অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
কল্লোল যুগ
তিন
তেরো-শ একত্রিশ সালের পয়লা জ্যৈষ্ঠ আমি প্রেমেন আর আমাদের দু’টি সাহিত্যিক বন্ধু মিলে একটা সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করলাম। তার নাম হল “আভ্যুদয়িক”। আর বন্ধু দু’টির নাম শিশিরচন্দ্র বসু আর বিনয় চক্রবর্তী।
যেমনটি সাধারণত হয়ে থাকে। অভিভাবক ছাড়া আলাদা একটা ঘরে জন কয়েক বন্ধু মিলে মনের সুখে সাহিত্যিকগিরির আখড়াই দেওয়া। সেই গল্প-কবিতা পড়া, সেই পরস্পরের পিঠ চুলকোনো। সেই চা, সিগারেট, আর সর্বশেষে একটা মাসিক পত্রিকা ছাপাবার রঙিন জল্পনাকল্পনা। আর, সেই মাসিক পত্রিকা যে কী নিদারুণ বেগে চলবে মুখে মুখে তার নির্ভুল হিসেব করে ফেলা। অর্থাৎ দুয়ে-দুয়ে চার না করে বাইশ করে ফেলা।
তখনকার দিনে আমাদের এই চারজনের বন্ধুত্ব একটা দেখবার মত জিনিস ছিল। রোজ সন্ধ্যায় একসঙ্গে বেড়াতে যেতাম হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা উডবার্ন পার্কে, নয়তো মিন্টো স্কোয়ারে মালীকে চার আনা পয়সা দিয়ে নৌকা বাইতাম। কোনো দিন বা চলে যেতাম প্রিনসেপ ঘাট, নয়তো ইডেন গার্ডেন। একবার মনে আছে, স্টিমারে করে রাজগঞ্জে গিয়ে, সেখান থেকে আন্দুল পর্যন্ত পায়ে হাঁটা প্রতিযোগিতা করেছিলাম চারজন। আমাদের দলে তখন মাঝে-মাঝে আরো একটি ছেলে আসত। তার নাম রমেশচন্দ্র দাস। কালে ভদ্রে আরো একজন। তার নাম সুনির্মল বসু। “বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেল, যেওনা যেওনা সেথা যেথা চলে সাইকেল।” মনোহরণ শিশু-কবিতা লিখে এরি মধ্যে সে বনেদী পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে।
শিশির আর বিনয়ের সাহিত্যে বিশেষ প্রতিশ্রুতি ছিল। বিনয়ের ক’টি ছোট গল্প বেরিয়েছিল “ভারতী”তে, তাতে দস্তুরমতো ভালো লেখকের স্বাক্ষর আঁকা। শিশির বেশির ভাগ লিখত “মৌচাকে”, তাতেও ছিল নতুন কোণ থেকে দেখবার উঁকিঝুকি। আমরা চার জন মিলে একটা সংযুক্ত উপন্যাসও আরম্ভ করেছিলাম। নাম হয়েছিল “চতুষ্কোণ”। অবিশ্যি সেটা শেষ হয় নি, শিশির আর বিনয় কখন কোন ফাঁকে কেটে পড়ল কে জানে। সেই একত্র উপন্যাস লেখার পরিকল্পনাটা আমি আর প্রেমেন পরে সম্পূর্ণ করলাম আমাদের প্রথম বই “বাঁকালেখা”য়। জীবনের লেখা যে লেখে সে সোজা লিখতে শেখেনি এই ছিল সেই বইয়ের মূল কথা।
“আভ্যুদয়িকে”র বৈঠক বসত রোজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ভালো ঘর পাইনি কিন্তু ভালো সঙ্গ পেয়েছি এতেই সকল অভাব পুষিয়ে যেত। আড্ডায় প্রথম চিড় খেল প্রেমেন ঢাকায় চলে গেলে। সেখানে গিয়ে সে “আভ্যুদয়িকে”র শাখা খুললে, শুভেচ্ছা পাঠাল এখানকার আভ্যুদয়িকদিগের :
“আভ্যুদয়িকগণ, আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
ঢাকায় এসেও আপনাদের ভুলতে পারছি না। আজ বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যায় সেই ছোট ঘরটিতে যখন জলসা জমে উঠবে তখন আমি এখানে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলব বই আর কি করব? ঢাকার আকাশ আজকাল সর্বদাই মেঘে ঢাকা, তবু কবিতার কলাপ বিকশিত হয়ে উঠছে না। আপনাদের আকাশের রূপ এখন কেমন? কোন কবির হৃদয় আজ উতলা হয়ে উঠেছে আপনাদের মাঝে, প্রথম শ্রাবণের কাজল-পিছল (দোহাই তোমার অচিন্ত্য, চুরিটা মাফ কোরো) চোখের কটাক্ষে? কার “বাদল-প্রিয়া” এল মেঘলা আকাশের আড়াল দিয়ে হৃদয়ের গোপন অন্তঃপুরে, গোপন অভিসারে?
