টো।
* * *
ক্ষুব্ধ মনে নিজ কক্ষে পায়চারী করছেন নাজি। তাকে শান্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে জোকি। কিন্তু উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে তার ক্ষোভ।
‘সালাহুদ্দীনের কাছে আপনি আমাকে আরেকবার যেতে দিন। আমি লোকটাকে বোতলে ভরে ফেলব।’ বলল জোকি।
‘লাভ হবে না। কমবখ্ত তার নির্দেশনামা জারি করে ফেলেছে; যার বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে। লোকটা আমার অস্তিত্বই শেষ করে দিল। তোমার যাদু তার উপর অচল। আমার বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্রটা কে করল, তা আমি জানি। বেটা আমার ক্রমবর্ধমান মর্যাদা ও যোগ্যতায় হিংসা করছে। আমি মিসরের গভর্নর হতে যাচ্ছিলাম। আমি মিসরের শাসকবর্গের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতাম। অথচ আমি ছিলাম একজন সাধারণ সালার। এখন আমি একজন সালারও নই।’ গর্জে উঠে বললেন নাজি। দারোয়ানকে বললেন, ‘ঈদরৌসকে এক্ষুণি ডেকে আন।’
সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয় নাজির নায়েব ঈদরৌস। নাজি বলেন, ‘আমি এর উপযুক্ত একটা জবাব ঠিক করে রেখেছি।’
কী জবাব জানতে চায় ঈদরৌস।
‘বিদ্রোহ।’ বললেন নাজি।
শুনে নির্বাক নিষ্পলক নাজির প্রতি তাকিয়ে থাকে ঈদরৌস। ক্ষণকাল নীরব থেকে নাজি বললেন, ‘তুমি অবাক হয়েছে? এই পঞ্চাশ হাজার সুদানী সৈন্য আমাদের ওফাদার হওয়ার ব্যাপারে তোমার কোন সন্দেহ আছে? এরা কি? সালাহুদ্দীন আইউবীর তুলনায় আমাকে ও তোমাকে বেশী মান্য করে না? তুমি কি তোমার বাহিনীকে এই বলে বিদ্রোহের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে পারবে না যে, সালাহুদ্দীন আইউবী তোমাদেরকে মিসরীদের গোলামে পরিণত করছে; অথচ মিসর তোমাদের?’
গভীর এক নিঃশ্বাস ছেড়ে ঈদরৌস বলল, ‘এরূপ কোন পদক্ষেপ নিয়ে আমি চিন্তা করে দেখিনি। বিদ্রোহের আয়োজন আঙ্গুলের এক ইশারায়-ই হতে পারে। কিন্তু মিসরী বাহিনী আমাদের বিদ্রোহ দমন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। বাইরের সাহায্য নেওয়ার ব্যবস্থাও তাদের আছে। সরকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগে সবদিক ভাল করে ভেবে দেখা প্রয়োজন।’
‘আমি সবই ভেবে দেখেছি। খৃষ্টান সম্রাটদের কাছে সাহায্যের আবেদন পাঠাচ্ছি। তুমি দুজন দূত প্রস্তুত কর। তাদের অনেক দূর যেতে হবে। এস, আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোন। জোকি! তুমি তোমার কক্ষে চলে যাও।’ বললেন নাজি।
নিজ কক্ষে চলে যায় জোকি। নাজি ও ঈদরৌস পরিকল্পনা আঁটে সারা রাত জেগে।
* * *
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দুই বাহিনীকে একীভূত করার সময় ঠিক করেছিলেন সাত দিন। কাগুজে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। পূর্ণ সহযোগিতা করছেন নাজি। কেটে গেছে চারদিন। এ সময়ে নাজি আরেকবার সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে। কিন্তু কোন অভিযোগ করেননি। বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে সে সালাহুদ্দীন আইউবীকে নিশ্চিন্ত করে দেয় যে, সপ্তম দিনে দুই বাহিনী এক হয়ে যাবে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নায়েবগণও তাকে নিশ্চিত করে, নাজি বিশ্বস্ততার সাথে সহযোগিতা করছে। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের রিপোর্ট ছিল ভিন্ন রকম। আলীর গোয়েন্দা বিভাগ রিপোর্ট করেছে, সুদানী ফৌজের সিপাহীদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিশৃংখলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মিসরী ফৌজের সঙ্গে একীভূত হতে তারা সম্মত নয়। তাদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, মিসরী ফৌজের সঙ্গে একীভূত হলে তাদের অবস্থান গোলামের মত হয়ে যাবে। তারা গনীমতের সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে এবং তাদেরকে গাধার মত খাটতে হবে। সবচে বড় ভয়, তাদের মদপান করার অনুমতি থাকবে না।
