১২
পটলমামা চুপচাপ হাঁটতে থাকলেন। মনে মনে বললেন, কোন খেলাই শেষ হয় না। থেকে যায় স্মৃতি। একটা মানুষকে গনগনির খোলায় খুন করা যায়। ঘটনা সেখানেই থেমে থাকে না। যদি বা থেমে যায় তাকে শেষ হয়ে যাওয়া বলা যায় না। আবার দৃশ্যপট উন্মোচিত হতে পারে। শত শত বছর পরে। এমন হতে পারে হাজার বছর পার হয়ে গেল। শীত এল, গ্রীষ্ম গেল। হাজার হাজার বছরের মাটি জমে উঠলো তার উপর। এমন কি দশ হাজার বছর পার হয়ে গেল। তারপর একদিন—
নদী খয়ে খয়ে মাটি নিয়ে চলেছে। মাটি নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে মোহনায়। সেখানে ব-দ্বীপ গড়ে উঠছে। ব-দ্বীপের নীচে চাপা পড়ে গেল। সবটা গেল না। কিছু থেকে গেল মাটির মধ্যে। নদীর খাড়াই দেওয়ালে।
একদিন এক অপরাহ্ন বেলায় এক প্রত্নবিজ্ঞানী এলেন নদীর তীরে অনুসন্ধানে। তীক্ষ্ণ সতর্ক চোখে দেখছেন। হঠাৎ চোখে পড়লো বিবর্ণ একটি হাড়। ফসিল হয়ে কাঁকর বালির মধ্যে গেঁথে আছে। গেঁথে আছে এক যুবকের চোয়াল। দেহের অন্যান্য অংশ মহাকাল, মাটি, নদী গ্রাস করেছে। গ্রাস করে নি অথবা করতে পারে নি যুবকের চোয়ালটি। অথবা চোয়ালটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে অতীতের নমুনারূপে।
চোয়ালটিকে মাটি থেকে বের করে আনা হল। দেখা গেল অনুমান যথাযথ। দশ হাজার বছর আগে যুবকটি বেঁচে ছিল। সে পশু শিকার করে প্রাণধারণ করতো। হয়তো পাথর ঘসে অস্ত্র তৈরী করতো। সে একা নয়। আরো দু’চারজন মানুষ ছিল তার সঙ্গে। তারা সমবেতভাবে বাঁচবার জন্য চেষ্টা করেছে।
বাঁচতে চাইলেই বাঁচা যায় না। মৃত্যু অনিবার্য। অপঘাতে হতে পারে আবার স্বাভাবিক ভাবেও হতে পারে। প্রাচীন পৃথিবীতে অপঘাতেই মৃত্যু হত বেশি। জীবনে ছিল না কোন নিরাপত্তা।
একদিন যুবকটির মৃত্যু হল। কিভাবে মৃত্যু হল? কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিতে হবে। হয়তো তার সঙ্গীরাই হঠাৎ আক্রমণ করে মেরে ফেলেছিল। কোন জীবজন্তুর আক্রমণেও মৃত্যু হতে পারে।
যে মরেও মরলো না। তার চোয়াল বেঁচে থেকে আজকের মানুষের কাছে পৌঁছে দিল সেদিনের মানুষের খবর। খবর সংক্ষিপ্ত, সংবাদপত্রের হেডিংয়ের মত। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খবর। ভারতবর্ষের সর্ব প্রাচীন নর করোটির স্বাক্ষর মানুষের হাতে তুলে দিল মেদিনীপুরের ‘সিজুয়া’ গ্রাম।
পটলমামা নিজের ভিতর গভীর ভাবাবেগ অনুভব করলেন। একটা আঙ্গুল তুলে বললেন, “সিজুয়া ম্যান, সিজুয়া ম্যান‥‥”
এঙলিঙ থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে পড়লো সিজুয়া চোয়ালের কথা। পশ্চিমবঙ্গ প্রত্ন সংগ্রহশালায় গিয়ে নিজে দেখে এসেছেন সেই চোয়াল। দশ হাজার বছর আগের এক যুবকের চোয়াল। তিনি বললেন, “ইয়েত, ইয়েত—থিদুয়া ম্যান ফম থিদুয়া!”
