২২
পটলমামা বললেন, “দেশের ইতিহাস আবিষ্কার করা খুব সহজ কাজ নয়। শ্রম, নিষ্ঠা, জ্ঞান, অনুশীলন, ভালোবাসা এমনি অনেক গুণ চাই।”
আগন্তুক বুঝতে পারলেন না পটলমামার কথা। ফ্যাল ফ্যাল, করে তাকিয়ে রইলেন।
পটলমামা বললেন, “শীলাবতী, কংশাবতী, রূপনারায়ণ এসব নদীর পারে লুকিয়ে আছে ভারতের ইতিহাসের অনেক অজানা কাহিনী। কে বলতে পারে সভ্যতার সূচনা বাংলা ভূখণ্ডেই হয় নি?”
পটলমামা প্রশ্ন করে থামলেন। দু’জনার মুখ দেখলেন। সাধুজী চুপচাপ বসে আছেন। অবশ্য চোখ মুখ তাঁর স্ফীত হয়ে উঠেছে। নিজের ভিতর উত্তেজনা অনুভব করছেন। কিন্তু কিছু জানেন না বলে চুপচাপ বসে আছেন। অন্যজন বাক্যহারা। পাইপ মুখে একটা মানুষ এত অতীতে তাঁদের দু’জনকে টেনে নিয়ে যাবে তা ভাবেন নি। অন্যদিকে সভ্যতার এই রহস্যময় কাহিনী তাঁদের কাছে অভিনব মনে হচ্ছে।
পটলমামা নিস্পৃহভাবে খানিক সময় পাইপ টানলেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “তাল-বেতালের গল্প-গুজব নিয়ে আপনারা মশগুল হয়ে আছেন গড়বেতার মানুষ। আপনারা জানেন কি যে বাস করছেন সুঙ্গ যুগের একটা সমাধির উপর?”
সাধুজী একটু চমকে উঠলেন। বললেন, “বলছেন কি?”
পটলমামা বললেন, “আমি খোলামকুচি কুড়াই বলে আপনি গতকাল ব্যঙ্গ করেছিলেন। খোলামকুচির কি পরিচয় তা আপনি জানেন?”
সাধুজী বললেন, “গরীব মানুষরা মাটির হাড়ি-কলসী ব্যবহার করে। ভেঙ্গে গেলে ফেলে দেয়। তার আবার মূল্য কি থাকবে?”
পটলমামা মুখ থেকে পাইপ নামালেন। তিনি চটে গেলেন, তা বোঝা গেল মুখ দেখে। বললেন, “হ্যাঁ মশাই, যাদের গরীব করে রেখেছেন তারা মাটির হাড়ি-কুড়ি ব্যবহার করে। কিন্তু যখন লোহা, পিতল, কাঁসা ছিল না তখন মানুষ এসব কাজ কি দিয়ে করতো?”
সাধুজী বিড় বিড় করে বললেন, “তামা। গরীব যারা তারা মাটির।”
পটলমামা পাইপ মুখে তুলে ধরে বললেন, “প্রথমে মানুষ কাঁচা মাটির বাসন তৈরী করে রোদে শুকিয়ে কাজে লাগাতো। তারপর তাকে পুড়িয়ে শক্ত করতে শিখলো। চিন্তা করুন কতখানি সুখ-স্বস্তি তারা তখন পেল।”
আগন্তুক ভদ্রলোক এবার মুখ খুললেন। বললেন, “মানুষ অনেক অসুবিধা থেকে রেহাই পেল।”
পটলমামা আঙুল তুলে বললেন, “দ্যাটস্ রাইট। পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন এলাকায় নানা রকমের খোলামকুচি পাওয়া গেছে। লাল কালো খোলামকুচি। এগুলো খৃষ্ট জন্মের পাঁচ শত বছর আগের। তার পরেই চকচকে কালো। সংক্ষেপে বলা হয় N.B.P.। আপনি যে কবরের উপর বসে আছেন সেখানে আছে ধূসর কালো রংয়ের খোলামকুচি। বাউরী পাড়ায় চকচকে কালো খোলামকুচি পেয়েছি। আর একরকম পাত্র হত বালি মেশানো মাটিতে, তা পেয়েছি।”
সাধুজী বললেন, “কি বলছেন? এতো ধারণাই করতে পারছি না!”
