» » স্মৃতির জার

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

স্মৃতির জার : ছয়

বাবা-মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মন কেমন করে মাঝেসাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই-করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োরের মাংসের বড়া, আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসন মাখা, হামান দিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই। ওনার ছেলে অপু, যদিও বাংলা বলতে পারে, কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে; আরে অগর আপকা দিল নহিঁ লগতা থা তো ভাগ কেঁও নহিঁ গয়ে থে? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক। পর আপ নহিঁ ভাগে। লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুর সে হ্যায়। বিবি কহিঁ ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মণ্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম?

তারিণী মণ্ডলের হাঁটু-ডিংডং স্ত্রী, ফোকলা গুটকাদেঁতো হাসি হেসে নিজের মহিষ-কালো বরকে খুসুরফুসুর কন্ঠে বলেন, দোগলা হ্যায় না আপকা পোতা, ইসিলিয়ে বহুত দিমাগ রখতা হ্যায়। সাধারণ জারজ নয়, বাঙালি-বিহারি, উঁচুজাত-নিচুজাত, পড়াশোনাঅলা- মুখ্খু, শহুরে-গাঁইয়া, গরিব-মালদার, কানুনি-গয়েরকানুনি, কলমচি-খেতিহর, কত রকমের মিশেল।

—আরে মাথা তো খাটিয়েছিলুম আমি ছোঁড়াটাকে বন্ধক বানিয়ে, ঘরজামাইও পেলুম, আবার নসলও ভালো হয়ে গেল। এখন কয়েক পুরুষ চকচকে ফর্সা বাচ্চা পাবি; অপুর মেয়েদের বিয়ে দিতে বেশি অসুবিধা হবে না। জামাইবাবার মেয়ে না হওয়াই ভালো, কী বল? বলল তারিণী মণ্ডল, ডান চোখে হাসি মেলে। যখন সুশান্ত ঘোষকে কিডন্যাপ করেছিল, তখন অবশ্য দুটো চোখই ছিল,বাঁ চোখটা নষ্ট হয়নি রামধারী ধানুকের হামলায়।

—সে কথা ঠিক। আমি তি ভেবেছিলুম ছোঁড়াটা পালিয়ে যাবে।

—আমার মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে পালিয়ে গেলেই হল? ধরে এনে কেটে টুকরো করে দিয়ারার বালিতে পুঁতে দিতুম।

—ছোঁড়াটা ভালোবেসে ফেলেছে ওর গালফোলা বউকে। শোবার সময় রোজ রাতে খুশবুর টিন থেকে গ্যাস মারে তোমার মেয়ের গায়ে, দ্যাখো না কেমন গন্ধ ভুরভুর করে বেবির গা থেকে, মনে হয় চবুতরা জুড়ে ফুলের গাছ? ভৌঁরাভৌঁরি জোড়ি।

—তাজ্জব ব্যাপার, না? বকের সঙ্গে কোকিলের বিয়ে!

—তাজ্জবের কি আছে। এরকম কচি কুচুরমুচুর মেয়ের সঙ্গে কি ওর বিয়ে হতো ওদের নিজেদের সমাজে? কোনো দরকচা হেলাফেলা টিড্ডিছাপ বউ পেতো।

—কি যা তা বকছিস নিজের মেয়ের সম্পর্কে।

—সত্যি কথাটাই বলছি। নিজের বিয়ের কথা মনে করে দ্যাখো। তুমিও কচি কুচুরমুচুরই পেয়েছিলে। ওই কুচুরমুচুর জিনিসটাই হল মেয়েদের দুসরা দিল, যা মরদদের থাকে না। দ্বিতীয় হৃদয়ে রক্ত থাকে না, থাকে রসালো মাদকের ফাঁদ, যে ফাঁদে একবার পড়লে রোজ-রোজ পড়ার নেশায় মরদরা ভোগে, যতদিন সে মরদ থাকে ততদিন তো ভোগেই।সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই অনলাইনে কিনুন

—তা ঠিক, ছিলিস ছাপ্পানছুরি-ছইলছবিলি। এটা কোনো টিভি সিরিয়ালের সংলাপ বললি নাকি? ছোঁড়াটা নাকি প্রথম রাতেই রক্তারক্তি করে ফেলেছিল?