এখানে কিন্তু “এ ভরা বাদর, মাহ—ভাদর নয়, শাঙন, শূন্য মন্দির মোর।” কেউ আপনারা পারেন নাকি মন্দাক্রান্তা ছন্দে দুলিয়ে এই শ্রাবণ-আকাশের পথে মেঘদূত পাঠাতে? কিন্তু ভুলে যাবেন না যেন যে আমি যক্ষপ্রিয়া নই।
দূর থেকে এই আভ্যুদয়িকে’র নমস্কার গ্রহণ করুন। আর একবার বলি সেই প্রাচীন বৈদিক যুগের সুরে—“সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবো মনাংসি জানতাম—”
আমরা যে যেখানেই থাকি না, আমরা আভ্যুদয়িক।”
এই সময়কার প্রেমেনের তিনখানা চিঠি—ঢাকা থেকে লেখা :
“অচিন,
আজকালকার প্রেমের একটা গল্প শোন।
সে ছিল একটি মেয়ে, কিশোরী—তনু তার তনুলতা, চোখের কোণে চঞ্চলতাও ছিল, আর তাদের বাড়ীর ছিল দোতলা কিম্বা তেতলায় একটা ছাদ। অবশ্য লাগাও আর একটা ছাদও ছিল। মেয়েটির নাম অতি মিষ্টি কিছু ঠাউরে নে—ভাষায় বললে তার মাধুৰ্য্য নষ্ট হয়ে যাবে। কৈশোরের স্বপ্ন তার সমস্ত তনুবল্লরীকে জড়িয়ে আছে, ফুটন্ত হাসনাহানায় চাঁদের আলোর মত। সে কাজ করে না, কিচ্ছু করে না—শুধু তার পিয়াসী আঁখি কোন সুদূরে কি খুঁজে বেড়ায়। একদিন ঠিক দুপুর বেলা, রোদ চড়চড় করছে অর্থাৎ রুদ্রের অগ্নিনেত্রের দৃষ্টির তলে পৃথিবী মুর্চ্ছিত হয়ে আছে—সে ভুল করে তার নীলাম্বরী শাড়ীখানি শুকোতে দিতে ছাদে উঠেছিল। হঠাৎ তার দূরাগত-পথ-চাওয়া আঁখির দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ওগো জন্মজন্মান্তরের হৃদয়দেবতা, তোমায় পলকের সৃষ্টিতেই চিনেছি—এইরকম একটা ভাব। হৃদয়দেবতাও তখন লম্বা চুলে টেড়ি কাটছিলেন, সামনেই দেখলেন তীব্র জ্বালাময় আকাশের নীচে স্নিগ্ধ আষাঢ়ের পথহারা মেঘের মত কিশোরীটিকে। আর্শির রোদ ঘুরিয়ে ফেললেন তার মুখে তৎক্ষণাৎ। “ওগো আলোকের দূত এলো তোমার হৃদয় হতে আমার হৃদয়ে।” মেয়েটি একটু হাসলে যেন দূর মেঘের কোলে একটু শীর্ণ চিকুর খেলে গেল। প্রেম হল। কিন্তু পালা এইখানেই সাঙ্গ হল না। আলোকের দূত যাতায়াত করতে লাগল। লোষ্ট্রবাহন লিপিকা তারপর। একদিন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হৃদয়দেবতার স্থূল দেহের কপাল নামক অংশবিশেষকে আঘাত করে রক্ত বার করে দিলে ও কালশিরে পড়িয়ে দিলে। হৃদয়দেবতা লিখলেন, ‘তোমার কাছ থেকে এ দান আমার চরম পুরস্কার। এই কালো দাগ আমার প্রিয়ার হাতের স্পর্শ, এ আমার জীবন পথের পাথেয়। তোমার হাতে যা পাই তাইতেই আমার আনন্দ।’ অবশ্য প্রিয়ার হাতের স্পর্শ ও জীবনপথের পাথেয়র ওপর টিঙ্কচার আয়োডিন লাগাতে কোন দোষ নেই। জীবনদেবতা তাই লাগাতেন। এবং বাড়ীর লোক কারণ জিজ্ঞাসা করলে একটা অতি কাব্যগন্ধহীন স্থূল বিশ্রী মিথ্যা বলতে দ্বিধা করেন নি, যথা—‘খেলতে গিয়ে ইটে আছাড় খেয়েছি।’
