অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

কল্লোল যুগ

ছয়

‘আপনি যাবেন না?’

‘তোমার কি মনে হয়?’ দুই চোখে কথা-ভরা হাসি নিয়ে তাকালেন দীনেশদা।

উজ্জ্বল দৃষ্টির মধ্য দিয়ে এমন বন্ধুতাপূর্ণ হাসি—এ আর দেখিনি কোনোদিন। সে-হাসিতে কোমল স্নেহের স্পর্শ মাখানো। পুঁজিপাটা তাঁর কিছুই ছিল না—শুধু হৃদয়ভরা নীরবনিবিড় স্নেহ আর দুই চোখের এই মাধুৰ্যময় মিত্রতা। যেন বা একটি অন্তিম আশ্রয়ের প্রশ্নহীন প্রতিশ্রুতি। সব হারিয়ে-ফুরিয়ে গেলেও আমি আছি এই অভয় ঘোষণা। তাই দীনেশরঞ্জন ছিলেন “কল্লোলে”র সব-পেয়েছির দেশ। সব-হারানোদের মধ্যমণি।

দেখতে সুপুরুষ ছিলেন। চৌরঙ্গি অঞ্চলে এস রায়ের খেলার সরঞ্জামের দোকানে যখন চাকরি করতেন, তখন সবাই তাঁকে পার্শি বলে ভুল করত। দু-চার কথা আলাপ করেই বোঝা যেত ইনি যে শুধু বাঙালি তা নন, একেবারে বিশ্বাসী বন্ধুস্থানীয়। অল্প একটু হেসে দু’ চারটি মিষ্টি কথায় দূরকে নিকট ও পরকে আপন করার আশ্চর্য জাদুমন্ত্র জানতেন। একটি বিশুদ্ধ প্রীতিস্বচ্ছ অন্তরের নির্ভুল ছায়া এসে সে চোখে পড়ত বলেই সে-জাদুমন্ত্রের মায়ায় মুগ্ধ না হয়ে থাকা যেত না। এস রায়ের দোকান থেকে চলে আসেন তিনি লিসে স্ট্রিটে এক ওষুধের দোকানে অংশীদার হয়ে। সমবেত রুগীদের এমন ভাবে যত্ন-আত্তি করতেন কে বলবে ইনিই ডাক্তার নন। মানুষের অন্তরে প্রবেশ করবার সহজ, সংক্ষিপ্ত ও ত্বরান্বিত যে পথ আছে তিনি ছিলেন সেই পথের পথকার। সে পথের প্রবেশে স্বচ্ছ-স্নিগ্ধ হাসি, প্রস্থানে অকপট আন্তরিকতা। এই সময়ে প্রায়ই নিউ মার্কেটে ফুলের স্টলে বেড়াতে আসতেন। ফুল ভালবাসতেন খুব, কিন্তু কেনবার মত স্বচ্ছলতা ছিল না। মাসে দু-এক টাকার কিনতেন বড় জোর, কিন্তু যখনই দোকানের গলিতে এসে ঢুকতেন দোকানীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত—কে কোন ফুল তাকে উপহার দেবে। অম্লান ফুলের মতই যে এর হৃদয় ফুলের জহুরিরা বুঝতে পারত সহজেই। কথা-ভরা উজ্জ্বল চোখ, হাসিভরা মিষ্টি আলাপ আর অনন্যসাধারণ সরল সৌন্দর্যবোধ—সকলের থেকেই কিছু না কিছু আদায় করে নিত অনায়াসে। শুধু ক্ষণজীবনের ফুল নয়, আমার-তোমার ইহজীবনের ভালোবাসা। অজাতশত্রু শুনেছি, কিন্তু এই প্রথম দেখলাম—জাতমিত্র। এই একজন।

