» » কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন

বর্ণাকার

অজেয় রায়

কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন

ছয়

মনে হল কান্নার রব আসছে খাদের ওপারে কেল্লাপাহাড়ের গায়ে কোনো গুহার ভিতর থেকে। প্রায় চল্লিশ—পঞ্চাশ ফুট গভীর খাদ দুই পাহাড়ের মাঝখানে। এই খাদের ওপরের দিকে কেল্লাপাহাড়ের গায়ে দু—তিনটে পাশাপাশি বড় বড় গুহা। গুহাগুলির সামনে খানিকটা বারান্দার মতো জায়গা। তারপরই খাদের ঢল নেমেছে খাড়াই। সবিস্ময়ে দেখলাম, একটা গুহার ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে গলগল করে, আর সেই সঙ্গে কান্নার স্বর আরো বেড়ে গেল।

এবার হতভম্ব হয়ে দেখলাম, যে—গুহা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল, সেই গুহা থেকে বেরিয়ে এল এক কালো ভাল্লুক, আর তার পিছনে পিছনে দুটো ছানা। বাচ্চা দুটো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। কী আশ্চর্য—এদের কান্নাই শোনাচ্ছে মানুষের মতো!

ভাল্লুক ফ্যামিলি আস্তে আস্তে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেল।

এবার ধোঁয়া একটু কমে এল। পরক্ষণেই সেই গুহার মুখে বন্দুক হাতে ডাকুর আবির্ভাব ঘটল। যেন ভোজবাজি। আমরা থ। ডাকু আমাদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকল—চলে আয়, কোনো ভয় নেই। ভাল্লুক পালিয়েছে।

সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে ঠিক অমনি আর একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডাকুর কাছে পৌঁছলাম।

রতন বলল, কী ব্যাপার। এ সব কী?

ডাকু বলল, ব্যাপার অনেক। ভিতরে আয়, দেখতে পাবি।

এই গুহার ভিতর?

হ্যাঁ, তবে এটা সাধারণ গুহা নয়,সুড়ঙ্গ।

আমরা চারজনে সেই প্রায় অন্ধকার গুহার মধ্যে ঢুকলাম।

ঢকে বঝলাম গভীর গহুর। গুহার মুখে কতগুলো বড় বড় পাথর একটার ওপর একটা সাজানো। কিছু পাথর মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ডাকু টর্চ জ্বালল। তারপর একটু এগিয়ে গিয়েই বলল, সাবধান। সামনে দেখ।তার টর্চের আলো মাটিতে শায়িত এক মনুষ্যদেহের ওপর পড়ল।

এক যুবকের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ।

ডাকু বলল—এই হচ্ছে পঞ্চা। মরেছে ভাল্লুকের হাতে।

বোসদা আমার গায়ে ঘেঁষে দাঁড়ালেন।

পঞ্চা গুহায় ঢুকেছিল কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

এই গুহামুখ দিয়ে ঢোকেনি পঞ্চা। বলেছি তো এটা সুড়ঙ্গ। পঞ্চা সুড়ঙ্গের অন্য মুখ দিয়ে এসেছিল। সেই মুখটা হল আমাদের তাঁবুর সামনে, দুর্গ—বাড়ির ভিতরে।

তুই বঝেছিলি পঞ্চা এর মধ্যে ঢুকেছে? রতন বলল।

পঞ্চা কেল্লাপাহাড়ে এসেছে সেটা সন্দেহ করেছিলাম। তাই প্রাণপণে খুঁজছিলাম পাহাড়ের গোপন জায়গাগুলি। তারপর বোসদাই আমাকে আসল ক্লু—টা দিলেন!

আমি!—বোসদা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠেন। বলছ কী ব্রাদার!

