৮
নদীর পরেই শ্মশান। শ্মশানের গা থেকে শুরু হয়েছে খাড়ি। কয়েক পা এগিয়ে গেলে খাড়ি গভীর হয়ে ওঠে। দু’পাশে পাহাড়ের মত উঁচু পাড় দেওয়ালে হাজার হাজার ফাটল। কোথাও দেওয়াল মসৃণ করে চাঁছা। পাশেই ছোট ছোট খাড়ি। খাড়ি পাক খেয়ে খানিকটা গিয়ে থেমে গেছে।
এঙলিঙ বাঁ পাশের খাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন দেখে পটলমামা দাঁড়ালেন। মাথার উপর সূর্য। রোদ খাড়া ত্রিশূলের মত নেমে আসছে। পায়ের নীচে পাথর। কোথাও কোথাও বালি।
এঙলিঙ সামান্য একটু এগিয়ে ফিরে এলেন। পটলমামা বললেন, “বড় খাড়িটা ধরে চলুন। এ খাড়িটা বাউরী পাড়ার পাশ দিয়ে পাক খেয়ে গিয়ে উঠেছে ওলাই-চণ্ডীর থানে। তারপরে গড়খাই। এ খাড়িটা দিয়ে এগোলে বাউরী পাড়ার পিছনটা দেখতে পাব।”
এঙলিঙ বললেন, “এ্যাদ ইউ লাইখ।” মাথাটা ঝাঁকিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। তাঁর পিছনে পটলমামা। রোদের তাত প্রখর। জায়গাটা নিষ্ঠুর। কে যেন রেগে-মেগে পাথরের বুক চিঁড়ে ফালি ফালি করে দিয়েছে। তবুও গনগনির খোলের মত গনগনে নয়।
পটলমামার চোখের উপর ভেসে উঠলো গনগনির খোল। একের পর এক খাড়ি। খাড়ি থেকে বেড়িয়েছে আবার খাড়ি। সে খাড়িরও অনেক শাখা-প্রশাখা।’ সবুজের চিহ্ন নেই। কোন মানুষ আসে না গনগনির খোলে। পাখীও উড়ে আসে না। শ্মশানের মত নিস্তব্ধ। প্রাণ হীন। যুগ যুগ ধরে গনগনি যেন ভৈরবের মত ধূনি জ্বালিয়ে কার অপেক্ষায় বসে আছে।
খাড়ির শেষ প্রান্তে শীলাবতী নদী। তীব্র স্রোত নিয়ে জল বালি কাঁকর টেনে নিয়ে চলেছে। সেই জল নদীর উপর সবুজ শ্যামল। অথচ তার বিন্দুমাত্র করুণা গ্রহণ করে নি গনগনি। সে যেন আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকতেই ভালোবাসে।
এঙলিঙ বললেন, “মিত্থিরিয়াত ল্যান্দ। নো লাইফ। দাত্থ লাইখ মলুভূমি। দল নেই, ঘাত নেই, কলুনা নেই।” হাত নেড়ে বললেন, “ভালোবাতা নেই। থুছ থতান-থতান।”
পটলমামা বললেন, “শ্মশানই বটে। কত মানুষ এখানে প্রাণ দিয়েছে তার কোন হিসাব আছে?”
বিস্মিত এঙলিঙ ঘুরে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখ দুটি বিস্ফারিত। বললেন, “নেখলে মানুত ধলে নিয়েছে। খুন। আই মিন হান্তিং প্লেথ?”