এই ফুলের স্টলে ঢুকেই গোকুলের কাছাকাছি এসে পড়েন। লক্ষ্য করেন একটি উদাসীন বিমনা যুবক ছিন্নবৃন্ত ফুল গুচ্ছের দিকে করুণ চোখে চেয়ে কি ভাবছে। হয়তো ভাবছে ফুল বেচে জীবিকার্জন করতে হবে এ কি পরিহাস! পরিহাসটা আরো বেশি মর্মান্তিক হয় যখন তা আঘ্রাণেও লাগে না—আস্বাদনেও লাগে না। পুরোপুরি অন্তত জীবিকার্জনটাই কর। দীনেশরঞ্জন হাত মেলালেন গোকুলের সঙ্গে। তার বিপণি-বীথি নতুন ছন্দে সাজিয়ে দিলেন, নতুন বাচনে আলাপ করতে লাগলেন হলে-হতে-পারে খদ্দেরদের সঙ্গে। ফুল না নাও অন্তত একটু হাসি একটু সৌজন্য নিয়ে যাও বিনি-পয়সায়। আর এমন মজা, যেই একটু সেই হাসি দেখেছ বা কথা শুনেছ, নিজেরও অলক্ষিতে কিনে বসেছ ফুল। দেখতে-দেখতে গোকুলের মরা গাঙে ভরা কোটালের জোয়ার এল। তবু যেন মন ভরে না। এমন কিছু নেই যার সৌরভ অল্পযায়ী বা অল্পজীবী নয়? যা শুকায় না, বাসি হয় না? আছে নিশ্চয়ই আছে। তার নাম শিল্প, তার নাম সাহিত্য। চলো আমরা সেই সৌরভের সওদা করি। হোন তিনি এ সৃষ্টির কারিক, তবু আমরা পরের জিনিসে কারবার করব কেন? আমরা আমাদের নিজের জিনিস নিজেরাই নির্মাণ করব।

সেই থেকে ফোর আর্টস বা চতুষ্কলা ক্লাব। আর সেই চতুষ্কলার ক্ষীরবিন্দু “কল্লোল”।

মুরলীদা, শৈলজা, প্রেমেন আর আমি চারজন ভবানীপুর থেকে এক দলে, আর অন্য দলে ডি-আর, গোকুল, নৃপেন, ভূপতি, পবিত্র, সুকুমার— সকলে সদলবলে হুগলিতে এসে উপস্থিত হলাম। প্ল্যাটফর্মে স্বয়ং নজরুল। “দে গরুর গা ধুইয়ে” অভিনন্দনের ধ্বনি উঠল। পূর্ব-পরিচয়ের নজির এনে ব্যবধানটা কমাবার চেষ্টা করা যায় কিনা সে-কথা ভেবে নেবার আগেই নজরুল সবল আলিঙ্গনে বুকে টেনে নিলে—শুধু আমাকে নয়, ভনে-জনে প্রত্যেককে। তোমরা হেঁটে-হেঁটে একটু-একটু করে কাছে আস আর আমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরি–সাঁতার জানা থাকতে সাঁকোর কি দরকার!

সেটা বোধ হয় নজরুলের বড় ছেলের আকিকা উৎসবের নিমন্ত্রণ। দিনের বেলায় গানবাজনা, হৈ-হল্লা, রাতে ভুরিভোজ। ফিরতি ট্রেন কখন তারপর? “দে গরুর গা ধুইয়ে।” ফিরতি ট্রেনের কথা ফিরতি ট্রেনকে জিগগেস করো।

দুপুরে নজরুলকে নিয়ে কেউ-কেউ চলে গেলাম নৈহাটি—সুবোধ রায়ের বাড়ি। সুবোধ রায় মুরলীদার সহপাঠী, তাছাড়া সেই বছরেই তার আর সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের হাতে এসে গিয়েছে “বিজলী”—মহানিশার অন্ধকারে সেই বিদ্যুজ্জ্বালাময়ী কথা। আর তার সঙ্গে আছে কিরণকুমার রায়, সংক্ষেপে কিকুরা। তীক্ষ্ণধী সুজন-রসিক বন্ধু। কিন্তু সে নিজের আত্মপরিচয় দিতে ভালবাসে চিরকেলে সাব-এডিটর বলে। বলেই বয়েৎ ঝাড়ে : এডিটর মে কাম, এডিটর মে গো, বাট আই গো অন ফর এভার। আরো একজন আছেন—তিনি শিল্পী নাম অরবিন্দ দত্ত, সংক্ষেপে এ-ডি। নিপুণ রূপদক্ষ। কিন্তু তিনি বলেন, তার শিল্পের আশ্চর্য কৃতিত্ব তার রঙে-তুলিতে-কাগজে-কলমে তত নয়, যত তার আননমণ্ডলে। কেননা উত্তরকালে তিনি বহু সাধনায় তার মুখখানাকে চার্চিল সাহেবের মুখ করে তুলেছেন। দাঁতের ফাঁকে একটা মোটা চুরুট শুধু বাকি।

