» » কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন

বর্ণাকার

অজেয় রায়

কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন

দুই

শহরে পৌঁছে আমরা ডাকুর বাড়িতে নামলাম, কাকাবাবু গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। খিদেটা পেয়েছিল বেশ চনচনে, তাই দোকান থেকে চা আর গরম আলুর চপ আনিয়ে জমিয়ে বসলাম।

একটা বড় বাড়ির একতলায় একটা মাঝারি সাইজের ঘর নিয়ে ডাকু থাকে। আমরা দুজন সতরঞ্চি বিছানো তক্তপোশে বসেছি, ডাকু একটা হাতল—ভাঙা কাঠের চেয়ারে। গরম চপে একটা বেপরোয়া কামড় দিয়ে মুখটাকে একটু বিকৃত করে ডাকু হঠাৎ বলল, কোনো মানে হয় না।

কীসের কোনো মানে হয় না? রতন জিজ্ঞেস করল।

তিন হাজার টাকা। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। তারা যদি বামাল সমেত চোর ধরে ফেলে তাহলে তো টাকাটা মাঠে মারা যাবে।

আমি বললাম, তাই বলে তুই পুলিশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তদন্ত শুরু করবার তাল করছিস নাকি? তিন হাজার টাকা কি সকলের কপালে থাকে রে? তাও যদি বা কোনো ক থাকত।

আমার ইচ্ছে ছিল যেখানে বিগ্রহটা ছিল সে জায়গাটা একবার দেখে আসি। তোরা এমন তাড়াহুড়ো করে চলে এলি!

ভালো কথা,—রতন বলে উঠল—তোর হঠাৎ ওই ছুরিটার ওপর চোখ গেল কেন?

ঠিক ও—রকম একটা ছুরি একবার আমার প্রায় হাতে এসে গেসল, তাই।

ডাকু বেপরোয়া ডানপিটে হতে পারে, কিন্তু বাজে গুল মারার অভ্যাস নেই সেটা আমরা জানি। কাজেই কথাটা শুনে আমরা দুজনেই বেশ অবাক। বললাম, কী ব্যাপার একটু খুলে বলতো।

ডাকুর কথা থেকে যা বেরোল তা মোটামুটি এই—

বছর দুয়েক আগে বর্ষার মুখটাতে ডাকু একা মহাগিরি রেঞ্জে শিকার করতে গিয়েছিল। শিকার শেষে পাহাড় থেকে হেঁটে ফিরছিল রামচন্দ্রপুরে বাস ধরবে বলে। পথে বৃষ্টি নামে, ডাকু দৌড়ে গিয়ে কাছের একটা গ্রামে এক বুড়োর ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে বুড়ো নাকি কামার, এবং ভারি ভাল লোক! সেই বুড়োর ঘরের দেয়ালে ঝোলানো একটা ছুরির ওপর ডাকুর চোখ যায়। দেবদের অস্ত্রাগারে দেখা পদ্মমার্কা ছুরির প্রায় ডুপ্লিকেট। সেই রকম সাইজ, সেই রকম ফলা কেবল হাতির দাঁতের বদলে কাঠের হাতল। কিন্তু হাতলে অবিকল সেই রকম পদ্মচিহ্ন। ডাকু নাকি ছোরাটা অনেক করে কিনতে চেয়েছিল, কিন্তু বুড়ো কামার রাজি হয়নি। সে বলেছিল যে এই ছুরির ফলার ইস্পাত লোহার সঙ্গে এক রকম বিশেষ। ধাতু মিশিয়ে তৈরি করেছে, এবং এই মেশাবার কায়দা নাকি ওই বুড়ো কামারেরই এক পূর্বপুরুষ দৈবাৎ আবিষ্কার করে। এই সব ইস্পাতের জিনিস আগে বুড়োর পূর্বপুরুষরা বানাত, রাজা জমিদার, সেনাপতি—এই সব বড়লোকদের জন্য। এখন এ সবের কদর নেই, চাহিদা নেই, তাই বানানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ওই একটি ছুরি তাই অতি যত্নে রেখে দিয়েছে কামার।

ডাকুর এই বর্ণনা আমাদের দুজনেরই কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল—অবিশ্যি সেটা দুটো আলাদা কারণে। ডাকু থামলে পর আমিই প্রথম প্রশ্ন করলাম।

গ্রামের নামটা মনে আছে তোর? বাঃ, মনে থাকবে না? ডাকু বেশ জোরের সঙ্গেই বলে উঠল কথাটা—জগন্নাথপুর। কেন, তোর কি যাবার শখ হয়েছে? ও ছুরি দেবে না বুড়ো।

আমি ডাকুর কথা অগ্রাহ্য করে আরেকটা প্রশ্ন করলাম—আর বুড়ো কামারের নাম?