আলী বিন সুফিয়ান এ রিপোর্ট সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে পৌঁছিয়ে দেন। জবাবে সুলতান বললেন, ‘এরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিলাসিতা করে আসছে তো, তাই হঠাৎ এই পরিবর্তন মনোঃপূত হচ্ছে না। আশা করি ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের গা-সহা হয়ে যাবে। এতে চিন্তার কিছু নেই।’
‘আচ্ছা ঐ মেয়েটির সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হয়েছে কি?’ জিজ্ঞেস করেন সুলতান।
‘না। ওর সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমার লোকেরাও ব্যর্থ হয়েছে। নাজি তাকে বন্দী করে রেখেছে।’ জবাব দেন আলী বিন সুফিয়ান।
পরের রাতের ঘটনা।
সবেমাত্র আঁধার নেমেছে। জোকি তার কক্ষে উপবিষ্ট। ঈদরৌসকে সঙ্গে নিয়ে নাজি তার কক্ষে বসা। ঘোড়ার পদশব্দ শুনতে পায় জোকি। দরজার পর্দাটা ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকায় সে। বাইরে দীপের আলোতে দুজন আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে দেখতে পায় মেয়েটি। পোশাকে তাদেরকে বণিক বলে মনে হল তার। কিন্তু ঘোড়া থেকে অবতরণ করে যখন তারা নাজির কক্ষের দিকে পা বাড়ায়, তখন তাদের চলনে বুঝা গেল, লোকগুলো ব্যবসায়ী নয়।
ইত্যবসরে বাইরে বেরিয়ে আসে ঈদরৌস। তাকে দেখেই থেমে যায় আগন্তুকদ্বয়। সামরিক কায়দায় সালাম করে ঈদরৌসকে। ঈদরৌস তাদের চারদিক ঘুরে, আপাদমস্তক গভীরভাবে নিরীক্ষা করে বলে, অস্ত্র কোথায় দেখাও। চোগার পকেট ও আস্তিনের ভিতর থেকে অস্ত্র বের করে দেখায় তারা। ক্ষুদ্র আকারের একটি তরবারী ও একটি করে খঞ্জর। তাদেরকে ভিতরে নিয়ে যায় ঈদরৌস।
গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায় জোকি। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে নাজির কক্ষপাণে হাঁটা দেয়। কিন্তু দারোয়ান দরজায় তার গতিরোধ করে বলে, ‘ভিতরে যেতে পারবেন না, নিষেধ আছে।’ জোকি বুঝে ফেলে, বিশেষ কোন ব্যাপার আছে। তার মনে পড়ে যায়, দু রাত আগে নাজি তার উপস্থিতিতে ঈদরৌসকে বলেছিল, ‘আমি খৃষ্টান সম্রাটদের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। তুমি দু’জন দূত প্রস্তুত কর; অনেক দূর যেতে হবে।’ তারপর আমাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে বিদ্রোহের কথাও বলেছিল। নিজের কক্ষে চলে যায় জোকি। জোকি ও নাজির কক্ষের মধ্যখানে একটি দরজা, যা অপর দিক থেকে বন্ধ। এ দরজাটির সঙ্গে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যায় জোকি। অপর কক্ষে নাজির কথা বলার ফিসফিস শব্দ শোনা গেলেও বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।
কিছুক্ষণ পর নাজীর পরিষ্কার কণ্ঠ শুনতে পায় জোকি। সে বলছে, ‘বসতি থেকে দূরে থাকবে। সন্দেহবশত কেউ তোমাদের ধরার চেষ্টা করলে সর্বাগ্রে পত্রটি গায়েব করে ফেলবে। জীবন বাজি রেখে কাজ করবে। পথে যে-ই তোমাদের গতিরোধ করবে, নির্দ্বিধায় তাকে শেষ করে দেবে। সফর তোমাদের চার দিনের; কিন্তু পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবে তিন দিনে। দিকটা মনে রেখ; উত্তর-পশ্চিম।’
বাইরে বেরিয়ে পড়ে আগন্তুকদ্বয়। জোকিও বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। নাজি ও ঈদরৌস দাঁড়িয়ে আছে ফটকের সামনে। আরোহীদের বিদায় দেওয়ার জন্যই তারা বের হয়েছে বোধ হয়।
দুটি ঘোড়ায় চড়ে দু আরোহী ছুটে চলে দ্রুত। জোকিকে দেখে নাজি ডাক দিয়ে বলেন, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি, অনেক কাজ আছে, ফিরতে দেরী হবে, তুমি আরাম কর। একাকী ভাল না লাগলে হেরেমে ঘুরে এস।’
