১৯
এঙলিঙ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। দর দর করে ঘামছেন। কেউটে সাপ মাথা বের করে তেমনি দোল খাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। একটু পরেই কালি-গোলা অন্ধকারে ঢাকা পড়বে গর্ত। কেউটে সাপ তখন কি করবে বোঝা যাচ্ছে না।
একবার ভাবলেন, কাঁধের থলেটা দিয়ে সপাটে মারেন ফণার উপর। যদি হাত কেঁপে যায়? মাথাটা যদি না থেতলায়? সুরুৎ করে কেউটে নেমে আসবে মাটিতে। তারপর অন্ধকারের মধ্যে একটা ক্রুদ্ধ কেউটে আর তিনি।
তবু ঝোলাটাকে পিঠ থেকে টেনে নামালেন। হাতে থাকলে ঢালের মত করে ধরে হয়তো সাপের ছোবল এড়িয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু তা কতক্ষণ! এঙলিঙ নড়তে এখন ভয় পাচ্ছেন। অন্ধকারের মধ্যে নড়তে দেখে সাপটা ফোঁস করে নেমে আসার সম্ভাবনা আছে। ধীরে ধীরে নীচু হতে থাকলেন। তিল তিল করে নিজেকে নীচু করছেন। হাত নীচে নামছে। এক সময় হাতের থলে মাটির নাগাল পেল। থলে নামালেন।
একটুও না নড়ে ধীরে ধীরে সোজা হলেন। পকেট থেকে দিয়াশলাই সাবধানে বের করলেন। হাতে দিয়াশলাই থাকলো, অন্তত আলো জ্বেলে একটু সময় অন্ধকার দূর করতে পারবেন।
পায়ের কাছে ঠাণ্ডা লাগলো। সাপটা নেমে এল নাকি? ভয় পেয়ে এঙলিঙ ফস্ করে কাঠি জ্বালালেন। অন্ধকার গিয়ে আলো ঝলসে উঠলো। তখন সাপটাকে দেখতে পেলেন। আলো দেখে ঘাবড়ে গিয়ে একটু একটু করে মাথা ভিতর দিকে ঢুকিয়ে নিচ্ছে সাপটা।
এঙলিঙ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণে একটা কৌশল বের করতে পেরেছেন। হয়তো গর্তের ভিতর সাপটাকে আটকে ফেলতে পারবেন। তা করতেই হবে। নয়তো বাঁচার কোন উপায় নেই।
ফস্ করে আবার কাঠি জ্বালালেন। সাপ আর একটু ভিতরে ঢুকে গেল। আবার জ্বালালেন। সাপ মাথা আরো ঢুকিয়ে নিল। পকেটের মধ্যে কাগজ আছে মনে এল।
একখানা কাগজ টেনে বের করে কাঠির উপর ধরলেন। চোখ সাপের গর্তে। কাগজে আগুন লাগলো না। কাগজ আগুনের ছোয়া পায় নি।
কাঠি নিভে যেতেই আবার অন্ধকার। ফস্ করে আবার কাঠি জ্বালালেন। না, সাপ বেরিয়ে আসে নি। এবার কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ ধরলেন। কাগজ জ্বলে উঠলো। গর্ত কাগজের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠলো। সাপ ভয় পেয়ে আরো ভিতরে ঢুকলো।
সরু একখানা পাথর দেখতে পেলেন এলিঙ। লাল মাটির মধ্যে থেকে দাঁত বের করে আছে।
ধরে টান দিতেই একটু মাটি ঝরে পড়লো, পাথর খসলো না। সর্বশক্তি দিয়ে আবার টান দিলেন। এবারে পাথরখানা আলগা হয়ে উঠে এল।
পাথরের টুকরোটি নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন। মুহূর্তে গর্তের মুখে ঠেসে গুঁজে দিলেন। তারপর পাগলের মত তাকে চাপতে লাগলেন।
পাথরখানা ভিতরে ঢুকলো।
আবার কাগজ জ্বালালেন। আর একখানা পাথর খুলে সেখানাও ঠেশে ঢুকিয়ে দিলেন! নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারলেন না। আর একখানা পাথর খসাতে গেলেন। পাথরখানা খসাতে পারলেন না। উত্তেজনায় তাঁর বুক হাঁপরের মত ফুঁসছে। কপাল বেয়ে ঘাম নামছে। হাত পা কাঁপছে। পাথর খসছে না। এগুলিঙ এত জোরে টান দিলেন যে হঠাৎ পাথরখানা বেরিয়ে এল।
তিনি ছিটকে পড়লেন দূরে। মাথায় লাগলো। অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
২০
চোখ খুলে তাকালেন। সূচিভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে বসে আছেন কেন বুঝতে পারলেন না। মাথা ভারী। চেতনা শিথিল। উপরে চোখ গেল। অন্ধকারের মধ্যে মাথার উপর চুমকী লাগানো কালো চাঁদোয়া। কে টানালো?
