☼ অজেয় রায় ☼
কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন
এক
চৈত্র মাস। রতন এসে প্রস্তাব দিল, চল, কেওঞ্ঝরগড় বেড়িয়ে আসি। ছোটকাকার বাড়ি।
রতন ও আমি ছেলেবেলার বন্ধ। ও ভতত্তের ছাত্র, আপাতত গবেষণা করছে। আমার বিষয় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস। আমিও গবেষণা করছি একটি ফেলোশিপ পেয়ে—প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে।
কেওঞ্ঝর উড়িষ্যার শহর এইটুকুই জানতাম, তার বেশি কিছু না। তাই প্রথমটা একটু গাঁইগুঁই করছিলাম। রতন তাড়া দিয়ে বলল, চ চ, প্রাগৈতিহাসিক! শুনেছি জায়গাটা দারুণ। যাসনি তো কখনও। দুজনেরই খোরাক মিলবে। ওখানে প্রচুর পাহাড়—জঙ্গল। ছোট বড় পুরনো মন্দির আর মূর্তির ছড়াছড়ি। আমিও ধারে—কাছের খনিগুলো দেখে নেব। আর কাকা কাকিমা দুজনেই গ্র্যান্ড লোক, বুঝলি।
দিন কয়েকের মধ্যেই কেওঞ্ঝরগড় গিয়ে হাজির হলাম। রতনের কাকা মিস্টার দত্তকে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়েছিলাম। বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর, লম্বা ভারিক্কি সুপুরুষ চেহারা, রঙ টকটকে ফরসা। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, খুব কম কথা বলেন। নাম করা এনজিনিয়ার।
প্রথম দিন পরিচয় হবার পর আমায় বলেছিলেন, প্রতাপাদিত্য চৌধুরী। বাঃ, বেশ নাম তো তোমার।
কেমন ইতিহাসের গন্ধ আছে, তাই না?রতন পাশ থেকে টিপ্পনী কাটে। মিঃ দত্ত একটু হাসেন। ব্যস, আর কথাবার্তা হয়নি তাঁর সঙ্গে। খুব ব্যস্ত মানুষ, তবে সাদাসিধে।
কাকিমা অবশ্য ভারি আমুদে। আমাদের পেয়ে মহা হৈ—চৈ জুড়ে দিলেন। চট করে জেনে নিলেন, আমি কী কী খেতে ভালবাসি। তিনি খানিক আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেন, আর খানিক রান্নাঘরে ঢোকেন। এই চলল তার রুটিন।
আসলে রতনকে এঁরা ভীষণ ভালবাসেন। এঁদের ছেলেপুলে নেই। রতনকে দেখেন ছেলের মতন। রতন সুযোগ পেলেই কাকার কাছে বেড়াতে আসে। তবে এবার এসেছে। অনেক দিন পরে। তাই খাতির—যত্নটা কিঞ্চিৎ বেশি।
কেওঞ্ঝরগড় আসার পর দ্বিতীয় দিন সকালে কাকাবাবুর কোয়ার্টারের সামনে লনে পায়চারি করছি আমি ও রতন, এমন সময় হঠাৎ এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন সামনে। শ্যামবর্ণ, নাদুসনুদুস মাঝারি হাইট। গোলগাল হাসি হাসি মুখ, মাথার সামনের দিকে একট টাক। নীল সার্ট ও সাদা ফুলপ্যান্ট পরা। ঝুঁকে পড়ে রতনের হাত আঁকডে ঝাঁকিয়ে বললেন—গ্ল্যাড টু মিট ইউ। এরপরই আমার সঙ্গে একদফা হ্যান্ডশেক।
—বস মানে দত্ত সাহেব বললেন, আপনাদের একটু ঘুরিয়ে—টুরিয়ে দেখাতে, হেল্প করতে। তারপর রতনের মুখের পানে তাকিয়ে—আপনি বুঝি দত্ত সাহেবের ভাইপো?, হুঁ ঠিক। চেহারায় ভারি মিল।
এমন হুড়মুড়িয়ে কথা বলছিলেন ভদ্রলোক যে রতন থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি?