—হ্যাঁ। বেচারা। গলার শেকল খুলে-দেয়া শহুরে রামছাগল। কত দিনের বদবুদার তবিয়ত।

—ওদের বিয়ে দিতে এত দেরি করে কেন জানি না। কম বয়সের টাটকাতাজা রস সব বেকার বয়ে চলে যায়।

—দেরি করে বলেই তো পেলে ছোঁড়াটাকে।

তা নয়; কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত ঘোষ হয়ে গেছেন দিয়ারাচরিত্রের উন্মূল মানুষ। যখন নোট গোণার চাকরি করতেন, তখন বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্থ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান আনতেন। ব্র্যাণ্ডেড জ্যাকেট জিন্স টিশার্ট উইন্ডচিটার। দপতরের গৃহবধু কর্মীদের চোখে সুশান্ত ঘোষ ছিলেন অবিনশ্বর জাদুখোকোন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ। গেঁজিয়ে যেতে পারতেন, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছেন পৌরাণিক কিন্নরে, সবায়ের অজান্তে। গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদকের আঙুলের ছান্দসিক অস্থিরতা, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো শীতঘুম-ভাঙা টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি বা হিন্দি বা বাংলায় বা ইংরেজিতে, বলার জন্যই বলা, শ্বাসছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলতেন সুশান্ত ঘোষ।

এখন আর ওনার, সুশান্ত ঘোষের সম্পর্কে, আগাম বলা যায় না কিছু। চাকরি করতেন পচা টাকার নোট জ্বালিয়ে নষ্ট করার। এখন কাঁচা টাকার করকরে আরামে ঠ্যাং তুলে খালি গায়ে, ভুঁড়ির তলায় চেককাটা লুঙ্গি পরে, লুঙ্গির গেঁজেতে সেমিঅটোমেটিক পিস্তল, যা জীবনে কখনও চালাননি, শাশুড়ির পরানো কালো কাপড়ের ছোট্ট তাবিজ গলায়, নিজেকে অন্যমানুষে পালটে ফেলার আনন্দে তরমুজ-সোমরসের হেঁচকি তোলেন। যা একখানা চেহারা করেছেন, ওনার স্তাবকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময়ে ওনাকে বলে গেণ্ডা-মরদ অর্থাৎ আলফা গণ্ডার।

প্রতি রাতে শোবার আগে বিবসনা বউয়ের আগাপাশতলা বডি ডেওডোরেন্ট স্প্রে করেন সুশান্ত ঘোষ বা গেণ্ডা-মরদ, মানে আলফা গণ্ডার। এমন নয় যে বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের গায়ে দুর্গন্ধ; প্রথম রাতেই সুশান্ত ঘোষ একটা স্যান্ডালউড সাবান কিনে বলে দিয়েছিলেন যে রোজ এই সাবান মেখে স্নান করতে হবে, সপ্তাহে একদিন শাম্পু করতে হবে। বউই আসক্ত হয়ে গেছে ডেওডোরেণ্টের, শ্যাম্পুর, লিপগ্লসের, লিপস্টিকের, ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলির, কমপ্যাক্ট পাউডারের, ওলে টোটাল এফেক্টের, নখপালিশের, পিচ-মিল্ক ময়েশ্চারাইজার আর নানা আঙ্গিকের শিশি-বোতল-কৌটোর-ডিবের সুগন্ধের নেশায়।

শহুরে দশলাখিয়া বরকে বশ করার জন্য, টিভিসুন্দরীরা যা মাখে, তা মেখে কৃষ্ণাঙ্গী-অপ্সরা হবার প্রয়াস করে বেবি, সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর শ্যামলিমা চির-তুলতুলে বউ, আর সুশান্তর শাশুড়ি বশ করার মন্ত্রপূত তাবিজ পরিয়ে জামাইকে বেঁধে রেখেছেন বেবির আপাত-বেবিত্বে।