ধীরে ধীরে সব মনে পড়লো। গর্তের মুখে বসে গর্তের গা দেখা। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়া। অমনি তীরের ফলার মত মনে এল সাপের কথা। চোখের উপর যেন দেখতে পেলেন সাপটিকে। বিশাল ফণা তুলে তুলছে। মাথার উপর খড়মের ছাপ। বিষধর কাল কেউটে। জিভ বের করে হাওয়া চেটে যেন এঙলিঙকে বুঝে নিতে চাইছে।
বুকের মধ্যে যেন কে ছুরি বসিয়ে দিল। আকণ্ঠ-তৃষ্ণা। ভয় এসে সাঁড়াশীর মত গলা চেপে ধরেছে। চীৎকার করে উঠলেন, “হেল্প মী…. হেল্প মী….”
আর চীৎকার করতে হোল না। তার আগেই এক ঝলক আলো গর্তের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েছে। এঙলিঙের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। উপরে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। উপর থেকে গর্তে আলো ফেলছে।
এঙলিঙ বললেন, “হেল্প্ মী।”
উপর থেকে আওয়াজ এল, “সিওর।” তার পরেই অন্ধকার। আলো নিভিয়ে দিয়েছে। এঙলিঙ উপরের সামান্য আলোতে এবার দেখতে পেলেন তাদের। চার-চারটি যুবক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাথার উপর আকাশ। আকাশে তারা।
অন্ধকার দেখে আবার সাপের কথা মনে এল তাঁর। চীৎকার করে উঠলেন, “প্লীজ হেল্প মী। থেনেক্, এ বিগ থেনেক্, কাল কেউতে…..”
আবার তারা টর্চ জ্বাললো। আলো ঝাপিয়ে পড়লো গর্তের মধ্যে। সাপটাকে দেখা গেল না। গর্তের মুখে পাথরখানা আটকে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এঙলিঙ। এতক্ষণে স্বাভাবিক হতে পারলেন তিনি।
একটা গাছের ডাল নেমে এল গর্তের ভিতর। মাঝে মাঝে তার গাট। দেখতে এক কাঠি সিঁড়ির মত। আলো ফেলে জিজ্ঞাসা করলো, “উঠতে পারবেন?”
তিনি ভালো করে সিঁড়ি দেখলেন। বললেন, “থিওল-থিওল।”
নীচু হয়ে ঝোলা তুলে নিলেন পিঠের উপর। ডাল আঁকড়ে লাল মাটির দেওয়ালে পা রেখে রেখে উঠতে লাগলেন।
আলো নিভলো না। আলো জ্বেলে রেখে সাহায্য করতে লাগলো তারা। উপরে উঠতেই একজন খপ করে চেপে ধরলো তাঁর হাত। চাপা গলায় বললো, “পেয়েছি।”
তিনি প্রতিবাদ করলেন না। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
কঠিন গলায় একজন বললো, “সোজা হাঁটবেন। কোন রকম “ফিকির করবার চেষ্টা করবেন না। গুলি করে মাথার চাঁদী উড়িয়ে দেবো।” পিস্তলটা একেবারে কপালের উপর চেপে ধরলো।
একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ কপাল বেয়ে বুকে নেমে এল। ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলেন এঙলিঙ। এক ঝম্কায় হৃদপিণ্ডের রক্ত থমকে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করলো। তিনি কথা বললেন না, হাঁটতে শুরু করলেন।
এঙলিঙ হাঁটছেন। তাঁর সামনে একজন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। দু’পাশে দু’জন। পিছনে একজন। তার হাতে উদ্ধত পিস্তল, না দেখেও তিনি বুঝতে পারলেন।