আমি? আমি নন্দদুলাল বোস।
ভদ্রলোক আমাদের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জরিপ করতে করতে বেশ সজোরে বিড়বিড় করে চললেন—হুঁ, পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি নয়…এ্যাট লিস্ট দশ বছরের সিনিয়ার হব…অতএব ব্রাদার এবং তুমি! কি, আপত্তি আছে?
খানিকক্ষণ সময় লাগল হেঁয়ালি বোধগম্য হতে। তারপর বলে উঠলাম, না, না, আপত্তির কি? নিশ্চয় তুমি বলবেন। ভদ্রলোক খুশিতে উজ্জ্বল হন। রতন মিটমিটিয়ে দুষ্টু হেসে বলল, আর আমরা যদি ডাকি বোসদা, আপত্তি আছে?
সার্টেনলি নট।
বোসদার সঙ্গে দারুণ জমে গেল। পরে জেনেছিলাম উনি কেওঞ্ঝরগড়ে এসেছেন মাত্র দু—বছর। বিয়ে করেছেন বছর তিনেক, তবে ফ্যামিলি, মানে স্ত্রী, থাকেন দেশের বাড়ি বর্ধমানে। বোসদা এখানে থাকেন একা।
জায়গাটা সত্যি সুন্দর। পুরনো আমলের ছোট্ট শহর। দেশীয় রাজার রাজধানী ছিল। শহরের চারপাশ পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা। কলকাতা থেকে এসে ভারি আরাম লাগে।
মিস্টার দত্তর গল্প করার ধাত নয়, তবে নজর ঠিক আছে। একদিন চা খাচ্ছি, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কেমন বেড়াচ্ছ? বোস সব দেখাচ্ছে তো?
বললাম, নতুন আর পুরনো দুটো রাজপ্রাসাদ দেখেছি। এবার জগন্নাথ মন্দির দেখতে যাব। ধারে—কাছে নাকি অনেক প্রাচীন মন্দির আছে?
মিস্টার দত্ত বললেন, আছে বৈকি। উড়িষ্যা হচ্ছে মন্দির আর মূর্তির দেশ। পুরী, কোনারক, ভুবনেশ্বরের কথা ছেড়ে দিলেও আমি ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি কত অজানা ছোট্ট গ্রামে কী সুন্দর মন্দির আর বিগ্রহ। মাঠে—ঘাটে পাওয়া যায় কত মূর্তি। বিশেষ করে পাথরে তৈরি! সামান্য দামে লোকে সে সব বেচে দেয়। আমার ড্রইংরুমে যে পাথরের যক্ষমূর্তিটা রয়েছে ওটা এক ওভারসিয়ার আমায় প্রেজেন্ট করেছে। কী সুন্দর না?
সেই দিনই গেলাম জগন্নাথ মন্দির দেখতে। কে জানত সেখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে এক চমক।
আমি ও রতন মন্দির দেখছি। দেওয়ালের গায়ে মূর্তি দেখতে দেখতে ঊর্ধ্ব মুখে মন্দিরকে পাক দিচ্ছি। ঠিক একই ভাবে আর একজন ঘাড় উঁচু করে এলো উলটো দিক থেকে। তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। রঙ কালো। বেশ লম্বা। কেঁকড়া চুল, সার্ট ও ফুলপ্যান্ট পরনে, জোয়ান চেহারা।
সে মখ ফেরাতেই চমকে রতনকে খোঁচা মারলাম—দেখ, ডাকু।
আগন্তুকের কানে আমার কথা গিয়েছিল। সে পিটপিটিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে দেখল কয়েক সেকেন্ড। তারপর লাফাতে লাফাতে এসে—অ্যাঁ, তোরা? বলে জাপটে ধরল দুজনকে।
উঃ কী গায়ে জোর। দম বন্ধ হবার যোগাড। বলি—ছাড় ছাড। তুই এখানে কোত্থেকে?