পটলমামা চোখ বুজে যেন রামগড়ের ‘সিজুয়া’ গ্রামের কংশাবতী নদীর তীর দেখতে চাইলেন। লালচে উপলরাশির মাঝখানে প্লাইস্টোসীন পর্বে গেঁথে আছে একটি মানুষের চোয়াল। চোয়ালটি ভাঙ্গা, তাতে কিছু আসে যায় না। মানুষের চোয়াল। প্লাইস্টোসীন পর্বের মানুষের চোয়াল। মহেন্জোদড়োতে পাওয়া মানুষের কঙ্কালের আগের। দশ হাজার বছর আগের মানুষ! কিন্তু চোয়ালটি ভাঙ্গা কেন? পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছিল? হঠাৎ কোন জন্তু আক্রমণ করেছিল? গোষ্ঠীর কোন মানুষ ঈর্ষাবশত খুন করেছিল?
আজ আর তার জবাব পাওয়া যাবে না। শুধু জানা যাবে একটি মানুষের নিহত হবার খবর।
পটলমামা বিড় বিড় করে বললেন, “মানুষ মানুষকে খুন করে। পৃথিবীতে এর থেকে বিস্ময়কর আর কি থাকতে পারে?”
এঙলিঙ শুনলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “নাথিং নাথিং।”
১৩
সন্ধ্যা উতরে গেল, এঙলিঙ ফিরে এলেন না। চিন্তা ক্রমশঃ দুঃশ্চিন্তায় পরিণত হল পটলমামার। সেই দুপুরে বেরিয়ে গেছেন বাঘরায়ের থান দেখতে। গড়বেতার দু’দিকের সীমানা পাহারা দেয় বারভুঁইঞা আর বাঘরায়।
- বাঘরায় নিশ্চয় ধর্মঠাকুরের নাম। প্রথম নাম বাঘরায়। বাঘের দেবতা। আরণ্যের মানুষ বাঘকে ভয় পায়, ভয় পাবারই কথা। ভয় থেকেই তো পূজার্চনার উদ্ভব।
যেখানে বাঘ সেখানে বাঘের পূজো। সুন্দরবনে এখনো বাঘের পূজো হয়। তাকে বলে বনবিবি। বনবিবিকে পূজো না দিয়ে সুন্দরবনে ঢোকার কথা ভাবে না মানুষ। বাঘরায় নানা এলাকায় ধর্মঠাকুর নাম নিয়ে বেঁচে আছে।
ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরের লোকেরা বাঘরায়ের পূজো করবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। গড়বেতার চারিদিকে ছিল গভীর শালবন। সেই অরণ্যে আরণ্যক মানুষ বাস করতো।
কিন্তু এঙলিঙ ফিরে আসছেন না কেন? ক্রমশঃ পটলমামার উদ্বেগ বাড়ছে। এখানে আসা থেকেই কারো কারো নজরে তাঁরা পড়েছেন। কিছু মানুষ তাঁদের দু’জনকে অনুসরণ করেছে। কি সে উদ্দেশ্য তা বোঝা যাচ্ছে না।
যত ভাবছেন তত চিন্তা বাড়ছে। পটলমামার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। থলে থেকে প্যাডের কাগজ বের করতে গেলেন। দেখলেন থলে নেই, এঙলিঙ নিয়ে গেছেন। মুখ ভাঁড় করে বসে রইলেন।
হঠাৎ বিষ্ণুপুরের কথা মনে এল। এঙলিঙ বিষ্ণুপুর যান নি তো! যাবার কথা বলেছিল। বিষ্ণুপুরের রাজারা একসময় গড়বেতা দখল করেছিল। তবে নিজেরা এখানে এসে শাসন করে নি। তাদের হয়ে স্থানীয় রাজারাই রাজ্য শাসন করতো। দুর্জন সিংহ তখন মল্লভূমের রাজা।
মল্লরাজারা যে নানা কারণে বার বার গড়বেতা দখল করেছে তা রাধামাধবের মন্দির দেখেই সন্দেহ করেছিলেন। বঙ্কিম আটচালা জাতীয় চাল গড়ার নমুনাই প্রথম ধাক্কা দিয়েছিল। অবশ্য গড়বেতার পাশেই মল্লভূমি বিষ্ণুপুর। শিল্পরীতিতে তার ছাপ পড়া অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবুও পটলমামা নাকে গন্ধ পেয়েছিলেন।