পটলমামা মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে হাসলেন। বললেন, “কবরের উপর যারা ঘর বানায় তারা কি কবরের খবর রাখে?” দু’জনে নীরব রইলেন, মুখে কোন ভাষা এল না।
২৩
পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটি বললো, “মিঃ এঙলিঙ, আপনার ক্ষিদে পাওয়ার কথা। দুপুর থেকে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে আছেন। কিছু খাবেন?”
তিনি চোখ কাঁপিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “ইয়েত্-ইয়েত্।”
একটি যুবক উঠে গেল। উই ঢিপির এক পাশে জড় করা শালপাতা সরিয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে ছোট গর্ত থেকে টেনে বের করে আনলো একটা প্লাস্টিকের থলে। থলের মধ্যে মুড়ি আর বাতাসা।
যুবকটি প্রথমেই এঙলিঙকে মুড়ি বাতাসা দিয়ে নিজেদের জন্য রেখে থলে আবার ঢিপির গর্তে পুরে দিল। কেটলি বের করে এনে একটা লোহার মাথায় তাকে ঝুলিয়ে দিল। অপর একটি যুবক তার নীচে শুকনো কাঠে আগুন জ্বেলে দিল।
জঙ্গলের মধ্যে এমন নিখুঁত আয়োজন দেখে এঙলিঙ বিস্ময় মানলেন। বুঝতে পারলেন, এ হল যুবকদের দূর্গ। জঙ্গলে ঘাঁটি করে তারা সশস্ত্র এক বিপ্লবের ছক তৈরী করেছে। এরা দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু দেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না নিয়েই তারা বিপ্লবের পথে পা দিয়েছে।
পরিণতি কি হবে তা তিনি কল্পনা করতে পারছেন। বিয়োগান্ত এক নাটক অভিনয় হবে বুঝতে পেরে বেদনায় বুক ভরে গেল। গনগনির খোলের কথা মনে এল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাদের ঘাঁটি ছিল গনগনির খোল। দিনের পর দিন তীর, ধনুক, টাঙ্গী নিয়ে ইংরেজদের মুখোমুখি হয়ে লড়াই করেছে।
সেই বীরত্বময় আত্মত্যাগের কোনো কাহিনী কোনো লেখক লেখেন নি। লিখে রাখলে কত বীরপুরুষ আর আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিকের জীবন কাহিনী জানা যেত।
মুড়ি শেষ হতেই এঙলিঙকে তারা চা দিল। তিনি চা মুখে দিলেন। দুধ-চিনিহীন চা। তবু তাঁর ভালো লাগলো। গনগনির খোলের সেই আত্মত্যাগীরা হারিয়ে যায় নি। আবার বেঁচে উঠেছে নতুন চেহারায়। যতদিন মানুষকে মানুষ শোষণ করবে ততদিন এরা জন্ম নেবে। ভুল করবে। হারিয়ে যাবে। তবুও তারা আসবে।
এঙলিঙ চোখের সামনে যেন যুবক ক’টির মৃত দেহ দেখতে পেলেন। গনগনির লাল কাঁকড়ের উপর রক্ত ঢেলে দিয়ে শুয়ে আছে। মন তাঁর দুঃখে, বেদনায় কানায় কানায় ভরে গেল। একটা অন্ধকার গর্ত, গর্তের মধ্যে কেউটে সাপ, মাথায় পিস্তলের হিমশীতল স্পর্শ—সব ভুলে গেলেন।
চা শেষ হতেই পাঞ্জাবী গায়ে যুবকটি বললো, “চলুন, আপনাকে বনের বাইরে পৌঁছে দি। আমাদের কথা কিন্তু কাউকে বলবেন না।”
তিনি কোন জবাব দিতে পারলেন না।
কালো জামা গায়ে যুবকটি খোলামকুচিগুলো যত্ন সহকারে থলের ভিতর পুরে দিল। তার খোলামকুচি থলেতে তোলার মধ্যে ফুটে উঠলো অসীম মমতার ছাপ। এসব খোলামকুচি একদিন হাড়ি-কুড়ি হয়ে গৃহস্থের ঘরে ব্যবহার হত। তারাই-তো পিতা-পিতামহের দল।
