» » মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে

এক

সে কীরে, ব্যাংকক! তপনের বন্ধুরা শুনে আঁতকে উঠল।

কেন, তাতে কী? তপন দৃঢ়স্বরে জানায়, লোকে ইউরোপ—আমেরিকায় যাচ্ছে না? পড়তে যাচ্ছে, চাকরি করতে যাচ্ছে। এ—তো ঢের কাছে। ব্যাংকক চমৎকার শহর। আর। সুনীলদা বলেছে চাকরিটাও ভালো। এক পাঞ্জাবি ব্যবসাদার ও—দেশ থেকে মশলা নিয়ে। ভারতে চালান দেয়। ওর ব্যাংকক অফিসের জন্য একজন বিশ্বাসী লোক চাই। ভালো মাইনে দেবে। অনেক বাঙালি থাকে ওখানে। সাউথ—ইস্ট—এশিয়ার সঙ্গে ভারতের কদ্দিনের যোগাযোগ জানিস?

সব শুনে বন্ধুরা ঘাড় নাড়ল, তা বটে, তা বটে। ঠিক আছে, যা দেখ কেমন লাগে। ছুটি—টুটি দেবে তো?

অত দূরে? মা খবরটা শুনে তপনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন। তপনের বাবা নেই। মা একটা স্কুলে পড়ান।

তপন বলল, কিছু দূরে নয়। তুমি ভেবো না। সুনীলদা অ্যাদ্দিন রয়েছেন।

বেশ, যা তবে। সাবধানে থাকবি। তোর বাবা থাকলেও বারণ করতেন না। খুশিই হতেন।

বি. এ. পাস করে দু—বছর ধরে চাকরি খুঁজছিল তপন। হঠাৎ বন্ধু গুরুপদর পিসতুতো দাদা সুনীল ব্যানার্জির সঙ্গে আলাপ। সুনীলদা মালয়েশিয়ায় থাকেন। সেখানে স্কুলে পড়ান। ছুটিতে কলকাতায় এসেছেন। সুনীলদা কথায় কথায় বললেন, আমার বিশেষ পরিচিত ব্যাংককের ব্যবসায়ী গোবিন্দ সিং একজন লোক খুঁজছে। যাবে ব্যাংকক? তাহলে তোমার জন্য লিখি।

তপন রাজি হয়ে গেছে।

তপনের ভাই—বোন তিলু মিলু খবরটা শুনেই লাফাতে লাগল। তিলু তক্ষুনি ম্যাপ নিয়ে বসে গেল, থাইল্যান্ডের রাজধানী, তাই না? এই তো ব্যাংকক। কীসে যাবে দাদা? প্লেন, না জাহাজে?

মিলু বলল, দাদা, ওঙ্কারভাট দেখতে যাবে না?

তপন বলল, ইচ্ছে আছে। ব্যাংককের কাছেই তো।

উঃ, কী লাক তোমার! গভীর বনের মধ্যে বিরাট ধ্বংসাবশেষ নগর। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির। আমি বইয়ে ছবি দেখেছি। প্রায় হাজার বছর আগে হিন্দু—রাজত্ব ছিল ওখানে। আর জানো দাদা, ওদেশের বাটিকের কাজ খুব সুন্দর। ছুটিতে আসার সময়—আমার জন্যে একটা…

বাইরে বেপরোয়া ভাব দেখালেও প্রথমটা ভিতরে ভিতরে বেশ ঘাবড়াচ্ছিল তপন। কলকাতার বাইরে বড় একটা যায়নি সে। দিনে দিনে মনটা তার অস্থির হয়ে ওঠে। ভ্রমণ কাহিনি বা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়তে পড়তে মনে মনে বইয়ের চরিত্রদের পাশে নিজেকে কল্পনা করেছে। ওইসব অজানা দেশে বিচিত্র সব ঘটনার মধ্যে নিজেও যেন জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই কল্পনার জগৎ যে খানিকটা বাস্তবে ফলে যেতে পারে তা কোনো আশা করেনি। এই কলকাতা, এই ভবানীপুরের এত দিনের জীবন ছেড়ে কোথায় যেতে হবে?