কোনো রাতে মাতাল অবস্থায় সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়লে, মাঝরাতে বউ ওনাকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বলে, উঠিয়ে না, নিন্দ নহিঁ আ রহল, জরা গ্যাস মার দিজিয়ে না। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা একাধিক ডেওডোরেন্টের স্প্রে থেকে যেটা হাতে পান বউয়ের পোশাকহীন গায়ে সুগন্ধী বর্ষা ছিটিয়ে এক খেপ দ্রূত-প্রেম সেরে ফেলে দুজনে দুপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন। অনেক সময়ে বেবি নামের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ আগেই হুশিয়ারি দিয়ে রাখে, জল্দিবাজি মত কিজিয়ে, ধিরজ সে কিজিয়ে, বুডঢি নহিঁ না হো গয়ে হ্যাঁয় হম।

ডেস্কটপের মনিটারে, বেবি নামের মেঠোগন্ধা শ্যামলিমা বউকে, পর্নো ফিল্ম দেখিয়ে আরো বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের। বেবি বলে, ফিলিম মেঁ জইসন কর রহা হ্যায় ওইসন কিজিয়ে না, উঠাইয়ে, লেটাইয়ে, গিরাইয়ে, গিরিয়ে, পটক দিজিয়ে, সাঁস ফুলাইয়ে, মুহ সে প্যার কিজিয়ে, হমকো ভি মৌকা দিজিয়ে। কেতনা দের তক ভোগ করতা হ্যায়, অওর আপ হ্যাঁয় কি কবুতরকে তরহ ঝপট লিয়ে বস সো গয়ে। শুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ। তারপর বলে, দেখেছেন তো ওরা কেউ পৈতে পরে না; আপনি যদি পৈতে পরতেন তাহলে সুতোর লচ্ছা সামলাতেই আমাদের সময় চলে যেত, ভালো করেছেন পৈতে পরা বন্ধ করে।

ঘুমনেশার ঘোরে সুশান্ত বলেন, আরে ওরা সব সাহেব-মেম কিংবা হাবশি, কুমিরের মাংস, বনমানুষের মাংস, ঘোড়ার মাংস, হাতির মাংস খায়, গাধার মাংস খায়।

—হাঁ, সে-কথা ঠিক, হাতিদের মতন; হাতিরা কেমন নিজেদের গোমোরের জিনিসকে লটকিয়ে হাঁটে, মাটিতে ছুঁয়ে যায়। আপনি অপুকে বিলেতে পড়াশুনা করতে পাঠাতে চাইছেন; সেখানে গিয়ে ও যদি মেম বিয়ে করে তাহলে তো সঙ্গত দিতে-দিতে হালকান হয়ে যাবে! বিয়ে দিয়ে পাঠাতে পারতেন; ওর বউ থাকত দিয়ারায় আমাদের সঙ্গে।

—ওখানে বিয়ে করার দরকার হয় না; না করেই একসঙ্গে থাকা যায়। সঙ্গত মনের মতন না হলে আরেকজনের কাছে চলে যাওয়া যায়, বুঝলি?

—তাহলে তো ভালোই, মন ভরে গেলে বাড়ি ফিরে আসবে; তখন ওর বিয়ে দেবেন।

অপুর মা, সুশান্তর মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ, পর-পর কয়েকদিন মাঝ রাতে ঘুম ভাঙাবার পর বলে ফ্যালে, চাহিয়ে তো এক বংগালন বিবি শাদি করকে লাইয়ে না পটনা য়া কলকত্তা সে, সাহব-মেম খেলিয়েগা দোনো মিলকর, জইসন নঙ্গা-ফিলিম মেঁ দিখাতা হ্যায়, কেতনা মছলি পকড়া যাতা হ্যায় অপনে হি নদী মেঁ, বড়কা-বড়কা রোহু। ঘরকা বনা মিঠাই খাতে হম লোগ সব। আপ চখতে বংগালন বিবি কি মিঠি চুচি। হমরে বিছওনে মেঁ হি, লগাকে মচ্ছরদানি, পিলাসটিকবালা গুলাবি মচ্ছরদানি। নহিঁ তো কলকত্তা যাইয়ে না, বংগালন রণ্ডিলোগন কা বাজার নহিঁ হ্যায় ওয়াহাঁ কাআআআআআআ? কমর হিলাকে আইয়ে, অইসন দুখি-দুখি মত রহিয়ে, অওর দারু মে মত ডুবে রহিয়ে রাত ভর; দারু পিকে আপ একদম সঠিয়া যাতে হ্যাঁয়। দিন মেঁ পিজিয়ে দারু, কৌনো মনা কিয়া হ্যায় কাআআআআ? রতিয়া কে বখত বদনওয়া ফিরি রখিয়ে জি।