ছোটখাটো বেঁটে মানুষটি এই সুবোধ রায়, অফুরন্ত উচ্চহাস্যের ও উচ্চরোলের ফোয়ারা। প্রচুর পান খান আর প্রচুর কথা বলেন। আর, উচ্চগ্রামের সেই কথায় আর হাসিতে নিজেকে অজস্র ধারায় অবারিত করে দেন। আজো, বহু বৎসর অতিক্রম করে এসেও, সেই সরল খুশির সবল উৎসার যেন এখনো শুনতে পাচ্ছি।

আসলে সেই যুগটাই ছিল বন্ধুতার যুগ, কমরেডশিপ বা সমর্মিতার যুগ। যে যখন যার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, আত্মার আত্মজনের মত দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসা নেই, পরীক্ষা নেই, ব্যবধান নেই। সৃজনসমুদ্রের উর্মিল উত্তালতায় এক ঢেউয়ের গায়ে আরেক ঢেউ—ঢেউয়ের পরে ঢেউ। সব এক জলের কলোচ্ছ্বাস! বাঁধ ভাঙা এক বন্যার বল।

কল্লোল-যুগের আরেক লক্ষণ এই সুন্দর সৌহার্দ্য, নিকটনিবিড় আত্মীয়তা। একজনের জন্যে আরেকজনের মনের টান। একজনের ডাকে আরেকজনের প্রতিধ্বনি। এক সহমর্মিতা।

নজরুল বিষের বাঁশি বাজাচ্ছে, আর সে-সুর সে-কথা সবাইর রক্তে বিদ্রোহের দাহ সঞ্চার করছে। গলার শির জোঁকের মত ফুলে উঠেছে, ঝাঁকড়া-চুলে মাথা দোলাচ্ছে অনবরত, আর কখনো-কখনো চড়ার কাছে গিয়ে গলা চিরে যাচ্ছে দুতিন ভাগ হয়ে—সব মিলে হয়ত একটা অশালীন কর্কশতা—কিন্তু সব কিছু অতিক্রম করে সেই উন্মাদনার মাধুর্য–ইহসংসারে কোথাও তার তুলনা নেই। প্রখরতার মধ্যে সে যে কি প্রবলতা, কার সাধ্য তা প্রতিরোধ করে! কার সাধ্য সে অগ্নিমন্ত্রে না দীক্ষা নেয় মনে-মনে! এ তো শুধু গান নয় এ আহ্বান—বন্ধনবর্জনের আর্তনাদ! কার সাধ্য কান পেতে না শোনে! বুক পেতে না গ্রহণ করে।

এই
শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল!
এই
শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥
তোদের
বন্ধ-কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়,
ওরে,
ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
এই
বাঁধন পরেই বাঁধন তোদের করব মোরা জয়
এই
শিকল-বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল॥
ওরে
ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল ঝঞ্চনা
এ যে
মুক্তি পথের অগ্রদূতের চরণবন্দনা।
এই
লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা,
মোদের
অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল॥

একবার গান আরম্ভ করলে সহজে থামতে চায় না নজরুল। আর কার এমন ভাবের অভাব হয়েছে যে নজরুলকে নিবৃত্ত করে। হারমোনিয়মের রিডের উপর দিয়ে খটাখট খটাখট করে ক্ষিপ্তবেগে আঙুল চালার আর দীপ্তস্বরে গান ধরে :

