অজেয় রায়
বাস্তেন দ্বীপে অভিযান
এক
সুনন্দ হঠাৎ খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, দাঁড়া। সামনে একটা ছিনতাই কেল মনে হচ্ছে। দেখি ব্যাপারটা? দুজনে স্তব্ধ হয়ে যাই। একটু সরে গেলাম পাশে গাছের ছায়ার আড়ালে। চুপচাপ দেখতে থাকি।
কলকাতা শহর। রাত দশটা বাজে প্রায়। আমি আর বন্ধু সুনন্দ গিয়েছিলাম গঙ্গার ধারে বেড়াতে বেড়াতে এবং আড্ডা মারতে। ওখানে আরও কয়েকজন বন্ধু প্রায়ই জমা হই সন্ধে থেকে।
হেঁটে ফিরছিলাম রাজভবনের গা ঘেঁষে। এসপ্ল্যানেড় অবধি হেঁটে গিয়ে বাস ধরব। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। গরম কমেছে কলকাতায়। তবে শীত পড়েনি তেমন। ভালোই লাগছিল হাঁটতে। ফুটপাতে তখন পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। হু হু করে মাঝে মাঝে। রাজভবনের পাঁচিলের ধারে ধারে গাছগুলোর লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে ফুটপাতে। এক ফালি চাঁদ আবছা আলো ছড়াচ্ছে আকাশে। স্ট্রিট লাইটগুলো অবশ্য জ্বলছে। আলো—আঁধারি মিশেল বেশ রহস্যময় পরিবেশ।
আমাদের আগে ষাট—সত্তর ফুট দূরে একটি লোকও এগোচ্ছিল ওই ফুটপাত ধরে। গঙ্গার কাছ থেকেই সে আমাদের সামনে সামনে যাচ্ছিল। বেঁটেখাটো প্যান্টসার্ট পরা মানুষটি ধীরে সুস্থে হাঁটছিল আমাদের মতোই। দেখলাম, হঠাৎ যেন অন্ধকার যুঁড়ে দুটো লোক সামনে খাটো লোকটির পথ আগলে দাঁড়াল। মনে হয় পাচিলের ধারে লোক দুটো গাছের ছায়ায় মিশে ঘাপটি মেরে ছিল শিকারের আশায়।
দুটো লোকের একজন বেঁটে মানুষটিকে মুঠো পাকিয়ে নিচু স্বরে বলছে কিছু। তার ভাবভঙ্গি সুবিধের নয়। দ্বিতীয় জন পাশের দিকে সরে গেল। দেখলাম যে পথ আগলানো আগন্তুক বেঁটে মানুষটির প্যান্টের পকেটে স্রেফ হাত ঢুকিয়ে দিল। হয়তো মানিব্যাগের আশায়।
পথচারী বেঁটে মানুষটি এতক্ষণ কিছু বলছিল মৃদুস্বরে আর কেবলই ঘাড় নাড়ছিল। এবার সে তড়িৎগতিতে হাত চালাল। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনের লোকটি উলটে পড়ল ফুটপাতে। কিন্তু পাশে থাকা দ্বিতীয়জন কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করল বেঁটে পথচারীটিকে। লোকটি বসে পড়ে মাথা চেপে। ভূপতিত ছিনতাইকারী এই সুযোগে উঠে দাঁড়িয়েছে।
সুনন্দ বলল, ছোট। আটকাতে হবে।
সুনন্দ দৌড়ল। পিছু পিছু আমি।
যে লোকটা মেরেছিল সে ঝুঁকে তার শিকারের পকেট হাতড়াচ্ছে। দ্বিতীয় ছিনতাইকারীও কাছে এসে দেখছে। আমাদের পায়ের শব্দে লোক দুটো ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে না দেখতেই সুনন্দ ঝুঁকে পড়ার পশ্চাদদেশে কষাল ভারী জুতোর প্রচণ্ড এক লাথি। লোকটা ছিটকে উলটে পড়ল ফুটপাতে। আমি দ্বিতীয় ছিনতাইকারীর মুখে মারলাম এক মোক্ষম ঘুষি। আক শব্দ করে সে মুখ চেপে টলমলিয়ে পিছিয়ে গেল।
সুনন্দর লাথি খাওয়া লোকটা কিঞ্চিৎ সামলে উঠে দাঁড়াচ্ছে, দেখি তার হাতে একখানা ছুরি। চকচক করে ওঠে স্ট্রিট লাইটের আলোয় ছুরির সরু লম্বা ফলা। কিন্তু সুনন্দ তাকে আক্রমণের সুযোগই দেয় না। ফের এক লাথি কষায় লোকটার ছুরি ধরা হাতে কনইয়ের কাছে। ছুরি খসে পড়ে হাত থেকে। ব্যথায় কাতরে ওঠে লোকটা। তারপর ঘুরে মারল। টেনে দৌড়। তার ছিনতাইয়ের সাধ উবে গেছে। দ্বিতীয় লোকটাও প্রাণপণে অনুসরণ করল সঙ্গীকে। দুজনে রাস্তা পেরিয়ে মিলিয়ে গেল ময়দানের অন্ধকারে।
সুনন্দ ছুরিটা কুড়িয়ে নেয়। ফলাটা আট ইঞ্চি হবে। দারুণ ধার। ইস, লাভের বদলে ব্যাটাদের লোকসানই হয়ে গেল। আমরা এবার সেই বেঁটে মানুষটির দিকে নজর দিই।
লোকটি তখনো ফুটপাতে বসে। হতভম্ভ দৃষ্টি। এক হাতে চেপে আছে নিজের মাথার এক পাশ। লোকটিকে তুলে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় পরীক্ষা করি। নাঃ রক্ত গড়াচ্ছে না। তবে লেগেছে খুব। ওর যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখেই মালুম হচ্ছে। লোকটির মাথায় পরা কাউন্টি—ক্যাপ জাতীয় মোটা কাপড়ের টুপি তার মাথাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এযাত্রা।
পথচারীকে দেখে আমরা অবাক। লোকটি বাঙালি নয়। মনে হল ভারতীয়ই নয়। মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ। চিনা, বর্মী বা মালয়িদের মতন দেখতে। গড়ন ছোটখাটো হলেও মজবুত। লোকটি খানিক সামলিয়ে বলল, থাঙ্কু মিস্তার। ইউ ছেভ মি। ওঃ। সে নিজের মাথায় হাত বোলায় টুপিটা খুলে।
আমরা দেখলাম, কাটেনি বটে কিন্তু মাথার এক জায়গায় বেশ ফুলে উঠেছে।
কয়েকজন পথচারী ইতিমধ্যে জুটে গেছে চারপাশে। প্রশ্ন হয়—
—কী হয়েছে দাদা?