এটা হয়। পুরণো সভ্যতার কোন কেন্দ্রে পা দিলেই তিনি গন্ধ পান। বিচিত্র সে গন্ধ। হাজার হাজার মানুষের ঘামের গন্ধের মত। তারা যেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। মৌনমুখে বলে, ‘আমাদের দেখুন। আমরা একসময় পৃথিবীতে আপনাদের মত বেঁচে ছিলাম। গায়ের ঘাম ঝড়িয়ে সভ্যতার ইট গেঁথেছি। তারপর হারিয়ে গেলাম। হারিয়ে যেতে মানুষ চায় না। সে চায় বাঁচতে। আপনি আমাদের কথা শুনুন। আমাদের কথা সবাইকে বলুন।’
পটলমামা তখন নিজের ভিতর রোমাঞ্চ অনুভব করেন। গড়বেতার রাধামাধব মন্দিরে দাঁড়িয়ে এমনি রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলেন। তখনই চোখে পড়ে মন্দিরের গায়ে খোদাই করা লিপি। “শ্রীমল্লভূরমণ দুর্জনসিংহ দেবঃ সৌধনেবেদয়দিদম্” কথাগুলির উপর চোখ আটকে গিয়েছিল। তারপরেই এঙলিঙ বলেছিলেন বিষ্ণুপুরের কথা।
দুশ্চিন্তা পটলমামাকে বসে থাকতে দিল না। তিনি শেষ পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এলেন। এঙলিঙকে খোঁজার জন্য নয়। তিনি খোঁজার মত মানুষ নন। যখন আসার তখন ঠিক আসবে। কিন্তু নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না।
১৪
হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানের কাছে চলে এলেন। সামনেই শিলাবতী। পাশে সাধুজীর আশ্রম। ঘন গাছপালার মধ্যে প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে। পটলমামা ধীরে ধীরে গেট খুললেন। উপরে উঠে দেখতে পেলেন সাধুজীকে। চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। পটলমামা উপরে উঠতেই চোখ খুললেন। চিনতে পেরে বললেন, “আসুন-আসুন।”
পটলমামা পাশের খাটিয়ায় বসলেন। একটা রাতজাগা পাখী ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। এক মুঠো আকাশমণি ফুল ঝরে পড়লো।
পটলমামা পাইপ মুখে লাগালেন।
সাধুজী বললেন, “আপনি আসাতে ভাল লাগছে। সকালে আপনার পুরোপুরি পরিচয় নেওয়া হয় নি।”
পটলমামা মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বললেন, “বলার মত তেমন কিছু নেই। বলতে পারেন, ভূত। ভূত হয়ে সংসারের মধ্যে বসে আছি।”
সাধুজী খলখল করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “এখানে শ্মশানকালী আছে বলে আপনি ভূত হলেন?”
পটলমামা বললেন, “না, তা নয়। আসলে বর্তমান অপেক্ষা যা অতীত তাই আমার ভাল লাগে। তা মশায় জীবিত মানুষের আর অতীত কতটুকু! সেজন্য বেশী অতীত পেতে হলে মরা মানুষের খোঁজ নিতে হয়। জ্যান্ত মানুষ কি মরা মানুষের সঙ্গ করে? অতীত নিয়ে থাকি বলে ভূত বললাম।”
সাধুজী বললেন, “এখানে বাইরের মানুষ এলে ভূত হয়ে যায়।‥‥ কথাটা শেষ না করেই হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “তাল-বেতালের দেশ তো! স্বয়ং বিক্রমাদিত্য বেতাল-সিদ্ধ হয়েছেন এই গড়বেতায়। বেতালের গড় থেকেই গড়বেতা।”
পটলমামা গল্প পেয়ে নড়েচড়ে বসলেন। পাইপটাকে কামড়ে ধরে বললেন, “কি রকম?”