মোরা ভাই বাউল চারণ মানি না শাসন বারণ

জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।

দেখে ঐ ভয়ের ফাঁসি হাসি জোর জয়ের হাসি

অ-বিনাশী নাইক মোদের ডর রে॥

যা আছে যাক না চুলায়, নেমে পড় পথের ধূলায়

নিশান দুলায় ঐ প্রলয়ের ঝড় রে।

ধর হাত ওঠরে আবার দুর্যোগের রাত্রি কাবার

ঐ হাসে মার মূর্তি মনোহর রে॥

জীবনে এমন কয়েকটা দিন আসে যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে স্মৃতিতে—অক্ষরও মুছে যায় ক্রমে-ক্রমে কিন্তু সেই স্বর্ণচ্ছটা জেগে থাকে আমরণ। তেমনি সোনার আলোয় আলো করা দিন এ। রেখা মুছে গেছে কিন্তু রূপটি আছে অবিনশ্বর হয়ে। দুপুরে গঙ্গায় স্নান, বিকালে গঙ্গায় নৌকাভ্রমণ, রাত্রে আহার—এ একটা অমৃতময় অভিজ্ঞতা। বায়ু, জল, তরু, লতা, তারা, আকাশ সব মধুমান হয়ে উঠেছে— মৃত্যুজিৎ যৌবনের আস্বাদনে। সৃষ্টির উল্লাসে বলীয়ান হয়ে উঠেছে দুর্বার কল্পনা।

সেই রাত্রে আর গান নেই, সুরু হল কবিতা। প্রেমেন একটা কবিতা আবৃত্তি করলে—বোধ হয়, “কবি নাস্তিক”। “বুক দিলে যে, ভুখ দিলে যে, দুখ দিতে সে ভুলল না, মৃত্যু দিলে লেলিয়ে পিছে পিছে।” আমিও অনুসরণ করলাম। “দে গরুর গা ধুইয়ে।” এরা আবার কবিতাও লেখে নাকি? সবাই অভিনন্দন করে উঠল এই প্রথম ও অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারে। বলো, আরো বলো—আরও যতটা মুখস্থ আছে।

ফিরতি ট্রেন কখন চলে গিয়েছে। নেমে এসেছে ক্লান্তিহরণ স্তব্ধতা। কিন্তু নৃপেন কাউকে ঘুমুতে দেবে না। যেন একটা ঘরছাড়া অনিয়মের জগতে চলে এসেছি সবাই। দেখলাম, বাড়ি ফিরে না গেলেও চলে, দিব্যি না ঘুমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায় সারারাত। প্রতিবেশী হৃদয়ের উত্তাপের পরিমণ্ডলে এসে নবীন সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করা যায়, কেননা আমরা জেনে নিয়েছি, আমরা সব এক প্রাণে প্রেরিত। এক ভবিষ্যতের দিশারী।

“বিষের বাঁশী”র ভূমিকায় নজরুল দীনেশরঞ্জনকে উল্লেখ করেছিল আমার ঝড়ের রাতের বন্ধু বলে। দীনেশরঞ্জন বয়সে আমাদের সকলের চেয়ে বড়, কিন্তু আশ্চর্য, বন্ধুতায় প্রত্যেকের সমবয়সী, একেবারে নিভৃততম, দুঃসহতম মুহূর্তের লোক। কি আকর্ষণ ছিল তাঁর, তাঁর কাছে প্রত্যেকের নিঃসঙ্কোচ ও নিঃসংশয় হবার ব্যাকুলতা জাগত। অথচ এত ঘনিষ্ঠতার মাঝেও একদিনের জন্যেও তাঁর জ্যেষ্ঠত্বের সন্ত্রম হারাননি। তাঁর দৃঢ়তাকে উচ্চতাকে অবনমিত করেননি। নিজে আর্টিস্ট ছিলেন, তাই একটি পরিচ্ছন্ন শালীনতা তার চরিত্রে ও ব্যবহারে মিশে ছিল। তারই জন্যে এত আস্থা হত তাঁর উপর। মনে হত, নিজে নিঃসম্বল হলেও নিঃসম্বলদের ঠিক তিনি নিয়ে যাবেন পরিপূর্ণতার দেশে। নিজে নিঃসহায় হলেও নিঃসহায়দের উত্তীর্ণ করে দেবেন তিনি বিপদ-বাধার শেষে শ্যামলিম সমতলতায়।