—কেসটা কী?
—ছিনতাই করছিল। জবাব দেয় সুনন্দ।
—নিয়েছে কিছু?
—মেরেছে বুঝি? লোকটা তো মনে হচ্ছে চিনেম্যান।
—হুঁ বিদেশি। তাই মনে হচ্ছে। জানাই আমি।—তবে নিতে পারেনি কিছু। আমরা কয়েক ঘা লাগাতেই পালাল লোক দুটো। আমরা একটু দূরে পিছনে ছিলাম ভাগ্যিস। তবে মেরেছে মাথায়। দেখি জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবে? পরিচয় কী? কিছু একটা ব্যবসা তো। করতে হবে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো বটেই। থানায় নিয়ে যান। ডায়ারি করে দিন। পুলিশই যা করবার করবে।
—সঙ্গে টাকাকড়ি বেশ আছে বোধহয়। তাই ফলো করছিল। এই লোকগুলোও সুবিধের হয় না। থানায় জমা করে দিন।
অন্য পথচারী কেউ কিন্তু ওই লোকটিকে থানায় নিয়ে যেতে সাহায্য করতে এগোল না। তারা সুটসাট কেটে পড়ল উপদেশ ঝেড়ে। ফের আমরা তিনজন। চারপাশ মোটামুটি ফাঁকা।
আক্রান্ত লোকটি এতক্ষণ চুপচাপ অন্যদের কথা শুনছিল। বোধহয় বুঝতে পারছিল। বাকিরা চলে যেতে সে মাথা নেড়ে বলল, নো পুলিশ। নো পুলিশ।
কে জানে, পুলিশে ছুঁলে আঠারো—ঘা আপ্তবাক্যটি এর জানা আছে হয়তো। যাহোক সুনন্দ তাকে ইংরেজিতে আশ্বাস দেয়, ঠিক আছে, পুলিশে রিপোর্ট করা দরকার নেই। তবে তোমার মাথায় লেগেছে রেশ। ফাস্ট—এড দেওয়া উচিত। হাঁটতে পারবে খানিকটা?
লোকটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ধীরে ধীরে হেঁটে এসপ্ল্যানেডের দিকে যেতে যেতে আমরা লোকটির পরিচয় জানার চেষ্টা করি। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করি, তুমি কয়রা কী? মানে প্রফেশন?
উত্তর হয়, সেলার।
জাহাজের নাবিক! বাঃ।
—দেশ কোথায়? ইন্ডিয়ান?
—নো। ইন্দোনেশিয়ান।
আমি ও সুনন্দ চোখাচোখি করি। দারুণ ইন্টারেস্টিং লোক। সুনন্দ আমায় ফিসফিসিয়ে বলে বাংলায়, লোকটাকে সহজে ছাড়ছি না। ওর গল্প শুনতে হবে।
বটেই তো। আমারও তাই হচ্ছে। সাত—সমুদ্রে ঘোরা জাহাজের নাবিকদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার হয় বিচিত্র। আমরা ডাঙার মানুষরা তার কতটুকু জানি বা দেখেছি। সব বিদ্যে বই পড়ে ঠিক জানা যায় না। এসব মানুষ তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লেখেও কদাচিৎ। তবে আগ্রহ দেখালে বলে শুনেছি।
লোকটি দেখলাম ইংরেজিটা মোটামুটি বলতে ও বুঝতে পারে। কিছু বাংলা হিন্দিও জানে। তবে তেমন সড়গড় নয় কথায়, বোঝে বেশ। আরও নিশ্চয় অনেক ভাষাই কিছুটা জানে। যারা বন্দরে বন্দরে ঘোরে, তারা নানান দেশের ভাষা কাজ চালানোর মতো শিখে ফ্যালে। ইংরেজিতে চিনাদের মতো ট উচ্চারণটা করে ত এবং কিঞ্চিৎ আধো আধো সরে উচ্চারণ। জানলাম যে লোকটির নাম মিকি। মিকি হরতানো। থাকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায়। বছর কুড়ি জাহাজে কাজ করছে। ওদের গ্রামের অনেকেই জাহাজি নাবিক। মিকি ধর্মে বৌদ্ধ। মিকি মালবাহী জাহাজের কাজ করে। ভারতবর্ষের নানা বন্দরে এবং কলকাতা বন্দরে কয়েকবার এসেছে আগে। ঘুরেছে কলকাতায়। কলকাতার পথঘাট চেনে কিছুটা। ওর জাহাজ খিদিরপুর ডকে ভিড়ে আছে। মাল খালাস চলছে। দিন তিনেক বাদে ফের গান করবে। ছেড়ে যাবে কলকাতা। কয়েকদিন মিকি কলকাতাতেই রয়েছে জাহাজি মাল্লাদের এক আস্তানায়। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে আস্তানাটা। ওখানে অনেক চেনা জানা মাল্লা জোটে। আড্ডা হয়। আজ গিয়েছিল জাহাজি অফিসে একজন এদেশি লোকের সঙ্গে দেখা করতে। গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেল। হেঁটেই ফিরছিল ওয়েলিংটনে। রাস্তা চেনে। হাঁটতে তার খুব ভালো লাগে। জাহাজে তো বন্দি জীবন। কোনো বন্দরে নামলেই তার শখ শহরটা হেঁটে দেখে বেড়ানো। আজকের মতো উটকো ঝামেলায় আগে পড়েনি কলকাতায়। তবে অন্য দেশে পড়েছে কয়েকবার। ভাগ্যিস আজ তার পার্সটা খ— না। অনেক টাকা ছিল। আমাদের সে অনেক ধন্যবাদ জানাল এযাত্রা সেভ করার জন্য। দেশে মিকির পরিবার থাকে। স্ত্রী এবং সাত ও পাঁচ বছরের দুটি ছেলে।
কথা বলতে বলতে এসপ্ল্যানেডে হাজির হলাম। একটা দোকান থেকে বরফ নিয়ে মিকির মাথায় আঘাতের জায়গায় লাগানো হল। বরফ লাগাতে ব্যথা কিছু কমল।
এরপর সুনন্দ অনুরোধ করল মিকিকে, আজ তোমার জাহাজি আস্তানায় না গেলে। বরং চলো আমাদের বাড়িতে রাতটা কাটাবে। তোমার গল্প শুনব। কত দেশে ঘুরেছ। নিশ্চয় কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে।
মিকি ইতস্তত করছে দেখে সুনন্দ জোর দেয়, আমাদের কোনো অসুবিধে নেই। আমাদের বাড়িতে থাকি শুধু আমি আর আমার এক মামা। তিনি সায়ান্টিস্ট প্রফেসর হলেও মাই ডিয়ার মানুষ। তোমার সঙ্গে আলাপ হলে খুশি হবেন। বাড়িতে শোবার জায়গা যথেষ্ট। কী খাবে বলো রাতে। দোকান থেকে কিনে নিয়ে যাই। যা যা তোমার পছন্দ।
—অলরাইত। মিকি রাজি হয়ে যায়।
সুনন্দ বলে, বুঝলে মিকি, শহুরে লোকের সঙ্গে তো একঘেয়ে দিন কাটাই। তোমার মতো ইন্টারেস্টিং লোকের দেখা পাই খুব কম। তুমি গেলে আমাদের সৌভাগ্য। জানো আমরা খুব বেড়াতে ভালোবাসি। অনেক বেড়িয়েছি দেশে বিদেশে। দুর্গম অঞ্চলে। অচেনা দেশ, সমুদ্র, প্রাণী, গাছপালা আমাদের ভীষণ টানে। তাই তোমায় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
সুনন্দ আমায় বলল, আজ রাতে তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দে।
আমি তো তক্ষুনি রাজি।
এই ঘটনার ফলেই মিকির সঙ্গে সুনন্দর মামাবাবু প্রফেসর প্রাণিবিজ্ঞানী নবগোপাল ঘোষের যোগাযোগ হয়। আর তার ফলেই আমাদের এক নতুন রোমাঞ্চকর অভিযান ও অ্যাডভেঞ্চারের সূত্রপাত। এখন আমাদের নিজেদের পরিচয়টা কিছু জানিয়ে রাখি।
আমি—অসিত রায়। সুনন্দ মানে সুনন্দ বোস আমার বাল্যবন্ধু। সুনন্দর মামাবাবু শুধু প্রাণিবিজ্ঞানী নয়, জ্ঞান—বিজ্ঞানের নানা শাখায় তার প্রবল আগ্রহ। সুনন্দও প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র। এম. এস. সি পাস করে এখন রিসার্চ করছে। আপাতত সে কিছু দিন রয়েছে নবগোপালবাবুর বাড়িতে। তার রিসার্চের কাজে মামাবাবুর সাহায্য নিতে।
নবগোপাল ঘোষ বিয়ে থা করেননি। একা থাকেন। সুনন্দকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন। সুনন্দর বন্ধু হিসেবে ছোট থেকেই আমি তাকে চিনি।
আপাতগম্ভীর দর্শন, মাঝারি স্বাস্থ্য, মাঝারি হাইট, মামাবাবুকে দেখলে আর পাঁচটা সাধারণ ছাপোষা বাঙালি গেরস্থ অধ্যাপকের থেকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু ওই মানুষটি প্রচণ্ড অ্যাডভেঞ্চার—প্রিয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেশায় কত দুর্গম অঞ্চলে যে পাড়ি দিয়েছেন। অনেক সময় সুনন্দ এবং কখনো কখনো আমিও তার সঙ্গী হয়েছি।