হাত তুলে ঠিক আছে বলে সম্মতি জানায় জোকি।
মহল ত্যাগ করে চলে যায় নাজি ও ঈদরৌস। কক্ষে প্রবেশ করে জোকি। চোগা পরিধান করে কটিবন্ধে খঞ্জর বাঁধে। কক্ষের দরজায় তালা দিয়ে হাঁটা দেয় হেরেমের দিকে।
জোকির কক্ষ থেকে হেরেমের দূরত্ব কয়েকশ গজ। দারোয়ানকে অবহিত করে হেরেমে প্রবেশ করে সে। অপ্রত্যাশিতভাবে জোকিকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে হেরেমের মেয়েরা। এই প্রথমবার হেরেমে প্রবেশ করল জোকি। হেরেমের মেয়েরা তাকে সম্মানের সাথে স্বাগত জানায়। যে দুটি মেয়ে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল, সহাস্যে অভিবাদন জানায় তারাও। কক্ষময় ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জোকি। সবার সাথে কথা বলে ফেরত রওনা হয়। যে চতুর চাকরানীটি তাকে খুন করার দায়িত্ব নিয়েছিল, বিদায়ের সময় সেও সেখানে উপস্থিত। গভীর দৃষ্টিতে জোকির আপাদমস্তক একবার দেখে নেয় সে। জোকি বেরিয়ে পড়ে বাইরে।
হেরেমের প্রাসাদ আর নাজির বাসগৃহের মধ্যবর্তী জায়গাটা অনাবাদী; কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু। হেরেম থেকে বেরিয়ে জোকি নাজির বাসগৃহে না গিয়ে দ্রুতগতিতে হাঁটা দেয় অন্যদিকে। ওদিকে একটি সরু গলিপথও আছে।
অতি দ্রুত হাঁটছে জোকি। হঠাৎ গলিপথের পনের-বিশ গজ পিছনে একটি কালো ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে তার। সেটিও এগিয়ে চলছে দ্রুত। হয়ত বা কোন মানুষ। কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটি কালো চাদরে আবৃত থাকায় তাকে ভূত বলেই মনে হল জোকির কাছে।
হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দেয় জোকি। সাথে সাথে ভূতের গতি বেড়ে যায় আরও বেশী। সামনে ঘন ঝোঁপ-ঝাড়। তার মধ্যে অন্তহিত হয়ে যায় জোকি। সেখান থেকে আড়াই থেকে তিনশ গজ সম্মুখে সুলতান সালাহুদ্দীনের বাসগৃহ, যার আশপাশে সেনা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের আবাস।
জোকি যাচ্ছিল ওদিকেই। মেয়েটি ঘন ঝোঁপের মধ্য থেকে বের হল বলে, এমন সময় বাঁ দিক থেকে ছায়া মূর্তিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। জোছনা রাত। তবু ছায়াটির মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে না। তার পায়ের কোন শব্দ নেই। হাতটা উপরে উঠে যায় ছায়াটির। জোছনার আলোয় একটি খঞ্জর চিক করে ওঠে এবং বিদ্যুগতিতে জোকির কাঁধ ও ঘাড়ের মধ্যখানে এসে বিদ্ধ হয়। জোকির মুখ থেকে কোন চিৎকার বেরোয়নি। খঞ্জর তার কাঁধ থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এত গভীর জখম খেয়েও মেয়েটি দ্রুতগতিতে কোমর থেকে খঞ্জর বের করে। ছায়া মূর্তিটি তার উপর পুনর্বার আক্রমণ চালায়। এবার জোকি আক্রমণকারিণীর খঞ্জরধারী হাতটা নিজের বাহু দ্বারা প্রতিহত করে নিজের খঞ্জরটা তার বুকে সেঁধিয়ে দেয়। আঘাত খেয়ে ছায়া মূর্তিটি চীৎকার করে ওঠে। এবার জোকি বুঝতে পারে আক্রমণকারী মূর্তিটি একজন নারী। জোকি খঞ্জরটা তার বুক থেকে বের করে পুনরায় আঘাত হানে। এবার বিদ্ধ হয় ছায়া মূর্তির পিঠে। আঘাত লাগে নিজের পাঁজরেও। ছায়া মূর্তিটি ঘুরপাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
আক্রমণকারী লোকটা কে দেখার চেষ্টা করল না জোকি। ছুটে চলল গন্তব্যপানে। তার শরীর থেকে ফিনকি ধারায় রক্ত ঝরছে। জোৎস্নালোকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাসগৃহ দেখতে পাচ্ছে জোকি। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর মাথাটা চক্কর খেয়ে ওঠে তার। চলার গতি মন্থর হতে শুরু করেছে। জোকি চীৎকার করে ওঠে— ‘আলী! সালাহুদ্দীন! আলী! সালাহুদ্দীন!’