দীনেশরঞ্জনের বিদ্রোহ রাজনৈতিক নয়, জীবনবাদের বিদ্রোহ। একটা আদর্শকে সমাজে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বৈরাগ্যভূষণ সংগ্রাম। সাংসারিক অর্থে সাফল্য খোঁজেন নি, শুধু একটি ভাবকে সব কিছুর বিনিময়ে ফলবান করতে চেয়েছিলেন। সে হচ্ছে সত্যভাষণের আলো-কে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় অনির্বাণ করে রাখা। প্রতিদিনকার সাংসারিক তুচ্ছতার ক্ষেত্রে অযোগ্য এই দীনেশরঞ্জন কত বিদ্রুপ-লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন জীবনে, কিন্তু আদর্শভ্রষ্ট হননি। তাঁর দীপায়নের উৎসবে ডাক দিয়ে আনলেন যত “হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথার” ঘরছাড়াদের। বললেন, অমৃতের পুত্রকে কে বলে গৃহহীন? এই ঘরছাড়াদের নিয়েই ঘর বাঁধব আমি। থাকব সবাই মিলে একটা ব্যারাক বাড়িতে। কেউ বিয়ে করব না। বিভক্ত হব না। থাকব অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতায়। সাহিত্যের ব্রতে একনিষ্ঠ হব। মৃত্যুর পরে কোনো সহজ সুন্দর পরলোক চাই না, এই জীবনকেই নব-নব সৃষ্টির ব্যঞ্জনায় অর্থ দেব, মূল্য দেব নব-নব পরীক্ষায়।

কিন্তু গোকুলের বিদ্রোহ সাহিত্যিক বিদ্রোহ। গোকুলকে থাকতে হত তার ব্রাহ্ম মামাবাড়িতে নানারকম বিধি-বিধানের বেঁড়াজালে। সে বাড়িতে গোকুলকে গলা ছেড়ে কেউ ডাকতে পেত না বাইরে থেকে, কোনো মুহূর্তে জামা খুলে খালি-গা হতে পারত না গোকুল। এমন যেখানে কড়া শাসন, সেখান থেকে আর্টস্কুলে গিয়ে ভর্তি হল। তার অভিভাবকদের ধারণা, আর্টস্কুলে যায় যত বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো ছেলে, এবার আর কি, রাস্তায়-রাস্তায় বিড়ি ফুঁকে বেঁড়াও গে। শুধু আর্ট স্কুল নয়, সেই বাড়ি থেকেই সিনেমায় যোগ দিলে গোকুল। “সোল অফ এ শ্লেভ” ছবিতে নামল একটি বিদূষকের পার্টে। সহজেই বুঝতে পারা যায় কত বড় সংঘর্ষ করতে হয়েছিল তার সেদিনকার সেই পরিপার্শ্বের সঙ্গে। নীতি-রীতির কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে। কিছু কিছু তার ছায়া পড়েছে “পথিকে”:

“মায়া উঠিয়া মুখ ধুইয়া আসিয়া চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে গান ধরিল–

তোমার আনন্দ ঐ এলো দ্বারে

এলো–এলো–এলো গো!

বুকের আঁচলখানি I beg your pardon, miss–

সুখের আঁচলখানি ধূলায় পেতে

আঙ্গিনাতে মেল গো—’

নাঃ, আমার মুখটা দেখছি সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস কেউ ছিল না—‘বুকের আঁচল’ বলে ফেলেছিলাম!

দীপ্তি হাসিয়া বলিল—বাঃ বাঃ! দিদি, তোকে পারবার যো নেই!

মায়া। কেন, দোষটা শুধরে নিলাম তাতেও অপরাধ?

দীপ্তি। ওর নাম দোষ শুধরে নেওয়া? ও ত চিমটি কাটা।

মায়া। তা হলে আমার দ্বারা হয়ে উঠল না সভ্য হওয়া। তোদের মত ভাল মেয়ের পাশে থেকে যে একটু-আধটু দেখে শুনেও শিখব, তাও দিবি না? আচ্ছা সবাই এত রেগে যায় কেন বলতে পারিস? সেদিন যখন কমলা ঐ গানটা গাইছিল, মিসেস ডি এমন করে তার দিকে তাকালেন যে বেচারীর বুকের আঁচল বুকেই রইল, তাকে আর ধূলায় মেলতে হল না। মিসেস ডি বলে দিলেন, বই-এ ওটা ছাপার ভুল কমল, সুখের আঁচল হবে–

কমলা বলল—কিন্তু রবিবাবুকে আমি ওটা বুকের আঁচল–

মিসেস ডি বলিল—তর্ক কোর না, যা বলছি শোন। আর কমলাটারও আচ্ছা বুদ্ধি! না হয় রবিবাবু গেয়েছিলেন বুকের আঁচল–কিন্তু এদিকে বুকের আঁচলটা ধূলায় পাততে গেলে যে ব্যাপারটা হবে তার সম্বন্ধে কবির অনভিজ্ঞতাকে কি প্রশ্রয় দেওয়া উচিত?…”

“বীরেন্দ্রনাথ বলিলেন—আজকের ব্যাপারের হোষ্টেস কে?

