গনগনির গুপ্তধন
বিমলেন্দু চক্রবর্তী
প্রকাশক
শ্রী দ্বিজদাস কর
অণিমা প্রকাশনী
১৪১ কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট, কলকাতা-৯
ফোন : ৩৫-৭৯১৩
প্রথম প্রকাশ
জন্মাষ্টমী, ২রা ভাদ্র, ১৩৯১
১৯শে আগষ্ট, ১৯৮৪
মুদ্রক
শ্ৰী দুলাল চন্দ্র ঘোষ
নিউ লোকনাথ প্রেস
৮এ, কাশী বোস লেন
কলকাতা-৭০০০০৬
প্রচ্ছদপট ও ছবি
বিমলেন্দু চক্রবর্তী
মূল্য
আট টাকা
স্থাপত্য-শিল্পী
গোপালকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পরম সুহৃদবরেষু
লেখকের অন্যান্য রচনা :
মধ্যদিনের গান
রহস্যময় মহেনজোদড়ো
মহাসংগম
শুশুনিয়ার রহস্য
রহস্যময় আগন্তুক
প্রতিবিশ্ব
সোপান
বাঘবন্দী
সাক্ষাৎকারে ভৈরবী সাধিকা
অজন্তার কথা
ভারতের গুহাচিত্র
১
সরু চাপা গলি। দু’পাশে মাটির বাড়ি। একের পর এক মাটির ঘর। মাথায় বিচালীর চাল। মাটির দেওয়ালে লেপ্টে আছে খোলামকুচি। একখানা দু’খানা নয়—হাজার হাজার খোলামকুচি। কোনটা লাল কোনটা কালো। ফ্যাকাসে কালো রঙের খোলামকুচিও আছে।
এক দেওয়ালে পোতা আধখানা কলসীর কানা। পটলমামার চোখে পড়তেই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। চশমার ফাঁক দিয়ে বাঁকা চোখে দেখলেন। দাঁড়ালেন না। রাস্তা এখানে বাঁক খেয়েছে। একটা সরু রাস্তা নীচের দিকে নেমে গেছে। গলি-পথ আরো সরু। গলির মুখের সামনে একটা লাল বাক্স। পোষ্ট অফিস থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে চিঠিপত্র ফেলার জন্যে।
পটলমামার পাশ থেকে এঙলিঙ নীচের রাস্তায় নেমে গেলেন। ঝটপট কয়েক ধাপ এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দেওয়ালের গায় নিকষ কালো বড় একখানা খোলামকুচি। মাটির ভিতর থেকে দাঁত বের করে যেন হাসছে।
পটলমামা নামলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ দু’টি শুধু এগিয়ে গেল। তাকিয়ে আছেন দূরের মজা পুকুরের দিকে। কি যেন ভাবছেন।
এঙলিঙ বললেন, “ইউ থি….ইউ থি….”
পটলমামা দেখলেন। তাঁর কপালের চামড়ায় কয়েকটা ভাঁজ খেলে গেল। নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, “কাম ব্যাক।”
এঙলিঙ ঘুরে দাঁড়ালেন। আবার হাঁটতে শুরু করলেন। গলি বেয়ে রাস্তায় উঠে এসে পটলমামার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। দু’জনে নীরব চোখে কি যেন বললেন। তারপর হাঁটা শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে এলেন শাস্ত্রী পল্লীর শেষ প্রান্তে। সেখানেই দুর্ঘটনা ঘটলো।
গলির মধ্য থেকে হঠাৎ একটা সাইকেল এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো দু’ জনের উপর। আর একটু হলে এঙলিঙ চাপা পড়ে যেতেন। চাপা পড়লেন না। হঠাৎ সাইকেল হুড়মুড় করে কাঁধের উপর পড়তেই লাফ মারলেন। ছিটকে পড়লেন পটলমামার গায়ের উপর। দু’ জনেই পড়ে গেলেন। পটলমামার মুখ থেকে পাইপ ছিটকে পড়লো রাস্তায়।
যুবকটি পা নামিয়ে নিজেকে সামলে নিল। চোখ বুলিয়ে দেখে নিল দু’ জনকে। তারপরই সাইকেল চালিয়ে দিল। পটলমামার পাইপের উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে তীর বেগে বেরিয়ে গেল।