আরো বলছি, ডাকু বলে চলল, জগন্নাথপুরেই প্রহ্লাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে পঞ্চা হয়তো কেল্লাপাহাড়ে যেতে পারে লুকোতে। বংশীর সূত্রে এ কেল্লার অন্ধিসন্ধি পঞ্চার চেনা, সুতরাং লুকোবার পক্ষে আইডিয়াল জায়গা। তারপর কাল এই পাহাড়ে এসে পেলাম একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট, ওই ব্রান্ডের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখেছি বংশীর বাড়ির উঠোনে। জেনেছিলাম পঞ্চার ওই সিগারেট। অতএব আমার ধারণা আরো দৃঢ় হল। আজ সকালে বোসদা বললেন তিনি রাত্তিরে অদ্ভুত কান্নার মতো শব্দ শুনেছেন। দুগর মধ্যে থেকে। তোরা চলে যেতেই কৌতূহলী হয়ে ঢুকলাম ওই ঘরগুলোর ভেতর। খানিক সন্ধান করতেই চোখে পড়ে গেল খোলা সুড়ঙ্গ—মুখ। ইনস্পেক্টরও বলেছেন পঞ্চা এদিকে এসেছে। অতএব প্রস্তুত হয়েই ঢুকলাম সুড়ঙ্গে। কান্নাটা ছিল ভাল্লকের, সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। খোলা সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেসে এসেছিল আওয়াজ। সুড়ঙ্গের ভিতর আবিষ্কার করলাম ভাল্লুকের কীর্তি। তারপর ধোঁয়া দিয়ে ভাল্লুক তাড়ালাম।

আমাদের দৃষ্টি আবার চলে গেল পঞ্চার মৃতদেহের দিকে। কী ভয়ংকর! বলে উঠলেন বোসদা।

ভয়ংকর ছাড়াও অবিশ্যি এর আরেকটা দিক আছে।

ডাকুর কথাটা শুনে তার দিকে চাইতেই সে একটু হেসে পঞ্চার দেহ পাশ কাটিয়ে গুহার ভিতর খানিকটা ঢুকে গেল। তারপর একটা ফাটলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল। একটা মূর্তি। রতন আর আমার মুখ দিয়ে একসঙ্গে একটা কথা বেরিয়ে পড়ল—

দেববাড়ির বিগ্রহ!

ডাকু মাথা নাড়ল। পঞ্চা এটাই লুকোতে চেয়েছিল সুড়ঙ্গে। সে বোধহয় সুড়ঙ্গের এই মুখটা পাথর সাজিয়ে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। ভাল্লুক তখন ছিল না গুহাতে। তারপর বাসায় ফিরে ভাল্লুক অতর্কিতে পঞ্চাকে আক্রমণ করে। এই মূর্তি পেয়েছি অনেক ভিতর দিকে—সুড়ঙ্গের এক কুলুঙ্গিতে।

বিগ্রহ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে পরীক্ষা করলাম আমরা। কিছু অলঙ্কার জোর করে খুলে নেওয়া হয়েছে বটে, তাতে মূর্তির কোনো ক্ষতি হয়নি। এই প্রাচীন কারুশিল্পের নমুনার দিকে অবাক হয়ে দেখছি, এমন সময় খেয়াল হল ডাকু বিড়বিড় করে কথা বলছে

ব্যবসা করব। একজন আমায় পার্টনার করবে বলেছে। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে চালান দেবার ব্যবসা…আর মনের সুখে জঙ্গলে ঘুরব।

সত্যিই তো! ডাকু যে তিন হাজার টাকা পাচ্ছে সেটা খেয়াল হয়নি। আশ্চর্যভাবে ডাকুর একটা হিল্লে হয়ে গেল।

এবার তোমার ক্রোম আবিষ্কারের কথাটা ডাকুকে বলে দাও, বোসদা রতনকে বললেন।

তুই ক্রোম পেয়েছিস? ডাকু উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল। চল, বাইরে গিয়ে সব শুনব। এই অন্ধকারে আর ভালো লাগছে না।

শুধু তাই নয়, বোসদা বলে উঠলেন, বারোটা বাজে। মনে আছে, দুটোর মধ্যে পলাশবুনি পৌঁছবার কথা আমাদের?

