১৬
হাঁটতে হাঁটতে এঙলিঙ অনেক দূর চলে গেলেন। মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালেন। কপালগুণে বামাল সমেত পালিয়ে আসতে পেরেছেন। থলের ভিতর এখন সেই কুঠারের ফলক। কত হাজার বছর আগে মানুষ কুঠার তৈরী করেছিল তা এখনই বোঝা যাবে না। কারবন পরীক্ষায় ফেললে যথাযথ সময় পাওয়া যাবে। এঙলিঙ রোমাঞ্চ অনুভব করলেন।
একদিন এই এলাকায় ছিল শালের বন। তা আন্দাজ করতে পারছেন। কত রকম জীবজন্তু ঘুরে বেড়াতো। তাদের পাশে বাস করতো কিছু মানুষ। তারা শিকার করে ক্ষুধা মেটাতো। তারপর তাদের আস্তানা হল। আস্তানা শক্ত করতে দরকার হল কাঠ। আজকের মানুষের মত হাজার রকমের ধাতু তাদের ছিল না। তখনো খনিজ ধাতু ব্যবহার করতে শেখে নি মানুষ। তাদের ভরসা পাথর। সেই পাথর ঘসে ঘসে তাদের কুঠারে পরিণত করেছে। সে কুঠার শিকার করার সঙ্গে গাছ কাটতে তাদের কাজে লেগেছে।
ধাপে ধাপে এগিয়েছে মানুষ। তাদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। শিখেছে তামার ব্যবহার। তামা এসে পাথরের কুঠারকে বাতিল করে দিয়েছে। চলার পথে এমনি লোহা এসে একদিন তামাকে বাতিল করে দিয়েছে। মানুষ চলার পথের পাশে পাশে কত উপাদান ফেলে এসেছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
সেই ফেলে আসা একখানি কুঠার আজ তার বংশধররা সিঁদুর লেপে পূজা করছে। ভালোবাসা, ভক্তির আড়াল দিয়ে রক্ষা করছে। কি রক্ষা করছে তা ভুলে গেছে। আপন মনে এঙলিঙ বললেন, ‘বিচিত্র—।’
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছেন তিনি। পথের নীচে লাল কাঁকর মাটি। পাশেই শালবন।
থমকে দাঁড়ালেন এঙলিঙ। অবাক চোখে দেখতে থাকলেন শালবন। সারি সারি, দাঁড়িয়ে আছে গাছ—একের পর এক। সোজা হয়ে উপরে উঠে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। রোদ আসছে না নীচে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বন। মাঝে মাঝে দু’একটা কাটা গাছ। পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে উইয়ের ঢিপি।
সেই আদিম পৃথিবী এখনও বেঁচে আছে। মাটির ভিতর থেকে হাজার হাজার হাত তুলে সূর্যের আলো পান করছে সবুজ পাতা মেলে। একদিন এমনি বনের মধ্যে গাছের ছায়ায় ছায়ায় হাঁটতো মানুষ। খুঁজতো বেঁচে থাকার উপাদান। শালবন নীরবে দাঁড়িয়ে দেখতো মানুষের অভিযান। কিভাবে মানুষ দল বেঁধে বাঁচতে চাইছে। নিজেকে নিরাপদ করে অভিজ্ঞতা তুলে দিয়ে যাচ্ছে বংশধরদের হাতে।
এঙলিঙ যেন সেই আদিম মানুষ হয়ে গেলেন। বন তাঁর ভিতর বিচিত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তিনি এগিয়ে চললেন শাল গাছের মধ্য দিয়ে। চমৎকার লাগছে। কাঁকর মেশানো লাল মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে শাল বন।
খানিকটা গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হ’ল এঙলিঙকে। তাঁর সামনে শালবনের মধ্যে বিরাট এক চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চার মত অনেকখানি জায়গা কে যেন খুঁড়ে মাটি তুলে নিয়েছে! লাল মাটি হাঁ করে আছে। শালবন যেন সেই বড় হাঁ করা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।