শালবনের মধ্যে ডানে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুলেন একটা কাঁটা ঝোপের পাশে। তার দু’ পাশে দুটো উইয়ের ঢিপি। এত বড় উইয়ের ঢিপি এঙলিঙ কখনো দেখেন নি। পাহাড়ের চূড়ো সাজিয়ে দাঁড়িয়ে জায়গাটাকে শালবন থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
ঢিপির মাঝখানে এসে এঙলিঙের সবার আগে মনে এল সাপের কথা। এইসব উইয়ের ঢিপির মধ্যে বাস করে কেউটে সাপ। আবার সেই সাপের আস্তানায়! ঘাবড়ে গিয়ে বসলেন, “থেনেক্।”
চারজনের কেউ জবাব দিল না। একজন ফস্ করে দিয়াশলাই জ্বালালো। একখানা মোম জ্বেলে বসিয়ে দিল। এঙলিঙ দেখতে পেলেন আর একজনকে। একপাশে মাটির উপর বসে আছে। চোয়াল শক্ত। মাথায় রুমাল বাঁধা। নাকের নীচে নকল গোঁফ। হাতের কাছে একটা পিস্তল। আলো লেগে চক্ চক্ করছে।
লোকটির গায় ঘিয়ে রংয়ের পাঞ্জাবী। বোতাম খোলা। দেখা যাচ্ছে গড়ানো-পেটানো বুকের অংশ।
প্রথমে সে-ই কথা বললো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “হু আর ইউ?”
চট্ করে প্রশ্নের জবাব দিলেন না, দিতে পারলেন না। এ রকম বিচিত্র পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন তা কখনো ভাবেন নি। কি জবাব দেবেন তা আগে থেকে ভেবে নেওয়া দরকার। সামান্যতম ভুলে একটা সিসের গুলি এসে মাথায় গেঁথে যেতে পারে। আর উঠতে হবে না। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হবে এই শালবনে। মানুষ তাঁর মৃত দেহের খোঁজ না পেলেও শকুন পাবে। শেষ পর্যন্ত শকুনের খাদ্য হতে হবে?
যুবকটি অসহিষ্ণু হল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললো, “আপনি কে?”
আর একটি যুবক বিরক্তির সঙ্গে বললো, “আজ চার-পাঁচ দিন ধরে দেখছি শুধু ঘুর-ঘুর করছেন। গড়বেতায় ঘুর-ঘুর করার কি আছে?”
এঙলিঙ চোখ তুলে যুবকটিকে দেখলেন। নাকের নীচে সদ্য গজিয়ে ওঠা গোঁফ। লম্বা চুল। কালো প্যাণ্ট আর বুক খোলা হাফকলার সার্ট গায়ে চাপিয়েছে। চোখের তারা জ্বল জ্বল করছে। তীব্র এক আলো জ্বলছে সেখানে। মানুষ যখন সব কিছু গুঁড়িয়ে নিজের মত করে নিতে চায় তখন এরকম আলো চোখে জ্বলে তা তিনি জানেন।
বসে থাকা যুবকটি আবার প্রশ্ন করলো, “আপনি কে?”
তিনি মাথায় ঝাকুনি দিলেন। হাতখানি বুকের উপর এনে নিজেকে দেখিয়ে বললেন, “এঙলিঙ। এ ওল্দ, আই মিন্ ওল্দ ম্যান।”
তাঁর মুখে উচ্চারণের দোষে ওল্ড ম্যান যে ওল্দ হয়ে গেল তা তারা বুঝতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, “হোয়াট?”
এঙলিঙ চমকে উঠে তার মুখ দেখলেন। মুখখানা পাথরের মত শক্ত। চোখে উদাসীন দৃষ্টি। হলে হবে কি, তার বসা, কথা বলার মধ্যে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসজাত শক্তি আছে। ‘হোয়াট’ শব্দের সঙ্গে সেই শক্তি আত্মপ্রকাশ করে যেন এঙলিঙের বুকের মধ্যে ছুরির মত গেঁথে গেল।
তিনি ঘাবড়ালেন না। বললেন, “এঙলিঙ মাই নেম। তিবেথিয়ান ফিলথফাল। দর্থন—আই মিন—দর্থন — ধর্ম।….”