ওই পর্যন্ত লিখে নাইতে খেতে গেছলুম। আবার লিখছি। এখানে সাহিত্য জগতের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা রাখবার সুযোগ নেই। লেখা তো একেবারেই বন্ধ। My Muse is mute. কোন কালে আর সে মুখ খুলবে কিনা জানি না। মাথাটায় এখন ভারী গোলমাল। মাথা স্থির না হলে ভালো আর্ট বেরোয় না, কিন্তু আমার মাথায় ঘূর্ণি চলেছে। শরীর ভালো নয়। বিনয় আর রমেশের ঠিকানা জানি না, পাঠিয়ে দিস।
খানিক আগে ক’টা প্রজাপতি খেলছিল নীচের ঘাসের জমিটুকুর ওপর। আমার মনে হল পৃথিবীতে যা সৌন্দর্য প্রতি পলকে জাগছে, এ পর্যন্ত যত কবি ভাষার দোলনা দোলালে তারা তার সামান্যই ধরতে পেরেছে—অমৃত-সাগরের এক অঞ্জলি জল, কেউ বা এক ফোঁটা। আমরা সাধারণ মানুষ এই সৌন্দর্যের পাশ দিয়ে চলাচল করি, আর কেউ বা দাঁড়িয়ে এক অঞ্জলি তুলে নেয়। কিন্তু কিছুই হয়নি এখন। হয়ত এমন কাল আসছে যার কাব্যের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তারা এই মাটির গানই গাইবে, এই সবুজ ঘাসের এই মেঘলা দিনের কিম্বা এই ঝড়ের রাতের–কিন্তু যে সুক্ষ্মতম সুর যে পরম ব্যঞ্জনা আমরা ধরতেও পারি নি তারা তাকেই মূৰ্ত্ত করবে। আমি ভাবতে চেষ্টা কচ্ছি তখন নারীর ভেতর মানুষ কি খুঁজে পাবে। মানুষ দেহের আনন্দ নারীর ভেতর খুঁজতে খুঁজতে আজ এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে—সেদিন যেখানে গিয়ে পৌঁছাবে তার আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু আছে সৃষ্টির অন্তরে অনন্ত অমৃতের পথ—তার কোথায় আজ আমরা? চাই অমৃতের জন্যে তপস্যা। মানুষ ড্রেডনটই তৈরী করুক আর ওয়ারলেসই চালাক এ শুধু বাইরের–ভেতরের সাধনা তার অমৃতের জন্যে।”
“কিন্তু আসল কথা কি জানিস অচিন, ভালো লাগে না—সত্যি ভালো লাগে না। …বন্ধুর প্রেমে আনন্দ নেই, নারীর মুখেও আনন্দ নেই, নিখিল বিশ্বে প্রাণের সমারোহ চলেছে তাতেও পাই না কোনো আনন্দ। কিন্তু একদিন বোধ হয় পৃথিবীর আনন্দসভায় আমার আসন ছিল—অন্ধকার রাত্রে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে আকাশের পানে চাইলে মনে হত, সমস্ত দেহ-মন যেন নক্ষত্রলোকের অভিনন্দন পান করছে—অপরূপ তার ভাষা। বুঝতে পারতুম আমার দেহের মধ্যে অমনি অপূৰ্ব রহস্য অনাদি অনন্ত আকাশের ভাষায় সাড়া দিচ্ছে। আজকাল মাঝে মাঝে জোর করেই সেই আসনটুকু অধিকার করতে যাই কিন্তু বৃথাই। ভালো লাগে না, ভালো লাগে না। আশ্চর্য হয়েই ভাবি এই দেহটার মাল মশলা সবই প্রায় তেমনি আছে। হৃৎপিণ্ড তেমনই নাচছে, শিরায় শিরায় রক্ত ছুটছে, ফুসফুস থেকে নিংড়ে নিংড়ে রক্ত বেরুচ্ছে। খাড়া হয়ে হাঁটি, গলা থেকে তেমনি স্বর বেরোয়। এই সেই দেবতার দেহটা এমন হল কেন? আর সে বাজে না। নিখিল-দেবতার এই যে দেহ সে নিখিল-দেবতাকেই এমন করে ব্যঙ্গ করে কেন? …এখানে ধারা-শ্রাবণ, কিন্তু