ধাঁধায় পড়লেন এঙলিঙ। বনের মধ্যে চৌবাচ্চা খুঁড়লো কারা? দু’ মানুষের মত গভীর গর্ত। তিনি আরো একটু এগিয়ে গেলেন। রহস্য পরিষ্কার হল। এক জায়গায় দেখতে পেলেন আলগা লাল মাটি অর্থাৎ মাটি কেটে এনে এখানে ফেলেছে বন দপ্তর।
শালবনের মধ্য দিয়ে বর্ষার জল গড়িয়ে নামে। যেখানে জলের ধার থাকে সেখানকার মাটি কেটে নীচে নামিয়ে নিয়ে যায়। এমনি প্রবল ধারায় জল নেমে মাটি কেটে কেটে একদিন তৈরী হয়েছিল গনগনির খোল। এখানেও বোধহয় আর-এক গনগনির খোলের সূচনা হয়েছিল। বন-দপ্তর টের পেয়ে মাটি কেটে ভরাট করে রেখেছে।
আবার বড় গর্তের কাছে ফিরে এলেন তিনি। খাড়া দেওয়াল। মাঝে মাঝে পাথরের মুখ বেরিয়ে আছে। ফুট দু’য়েক নীচের একখানা পাথরে এঙলিঙের চোখ আটকে গেল। তিনি বসে পাথরখানা দেখবার চেষ্টা করলেন। কিছু বুঝতে পারলেন না। উল্টো দিকে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসলেন। মাথা নীচু করে দেখতে চাইলেন পাথরখানা।
হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে ধাক্কা দিল। তিনি উল্টে পড়লেন।
নীচে পড়লেন। খুব একটা লাগলো না। কিন্তু পড়লেন কি ভাবে? উপরে কোন মানুষ দেখতে পেলেন না। শালগাছের মাথাগুলো শুধু দেখতে পেলেন, তার মাঝখানে নীল আকাশ।
কে যেন পেছন থেকে হাল্কা হাতে ধাক্কা দিয়েছিল। এঙলিঙ মাথা নাড়লেন। নিশ্চয় কেউ ধাক্কা দিয়েছিল, নয়তো পড়তেন না। মনে হয়েছিল একখানা হাত তাঁর পিঠের উপর কেউ রেখেছিল। কিন্তু কিছু বুঝবার আগেই ধাক্কা—
এঙলিঙ চীৎকার করে উঠলেন, “হু আল ইউ।”
কোন উত্তর এল না। তাঁর চীৎকার গহ্বরের মধ্যে পাক খেয়ে তাঁকেই যেন ব্যঙ্গ করল।
নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কি করবেন বুঝতে পারলেন না। তখন ফস্ করে আওয়াজ হল। চমকে উঠলেন এঙলিঙ। চারিদিকে চোখ বোলালেন, কিছু দেখতে পেলেন না। রক্তের মত লাল মাটি আর মাঝে মাঝে মুখ বের করে আছে কালো পাথর।
একটু বাদে তামাকের গন্ধ পেলেন। নাকটা উঁচু করলেন এঙলিঙ। না, কোন ভুল নেই। নাকে পোড়া তামাকের গন্ধ। গর্তের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কোন লোক সিগারেট খাচ্ছে। কিন্তু কে? তাঁকে ধাক্কা মেরে গর্তে ফেললো কেন তা বুঝতে পারলেন না।
১৭
আবার গর্তের দেওয়ালগুলো দেখলেন। দেওয়াল খাড়া। উঠে যাবার সহজ কোন রাস্তা নেই। দেওয়াল বেয়ে হয়তো ওঠা যায় কোন রকমে। কিন্তু উপরে উঠতে দু’হাতই ব্যবহার করতে হবে। পীঠের ঝোলা নিয়ে একদম ওঠা যাবে না। ঝোলা ফেলে নিজেকে মুক্ত করার কথা ভাবতেই পারলেন না। ঝোলায় আছে তাঁর কয়েক দিনের সংগ্রহ। কোনটাই সাধারণ জিনিস নয়। কতগুলি হীরের টুকরো।
উপরে নীল আকাশ আর চক্-চকে নীল নয়, খানিকটা বিবর্ণ। সূর্য পশ্চিম আকাশে চলে গেছে। শালের পাতা চক্-চক্ করছে না আর। এখানে গুমোট গরম। পায়ের নীচের মাটি নরম। সিগারেটের গন্ধ কখন মিলিয়ে গেছে। থেকে থেকে একটা ঘুঘু মন্থর গলায় ডাকছে। তার ফলে বিষণ্ণতা নেমে আসছে।