আমার বিষয় অবশ্য ইতিহাস। এম. এ. পাস করে গবেষণা করছি। তবে সুনন্দ ও মামাবাবর সঙ্গ পেয়ে বিজ্ঞানেও যথেষ্ট আগ্রহ জন্মেছে। নতুন দেশ দেখার সুযোগ পেলে আমিও ছাড়ি না।
মিকিকে নিয়ে গেলাম মামাবাবুর কাছে, ভবানীপুর অঞ্চলে মামাবাবুর বাড়িতে। মামাবাবু মিকির পরিচয় জেনে খুব খুশি হলেন।
রাতে খাবার আগে ও পরে জমিয়ে গল্প হল। প্রধানত এশিয়া মহাদেশের বন্দরগুলিতেই মিকির যাতায়াত। বন্দরে বন্দরে তার কত আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কাহিনি। কত অজানা দ্বীপ। সে দেখেছে। কত অজানা প্রাণী ও মানুষ। গাছপালা। কত বিপদে যে পড়েছে। প্রথমে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট থাকলেও পরে দেখলাম মিকি দিব্যি হাসিখুশি মানুষ। তার গল্প বলার ঢংও চমৎকার।
ভালো ভালো খাবার একপেট খেয়ে মিকি মহাখুশি। জানাল যে অনেক দিন বাদে এমন খাসা ভোজ জুটল তার কপালে। জাহাজের খাদ্য তো বেজায় নীরস। কলকাতায় তার আস্তানার খাবার অতি বাজে। হোটেল রেস্তরাঁয় বেশি খরচ করে ভালো খাওয়া তার সাধ্যের বাইরে। মাইনে তো বেশি নয়। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়।
পরদিন ভোরে উঠেছে মিকি। চা জলখাবার খেয়েছে। খানিক বাদে বিদায় নেবে। মামাবাবু তখন তার বাড়ির বাগানে গাছপালার তদারকি করছেন। মিকি বাগানে গিয়ে দাঁড়ায়। আমরাও সঙ্গ ধরি।
ইদানীং মামাবাবুর এক নতুন শখ হয়েছে বাগান করা। মামাবাবুর বাড়ির পিছনে কাঠা দুই বাগান করার মতন জমি আছে। সেখানেই তার উদ্যানচর্চা। একটা ছোট গ্রিনহাউসও বানিয়েছেন।
প্রথামতো চেনা ফুল—ফলের গাছ করায় মামাবাবুর উৎসাহ নেই। নানান বিচিত্র গাছ। লাগাচ্ছেন। নিজের ফর্মুলা অনুযায়ী তাদের সার দিচ্ছেন, যত্ন করছেন। ফলাফলের নোট রাখছেন। অর্থাৎ ওই গাছপালা নিয়ে গবেষণা চলছে। হয়তো সেটাই আসল উদ্দেশ্য।
আমরা তার বাগান নিয়ে কিছু মন্তব্য করলে মোটেই আমল দেন না। নিজের তালেই। আছেন।
মিকি ঘুরে ঘুরে বাগান দেখতে দেখতে কয়েকটি গাছের সামনে এসে বলল, এই গাছ দেখেছি একটা দ্বীপে। প্রচুর। তবে সাইজে ঢের বড় বড়। আর পাতার ঝাড় অনেক বেশি।
—এগুলো কী গাছ জানো? প্রশ্ন করেন মামাবাবু।
—না। মিকি মাথা নাড়ে।
—এগুলো পোস্ত গাছ। পপি প্ল্যান্ট। যা থেকে আফিং হয়। ওপিয়াম।
—ইজ ইত? মিকি বেশ আগ্রহ দেখায়, আপনি ওপিয়াম তৈরি করেন নাকি?
—না বাবা। মামাবাবু হাসেন, তাহলে পুলিশে ধরবে। কয়েকটা মাত্র গাছ করেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে।
—আফিং হয় কী ভাবে? প্রশ্ন মিকির।
—এর ফলের গা চিরে দিলে রস বেরায়। তাই শুকিয়ে আফিং হয়। আর ক্ষমত ভিতরের বিচি হল পোস্ত। বাঙালিদের প্রিয় খাদ্য। আচ্ছা তুমি কোন দ্বীপে এ গাছ প্রচুর দেখেছিলে বড় বড়? দ্বীপের লোক চাষ করে বুঝি?
—ও দ্বীপে লোকই থাকে না কেউ। শুধু বাস্তেন সাহেব ছিল। সেই বোধহয় লাগিয়েছিল।
—দ্বীপটা কোথায়?
—জাভা সি—তে। ছোট্ট দ্বীপ। বনজঙ্গলে ভরা।
—তুমি ওখানে গিছলে কেন?
—গিয়েছিলাম বাধ্য হয়ে, প্রাণ বাঁচাতে। সাধ করে কি ও দ্বীপে যায় কেউ?