শ্রাবণঘন-গহন মোহে কারুর গোপন চরণ-ফেলা টের পাই না। বৃষ্টিতে দেশ ভেসে গেল কিন্তু আমার প্রাণে তার দৃষ্টি পড়ল না। কেবল শুকনো তৃষ্ণার্ত মাটি—নিস্পন্দ নির্জীব। বর্ষার নৃত্যসভার গান শোনবার জন্যে দেখছি মাটি পাথর মরু ফুড়ে কোণে-কোণে আনাচে-কানাচে পৃথিবীর স্থানে-অস্থানে নব নব প্রাণ মাথা তুলে উঁকি মারছে, কিন্তু আমার জীবনের নবাঙ্কুর শুকিয়ে মরে আছে। আমার মাটি সরস হল না। সেদিন রাত্রে শ্রাবণের সারঙে একটা সুর বাজছিল, সুরটা আমার বহুদিনকার পরিচিত। ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম, আশা হচ্ছিল হয়ত পুরোনো বর্ষারাত্রির আনন্দকে ফিরে পাব। কিন্তু হায়, বৃষ্টি শুধু বৃষ্টি, অন্ধকার আকাশ শুধু অন্ধকার আকাশ। এই বৃষ্টি পড়াকে ব্যাখ্যা করতে পারি অনুভব করতে পারি ইন্দ্রিয় দিয়ে কিন্তু অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি না। তাই মেঘের জল শুধু ঝরতে লাগল, আমার হৃদয় সাড়া দিলে না।
সত্যি নিজেকে আর চিনতে পারি না। তোদের যে প্রেমেন বন্ধু ছিল তাকে আমার মধ্যে খুঁজে খুঁজে পাই না। মনে হয় গাছের যে ডালপালা একদিন দুবাহু মেলে আকাশ আর আলোর জন্যে তপস্যা করত, যার লোভ ছিল আকাশের নক্ষত্র, সে ডালপালা আজ যেন কে কেটেকুটে ছারখার করে দিয়েছে। শুধু অন্ধকার মাটির জীবন্ত গাছের মূলগুলো হাতড়ে-হাতড়ে অন্বেষণ করছে শুধু খাবার, মাটি আর কাদা, শুধু বেঁচে থাকা—কেঁচোর মত বেঁচে থাকা। এ প্রেমেন তোদের বন্ধু ছিল না বোধ হয়।
বাতি নিবে গেছে। হৃদয়ের বিষাক্তবাতাসে সে কতক্ষণ বাঁচতে পারে? ‘যে প্রদীপ আলো দেয় তাহে ফেল শাস।’
মানুষের দিকে তাকিয়ে আজকাল কি দেখতে পাই জানিস? সেই আদিম পাশব ক্ষুধা—হিংসা, বিষ, আর স্বার্থপরতা। চোখের বাতায়ন দিয়ে শুধু দেখতে পাই সুসভ্য মানুষের অন্তরে আদিম পশু উৎপেতে আছে। যে চোখ দিয়ে মানুষের মাঝে দেবতাকে দেখতুম সেটা আজ অন্ধপ্রায়। আমার যেন আজকাল ধারণা হয়েছে এই যে, লোকে বন্ধুকে ভালবাসে এটা নেহাৎ মিথ্যে—মানুষ নিজেকেই ভালবাসে। যে বন্ধুর কাছে অর্থাৎ যে মানুষের কাছে সেই নিজেকে ভালবাসার অহঙ্কারটা চরিতার্থ হয়, অর্থাৎ যার কাছ থেকে সে নিজের আত্মম্ভরিতার থোক পায় তাকেই সে ভালবাসে মনে করে। দরকার মানুষের শুধু নিজেকে, শুধু নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে সে অহঙ্কার চরিতার্থ করতে চায়। বন্ধু হচ্ছে মাত্র সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবার আর্শি। ওই জন্যেই তাকে ভালবাসা। যে আর্শি থেকে নিজেকে সব চেয়ে ভাল দেখায় তাকেই বলি সব চেয়ে বড় বন্ধু। বন্ধুর জন্যে বন্ধুকে মানুষ ভালবাসে না—ওটা মিথ্যা কথা—মানুষ নিজের জন্যে বন্ধুকে ভালবাসে। শুধু স্বার্থ, শুধু স্বার্থ। তাই নয় কি?