সাধুজী বললেন, “যে শ্মশানের পাশে বসে আছেন এই শ্মশান থেকেই শব তুলে নিয়েছিলেন বিক্রমাদিত্য। সাধনায় বসে সিদ্ধি লাভ করলেন সর্বমঙ্গলা মন্দিরে। তাল-বেতাল এসে দাঁড়ালো সামনে।”
পটলমামা এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “তারপর?”
সাধুজী উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে বসলেন। বললেন, “অমাবস্যার অন্ধকার। হাতের কাছে কি আছে তা দেখা যায় না। শবের উপর বসে আছেন বিক্রমাদিত্য। চারদিকে ভূত-প্রেত। ভাবলেও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।”
পটলমামা বললেন, “কি বলছেন মশাই! খুব সাহসতো লোকটির।” সাধুজী অবাক হয়ে বললেন, “লোকটি কি মশাই ! বিক্রমাদিত্য, মহারাজ বিক্রমাদিত্য।”
পটলমামা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আপনি বলুন।”
সাধুজী বললেন, “তাল-বেতাল এসে দাঁড়ালো। বললো, ‘হুকুম করুন, যা বলবেন তাই করবো। আমরা আপনার ক্রীতদাস।”
সাধুজী থামলেন। নিস্তব্ধতা নেমে এল দু’জনার মাঝখানে। মাথার উপর সামান্য এক টুকরো আকাশ। আকাশমণি ফুলের মতো হাজার হাজার তারা ফুটে আছে। শীলাবতীর উপর ছায়াপথ! অন্ধকার যেন আকাশ থেকে ঝরে নামছে। গাছপালার আড়ালে দেখা যাচ্ছে ক্ষীণ চাঁদ। মেঘ তাকে ঢেকে রেখেছে। বিচিত্র এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরী হয়েছে।
সাধুজী সে পরিবেশ ভাঙলেন। বললেন, “বিক্রমাদিত্য ভাবলেন তাল-বেতালের শক্তি পরীক্ষা করবেন। বললেন, ‘সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দরজা উত্তর দিকে করে দিতে পারবে? তাল-বেতাল আনত হয়ে বললো, “আপনি আদেশ করুন, মহারাজ। তাল-বেতাল ঐ বিশাল মন্দির ঘুরিয়ে বসিয়ে দিল। সেই থেকে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দরজা উত্তর দিকে। মা নিজেও উত্তর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।”
পটলমামা মুখ থেকে পাইপটা নামালেন। বললেন, “গল্প গল্পই। গল্প সব সময় সত্য কথা বলে না।
সাধুজী অবাক হয়ে বললেন, “আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না!”
পটলমামা হেসে বললেন, “অবিশ্বাসের কথা নয়। আমাদের দেশে শক্তি-শালী ওঝা, গুণীন, ভৈরব এরা অনেক সময় বেতাল-সিদ্ধ বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তেমনি কোন শক্তিশালী প্রভাবশালী গুণীন অথবা ভৈরব ওখানে থাকতেন। নরবলি দিয়ে পূজো করার সঙ্গে অদ্ভূত সব মন্ত্রের কাজ দেখাতেন। তাই ভক্তের অভাব হল না তাঁর। ভক্তদের কাছে তিনি বিস্ময়কর পুরুষ। তাই তাঁকে বেতাল-সিদ্ধ বা বেতাল ভাবা অস্বাভাবিক নয়। বেতাল থেকে বেতালের স্থান, বেতালের গাঁ, বেতালের আগার, বেতাল বসতি, গড় বেতাল থেকে গড়বেতা নাম আসতে পারে।”
সাধুজী আশ্চর্য হয়ে বললেন, “এ রকম হয় নাকি?”