মনে সে সাহস আনে। কেন, এই তো সুনীলদা গিয়েছেন? বাবা নাকি পাস করেই বর্মায় গিয়েছিলেন চাকরি নিয়ে। চার বছর ছিলেন। ওঁরা শহরের লোক ছিলেন না। আর সে খাস কলকাতায় মানুষ। কত বেশি জানে—শোনে। তার অত ভয় কী?

ভালো মাইনে। বাড়িতে বেশ কিছু টাকা পাঠানো যাবে। সে কী কম আনন্দের কথা? তাতেই সব কষ্ট সয়ে যাবে।

মাসখানেকের ভিতর গোবিন্দ সিং—এর চিঠি এল। চাকরি মঞ্জুর। তপনের পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি হয়ে গেল। সিং ব্রাদার্সের কলকাতায় বড়বাজারের অফিস থেকে তপনকে দেওয়া হল ব্যাংকক যাবার একখানি প্লেনের টিকিট। যাওয়ার দিনও এসে পড়ল।

মায়ের চোখ ছলছল। বন্ধুরা ঘটা করে একটা বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে ফেলল তপনকে। তারপর সত্যি একদিন তপন রওনা দিল দমদম থেকে ব্যাংককের পথে।

ব্যাংকক। থাইল্যান্ড বা শ্যামদেশের রাজধানী।

তপন এক মাস হল ব্যাংককে এসে কাজে যোগ দিয়েছে।

সিং ব্রাদার্সের মালিক গোবিন্দ সিং—এর বয়স প্রায় ষাট। শক্ত সমর্থ সর্দারজি। বহু দেশে ঘুরেছেন, অনেকগুলো ভাষা জানেন, দিলদরিয়া লোক। তপনের সঙ্গে কথা বলেন ইংরেজি বা হিন্দিতে। মেনাম নদীর কাছে রাজাবংশী রোডে সিং ব্রাদার্সের মস্ত গুদাম। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ায় অগুনতি ছোট—বড় দ্বীপ। অনেক দ্বীপেই নানারকম মশলার গাছ জন্মায়। তাই ইউরোপীয়ানরা এইসব দ্বীপকে বলত স্পাইস—আইল্যান্ডস। সিং ব্রাদার্স এই অঞ্চলের নানা জায়গা থেকে লবঙ্গ, গোলমরিচ, জায়ফল, এলাচ ইত্যাদি আমদানি করে। বড় বড় নৌকো আর লঞ্চে করে নদীপথে ব্যাংককে আনে। সেগুলো জমা হয় গুদামে, তারপর চালান যায় ভারতবর্ষে। আবার ভারত থেকে সিং ব্রাদার্স আনে রেশম ও চা। মালের হিসেব রাখা, নদীর ঘাট থেকে জিনিস ছাড়িয়ে আনা। সব কাজই করতে হয় তপনকে। এসব ব্যাপারে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে মন দিয়ে শেখে, মশলার রকমফের চেনে।

গোবিন্দ সিং থাকেন নিউ রোডে। গুদাম থেকে বেশি দূরে নয়। তপনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে মহারাজ রোডে, গোবিন্দ সিং—এর বাড়ির কাছেই। খায় একটা পাঞ্জাবি হোটেলে—ভাত রুটি সবজি ডাল তরকারি। দইও মেলে।

তপন সপ্তাহে একখানা চিঠি দেয় বাড়িতে। মাকে লেখে—কিছু ভেবো না। দিব্যি আছি। তিলু মিলুকে লেখে ওই দেশের খবর—