বারবার শুনে বিরক্ত সুশান্ত একদিন বলেছিলেন, ঠিক আছে, নিয়ে আসবো একজন লেখাপড়া-শেখা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে। নাছোড়বান্দা বেবি, যাকে বলা যায় তৎক্ষণাত, প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, নিয়ে এসে দেখুন না, আপনার আর আপনার বাঙালি বউয়ের মাথা, সেই দিনই হাসুয়া দিয়ে ধড় থেকে নামিয়ে দেবো; জানেন তো আমি তারিণী মণ্ডলের মেয়ে।

—হ্যাঁ, জানি, তুই প্রথমে তারিণী মন্ডলের মেয়ে, তারপর আমার বউ। ধড়টা তো তোকে দিয়েই দিয়েছি, আর আলাদা করে নিয়ে কী করবি? আর মুণ্ডুও অনেকসময়ে তোর উরুর ঝক্কি সামলায়।

—খারাপ লাগল শুনে? তাহলে মাফ করে দিন। আমি বেবি ঘোষ, আপনিও জানেন, আমিও জানি, ভোটার লিস্টে দেখে নেবেন, আমি তো লিখাপড়হি জানি না, কিন্তু বেবি ঘোষই লেখা আছে আমার ফোটুর পাশে, ভোট দিতে গিয়ে জানতে পেরেছি। আমি বেবি মণ্ডল নই। আমার ছেলেও মণ্ডল নয়। আর বলব না, মাফ করেছেন কি না? আঁয়?

—করে দিলুম। এখন যা। দরকার হলে ডেকে নেবো।

—দাঁড়ান চান করে আসি, তারপর। ভিজে-ভিজে শরীরে আপনি যখন ফোঁটায় ফোঁটায় গুটিপোকা ফ্যালেন তবিয়ত এতো মগন হয়, গুটিপোকাগুলো সব ভেতরে গিয়ে নানা রঙের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়।

—এই জন্যই তো থেকে গেলুম; যখন বলি তখনই তুই তৈরি, ঘুম থেকে উঠে হোক, দুপুর হোক, সন্ধ্যা হোক, মাঝ রাত হোক।

—রান্না চাপিয়ে গ্যাস নিভিয়েও তো কতবার এসেছি আপনার গুটিপোকাদের ফোঁটা নিয়ে প্রজাপতি ওড়াবো বলে। ভাগ্যিস আপনাকে পেয়েছি, কোনো গংগোতা বর হলে তো যৌবন নষ্ট হয়ে যেত বছর-বছর বাচ্চা পয়দা করে।

দিয়ারা, দ্বীপের মতন চর, জেগে ওঠে, জলপ্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর, জামাইবাবার মতন, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে গঙ্গা নদীর কিনার বরাবর, ভাগলপুর কাটিহার অব্দি; এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের মতন জেগে ওঠে, খেলা করে অজস্র মানুষের সুখ-শান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গাঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস একে-ছপ্পন দিয়ে।

আচমকা যদি কখনও ওনার, সুশান্ত ঘোষের, মগজে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা ধড়মড় করে উঠে বসে জানতে চায় যে, ওহে খোকা, তুমি কি ছিলে আর কি হয়ে গেলে, তখন ছিপি খুলে গুড়ে চোলাইকরা তরমুজের সোমরসের বোতল নিয়ে বসেন, আর নিজেকে বলেন, ইতু জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে চলেছে, আমার উদ্দেশ্য আমাকে খুঁজতে হয়নি। উদ্দেশ্যই আমাকে খুঁজে নিয়েছে। আমারও কী আত্মপরিচয় আছে? কী? আমি তারিণী মণ্ডলের জামাই, বেবির স্বামী, গংগোতা ক্ল্যানের ডনের অভিনেতা! আমি কে? আমি, যার নাম সুশান্ত ঘোষ? আই অ্যাম নাথিং।

ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে লোডকরা ওনার প্রিয় গান শোনেন, বারবার, বারবার, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন, ব্যায়ঠে রহে তসব্বুর-এ-জানা কিয়ে হুয়ে, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন…। শুনতে পান, বেবি বলছে, এরকম দুখি-দুখি গান শুনছেন কেন, অন্য গানটা শুনুন না, দো দিওয়ানে শহর মেঁ, রাত মেঁ য়া দোপহর মেঁ…। ঠিক আছে, শোন, জিন্দগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়, কভি ইয়ে রুলায়ে, কভি ইয়ে হাসায়ে…।

বেবি : কী-ই বা করবেন, আমাদের দুজনের অদৃষ্ট, আর সেই শুশুকটার ইশারা, আপনি রামচন্দ্রজীর মতন দরজায় এসে যেদিন দাঁড়ালেন, তার আগের দিন গঙ্গায় শুশুক দেখে সবাই বলেছিল যে আমার জন্য গঙ্গা মাইয়া একজন রাজপুত্রকে পাঠাচ্ছেন। হ্যায় নাআআআআআ।

দুপুরের প্যাচপেচে গরমে একা বসে-বসে স্বস্তি না পেলে ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে ট্রিপল এক্স। তাতেও স্বস্তি না পেলে বেবি বলে হাঁক পাড়েন, আর বেবি ঘরে ঢুকলে, বলেন, দরোজা বন্ধ করে দে, এই নে, দেখে একটু শরীর টাটকা-তাজা করে নে, তারপর তুই শুশুক ধরিস, আমি চুচুক ধরব, তাড়াহুড়ো করব না। বেবি উত্তর দ্যায়, তাড়াহুড়ো করলে আপনার গুটিপোকাগুলো থেকে তরমুজের গন্ধ বেরোতে থাকে, ভাল্লাগে না, গ্যাসের টিন বরবাদ।

জমিন, জল, জবরদস্তি— এই তিনটের মালিকানা, একদা লালটুশ এখন ভুঁড়োকার্তিক সুশান্ত ঘোষকে করে তুলেছে বহু ফেরারির আশ্রয়দাতা। নর্থ বিহার লিবারেশান আর্মির নেতা শংকরদয়াল সিং, ফাইজান পার্টির অওধেশ মণ্ডল আর হোয়াইট অ্যান্ট পার্টির বিকরা পাসওয়ানদের পোঁদে বেয়নেট ঠেকিয়ে পুলিশ যখন তাড়িয়ে বেড়াবার খেলা খেলছিল, তখন সুশান্ত ওদের লুকিয়ে রেখেছিলেন দুষ্প্রবেশ্য নামহীন এক দিয়ারায়, গঙ্গামাটির প্রলেপ-দেয়া, ডিজেল ইনভার্টারে চালানো রুমকুলারে ঠাণ্ডাখড় আরামঘরে। ভাড়া সেভেনস্টার হোটেলের। রুম সার্ভিস চাইলে ওনার শশুর ডান্সবারের নাচিয়েদের আনান নৌকোয় চাপিয়ে, সার্ভিস হয়ে গেলে ডান্সগার্লদের ফেরত পাঠান ভোর রাতের নৌকোয় চাপিয়ে।

সুশান্ত ঘোষের পারিবারিক কিংবদন্ধি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিল ঠগি; গুড়ে চোলাই করা তরমুজের মদ টেনে সুশান্ত ঘোষ ভেবে ফ্যালেন যে হয়ত তাই তিনিও শশুরের দেয়া সুপারঠগির সিংহাসন দখল করলেন।

পুলিশ যায় না অপরিচিত কোনো দিয়ারায়; গুজব যে ভাগলপুর শহর থেকে চান করার মার্বেল-বাথটব এনে দিয়ারার বালিতে বসিয়ে রেখে গেছেন তারিণী মণ্ডলের বাবা। তাইতে নাইট্রিক অ্যাসিড ভরে একজন পুলিশের মুখবির বা ইনফরমারকে চুবিয়ে গলিয়ে ফ্যালা হয়েছিল।