পটলমামা মাথা নাড়িয়ে বললেন, “নো, নো। নেকড়ের হাতে আর কটা মানুষ মরেছে। তার থেকে ঢের বেশি মানুষ মেরেছে মানুষরূপী নেকড়েরা। এক সময় গনগনির খোলে হাজার হাজার ইংরেজ সেপাই বন্দুক নিয়ে লাফিয়ে পড়েছে। হাজার হাজার গুলি ছুড়েছে। হাজার হাজার মানুষ লুটিয়ে পড়েছে গনগনির খোলে। রক্ত নদীর স্রোতের মত খাড়ির পথ বেয়ে নেমে গেছে। তবু গনগনির তৃষ্ণা মেটে নি। দেখছেন, একটা ঘাস পর্যন্ত গজায় না।”
এঙলিঙ থমকে দাঁড়ালেন। চোখ থেকে চশমাটা টেনে নামিয়ে হাতে ধরলেন। রোদের তাতে মুখ লাল। বললেন, “হোয়াত? হাদাল হাদাল মানুত মোলে গেলো!”
পটলমামা বললেন, “তাই হয়েছিল এখানে। আপনি চূয়াড় বিদ্রোহের কথা শুনেছেন?”
এঙলিঙ বললেন, “তুয়াল!”
পটলমামা তাঁর উচ্চারণ ঠিক করে দেবার জন্য বললেন, “চূয়াড়। চূয়াড় বিদ্রোহ।”
এঙলিঙ তাকিয়ে রইলেন বিহ্বল চোখে।
পটলমামা বললেন, “ইংরেজ আমলে মেদিনীপুরের আদিবাসীরা গণবিদ্রোহ করেছিল। তাদের ঘাঁটি ছিল এই গনগনির খোল। এখান থেকে তারা লড়াই করেছে ইংরেজদের গোলাবারুদের বিরুদ্ধে। এ বিদ্রোহে লায়েক, চূয়াড় পাইক সবাই ছিল। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা গণ-হত্যার সাফাই গাইতে নাম দিয়েছে ‘অসভ্য চূয়াড় বিদ্রোহ’।”
পটলমামা থামলেন। খাড়া পাথরের পাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনের পাতায় ভীড় করে এল কতো ইতিহাস।
গড়বেতা বগড়ী পরগণার অংশ। বগড়ী বা বকদ্বীপ থেকেই বাগ্দী নাম এসেছে। এখানে কোন রাজা ছিল না। আরণ্যক বাগ্দী অন্যান্য আদিবাসীরা মিলিত হয়ে সর্দার নির্বাচন করতো। তাকে বলা হত ‘মণ্ডল’। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। মণ্ডল তাদের মত নিয়ে রাজ্য শাসন করতো।
চারিদিকে ছিল গভীর শাল বন। মাঝে মাঝে ভূমিজ মানুষের বসতি। চাষ করে ফসল ফলাতো। বন থেকে শিকার করে আনতো। মেয়েরা ফল-মূল সংগ্রহ করতো। এমনি করে তারা শান্তিতে বাস করতো।
কিন্তু শান্তিতে কোন মানব গোষ্ঠীই বুঝি বাস করতে পারে না। একদল চালাক লোক বাইরে থেকে আসে। কখনো গোষ্ঠীর মধ্য থেকেই ক্রমে শক্তিশালী হয়ে রাজা হয়ে বসে। তার পরেই শুরু হয় লুটপাট। যুদ্ধ এসে হানা দেয় শান্ত সুখী জীবনে।
পটলমামা এসব কথা ভাবছিলেন আর হাঁটছিলেন। কিন্তু হঠাৎ চমকে সরে গেলেন, একটা পাথরের নুড়ি এসে পড়লো পায়ের উপর। তিনি পাথরটি হাতে তুলে নিলেন। কালো কিন্তু ঝামার মত নানা ছেদা। ওজন আছে। তিনি উপর দিকে তাকালেন। আরো কয়েকটি ঢেলা ঝড়ে পড়লো।
পটলমামা এক লাফে এঙলিঙের কাছে চলে গেলেন। তাঁর হাত ধরে দ্রুত দেওয়ালের কাছে সরে এলেন। পাথরের আড়ালে আড়ালে চলতে শুরু করলেন। দু’পা গিয়েই একটা পাথরের ফাটল দেখতে পেলেন। ফাটলের মধ্যে কাত হয়ে একটা মানুষ ঢুকে যেতে পারে। এঙলিঙকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন। পরে নিজে ঢুকলেন।