পাথরের একখানা টুকরো ভালো করে দেখতে যাওয়ার ফলেই এ বিপত্তি! এই বনের মধ্যে মানুষ হয়তো কারো পছন্দ হয় নি। সে আড়ালে আড়ালে অনুসরণ করে এসেছে। সুযোগ পেয়ে নীচে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। থাক, বুড়ো মানুষটা ঠ্যাং ভেঙ্গে গর্তে। না খেতে পেয়ে আপনি মরে যাবে।
এরা কারা? এঙলিঙ ভাবতে শুরু করলেন। প্রথমেই মনে এল ডাকাতদের কথা। তাঁর কাছে ডাকাতি করার মত কিছু নেই। যে হীরে মুক্তো আছে তা ডাকাতদের কাজে লাগবে না। তিনি শুনেছেন বনের মধ্যে অনেক চোর-বদমাস আত্মগোপন করে থাকে। লুকিয়ে পশু শিকার করে চামড়া বিক্রি করে। এ বনে কোন পশু থাকার কথা নয়। অনেকে চুরি করে গাছ কাটে। তারা বনের মধ্যে মানুষ আসা পছন্দ করে না। তাই বলে একটা মানুষকে মৃত্যুর মুখে‥‥
না, তা হতে পারে না, এঙলিঙ সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। মনে পড়লো শীলাবতী নদীর কথা। গুলি করেছিল কারা? কেন? তিনি যেন একটু আলো দেখতে পেলেন। তাঁরা এখানে অবাঞ্ছিত তা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অবাঞ্ছিত কেন তা বুঝতে পারছেন না।
একটা খরগোশ এসে দাঁড়ালো গর্তের মুখের কাছে কান খাড়া করে। দু’বার কান নাচালে! তারপর পালিয়ে গেল। এঙলিঙ বুঝলেন কাছাকাছি এখন আর কোন মানুষ নেই।
আকাশে রোদ নেই। অন্ধকার হয়ে আসছে। দুটো পাখী বেড়িয়ে গেল তীর বেগে। বাসায় ফিরে যাচ্ছে। এবার অন্ধকার নামবে। এখনই গর্ত থেকে বের হতে হবে। লুকিয়ে থাকতে হবে কোন গাছের আড়ালে। অন্ধকার হলে সরে পড়বেন।
খাঁজের দিকে এগিয়ে গেলেন। দাঁত বের করা পাথরগুলো ধরে ওঠা যাবে কিনা তা পরীক্ষা করতে গেলেন। একখানা পাথরের টুকরোয় হাত দিতে গিয়ে লাফিয়ে সরে এলেন পাঁচ হাত দূরে।
গর্ত থেকে মাথা বের করে রেখেছে একটা সাপ। সাপের মাথাকেই লাল মাটিতে গাঁথা পাথর ভেবেছেন তিনি।
সাপটা আওয়াজ পেয়েই ফণা তুললো। লাল মাটির পটভূমিকায় তার ফণাকে মনে হল কুলোর মত। ফণা দোলালো। জিভ বের করে একবার যেন হাওয়া চেটে পরখ করলো। গলা আবার টেনে নিল ভেতরে। কেউটে সাপ।
এঙলিঙের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। সামনেই মৃত্যু। কেউটে কি ভয়ঙ্কর সাপ তা অজানা নয়। একবার ছোবল দিলে আর রক্ষা নেই। তেমনি নিষ্ঠুর স্বভাব। গাছের পাতা নড়লেও কেউটে ছোবল হানে।
তিনি আরো সরে এলেন। বুঝলেন, গর্তের ভিতর ফেলে দিয়ে লোকটি সরে পড়েছে কেন? কেউটের যে বাসা আছে তা সে জানে। তাই ঠেলে ফেলে আর কোন খোঁজ নেয় নি।
তিনদিকের দেওয়াল দেখলেন। একেবারে খাড়া। কোন রকমেই বেয়ে ওঠা যাবে না।
দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। কোমর পর্যন্ত অন্ধকারে ডুবে গেছে। আর একটু অন্ধকার হলেই সাপের গর্ত অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। তারপর?
