মলয় রায় চৌধুরী
ঔরস
দণ্ডকারণ্যে যাবো : এগার
দণ্ডকারণ্যে যাবো আপনার বাড়ি, যদি নিয়ে যান কখনও। আর হ্যাঁ, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাবো, আপনি আমার অ্যাবসেন্সটা ম্যানেজ করে দেবেন। আপনি তো পি এইচ ডি করছেন, অসুবিধা হবার কথা নয়। অপু বলল সনাতন সরকারকে।
—চলিস আমার সঙ্গে, একা তুই রাস্তা গোলমাল করে ফেলবি। নারায়ণপুর জেলাসদর হলেও, এখনও ডেভেলাপ করেনি।
—আমার বাবার পদবি ঘোষ হলেও, আমার মা বিহারি গংগোতা পরিবারের মেয়ে, ভাগলপুর শহরে নয়, আমাদের বাড়ি গঙ্গার চরে, দিয়ারায়। দিয়ারা শুনেছেন তো? মলম লাগাবার মতো করে কথাগুলো বলল অপু, ক্যান্টিনে বসে মসালা দোসা খেতে-খেতে, সনাতনকে।
—গংগোতা? কাস্ট? তোর পাঞ্জাবি গার্লফ্রেণ্ড সে-কথা জানে, যে মেয়েটা সব সময় তোর সঙ্গে চিপকে থাকে?
—হ্যাঁ, বিহারের লোয়েস্ট নিম্নবর্ণ। হ্যাঃ, নিকিতা মাখিজা পাঞ্জাবি নয়, ও সিন্ধি। ওকে আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়েছি, বিশ্বাস করে না, ভাবে কাটিয়ে দেবার জন্য গুল মারছি। বলেছি প্রায়ভেট ডিটেকটিভ দিয়ে ইনভেসটিগেট করাতে, সে-প্রস্তাবকেও মনে করে ওকে ছেড়ে দেবার আরেক চাল। দিল্লির নাইটলাইফ এনজয় করা-মেয়ে, প্রায়ই ডিসকোয় গিয়ে টাল্লি হয়ে যায়, আর বাড়ি পৌঁছে দিতে হয় আমাকে। ওর বাবা-মা কেন যে অমন ছুট দিয়ে রেখেছেন, জানি না। ওকে আমাদের দিয়ারায় নিয়ে গেলে ওর হার্টফেল করবে।
—নিম্নবর্ণের আবার হাই-লো আছে নাকি রে, বওড়া? এনিওয়ে, তোর বাবার প্রেম তো স্যালুট করার মতন অসমসাহসী ঘটনা রে। তোর বাপ পারলেন, তোর গার্লফ্রেণ্ডও পারবে, সিন্ধিরা বেশ সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে, ওরাও উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল, কিন্তু সরকার ওদের ধরে-ধরে আদিবাসীদের মাঝখানে পোঁতেনি, যেমন আমাদের পুঁতেছে। তবে টাকাকড়িকে ওরা মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসে; চেক করে দেখেনিস তোর কাঁচা টাকা ওড়ানো দেখে তোকে ফাঁসিয়েছে কি না। সেক্স-টেক্স করলে কনডোম পরে করিস, মনে রাখিস এটা ইনডিয়ার রাজধানি, এখানে মানুষের মুখের লালায় যত সায়েনাইড, তার চেয়ে বেশি সায়েনাইড তাদের চুতে আর লাঁড়ে।
—প্রেম নয়, আমার মায়ের বাবা আমার বাবাকে কিডন্যাপ করে আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের বয়স তখন চোদ্দ বছর আর বাবার একুশ। মা লেখাপড়া শেখেননি, স্কুলের কোনো বিল্ডিংও দেখেননি আজ পর্যন্ত; বাবা কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক। সেই থেকে বাবা শশুরবাড়িতে আমার নানা, মানে দাদুর সঙ্গে থাকেন, দিয়ারায় চাষবাসের উন্নতির কাজ দেখেন। বাবা আমার মাকে নিজের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাননি, একাই গিয়েছিলেন বিয়ের পরে। গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে মাকে ওই বাড়িতে অ্যাকসেপ্ট করা হবে না। তারপরে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকেও অ্যাকসেপ্ট করা হয়নি।
—স্ট্রেঞ্জ। আমি ভাবছিলাম আমার জীবনের ঘটনাটাই ইউনিক। তুই তো নিজেই একটা ইউনিক সোশিওলজিকাল প্রডাক্ট। তো তুই বাংলা শিখলি কী করে?