ডাকুর সঙ্গে এমন যোগাযোগ হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ওর সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার আশাই মুছে গিয়েছিল মন থেকে। ও ছিল ইস্কলে একটানা পাঁচ বছর ধরে আমাদের দুজনের সহপাঠী। পড়াশুনায় মাঝারি, কিন্তু দারুণ ফুটবল খেলত, আর ডানপিটেমিতে ছিল এক নম্বর ওস্তাদ। ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে ও স্কুল ছেড়ে দেয়। কারণ ওর বাবার আকস্মিক মৃত্যু। তখন ডাকুরা সব ভাইবোন মা—র সঙ্গে কলকাতা ছেড়ে ওদের দেশের বাড়ি মেদিনীপুরে চলে যায়। আর দেখা হয়নি। প্রথমে কয়েকবার চিঠিপত্র লেখালেখি হয়েছে। ক্রমে তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
রতন বলল, হ্যাঁ রে তুই আছিস কেমন? এখানে কী করছিস?
ডাকু ম্লানমুখে বলল, আছি এক রকম। টিকে আছি। এখানে এসেছি চাকরি করতে।
কী চাকরি? কদিন হল?
সামান্য চাকরি ভাই। কেরানিগিরি। দুমাস কেওঞ্ঝরগড়ে এসেছি। উড়িষ্যায় আছি পাঁচ বছর। আগে ছিলাম জাজপুরে। এখানে কোম্পানি একটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে, তাই ট্রান্সফার হয়ে এসেছি। বুঝলি, স্কুল ফাইনালের পর আর তো লেখাপড়া এগুল না। আমার গাঁয়ের কাছে কলেজ নেই। শহরে হোস্টেলে থেকে পড়া সম্ভব নয়। তাই দেশেই ছিলাম। যা। সামান্য জমিজায়গা আছে, চাষ—বাস দেখতাম। কিন্তু তাতে কি সংসার চলে? তখন আমার এক আত্মীয় এই চাকরিটা জুটিয়ে দিল। মাইনে কম বলে দুঃখ নেই, কিন্তু বসে বসে একঘেয়ে হিসেব কষতে অসহ্য লাগে। ছোটবেলায় ভাবতাম বড় ফুটবলার হব, হল না। ভাগ্যে। স্কুল ফাইনাল পাস করে নেভিতে ঢুকতে চাইলাম, বাড়িতে কান্নাকাটি করে দিলে আটকে। এখন এই করছি।—
বড় কষ্ট হল। জানি তো কী ছটফটে প্রাণশক্তি ভরা দুরন্ত ছেলে ছিল ডাকু। বেচারা।
ডাকু একটু হেসে বলল, তবে একদম ঘেঁতিয়ে যাইনি। সুযোগ পেলেই শিকার করি। বাবার বন্দুকটা আছে। কয়েকটা বড় জানোয়ারও মেরেছি।
তিনজনে ফিরলাম। বোসদা ডাকুর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, ব্রাদার ইটি
রতন বলল, শ্রীযুক্ত শান্তসুবোধ শাসমল ওরফে ডাকু। আমাদের ইস্কুলের বন্ধ। এখানে চাকরি করে।
ডাকু কেন? বোসদা জানতে চাইল।
অসম্ভব ডানপিটে ছিল কিনা, তাই স্কুলে ওই খেতাব পায়। বলল রতন।
বোসদা ডাকুর দিকে চেয়ে বললেন, হুঁ, চেহারাটা কিঞ্চিৎ গুণ্ডে গুণ্ডো বটে। কিন্তু ব্রাদার, এ ব্যক্তি লোক খারাপ নয়। হাসিটি ভারি মিষ্টি।