পটলমামা উঠে গায়ের ধুলো ঝেড়ে নিলেন। এঙলিঙ চোখের চশমা নাকে ঠিক মত লাগিয়ে ঝোলা কাঁধে তুলে নিলেন। ততক্ষণে পটলমামা পা বাড়িয়েছেন। এঙলিঙ বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর পিছনে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁদের দেখে মনে হল না এই মুহূর্তে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক পা এগোতেই শাস্ত্রী পল্লীর শেষ বাড়ি এসে গেল। মাটির দোতালা ঘর। সামনে উঠোন। উঠোনে বকুল গাছ। গাছের গোড়া সিমেণ্ট দিয়ে বাঁধানো। উল্টো দিকে বাউরী পাড়া। বাড়ির শেষ প্রান্তে কয়েকটি গাছ। বাঁয়ে উঁচু ঢিপি। ঢিপির উপর তালগাছ। তালগাছের পিছনে খাদ। খাদের পরেই চড়াই। চড়াইতে কয়েকখানা ছোট ঘর। বাউরীরা থাকে।
দু’ পা এগোতেই রাস্তার পাশে আতা গাছের নীচে হাজার হাজার ঘোড়া। ঘোড়া নয় ঘোড়ার মৃত দেহ। একের উপর আর একটা ঘোড়া মুখ থুবরে পড়ে আছে। কোন ঘোড়ার মাথা স্কন্ধচ্যুত। কোন ঘোড়ার পা ভাঙ্গা। কোন ঘোড়া চিৎ হয়ে আছে। ঠ্যাং চারটে আকাশের দিকে তুলে ধরা। রাস্তার পাশে এমন হাজার হাজার ঘোড়া দেখলে চমকে উঠতে হয়।
পটলমামা চমকালেন না। ঘোড়ার সমাধির সামনে থমকে দাঁড়ালেন। পিছনে এসে দাঁড়ালেন এঙলিঙ। এ যেন এক যুদ্ধ ক্ষেত্র। লড়াই শেষ হয়েছে। সৈন্যরা সব ফিরে গেছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে পড়ে আছে হাজার হাজার নিহত ঘোড়া। কালো আর লাল ঘোড়া। বর্ষার জল পেয়ে স্যাঁতলা জমে গেছে।
এঙলিঙ অস্পষ্ট গলায় বললেন, “ইউ থি।”
পটলমামা বললেন, “গোরাই গাজীর কবর। এগুলো মানতের ঘোড়া।”
এঙলিঙ চোখ তুললেন। দেখতে পেলেন আতা গাছের জটলার মধ্যে ইটে গাঁথা কবর। ইটগুলি দাঁত বের করে আছে। মানুষ প্রমাণ উঁচু কবরটি। ছাদ নেই। সামনের দিকে নীচু দরজা। দরজার দু’ পাশে সামান্য নক্শা। মাঝখানে সমাধি। সমাধির উপর গাছের শুকনো পাতা। কতদিন ঝাঁটা পড়ে নি যেন। ধূপকাঠী জ্বলে না আর। সন্ধ্যা হলে প্রদীপ জ্বালাতে আসে না কোন ভক্ত নারী। পরিত্যক্ত গোরাই গাজী মাটির নীচে তাঁর সব বিশ্বাস আর কর্মফল নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।
পটলমামা আবার অস্ফুট গলায় বললেন, “গোরাই গাজীর কবর।”
এঙলিঙ পটলমামার মুখে চোখ ফেললেন। পটলমামা কি বলছেন তা বুঝতে পারছেন না। এঙলিঙ গোরাই গাজীর নাম শোনেন নি।
পটলমামা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। গাঢ় স্বরে বললেন, “কিছুই থাকে না। মহাকাল সব গ্রাস করে। . যুগোত্তীর্ণ নায়ক বিস্মৃত হয়ে যায়। জঙ্গল এসে কবর দখল করে।”
এঙলিঙ মাথা কাত করে পটলমামার কথাগুলি শুনলেন। তাঁর ছোট চোখ দুটি আরও ছোট হয়ে গেল। পিট্-পিট্ করে খানিক সময় দেখলেন কবর। পাশেই জঙ্গলা গাছে ফুটে আছে হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল। বুনো ফুল। তার কয়েকটি তুলে কবরের উপর সাজিয়ে দিলেন। পটলমামা পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাইপটা খুঁজলেন। পাইপ পেলেন না। শূন্য হাত পকেট থেকে তুলে আনলেন। চোখ তুললেন আকাশে। আকাশ অনাবৃত নীলে নীল। নীল সমুদ্রের মত। সেই নীল সমুদ্রে সাদা মেঘ সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। নীলের পিছনে নীল, তার পিছনে আছে মানুষের অজানা অচেনা অজ্ঞাত এক দেশ। মৃত্যুর পরের কুহেলিকাময় সেই দেশ।