পরনের পোশাক রক্তে লাল হয়ে গেছে জোকির। সীমাহীন কষ্টে পা টেনে টেনে অগ্রসর হচ্ছে মেয়েটি। গন্তব্যের কাছে চলে এসেছে সে। কিন্তু বাকি পথ অতিক্রম করা সম্ভব মনে হচ্ছে না। দেহের সবটুকু শক্তি ব্যয় করে অনর্গল ডেকে চলছে আলী ও সালাহুদ্দীনকে।
নিকটেই একস্থানে একজন টহল সেনা টহল দিয়ে ফিরছিল। জোকির ডাক শুনে ছুটে আসে সে। জোকি তার গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে বলল— ‘আমাকে আমীরে মেসেরের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। দ্রুত, অতি দ্রুত।’ সান্ত্রী মেয়েটিকে পিঠে তুলে সুলতান সালাহুদ্দীনের বাসগৃহ অভিমুখে ছুটে যায়।
* * *
নিজ কক্ষে বসে আলী বিন সুফিয়ানের নিকট থেকে রিপোর্ট নিচ্ছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। কক্ষে তাঁর দুজন নায়েবও উপস্থিত। আলী বিন সুফিয়ান বিদ্রোহের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। সে নিয়েই আলাপ-আলোচনা করছেন তাঁরা। চরম ভয়ার্ত চেহারায় কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান। বলে, ‘এক সেপাহী একটি জখমী মেয়েকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, মেয়েটি নাকি আমীরে মেসেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে।’
শুনেই আলী বিন সুফিয়ান ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীরের ন্যায় কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। সুলতান সালাহুদ্দীনও তার পেছনে পেছনে ছুটে যান। ইত্যবসরে মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে। সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাক।’ মেয়েটিকে সুলতান সালাহুদ্দীনের খাটের উপর শুইয়ে দেওয়া হল। মুহূর্ত মধ্যে বিছানাপত্র রক্তে ভিজে যায়।
‘ডাক্তার-কবিরাজ কাউকে ডাকতে হবে না’— ক্ষীণ কণ্ঠে মেয়েটি বলল— ‘আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।’
‘তোমাকে কে জখম করল জোকি’, আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেন।
‘আগে জরুরী কথাগুলো শুনুন’— জোকি বলল— ‘উত্তর-পূর্ব দিকে ঘোড়া হাঁকান। দুজন অশ্বারোহীকে যেতে দেখবেন। উভয়ের পোশাকই বাদামী বর্ণের। একটি ঘোড়া বাদামী, অপরটি কালো। লোকগুলোকে দেখতে ব্যবসায়ী মনে হবে। তাদের সঙ্গে সালার নাজির লিখিত পয়গাম আছে, যেটি খৃষ্টান সম্রাট ফ্রাংক বরাবর পাঠানো হয়েছে। নাজির এই সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ করবে। আমি আর কিছু জানি না। আপনাদের সালতানাত কঠিন বিপদের সম্মুখীন। অশ্বারোহী দুজনকে পথেই ধরে ফেলুন। বিস্তারিত তাদের নিকট থেকে জেনে নিন।’ বলতে বলতে চৈতন্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে মেয়েটি।
অল্পক্ষণের মধ্যে দুজন ডাক্তার এসে পৌঁছেন। তারা মেয়েটির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে চেষ্টা শুরু করেন। মুখে ঔষধ খাইয়ে দেন। ঔষধের ক্রিয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে জোকি বাকশক্তি ফিরে পায়। জরুরী বার্তা তো আগেই জানিয়ে দিয়েছে। এবার বিস্তারিত বলতে শুরু করে। নাজি ও ঈদরৌসের কথোপকথন, তাকে নিজ কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া, নাজির ক্ষুব্ধ হওয়া—দৌড়-ঝাঁপ এবং দুজন অশ্বারোহীর আগমন ইত্যাদি সব কথা। শেষে জোকি বলল, ‘আক্রমণকারী কে ছিল, আমি জানি না। তবে আমার আঘাত খেয়ে আক্রমণকারী যে চীৎকারটা দিয়েছিল, তাতে বুঝা গেছে লোকটা মহিলা।’ জোকি আক্রমণের স্থান জানায়। তৎক্ষণাৎ সেখানে দুজন লোক প্রেরণ করা হয়। জোকি বাঁচবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করে। তার পেট ও পিঠে দুটি গভীর জখম।