আরও দুটো দিন ডাকু আমি আর রতন প্রাণভরে আড্ডা দিলাম। মাঝে মাঝে বোসদাও যোগ দেন। পুরনো দিনের কত গল্প হয়। কত মজার ঘটনা, দুষ্টুমির কথা। কাছাকাছি কী কী দেখতে যাব প্ল্যান করি। এমনি করেই হয়ত আমাদের বাকি দিনকটা কেটে যেত, যদি না রতনের কাকা দেব—বাড়ির মিউজিয়ামের কথা শোনাতেন। কারণ সেই মিউজিয়াম দেখতে গিয়েই আবিষ্কার হল এক রহস্যের সূত্র, যার ফলে জড়িয়ে পড়লাম এক দারুণ রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারে।
জাজপুরের কাছে দেবদের প্যালেস। লোকে বলে রাজবাড়ি, তবে ঠিক রাজা নয়—খুব বড় জমিদার, আর খুব পুরনো ফ্যামিলি। এই বাড়িতে দুটো দেখবার জিনিস আছে। এক হল অষ্টধাতুর বিগ্রহ, আরেক হল অস্ত্রশস্ত্রের এক বিরাট সংগ্রহশালা। ছোটকাকা দেবমশাইকে খবর দেওয়াতে তিনি আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। বলা বাহুল্য, ডাকুকেও আমরা সঙ্গে নিলাম। বোসদারও ইচ্ছে ছিল মিউজিয়াম দেখার, কিন্তু গাড়িতে জায়গা কম; তাছাড়া ব—এর সঙ্গে যাওয়াটাও একটু অস্বস্তিকর, তাই তিনি চেপে গেলেন।
খুব ভোরে আমরা রওনা হলাম।
জাজপুর—কেওঞ্ঝর রোড রাস্তাটি ভারি সুন্দর। পিচ বাঁধানো প্রশস্ত সড়ক। আমাদের মোটর চলেছে হু—হুঁ করে। পথের দুপাশে কখনো বিস্তীর্ণ প্রান্তর, কখনো ঝোঁপঝাড়, হালকা জঙ্গল, কখনও বা উঁচু—নিচু বনময় পাহাড়।
ডাকু এ পথে যাতায়াত করেছে। চিনিয়ে দিল—ডানদিকে দূরে ওই যে উঁচু পাহাড়, ওর নাম টোমকা। এরপরে আসবে মহাগিরি রেঞ্জ।
মাঝে মাঝে গ্রাম বা ছোট লোকালয় চোখে পড়ে। পথে রামচন্দ্রপুরে একবার থেমেছিলাম আড়মোড়া ভাঙতে। রামচন্দ্রপুর নাকি পুলিশ স্টেশন। কিন্তু ছোট্ট লোকালয়। দেব—বাড়ি পৌঁছলাম বেলা দশটা নাগাদ।
জাজপুর—কেওর স্টেশন রোড ছাড়িয়ে, পিচ রাস্তা থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটা চওডা মেঠো রাস্তা ধরে মাইল দুই ঢুকে এক গ্রামে পৌঁছলাম। দেখে মনে হয় এককালে বেশ বর্ধিষ্ণ ছিল এই গ্রাম। গাছপালার আড়াল থেকে সহসা জেগে উঠল উঁচু পাঁচিলে ঘেরা এক প্রকাণ্ড দোতলা অট্টালিকা। লক্ষ করলাম, অট্টালিকার কয়েকটি অংশ খুবই জীর্ণ। বাড়ির চার পাশে পরিখা কাটা ছিল, এখন বুজে গেছে।
ভিতরে খবর পাঠানো হল।
বাব খগেশ্বর দেব মহাশয় স্বয়ং বেরিয়ে এলেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। সৌম্যকান্তি দীর্ঘকায় বৃদ্ধ। গায়ের রঙ টক্টকে, মাথা জোড়া টাক, নাকটি টিয়াপাখির মতন। বয়সের ভারে শরীর সামান্য নুইয়ে পড়েছে সামনে।
কাকাবাবু বললেন একদম সময় পাই না বলে আসা হয়নি অ্যাদ্দিন। তবে মিউজিয়াম দেখার ইচ্ছে ছিল খুবই। এবার এরা ধরল, তাই এসে পড়লাম।
কাকাবাবু আমাদের পরিচয় দিলেন। বৃদ্ধ হাসিমুখে বললেন, আপনারা এসেছেন, আমার সৌভাগ্য। চলুন ভিতরে।