ব্যাংকক বিরাট শহর, মেনাম নদীর দু—ধারে ছড়ানো। পুব পাশেই শহর বেশি জমজমাট। নদী থেকে অনেকগুলো খাল বেরিয়ে ঢুকে গেছে শহরের ভিতর। খালগুলোর ওপর দিয়ে অজস্র সাঁকো। থাইরা খালকে বলে কেলাং। বইয়ে পড়েছিস তো, ইটালির ভেনিস শহরে যেমন খাল আছে তেমনি। এই খালগুলোকে রাস্তাও বলা চলে, কারণ তাহই দিয়ে চলে অসংখ্য ছোট ছোট নৌকো, লোজন জিনিসপত্র নিয়ে। নৌকোর ওপর রীতিমতো বাজার বসে। নাম দিয়েছে—ফ্লোটিং মার্কেট। মাসখানেকে এত বড় শহরের কতটুকুই বা দেখেছি।

কলকাতার মতোই এর কোনো অংশে আধুনিক বাড়িঘর হোটেল, চওড়া ঝকঝকে রাস্তা, আবার কোনো কোনো অংশে গলিঘঁজি বস্তি, পুরনো নোংরা ঘুপচি বাড়ি, দোকানপাট। মেনাম নদীতে নৌকো, বজরা, স্টিমার গিজগিজ করে। শ্যাম উপসাগরে পড়েছে মেনাম। বড় জাহাজ মোহনার বেশি ঢুকতে পারে না।

এদেশে বেশিরভাগ লোকই বৌদ্ধ। সাত—আটশো বছর আগে এখানে ভারতীয় হিন্দু সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল। তাই শহরে ছড়িয়ে আছে এই দুই ধর্মের নিদর্শন। পথের ধারে কত যে বৌদ্ধ মন্দির বা ওয়াট। ঢালু ছাদ, ছুঁচালো মাথা, প্যাগোডা চেহারার মন্দিরগুলি। মন্দিরের গায়ে কেবল বুদ্ধমূর্তি—নানান আকার, নানান ছাঁদ দেখে দেখে একঘেয়ে লাগছে।

পথের নাম দেখে ভারি মজা লাগে। মহারাজ রোড, রাম এক, রাম দুই, এমনি সব নাম। আগে এখানকার রাজাদের নাম ছিল নাকি রাম দিয়ে। প্রাচীন রাজধানীর নাম অযোধ্যা। ঘুরতে ফিরতে বিদেশ বলে মনে হয় না।

কত দেশের লোকের বাস। বিদেশিদের মধ্যে চিনারাই সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ লোক বাইরে প্যান্ট—শার্ট পরে। তাছাড়া পাজামা লুঙ্গি কুর্তা এমনকি ধুতি—পরা লোকও দেখেছি। পথেঘাটে ঘঘারে প্রচুর হলুদ আলখাল্লা—পরা পুরুষ। এরা নাকি শ্ৰমণ অর্থাৎ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। শুনেছি প্রত্যেক বৌদ্ধ থাই অন্তত কিছু দিনের জন্য সন্ন্যাস নেয়, শ্রমণ হয়। থাইরা বেশ আমুদে। চিনা প্যাটার্নের চেহারা। জানিস, এ—দেশের টাকার নাম ভাট। প্রায় চল্লিশ পয়সার সমান এক ভাট।

শান্ত ভদ্র তপনকে গোবিন্দ সিং—এর পছন্দ হয়েছে। গোবিন্দ সিং—এর সঙ্গে থাকেন তার। স্ত্রী এবং ছোট ছেলে। ছেলের বয়স বছর পঁচিশ। বাবার ব্যবসা দেখে। বড় ছেলে গেছে। কানাডা, কাগজ তৈরি শিখতে। ফিরে এসে এখানে কাগজের কল বানাবে।

সময় পেলে গোবিন্দ সিং গল্প করেন। তিনি তপনকে কখনো ডাকেন তপনবাব, কখনো শুধু বাবু। বলেন, কত দেশ দেখলাম, কত কী শিখলাম, বড় ছেলে ফিরে এলে আমার ছুটি। আর দু—তিন বছর। তারপর দেশে চলে যাব, লুধিয়ানা। খেত—খামার করব। তখন ইচ্ছে হলে তুমি চলে যেও আমার কলকাতার অফিসে। ওখানে ভালো লোক দরকার।