জোকির রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। বেশির ভাগ রক্ত আগেই ঝরে গেছে। সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল— ‘আল্লাহ আপনাকে এবং আপনার সাম্রাজ্যকে নিরাপদ রাখুন। আপনি পরাজিত হতে পারেন না। সালাহুদ্দীন আইউবীর ঈমান কত পরিপক্ক আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।’ তারপর আলী বিন সুফিয়ানকে উদ্দেশ করে বলল— ‘আমি কর্তব্য পালনে ত্রুটি করিনি তো? আপনি আমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, আমি তা পালন করেছি।’
‘তুমি প্রয়োজনের বেশি দায়িত্ব পালন করেছে’— আলী বিন সুফিয়ান বললেন— ‘আমার তো ধারণাই ছিল না, নাজি এত ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত এবং তোমাকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। আমি তোমাকে শুধু গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রেরণ করেছিলাম।’
‘হায়, আমি যদি মুসলমান হতাম!’ –জোকি বলল— তার চোখে অশ্রু নেমে আসে। বলল—‘আমার এ কাজের যা বিনিময় দেবেন, আমার অন্ধ পিতা ও চিররুগ্ন মাকে দিয়ে দেবেন। তাদের অক্ষমতাই বার বছর বয়সে আমাকে নর্তকী বানিয়েছিল।’
জোকির মাথাটা একদিকে ঝুঁকে পড়ে। চোখ দুটো আধখোলা। ঠোঁট দুটোও এমনভাবে আছে, যেন মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে। ডাক্তার তার শিরায় হাত রাখেন এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি তাকিয়ে মাথা নাড়ান। জোকির প্রাণপাখি আহত দেহের খাঁচা থেকে বেরিয়ে গেছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন— মেয়েটার ধর্ম যা-ই থাকুক, তাকে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে দাফন কর। ইসলামের জন্য মেয়েটা নিজের জীবন দান করেছে। ইচ্ছে করলে আমাদেরকে ধোকাও দিতে পারত।
দারোয়ান কক্ষে প্রবেশ করে বলল, ‘বাইরে এক নারীর লাশ এসেছে।’ সুলতান সালাহুদ্দীন ও আলী বেরিয়ে দেখেন মধ্য বয়সী এক মহিলার লাশ। অকুস্থলে দুটি খঞ্জর পাওয়া গেছে। মহিলাকে কেউ চেনে না। এ নাজির হেরেমের সেই চাকরানী, যে পুরস্কারের লোভে জোকির উপর সংহারী আক্রমণ চালিয়েছিল।
জোকিকে রাতেই সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হল। আর চাকরানীর লাশ পূর্ণ অবজ্ঞার সাথে গর্তে নিক্ষেপ করা হল। তবে দুটো কর্মই সম্পাদন করা হল গোপনে।
সময় নষ্ট না করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী উন্নত জাতের আটটি তাগড়া ঘোড়া এবং আটজন কমাণ্ডো নির্বাচন করে তাদেরকে আলী বিন সুফিয়ানের কমাণ্ডে নাজির প্রেরিত লোক দুটিকে ধাওয়া করে ধরতে পাঠিয়ে দেন।
জোকি ছিল মারাকেশের এক নর্তকী। কেউ জানত না তার ধর্ম কী ছিল। তবে মুসলমান ছিল না; খৃষ্টানও নয়। আলী বিন সুফিয়ান জানতে পারেন, সুদানী ফৌজের সালার নাজি একজন কুচক্রী ও শয়তান চরিত্রের মানুষ। তার অন্দর মহলের খবরাখবর জানার জন্য আলী গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একটি তথ্য জানতে পারেন, নাজি হাসান ইবনে সাব্বাহর ফেদায়ীদের ন্যায় প্রতিপক্ষকে রূপসী মেয়ে ও হাশিশ দ্বারা ফাঁদে আটকায় এবং নিজের অনুগত বানায় কিংবা খুন করায়। আলী বিন সুফিয়ান বহু খোঁজাখুঁজির পর এক ব্যক্তির মাধ্যমে জোকিকে মারাকেশ থেকে আনান এবং কৌশলে নাজির নিকট পাঠিয়ে দেন। মেয়েটির মধ্যে এমনই জাদু ছিল যে, নাজি তাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফাঁসানোর কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু মেয়েটি যে তারই জন্য একটি পাতা ফাঁদ, তা সে জানত না। সুলতান সালাহুদ্দীন ও আলী বিন সুফিয়ানের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে নাজি নিজেই জোকির ফাঁকে আটকে যায়। জোকির মাধ্যমে তার গোপন সব তথ্য চলে যেতে শুরু করে সালাহুদ্দীন ও আলীর কানে। এই তথ্য গ্রহণই ছিল মহড়ার দিন মেয়েটিকে নিজ তাঁবুতে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের তাৎপর্য। তাঁবুতে নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন মেয়েটির সঙ্গে প্রেম নিবেদন করেননি—নাজির কাছে থেকে তার প্রাপ্ত তথ্যাবলীর রিপোর্ট গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটির দুর্ভাগ্য যে, নাজির হেরেমে তার শত্রু জন্মে যায়, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আঁটা হয় এবং তাকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়।
* * *
আট দ্রুতগামী অশ্বারোহী নিয়ে ছুটে চলছেন আলী বিন সুফিয়ান। গন্তব্য দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। সম্রাট ফ্রাংকের হেডকোয়াটার কোথায় তার জানা আছে। সে পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ-ঘাটও চেনা।
এখন পরদিন ভোর বেলা। রাতে তেমন বিশ্রাম করেননি। আরবী ঘোড়া ক্লান্ত হয়েও তাগড়া থাকে। দূর দিগন্তে খেজুর বীথির মধ্যে দুটি ঘোড়া দেখতে পান আলী। রাস্তা পরিবর্তন ও আড়ালের জন্য তিনি টিলার কোল ঘেঁষে ঘেঁষে চলছেন। মরুভূমির ভেদ-রহস্য তার জানা আছে। লোকালয় ফেলে এখন অনেক দুরে চলে এসেছেন তিনি। বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা নেই তার।
চলার গতি আরও বাড়িয়ে দেন আলী বিন সুফিয়ান। সামনের দুই আরোহী আর তাঁর দলের মধ্যকার ব্যবধান কমপক্ষে চার মাইল ছিল। এখন দূরত্বটা কমিয়ে এনেছেন তিনি। কিন্তু ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
আলী বিন সুফিয়ান ও তার বাহিনী এখন খেজুর বীথির নিকটে এসে পৌঁছেছেন। সম্মুখের আরোহী দুজন দু মাইল দূরে একটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চলছে। বোধ হয় তাদের ঘোড়াও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আরোহী দুজন ঘোড়া থেকে অবতরণ করে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
ওরা পাহাড়ের আড়ালে বসে পড়েছে বলেই আলী বিন সুফিয়ান রাস্তা বদল করে ফেলেন।
দু দলের মাঝে ব্যবধান কমে আসছে। এখন দূরত্বটা কয়েক শ গজের বেশি হবে না। সম্মুখের আরোহীদ্বয় আড়াল থেকে সামনে চলে আসে। পিছনে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসা ঘোড়ার পদধ্বনি শুনে ফেলেছে তারা। তারা একদিকে সেরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আলী বিন সুফিয়ানের ঘোড়ার গতি আরও বেড়ে যায়। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ঘোড়া আপত্তি জানায় না। তারাও জানে, এই মিশনে আলী ও সালাহুদ্দীনকে সফল হতেই হবে। অতএব, কর্তব্যে অবহেলা করা চলবে না।
দলবলসহ পাহাড়ের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন আলী। দুটি ঘোড়া সে পথে অতিক্রম করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেল। কিন্তু এখনও বেশিদূর যেতে পারেনি। বোধ হয় পিলেয় ভয় ধরে গেছে তাদের। সম্ভবত তারা বেরুবার পথ পাচ্ছে না। একবার ডানে, একবার বাঁয়ে ছুটাছুটি করে ফিরছে শুধু।