পটলমামা হেসে বললেন, “বাংলার গ্রামাঞ্চলে আকছাড় হচ্ছে। রাজা বিক্রমাদিত্য, গ্রাম-দেবতা এ সবের অভাব নেই।”
সাধুজী কোন কথা বললেন না। পটলমামা কতটা সত্য কথা বলছেন তা বোধ হয় ভাবছেন। বুঝতে পারছেন না মন্দিরের দরজা কি ভাবে উত্তর দিকে গেল।
পটলমামা সাধুজীর মনের কথা বুঝতে পারলেন। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “সর্বমঙ্গলা মন্দিরের উত্তর দিকে দরজা কেন তার উত্তর খুব কঠিন নয়। সর্বমঙ্গলা, মন্দির উড়িষ্যার রেখ-দেউলের রীতিতে তৈরী। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরী। তৈরী করেছিলেন উড়িষ্যার রাজারা।”
সাধুজী বললেন, “কিন্তু উত্তর দিকে দরজা‥‥”
পটলমামা তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিলেন, বললেন, “সে জবাব দিচ্ছি তার আগে উড়িষ্যার রাজার তৈরী মন্দির যে সেই প্রমাণ প্রথমে বলি।”
পটলমামা আপন মনে খানিক সময় পাইপ টানলেন। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। এঙলিঙের কথা মনে এসেছিল। মনে আসতেই উত্তেজনা অনুভব করলেন। বিপদের কথা মনে এল। অবশ্য বিপদে পড়লে তা থেকে বেড়িয়ে আসার মত বুদ্ধি তিনি রাখেন। অনেক দিন ধরে দু’জনে সবার অজ্ঞাতে এক বিচিত্র জীবনযাত্রা নির্বাহ করে চলেছেন। দেশের ইতিহাসের নানা উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।
সাধুজী বললেন, “বলুন আপনার প্রমাণ।”
মুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলেন পটলমামা। বললেন, “বলবো বৈকি। রেখ-দেউলের প্রথম প্রমাণ দিয়েছি। এবার দ্বিতীয় প্রমাণ। আচ্ছা, এখান থেকে ‘উড়িয়াশাহী’ গ্রাম কত দূরে?”
সাধুজী বললেন, “বেশি দূরে নয়, চন্দ্রকোণা রোডের পাশে।”
পটলমামা বললেন, “হ্যা, বেশি দূরে নয়। গ্রামটি আমি ঘুরে দেখেছি। গড়বেতার গায় এ রকম উড়িয়াবাসীদের কলোনী দেখে প্রথম খুব অবাক হয়েছিলাম। হঠাৎ একটা উড়িয়া গ্রাম কি করে মেদিনীপুরের জঙ্গলের পাশে গড়ে উঠলো! বেতাল একটা গ্রাম উড়িষ্যা থেকে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে?”
পটলমামার কথা শুনে সাধুজী হাসলেন। বললেন, “তাই হয় নাকি?”
পটলমামা গম্ভীর হয়ে বললেন, “হবে না কেন? মন্দির ঘুরিয়ে বসিয়ে দিতে পারে আর একটা গ্রাম তুলে আনতে পারবে না?”