২
সামনেই দেখা গেল শীলাবতী নদী। এখান থেকে শুধু বালির এক দীর্ঘ রেখা। তার পরেই সবুজ মাঠ। সবুজ গাছের জটলা। তার ছায়ায় ছায়ায় গ্রাম আর মানুষের নিত্য দিন যাপনের সংসার।
এপারে শুধু ঢেউয়ের পর ঢেউ। নদীর ঢেউ নয়। মাটির ঢিপি। একের পর এক মাটির ঢিপি। নদীর ঢেউ যেন কার মন্ত্রে মাটি পাথরে পরিণত হয়ে স্থির হয়ে আছে।
ঢিপির মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ। পটলমামার পিছনে এঙলিঙ। দু’পাশে মাটির ঢিপি। ঢিপির উপর অসংখ্য খোলামকুচি। কোন এক খেয়ালী মানুষ যেন কয়েক হাজার হাড়ি-কলসী এখানে ভেঙে গুড়ো-গুড়ো করেছে। কবে, কোন সময়ে? উত্তর নেই। আকাশে সূর্য। তার রোদ ঢিপির উপর। লাল-কালো খোলামকুচি আর কাঁকড়। কোন কোন কাঁকর কালো। পটলমামা ঝুঁকে একটি তুলে নিলেন। বেশ ভারী। হয়তো পাথরের মধ্যে লোহা। তিনি পাথরের টুকরোটি এঙলিঙের হাতে দিলেন।
এঙলিঙ পাথরের টুকরো নাকের কাছে এনে দেখলেন। টপ্ করে পাথর আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। পাথর খণ্ড ফিরে আসতেই খপ করে লুফে নিলেন। আবার ভাল করে দেখলেন। পাথরটা পাশের জঙ্গলে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
ততক্ষণে পটলমামা অনেকটা নীচে নেমে গেছেন। এখান থেকে রাস্তা নীচু হয়ে খাদ কেটে শীলাবতীতে গিয়ে মিশেছে। যত নীচে নামা যায় তত বড় খাদ চোখে পড়ে। দু’পাশে পাথর আর কাঁকড়ের তাল দোতালা বাড়ীর মত উঁচু। উপরের দিক কালো। নীচের দিক টকটকে লাল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট খাদ। শাল গাছের চারা। তাদের আঁকাবাঁকা শিকড় সাপের মত পাক খেয়ে ঝুলে আছে।
পটলমামা থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর ডান দিকে কাঁকড়রমাটির গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটি খোলামকুচি। তিনি চোখ উপর দিকে তুললেন। আঁকা-বাঁকা শালের শিকড় আর কাঁকড়ের শক্ত দেওয়াল। এমন শক্ত মনে হয় পাথরের খোয়া ফেলে কে যেন দুরমুজ করে রেখেছে।
“ইউ থি….ইউ থি” শুনে পটলমামা ফিরে তাকালেন। তাঁর কয়েক হাত দূরে এঙলিঙ। পিছন দিকে পিঠ ঝুঁকিয়ে ঢিপির উপর চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। কুতকুতে ছোট চোখ দুটি বিস্ময়ে বিস্ফারিত। নাকটা ফুলে আছে। চশমা নীচে নেমে এসে নাকের ডগায় ঝুলছে।
পটলমামা দ্রুত এগিয়ে এলেন। এসে যা দেখলেন তা বিস্মিত হবার মতই। পাহাড়ের ফুট দুয়েক নীচে লাল মাটির স্তর। সেই স্তরে পর পর সাজানো আছে একের পর এক ভাঙ্গা হাড়ি-কলসীর টুকরো। তাদের গায়ের রং ধুসর কালো।
একি কোন শ্মশান? দেখে তাই মনে হয়। খোলামকুচির অনেক অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে। তার উপরে রোদ পড়েছে। ঝক্-ঝক্ করছে হায়েনার দাঁতের মত। কারো পিঠ পেলেই ছুবলে রক্ত বের করে নেবে।
