অশেষ গুণসম্পন্ন শ্রীযুক্ত কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব

আশীর্বাদ ভাজনেষু

আপনি আমাকে যে কয়েক প্রশ্ন করিয়াছেন, ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ীরাই তাহার উপযুক্ত উত্তর দিতে সক্ষম। আমি ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ী নহি, এবং ধর্মশাস্ত্রবেত্তার আসন গ্রহণ করিতেও প্রস্তুত নহি। তবে সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে যে আন্দোলন উপস্থিত, তৎসম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিবার আমার আপত্তি নাই।

প্রথমতঃ—শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কোন প্রকার সমাজ সংস্কার যে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা সম্পন্ন করা উচিত, আমি এমন বিশ্বাস করি না। যখন মৃত মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ নিবারণ জন্য শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিয়া আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তখনও আমি এই আপত্তি করিয়াছিলাম, এবং এখনও পর্যন্ত সে মত পরিবর্তন করার কোন কারণ আমি দেখি নাই। আমার এরূপ বিবেচনা করিবার দুইটী কারণ আছে। প্রথম এই যে, বাঙ্গালী সমাজ শাস্ত্রে বশীভূত নহে,—দেশাচার বা লোকাচারের বশীভূত। সত্য বটে যে, অনেক সময়ে লোকাচার শাস্ত্রানুযায়ী, কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় যে, লোকাচার শাস্ত্রবিরুদ্ধ। যেখানে লোকাচার এবং শাস্ত্রে বিরোধ, সেখানে লোকাচারই প্রবল।

উপরিউক্ত বিশ্বাসের দ্বিতীয় কারণ এই যে, সমাজ সর্বত্র শাস্ত্রের বিধানানুসারে চলিলে, সামাজিক মঙ্গল ঘটিবে কি না সন্দেহ। আপনারা সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে শাস্ত্রেয় বিধান সকল অনুসন্ধান দ্বারা বাহির করিয়া, সমাজকে তদনুসারে চলিতে পরামর্শ দিতে ইচ্ছা করিতেছেন; কিন্তু সকল বিষয়েই কি সমাজ শাস্ত্রের বিধানানুসারে চলিতে বলিতে সাহস করিবেন? ধর্মশাস্ত্রের একটি বিধি এই, ব্রাহ্মণাদি শ্রেষ্ঠ বর্ণের পরিচর্যাই শূদ্রের ধর্ম। বাঙ্গালার শূদ্রেরা কি সেই ধর্মাবলম্বী? শাস্ত্রের ব্যবস্থা এখানে চলে না। আপনারা কেহ চালাইতে সাহসী হয়েন কি? চেষ্টা করিলেও এ ব্যবসা চালান যায় কি? হাইকোর্টের শূদ্র জজ জজিয়তি ছাড়িয়া, বা সৌভাগ্যশালী শূদ্র জমিদার জমিদারের আসন ছাড়িয়া, ধর্মশাস্ত্রের গৌরবার্থ লুচিভাজা ব্রাহ্মণের পদ সেবায় নিযুক্ত হইবেন কি? কোন মতেই না। বাঙ্গালী সমাজ, প্রয়োজন মতে ধর্মশাস্ত্রের কিয়দংশ মানে ; প্রয়োজন মতে অবশিষ্টাংশ অনেককাল বিসর্জন দিয়াছে। এবং সেইরূপ প্রয়োজন বুঝিলে, অবশিষ্টাংশ বিসর্জন দিবে। এমন স্থলে ধর্মশাস্ত্রের ব্যবস্থা খুঁজিয়া কি ফল? আমার নিজের বিশ্বাস যে, ধর্ম সম্বন্ধে এবং নীতি সম্বন্ধে সামাজিক উন্নতি (Religious and moral regeneration) না ঘটিলে, কেবল শাস্ত্রের বা গ্রন্থ বিশেষের দোহাই দিয়া, সামাজিক প্রথা বিশেষ পরিবর্তন করা যায় না। আমার প্রণীত কৃষ্ণ-চরিত্র বিষয়ক গ্রন্থে, ইহা আমি সবিস্তারে বুঝাইয়াছি। আমি উপরে বলিয়াছি যে, সমাজ দেশাচারের অধীন,—শাস্ত্রের অধীন নহে। এই দেশাচার পরিবর্তন জন্য ধর্ম সম্বন্ধীয় এবং নীতি সম্বন্ধীয় সাধারণ উন্নতি ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। এই সাধারণ উন্নতি কিয়ৎ পরিমাণে ঘটিয়াছে বলিয়াই এই আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে। এই উন্নতি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইলে, সমুদ্রযাত্রায় সমাজের কাহারও কোন আপত্তি থাকিবে না, কাহারও আপত্তি থাকিলেও সে আপত্তির কোন বল থাকিবে না। কিন্তু যতদিন না সেই উন্নতির উপযুক্ত মাত্রা পরিপূর্ণ হয়, ততদিন কেহই সমুদ্রযাত্রা সাধারণে প্রচলিত করিতে পারিবেন না।