আচ্ছা অচিন্ত্য, পড়েছিস তো, ‘এতদিনে জানলেম যে কাঁদন কাদলেন সে কাহার জন্য?’ পেরেছিস কি জানতে? সে কি প্রিয়া? সে প্রিয়াকে পাব কি মেয়েমানুষের মধ্যে? কিন্তু কই? যার জন্যে জীবনভরা এই বিরাট ব্যাকুলতা সে কি ওইটুকু? দিনরাত্রি আকাশ-পৃথিবী ছাড়িয়ে গেল যার বিরহের কান্নায় সে কি ওই চপল ক্ষুদ্র ক্ষুধায় ভরা প্রাণীটা? যাকে নিঃশেষ করে সমস্ত জীবন বিলিয়ে দিতে চাই, যার জন্যে এই জীবনের মৃত্যু-বেদনা-দুঃখ-ভয়-সংকুল পথ বেয়ে চলেছি, সে প্রিয়াকে নারীর ভেতর পাই কই ভাই! কার জন্যে কান্না জানি না বটে, কিন্তু কেন তা তো জানি—এ কথা তো জানি যে এটা দিতে চাওয়ার অশ্রান্ত কান্না। দেব, দেব—মায়ের স্তন যেমন দেবার কান্নায় ব্যথাভরা আনন্দে টলমল করে ওঠে, আমাদের সমস্ত জীবন যে তেমনি ব্যথায় কাঁপছে। কিন্তু কে নেবে ভাই? কে নেবে ভাই নিঃশেষ করে আমাকে, শিশির প্রভাতের আকাশের মত নিঃস্ব, রিক্ত, শূন্য করে, বাশির বেণুর মত নিঃসম্বল করে—কে সে অচিন?”
“কি কথা বলতে চাই বলতে পারছি না। বুকের ভেতর কি কথার ভিড় বন্ধ ঘরে মৃগনাভির তীব্র ঘ্রাণের মত নিবিড় হয়ে উঠেছে, তবু বলতে পারছি না। কত রকমের কত কথা—তার না পাই খেই না পাই ফাঁক! হাসনাহানার বন্ধ কুঁড়ির মত টনটন করছে সমস্ত প্রাণ—কিন্তু পারছি না বলতে। কাল থেকে কতবার ছন্দে দুলিয়ে দিতে চাইলুম, পারলুম না। ছন্দ দোলে না আর। বোবা বাঁশী যেন আমি, ব্যাকুল সুরের নিশ্বাস শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে—বাজাতে পারছি না। কত কথা ভাই—যদি বলতে পারতুম!