বংশীধর পাত্র। আরো কিছু জানতে চাস?

না, জানতে চাই না। যেতে চাই জগন্নাথপুর। তবে ছুরি হাত করতে নয়। ছুরিটা কীভাবে বানিয়েছিল বংশীধর পাত্র, সেটা জানতে। ভারতীয় ইস্পাত একদিন পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল। শুধু তাই নয়—ইস্পাত তৈরির কৌশল প্রথমে ভারতেই আবিষ্কার হয়। অনেকে বলেন, ভারতীয় ইস্পাতের সাহায্যেই প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের কঠিন পাথরের মন্দিরের গায়ে চিত্রলিপি ও মূর্তি খোদাই করেছিল। প্রাচীন যুগের কথা ছেড়ে দিলেও—ধর, এই একশো বছর আগেও সিপাই বিদ্রোহের পর সিপাইদের কাছ থেকে যে সব ছুরি, তলোয়ার ইতাদি পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো পরীক্ষা করে ইংরেজরা অবাক হয়ে যায়। শেষে কলকারখানার যুগ আরম্ভ হওয়ায় এই সব কামাররা মার খেয়ে যায়। কিন্তু এই সব কামারদের মধ্যে একজনেরও যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাহলে তার কাছ থেকে ইস্পাত তৈরির আশ্চর্য সব তথ্য পাওয়া যেতে পারে। বল ডাকু—জগন্নাথপুর নিয়ে যাবি?

এবার রতন আমার প্রস্তাবে যোগ দিল। সে বলল, আমারও যাওয়া দরকার, কারণ আমারও বংশী কামারের সঙ্গে দরকার আছে। প্রতাপের কৌতূহল ঐতিহাসিক হিসাবে, আমার কৌতূহলটা জিওলজিস্টের। আমি জানতে চাই বংশী লোহার সঙ্গে কী ধাতু মিশিয়ে ইস্পাত তৈরি করে, এবং কোত্থেকে সে এই ধাতু পায়।

ডাকু ভেবে বলল, বেশ, পরশু চল জগন্নাথপর। কীসে যাবি? বাসে, না প্রাইভেট গাড়িতে?

বাসে নয়, বলল রতন, কাকার গাড়িটা আমি ম্যানেজ করব।

রামচন্দ্রপুর ছাড়িয়ে কিছুটা গিয়ে বাঁ—ধারে মাইলখানেক দূরে জগন্নাথপুর গ্রাম। পিচ রাস্তা থেকে একটা গোরুর গাড়ি চলার মেঠো রাস্তা চলে গেছে গ্রামের দিকে। ওপথে মোটর যাবে না। তাই ঠিক হল, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বড় রাস্তার ধারে অপেক্ষা করুক।

আমরা পায়ে হেঁটে চললাম গ্রামে।

গ্রামের সীমানায় আমাদের অভ্যর্থনা জানাল এক দঙ্গল ছোট ছেলেমেয়ে। সর্বাঙ্গে ধুলো। বিস্ফারিত দৃষ্টি। নির্বাক অভ্যর্থনা।

ডাকু বলল, সোজা চল, একটা বড় বটগাছের ধারে বংশীর ঘর।

রাস্তার পাশে এক বাড়ির দাওয়ায় কয়েকজন লোক বসে ছিল। তারা হাঁ করে আমাদের দেখতে লাগল। বটগাছ দেখলাম! সত্যি বিরাট। ডাল থেকে প্রচুর ঝুরি নেমেছে মাটিতে। যেন জটাজুটধারী মুনি একজন। গাছের ধারে ধারে কয়েকটি কুটির। ডাকু দেখাল, ওইটে বংশীর বাড়ি।

দুঃখের বিষয়, বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। বুঝলাম বংশী কোথাও বেরিয়েছে। এদিক সেদিক চাইতে দেখি পাশের বাড়ির দরজা দিয়ে একটা মুখ উঁকি মারছে। ডাকু ডাকল তাকে—শুনুন। লোকটি যেন ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এল। অস্থিচর্মসার ছোটখাটো মানুষটি। বয়স বোঝা ভার। ডাকু জিজ্ঞেস করল, বংশী নেই দেখছি। কখন আসবে বলতে পারেন?