শ্মশান আর একটু দূরে। তাই পটলমামা দাঁড়ালেন না।
ঢালু পথ এগিয়ে শীলাবতীর বালিতে হুমরী খেয়ে পড়েছে। পথের ডান পাশে শ্মশান। শ্মশানের পাশ থেকে নদীর রেখার মত বৃহৎ খাদ। দু’পাশে খাড়াই পাহাড়। বালি ভেঙে চলতে হয়। দু’পাশের পাহাড়ের গায়ে নানা রকম নক্শা। ছোট ছোট খাদ। কোথাও পাথর এগিয়ে এসেছে। রোদ পড়েছে। পাশেই দীর্ঘ ছায়া। এ যেন ঘুমন্ত রাজপুরী। একের পর এক প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দরজা সব আছে। হাঁ করে খোলা আছে। কিন্তু কোন প্রাণী নেই। নিস্তব্ধ। দুপুরের রোদে ঝিম মেরে আছে। হয়তো এককালে প্রাণ ছিল, প্রাণী ছিল, ছিল সবুজ মায়া। এখন কিছু নেই। ক্ষত বুক হাঁ করে খুলে রেখে রোদের মধ্যে হা-হা করছে।
পটলমামা শ্মশান পার হয়ে নীচে নামলেন না। দাঁড়ালেন সবুজ বাগানের সামনে। শ্মশানের বাঁয়ে উঁচু ঢিপি। ঢিপির চারিদিকে কাঠি পুঁতে বেড়া দেওয়া! মাঝখানে অনেক গাছ, গাছের পর গাছ। সবুজ পাতা, পাতার ফাঁকে ফুল। রুক্ষ লাল ঢিপির মাঝখানে যেন জীবনের সবুজ উজ্জ্বলতা।
৩
দরজা খোলাই ছিল। পর পর ইট সাজিয়ে সিড়ি তৈরী। সিঁড়ির মাথায় বিচালীর চালের ছোট মাটির ঘর। পটলমামা উপরে ওঠা শুরু করলেন। উপরে উঠতেই খানিকটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উঠোন। আরো দু’খানা মাটির ঘর। মাঝখানের ঘরে কালীর মূর্তি। কালো কালী নয়, নীল কালী। শ্মশান কালী সাধারণত নীল হয়ে থাকে।
পাশের ছোট ঘর থেকে ছ্যাক্ ছ্যাক্ আওয়াজ আসছে। একটু একটু ধোঁয়াও বাইরে এসে গাছের পাতা বেয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ওটি রান্না ঘর। মাছ ভাজার শব্দ আসছে তা এঙলিঙ বুঝতে পারলেন। তাঁর নোলায় জল এসে গেল। অন্যমনস্ক হতে গিয়ে কালীর মূর্তি দেখতে পেলেন। অমনি বলে উঠলেন, “ইউ থি, মাডাল খালি।” হাঁটু ভেঙে বসে ভক্তি সহকারে প্রণাম করলেন।
পটলমামা প্রণাম করলেন না। একটা দড়ির খাটিয়া পাতা ছিল। গিয়ে তার উপর জাঁকিয়ে বসলেন। পিঠের থলে খুলে একটা পাইপ বের করলেন। তামাক পুরে আগুন লাগিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে তাকালেন। মাথার ওপর দেখতে পেলেন আকাশমণি গাছ। কুচি-কুচি হলুদ ফুল ফুটে আছে। হাওয়ায় ডালপালা দোল খাচ্ছে। অমনি ঝাঁকে-ঝাঁকে আকাশমণি ফুল ঝরে পড়ছে। হলুদ রংয়ের যেন বৃষ্টি নামছে।
এঙলিঙ দু’-একবার রান্না ঘরের দিকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে এসে বসলেন পটলমামার পাশে। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে বললেন, “টান্ট্রিক ভৈলব ইন খিচেন লুম।” কথাটা বলে পটলমামার মুখে চোখ ফেললেন। পটলমামার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন।
খড়মের আওয়াজ শুনে চোখ খুললেন। দেখতে পেলেন দীর্ঘকায় এক পুরুষকে। গায়ের রং ফর্সা। চিবুকের নীচে কাঁচা-পাকা দাঁড়ি, মাথায় জটা নেই, আছে কাঁধ পর্যন্ত চুল। কপালে রক্ততিলক নেই দেখে এঙলিঙ হতাশ হলেন।
খড়ম বাজিয়ে সামনে এসে সাধুজী জিগ্যেস করলেন, “আপনারা?”