—কী রকম? আমরা সবাই কৌতূহলী।
—তাহলে একটা লম্বা গল্প ফাঁদতে হয়, জানায় মিকি। বোঝা গেল যে গল্পটা বলতে তার অনিচ্ছা নেই, তবে আমরা শুনব কিনা বুঝতে পারছে না।
—বলো বলো কী হয়েছিল? আমরা তাড়া লাগাই। বাগানের বেঞ্চিতে আর বেদিতে বসি সবাই।
মিকি বলতে শুরু করে, সে প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা। আমাদের জাহাজ ফিলিপিনস সেলিবিস লম্বক মাদুরা হয়ে যাচ্ছিল জাকার্তায়। মাদুরা ছেড়ে যাবার কিছু পরেই হঠাৎ উঠল। ঝড়। প্রচণ্ড ঝড়। তখন শীতকাল। তখন ওখানে ঝড় কমই হয়। তবে বৃষ্টি হয় প্রায়ই। ঝড়ের দাপটে ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা লেগে আমাদের জাহাজের তলা ফুটো হয়ে ডুবতে লাগল। সবাই প্রাণ বাঁচাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল কাছাকাছি কোনো দ্বীপে আশ্রয় নেবার আশায়। একটা লাইফ—বেল্ট জোগাড় করে আমিও ঝাপালাম জলে। ওখানে ছোট বড় প্রচুর দ্বীপ। স্রোত আর বাতাসের টানে ভাসতে ভাসতে প্রথমে উঠলাম এক ছোট্ট ন্যাড়া দ্বীপে। সেখানে মানুষজনের বাস তো নেই—ই। গাছপালাও খুব কম। শুধু অজস্র সামুদ্রিক পাখির আস্তানা। পাখির ডিম খেয়ে কোনোমতে সেখানে দুটো দিন কাটালাম। জোর বৃষ্টি পড়ছে থেকে থেকে। কোনোরকমে পাথরের খাঁজের তলায় মাথা গুঁজে রইলাম। বুঝলাম যে এখানে থাকলে স্রেফ না খেয়ে বা ভিজে অসুখ করে মরব। মাইল দুই দূরে আর একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল, একটু যেন বড়। লাইফবেল্ট আঁকড়ে ফের জলে নামলাম। সাঁতরে হাজির হলাম ওই দ্বীপে। ওই দ্বীপেই দেখেছিলাম ওপিয়াম গাছের ঝাড়।
—সে দ্বীপে মানুষ ছিল না?
—না। ছোট্ট দ্বীপ। তবে দ্বীপে গাছপালা প্রচুর। ঝরনা রয়েছে একটা। কয়েকটা ছোট পুকুর। বড় উঁচুনিচু। সমতল জায়গা কম। মাঝখানে এক ছোট পাহাড়। গুহাও রয়েছে কয়েকটা। ঘরে দেখে আমি অবাক। কত রকম যে গাছপালা দ্বীপটায়। দেশি বিদেশি। এমন দ্বীপ জন্মে দেখিনি। রীতিমতো গা ছমছম করতে লাগল। রবার গাছ, তাল আনারস আম জাম কাঁঠাল ডুরিয়ান কফি চা পেয়ারা বাঁশ কলা তেঁতুল, আরও কত কী! কত রকম যে ফুল ফুটেছে। অনেক ফুল চোখেই দেখিনি আগে। সেখানেই এই ওপিয়াম গাছ। দেখেছিলাম।
—পাহাড়ের গায়ে একটু সমতল জায়গায় একটা ভাঙাচোরা কাঠের বাড়ি দেখলাম। কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি। বেশ বড়ই ছিল একসময়। বুঝলাম, মানুষের বাস ছিল সেখানে। কিন্তু তখন জনমনিয্যি নেই।
—তবে খাবার সমস্যাটা মিটল। খাবার মতো প্রচুর ফল গাছে গাছে। মুরগি আর ছাগল চরছে। বুনো। সামুদ্রিক পাখি আর তাদের ডিমও পাওয়া গেল প্রচুর। বড় একটা ডোবায় সাঁতার কাটছে পাতি হাঁস। ওই ডোবার পাশেই দেখি মস্ত মস্ত ওপিয়াম গাছের ঝাড়।
আমার সঙ্গে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা ছিল। ওয়াটারপ্রুফ কেসের মধ্যে রাখা লাইটার। একটা গুহা খুঁজে আশ্রয় নিলাম। আগুন জ্বালালাম। ফল ও ঝলসানো মাংস খেয়ে কাটাতে লাগলাম। নজর রাখছি কোনো নৌকো বা জাহাজের দেখা যদি পাই। চারদিন বাদে দেখি দুটো বড় বড় নৌকো যাচ্ছে দ্বীপের কাছ দিয়ে। কাপড় নাড়িয়ে নানান ইঙ্গিতে ডাকলাম তাদের। ওরা সিঙ্গাপুর যাচ্ছিল। আমার তুলে নিল। নামিয়ে দিল জাকার্তায়। বেঁচে গেলাম সেযাত্রা।
—ওই দ্বীপটা সম্বন্ধে খোঁজখবর করেছিলে? প্রশ্ন করেন মামাবাবু।
—করেছিলাম বইকি। ওখানকার লোক ওই দ্বীপটাকে বলে—বাস্তেন সাহেবের দ্বীপ। বাস্তেন আইল্যান্ড। ফন বাস্তেন নামে এক ডাচ ওই দ্বীপটায় ছিল অনেক বছর। প্রায় পনেরো বছর। বাস্তেনই নাকি দ্বীপে অত গাছপালা লাগিয়েছিল। তার আগে দ্বীপটায় তেমন গাছপালা ছিল না। তবে নারকেল গাছ ছিল। আর বুনো ঝোঁপঝাড়।