বৈঠকখানায় বসে একপ্রস্থ চা—জলখাবার হল। তারপর আমরা খগেশ্বর বাবুর পিছনে পিছনে চললাম মিউজিয়াম দেখতে। আমাদের পিছনে আসছে একজন ভৃত্য। তার হাতে একটা জ্বলন্ত পেট্রোম্যাক্স আলো। দেবমশাইয়ের হাতে এক পেল্লায় চাবি।
বারান্দার প্রান্তে এক দরজার সামনে থামলেন খগেশ্বরবাবু। দরজায় বিশাল এক তাল ঝলছে। ঝনাৎ করে তালা খুললেন দেবমশাই তারপর ধাক্কা মেরে দরজা ফাঁক করে দিলেন। এবার তিনি পেট্রোম্যাক্সটা চাকরের কাছ থেকে নিজের হাতে নিয়ে ধীর পায়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। পিছনে আমরা চারজন। ভৃত্যটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
লম্বা হলঘর, উঁচু ছাদ, ভিতরে ভ্যাপসা অন্ধকার। বোধহয় অনেক দিন খোলা হয়ান ঘর। পেট্রোম্যাক্সের তীব্র আলোয় চমকে গিয়ে কয়েকটা চামচিকে আমাদের মাথার ওপর ঘুরপাক খেতে লাগল।
চতুর্দিকে দেওয়াল জুড়ে টাঙানো অজস্র অস্ত্র আর অস্ত্র। দেওয়াল ঘেঁষে লম্বা লম্বা কাঠের টেবিল পাতা। টেবিলগুলোর ওপরেও সাজানো বিচিত্র অস্ত্রের সম্ভার। ছুরি, ছোরা, তরবারি, ঢাল, বর্শা, বল্লম, টাঙ্গি, দাও, কুঠার, গদা, তীর—ধনুক, শিরস্ত্রাণ, বর্ম…। কত কী। ধাতু, কাঠ, হাড় প্রভৃতিতে তৈরি। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট কামান মখ উচ করে বসানো।
এ সবই পুরনো আমলের অস্ত্রশস্ত্র। এমন বিপুল সংগ্রহ দেখব ভাবতে পারিনি। আলো পড়ে ধাতুর অংশগুলি চকচক করে উঠল।
খগেশ্বরবাবু একটা টুলের ওপর আলোটা রাখলেন। বৃদ্ধের শরীর টান টান হয়ে উঠল। চক্ষু উজ্জ্বল। গম্ভীরস্বরে বললেন, আমার পূর্বপুরুষ ক্ষাত্রধর্মের চর্চা করতেন। যুদ্ধ ও শিকার। বাহুবলের সাহায্যে তাঁরা ধনসম্পত্তি উপার্জন করেছিলেন। এই সব অস্ত্রের অধিকাংশই আমাদের বংশের কেউ না কেউ ব্যবহার করেছেন। সবই কিন্তু সেই অতীতে। বহু স্মৃতি ও ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই অস্ত্রগুলির সঙ্গে। দেব বংশে অস্ত্রচর্চা আর হয় না, জমিদারিও আর নেই। আমার ছেলে নাতিরা বন্দুক টলুক বিশেষ পছন্দ করেন না। আসেও খুব কম। আমি বুড়ো মানুষ এই শূন্যপুরী আগলাচ্ছি। জানি না আমার পরে এ বাড়ির কী হাল হবে।
তার কণ্ঠে সাময়িকভাবে একটা বিষণ্ণতার সুর ধরা পড়ে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার স্বাভাবিক সুর ফিরে আসে, আর উৎসাহ ভরে তিনি আমাদের সব কিছু দেখাতে থাকেন।
চমৎকার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা ভদ্রলোকের। আমরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, কখনো বা কোনো জিনিস হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি।