দীপ্তি। দিদি।

মায়া ফোঁস করিয়া উঠিল—হাঁ, তা-ত হবেই, ছাই ফেলতে এমন ভাঙা কুলো আর কে আছে বল?

করুণা বলিলেন—ঝগড়াঝাঁটির দরকার কি? মেয়েদের মত তোদের ত আর সঙ্গে নিয়ে এক টেবিলে খেতে হবে না—তোরা খাওয়াবি।

মায়া বলিল—তাও ত বটে।

সুবর্ণ। টেবিলে! তার মানে? ওরা কি কখনো টেবিলে খেয়েছে? একটা বিদ্ঘুটে কাণ্ড না করে তোমরা ছাড়বে না দেখছি। চিবোনো জিনিষগুলো চারদিকে ছড়িয়ে ফেলবে—মুখে ভাত তোলার সময় সর-সর শব্দের সঙ্গে ঝর-ঝর করবে। হাতটা চাটতে চাটতে কনুই পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে–

মায়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা মা, তুমি কি কোনদিন ওঁদের খেতে দেখেছ?

সুবর্ণ। দেখব আবার কি। মেসে থাকে, এক সঙ্গে পঞ্চাশজনে মিলে বাইরের কলে চান করে আর চেঁচামেচি কাড়াকাড়ি করে খায়— আমাদের কর্পূরীটোলা লেনের বাড়ীর ছাদ থেকে একটা মেস স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়, ছেলেগুলো শুধু গায়ে বিছানার ওপর শুয়ে শুয়ে পড়ে, আর পড়ে তো কত! খাটের ছৎরিতে ময়লা গামছা আর ঘরের কোণে গামলায় পানের পিক, এ থাকবেই।”

“কল্যাণী বলিল,–মনিবাবু, আপনি আমার খুব কাছে কাছে থাকুন না–

মুনি কিছু বুঝিতে না পারিয়া কল্যাণীর মুখের দিকে চাহিল।

কল্যাণী হাসিয়া বলিল—জানেন না বুঝি, এটা ব্রাহ্মপাড়া। চারপাশের জানালাগুলোর দিকে একটু ভাল করে চেয়ে দেখুন, দেখবেন, কত ছোটবড় কত রকমের সব চোখ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আধঘণ্টার মধ্যেই গেজেট ছাপা হয়ে যাবে। ঐ যে প্রকাণ্ড হলদে রং-এর বাড়ীটা দেখছেন ওটা হচ্ছে মিসেস ডির বাড়ী, ওঁকে চেনেন না?

মনি ভীতভাবে বলিল—চলুন নীচে যাই, দরকার নেই ওসব গণ্ডগোলে।

কল্যাণী হাসিয়া বলিল—এই আপনার সাহস?

মুনি বলিল—তলোয়ারের চেয়ে জিভটাকে আমি ভয় করি। চলুন—

কল্যাণী বলিল—Its too late. ঐ দেখুন—

মুনি দেখিল প্রায় প্রত্যেক জানালা হইতে মেয়েরা বিশেষ আগ্রহের সহিত দেখিতেছে।”

“মিস লতিকা চ্যাটার্জি তাহার মাতাকে বলিল—মা, আমি এই গোল্ড-গ্রে শাড়ীটার সঙ্গে বাফ-ব্লাউজটা পরব?

মিসেস চ্যাটার্জি। ওটা না তুই মিসেস গুপ্তর পার্টিতে পরে গিয়েছিলি!

লতিকা। তবে এই ফ্লেম কলারের শাড়ী আর স্যামন পিঙ্ক ব্লাউজটা পরি, কি বল মা?