লোকটি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাদের লক্ষ করছিল। এবার সে যে প্রশ্নটি ছাড়ল, তার জন্য আমরা একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। তীব্র খ্যানখ্যানে গলায়—আজ্ঞে আপনারা কি পুলিশের লোক?

সে কি! আমাদের পুলিশ ঠাওরাবার কারণ?

রতন বলল, না আমরা পুলিশ নই। বংশীর কাছে এসেছি একটা কাজে। একটা লোহার জিনিস গড়াব, তাই।

ও। লোকটি যেন হাঁফ ছাড়ল। সে কাছে এগিয়ে এল।

তা আপনারা আসছেন কোত্থেকে?

ডাকু বলল, কেওঞরগড়। আমি ওখানেই থাকি। এঁরা দুজন কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন। বংশীর খুব প্রশংসা শুনেছেন, তাই তার কাজ দেখতে চান।

অ্যাঁ কলিকাতার লোক? লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আজ্ঞে আমিও কলিকাতা ছিলাম চার বছর। হোটেলে কাজ করতাম। অসুখে ভুগলাম খুব তাই দেশে চলে এসেছি হয় মাস হল। লোকটি এতক্ষণ ওড়িয়ায় কথা বলছিল। এবার সে বাংলা—ওডিয়ার জগাখিচুড়ি ছাড়ে। বলল, আজ্ঞে আমার নাম কার্তিকচন্দ্র পণ্ডা। তা বংশীদাকে খোঁজ করছিলেন কিনা তাই ভাবিলাম আবার বুঝি পুলিশ এসেছে।

ডাকু বলল, বংশীর কাছে বুঝি পুলিশ এসেছিল?

হ্যাঁ।

কেন?

আর বলবেন না মশাই। গতকাল পুলিশ এসেছিল পঞ্চার খোঁজে! বংশীদাকে কি হয়রানিটাই না করল।

পঞ্চা কে? আমি জিজ্ঞেস করি।

বংশীদার ছেলে। ইস অমন ভালো মানুষটা! ছেলের জন্যে মান—ইজ্জত সব গেল।

ডাকু বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ—বংশীর এক ছেলে আছে, বলেছিল সেদিন। তা পঞ্চা কী করেছে?

ডাকাতি মশায়!কার্তিক গলার স্বর একটু নামায়।দেব—বাড়ির ডাকাতির কেসে পুলিশ ওকে খুঁজছে। এ নাকি ওর দলের কাজ। দেব—বাড়ির মন্দির ভেঙে ভীষণ ডাকাতি হয়েছে। সাংঘাতিক ছেলে মশাই পঞ্চা। গুণ্ডা বদমাশ। আগে একবার মাস দুই জেলও খেটেছে। এবার ধরা পড়ে সারাজীবন জেলের ঘানি টানুক। শিক্ষে হোক বেটার।

দেব—বাড়ির ডাকাতি ও বংশীর ছেলে!—এ তো অদ্ভুত যোগাযোগ। আমি বললাম, বংশীর ছেলে বুঝি লোহার কাজ করত না?

কেন করবে না, বলল কার্তিক, আগে করত। বেশ কাজ শিখেছিল। তারপর কুসঙ্গে, পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। বংশীদা ওকে কত বুঝিয়েছে। বকেছে! কিন্তু ও ছেলে কি শোনার পাত্র। নেহাত মা—মরা একমাত্র ছেলে, নইলে বাড়িতেই ঢুকতে দিত না বংশীদা। এখন আট—দশ দিন পঞ্চা হাওয়া। তারপর কাল এল পুলিশ।

পঞ্চার কথা শুনতে আমার উৎসাহ হচ্ছিল না। বংশী কখন আসবে? কার্তিক জানাল, ভোর থেকেই দেখছি বংশীদার ঘরে তালা মারা। কোথায় গেছে, কখন আসবে হয়তো পেল্লাদ বলতে পারে।

কে পেল্লাদ?