তিবেথিয়ান যে টিবেটিয়ান হবে তারা বুঝতে পারলো। তিনি যে তিব্বতের এক দার্শনিক তা মানতে পারলো না। কাটা কাটা গলায় বললো, “সত্য পরিচয় বলুন। নয়তো বিপদ হবে।”
তিনি এক ঝটকায় মাথা ঘুরিয়ে বললেন, “থত্য। হান্দ্রেদ পারথেনত থ্রুত। এঙলিঙ। হেল্পাল। পথলমামা। মাই মাত্থাল।”
একজন বিস্মিত গলায় বললো, “পথলমামা?”
তিনি ঘাড় দুলিয়ে সুরেলা গলায় বললেন, “ইয়েত-ইয়েত। গ্রেত্ পথলমামা। ইউ নো পথলমামা?”
পাঞ্জাবী-গায়ে যুবকটি একটু চটে গেল। বললো, “স্টপ ইট। পথল-পটল উই ডোণ্ট ওয়ান্ট।”
“নো-নো—-” এগুলিঙ মাথা নাড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। “পথলমামা, এ গ্ৰেত ম্যান। প্রেত আর্কলজিথ। ইউ নো হিম, গ্রেত পথলমামা? থ্যামথুন্দল….” উত্তেজনা ও আবেগে তিনি হাত নাড়াতে থাকলেন।
কালো জামা গায়ে যুবকটি বিরক্তির সঙ্গে বললো, “ডোণ্ট টক এ লাই।”
“নো-নো” আবার সরবে প্রতিবাদ জানালেন এঙলিঙ। বললেন, “ইউ নো পথলমামা। গ্রেত আর্কলজিথ। থ্যামথুন্দল চকোল….”
যুবকটি বাধা দিয়ে বললো, “আর্ক-ফার্ক বন্ধ করুন। চালাকী ছেড়ে সত্য কথায় আসুন। নয়তো দেখছেন!” হাতের পিস্তল তাঁর চোখের সামনে ধরলো।
তিনি বড় বড় চোখ করে পিস্তল দেখলেন। উষ্ণ গলায় বললেন, “পিথ্তল-পিথ্তল। নাথিং। ও দিয়ে কিত্থু হোবে না। উই ওয়ান্ত হিথ্তরী।”
যুবকটি ব্যঙ্গের সুরে বললো, “এ দিয়ে চাঁদী ওড়ানো যায়। বিপ্লব করা যায়। হিথ্তরী দিয়ে হয় কচু।”
এগুলিও চুপ করে থাকতে পারলেন না। বললেন, “বিপ্লব! ভেলী গয়েদ। দেত্ বডলায়। রেদিখ্যাল চেইন্জ। বাত্ হোয়াত্? কি চাও ম্যান? লতুন থমাজ? নতুন থমাজ তৈরী হয় হিথ্তরী জেনে। ইউ নো বেঙ্গল হিথ্তরী? হোয়াত্ ইউ ওয়ান্ত? ইউ নো নাথিং।” বুড়ো আঙুল তুলে নাচালেন তিনি।
তাঁর কাণ্ডকারখানা, অকুতোভয় দেখে তারা স্তব্ধ হয়ে গেল।
২১
পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটি আবার সিগারেট ধরালো। তার চোখ এঙলিঙের মুখে। মানুষটিকে বুঝে নিতে চাইছে। সত্যি তিনি দার্শনিক না পুলিশের গুপ্তচর তা বুঝে নিতে হবে। দেশের ইতিহাস না জেনে দেশের পরিবর্তন আনা যায় না এটা ঠিক কথা। তাদের নিজেদের ইতিহাস জ্ঞান কম তা ঠিক। বাংলার ইতিহাস ভালো করে না পড়েই তারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে। সে বিপ্লব হয়তো শেষ হবে বা বিপ্লব চলবে! বিপ্লব হলে তারপর? এত বড় কথা একজন গুপ্তচরের মুখ থেকে শোনা যাবে ভাবে নি।
এঙলিঙ পকেট থেকে কলম বের করলেন। হাত উল্টে তার উপরে কলমটি শুইয়ে ঘুরিয়ে দিলেন। কলম হাতের উল্টো পিঠে ঘুরতে থাকলো। তিনি বললেন, “ইউ থি—ইউ থি।” হাতের পাশে অন্য হাতখানা উল্টে রাখলেন। কলম ঘুরতে ঘুরতে পাশের হাতে এল।
আবার তিনি বললেন, “ইউ থি—ইউ থি” তাঁর হাতের উল্টো পীঠে তেমনি কলম ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ডান হাত থেকে বাঁ হাতে যাচ্ছে। বাঁ হাত থেকে ডান হাতে আসছে।
কালো জামা গায়ে যুবকটি কর্কশ গলায় চীৎকার করে উঠলো, “স্টপ ইট। আমরা ম্যাজিক দেখতে চাই না।”
ঘাবড়ে তিনি কলম ঘোরানো বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।
যুবকটি খেঁকিয়ে উঠলো আবার, “ইউ সি।” পিস্তল হাতে ঘুরিয়ে বললো, “টিকটিকিদের আমরা জ্যান্ত মাটি চাপা দি।”
এঙলিঙ চোখ নাচিয়ে বললেন, “ইউ মিন খোচো?”