ঢুকে বুঝতে পারলেন পাথরের বুকের ফাটল নয়। এ এক খাড়ি। সাপের মত এঁকে-বেঁকে অনেক দূরে চলে গেছে। দু’জনে এগোতে লাগলেন। অনেকখানি এগিয়ে পেলেন বাটীর মত একটা ফাঁকা জায়গা। দু’তিনজন বেশ আরাম করে বসা যায়। মাটিতে লাল কাঁকর। উপরে এগিয়ে আছে খানিকটা ছাদ। সারা জীবন বসে থাকলেও কারো পক্ষে টের পাওয়া সম্ভব নয়।
পটলমামাকে বসতে দেখে এঙলিঙ বসলেন।
৯
পটলমামার অনুমান যে নির্ভুল তা দু’তিন মিনিট বাদেই বোঝা গেল। পাথরের গায়ে কান লাগিয়ে বুঝতে পারলেন উপরে মানুষ। মানুষ কয়টির পায়ের চাপেই পাথর খসে পড়েছিল।
হঠাৎ সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তখন পটলমামা দেখতে পেলেন মানুষের কঙ্কালটিকে। কঙ্কাল ঠিক নয়, একখানা হাত। লাল কাঁকড়ের মধ্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আছে। কোন মানুষের কঙ্কাল কাঁকর বালির নীচে চাপা পড়ে হাতখানা যেন বাইরে বের করে রেখেছে মুক্তির আশায়। মুক্তি সে পায় নি। হাতের মাংস কবে পচে খসে গেছে। কঙ্কালটার পাঞ্জাটুকু বিবর্ণ রং নিয়ে জেগে আছে।
পটলমামা বুঝতে পারলেন কোন এক হতভাগ্য পুরুষের কবরের উপর বসে আছেন। লোকটিকে খুন করে এখানে কবর দিয়ে রেখে গেছে। তাড়াতাড়িতে হাতখানা চাপা দিতে ভুলে গেছে।
তাতে খুনীদের কোন অসুবিধা হয় নি। দশ-বারো বছরে এখানে কোন মানুষ এসে ঢোকে নি। ঢোকার কথাও নয়। কোন মানুষের চোখে পড়ে থাকলে সে ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়ে আর কোন মানুষকে বলে নি। পটলমামা এঙলিঙকে দেখালেন। এঙলিঙ কঙ্কালের হাত দেখে অস্ফুট গলায় বললেন, “মাই গদ্।” একটু সরে বসলেন।
উপর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ শোনা গেল। ফস্ করে কে যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বাললো। তারপর শোনা গেল তাদের কথা। কিছু বোঝা গেল না। অনুমান করতে পারলেন কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।
পটলমামা পাইপটা নিভিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এঙলিঙ পাথরে হেলান দিয়ে দিবা নিদ্রা দিলেন। একটু বাদেই তাঁর নাকের ফস্- ফস্ আওয়াজ শুরু হল।
বসে থেকে থেকে পটলমামারও ঝিমুনি এসে যাচ্ছিলো। কিন্তু ঘুমোতে হল না। তার আগেই ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ শুনতে পেলেন। তারপর দ্রুত ছোটা পায়ের শব্দ। শব্দ শ্মশানের দিকে গিয়ে মিলিয়ে গেল।
মানুষ দেখে বাউরীদের শুয়োর ঘোঁত ঘোঁত করে পালিয়েছে তা পটলমামা বুঝতে পারলেন। এঙলিঙকে নিয়ে বাইরে এলেন। বাইরে বেরিয়ে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিক দেখলেন।
পায়ের কাছে বালিতে দেখতে পেলেন শুয়োরের পায়ের ছাপ। তার পিছনে পিছনে চলেছে জুতোর ছাপ। পটলমামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। পাইপ ধরিয়ে হাঁটা শুরু করলেন।