তবে ইহাও বক্তব্য যে, সমুদ্রযাত্রার পক্ষে বাঙ্গালী সমাজ বর্তমান সময়ে কতদূর বিরোধী, তাহা এখন আমাদের কাহারও ঠিক জানা নাই। দেখিতে পাই যে, যাঁহার অর্থ ও অবস্থা সমুদ্রযাত্রার অনুকূলে, তিনিই ইচ্ছা করিলে ইউরোপ যাইতেছেন। সমুদ্রযাত্রা শাস্ত্রনিষিদ্ধ বলিয়া কেহ কেহ যে যান নাই, ইহা আমার দৃষ্টিগোচরে কখনও আসে নাই। তবে ইহা স্বীকার করিতে আমি বাধ্য যে, যাঁহারা ইউরোপ হইতে ফিরিয়া আসেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এক প্রকার সমাজ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া আছেন, কিন্তু তাঁহাদের দোষে কি আমাদের দোষে, তাহা ঠিক বলা যায় না। তাঁহারা এ দেশে আসিয়াই সাহেব সাজিয়া ইচ্ছাপূর্বক বাঙ্গালী সমাজের বাহিরে অবস্থিতি করেন। বিদেশীয় পরিচ্ছদ, বিদেশীয় ভোজন প্রথা এবং বিদেশীয় ব্যবহার দ্বারা আপনাদিগকে পৃথক্ রাখেন। যাঁহারা ইউরোপ হইতে আসিয়া সেরূপ আচরণ না করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ অনায়াসে হিন্দুসমাজে পুনর্মিলিত হইয়াছেন। ইউরোপ হইতে প্রত্যাগত মহাশয়েরা সকলেই দেশে ফিরিয়া আসিয়া হিন্দুসমাজসম্মত ব্যবহার করিলে, সাধারণতঃ তাঁহারা যে পরিত্যক্ত হইবেন, একথা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না।

পরিশেষে আমার এই বক্তব্য, সমুদ্রযাত্রা হিন্দুদিগের ধর্মশাস্ত্রানুমোদিত কি না, তাহা বিচার করিবার আগে দেখিতে হয় যে, ইহা ধর্মানুমোদিত কি না? যাহা ধর্মানুমোদিত, কিন্তু ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহা কি ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া পরিহার্য? অনেকে বলিবেন যে, যাহা ধর্মশাস্ত্রসম্মত, তাহাই ধর্ম, যাহা হিন্দুদিগের ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহাই অধর্ম? এ কথা আমি স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহি। হিন্দুদিগের প্রাচীন গ্রন্থে এরূপ কথা পাই না। মহাভারতে কৃষ্ণোক্তি এইরূপ আছে।

ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহুর্ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎ স্যাদ্ধারণ প্রযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।
কর্ণপর্ব একোনসপ্ততিতমোহধ্যায়, ৫৯ শ্লোক।

ধর্ম লোক সকলকে ধারণ (রক্ষা) করেন, এই জন্য ধর্ম বলে। যাহা হইতে লোকের রক্ষা হয়, ইহাই ধর্ম নিশ্চিত জানিবে।

যদি মহাভারতকার মিথ্যা না লিখিয়া থাকেন, যদি হিন্দুদের আরাধ্য ঈশ্বরাবতার বলিয়া সমাজে পূজিত কৃষ্ণ মিথ্যাবাদী না হন, তবে যাহা লোকহিতকর তাহাই ধর্ম। এই সমুদ্রযাত্রা পদ্ধতি লোকহিতকর কি না? যদি লোকহিতকর হয়, তবে ইহা স্মৃতিশাস্ত্রবিরুদ্ধ হইলেও কেন পরিত্যাগ করিব?

আমি এইরূপ বুঝি ধর্মশাস্ত্রে যাহাই আছে, তাহাই হিন্দুধর্ম নহে। হিন্দুধর্ম অতিশয় উদার। স্মার্ত ঋষিদিগের হাতে—বিশেষতঃ আধুনিক স্মার্ত রঘুনন্দনাদির হাতে—ইহা অতিশয় সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। স্মার্ত ঋষিগণ হিন্দুধর্মের স্রষ্টা নহেন,হিন্দুধর্ম সনাতনতাঁহাদিগের পূর্ব হইতেই আছে। অতএব সনাতন ধর্মে এবং এই ধর্ম্মশাস্ত্রে বিরোধ অসম্ভব নহে। যেখানে এরূপ বিরোধ দেখিব, সেখানে সনাতন ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করাই উচিত। ধর্মে এবং হিন্দুধর্মের কোন বিরোধ আমি স্বীকার করিতে পারি না। ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মে যদি কোন বিরোধ থাকে, তবে হিন্দুধর্মের গৌরব কি? উহাকে সনাতন ধর্ম বলিব কেন? এরূপ বিরোধ নাই। সমুদ্রযাত্রা লোকহিতকর বলিয়া ধর্মানুমোদিত। সুতরাং ধর্মশাস্ত্রে যাহাই থাকুক, সমুদ্রযাত্রা হিন্দুধর্মানুমোদিত।

আপনার একান্ত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী,

শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

২৩ জুলাই, ১৮৯২

কলিকাতা,

‘হিতবাদী’]

Leave a Reply