তিলু মিলুকে লিখল তপন—

কয়েকটা নামকরা বৌদ্ধমন্দির দেখে ফেলেছি। যেমন ওয়াট পো, ওয়াট অরুণ ওয়াট ফ্রা—কিও। ফ্রা—কিওতে আছে বিখ্যাত এমারেল্ড বুদ্ধ। মন্দিরগুলোয় বিষ্ণু, গরুড়, কিন্নর, ড্রাগন ইত্যাদির মূর্তি। বড় বড় মন্দির সোনা আর মণি—মাণিক্যের ছড়াছডি। আর দেখেছি রাজপ্রাসাদ ও মিউজিয়াম। একটা ছুটির দিনে প্রাচীন রাজধানী অযোধ্যা দেখতে যাব। ঘোরার সময় তেমন পাই না। এত রাস্তা, ভয় হয় পথ না হারাই। পকেটে ব্যাংককের একটা ম্যাপ রাখি। হ্যাঁ, মিল ঠিক বলেছিলি, এখানে কাপড়ের ওপর বাটিকের কাজ চমৎকার। থাইরা ঘরে ঘরে বাটিক করে। নিয়ে যাব তোর জন্যে।

এই অযোধ্যা দেখতে গিয়েই এক রবিবার তপনের সঙ্গে আলাপ হল ডক্টর ইন্দ দত্তর, ফলে তার জীবনে আর একটা চমকপ্রদ মোড় ফিরল।

ব্যাংককের উত্তরে অযোধ্যা। সকালে ট্রেনে চড়ে রওনা দিল তপন। ঘণ্টা দুই লাগল পৌঁছতে। মেনাম নদীর ভিতর কয়েকটি দ্বীপ এবং নদীর দুই তীরে ছড়িয়ে আছে এই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ। প্রায় দুশো বছর আগে বর্মীদের আক্রমণে এই নগর ধ্বংস হয়।

তপন ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আরও অনেক টুরিস্ট এসেছিল। একটি লোককে তার বিশেষ ভাবে নজরে পড়ল।

ভদ্রলোক অন্তত ছ—ফুট লম্বা। শক্ত গড়ন, ফর্সা রং, সুশ্রী ধারাল মুখ। জুলপি ও রগের চুলে সামান্য পাক ধরেছে। পরনে ট্রাউজার্স ও ফুলশার্ট, মাথায় সাদা পানামা টুপি।

ভদ্রলোক মোটেই পুরনো মন্দির বা প্রাসাদ দেখছিলেন না। দূরবিন চোখে লাগিয়ে গাছে গাছে পাখি দেখে বেড়াচ্ছিলেন। চারপাশের লোকজন সম্বন্ধে ভ্রূক্ষেপ নেই।

তপনের কৌতূহল হয়। সে ভদ্রলোকের পিছু পিছু ঘুরতে থাকে। এইরকম দূরবিন দিয়ে পাখি দেখার ব্যাপারটায় তার আগ্রহ ছিল। তার এক মামার ছিল এই শখ। উনি আসামে। থাকেন। একবার কলকাতায় এসে তপনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকুরিয়ায় পাখি। দেখতে। ইনিও বোধহয় পক্ষিবিদ।

জায়গাটা নিরালা। ভদ্রলোক চোখ থেকে দূরবিন নামিয়ে ফিরলেন। তপন হাত কুড়ি পিছনে। তপনকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত দেখে তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, বাঙালি?

তপন চমকে থতমত খেয়ে ঘাড় নাড়ল।

বেড়াতে এসেছেন?

না। মানে আমি ব্যাংককে থাকি, জবাব দিল তপন।

ও! কী করেন?