পটলমামা যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। বললেন, “আপনি একজন প্রাক্তন বিপ্লবী। দেশমাতৃকা ছেড়ে কালীমাতায় এলেন কেন?”
সাধুজী একটু গম্ভীর হলেন। বললেন, “আপনি যা শুনেছেন তা সত্যই শুনেছেন। তবে মায়ের মূর্তি কেন তা বলতে পারবো না। কার্যকারণ সূত্রে অনেক ওলট-পালট ঘটনা জীবনে ঘটে। ঘটে না-কি?” পটলমামার চোখে চোখ ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন।
পটলমামা বললেল, “হ্যাঁ, এ রকম ঘটে। এই দেখুন না আমাকে, এক সময় ছিলাম আবগারী দারোগা। এখন চাকরি ছেড়ে বাউণ্ডুলের মত ঘুরে মরছি।”
সাধুজী বললেন, “চাকরি ছেড়ে দিলেন!”
পটলমামা বললেন, “হ্যাঁ। পাগলামী বলতে পারেন। তবে এ রকম পাগলামীও কোন কোন মানুষ করে।”
পটলমামা আবগারী দারোগা ছিলেন শুনে এঙলিঙ খিক্ থিক্ করে হেসে উঠলেন। পটলমামা ফিরে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে হাসি থামালেন। পটলমামা ডাহা মিথ্যা পরিচয় দিচ্ছিলেন বলেই এঙলিঙের হাসি পেয়েছিল।
সাধুজী এঙলিঙকে দেখে একটু বিস্মিত হলেন। বললেন, “ইনি?”
পটলমামা বললেন, “মিঃ এঙলিঙ। তিব্বতী দার্শনিক।”
এঙলিঙ মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে ফিক্ করে একটু হেসে দিলেন। বললেন, “ইউ থিত দাউন।”
সাধুজী ভাঙ্গা চেয়ারটায় চেপে বসলেন। বসে দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে কাঁচা-পাকা দাঁড়িকে পরিপাটি করে বললেন, “আপনার নামটি জানতে পারি? আমার নাম সুকুমার রায়। এই গড়বেতারই মানুষ।”
পটলমামা ঘরের মধ্যে কালীমূর্তির দিকে একবার তাকালেন। চোখ ফিরিয়ে এনে বললেন, “হারাধন চক্রবর্তী।”
পটলমামা নিজের নাম ‘হারাধন চক্রবর্তী’ বলতেই এঙলিঙ ফিক্ করে হাসতে গিয়ে পটলমামার চোখে চোখ পড়তেই হাসি আটকে ফেললেন।
সাধুজী নাম শুনে সামান্য একটু হাসলেন। পটলমামা সে হাসি দেখতে পেলেন বলে লজ্জা পেলেন। হাসি সামলে লজ্জিতভাবে বললেন, “ডাক-সাইটে আবগারী দারোগার নাম হারাধন। যে ধন হারিয়ে গেছে তাইতো হারাধন।”
তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
হাসি থামতেই পটলমামা ঝট্ করে উঠে পড়লেন। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন সাইকেলটিকে। সেই পথের যুবকটি সাইকেল নিয়ে নীচের উৎরাইতে দাঁড়িয়ে আছে। পটলমামাকে দেখতে পেয়েই ঝট্ করে সরে গেল। সাইকেল চালিয়ে ঢিপির আড়ালে চলে গেল।