আলী বিন সুফিয়ান ঘোড়াগুলো এক সারিতে বিন্যস্ত করে সামনে-পিছনে ঘুরিয়ে দেন এবং পলায়নপর আরোহীদের কাছাকাছি পৌঁছে যান। দু দলের মাঝের দূরত্ব এখন মাত্র একশ গজ। এক তীরন্দাজ ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে তীর ছোঁড়ে। তীরটা একটি ঘোড়ার সামনের এক পায়ে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ঘোড়াটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আরও কিছু দৌঁড়-ঝাঁপের পর পলায়নপর লোক দুজন আলীর বাহিনীর বেষ্টনীতে চলে আসে। তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
আলী বিন সুফিয়ান তাদের পরিচয় জানতে চান। তারা মিথ্যা বলে। নিজেদের ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তল্লাশি নেওয়ার পর সেই বার্তাটি পাওয়া গেল, যেটি নাজি তাদের দিয়ে প্রেরণ করেছিল। উভয়কে হেফাজতে নিয়ে নেওয়া হল। ঘোড়াগুলোকে বিশ্রামের জন্য সময় দেওয়া হল। অভিযান সফল করে আলী বিন সুফিয়ান ফেরত রওনা হন।
অস্থিরচিত্তে অপেক্ষা করছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। দিন কেটে গেছে। রাতটাও অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাতে সুলতান সালাহুদ্দীন ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখ লেগে গেছে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় কতক্ষণ বসে থাকা যায়।
রাতের শেষ প্রহরে সালাহুদ্দীনের কক্ষের দরজায় আলতো করাঘাত পড়ে। তার চোখ খুলে যায়। ধড়মড় করে উঠে দরজা খোলেন। আলী বিন সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনে দণ্ডায়মান তার আট অশ্বারোহী ও দু কয়েদি। সুলতান সালাহুদ্দীন আলী এবং কয়েদী দুজনকে নিজের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে যান এবং নজির পত্ৰখানা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। প্রথম প্রথম তার চেহারার রঙ বিবর্ণ হয়ে ওঠলেও পরক্ষণেই মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
নাজির বার্তাটি বেশ দীর্ঘ। সে খৃষ্টানদের জনৈক সম্রাট ফ্রাংককে লিখেছে, অমুক দিন, অমুক সময় ইউনানী, রোমান ও অন্যান্য খৃষ্টানদের সমুদ্র পথে রোম উপসাগরের দিক থেকে সৈন্য অবতরণ করিয়ে আক্রমণ করুন। আপনার আক্রমণের সংবাদ পেলেই পঞ্চাশ হাজার সুদানী সৈন্য সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে। মিসরের নতুন বাহিনী আপনার আক্রমণ ও আমার বিদ্রোহের একসঙ্গে মোকাবেলা করতে পারবে না। বিনিময়ে সমগ্র মিসর কিংবা মিসরের সিংহভাগ অঞ্চলের শাসন আপনাকে দান করা হবে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বার্তাবাহী লোক দুজনকে কয়েদখানার পাতাল প্রকোষ্ঠে ফেলে রাখেন। তৎক্ষণাৎ নিজের নতুন বাহিনী প্রেরণ করে নাজি ও তার নায়েবদের নিজ গৃহে নজরবন্দি করে ফেলেন। হেরেমের সকল নারীকে মুক্ত করে দেন এবং নাজির যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন। এ সকল অভিযান গোপন রাখা হয়।
নাজির উদ্ধারকৃত পত্রটিতে আক্রমণের যে তারিখ ছিল, সুলতান সালাহুদ্দীন সেটি পরিবর্তন করে অন্য তারিখ লিখে দুজন বিচক্ষণ লোককে সম্রাট ফ্রাংকের নিকট প্রেরণ করেন। বলে দেন, তোমরা নিজেদেরকে নাজির লোক বলে পরিচয় দেবে। তাদের রওনা করিয়ে সুলতান সুদানী বাহিনীকে মিসরী বাহিনীতে একীভূত করে ফেলার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন।