—বাস্তেন সাহেব ওখানে কী করত? মামাবাবু জানতে চান।
—অদ্ভুত লোক ছিল নাকি বাস্তেন। খেয়ালি প্রকৃতির। ওখানকার লোকদের মুখে যা শুনেছি। যৌবনে এসেছিল ইন্দোনেশিয়ায়। রবার বাগানে ম্যানেজারি করতে। চার—পাঁচ বছর ছিল আন্দালুস আর জাভায়। এই সময় দ্বিতীয় ওয়ার্ল্ড—ওয়ার বাধল। বাস্তেন কালিমাস্তান মানে বোর্নিও গিয়েছিল কাজে। স্টিমারে জাকার্তায় ফিরতে ফিরতে খবর পায় যে জাপানিরা জাভা অধিকার করে নিয়েছে। সাউথ—ইস্ট এশিয়া আক্রমণ করেছে জাপানিরা। হুড়হুড় করে এগোচ্ছে তাদের ফোর্স। জাপদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে বাস্তেন আর জাকার্তায় ফেরে না। জাভা সি—তে ওই একরত্তি জনমানবহীন দ্বীপে নেমে যায়। সেখানে লুকিয়ে থাকে মাসখানেক। এরপর দেশি জেলেদের নৌকায় চেপে ছদ্মবেশে হাজির হয় আন্দালাসের তীরে। তারপর স্রেফ জঙ্গলে গিয়ে লুকোয়। গভীর অরণ্যে।
—আন্দালাস কোথায়? সুনন্দ প্রশ্ন করে।
ইতিহাসের ছাত্র আমি পাণ্ডিত্য ফলাবার সুযোগ হারাই না।
গম্ভীরভাবে জানাই, আমরা যাকে বলি সুমাত্রা, তারই লোকাল নেম।
মামাবাবু ও মিকি মাথা নেড়ে সায় দেয়। বুঝি মিকি সুমাত্রা নামটা জানে।
মিকি বলে চলে, বাস্তেন সাহেব আন্দালাসের পাহাড়—জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল বছর দই। কী করে যে বেঁচে ছিল কে জানে? জঙ্গল যা ঘন। যা বৃষ্টি। বিষাক্ত সাপখোপ। ডিম জানোয়ারও আছে। অবশ্য জঙ্গলের আদিবাসীদের ধরনধারণ ভাষা কিছুটা জানত বাজে,
—যুদ্ধ থেমে গেলে বাস্তেন বেরিয়ে আসে শহরে। জাপানিরা হেরে গেছে তাই ভয় নেই আর। এরপর বাস্তেন চলে যায় নিজের দেশ হলান্ডে। কিন্তু ফিরে আসে আবার। জার্মানির আক্রমণে ওর অনেক নিকট আত্মীয় নাকি মারা গিয়েছিল। দেশে ওর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দেশে ওর আর মন টিকছিল না।
অনেকক্ষণ কথা বলেছে মিকি। মামাবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এক কাপ কফি খাবে নাকি?
—তা বেশ। মিকি রাজি।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ফের শুরু করে মিকি, বাস্তেন বছর খানেক নানা কাজ করে। ইন্দোনেশিয়ার কয়েক জায়গায়। তারপর নাকি ওই দ্বীপে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। চাকরি আর করেনি। বাস্তেনের গাছপালার খুব শখ ছিল। জানতও বেশ গাছপালা সম্বন্ধে। ওই দ্বীপে বাঝেন খুশিমতো গাছ পুঁততে থাকে। দেশ—বিদেশের গাছের চারা বিচি জোগাড় করে, ফুল। ফল অনেক রকম। তাই নিয়েই মেতে থাকত। সমুদ্র পেরিয়ে বড় দ্বীপের শহরে যেত। অবশ্য, তবে খুব কম। দরকার না হলে যেত না শহরে।
—স্রেফ একা গিয়েছিল? জিজ্ঞেস করি আমি।
—না। এক মালয়ি যুবককে সঙ্গে নিয়ে যায়। ওর খুব অনুগত ও বিশ্বাসী। দ্বীপে নিজের বাড়ি বানাতে কিছু দেশি মজুরকে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকবার অল্প দিনের জন্য। পরেও মজুর নিয়ে গেছে গাছ কাটতে, জমি কোপাতে, এমনি নানা কাজে। তবে তারা বেশিদিন থাকেনি দ্বীপে।
—বাস্তেন জাভায় যাওয়া—আসা করত কীভাবে? মামাবাবু জানতে চান।
—ওদের একটা ছোট মোটর বোট ছিল তাতে। বাস্তেন এবং ওর অনুচর পো দুজনেই বোট চালাতে পারত। কখনো কখনো পো একাই ঘুরে আসত জাভায় সুমাত্রায় বোট চালিয়ে। মাঝে মাঝে জাভা থেকে নৌকা যেত ওই দ্বীপে, দরকারি খাবার—দাবার জিনিসপত্র নিয়ে। বাইরের লোক বেশি আসা পছন্দ করত না বাস্তেন। মাঝিরা যারা যেত দরকারে তাদের মুখেই লোকে শুনত বাস্তেনের নানা কথা। বাস্তেন গাছের চারা আর বীজের খোঁজে যেত জাভা সুমাত্রা আর কাছাকাছি দ্বীপে। অর্ডার দিয়ে আনাত চারা ও বীজ। দ্বীপটা তখন নাকি রীতিমতো রহস্যময় ছিল বাইরের লোকের কাছে।