খানিকটা এগিয়েই খাড়ি বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে যেতেই দেখতে পেলেন একটা শুয়োরকে। শুয়োর তাঁদের আগেই দেখেছে। নাক দিয়ে বাতাস শুঁকে হুড়-মুড় করে উল্টো দিকে দৌড় লাগালো। শুয়োরের দৌড় দেখে এঙলিঙ ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে হেসে উঠলেন।
খাড়ি এখানে চওড়া। বুকের মধ্যে হুমড়ী খেয়ে পড়ে আছে পাথরের চাঁই। খাড়ি ভর্তি বালি। দু’পাশে খাড়াই পাথরের গায় ছোট ছোট দু’একটা শাল গাছ। কারো কারো লম্বা শিকড় সাপের মতো আঁকা- বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। একটা পাথরের ফাঁকে কাশ গাছ। ফুল শুকিয়ে আছে। পটলমামার এই শুকনো ফুলের চিহ্ন বড় ভালো লাগলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন কাছে গিয়ে দেখবেন বলে। কিন্তু কাছে যাওয়া হল না। থমকে দাঁড়াতে হল।
এঙলিঙ বললেন, “ইউ থি….ইউ থি।” তাঁর গলায় উত্তেজনা।
আঙ্গুল লক্ষ করে খাড়াই দেওয়ালের দিকে চোখ তুললেন পটলমামা। উপরে চোখ যেতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালেন। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলেন।
খাড়া দেওয়ালের উপর আকাশ। আকাশ নীল। নীল চাঁদোয়া টানিয়ে যেন পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মাথায় একটা কলা গাছ। বড় চওড়া চাওড়া পাতা। তার শিকড় নীচের দিকে নেমে এসেছে। তার প্রায় দু’ ফুট নীচে লাল মাটি কাঁকড়ের স্তর। আর সেইখানে সারি সারি গাঁথা রয়েছে একের পর এক খোলামকুচি।
মাটি ধ্বসে নামাতে মাটির নীচ থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে দশ বারোটি কলসি, হাড়ি, গামলার ভাঙ্গা টুকরোর একটি স্তূপ। রোদ পেয়ে চক্-চক্ করে হাসছে।
এঙলিঙ চাপা গলায় বললেন, “ইউলেখা… ইউলেখা।” কিন্তু তার গলার উল্লাস তাতে ঢাকা পড়লো না।
১০
গড়বেতার গড়খাই। কারা কবে কেটেছিল তার হিসাব নেই। তবে যারা গড় কেটেছিল তারা হিসাব করেই কেটেছিল। রাজধানী মজবুত করতে গড় খোঁড়া হয়। গড়ের সামনে থাকে বিশাল দরজা, আটকে দিলেই নগর দুর্ভেদ্য দুর্গ।
গড়বেতার চারদিকে চারটি দরজা ছিল। দরজাগুলির প্রচলিত নাম সিংহদ্বার। উত্তরে লাল দরজা, পূর্বে রাউতা দরজা, পশ্চিমে হনুমান দরজা, দক্ষিণে পেশা দরজা। আর আছেন চারদিকে চারজন পাহারাদার। গোরা খাঁ পীর, ওলাই-চণ্ডী, বাঘরায়, বারভূঁইঞা। পটলমামা এসব কথা যখন ভাবেন খুব আশ্চর্য হয়ে যান।
বাংলার অনেক দেশ তো দেখলেন। পীর, গাজী, দেবতার থান কম দেখেন নি। কিন্তু হিন্দু গ্রামের মধ্যে গড়ের এক দেবতা গোরা খাঁ পীর, তা দেখেন নি। ওলাই-চণ্ডী এক দিক রক্ষা করছেন, গড়ের অন্যদিক বাঘরায় রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু শিলাবতী নদীর দিক গোরা খাঁ পীরের হাতে কেন তার কোন জবাব পেলেন না।