—বাবার কাছে। আমি বলতে, পড়তে, লিখতে পারি।
—বাবা বাঙালি হলে না শেখার কারণ নেই, যদিও আমরা মাতৃভাষার, মানে মায়ের ভাষার কথা বলি, আদপে কিন্তু বাবার ভাষাটাই শিখি সবাই। তুই তো গ্রেট।
—আপনার জামাইবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা দেবেন আমায়। নিকিতাকে প্রথমেই দিয়ারায় আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলে ওর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমার তো বাঙালি আত্মীয়স্বজন নেই, আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবো ওকে। যদি আপনার ফ্যামিলিকে দেখে অ্যাডজাস্ট করতে পারে, তাহলে নিয়ে যাব দিয়ারার গংগোতা পাড়ায়।
—লিখে নে না। আমি বরং জামাইবাবুকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে রাখছি, যখনই তোর গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে যাবি চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে যাস। তোর নাম জানিয়ে ফোন করে দেব। আমরা মালকানগিরি থেকে চলে গেছি ছত্তিশগড়ে, আমার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান এড়াবার জন্য। দিদি-জামাইবাবু নারায়ণপুরে বাড়ি করেছেন, এখন তো নারায়ণপুর জেলা শহর, আগে যাতায়াতে বেশ অসুবিধা হতো। সরি ফর দ্য অ্যাবিউজেস। সামলাতে পারি না, বুঝলি। এত ছোটো ছিলাম যে মা-বাবার মুখও মনে নেই। ওনাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। পুলিশের লোকেরা লোপাট করার জন্য শব তুলে-তুলে জলে ফেলে দিয়েছিল।
—ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান? অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন।
—১৯৭১-এ ঢাকায় আমার দিদিকে চারজন রাজাকার রেপ করেছিল, জামাইবাবু অ্যাবর্ট করাতে দেননি। ইন ফ্যাক্ট, জামাইবাবু দিদিকে মালকানগিরিতে বিয়ে করেছিলেন, দিদি যখন প্রেগন্যান্ট, বিষ খেয়ে সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন দিদি। তখন মালাকানগিরিতে ডাক্তার-ফাক্তার ছিল না, জঙ্গল এলাকা, নব্বুই বছরের একজন বুড়ি ওকে জড়িবুটি খাইয়ে বিষ বের করে দিলে, জামাইবাবু দিদিকে ইমোশানাল সাপোর্ট দ্যান, বাচ্চা হবার কয়েকমাস আগে বিয়ে করেন।
—আমি তাই ভাবতুম যে আপনি দলিতদের এক্সট্রিম লেফটিস্ট ইউনিয়ানে কেন ঢুকেছেন। আপনার পারসোনাল ব্যাকগ্রাউণ্ড তো জানা ছিল না।
—এক্সট্রিম লেফটিস্ট? স্ট্রেঞ্জ ওয়র্ড। দিল্লির সংসদবাজ লেফটিস্টদের দেখছিস তো? অনেকে জে এন ইউতে এসে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে মাঝে-সাঝে, হোয়াট ফর?
—দণ্ডকারণ্য তো এখন শুনি আলট্রা লেফটিস্টদের ঘাঁটি।
—এই লেফটিস্ট ওয়র্ডটা কাইন্ডলি বারবার উচ্চারণ করিসনি। পোঁদ জ্বালা করে। আই হেট দেম।
—অলটারনেটিভ ওয়র্ড কী?