—পনেরো বছর পর বাস্তেন কোথায় যায়? প্রশ্ন করেন মামাবাবু।
—যায়নি কোথাও। ওখানেই হঠাৎ সে মারা যায় অ্যাকসিডেন্টে। পাহাড় থেকে পিছলে পড়ে মাথায় চোট পায়। তখন কয়েকজন মাঝি গিয়েছিল ওই দ্বীপে,তারাই এসে প্রথম খবরটা দেয় জাকার্তায়। ওই দ্বীপেই বাস্তেনকে কবর দেওয়া হয়। ওর অনুচর পো বেশি দিন আর থাকেনি ওই দ্বীপে। বাস্তেনের মোটরবোট চালিয়ে, বাস্তেনের বন্দুকটা আর কিছু দামি জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায় মালয়। আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকেই দ্বীপটা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। মাঝে মাঝে দেশি মাঝিরা গিয়েছে ওই দ্বীপে ফলটলের সন্ধানে। কিন্তু বাস করেনি কেউ স্থায়ীভাবে।
—তুমি বাস্তেন দ্বীপের কথা জানতে না আগে? মামাবাবুর প্রশ্ন।
—না। আসলে আমাদের দেশটা তো অজস্র দ্বীপের রাজত্ব। জাভা সি, ফ্লোরেস সি, বান্দা সি, চায়না সি, সুলু সি—এমনি কত সাগরে হাজার হাজার ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে। বড় দ্বীপগুলোর মোটামুটি খবর রাখলেও খুব ছোটগুলো আমাদের প্রায় অচেনা। বিশেষত আমার। আমি যে কটা জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেছি তাদের জাহাজ যায় বেশির ভাগ পশ্চিমে বা উত্তরে। বড় পোর্টগুলোয় জাহাজ থামে। সেগুলো চিনি। বাস্তেন দ্বীপের গল্প করে শুধু জাকার্তার জেলেরা আর নৌকার মাঝিরা। তাদের সঙ্গে আমার তত মেলামেশা নেই। জাকার্তায় গেছি অনেকবার। তবে সেখানে জাহাজি নাবিকদের সঙ্গেই মিশেছি বেশি। তাই আগে জানতেম না বাস্তেন দ্বীপের কথা।
—তুমি অনেক পোর্টে ঘুরেছ তাই না? সুনন্দ বলে।
—ঘুরেছি বইকি। জাকার্তা, সিঙ্গাপুর, পেনাং, রেঙ্গুন, ব্যাংকক, ক্যালকাতা, কলম্বো, করাচি কতবার গেছি। এদেন ডার্বানও গেছি। ফিলিপাইনসে ম্যানিলা গেছি। ব্রিসবেন গেছি। কালিমাস্তান মানে বোর্নিওতে ম্যাকাসার পোর্টে গেছি অনেকবার। ওই সব পোর্টটাউনে ঘুরেছি। সগর্বে ঘোষণা করে মিকি। বলে, তবে বেকায়দায় পড়ে খুব ছোট বা নির্জন বসতিহীন দ্বীপেও জাহাজ নোঙর ফেলেছে কয়েকবার।
আমরা হাঁ করে শুনি। ওঃ লোকটার জীবন বটে। কত ঘুরেছে। কত কী দেখেছে!
মামাবাবুর পিছু পিছু মিকি বাগানে গ্রিনহাউসে ঢোকে। খড়ের চাল, দরমার দেয়াল, ছোট লম্বাটে ঘরটায় নানান অর্কিড় ঝুলছে। ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। তবে রোদ ঢোকে দরমার বেডা সরিয়ে দিলে। ঘরের মেঝেতে লম্বা লম্বা কয়েকটা টবে কিছু পপি গাছ দেখে মিিক বলল, এই গাছ আমি ওই দ্বীপে দেখেছি। এর চেয়ে অনেক বড় বড় সাইজের।
—এগুলো কী ফুলের গাছ জানো? মামাবাবু প্রশ্ন করেন।
—না।
—এগুলোর নাম ক্যালিফোর্নিয়ান পপি। সত্যি তুমি এই গাছ দেখেছ বাস্তেন দ্বীপে? মিকি পপি গাছগুলোর পাতায় হাত দিয়ে দেখে বলল, আলবৎ এই গাছ। তবে সাইজে প্রায় ডবল। ফুল ছিল না মোটে। মাত্র দু—একটা ছোট্ট ছোট্ট ফুল ফুটেছিল এইরকম, এই রং—এর। হুঁ এই গাছই। এই পাতা। আমি তো ভেবেছিলাম লম্বা মোটা পাতার ঘাস। কী নাম বলছেন? পপি।
—কোথায় দেখলে? মামাবাবু জানতে চান।
—এক জায়গায় ঝরনার গা থেকে সরু নালা বেরিয়েছে, তার ধারে ধারে ছিল এই পপি গাছ। প্রচুর।
মিকি তার সমুদ্র ভ্রমণের অ্যাডভেঞ্চার আরও বলে। এমন শহুরে শিক্ষিত শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনছে এ অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম।
মামাবাবু কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক। কিছু ভাবছেন যেন? তিনি হঠাৎ বললেন, আচ্ছা মিকি ওই বাস্তেন সাহেবের চলত কীভাবে শুনেছ? মানে দ্বীপে থাকার সময় চাকরি তো করতেন না। খরচাপাতি চালাত কী করে খোঁজ পেয়েছিলে?