ডাক আবার টর্চটা জ্বালল আমাদের পথ দেখাবার জন্য। আলো দেয়ালে পড়তেই আমার দৃষ্টি একটা জায়গায় আটকে গেল। কয়েকটা লাল রঙের রেখা।

ডাকুর হাত থেকে টর্চ নিয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম।

পাথর মসৃণ করা হয়েছে। তার উপর সাধারণ রেখা নয়, রেখাচিত্র। এ তো আদিম মানবের হাতে আঁকা ছবি! ছবিগুলি ভালো বোঝা যাচ্ছিল না। বেশির ভাগই মুছে গেছে। একটিকে মনে হল মানুষ।

রতনরা অবাক হয়ে আমায় লক্ষ করছিল। ডাকু বলল—কী ব্যাপার?

বললাম, মনে হচ্ছে এ সব প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের আঁকা ছবি। এ গুহা নিশ্চয় খুব প্রাচীন। আদিম যুগে মানুষের বাস ছিল এ গুহায়।

ডাক বলল, হতে পারে। এ অংশটা ন্যাচারাল কেভ্‌। প্রাচীন গুহা। তবে কিছুদুর গিয়ে গুহাটা মানুষের তৈরি এক সুড়ঙ্গে পরিণত হয়েছে। কেল্লা থেকে গোপনে বেরিয়ে আসার জন্যে এই সুড়ঙ্গের সৃষ্টি।

আমি বেরিয়ে পাশের গুহাতে ঢুকলাম। হা ঠিক যা ভেবেছি। এ গুহার দেওয়ালেও অনেক রেখাচিত্র। লাল রঙে আঁকা। আঁচড় কেটে আঁকা। দুটো মানুষ এবং একটা শিংওলা পশুর ছবি। আর সন্দেহ নেই। এ সব প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা—মানুষের শিল্পচর্চার নিদর্শন।

এরপর আমি খাদে নামলাম। ডাকু বন্দুক হাতে পাহারায় রইল ভাল্লুকের আশঙ্কায়। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে জানি, কিন্তু তাতে আমার ভ্রূক্ষেপ নেই। আবিষ্কারের নেশায় তখন আমার মাথা ভো ভো করছে।

বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি। পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমার প্রত্নতাত্ত্বিকের চোখ আবিষ্কার করল তিনটি বিচিত্র প্রস্তরখণ্ড, পাথরগুলির সামনের দিক ছুঁচলো পিছন দিক হাতলের মতো। যেন বড় ছোরা বা কুঠারের ফলা। এ বস্তু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। মানুষের হাতে গড়া পাথুরে অস্ত্র। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গুহা থেকে নিচে পড়েছে।

পাথুরে অস্ত্রগুলি হাতে নিয়ে উঠে এলাম। রতনকে বললাম, এই অস্ত্র বা গুহাটি পরীক্ষা করলে অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাদের সময় স্থির করতে পারবেন। তবে আমার মনে হচ্ছে প্যালিওলিথিক যুগের শেষ ভাগ, অর্থাৎ প্রায় দশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগেকার মানবগোষ্ঠীর চিহ্ন এগুলি। ভারতের অনেক জায়গায় এমনি অতি প্রাচীন গুহা—মানবের চিহ্ন আবিষ্কার হয়েছে। এই গুহাগুলোর মেঝে খুঁড়লে আরও বহু চিহ্ন পাওয়া যাবে।

আশ্চর্য হালকা ও উৎফুল্ল মন নিয়ে আমরা তাঁবুর দিকে রওনা দিলাম। অভিযান সার্থক। বিদায় কেল্লাপাহাড়! আর কখনো এখানে আসা হবে কিনা জানি না। যদিও আসার ইচ্ছে রইল। আসন্ন গ্রীষ্মের ছোঁয়াতে ডালে ডালে নবীন পাতার আবির্ভাব ঘটেছে। আবার বসন্তের রেশটুকুতে প্রকৃতি কী মধুর। এত কাণ্ড যে ঘটে, প্রকৃতি—রাজ্যে কোনো ক্ষেপ নেই যেন। কে বলবে এই পাহাড়—জঙ্গলে মানব ইতিহাসের বিচিত্র সব পর্ব অভিনীত হয়েছে যুগ যুগান্তর ধরে। মানুষের আশা—আকাঙ্ক্ষা লোভ লালসায় প্রকৃতি সর্বদাই বুঝি এমনিই নির্বিকার, উদাসীন!