যুবকটি কোন জবাব দিল না।
তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “নো নো—হামি খোচো নই। এ ফিলথফাল। ইউ নো পথলমামা….”
তাঁর কথা শেষ হল না। ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল যুবকটি। বললো, “আলতু-ফালতু কথা শোনার সময় নেই। বলুন কি কি জানতে পেরেছেন।”
তিনি কোন কথার জবাব দিলেন না।
যুবকটি রূঢ় গলায় বললো, “স্পিক্ অন। চুপচাপ বসে থেকে কোন লাভ নেই।”
এঙলিঙ চিবুকের শেষ প্রান্তে ঝুলে থাকা চুল ক’গাছা কাঁপানো বন্ধ করে বললেন, “ইয়েত-ইয়েত। আই নো ঘলবেতা। মিত্থিরিয়াত্ হিথ্তরিক্যাল প্লেথ। ইউ নো নর্দার্ন ব্লাক পলিত্ড ওয়্যাল? গুপ্ত? শুঙ্গ? নো-নো।”
তিনি নিজের মনে খানিক সময় মাথা ঝাঁকালেন। মাথা ঝাঁকুনি থামিয়ে বললেন, “নিউলিথিক স্পত্ ঘলবেতা। ইউ নো নিউলিথিক….”
আবার যুবকটি ধমক দিল, “স্টপ, নিউলিথিক, কচু, ঘণ্টা….”
তিনি তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানালেন, “নো, নো …..”
পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটি নীরবে ধুমপান করছিল। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে যুবকটির দিকে তাকালো। বললো, “কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওর থলে সার্চ কর।”
একজন যুবক থলেটিকে টেনে আনতে গেল।
তিনি আর্ত গলায় চীৎকার করে উঠলেন, “নো—নো…..” থলে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলেন।
যুবকটি ছাড়লো না। সে ধরে টানতে থাকলো। হলে কি হবে এঙলিঙের কাছ থেকে থলে ছাড়িয়ে আনতে পারলো না। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে থলে আঁকড়ে আছেন আর চীৎকার করছেন, “নো—নো….”
একজন যুবক পিছন দিক থেকে তাঁকে চেপে চিৎ করে মাটিতে ফেলে দিল। এক ঝটকায় থলে তাঁর হাতছাড়া হল।
যুবকটি থলের মুখ খুলতে গেল। এঙলিঙ উঠে বসলেন। দেখলেন যুবকটি থলের মুখ খুলছে। পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন। পারলেন না। অন্য যুবকটি তার আগেই তাঁকে জাপটে ধরলো।
থলের মুখ খোলা হল। মোমবাতির আলোতে থলে উল্টে দিতেই ঝন্ ঝন্ করে থলের ভিতরের সব কিছু মাটির উপর পড়লো।
থলে থেকে মাটিতে পড়লো একগাদা খোলামকুচি! হাড়ি-কলসীর টুকরোর একটা ছোটখাট পাহাড় হয়ে গেল। এত খোলামকুচি দেখে যুবক ক’য়টি বিহ্বল হয়ে পড়লো। একটা মানুষের যত্ন সহকারে বয়ে বেড়ানো একটা থলের মধ্যে থাকবে কতগুলো ভাঙা খোলামকুচি, তা তারা স্বপ্নেও ভাবে নি।
বিহ্বলতা কাটতে একটি যুবক বললো, “পাগল।” এঙলিঙকে সে জাপটে ধরে রেখেছিল। তার বাহু বন্ধন আপনা থেকে শিথিল হয়ে গেল।
তিনি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “ম্যাদ ম্যান? পাঘল? নো-নো।”
বসে থাকা যুবকটি সখেদে বললো, “ফালতু ঝামেলায় একটা দিন নষ্ট হল।”
অন্য আর একজন ক্ষিপ্ত গলায় বললো, “ঝণ্টুটার মাথায় গোবর একটা পাগল নিয়ে এত কাণ্ড।”
পাগল বলতেই তিনি চটে গেলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে হাত নেড়ে প্রতিবাদ জানাতে বললেন, “নো-নো-নত্ পাঘল। হিথ্তিরিয়ান-হিথ্তিরিয়ান। ফেইনদ অফ পথলমামা, ইউ নো পথলমামা? গ্লেত্ হিথ্তিরিয়ান, ইউ নো হিম?”