গভীর ঘন অন্ধকার একটা গর্ত। গর্তের মধ্যে এঙলিঙ তাঁর সঙ্গী একটা কেউটে সাপ। সাপটা কোথায় তা আর জানা যাবে না।
এঙলিঙের মাথায় দু’এক গাছ যা চুল আছে সব খাড়া হয়ে গেছে। গলগল করে ঘামছেন তিনি। সামনে অনিবার্য মৃত্যু। ভয় পেয়ে চীৎকার করে উঠলেন, “হেল্প মী….হেল্প মী।”—কোন সাড়া পেলেন না। শব্দ শুনে কেউটে মাপ ভয় পেয়ে আবার ফণা তুললো।
১৮
সাপ সরে যেতেই পটলমামা সুস্থির হলেন! বললেন, “খুব ভয় পেয়েছিলাম।”
সাধুজী হেসে বললেন, “ওরা কামড়ায় না। অনেকদিন ধরে আমার সঙ্গে আছে।”
পটলমামা ভুরু বাঁকা করে বললেন, “সসর্পে চ নিবাস।”
সাধুজী হাসলেন। বললেন, “এটা গড়বেতা। তাল-বেতালের রাজ্যে উল্টো-পাল্টা ব্যাপার ঘটতে পারেই। নয়তো হিন্দু মন্দিরের দরজা উত্তর দিকে হবে কেন?”
পটলমামা খানিকটা সময় মাথা নীচু করে কি যেন ভাবলেন। বললেন, “সর্বমঙ্গলা কে, কি ভাবে তাঁর জন্ম, তা জানেন?”
সাধুজী অসহায় ভঙ্গী করে বললেন, “কি করে জানবো। তেত্রিশ কোটি দেবতার জন্ম কাহিনী কি জানা সম্ভব?”
পটলমামা বললেন, “আমি একটা গল্প জানি। গল্পটা উড়িষ্যার।”
সাধুজী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি রকম? বলেন শুনি।”
পটলমামা পাইপে দীর্ঘ টান লাগিয়ে বললেন, “চণ্ডীর সঙ্গে অসুরের যুদ্ধ —এইতো ইতিহাস। আপনাদের সর্বমঙ্গলা কিন্তু চণ্ডী নন, দুর্গাও নন। তবে কে এ প্রশ্ন উঠবে। উনি চণ্ডীর সহচরী মাত্র।”
পটলমামা থামলেন। দু’বার পাইপ টেনে বললেন, “চণ্ডী অসুরের সঙ্গে পারছেন না। যতবার যুদ্ধে যাচ্ছেন ততবার হেরে আসছেন। তখন তাঁর সহচরী যুদ্ধে জয়ী হবার উপায় বাৎলে দিলেন।”
সাধুজী বললেন, “কি রকম?”
পটলমামা বললেন, “সহচরী বললেন চণ্ডীকে বিবস্ত্র হয়ে যুদ্ধ করতে। চণ্ডী তাই করলেন। যুদ্ধে তাঁর জয় হল। অসুর বধ করে ফিরে এসে সহচরীকে বর দিলেন, এখন থেকে সর্বমঙ্গলা নামে তুমি পূজা পাবে।”
সাধুজী বললেন, “বিচিত্র ইতিহাস।”
পটলমামা বললেন, “আপনাদের সর্বমঙ্গলার মূর্তি ভাল করে লক্ষ্য করবেন। দেখলে মনে হবে কাঠ কেটে তৈরী। এরকম কাঠের মুখ উড়িষ্যায় পাওয়া যায়। আমি বলতে চাইছি উড়িষ্যার ছাপের কথা।”
সাধুজী গম্ভীর গলায় বললেন, “এত কথার পরেও কিন্তু রহস্য থেকেই গেল।”
পটলমামা বললেন, “রহস্য থাকলে তার সমাধানও আছে। স্থানীয় লোকদের মধ্যে প্রচলিত গল্পের মধ্যে আছে সমাধান।”
সাধুজী বললেন, “কোন্ গল্পটার কথা বলছেন? সেই যোগী পুরুষের কথা, তখন বিক্রমাদিত্য রাজা। যোগী পুরুষ বনের মধ্যে সর্বমঙ্গলার কথা শুনে আসেন। এখানেই সাধনা করেন। বিক্রমাদিত্য তাঁর নাম শুনে এখানে আসেন বেতাল-সিদ্ধ হতে।”
পটলমামা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, “এই গল্পটির মধ্যেই আছে আসল সত্যের ঈশারা। এই যোগী পুরুষ কে? তাঁর নাম জানা যায় না। তিনি যে খুব বড় যোগী ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। যোগের সঙ্গে কারা সব থেকে বেশি যুক্ত? এ প্রশ্নের জবাবে নিশ্চয় তন্ত্রের কথা আসবে। তন্ত্র সাধকরা ভূত, প্রেত, ডাকিনী, যোগিনী নিয়ে কারবার করে –এ হ’ল লোক-বিশ্বাস। কাপালিকরা নরবলি দেয়। আদিবাসীরা তাদের দেবীর কাছে নরবলি দিত না তা ভাববার সুযোগ নেই।”
সাধুজী বললেন, “সাঁওতাল, বাউরী এরা মুরগী, শুকর বলি দেয়।”
পটলমামা পাইপ কামড়ে ধরে বললেন, “যোগী সর্বমঙ্গলার নাম শুনে গড়বেতায় আসেন নি। এখানে ছিল অরণ্যবাসীদের বনদেবী। সেই বনদেবীর স্থানকেই তিনি নির্বাচন করেন নিজের সাধনার ক্ষেত্র রূপে। বনদেবী গাছের নীচে গ্রামের প্রান্তে বনের মধ্যে থাকেন। তার মুখ যদি উত্তর দিকে থাকে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।”
সাধুজী দ্বিধা জড়িত গলায় বললেন, “কিন্তু সর্বমঙ্গলা….”