আজ্ঞে বংশীদার অ্যাসিস্টান্ট। ভারি ভাল ছেলে।

পেল্লাদের সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে? বললাম আমি।

নিশ্চয়। পেল্লাদ এ গাঁয়েই থাকে।—ওরে এই ছোঁড়া। যা তো পেল্লাদকে ডেকে নিয়ে আয়। বল কলিকাতার বাবুরা ডাকছেন। কার্তিক একটা ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিল।

আমি লক্ষ করেছিলাম বটতলায় অনেকগুলো উনুন। ওগুলো লোহা গালাবার চুল্লি। সবই ভাঙা। শুধু একটা আস্ত আছে। চুল্লি শক্ত মাটিতে তৈরি। তলাটা গোল। প্রায় তিন ফুট ব্যাস। তলা থেকে ওপরে গম্বুজের মতো সরু হয়ে গেছে। চুল্লির তলায় দুটো ফুটো! মাথাতেও ফুটো। রতনকে দেখিয়ে বললাম—

এই হচ্ছে দেশি কামারদের আদিম চুল্লি। অবশ্য এর চেয়ে ছোট বা বড়ও হয়। তলার একটা ফুটো দিয়ে গলানো লোহার খাদ বেরিয়ে যায়। অন্য ফুটোটা দিয়ে চামড়ার হাপর চালিয়ে পাম্প করে হাওয়া ঢোকানো হয়, আগুনের তাত ভোলার জন্য। আর মাথার ফুটো দিয়ে লোহার আকর এবং কাঠকয়লা ফেলা হয় চুল্লির ভিতর জ্বলন্ত কাঠের ওপর। কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড আঁচে লোহা—পাথর গলে যায়। তখন ভারী ধাতু লোহা নিচে জমা হয় এবং ওই পাথরে মেশা অন্য ধাতু বা খাদ ওপরে ভাসতে থাকে। সেগুলো বেরিয়ে যায় ফুটো দিয়ে। তারপর গলিত লৌহপিণ্ড বের করে হাতুড়ি দিয়ে বেশ করে পেটালে বাকি খাদ ঝরে গিয়ে থাকে প্রায় বিশুদ্ধ লৌহপিণ্ড। আর ইস্পাত বানাতে হলে ওই রকম খাঁটি লোহাকে আবার গলিয়ে তার সঙ্গে মেশানো হয় গুঁড়ো কাঠকয়লা অর্থাৎ কার্বন, তৈরি হয় কার্বন—স্টিল।

মনের আনন্দে লেকচার দিচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল, রতন শুনছে না। সে ডাকুকে লক্ষ করছে। ডাকু দেখি কার্তিকের সঙ্গে বংশীর উঠানে বেড়াচ্ছে। একবার কানে এল পঞ্চার নাম। ওর মাথায় দেব—বাড়ির ডাকাতি ঘুরছে নাকি?

এই যে পেল্লাদ এসেছে। কার্তিক ডাকল, আয় আয়।

কার্তিক কুড়ি বাইশ বছরের একটি যুবককে আমাদের সামনে হাজির করল। যুবকের স্বাস্থ্য ভালো। শান্ত মুখশ্রী। কঁচুমাচু ভাবে এসে দাঁড়াল প্রহ্লাদ।

আমি বললাম, তুমি বংশীর সঙ্গে কাজ করো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি এবার প্রহ্লাদকে বললাম, বংশীর লোহার কাজের খুব নাম শুনেছি, তাই এসেছিলাম দেখতে। কিছু জিনিস গড়াতে। তা বংশী গেছে কোথায়, জানো?

প্রহ্লাদ আমতা আমতা করে বলল, এখনও ফেরেনি বংশীজ্যাঠা। হয়তো কেল্লাপাহাড়ে গেছে। তবে তো ফিরতে দেরি হবে।

ডাকু বলল, কেল্লাপাহাড়? সে কোথায়?