চাকরি।

হুঁ। ঠিক চিনেছি বাঙালি। ভদ্রলোক হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।

কী করে বুঝলেন? খানিকটা চেহারায়, আর খানিকটা কথা শুনে। তখন নিজের মনে বিড়বিড় করছিলেন যে বাংলায়।

আপনিও কি বাঙালি? তপন জিজ্ঞেস করল।

না, তা ঠিক নয়। আমি থাই, বলেই ভদ্রলোক হো—হো করে হেসে উঠলেন।

মানে! তপন ভ্যাবাচ্যাকা খায়।

মানে জন্মসূত্রে বাঙালি বটে কিন্তু এই দেশের নাগরিক, এই দেশেই মানুষ হয়েছি। আমার নাম ইন্দ্র দত্ত।

আমি তপন রায়। কলকাতায় থাকতাম।

পাখির শখ আছে নাকি?

নাঃ, তেমন কিছু নয়। আপনাকে দেখেই বেশি কৌতূহল হচ্ছিল।

কফি চলবে?

ভদ্রলোক কাঁধে ঝোলানো কফির ফ্লাস্ক নামিয়ে ঘাসে বসলেন। তপন বসল পাশে। একটু একটু করে আলাপ জমে উঠল।

ডক্টর ইন্দ্র দত্ত ব্যাংকক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিতত্ত্বের অধ্যাপক। এই দেশেই জন্মেছেন। এদেশেই পড়াশোনা। অবশ্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সেও পড়েছেন কিছুকাল। বাবা বিষ্ণু দত্ত ছিলেন ডাক্তার। কলকাতায় থাকতেন। ভারতের স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ফলে ইংরেজ সরকারের বিষনজরে পড়েন। জেল খাটা এড়াতে তিনি ভারত ছেড়ে পালান। বর্মা ঘরে আসেন শ্যামদেশে। ব্যাংককে বাস করতে থাকেন। ডক্টর ইন্দ্র দত্তর মা ছিলেন কা—প্রবাসী বাঙালি। ভদ্রলোকের বাংলা উচ্চারণ একটু বাঁকা বাঁকা। এদেশে মানুষ হয়েও বাংলা চর্চা করেছেন এই আশ্চর্য।

ইন্দ্র দত্ত দিলখোলা মানুষ। তপনের সব খবর নিলেন। চট করে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন—তোমাকে আবার আপনি বলব কী হে।

কথায় কথায় ডক্টর দত্ত বললেন, আমার বাবা বিদেশে থেকে গেলেও মনেপ্রাণে ছিলেন ভারতীয়। পুরো বাঙালি। বাংলা বই আনতেন, বাংলায় কথা বলতেন ঘরে। বাবার মনে বড় দুঃখ ছিল ভারতবর্ষ পরাধীন। তাই যেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এদেশে এলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন নিয়ে বাবা একেবারে মেতে উঠলেন। কোন্ সাল হবে সেটা? বোধহয় ১৯৪৩। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে। আমিও যোগ দিয়েছিলাম নেতাজির বাল—সেনায়। তখন আমার সাত—আট বছর বয়স।

ভারত স্বাধীন হবার পর বাবা দুবার ওদেশে যান। আমি গেছি সঙ্গে। কলকাতায় আমার কিছু আত্মীয়—স্বজন থাকে। তবে যোগাযোগ তেমন নেই। বড় হয়ে আমি তিনবার ইন্ডিয়ায়। গেছি। সুন্দরবন আর জলদাপাড়া রিজার্ভ—ফরেস্ট দেখে এসেছি। বাংলাটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। আমার স্ত্রীর কল্যাণে ফের চর্চা। ও কলকাতার মেয়ে। কেমব্রিজে পড়তে গেছিল। সেখানেই আমাদের আলাপ, তারপর বিয়ে। চলো আজই তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। মণিকা ভীষণ খুশি হবে দেশের ছেলে দেখলে।

দুপুরে ইন্দ্র দত্তর সঙ্গে ব্যাংককে ফিরল তপন।

ডক্টর ইন্দ্র দত্তর সঙ্গে আলাপ হয়ে তপন বিদেশে একা থাকার দুঃখ অনেকখানি ভলে গেল। ব্যাংককে আরও কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল বটে, তবে এমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি।