ভাবতে ভাবতে হাঁটছেন। কিন্তু আর ভাবার সুযোগ হল না। গড়ের খাড়ি ক্রমশঃ উঁচু হয়ে উঠছে। দু’পাশে লাল মাটি। মাঝে মাঝে গাড্ডার মত। গাড্ডায় জল জমে আছে। উপরে চাঁদোয়ার মত নীল আকাশ। কিন্তু সে আকাশ জলের মধ্যে নিজের মুখ দেখার সুযোগ পায় নি। জলের রং লাল-রক্তের মত লাল।
এঙলিঙ জলের সামনে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, “লেদ ওয়াতাল। লেদ ওয়াতাল।”
পটলমামাও থামলেন। বললেন, “খুনের রক্তের মত লাল জল।”
কোথায় যেন একটা মুরগী কোঁ কোঁ করে উঠলো। পটলমামা কোন মুরগী দেখতে পেলেন না। খাড়া পাড় এখনো মাথার সামান্য উপরে।
আর একটু উঠতেই দেখতে পেলেন গ্রাম। মাটির দেওয়াল। মাথায় বিচালীর চাল। বাউরী গ্রাম। মুরগী শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে। দক্ষিণ দিকে খোলা মাঠ। লাল সালু কে যেন বিছিয়ে রেখেছে। সালুর উপর কাঁকর বিছানো। রোদ পড়েছে। খাঁ খাঁ করছে লাল সালু। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে।
এতক্ষণে পটলমামার খেয়াল হল। এতটা পথ হেঁটেও কোন পাখী দেখেন নি! এখন বুঝতে পারলেন কেন এদিকটায় পাখী আসে না। অস্ফুট গলায় বললেন, “গনগনির খোল। গন্গন্ করে যেন তৃষ্ণার তাপে জ্বলছে।”
এঙলিঙ উঠে এসে পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, “ঘন্ঘনি। থথান-থথান। গাথ না, ঘাত না, পাত্থল, লাল পাত্থল। লেদ থথান।”
পটলমামা গড়ের পাড় বেয়ে আরো খানিকটা হেঁটে গেলেন। দেখতে পেলেন গাছটিকে। গড়ের বাইরে ঠিক গনগনির আরম্ভে সবুজ অশ্বত্থ গাছটি দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাতা নিয়ে। সেই যেন গড়বেতার প্রাণের শেষ সীমানা।
পটলমামা এগিয়ে গেলেন। গাছটি বেড়া দিয়ে ঘেরা। কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন একগাদা হাতী ঘোড়া। মাঝখানে কালো পাথর আর ত্রিশূল। সিঁদুর লেপে লেপে তার আসল চেহারা লুপ্ত করে দিয়েছে। ঘোড়া হাতীগুলিও সিঁদুরে রক্তাক্ত।
পটলমামা বললেন, “ওলাই-চণ্ডী।”
এঙলিঙ চোখের চশমা নামিয়ে দেখলেন। হাঁটু গেড়ে প্রণাম করে বললেন, ‘গদ্, ওলাইচন্দী। ভেলী ফাইন, হাথী, ঘোলা।” ঘুরে ঘুরে চিবুকের শেষ প্রান্ত নাচিয়ে নাচিয়ে দেখতে লাগলেন।
তিনটি যুবক গড়বেতার দিক থেকে গড়খাই পার হয়ে উঠে এল। তাদের হাতে তাস। পটলমামা আর এঙলিঙকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। একজন বিস্মিত গলায় বললো, “আপনারা?”
পটলমামা মুখ তুলে দেখলেন তাদের। বললেন, “আগন্তুক।”
যুবকটি অবাক হয়ে বললো, “ওলাই-চণ্ডী দেখতে এসেছেন?”
এঙলিঙ মাথা দুলিয়ে মিহি সুরেলা কণ্ঠে বললেন, “ইয়েত— ইয়েত।”
যুবকটি হেসে বললো, “ওলাই-চণ্ডী দেখার কি আছে? বাউরীরা পূজা করে। এ আবার কেউ দেখতে আসে নাকি!”
পটলমামা বললেন, “কেন দেখবে না? এ তো দেখার মত বলার মত একটা ঘটনা।”
যুবকটি হাসি সামলে বললো, “কেন?”