পটলমামা তাঁকে থামালেন। বললেন, “কালে কালে পাল্টে পাল্টে আদিম মানব সমাজের বনদেবী সর্বমঙ্গলায় পরিণত হয়েছেন। রুক্মিনী, চম্কিনী এ রকম কোন দেবী ছিলেন আদিতে। মূর্তির ভয়ঙ্করতা তাই বলে।”
সাধুজী আর কোন কথা বললেন না। কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।
মায়ের নাম গান করতে করতে এলেন আর একজন। অনেক দূর থেকেই তাঁর গলা শোনা যাচ্ছিল। ভরাট গলায় গাইছিলেন :
“এমন মা কোথায় পাব, নিত্যদিন যে—“
উপরে উঠে এলেন। ভক্তি সহকারে প্রণাম করলেন মা কালীকে। সামনে এসে পটলমামাকে দেখতে পেলেন। ভুরু বাঁকা হয়ে গেল তাঁর। খানিক সময় তাকিয়ে থেকে বললেন, “আপনি?”
পটলমামা জবাব দিলেন না। উত্তর দিলেন সাধুজী। বললেন, “আপনি চিনবেন না, নতুন লোক। বেড়াতে এসেছেন গড়বেতা।”
“অঃ”— গলায় বিচিত্র এক শব্দ করলেন আগন্তুক। বসলেন না। বললেন, “গড়বেতা কি রকম লাগছে আপনার?”
পটলমামা সংক্ষেপে বললেন, “ভালই।”
সাধুজী পটলমামার উদাসীনতায় বোধহয় একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, “উনি কয়েক দিন থেকেই গড়বেতার সব জেনে নিয়েছেন। আমাদের সর্বমঙ্গলা দুর্গা নন, সর্বমঙ্গলাও নন।”
আগন্তুক বিস্মিত গলায় বললেন, “তাই নাকি? আমরা কি তাহলে যুগ যুগ ধরে ভুল করে আসছি?”
পটলমামা মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বললেন, “ভুল করবেন কেন? যে যাকে যেমন ভাবেন। তবে উনি কোন প্রাচীন বনদেবী। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে পূজো পেতেন। যে কোন কারণে হোক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।”
আগন্তক আহত গলায় বললেন, “আপনি বলতে চান বাউরী, ডোম, কৈবর্ত, তাদের দেবতা?”