ডক্টর দত্তর স্ত্রীও খুব ভালো। ভারি গোপ্লে। ওঁরা থাকেন সাদার্ন রোডে। নিজেদের বাড়ি। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন এলাকা। একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, সামনে টকরো জমিতে ফুলের বাগান। তপন সপ্তাহে দু—তিনবার সাইকেলে চেপে হাজির হতে লাগল ডক্টর দত্তর বাড়ি। ওকে বাড়ির ছেলের মতনই আপন করে নিয়েছিলেন তারা। ডক্টর দত্তর ছেলেঙ্গলে নেহা একটি থাই ছেলেকে দত্তক নিয়েছেন। তার বয়স বছর পাঁচ—ছয়। ফুটফুটে দেন। নাম রেখেছেন রবি।

ডক্টর দত্ত সন্ধের সময় সাধারণত বাড়িতেই থাকতেন। তপনের সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প করতেন—তার নানা দেশের অভিজ্ঞতা, নানান জীবজন্তুর কথা। কত জায়গায় ঘুরেছেন যে ঠিক নেই। জীবজন্তু সম্বন্ধে তপনের আগ্রহ ছিল। ডক্টর দত্তর সঙ্গে আলাপ হয়ে তার নতুন করে চোখ ফোটে। ডক্টর দত্তর কাছ থেকে সে জীবজন্তু ও ভ্রমণ কাহিনির বই নিত পড়তে।

ইন্দ্র দত্তকে প্রথমে তপন ডক্টর দত্ত বলে ডাকত। ওঁর স্ত্রী আপত্তি জানালেন, তা হবে না। আমায় যখন বউদি বলেছ, ওকেও দাদা বলতে হবে।

অতএব ডক্টর দত্তকে তপন দত্তদা বলে ডাকতে শুরু করল।

চার মাস কেটেছে। গোবিন্দ সিং একদিন বললেন, তপনবাবু, আমার এক বন্ধুলোক ব্যাংককে বেড়াতে আসছে। ওর জন্য একটা কিউরিও কিনে এনে দিও। এই আট ডলারের মধ্যে। তোমার পছন্দ ভালো।

রাজাবংশী রোডের গায়ে একটা রাস্তায় অনেকগুলো কিউরিও—শপ দেখেছিল তপন। বিকেলে সেখানে গেল।

সরু গলিতে ছোট্ট দোকান। কাঁচের দরজা। ভিতরে কতরকম জিনিস সাজানো। নীলাভ আলোয় রহস্যময় লাগছে। দোকানদার কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এটা কিউরিও—শপ। অর্থাৎ দুর্লভ জিনিসের দোকান। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল তপন।

কাউন্টারে একটি মুখ আবির্ভূত হল। শুকনো হর্তুকির মতো মুখখানা। অজস্র ভাজ। তর্পনের দিকে চেয়ে হাসল সে। চোখ সরু হয়ে গেল। খুদে খুদে দাঁতের মাঝে একটি সোনা—বাঁধানো দাঁত ঝিলিক দিল।

বৃদ্ধাটিকে মনে হল চিনা রমণী। চুল টান করে ঘাড়ের কাছে গিট দেওয়া। গায়ে নীল রঙের ঢোলা জামা ও পাজামা। একগাল হেসে সে দোকানের শো—কেসের দিকে আঙল। দেখিয়ে বলল—সী।

তপন এ ধরনের দোকানে কখনো ঢোকেনি আগে। কত অদ্ভুত অদ্ভুত যে জিনিস, কতরকম মূর্তি, ছুরি, পাত্র, ছবি।

হঠাৎ একটা শো—কেসের ওপর তার চোখ আটকে গেল। সেখানে কয়েকটা পাখি সাজানো রয়েছে। জ্যান্ত নয়, স্টাফ করা। যেমন মিউজিয়ামে থাকে। তপন শুনেছে, গোটা পাখির পালকসুন্ধু চামড়ার মধ্যে কাঠের গুঁড়ো পুরে সেলাই করে দেওয়া হয়। দেখতে মনে হয় স্বাভাবিক পাখি। স্থির অবস্থায় বসা বা দাঁড়ানো।