গলসওয়ার্দির Apple Tree পড়ছিলুম—না, পড়ে ফেলেছি আজ দুপুরে। সেই না-জানা আপেল-মঞ্জরীর সুবাস বুঝি এমন উদাস করেছে। তুই সেখানে পাস খুঁজে গলসওয়ার্দির Apple Tree গল্পটা পড়িস। Pan ছাড়া এ রকম love story পড়েছি বলে তো মনে পড়ছে না।
না, শুধু Apple Tree নয় ভাই, এই নতুন শরৎ আমার মনে কি যেন এক নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। মরতে চাই না, কিন্তু মরতে আর ভয়ও পাই না বোধ হয়। যে একদিন অযাচিত জীবন দিয়েছিল সেই আবার কেড়ে নেবে তাতে আর ভয় কিসের ভাই। তবে একটু সকাল-সকাল এই যা। তাতে দুঃখ আছে, ভয়ের তো কিছু দেখি না। আজ পর্যন্ত তো ভাই কোটি-কোটি মানুষ এমনি করে চলে গেছে—এমনি করে নীল আকাশ শিউলি মেঘ সবুজ ঘাস বন্ধুর ভালবাসা ছেড়ে—নিস্ফল প্রতিবাদে। তবে? জীবন কেন পেয়েছিলাম তা যথন জানি না, জানি না যখন কোন পুণ্যে, তখন হারাবার সময় কৈফিয়ৎ চাইবার কি অধিকার আছে ভাই? খোঁড়া হয়ে জন্মাই নি, অন্ধ হয়ে জন্মাই নি, বিকৃত হয়ে জন্মাইনি—মার কোল পেলাম, বন্ধুর বুক পেলাম, নারীর হৃদয় পেলাম, তা যতটুকু কালের জন্যেই হোক না—আকাশ দেখেছি, সাগরের সঙ্গীত শুনেছি, আমার চোখের সামনে ঋতুর মিছিল গেছে বার বার, অন্ধকারে তারা ফুটেছে, ঝড় হেঁকে গেছে, বৃষ্টি পড়েছে, চিকুর খেলেছে—কত লীলা কত রহস্য কত বিস্ময়! তবে জীবনদেবতাকে কেন না প্রণাম করব ভাই! কেন না বলব ধন্য আমি—নমো নমো হে জীবনদেবতা!
যা পেয়েছি তার মান কি রাখতে পেরেছি ভাই? কত অবহেলা কত অপচয় কত অপমান না করলুম! এখনো হয়তো করছি। তাই নো কেড়ে নেবে বলে জোর করে তাকে ভর্ৎসনা করতে পারি না। জানি তুলনা করে তাকে দোষ দিয়েছি কতবার, কিন্তু কি সে যে ভুল ভাই—তার খুশির দান তাতে আমার কি বলবার আছে? কারুর গলায় হয়তো সে বেশী গান দিলে, কাউকে প্রাণ বেশী, কাউকে সে সাজিয়ে পাঠালে, কাউকে না—আমায়ও তো সে রিক্ত করে জাগায়নি।
তাই ভাবি যখন যাব তখন ভয় কেন? এখনও শিরায় জোয়ার ভাটা চলছে, স্নায়ুতে সাড়া আছে, তবে চোখ বুজে মাথা গুঁজে পড়ব কেন? যেমন অজান্তে এসেছিলাম তেমনি অজান্তে চলে যাব—হয়ত শুধু একটু ব্যথা একটু অন্ধকার একটু যন্ত্রণা। তা হোক। এখন এই নীলাভ নিথর রাত্রি, এই কোমল জ্যোৎস্না, তন্দ্রালস পৃথিবীর গুঞ্জন—সমস্ত প্রাণ দিয়ে পান করি না কেন—এই বাতাসের ক্ষীণ শীতল ছোঁয়া—এই সব।
এমনি সুন্দর শরতের প্রভাতে নিষ্কলঙ্ক শিশিরের মত না একদিন এসেছিলাম অপরূপ এই নিখিলে। কত বিস্ময় সে সাজিয়েছে, কত আয়োজন কত প্ৰাচুৰ্য্য। কত আনন্দই না দেখলাম। হ্যাঁ, দুঃখও দেখেছি বটে, দেখেছি বটে কদৰ্যতা। মার চোখের জল দেখেছি, গলিত কুষ্ঠ দেখেছি, দেখেছি লোভের নিষ্ঠুরতা, অপমানিতের ভীরুতা, লালসার জন্য বীভৎসতা, নারীর ব্যভিচার, মানুষের হিংসা, কদাকার অহঙ্কার, উন্মাদ, বিকলা, রুগ্ন-গলিত শব। তবু— তবু তুলনা হয় না বুঝি!