আটদিন পর দূতরা ফিরে আসে। তারা সম্রাট ফ্রাংককে নাজির পত্র পৌঁছিয়ে উত্তর নিয়ে আসে। ফ্রাংক লিখেছেন, ‘আমার আক্রমণের দুদিন আগে যেন সুদানীরা বিদ্রোহ করে, যাতে সালাহুদ্দীনের আক্রমণ মোকাবেলা করার হুঁশ-জ্ঞান না থাকে।’ আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীনের অনুমতিক্রমে এই দূত দুজনকে নজরবন্দি করে রাখেন, যাতে তথ্য ফাঁস হওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকে।
যেসব স্থানে খৃষ্টানদের নৌযান এসে ভেড়ার কথা, সুলতান সালাহুদ্দীন সেই স্থানগুলোতে নিজের সৈন্য লুকিয়ে রাখেন।
পত্রে উল্লেখিত তারিখে সম্রাট ফ্রাংক আক্রমণ চালান। নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী রোম উপসাগরে আত্মপ্রকাশ করে। ঐতিহাসিকদের পরিসংখ্যান মোতাবেক খৃষ্টানদের যুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা ছিল একশত পঁচিশ। তন্মধ্যে বারোটি ছিল বেশ বড়। সেগুলোতে বোঝাই ছিল সৈন্য, যারা মিসর আক্রমণ করতে এসেছিল। এই বাহিনীর কমাণ্ডার ছিলেন এম্লার্ক, যার পালতোলা জাহাজগুলোতে রসদ ছিল। লাইন ধরে আসছিল জাহাজগুলো।
প্রতিরক্ষার কমাণ্ড নিজের হাতে রাখেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তিনি খৃষ্টানদেরকে সাগরের কূলে ভেড়ার সুযোগ দেন। সর্বাগ্রে বড় জাহাজটি লঙ্গর ফেলে। হঠাৎ তার উপর আগুনের বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। এগুলো মিনজানিক দ্বারা নিক্ষিপ্ত আগুন। মুসলমানদের বর্ষিত এই অগ্নিগোলা খৃষ্টানদের জাহাজ কিশতিগুলোর পালে আগুন ধরিয়ে দেয়। কাঠের তৈরি জাহাজগুলোর গায়েও আগুন ধরে যায়। অপর দিক থেকে মুসলমানদের লুকিয়ে থাকা জাহাজ এসে পড়ে। তারাও খৃষ্টানদের জাহাজের উপর আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। এখন মনে হচ্ছে, যেন রোম উপসাগরে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে এবং সাগরটা জ্বলছে। খৃষ্টানদের জাহাজগুলো মোড় ঘুরিয়ে পরস্পর ধাক্কা খেতে ও একটি অপরটিতে আগুন ধরাতে শুরু করে দেয়। নিরুপায় হয়ে জাহাজের খৃষ্টান সেনারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের যারা কূলে এসে ভিড়ে, তারা সুলতান সালাহুদ্দীনের তীরন্দাজদের নিশানায় পরিণত হয়।
ওদিকে নুরুদ্দীন জঙ্গী সম্রাট ফ্রাংকের দেশের উপর আক্রমণ করে বসেন। ফ্রাংক মিসর প্রবেশের জন্য তার বাহিনীকে স্থলপথে রওনা করিয়ে নিজে নৌ বাহিনীতে যোগ দেন। নিজ দেশে আক্রমণের সংবাদ শুনে বড় কষ্টে তিনি দেশে ফিরে যান। গিয়ে দেখেন সেখানকার চিত্র-ই বদলে গেছে।
রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের সম্মিলিত বহরটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সৈন্যরা আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে এবং সালাহুদ্দীনের সৈন্যদের তীর খেয়ে প্রাণ হারিয়েছে। তাদের এক কমাণ্ডার এম্লার্ক প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি আত্মসমর্পণ করে সন্ধির আবেদন জানালে সুলতান সালাহুদ্দীন চড়া মূল্যের বিনিময়ে তা মঞ্জুর করেন। ইউনানী ও সিসিলির কয়েকটি জাহাজ রক্ষা পেয়েছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন তাদেরকে জাহাজগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু ফেরার পথে সমুদ্রে এমন ঝড় ওঠে যে, সবগুলো জাহাজ নদীতে ডুবে যায়।
১১৬৯ সালের ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ খৃষ্টানরা তাদের পরাজয়ে স্বাক্ষর করে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে জরিমানা আদায় করে।
কিন্তু এ জয়ের পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবন ও তার দেশ মিসর আগের তুলনায় বেশির সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।