হঠাৎ ডাকু একটা ছুরি তুলে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা খগেশ্বরবাবু লক্ষ করেছিলেন। বললেন, ওটা হানটিং নাইফ। দেশি কারিগরের তৈরি। খুব মজবুত জিনিস।
এটা কতদিন আছে এখানে? ডাকু প্রশ্ন করল।
তা অনেক দিন। আমার বাবা ছোটবেলা থেকে এটা দেখেছেন। কে এটা এনেছিল জানি না।
এই পদ্মফুলটা কেন খোদাই করেছে বাঁটে? জিজ্ঞেস করল ডাক।
কি পদ্মফুল? আমি ও রতন এবার কাছে গিয়ে ছুরিটা দেখি।
বাঁটসুদ্ধ প্রায় এক ফুট লম্বা ছুরিখানা। চওড়া ফলা। হাতির দাঁতের বাঁট। বাঁটের ওপর একটা সুন্দর ছোট পদ্মফুলের নকশা খোদাই করা।
দেবমশাই ডাকুর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে কারুকার্যটি দেখলেন। তারপর বললেন, খেয়াল—খুশিমতো নকশা করেছে হয়তো। কিংবা কারিগরের নিজস্ব ছাপ হতে পারে, মানে ট্রেডমার্ক।
ও। ডাকু ছুরি রেখে দিল একটু অন্যমনস্কভাবে।
ওই সামান্য ছুরি সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কত বড় বড় অদ্ভুত আকৃতির অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে, সেগুলোর ওপরই আমাদের বেশি নজর।
ঘণ্টা দুই পর আমাদের মিউজিয়াম দেখা শেষ হল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় কাকাবাবু বললেন, দেবমশাই আপনাদের মন্দিরের বিগ্রহটি একবার দেখাবেন? খুব নাম শুনেছি।
দেবমশাই থমকে দাঁড়ালেন। তার মুখ বিমর্ষ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বললেন, খবরটা বোধহয় আপনাদের ওদিকে পৌঁছায়নি এখনো। সমস্ত অলংকার সমেত আমাদের বিগ্রহটি চুরি গেছে।
সে কী? কবে? কাকা বলে উঠলেন। আমরাও অবাক।
মাত্র দ—দিন আগে। চুরি নয়, ডাকাতি। চার—পাঁচজন লোক এসেছিল রাতে। মিন্দরের প্রহরীকে অতর্কিতে আঘাত করে বেঁধে ফেলে, মন্দিরের দরজা ভেঙে ঢুকে ভিতরের যাবতীয় দামি জিনিস লট করেছে। গৃহ—দেবতা বিগ্রহ হারিয়েই বেশি কষ্ট পেয়েছি। পুলিশ অনুসন্ধান করছে। তিন হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছি শুধু বিগ্রহের জন্যে। এখন ভাগ্য।
তিন হাজার টাকা, শুধু বিগ্রহের জন্যে? ডাকু চোখ বড় বড় করে বলে।
হ্যাঁ। যদি কেউ উদ্ধার করে দেয়। গৃহ—দেবতাকে ফিরে পাওয়াই আমার সবচেয়ে বং কামনা।
আমরা মনে মনে লজ্জিত হলাম। সত্যি, ভদ্রলোক একবারও বুঝতে দেনান যে এত মন খারাপ। দিব্যি হাসিমুখে সব দেখালেন।
মিস্টার দত্ত বললেন, ছি ছি, এখন আপনাকে বিরক্ত করা উচিত হয়নি। জানতাম না কিছু।
ভদ্রলোক যদিও কথাটা উড়িয়ে দিলেন, আমরা তার মনের আসল ভাবটা আন্দাজ করে তাঁকে আর বিরক্ত না করে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।