পটলমামা জিগ্যেস করলেন, “পুরোহিত ব্রাহ্মণ না বাউরী?”
যুবকটি বললো, “বাউরী।”
পটলমামা বললেন, “পূজো তো ব্রাহ্মণরা করে। এখানে বাউরি পুরোহিত পূজো করে কেন ভেবে দেখেছো?”
যুবকটি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল কখনো ভাবে নি।
পটলমামা গাছের ছায়ায় বসলেন। পাইপটা জ্বালিয়ে নিলেন। যুবক কয়টি বসে পড়লো। পটলমামা একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “দেশ কার বা কাদের?”
যুবক কয়টি কোন জবাব দিল না। নীরবে পটলমামার মুখের পানে তাকিয়ে রইল।
পটলমামা পাইপটা কামড়ে রেখে বললেন, “আমরা নয়। যারা মাটির সঙ্গে আছে তারাই ভূমিজ। ভূমি থেকে জাত তাই ভূমিজ। তারা এইসব বাগ্দী, বাউরী, হাড়ী, ডোম, জোলা, মালো তারাই। আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। ওদের শ্রমলব্ধ ফল চালাকী করে ভোগ করছি। ওদের দারিদ্রতার মধ্যে গ্রামের পাশে ফেলে রেখেছি।”
যুবক ক’টির দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেল না। পটলমামা হতাশ হয়ে পাইপটা আবার কামড়ে ধরলেন। বললেন, “এরাই বাংলার খাঁটি বাঙ্গালী। বহিরাগত শক্তি এ দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শাসন করেছে শোষণ। আমরা শোষকদের সাহায্য করে অভিজাত। ওরা প্রতিরোধ করেছে। ওলাই-চণ্ডীর থানে আর্য ব্রাহ্মণকে ঢুকতে দেয় নি।”
একটি যুবক বললো, “আশ্চর্য!”
পটলমামা বললেন, “ইতিহাসের পাতায় আরো অনেক আশ্চর্যকর ঘটনা আছে।”
১১
পটলমামা পাইপে কয়েকটা দীর্ঘ টান দিয়ে একগাল ধোঁয়া উগড়ে দিলেন। ধোঁয়ায় তাঁর মুখ ঝাপসা হয়ে গেল। সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে বললেন, “রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস শুধু দেশের ইতিহাস নয়। যারা চাষ করে, জঙ্গল সাফ করে, গ্রাম-নগর গড়ে তোলে তারাই যথার্থভাবে ইতিহাসের উপাদান। তাদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে কি ছিল আমাদের দেশ।”
পটলমামা থামতেই এঙলিঙ চোখ থেকে চশমা নামিয়ে উত্তেজিত ভাবে বললেন, “বাঘতী, বাক্লী, থান্তাল….”
পটলমামা হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, “আর্যদের আসার আগে অনার্যরা ছিল। তারাই এ দেশের মানুষ। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল। তারা উন্নততর এক জীবনযাত্রা নির্বাহ করতো। এখানে আদি প্রস্তর যুগ থেকেই যে মানুষ ছিল তার নানা প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
পটলমামা থামতেই একটি যুবক বললো, “আমরা শুনি নি।” সে তার হাতের তাস লুকিয়ে ফেললো। তাস খেলতে এখানে এসেছিল তা প্রকাশ করতে এখন লজ্জা পাচ্ছে।
পটলমামা হঠাৎ হাত তুলে একটি যুবকের বুকে খোঁচা মেরে বললেন, “বৎস, তুমি কি অবগত আছ যে তোমার প্রপিতামহরা হরিণের শিং দিয়ে তৈরী করেছিল হারপুন। হাড় ও তামার বঁড়শী। একটি চোয়ালে দন্তপংক্তির স্থানে ছোট ছোট পাথর সন্নিবেশ করে তৈরী করা হয়েছিল শস্যচ্ছেদক। বৎস, অবগত হয়ে থাক, এই শস্যছেদক প্রাচ্য ভারতের প্রাচীনতর কাস্তে।”
এঙলিঙ চোখের চশমা খুলে ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে হেসে উঠলেন। কিন্তু যুবক কয়টি হাসলো না। তারা হাঁ করে পটলমামার মুখের পানে তাকিয়ে রইল।
পটলমামা বললেন, “এই মেদিনীপুর থেকেই এসব পাওয়া গেছে। এবার ভেবে দেখ কত প্রাচীন সভ্যতার বংশধর তোমরা।….”