এই যে জাপানের এতগুলো প্রাণ নিয়ে একটা অন্ধ শক্তি নির্মম খেলাটা খেললে—এ দেখেও আবার যখন শান্ত সন্ধ্যায় ঝাপসা নদীর ওপর দিয়ে মন্থর না-খানি যেতে দেখি স্বপ্নের মত পাল তুলে, যখন দেখি পথের কোল পর্যন্ত তরুণ নির্ভয় ঘাসের মঞ্জি এগিয়ে এসেছে, দুপুরের অলস প্রহরে সামনের মাঠটুকুতে শালিকের চলাফেরা দেখি, তখন বিশ্বাস হয় না আমার মত না নিয়ে আমায় এই দুঃখভরা জগতে আনা তার নিষ্ঠুরতা হয়েছে।
একটা ছোট্ট, অতি ছোট্ট পোকা—একটা পাইকা অক্ষরের চেয়ে বড় হবে না—আমার বইয়ের পাতার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখা দুটি ছড়িয়ে–কি আশ্চর্য নয়? এইবারের পৃথিৰীতে এই জীবনের পরিচিতদের মধ্যে ও-ও একজন। ওকেও যেতে হবে। আমাকেও।
কিন্তু এমন অপরূপ জীবন কেনই বা সে দেয়, কেনই বা কেড়ে নেয় কিছু বুঝতে পারি না—শুধু এইটুকুই বিরাট সংশয় রয়ে গেল। যদি এমন নিঃশেষ করে নিশ্চিহ্ন করে মূছেই দেবে তবে এমন অপরূপ করে বিস্ময়েরও অতীত করে দিলে কেন? কেন কে বলতে পারে? এত আশা এত বিশ্বাস এত প্রেম এত সৌন্দৰ্য্য—আমার জগতের চিহ্ন পৰ্যন্ত থাকবে না—কোনো অনাগত কালের তৃণের রস জোগাবে হয়ত আমার দেহের মাটি—অনাগত মানুষের নীলাকাশতলে তাদের রৌদ্রে তাদের বাতাসে তাদের ঝড়ে তাদের বর্ষায় থাকব ধূলা হয়ে বাষ্প হয়ে। প্ৰীতি-বিনিময় তোর সাথে আমার, দুদিনের জীবনবুদ্বদের সঙ্গে দুদিনের জীবনবুদ্বুদের। তবু জয়তু জীবন জয়, জয় জয় সৃষ্টি—”
কুস্তি করে সারা গায়ে মাথায় ধুলো মাটি মাখা—কাপড়ের খুঁটটা শুধু গায়ের উপর মেলে দেওয়া—সকালবেলা ভবানীপুরের নির্জন রাস্তা ধরে বাঁশের আড়বাঁশি বাজিয়ে ঘুরে বেড়াত কে একজন। কোন নিপুণ ভাস্কর্যের প্রতিমূর্তি তার শরীর, সবল, সুঠাম, সুতনু। বলশালিতা ও লাবণ্যের আশ্চর্য সমন্বয়। সে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের যে একজন শ্রেষ্ঠ ভাস্কর হবে, যৌবনের প্রারম্ভেই তার নিজের দেহে তার নির্ভুল আভাস এনেছে। ব্যায়ামে বলসাধনে নিজের দেহকে নির্মাণ করেছে গঠনগৌরবদৃপ্ত, সর্বসঙ্গত করে।
ইস্কুলে যে-বছর প্রেমেনকে গিয়ে ধরি সেই বছরই দেবীপ্রসাদ বেরিয়ে গেছে চৌকাট ডিঙিয়ে। কিন্তু ভবানীপুরের রাস্তায় ধরতে তাকে দেরি হল না। শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিট ও চৌরঙ্গীর মোড়ের জায়গাটাতে তখন একটা একজিবিশন হচ্ছে। জায়গাটার হারানো নাম পোড়াবাজার। নামের জন্যেই একজিবিশনটা শেষ পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছিল কিনা কে বলবে। একদিন সেই একজিবিশনে দেবীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা—একটি সুবেশ সুন্দর ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কইছে। ভদ্রলোক চলে গেলে জিগগেস করলাম, কে ইনি? দেবীপ্রসাদ বললে, মণীন্দ্রলাল বসু।