ওই দিকে একটা ছোট পাহাড় আছে। প্রহ্লাদ পশ্চিমে মহাগিরি রেঞ্জের দিকে দেখায়। সেই পাহাড়ের মাথায় আছে একটা পুরনো ভাঙা কেল্লা। ওই পাহাড়কে আমরা বলি কেল্লাপাহাড়। এখান থেকে তিনক্রোশ পথ। পলাশবুনি গাঁয়ের পাশ দিয়ে যেতে হয়। বংশীজ্যাঠা মাঝে মাঝে যায় ওই পাহাড়ে।

কেন?

জ্যাঠা বলে ওই পাহাড়ে নাকি তার পূর্বপুরুষ থাকত, তাই দেখতে যায়। আর—প্রহ্লাদ হঠাৎ চুপ করে গেল।

আর কী? জিজ্ঞেস করলাম।

প্রহ্লাদ একটু ইতস্তত করে বলল, আর বংশীজ্যাঠা পাহাড় থেকে এক রকম পাথর আনে।

রতন বলল, পাথর? কী পাথর?

সে পাথর আমি চিনি না। একবার মাত্র দেখেছি।

লোহা—পাথর?

না। প্রহ্লাদ ঘাড় নাড়ে।

ওই পাথর দিয়ে কী করে বংশী? বলল রতন।

ঠিক জানি না। তবে মনে হয় লোহার সঙ্গে মেশায়। তবে কীভাবে মেশায় দেখায়নি কখনো। প্রহ্লাদ উত্তর দেয়।

হন গেছো কখনো ওই পাহাড়ে পাথর আনতে? রতন জানতে চায়।

না। আমি কখনো যাইনি কেল্লাপাহাড়ে। বলল প্রহ্লাদ।

বংশীর ছেলে গেছে? এবার ডাকুর প্রশ্ন।

হ্যাঁ তা গেছে। আমি যাইনি।

সেই পাথর আছে এখানে? দেখাতে পারো। রতন বলে।

এত প্রশ্নের মুখে প্রহাদ কেমন ঘাবড়ে যায়। আড়ষ্টভাবে বলে, না নেই। কাজ হয়ে গেলে বংশজ্যাঠা ওই পাথরের টুকরো দূরে ফেলে দিত। বেশি পাথর তো আনত না। শেষবাব এনেছিল বছরখানেক আগে। আর যায়নি। প্রহ্লাদ জানাল, কেল্লাপাহাড়ে গেলে বংশীজ্যাঠার ফিরতে রাত হয়ে যায়।

আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করলাম। নাঃ, বংশী এখন ফিরবে না। অগত্যা আর একদিন আসব বলে বাড়িমুখো রওনা দিলাম। মন খারাপ। আজকের অভিযান ব্যর্থ হল! ডাকু রতনও চুপচাপ।

মাত্র মাইল দুই গেছি। হঠাৎ দুম! মোটরের টায়ার ফাটল।

কী ঝামেলা। বাড়তি টায়ার অবশ্য আছে সঙ্গে। আমরা নামলাম। ডাইভার নতুন টায়ার লাগানোর তোড়জোড় করে। জায়গাটার বাঁ—পাশে পথের ধারেই এক ছোট পাহাড়।

ডাকু বলল, চ, ততক্ষণ পাহাড়ে বেড়িয়ে আসি।

উত্তম প্রস্তাব। ডাকু বন্দুক নেয়—যদি বনমোরগ পাওয়া যায় শিকার করব।

পাহাড়ে উঠছি। এদিক সেদিক ঘুরছি। এক জায়গায় পাহাড়ের ঢাল খাড়া নেমে গেছে অনেকখানি। আমি কিনারে গিয়ে নিচে তাকাতেই চমকে উঠলাম।

সোজা নিচে পাহাড়ের ওপর একটি মানুষের দেহ পড়ে আছে চিৎ হয়ে। কয়েক সেকেণ্ড, লক্ষ করে বুঝলাম—নিশ্চল। তার দেহের অদ্ভুত—ভঙ্গি দেখে সন্দেহ হল মরে গেছে নাকি?

বতন ও ডাকুকে দেখালাম। তারপর তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম ঘুরে। কাছাকাছি গিয়েও ডাক প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে—একি, এ যে বংশী!