—প্রতিশব্দ নেই। মাওওয়াদকে প্রতিশব্দ বলা যায় না। মাওওয়াদ ইজ এ সেল্ফকনফিউজড ডগমা।
—কেন? আমি যদিও মাওওয়াদ সম্পর্কে বিশেষ জানি না, কাগজে পড়ি, ব্যাস ওইটুকু। সিলেবাসে্ও নেই।
—ওদের লক্ষ্য হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক জবরদস্ত গণআন্দোলন, ইংরেজি মাইটিকে বাংলায় জবরদস্ত বলা ছাড়া অন্য ওয়র্ড আছে কিনা জানি না।
—আমার বাংলা নলেজ আপনার চেয়ে খারাপ, হাফ বেকড। ইন ফ্যাক্ট সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটাই যে কী তা ঠিকমতন বুঝি না। সবকটা রাজনীতিককেই তো মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী, যে যার নিজের এমপায়ার খাড়া করে চলেছে।
—কী করে তুই স্নাতক হলি রে? টুকলি? না তোর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষায় বসেছিল? মওকাপরস্ত তেঁদুয়া কহিঁকা। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত করতে চায় মাওওয়াদিরা, গড়ে তুলতে চায় পাওয়ারফুল আর্বান মুভমেন্ট, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্যে, কেননা কেতাবি মার্কসবাদ মেনে সশস্ত্র কৃষকদের সংঘর্ষ এদেশের কৃষিকাঠামোয় দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতীয় বহুত্বওয়াদি বাস্তবতার ক্ষেত্রে ওগুলো কোনোটাই লাগু হয় না; তাছাড়া পৃথিবীতে কী ঘটছে সেদিকেও তো তাকাতে হবে। পৃথিবী তো রামচন্দ্রের বনবাসের দণ্ডকারণ্যে আটকে নেই, রামচন্দ্রের নির্বাসনের পথটাই নাকি রেড করিডর।
—রিয়্যালি? এই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা জিনিসটাও বুঝলুম না।
—যা যতটা বুঝেছিস, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক। জে এন ইউতে কয়েকজন নেপালি ছাত্র আছে, ওই তুই যাদের বলছিস একস্ট্রিম বা আলট্রা লেফটিস্ট। তাদের একজন, চিনিস বোধহয়, জনক বহুছা, ওর মতে রেড করিডর হল যে পথে গৌতম বুদ্ধ নেপাল থেকে বেরিয়ে তাঁর বাণী বিলিয়েছিলেন ভারতবর্ষের গ্রাম-গঞ্জ-বনপথে।
—বলুন না, থামলেন কেন? ইনটারেসটিং।
—দণ্ডকারণ্যে ওরা বৌদ্ধবিহার বানায় না, যা বানায় তার নাম দলম। দলমরা বানায় জনতম সরকার। দলম, জনতম এটসেটরা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিস যে ডিসকোর্সটা তেলুগু ডমিনেটেড। ডিসকোর্স বুঝিস তো, না তাতেও গাড্ডুস? এর আগে মানুষের ইতিহাসে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতরা সন্ত্রাসের সাহায্য নেয়নি। ওদের মতে শোষিতদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এখন সন্ত্রাস।
অপু নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, সনাতন বোধহয় মায়াবতীর দলের ভাবুক, আর এগোনো উচিত হবে না। বলল, আপনার পিসতুতো দিদির কথা বলছিলেন, যিনি আপনার অভিভাবক, তাঁর গল্প বলুন না, আপনার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশানের, যদি অসুবিধা না থাকে।
—বললাম বোধহয় একটু আগে, দিদি বাচ্চাটাকে অ্যাবর্ট করায়নি, জামাইবাবু করাতে দেননি। ভাগ্নেটা জানতে পেরে দু-দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। ভাগ্নের বয়স অবভিয়াসলি আমার চেয়ে বেশি, সেভেন্টিটুতে জন্মেছিল, আর আমি জন্মেছি ওর পাঁচ বছর পর, ভাগ্নেদা বলে ডাকি। ওকে ওর বাবার নাম জিগ্যেস করলে ও আনকনট্রোলেবলি উন্মত্ত হয়ে যায়, বলে, আমার বাবা একজন নয় চারজন, বাবাদের নাম জানি না। দিদি-জামাইবাবুর চোখাচোখি বড় একটা হতে চায় না কার্তিক, বাড়ির বাইরে সময় কাটায়। আমার ভাগ্নের নাম কার্তিক সরকার। ওকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল, নারায়ণপুর থেকে রায়পুর, কিংবা অন্যা নন-মোটোরেবল জায়গায় যাত্রীদের নিয়ে যায়; সব জায়গায় তো বাস যায় না, মোটোরেবল রোডও বিশেষ নেই নারায়ণপুর জেলার ফরেস্ট এরিয়ায়। আগে তো রেসট্রিকশান ছিল ফরেস্ট এরিয়ায় যাবার, মুরিয়া, মাড়িয়া আর গোঁড় উপজাতির লোকেরা থাকে ওখানে, ষাট বছরে কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি, সার্ভে হয়নি, সেনসাস হয়নি।
—সরকারি অফিসাররা যেতে চায় না, না? সব রাজ্যে একই ব্যাপার।
—যেটুকু কাজ তা রামকৃষ্ণ মিশন করে, এমন কি রেশনের দোকান আর স্কুলও মিশনই চালায়। বিজলি নেই, পানীয় জল নেই, মাসে এক-আধ লিটার কেরোসিন, ব্যাস।
—ফরেস্ট এরিয়ায় গেছেন?