সাধুজী চুপচাপ রইলেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। বিপন্ন হয়ে বার বার হাত তুলে মাথায় বোলাতে থাকলেন।
পটলমামা বললেন, “এরাই হল সেই কারিগর যারা সর্বমঙ্গলার মন্দির তৈরী করেছিল। তারা এখানে এসে রাজার হুকুমে মন্দির তৈরী করেছে, রাজার কর্মচারীর কাজ করেছে। তারপর একদিন গড়বেতা স্বাধীন হয়েছে। এরা আর যায় নি। তাদের বংশধররা উড়িয়াশাহীতে বহাল তবিয়তে থেকে গেল। শাহী কথাটাও উড়িয়া।’ শাহী কথার অর্থ গ্রাম।”
সাধুজী মাথা চুলকে বললেন, “এসব কথা কখনো ভাবি নি। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি তাল-বেতালের গল্প।” কথা শেষ করেই তিনি হাতে তালি দিলেন। বললেন, “যা-যা – ”
পটলমামা নীচের দিকে তাকালেন। যা দেখতে পেলেন তাতে শিউরে ওঠার কথা। তাঁর পায়ের কাছে হাত পাঁচেক লম্বা একটা সাপ।
সাধুজী বললেন, “নড়বেন না। চুপচাপ বসে থাকুন। নিজেই চলে যাবে। গুটি ছয়েক এনারা এখানে আছেন। আমাকে বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছে। তাই মাঝে মাঝে একেবারে পায়ের কাছে চলে আসে।”
পটলমামা কাঠ হয়ে বসে রইলেন।
১৫
এঙলিঙ যা ভাবেন নি তাই পেলেন। বাঘরায় থান থেকে ফেরার পথে দেখতে পেলেন। পুকুরের পারে বাউড়ীদের ঘর। দরিদ্র মানুষের খান তিনেক ঘর। মাথায় বিচালীর চাল, মাটির দেওয়াল। রাস্তার পাশে উঠান। উঠানের একপাশে একটা বড় শাল গাছ বেখাপ্পাভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে শাল গাছ থাকার কথা নয়। লাগানো গাছ। হয়ত এক সময় ছিল, তার স্মৃতি রক্ষা করতে গাছ মরতে আর একটা গাছ লাগানো হয়েছে। তাতেই এঙলিঙ বিস্মিত হলেন।
খানিকটা এগিয়ে গেলেন। শাল গাছের নীচে লেপা-পোছায় তক্তকে। কতগুলি হাতী-ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। তৈরী দেবস্থানটি অনেক প্রাচীন। হাতী-ঘোড়া দু’চারটি ভাঙ্গা এবং বিবর্ণ। কোন কোন হাতী-ঘোড়া মাটির ভিতর তলিয়ে গেছে। তিনি আরো কাছে এগিয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন না কি ভাবে হাতী-ঘোড়া মাটির নীচে তলিয়ে গেল। পরেই মনে হল, এ তো স্বাভাবিক। প্রতিবার পূজোয় যত্ন করে মাটি গোবর লেপা হয়। একটু একটু করে মাটি উঁচু হয়—গ্রাস করে হাতী-ঘোড়া। এমনি করে পুরণো দু’চারটা হাতী-ঘোড়া মাটির নীচে তলিয়ে গেছে।
আরো কাছে এগিয়ে গেলেন। গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা ছোট এক খণ্ড পাথর। একখানা পাথর পেতে আসন করে তার উপর বসিয়ে রেখেছে। সিঁদুর মাখানো। এঙলিঙ বুঝতে পারলেন, এ কোন দেবতার প্রতীক।
পাথর খণ্ড ভালো করে দেখার জন্য আরো কাছে গেলেন। এবার চমকে উঠলেন। পাথর খণ্ডটি কালো হয়ে আছে। তা থাক, এ পাথর খণ্ড যে সাধারণ নয় তা বুঝতে পেরেছেন। উত্তেজনায় টান-টান হয়ে গেলেন। চিবুকের শেষ প্রান্তে ঝুলে থাকা গোঁফ থর-থর করে কাঁপতে লাগলো।
চিনতে পারলেন পাথর খণ্ডটিকে। এটি একটি পাথরে তৈরী কুঠার। মনে পড়ল, এমনি কুঠার তিনি দেখেছেন সংগ্রহশালায়। কুঠারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সস্কন্ধ কুঠার’। নামটি গালভরা হলে কি হবে, হাসবার উপায় নেই। মসৃণ করে কুঠারটি তৈরী। এঙলিঙের মনে পড়লো দূর প্রাচ্যের সমুদ্রের নানা দ্বীপের কথা। মালয়, সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি এলাকা থেকে পাওয়া কুঠারের সঙ্গে আশ্চর্য মিল।