পটলমামা উষ্ণ গলায় বললেন, “হ্যাঁ, তাদেরই দেবতা। আপনারা চুরি করে তাঁকে দুর্গা, সর্বমঙ্গলা এসব রূপে সাজিয়েছেন। যাদের দেবী তারা মন্দির চাতালে এখন আর আসতেও পারে না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। অর্থ আর ক্ষমতায় ওরা তো পরাজিত।”
পটলমামার চোখ-চোখা শব্দ শুনে আগন্তক একটু ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, “আপনি এসব কথা বলছেন বটে তবে কোন প্রমাণ নেই।”
পটলমামা বললেন, “প্রমাণ?” তিনি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তা বুঝতে পারলেন। ঘন ঘন পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে একগাদা ধোঁয়া উগড়ে দিয়ে বললেন, “প্রমাণ আছে। ঐ মন্দিরের চাতাল এক সময় ছিল বন জঙ্গলে ঢাকা। তান্ত্রিকরা সারা রাত আগুন জ্বেলে সাধনা করতো। দু’চারজন কাপালিকও আস্তানা গেড়েছে। দস্তুর মত নরবলি হত। হয়তো নরবলির আতঙ্ক থেকেই অনেক দূরে নাম ছড়িয়েছে।”
পটলমামা একটু দম নিলেন যেন। দম নিয়ে বললেন, “এখানকার লোকরা একসময় বৌদ্ধ ছিল। বাংলার দরিদ্র আর আদিবাসীরাই বেশির ভাগ বৌদ্ধ মত মেনে চলতো। বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চশীল তাদের জীবনযাত্রা আর বিশ্বাসের অনুকূল। পরে ব্রাহ্মণরা এসে জোরজার করে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে।”
আগন্তুক থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর দাঁড়িয়ে থাকা উদ্ধত ভঙ্গী দেখে বুঝতে পারা গেল পটলমামার কথা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
পটলমামা পা মাটিতে ঠুকলেন। বললেন, “আমার কথা বিশ্বাস করা আপনাদের পক্ষে কঠিন, কিন্তু বাস্তব ঘটনা তাই। মন্দিরের বাইরে দুটি বড় পাথরের মূর্তি আছে নিশ্চয় দেখেছেন।”
সাধুজী বললেন, “হ্যাঁ, দেখেছি, ভৈরব মূর্তি।”
পটলমামা বললেন, “দুটি মূর্তিই বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি। অনেক প্রাচীন মূর্তি বলে খয়ে খয়ে ওরকম হয়ে গেছে। ওতো মাটির ভিতর থেকে আপনারা পেয়েছেন।”
আগন্তুক বিস্মিত গলায় বললেন, “হ্যাঁ, মাটির ভিতর থেকেই পাওয়া গেছে। আপনি জানলেন কি করে?”
পটলমামা আগন্তুকের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন, “মন্দিরের ভিতরটা সুরঙ্গের মত। দেখে কামাখ্যা মন্দিরের কথা মনে হয়। সর্বমঙ্গলার পাশেই আছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। সর্বমঙ্গলা তন্ত্রের কোন এক ভয়ঙ্কর দেবী। তার ফলেই বেতালের গল্প জন্ম নিয়েছে। সর্বমঙ্গলার দাঁতের পাটি দেখলেই তাঁর আসল ভয়ঙ্কর আদিম রূপের আঁচ করা যাবে।”
পটলমামা থামলেন। অন্য দু’জনেও কোন কথা বললেন না। পটলমামার পাইপের তামাক ফুরিয়ে গিয়েছিল। তিনি পাইপে তামাক পুরলেন। তামাক পুরে পাইপ ধরালেন। পাইপ ধরিয়ে বললেন, “আমার কথাগুলো একটু বিচিত্র মনে হচ্ছে, না?”
আগন্তুক ভদ্রলোক দ্বিধা জড়িত গলায় বললেন, “কোন প্রমাণ নেই।”
পটলমামা এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “প্রমাণ-প্রমাণ”। হাতটা তুলে আগন্তুকের চোখের সামনে নাড়লেন। হাত নেড়ে বললেন, “প্রমাণ চাইছেন? আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন এখান থেকে একশ ফুট দূরে দেখিয়ে দেবো প্রমাণ। আপনারা, ব্রাহ্মণরা এখানে যখন আসেন নি, বাগড়ীর রাজপরিবার গড়বেতায় রাজধানী করেন নি, তখনো মানুষ বাস করতো। আপনারা যাদের অন্ত্যজ করে রেখেছেন, ছোটলোক বলেন, তারা এখানে বাস করতো।”
যেমন হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছিলেন তেমনি বসলেন ঝপ করে। বসে বললেন, “আইন-ই-আকবরীতে উড়িষ্যার রাজা যে গড়বেতা দখল করেছিল তা লেখা আছে।”
কথা শেষ করে পাইপ টানতে লাগলেন। পটলমামাকে উত্তেজিত মনে হল। তিনি কয়েকবার জোরে জোরে পাইপ টানলেন। এক রাশি ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “রাজরাজরাদের গল্প থাক, তাদের নিয়ে মাথা ব্যথা নেই আমার। আমি দেখাতে পারি গড়বেতায় আদিম অধিবাসীদের ইতিহাস। থরে থরে সাজানো আছে। প্রমাণ চেয়েছেন, প্রমাণ দেবো। কিন্তু ভেবে খারাপ লাগছে, আপনারা আসল খবর না রেখে তাল-বেতালের গল্প বলেন। দুর্ভাগ্য মশাই যে আপনি জানেন না একটা মানব গোষ্ঠীর কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছেন।”
আগন্তুক চমকে পাঁচ হাত দূরে সরে গেলেন।