—না তেমন করে যাইনি, রেসট্রিকশান ছিল এতদিন। নদীর জল নিয়ে, জঙ্গলের গাছ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে। তারপর গোপনীয় সৈনিক, স্পেশাল পুলিশ অফিসার, অগজিলিয়ারি ফোর্স আর সালওয়া জুড়ুমের নামে উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করানো হল। ভারতের সংবিধান ওই অঞ্চলে অস্তিত্বহীন। সালওয়া জুড়ুম আর আধামিলিট্রির সাহায্যে জঙ্গলে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা হল জাস্ট নাইটমেয়ার। কতকাল যে চলবে লড়াইটা, কেউই জানে না। ইনডিয়ার আকরিক খনিজের মানচিত্র আর ট্রাইবাল ডেনসিটির মানচিত্র একই, বুঝলি? যারা আকরিক খনিজ চায় তারা আদিবাসিদের উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে; তাদের চাই-ই চাই। প্রতিরোধ করার জন্য যা-যা করা দরকার তা আদিবাসীরা করে চলেছে, এসপার নয়তো ওসপার। ইয়াতো করনা হ্যায়, নহিঁতো মরনা হ্যায়।
অপু চুপ করে রইল, যে বিষয়ে কিছুই জানে না সে ব্যাপারে বেফাঁস কিছু যাতে না বলে ফ্যালে। প্রসঙ্গের খোঁচা ভোঁতা করার জন্য বলল, কী-কী গাছ হয় জঙ্গলে?
—সব তো আর জানি না, তবে প্রচুর পলাশ, মহুয়া, আমড়া গাছ দেখেছি। আর আছে চিকরাসি, জিলন, শিমুল, উলি, বডুলা, কড়ুয়া পাঙার, পিছলা, জারুল, জংলি বাদাম, ছাতিম এইসব।
শুনে, বুঝতে পারল অপু, ওর বাংলা জ্ঞান দিয়ে গাছের নাম চিনতে পারছে না। দিয়ারায় বসবাস করে গাছের নাম জানতে চাওয়া বোকামি হয়ে গেছে। কেবল মাথা দুলিয়ে সায় দিল, বোঝার ভান করে।
—মালিক মকবুজা শুনেছিস?
—না, কার লেখা?
—তুই তো পুরো চুতিয়াছাপ মূর্খ থেকে গেছিস রে, পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল গাণ্ডু। মালিক মকবুজা হল একটা স্ক্যাণ্ডালের নাম।
—না শুনিনি। বিহারে রোজ এতো স্ক্যাণ্ডাল হয় যে অন্য রাজ্যের স্ক্যাণ্ডাল পড়ার দরকার হয় না।
—ট্রাইবালদের ওনারশিপের নাম মালিক মকবুজা। দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে প্রচুর সেগুনকাঠের গাছ ছিল আর সেসবের মালিক ছিল স্থানীয় আদিবাসীরা। টিমবার মাফিয়ারা প্রশাসন আর রাজনীতিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আদিবাসীদের ঠকিয়ে সেগুনের গাছগুলো কেটে পাচার করে দিত, ইসকি…। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লোকায়ুক্ত একটা কমিটি গড়ে রিপোর্ট চেয়েছিল। রিপোর্টে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে নিচেতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত প্রশাসন সেগুনগাছ কাটায় আর ট্রাইবালদের ঠকানোয় ইনভলভড। সেসময়ের বস্তারের কমিশনার নারায়ণ সিং আর সালওয়া জুড়ুমের জন্মদাতা মহেন্দর করমার বিরুদ্ধে ছিল প্রধান অভিযোগ। কিন্তু অ্যাজ ইউজুয়াল সে রিপোর্ট ধামা চাপা পড়ে গেল, কারোর কিছু হল না, মাঝখান থেকে আদিবাসীগুলো জমিও হারালো আর জমির ওপরের সেগুনকাঠের গাছগুলোও, ইসকি…। রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যে আদিবাসীদের শহরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়ে বা ধমক দিয়ে বা চকচকে বোতলের মদ খাইয়ে চুক্তিতে টিপছাপ করিয়ে নেয়া হয়েছিল। যখন হইচই হয়েছিল তখন সেগুনগাছের গুঁড়িগুলোর চালান বন্ধ ছিল, তারপর সংবাদ মাধ্যম ভুলে গেল, পাবলিকও ভুলে গেল। সংবাদ মাধ্যম যে কাদের, তুই তো জানিস, ইসকি…।
—কিছুদিন আগে মারা গেছে, সেই লোকটাই মহেন্দর করমা, না?