এঙলিঙ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।
২৪
সারারাত পটলমামা দু’ চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। থেকে থেকে এঙলিঙের কথা মনে এল। প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা যেন কেউটে সাপ হয়ে তাঁর গা বেয়ে উঠে আসছিল।
ভোর হতেই উঠে পড়লেন। সাধুজী আর তাঁর সঙ্গীকে ডেকে তুললেন। সাধুজী চা তৈরী করে দিলেন। চা খেয়ে পটলমামা বললেন, “আমাকে এখনই যেতে হবে। বন্ধুটিকে খুঁজতে হবে।”
সাধুজী চিন্তিত ভাবে বললেন, “রাত পার হয়ে গেল, ভদ্রলোক ফিরলেন না। সত্যি খোঁজ নেওয়া দরকার।”
পটলমামা পাইপ ধরিয়ে বললেন, “চলুন, আপনাদের দেখাবো আপনাদের পিতা-পিতামহদের কবর। তাঁরা মরে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁদের জীবন যাত্রার পরিচয়।”
তিনজনে ইটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন বাইরে। বাইরে এসে পটলমামা শীলাবতী নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন। খাড়া পাড়। নদী মাটি খেয়ে খেয়ে দেওয়ালের মত করে তুলেছে। ঢিপির উপর সাধুজীর ঘর। চারিপাশে ঢিপির উপর সাধুজীর পোতা গাছ। কোন কোন গাছের শিকড় নীচের দিকে মাটি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
তিনজনে নদীর খাড়া পাড় ধরে এগোলেন। কয়েক পা এগিয়ে পটলমামা থমকে দাড়ালেন। নদী থেকে সাত-আট ফুট উপরে মাটির মধ্য দিয়ে মুখ বের করে আছে হাড়ি-কলসীর ভাঙা টুকরো। একের পর এক। মনে হয় কে যেন সারি দিয়ে খোলামকুচি গেঁথে রেখেছে। খোলামকুচির উপর ফুট ছয়েক পাথর, মাটি আর লাল কাঁকর। কাঁকরের উপর একটা খেজুর গাছ গজিয়ে উঠেছে।
পটলমামা বললেন, “দুষ্টু বালকের কীর্তি। খোলামকুচি মাটিতে গেঁথে রেখেছে।”
সাধুজীর সঙ্গী বললেন, “না, না, তা কি করে হবে?”
পটলমামা তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “তবে কিভাবে ওগুলো ওখানে গেল?”
লোকটি মাথা চুলকে বললো, “খোলামকুচি মাটির উপর থাকার কথা।” সাধুজী বললেন, “তাই ছিল। তারপর তার উপরে মাটি জমেছে। মাটি জমার ফলে খোলামকুচি নীচে এসেছে।”
পটলমামা বললেন, “দ্যাটস রাইট। কিন্তু দু’ফুট মাটি জমতে কত শত বছর লাগে?”
সাধুজী বললেন, “শত শত বছর কেন, দু’আড়াই হাজার বছর লেগে যেতে পারে।”
পটলমামা বললেন, “এবার আপনারা নিজেরা পড়ুন গড়বেতার অতীত ইতিহাস। খোলামকুচির ভাষায় আপনাদের পিতা-পিতামহেরা লিখে রেখে গেছেন।”
দু’জনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
পটলমামা বললেন, “আপনারা আপনাদের ইতিহাস পড়ুন। আমি চলি।”
পা ফেলবার আগেই শুনতে পেলেন, “গয়েদ মর্নিং, গয়েদ মর্নিং….”
পটলমামা ঘুরে দাঁড়ালেন। এঙলিঙকে দেখতে পেলেন নদীর ওপারে। নদীর বালিতে নেমে হাত তুলে গুড মর্নিং জানাচ্ছেন। তাঁর পিছনে লাল সূর্য।