পটলমামা তাঁর কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই আর্ত চীৎকার গনগনির মাঠের উপর থেকে ভেসে এসে আছড়ে পড়লো। সবাই চমকে উঠলো। কিছু বুঝতে পারার আগে আবার চীৎকার ভেসে এল। কে যেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বাঁচার তাগিদে শেষবারের মত আশ্রয় খুঁজছে।
স্তব্ধ হল পরিবেশ। গনগনির মাঠ তপ্ত কড়াই হয়ে বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে। রোদের তাপ যেন মাটির উপর থেকে সাপের মত এঁকে-বেঁকে উঠে আসছে। তাই হাওয়া পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে আছে।
আবার বাতাস চিড়ে আর্ত হাহাকার ভেসে এল, “বাঁ—চা—ও…‥বাঁ—চা….”
যুবক কয়টি এবার এক লাফে উঠে দাঁড়ালো। তারপর লাফিয়ে নামলো গড়ের মধ্যে। দৌড়ে গড়ের পাড় বেয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে, দৌড়ে পালিয়ে গেল বাউরী পাড়ার উপর দিয়ে আচার্য পল্লীর দিকে।
পটলমামা আর এঙলিঙ দু’জনের দিকে তারা ফিরেও তাকালো না একবার।
পটলমামা উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন এঙলিঙ। বললেন, “ইত ইদ্ মার্দাল কেথ।” গলা তার কেঁপে গেল।
পটলমামা বললেন, “হ্যাঁ, একটা খুন হচ্ছে। কে কাকে খুন করছে তা জানা দরকার। হয়তো তাকে বাঁচানো যাবে।”
পটলমামা গনগনির মাঠ পাড়ি দিয়ে ছুটলেন খাড়ির দিকে। হাজার হাজার শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে থাকা খাড়ি থেকেই শব্দ এসেছিল।
এঙলিঙ ছুটে গিয়ে পটলমামার হাত চেপে ধরলেন। বললেন, “নো-নো। ওখানে বিপড। দেইঞ্চার‥‥”
পটলমামা শুনলেন না। বললেন, “মানুষ খুন হতে দেওয়া যায় না। ফলো মি।”
পটলমামা ছুটলেন। পিছনে পিছনে ছুটলেন এঙলিঙ। তাঁর ছুটতে কষ্ট হচ্ছিল। পায়ের নীচে শুকনো মাটি আর কাঁকড়। পা পিছলে যেতে চাইছে। হয়তো বা মুখ থুবড়ে পড়ে যাবেন।
শেষ অবধি খাড়ি পর্যন্ত যেতে হল না তাঁদের। তার আগেই খাড়ি থেকে উঠে এল একটি যুবক। উঠেই দৌড় দিল। পটলমামার পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেল তীরের মত।
পটলমামা থমকে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়েই দেখতে পেলেন তিনটি যুবককে। হাতে চক্চকে ছুরি। হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে খাদের মধ্যে। তাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছে।
তারাও দেখলো পটলমামাকে। পটলমামাকে দেখেই তারা দু’ পা পিছিয়ে আর একটা খাড়ির মধ্যে ঢুকে পালিয়ে গেল। এবার এ খাড়ি ও খাড়ি হয়ে তারা পালিয়ে যাবে।
এঙলিঙ হাত দিয়ে কপালের ঘাম ফেললেন। ঘামে তাঁর মুখ ভেজা। বললেন, “দিথ্ মিথ্ …. দিথ্ মিথ্ দ্য ঘেম।”