» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

ভূমিকা

কোনো বাঙালি ছেলের পক্ষে আফ্রিকা যাওয়াই একটা বিরাট অ্যাডভেঞ্চার। তার ওপরে সেখানে গিয়ে যদি তাকে সব লোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! ডার-এস-সালাম পৌঁছনোর কিছুদিন পর থেকেই আমার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে সেগুলোর কথা ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়। অথচ যখন ঘটেছিল তখন সেগুলো ছিল বিস্ময় ও বিভীষিকা মেশানো এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার। কত কথাই না মনে পড়ছে আজ!…মামাবাবুর সেই আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মুহূর্তটা; ঢ্যাঙা উইচ ডক্টর কামাউ, টোটো, ডক্টর হাইনে, অল্পক্ষণের জন্য দেখা ডেয়ারিং বিল! আর মনে পড়ছে রুফিজি নদীর মোহনার সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড়, যে ঝড় না হলে আমার কাহিনী একেবারে অন্য চেহারা নিত; কিংবা সে-কাহিনী হয়তো লেখাই হতো না।

আফ্রিকা যাবার ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছিল সেটা অবিশ্যি তেমন চমকপ্রদ কিছু নয়। এর জন্য দায়ী আমার বন্ধু সুনন্দ। ঘটনাটা ঘটল সেপ্টেম্বর মাসে আমার শোবার ঘরে। তখন রাত এগারোটা। আমি বিছানায় শুয়ে বেশ জমিয়ে একটা ডিটেকটিভ বই পড়ছি, এমন সময় সুনন্দর আবির্ভাব। সময়টা বেয়াড়া, তবে সুনন্দর পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক নয়। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সে প্রশ্ন করল, ‘কীরে অসিত—আফ্রিকা যাবি?’

‘কোথায়?’

‘ইস্ট আফ্রিকা। টাঙ্গানিকা।’

‘রাতদুপুরে এসে রসিকতা! কেটে পড়।’

‘বইটা বন্ধ কর। রসিকতা নয়। সিরিয়াসলি বলছি। সম্প্রতি মামাবাবুর বন্ধু জার্মান বৈজ্ঞানিক ডক্টর হাইনে ডার-এস-সালাম-এর মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়েছেন। তিনি মামাবাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিছুদিনের জন্য তাঁর অতিথি হতে। ডক্টর হাইনে আফ্রিকার প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণী ও উদ্ভিদের অনুসন্ধান করছেন। সে-কাজে তিনি মামাবাবুর সাহায্য চান।’

আমি হাত থেকে বই রেখে উঠে বসলাম।

‘কিন্তু যাতায়াতে অনেক টাকার ধাক্কা।’

‘তারও একটা সুরাহা হাইনে করেছেন। তিনি ব্যবস্থা করেছেন যে ডক্টর ঘোষ—মানে মামাবাবু আফ্রিকায় গিয়ে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্রে বক্তৃতা করবেন। তাতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। হিসেব করে দেখেছি ওতে আমাদের তিনজনের এক পিঠের ভাড়া কুলিয়ে যাবে। সুতরাং তোর খরচ হচ্ছে সিঙ্গল ফেয়ার, ডবল জার্নি। আর থাকা-খাওয়া ফ্রি, কারণ ওখানে তুই হবি মামাবাবুর অর্থাৎ হাইনের গেস্ট।’

প্রস্তাবটি অতি লোভনীয় সন্দেহ নেই। মামাবাবু অর্থাৎ বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী প্রোফেসর নবগোপাল ঘোষ এবং তাঁর ভাগনে আমার বাল্যবন্ধু সুনন্দর সঙ্গে আমি দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। মনে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম, কিন্তু বাইরে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে একটু ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘আচ্ছা, ভেবে দেখি।’

পরদিন সকালে বাড়িতে ঘোষণা করলাম, ‘এবার পুজোয় আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আফ্রিকা। সুনন্দের সঙ্গে।’

তারপর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সুনন্দর নম্বরটা ডায়াল করলাম।