☼ অজেয় রায় ☼
অ্যাডভেঞ্চার সমগ্ৰ
‘সন্দেশ’ ও ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ছয়টি উপন্যাস ও দু’বড়গল্প নিয়ে সঙ্কলন করা হয়েছে ‘অজেয় রায়ে’র ‘অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র’; যদিও লেখকের আরও অনেক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা এই সঙ্কলনে স্থান লাভ করেনি। এই সঙ্কলনের কাহিনীগুলো মূলত কিশোর কিশোরীদের জন্যে লেখা হলেও বড়দেরও ভাল লাগার মত প্রতিটি কাহিনী। এই সঙ্কলনে স্থান পাওয়া উপন্যাস ও গল্পগুলো হচ্ছে— মুঙ্গুআমাজনের গহনেফেরোমনমিস্টার বাসুর ফরমুলামানুক দেওতার রহস্য সন্ধানেরক্তচোষাবাস্তেন দ্বীপে অভিযানকেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন
এগুলোর মধ্যে ৬টি কাহিনীর প্রধান তিন চরিত্র হলো গল্পকথক অসিত, অসিতের বন্ধু সুনন্দ এবং প্রাণিতত্ত্ববিদ প্রফেসর নবগোপাল ঘোষ। এই ত্রয়ীর মাধ্যমেই অভিযানের কাহিনী এগিয়ে চলে। আলাদা আলাদা উপন্যাস ও গল্পে দেশী বিদেশী অন্যান্য চরিত্ররাও যুক্ত হয়ে যায়। বাকি দু’টি কাহিনীতে এই তিনটি চরিত্র নেই। সেখানেও অন্য চরিত্রের মাধ্যমে অ্যাডভেঞ্চারের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
প্রতিটি উপন্যাস ও গল্পে দেশ বিদেশের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী তো আছেই। এর সঙ্গেই ইতিহাস, ভূগোল, নৃতত্ত্ব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা রকম তথ্য আকর্ষণীয় ভাবে পরিবেশিত হয়েছে যা কখনই একঘেয়ে মনে হয় না। আফ্রিকা, আমাজনের অদেখা বন জঙ্গল হোক কিংবা কোন অচেনা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার কথা, অথবা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা পশ্চিমবঙ্গে বীরভূমের ঝিলে উত্তর এশিয়া ও ইউরোপ থেকে শীতকালে আসা যাযাবর হাঁসের গল্প—সব ক’টি কাহিনীই মনোহারী। উপন্যাসের মাধ্যমে উঠে এসেছে ইনকা সভ্যতা, আর্মি অ্যান্ট, ফেরোমন, সরিসৃপ ও পাখির মিসিং লিংকের ফসিল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অজানা দ্বীপ ও জঙ্গল, প্যারাডাইস বার্ড সম্পর্কে প্রচুর তথ্য। কিন্তু সবকিছুই লেখক পরিবেশন করেছেন সহজ সরল লেখনীর মধ্য দিয়ে। ফলস্বরূপ কাহিনীগুলি মনোগ্ৰাহী ও সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে।
বইয়ের শেষে প্রতিটি উপন্যাস ও গল্পের প্রকাশকাল ও এর মধ্যে যে যে কাহিনী আলাদা আলাদা বই হিসেবে কবে প্রকাশিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মুঙ্গু ও মি. বাসুর ফরমুলা এবং আমাজনের গহনে উপন্যাসের ভূমিকা লিখেছিলেন যথাক্রমে লীলা মজুমদার ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁদের লেখা পড়লেই বোঝা যায় যে অজেয় রায় কত বড়মাপের লেখক ছিলেন। পাঁচটি উপন্যাসে অলঙ্করণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় যা এককথায় অনবদ্য। অলঙ্করণগুলি নিঃসন্দেহে এই সঙ্কলনটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞান ভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চার গল্প / উপন্যাস পড়তে হলে অবশ্যই এই বইটি পড়া উচিত।
অজেয় রায় বাঙালি শিশুসাহিত্যিক। শিশু কিশোরদের জন্যে তিনি প্রচুর কাহিনী রচনা করেছেন। জন্ম ১৯৩৫ সালে বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ মারা যান।
মুখবন্ধ
যেদিন প্রথম ছোটদের জন্য দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প লেখা শুরু হয়েছিল, সেদিন থেকে শিশুসাহিত্যের একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেছিল। বলা বাহুল্য, এর সূচনা হয়েছিল ইয়োরোপে। এবং সে সময়ে শিশুসাহিত্যের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ রত্ন দিনের আলোর মুখ দেখেছিল। রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের, ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’, ‘কিডন্যাপ্ড’, জুল ভের্নের ছোটবড় সকলের জন্য লেখা নানান বিজ্ঞানভিত্তিক কিংবা অসমসাহসিক অভিযানের নানান বইয়ের গুণ আজ পর্যন্ত ম্লান হয়নি। পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য বিস্ময়ের দিকটা চিরকালই ছোটদের মুগ্ধ করেছে। এ-ও তাদের বড় হওয়ার একটা বলিষ্ঠ দিক; অজ্ঞাতকে জানবার, দুর্গমকে জয় করবার, প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে লড়বার, দেহ-মনের বল আহরণের প্রবল একটা দিক।
অনেক দিন আগেই বাংলায় এই ধরনের কিছু কিছু বই বেরিয়েছে, লেখকদের মধ্যে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের নাম করতে হয়। তাছাড়া আরো আছেন। এই বইখানির রচয়িতা অজেয় রায় সেই জাতের লেখক, যাঁরা দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প অতিশয় সরস ও সহজ ভাবে লিখতে পেরেছেন। এর মধ্যে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় সংবলিত আছে। অজেয় রায় কোনো তথ্য পরিবেষণ করার আগে, সেটি নির্ভুল কিনা সে বিষয়ে পরীক্ষা করে নিতে যত্নবান হন। এইটি তাঁর বিশেষত্ব। এমন কি দুটো একটা বিদেশী কথা ব্যবহার করতে হলেও, আগে শব্দগুলি সম্বন্ধে নিজে নিঃসন্দেহ হন, তারপর লেখেন। ছোটদের বইতে ভুল লিখলে চলে না ।
এই ধরনের বই কোনো কোনো অভিভাবক স্রেফ রোমাঞ্চময়, নিকৃষ্ট শ্রেণীর লেখা বলে অপছন্দ করেন। তাঁরাও এই বইখানি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারেন, এর কাল্পনিকতা তথ্যপুষ্ট বলেই এত আকর্ষণীয়। রস ও কল্পনাশক্তিই হল সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। এ ছাড়া হাজার জ্ঞাতব্য তথ্যে পূর্ণ হলেও রচনা উরোয় না। ছোটরা আনন্দের সঙ্গে পাঠ করলে তবে না তাদের জন্য গল্প লেখা সার্থক হয়।
অজেয় রায়ের ছাত্র-জীবনের ও কর্ম-জীবনের পটভূমিকা হল গিয়ে শান্তিনিকেতন, কল্পনায় ভরা স্থান। তাঁর বয়স চল্লিশের অনেক কম। ছোটদের আদর্শ লেখক তিনি।
১৫ মে, ১৯৭৫