—হ্যাঁ, মাওওয়াদিদের অনেকদিনের পেয়ারা সনম ছিল। সালওয়া জুড়ুমের ভয়ে প্রচুর আদিবাসী ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে অন্ধ্র আর মহারাষ্ট্রে; ওদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হতো, ফসল কেটে নেয়া হতো। সরকারি অফিসাররা বলে যে মাওওয়াদিদের ভয়ে ওরা ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে। দাঁতেওয়াড়ায় হাই টেনশান লাইন উড়িয়ে দশদিন অন্ধকার করে দিয়েছিল মাওওয়াদিরা। সত্যি-মিথ্যে একাকার হয়ে গেছে আমাদের দণ্ডকারণ্যে। নিম্নবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের অভিশাপ থেকে রাঘব বোয়ালের বংশই মুক্তি পেলো না, এরা তো সব চিতি-কাঁকড়া, ইসকি…।
—এ তো দেখছি কিছুটা আমাদের দিয়ারার মতন ব্যাপার। উঁচু জাত আর উঁচু চাকরির মতলবখোরি!
—আদিবাসীদের জমিজমার কোনো রেকর্ডও সরকারি দপতরে পাওয়া যায় না, ইসকি…। একবার ছানবিন করে জানা গিয়েছিল যে দুজন মুখিয়ার পাঁচশ একর করে জমির মালিকানার পাট্টা আছে, আর কারোর নামে কোনো প্রমাণ নেই। জমি নেই তো কিষাণ ক্রেডিট কার্ড হবে না। অনেকে ভোটার কার্ড কাকে বলে জানে না, বি পি এল কাকে বলে জানে না।
—ওফ, বড় বেশি কমপ্লিকেটেড আপনার এনভিরন। যাকগে, রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যেতে কোন কোন শহর পড়ে বলুন? আপনার দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সেলাম জানাতে ইচ্ছে করছে।
—কথাটা সেলাম নয়, প্রণাম।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, কারেক্ট, সরি।
—ভিলাই, দুর্গ, দাল্লি রাজহরা, ভানুপ্রতাপপুর, তারপর নারায়ণপুর। তবে রায়পুর থেকে মোটোরেবল রোডও আছে। কোন রাস্তায় যাবি তার ওপর নির্ভর করে দূরত্ব, ২২৫ থেকে ২৭৫ কিলোমিটার খানেক হবে। শর্টকাট রাস্তা হল রাওঘাট হয়ে। এখন অবশ্য বয়লাডিলার খনির জন্যে এলাকাটায় চহলপহল দেখা দিয়েছে। আগে মাওওয়াদিরা কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল, এখনও ওড়ায় মাঝে-মধ্যে, রাস্তার মাঝখানে লাশ পড়ে থাকে, পুলিশ ভয়ে সরায় না, সরাতে গেলেই বোমা ফাটার সম্ভাবনা; মরেওছে অনেক সিপাহি জওয়ান। আসাম থেকে, হরিয়ানা থেকে, তামিলনাডু থেকে, চাকরি করতে এসে বেচারাদের কি বিপত্তি।
অপুর জ্ঞান সীমিত, টের পেল অপু, দিয়ারাও তো প্রায় আদিনিবাসীদের অঞ্চল।