পরদিন বিকেল। মিস্টার দত্তর বৈঠকখানায় চারজন জমায়েত হয়েছি। গতকাল ফিরে এসে প্রথমে এক চোট ধমকের পর আমাদের খবর শুনে যে ধরনের অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম, তা অন্তত আমার ভাগ্যে আর কখনো জোটেনি। রতনের কাকা কাকিমা আমাদের অভিযানের সমস্ত বিবরণ খুঁটিয়ে শুনলেন। মিস্টার দত্ত দুর্গ ও সুড়ঙ্গ সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলেন। কাকিমার আগ্রহ দেখলাম সব চেয়ে বেশি সেই ভয়ংকর শঙ্খচূড় সাপটা সম্বন্ধে। রাতের বেলায় সেই রহস্যময় শব্দ অর্থাৎ ভাল্লুকের কান্নার কথা শুনে তিনি বড় বড় চোখ করে বললেন, কে জানে বাপু ওটা কীসের আওয়াজ ছিল। রাত্তিরে যে আবার বাহাদুরি করে দেখতে বেরোওনি তাই রক্ষে। যা ডানপিটে সব।

গতকাল ফেরার পথে রামচন্দ্রপুর থানায় থেমে দারোগাবাবুর হাতে বিগ্রহ সমর্পণ করে। তাকে ক্রোমের ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম (নিকেল সম্বন্ধে অবিশ্যি কিছুই বলিনি)। চন্দ্রজিৎ সিং—এর কথা শুনে দারোগাবাবু স্পষ্টই বললেন যে ওই পাহাড়ে সিং—এর কোনো মাইনিং রাইট নেই, এবং এই বেআইনি কারবার তিনি অচিরেই ঘুচোবেন। বিগ্রহর ব্যাপারে এই কিছুক্ষণ হল খবর এসেছে যে বাবু খগেশ্বর দেব দু—একদিনের মধ্যে নিজেই এসে ডাকর হাতে টাকাটা তুলে দেবেন।

আমরা চারজন গল্পগুজব করছি এমন সময় চাকর এসে খবর দিল যে রতনের ফোন এসেছে, ত্রিপাঠী সাহেবের কাছ থেকে। ফোন সেরে রতন একগাল হাসি নিয়ে ফিরে এসে বলল, পেয়েছে। ওই ছাইরঙা পাথরে নিকেল পেয়েছে ত্রিপাঠী।

আমি ও ডাকু লাফ দিয়ে উঠে রতনকে জড়িয়ে ধরলাম।

থ্রি চিয়ারস্ ফর দা হিরো! ডাকু চেঁচিয়ে উঠল।

রতন বলল, কেন বাপ, আমি একা কেন? তোরা দুজনই বা কীসে কম?

কথাটা খুব ভুল বলেনি রতন। ডাকু দেব—বাড়ির বিগ্রহ উদ্ধার করেছে, আর আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানবের গুহাগৃহ আবিষ্কার করেছি। সত্যিই। আমরা তিনজনেই তো হিরো।

বোসদা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার শুনলাম তাঁর গলা খাক্রানি। কিছু বলবেন কি? আমরা তিনজনেই তার দিকে চাইলাম। কফির পেয়ালাটা হাত থেকে নামিয়ে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বোসদা গম্ভীর গলায় বললেন, আমার কথা ভুলে যেও না ব্রাদার। আমিও যে একজন হিরো! অবিশ্যি তোমাদর বৌদির কাছে। কিন্তু তাঁর কাছে হিরো হওয়াটা যে কত বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট সে তো তোমরা বুঝবে না! আজ সকালেই বারো পাতার একখানা চিঠি দিয়েছি তাকে, আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের বর্ণনা দিয়ে। আর বাকিটা শোনাব সামনের মাসে ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলে।

রতন এবার জয়ধ্বনি দিল—থ্রি চিয়ারস ফর কেল্লাপাহাড়!

আমরা বাকি তিনজনে হুঙ্কার ছাড়লাম—হিপ হিপ হুর—রে!