শো—কেসের ওপর রয়েছে একটা বাজপাখি, একটা মস্ত কালো কাকাতুয়া, আর একটা অদ্ভুত দেখতে পাখি। কোনো পাখির পালকের এমন বাহার তপন কখনো দেখেনি, কল্পনাও করেনি। একখণ্ড কাঠের ওপর স্ট্যান্ড দিয়ে আটকে দাঁড় করানো রয়েছে পাখিটা। উঃ কী রং! গাঢ় লাল, কমলা, নীল, সবুজ, সাদা, কালো—রেশমের মতো নরম চকচকে পালকে আলো ঠিকরোচ্ছে। লাল আর নীল রঙের পালকই বেশি।

পাখিটা ছোট। সাত—আট ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়। খাটো ল্যাজ। সবচাইতে সুন্দর হচ্ছে তার ল্যাজ থেকে বেরনো দুটি লম্বা পালক। ঠিক যেন দুটি সরু লোহার তার লম্বা হয়ে ডগায় গিয়ে পাকিয়ে গেছে। আর তারের ডগায় সবুজ পালকের গুচ্ছ। ছোট মাথাটি উঁচু করা, ডানা ছড়ানো, যেন এখুনি উড়বে। চোখের মণির জায়গায় দুটি টুকটুকে লাল পুঁতি বসানো। বাঃ! ওই পাখি যখন উড়ে বেড়াত! তপন কল্পনা করে। ঠিক একটুকরো রামধনু যদি উড়ে বেড়ায় তেমনি দেখতে লাগত নিশ্চয়ই।

সেয়ানা দোকানি তপনের দৃষ্টি অনুসরণ করে অমনি পাখিটাকে নামিয়ে এনে সামনে রেখে বলল, বুরং রাজা।

তপন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তখন দোকানি বদ্ধা আধো আধো ইংরেজিতে বলল, প্যারাদাইজ বার্ড।

ও, এই হচ্ছে বার্ড অফ প্যারাডাইস! এ পাখির কথা পড়েছিল তপন। শুধু নিউগিনি অস্ট্রেলিয়ায় নাকি এই পাখি মেলে। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পাখি। এ পাখিটায় কিন্তু বেশ খুত আছে। দূর থেকে বোঝা যায় না এমনভাবে রেখেছিল। পাখির একটা ডানার পালন প্রায় উঠে গেছে, আর একটি পায়ের আধখানা কাটা।

হঠাৎ তপনের মাথায় এল এটা দত্তদাকে প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়? ওর বাড়িতে এমনি স্টাফ করা একটা কাঠঠোকরা পাখি আছে। এটা পেলে উনি খুশি হবেন নিশ্চয়। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে দরদস্তুর শুরু হল।

কত দাম?

বুড়ি মাথা নেড়ে, দাঁতের ঝিলিক দেখিয়ে দু—হাতের দশ দশ আঙুল ছড়িয়ে জানান— টুয়েন্টি ডলার।

বাপরে থাক, অত পয়সা নেই। তাছাড়া অনেক খুঁত রয়েছে।

অমনি দাম নেমে এল—ফিফটিন।

নাঃ।

কত দেবে?

টেন।

থার্টিন।

নো নো টেন। তপন মাথা নাড়ল।

বুড়ি মিটিমিটি করে দেখল খানিক। বুঝল তপন আর উঠবে না কিছুতেই। সে একটু হতাশভাবে বলল, অলরাইট, তে।

তপন হিসেব করে দাম দিল ভাট—এ।

দোকানি বুড়ি স্ট্যান্ড থেকে পাখিটা খুলে তার পাখা মুড়ে ছোট্ট করে ফেলল। তারপর প্লাস্টিকের থলিতে পুরে বেঁধে দিল। স্ট্যান্ডটা আলাদা দিল। আবার ইচ্ছেমতো এটাকে সাজিয়ে রাখা যাবে।

গোবিন্দ সিং—এর বন্ধুর জন্য তপন নিল একটা কাগজ—কাটার ছুরি—পিতলের হাতলে রঙচঙে পাথর বসানো।