মিসেস চ্যাটার্জি। মরি মরি, যে না রূপের মেয়ে, ঠিক যেন কয়লার বস্তায় আগুন লেগেছে মনে হবে।

তাহার পর মাতা এবং কন্যার মধ্যে যে প্রহসন সুরু হইল তাহার দর্শক কেহ থাকিলে দেখিত, কাপড় জামা ঘরময় ছড়াইয়া লতিকা তাহার উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া হিষ্টিরিয়া-গ্রস্ত রোগীর ন্যায় হাত-পা ছুঁড়িতেছে এবং তাহার মাথার কাছে বসিয়া মিসেস চ্যাটার্জি তাহাকে কিলাইতেছেন।”

নজরুলের যেমন ছিল “দে গরুর গা ধুইয়ে”, গোকুলের তেমনি ছিল, “কালী কুল দাও মা, নুন দিয়ে খাই”। এমনিতে ক্লান্ত-কঠিন গম্ভীর চেহারা, কিন্তু শুকনো বালি একটু খুঁড়তে পেলেই মিলে যাবে শীতল স্নিগ্ধ জলস্পর্শ। দীনেশ আর গোকুল দু’জনেই সংসার-সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত, দু’জনেই অবিবাহিত—দু’জনের মাঝেই দেখেছি এই স্নেহের জন্যে শিশুর মত কাতরতা। স্নেহ যে কত প্রবল, স্নেহ যে কত পবিত্র, স্নেহ যে মানুষের কত বড় আশ্রয় তা দু’জনেই তাঁরা বেশি করে বুঝতেন বলে তাঁরা দুজনেই স্নেহে এত অফুরন্ত ছিলেন।

প্রেমেন ঢাকায় ফিরে যাবে, আমি আর শৈলজা তাকে শেয়ালদা স্টেশনে গিয়ে তুলে দিলাম। প্রেমেন লিখলে ঢাকা থেকে :

অচিন,

এই মাত্র ‘কল্লোল’ অফিস থেকে সংক্রান্তির ফাইলের সঙ্গে তোর, শৈলজার আর দীনেশবাবুর চিঠি পেলুম।

সারাদিন মনটা খারাপই ছিল। খারাপ থাকবারই কথা। কলেজে যাই না, এখানেও জীবনটা অপব্যয় করছি। কিন্তু তোদর চিঠি পেয়ে এমন আনন্দ হল কি বলব।

ভাই, একটা কথা তোকে আগেও একবার বলেছি, আজও একবার বলব—না বলে পারছি না। দ্যাখ ভাই, জীবনে অনেক কিছুই পাইনি, কিন্তু যা পেয়েছি তার জন্যে একবার কৃতজ্ঞ হয়েছি কি? এই বন্ধুদের ভালবাসা—এর দাম কি কোন ভালবাসার চেয়ে কম? এর দাম আমরা সব চুকিয়ে কি দিতে পেরেছি?

আদিম মানুষ অর্ধসভ্য, মানুষ ছিল একক, হিংস্র। সে আরেকটা পুরুষকে কাছে ঘেঁষতেও দিত না। (উর্দ্ধতনের গোড়ার দিকের কথা বলছি) নারীর প্রতিও তার কাম তখনও প্রেমে রূপান্তরিত হয়নি। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবু হুইটম্যান যখন sexless loveএর কথা প্রথম প্রচার করেছিলেন অনেকেই মনে-মনে হেসেছিল, এখনও অনেকে হয়ত হাসে। কিন্তু আমি জানি ভাই, মানুষ পশুত্বের সে-স্তর ছাড়িয়ে এখন যে-স্তরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে সেখানে যৌনসম্বন্ধ ছাড়াও আর একটা সম্বন্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের হওয়া সম্ভব। কথা ভাল করে হয়ত বোঝাতে পারলুম না। তবুও তুই বুঝতে পারবি জানি।

এই যে প্রেম, মানুষের অন্তরের এই যে নতুন এক প্রকাশ এটা এত দিন সম্ভব ছিল না। যৌনমিলনপিপাসা ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে দরকারী ক্ষুধা ও প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করতেই একদিন মানুষের। দিন কেটে যেত। নিজের অন্তরের গভীরতর সত্যকে তলিয়ে খুঁজে বুঝে দেখবার অবসর তার ছিল না। আজ কয়েকজনের হয়েছে বা কয়েকজন সে অবসর করে নিয়েছে।