এই সেই? ভিড়ের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও দেখা পেলাম না। এর কত বছর পর মণীন্দ্রলালের সঙ্গে দেখা। “কল্লোল” যখন খুব জমজমাট তখন তিনি ইউরোপে। তারপর “কল্লোল” বার হবার বছর পাঁচেক পরে “বিচিত্রা”য় যখন সাব-এডিটরি করি তখন ভিয়েনা থেকে লেখা তাঁর ভ্রমণকাহিনীর প্রুফ দেখেছি।
“আভ্যুদয়িক” উঠে গেল। তার সব চেয়ে বড় কারণ হাতের কাছে “কল্লোল” পেয়ে গেলাম। যা চেয়েছিলাম হয়তো, তৈরি কাগজ আর জমকালো আড্ডা। সে সব কথা পরে আসছে।
একদিন দুজনে, আমি আর প্রেমেন, সকালবেলা হরিশ মুখার্জি রোড ধরে যাচ্ছি, দেখি কয়েক রশি সামনে গোকুল নাগ যাচ্ছে, সঙ্গে দুইজন ভদ্রলোক। লম্বা চুল ও হাতে লাঠি গোকুল চিনতে দেরি হয় না কখনো।
বললাম, ‘ঐ গোকুল নাগ। ডাকি।’
‘না, না, দরকার নেই।’ প্ৰেমেন বারণ করতে লাগল।
কে ধার ধারে ভদ্রতার! “গোকুলবাবু” “গোকুলবাবু” বলে রাস্তার মাঝেই উচ্চস্বরে ডেকে উঠলাম। ফিরল গোকুল আর তার দুই সঙ্গী।
প্রেমেনের তখন দুটি গল্প বেরিয়ে গেছে “প্রবাসী”তে—“শুধু কেরাণী” আর “গোপনচারিণী”। আর, সেই দুটি গল্প বাংলা সাহিত্যের গুমোটে সজীব বসন্তের হাওয়া এনে দিয়েছে। এক গল্পেই প্রেমেনকে তখন একবাক্যে চিনে ফেলার মত।
পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় হল। কিন্তু গোকুলের সঙ্গে ঐ দুজন সুচারুদর্শন ভদ্রলোক কে?
একজন ধীরাজ ভট্টাচার্য।
আরেকজন?
ইনি শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। সানন্দবিস্ময়ে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। বাংলা সাহিত্যে ইনিই সেই কয়লাকুঠির আবিষ্কর্তা! নিঃস্ব রিক্ত বঞ্চিত জনতার প্রথম প্রতিনিধি? বাংলা সাহিত্যে যিনি নতুন বস্তু নতুন ভাষা নতুন ভঙ্গি এনেছেন? হাতির দাঁতের মিনারচূড়া ছেড়ে যিনি প্রথম নেমে এসেছেন ধুলিম্লান মৃত্তিকার সমতলে?
বিষণ্ণ মমতায় চোখের দৃষ্টিটি কোমল। তখন শৈলজা ‘আনন্দ’ হয়নি, কিন্তু আমাদের দেখে তার চোখ আনন্দে জ্বলে উঠল। যেন এই প্রথম আলাপ হল না, আমরা যেন কত কালের পরিচিত বন্ধু।
‘কোথায় যাচ্ছেন?’ জিগগেস করলাম গোকুলকে।
‘এই রূপনন্দন না রসনন্দন মুখার্জি লেন। মুরলীবাবুর বাড়ি। মুরলীবাবু মানে ‘সংহতি’ পত্রিকার মুরলীধর বসু।’
মনে আছে বাড়িতে মুরলীবাবু নেই—কি করা—গোকুলের লাঠির ডগা দিয়ে বাড়ির সামনেকার কাঁচা মাটিতে সবাই নিজের নিজের সংক্ষিপ্ত নাম লিখে এলাম। মনে আছে গোকুল লিখেছিল G. C.—তার নামের ইংরিজি আদ্যাক্ষর। সেই নজিরে দীনেশরঞ্জনও ছিলেন D. R.। কিন্তু গোকুলকে সবাই গোকুলই বলত, G. C. নয়, অথচ দীনেশরঞ্জনকে সবাই ডাকত, D.R.। এ শুধু নামের ইংরিজি আদ্যাক্ষর নয়, এ একটি সম্পূর্ণ অর্থান্বিত শব্দ। এর মানে সকলের প্রিয়, সকলের সুহৃৎ, সকলের আত্মীয় দীনেশরঞ্জন।