মিকি থমকে গিয়ে একটু ভেবে বলে, হঁ আমিও ভেবেছি ব্যাপারটা। মাঝিদের মখে শুনে যা মনে হয়েছিল বাস্তেনের অনেক জমানো টাকা ছিল জাকার্তার কোনো বাংকে। মোটা মাইনের চাকরি করেছে তো আগে। হয়তো দেশ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল।
তবে ওই দ্বীপে থাকার সময়েও বাস্তেনের অন্য রোজগারের পথ ছিল। লোকটি নাকি চমৎকার ছবি আঁকতে পারত। হাতের কাজ ছিল দারুণ। চামড়া আর কাগজের মুখোশ, নকশা আঁকা বাঁশের পাত্র, নানান ডিজাইনের বাতিকের কাজ করা কাপড়—এই সব বানিয়ে এনে কয়েক মাস অন্তর অন্তর বিক্রি করত জাভায়। ভালো ডিমান্দ ছিল ওর হাতের কাজের, শিল্প—দ্রব্যের। এই ভাবেই চালাত খরচ, আমার তাই মনে হয়। জাকার্তার মাঝিদেরও তাই ধারণা।
—হুম। মামাবাবু ফের আনমনা হয়ে ভাবেন কিছু। এরপর একসময় জিজ্ঞেস করেন মিকিকে, তুমি দেশে ফিরছ কবে?
—এই পনেরো—কুড়ি দিন বাদে।
—তারপর থাকবে কিছুদিন দেশে।
—থাকব। অন্তত মাস তিনেক। বাড়িঘর সারানো, চাষবাসের কাজ আছে।
মামাবাবু বললেন, শোনো মিকি, মাসখানেক বাদে আমি সিঙ্গাপুর যাব একটা কাজে। আমরা তিনজনেই যেতে পারি। গেলে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। তুমি সুমাত্রা মানে আন্দালাসে থাকো কোথায়?
—সুমাত্রার দক্ষিণ—পুবে পালেমবাং নামে একটা ছোট শহরের কাছে আমার গ্রাম।
—সিঙ্গাপুর থেকে তোমার সঙ্গে যোগাযযাগ করব কীভাবে? টেলিফোন বা টেলিগ্রাম করলে?
মিকি বলে টেলিফোন তো নেই আমার বাসায়। তবে গ্রামের পোস্ট অফিসে টেলিফোন করে আমায় কোনো খবর দিতে বললে জানিয়ে দেবে আমায়। হা টেলিগ্রাম করলে পাব।
জানতাম যে সিঙ্গাপুরে মামাবাবুর একটা কনফারেন্স আছে ডিসেম্বরের শেষে। সঙ্গে সুনন্দও যাচ্ছে। কথার ভাবে মনে হল আমাকেও হয়তো সঙ্গে নেবেন। মনে মনে আমি পুলকিত। কিন্তু এরপরেই মামাবাবুর কথা শুনে আমি ও সুনন্দ চমকাই।
—বুঝলে মিকি, আমি ওই বাস্তেন দ্বীপে একবার যেতে চাই। দেখব ওখানকার গাছপালা। তুমি পারবে না আমাদের গাইড হয়ে নিয়ে যেতে? সেই কদিনের জন্য তোমার যা প্রাপ্য আমি দেব। কিন্তু তোমার হেল্প চাই। আমরা তো চিনি না ওদেশ। তুমিই নৌকা ভাড়ার ব্যবস্থা করবে। খাওয়া থাকা ইত্যাদি সব খরচ আমার। দ্বীপটার গাছপালা আমার দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। অত কাছে গিয়েও স্বচক্ষে ওই দ্বীপ না দেখে এলে ভারি আপশোস হবে।
সুনন্দ চিড়বিড়িয়ে ওঠে, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেই যে আপনাকে গোয়ায় যেতে হবে অল ইন্ডিয়া জুওলজিকাল সোসাইটির কনফারেন্সে। একটা সেশনে আপনি প্রিসাইড করবেন। কথা দিয়েছেন।
—যাব না গোয়া। ওদের জানিয়ে দেব। মামাবাবু নির্বিকার।
শুনে সুনন্দ থ। আমিও। মামাবাবু তো এমন কথার খেলাপ করেন না। আমার মনে হল যে বাস্তেন আইল্যান্ড যাবার প্ল্যান মোটেই গাছগাছড়া দেখার লোভে নিছক শখের ভ্রমণ নয়। মামাবাবুর স্বভাব জানি। অন্য কোনো গোপন উদ্দেশ্য আছে। এই নিয়ে এখন প্রশ্ন করলে আসল কারণ ভাঙবেন না। পরে হয়তো নিজেই বলবেন কারণটা।
—কি মিকি যাবে নিয়ে? মামাবাবু ফের অনুরোধ করেন সাগ্রহে।
প্রস্তাব শুনে মিকি কেমন মিইয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলে, দশ বছরেরও আগে গিয়েছিলাম ওই দ্বীপে। আর যাইনি ওর কাছ দিয়ে। ওখানকার ছোট দ্বীপগুলো তেমন চিনি না আমি।
মামাবার মিকির দ্বিধা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, তা লাগুক সময় খুঁজতে। দু—চার দিন নষ্ট হলে আমার ক্ষতি নেই। দ্বীপটায় পা দিলে চিনতে পারবে?
—তা পারব। দ্বীপের কয়েকটা চিহ্ন মনে আছে।
—ব্যস ব্যস তাহলেই হল।
মিকি বলে, পালেমবাংয়ে আমার চেনা একজনের নৌকা আছে। লামপুং বন্দরে তার নৌকা থাকে। ভাড়া খাটে। তাকে বললে সে ঠিক রাজি হয়ে যাবে তার নৌকা ভাড়া দিতে।