জীবনের চরম সার্থকতা এই প্রেমের জাগরণে। যতদিন না এই প্রেম জাগে ততদিন মানুষ খণ্ডিত থাকে, সে নিজেকে পায় না সম্পূর্ণ করে। কিন্তু বন্ধুর মাঝে যেই সে আপনাকে প্রসারিত করে দিতে পারে তখনই সে-খণ্ডতার হীনতা দুঃখ ও লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়ে সার্থক হয়। আমি যতদিন বন্ধুকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতে না পারি ততদিন আমার দরজা বন্ধ থাকে। যে পথে আনন্দময় পৃথিবীর চলাচল সে-পথ আমি পাই না।

কথাটাকে কিছুতেই গুছিয়ে ভাল করে বলতে পারছি না, শুধু অন্তরে অনুভব করছি এর সত্য। এইটুকু বুঝতে পারছি প্রিয়া আমার জীবনের যতখানি, বন্ধু তার চেয়ে কম নয়। এই কমরেডশিপের মুল্য হুইটম্যান প্রথম বোঝাতে চেষ্টা করেন। আমরাও একটু বুঝেছি মনে হয়। এখানে হুইটম্যান থাকলে সেই জায়গাটা একটু তুলে দিতুম।

বন্ধুত্ব, কমরেডশিপ ইত্যাদি কথাগুলো সব জাতির ভাষাতেই বহুকাল ধরে চলে আসছে, কিন্তু এই বন্ধুত্ব কথাটার ভেতরকার অর্থের গভীরতা দিন দিন মানুষ নতুন করে উপলব্ধি করছে। পঞ্চাশ বছর আগে এ কথাটার মানে যা ছিল আজ তা নেই, আকাশের মত এ কথাটার অর্থের আর সীমা, বিস্ময়ের আর পার নেই।

আমার অন্তরের দেবতা তোর অন্তরের দেবতার মিলন-প্রয়াসী, তাই তো তুই আমার বন্ধু। আমরা নিজেদের অন্তরের দেবতাকে চিনি না ভাল করে, ক্রমাগত চেনবার চেষ্টা করছি মাত্র। বন্ধুর ভেতর দিয়েই তাকে ভালো করে চিনি।

শুধু প্রিয়াকে পেল না বলে যে কাঁদে, সে হয় মূর্খ, নয় যৌনপিপাসার স্তরে আবদ্ধ অন্ধ। প্রিয়ার মাঝেও যতক্ষণ না এই বন্ধুকে খুঁজি ততক্ষণ প্রিয়াকে পূর্ণ করে পাই না। যে প্রেম বৃহৎ সে প্রেম মহৎ। সে প্রেম প্রিয়ার মাঝে এই বন্ধুকে খোঁজে বলেই বৃহৎ ও মহৎ। প্রিয়ার মাঝে শুধু নারীকে খুঁজত ও খোঁজে পশু।

অনেকক্ষণ বললুম। তোর ভাল লাগবে কি এই একঘেয়ে বক্তৃতা? তবু না বলে পারি না, কারণ তুই যে আমার “বন্ধু”।

দিন-দিন নিজের অজ্ঞাতে একটা বিশ্বাস বাড়ছে যে মৃত্যুই চরম কথা নয়। “কিরণ” অর্থহীন জীবন বুদ্বদ ছিল না–আরো কিছু–কি?

চিঠি দিস, ওখানকার সব খবর লিখিস। খুব লম্বা চিঠি দিবি। আভ্যুদয়িকের খবর, ‘কল্লোল’ আফিসের খবর, শৈলজা, মুরলীদা, শিশির, বিনয়ের খবর ইত্যাদি ইত্যাদি সব চাই। পড়াশুনা করছি না মোটে। কি লিখছিস আজকাল? সেদিন যিনি ফল খেতে দিলেন তিনিই কি তোর মা? তোর মাকে আমার প্রণাম দিস।–তোর প্রেমেন্দ্র মিত্র

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. কিরণ দাশগুপ্ত। আমাদের বন্ধু। আত্মহত্যা করে।