কালো জামা পায়ে যুবকটি হতাশ হয়ে নিজের চুল মুঠো করে ধরলো। হতাশ গলায় বললো, “একটা পাগল খোলামকুচি কুড়োচ্ছে গড়বেতায়। আমি আর ঝণ্টু, গাধা তার পিছনে চার দিন লেগে আছি। আমি একটা গাধা।” হতাশায় ক্ষোভে তার গলা বুজে এল।
পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটি বললো, “এই বিচার বুদ্ধি নিয়ে তোমরা বিপ্লব করবে? শোষিত মানুষদের মুক্ত করা এত সোজা!”
ঝণ্টু ক্ষোভের সঙ্গে মাথা ঝাঁকালো। একটা আঙুল তুলে এঙলিঙকে দেখিয়ে বললো, “পাগল, বদ্ধ উন্মাদ।”
তিনি চীৎকার করে উঠলেন, “নো, নো, পাঘল নয়। মিথ্তার এঙলিঙ। হিথ্তিরিয়ান। ইউ থি-ইউ থি…”
তিনি ক্ষিপ্তের মত ছুটে এলেন খোলামকুচির কাছে। একখানা খোলামকুচি টেনে তুললেন হাতে। দু’আঙুলের মাঝখানে তুলে ধরলেন। বললেন, “ইউ থি—” দাঁড়িয়ে রইলেন একজন যাদুকরের মত।
যুবক কয়টি নীরবে দেখতে লাগলো তাঁর কাণ্ড।
তিনি বললেন, “ইউ থি, N.B.P., নর্দার্ন ব্লাক পতালী ফম্ বিহাল।” খোলামকুচি নামিয়ে রেখে আর একখানা খোলামকুচি তুলে নিলেন হাতে। সবাইকে খোলামকুচি দেখিয়ে বললেন, “গ্লে কলাল পতালী ফম ঘলবেতা। সুঙ্গ পিলিয়দ ইন ইন্দিয়ান হিথ্তিরি। দিত্ পটালী কলাল।”
“ইউ থি” বলে খোলামকুচিটি নিয়ে পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটির নাকের কাছে ধরলেন। তাকে দেখিয়ে এক লাফে এলেন কালো জামা গায়ে যুবকটির কাছে। বললেন, “ইউ থি।” তার দেখা হতেই আর একজনের নাকের ডগায় ধরলেন। সবাইকে দেখিয়ে সাবধানে নামিয়ে রাখলেন মাটিতে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত নাড়িয়ে বললেন, “দীথু, আই মিন দীথু। দীথুল জন্ম? নো, নো, ফাইভ হান্দ্রেদ ইয়ার্ত, অ্যাঘো অন ঘলবেতা—ম্যান। মানুত্ ঘর-বালি—” এঙলিঙ আবার খোলামকুচি হাতে তুলে নিলেন।
পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটির শক্ত চোয়াল শিথিল হয়ে গেল। বললো, “যীশুখৃষ্টের জন্মের পাঁচ শত বৎসর আগে মানুষ বাস করতো গড়বেতায়?”
তিনি দীর্ঘ সুরেলা গলায় বললেন, “ইয়েত-ইয়েত। থ্রত্ অন্ মাই হ্যান্দ।” খোলামকুচি আবার তিনি নাড়িয়ে দেখালেন।
যুবকটি বললো, “আপনি বসুন মিঃ এঙলিঙ। আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা অভদ্র আচরণের জন্য দুঃখিত।”
এঙলিঙ একগাল হেসে আলোর সামনে বসে পড়লেন।
যুবকটি সখেদে বললো, “আমরা দেশকে ভালবাসি অথচ দেশের কোন খবর রাখি না—এ বড় লজ্জার।”