তিনি নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রস্তর যুগের একটি হাতিয়ার দিব্যি দেবতার প্রতীকে পরিণত হয়ে পূজা পাচ্ছে! যারা পূজা করছে তারা কল্পনা করতে পারবে না ইতিহাসের কোন্ রহস্য তারা গাছতলায় ফেলে রেখেছে।
এঙলিঙের মনে পড়লো পটলমামার কথা। সুইডেনের প্রত্ন বিজ্ঞানীদের সভায় একটা প্রবন্ধ পাঠ করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। বিষয়টি ছিল ‘প্রি-দ্রাবিয়ান ইন বেঙ্গল’। তাতে তিনি বলেছিলেন, প্রস্তর যুগ শেষ হবার আগেই বাঙ্গলার অষ্ট্রোলয়েড জনগোষ্ঠীর মানুষরা নৌকো তৈরী বা নৌকো জাতীয় কোন যান আবিষ্কার করেছিল। এটা স্বীকার না করলে ব্যাখ্যা করা যায় না পূর্ব ভারত ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস। একই কৃষি নির্ভর সমাজ এবং পারস্পরিক লেনদেনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।
পটলমামার পঠিত প্ৰবন্ধ নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়েছিল। স্পষ্ট কোন প্রমাণ তিনি পেশ করতে পারেন নি। সবটাই ছিল ভাষাতত্ত্ব আর নৃতত্ত্বের যুক্তিতে অনুমান। এখন তেমনি এক জীবন্ত প্রমাণের মুখোমুখি এঙলিঙ।
নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। কারো দেবস্থানে হাত দিতে নেই। কোন মানুষের বিশ্বাসের অমর্যাদা করা ঠিক নয়। পরের জিনিষ না বলে নেওয়াকে চুরি করা বলে—এসব কথা তিনি জানেন। তবু নিজেকে সামলাতে পারলেন না। কুঠারটি টুক্ করে তুলে থলের মধ্যে ঢুকিয়ে থলেটি পিঠে তুলে দাঁড়ালেন।
সরে পড়তে পারলেন না। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো বাউরী বুড়িকে। ঘর থেকে বেড়িয়ে তাঁকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
এঙলিঙ বুঝতে পারলেন, ফ্যাসাদে পড়েছেন। এখনই ধরা পড়ে যাবেন। দেবতা চুরির অপরাধে বাউরীরা কি করবে তা তারাই জানে। দেবতার থানে বাউরীরা মুরগী, শুয়োর বলি দেয়। এবার হয়ত তাঁকেই বলি দেবে।
তিনি ঘাবড়ালেন না। মুহূর্তে নিজেকে তৈরী করে নিলেন। বললেন, “ইউ থি‥‥ইউ থি”—বলতে বলতে বুড়ীর সামনে এগিয়ে গেলেন। বুড়ীর চোখ দেবতার থানে যাতে না পড়ে সেই চেষ্টা করলেন। হুড়মুড় করে গিয়ে বুড়ির সামনে দাঁড়ালেন।
বুড়ি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন এঙলিঙ। মাথা জুড়ে টাক। টাকে রোদ পড়ে চক্-চক্ করছে। ভুরুতে সামান্য চুল। চোখে চশমা। চিবুকের শেষ প্রান্তে কয়েকগাছা লাল চুল। গায়ে কালো কোট। ঢোলা পাতলুন। পিঠে থলি। তাঁকে বিচিত্র এবং গ্রহান্তরের মানুষের মত দেখাচ্ছিল।
তিনি সামনে ঝুঁকে বললেন, “নমত্কার।” অমনি তাঁর পিঠ থেকে ঝোলা সামনে এসে পড়ল। ঝক্-ঝক্ করে আওয়াজ উঠলো। তিনি ঝোলাটাকে পিঠের উপর চালান করে দিলেন। বললেন, “ইউ থি‥‥”
তাঁর গলা শুনে আরো কয়েকজন পুরুষ মহিলা বাইরে বেরিয়ে এল। ছেলেরা এসে ভূত দেখার মত বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।
এঙলিঙ পকেট থেকে চট করে পেনটা তুলে নিলেন। দু আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে বললেন, “ইউ থি‥‥ইউ থি” বলে কলমটিকে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
কলম আকাশের দিকে উঠে গেল। আবার নেমে এল। হাত এগিয়ে শূন্য থেকে খপ করে কলম ধরে নিলেন। ধরে নিয়ে আবার ছুঁড়ে দিলেন। এভাবে বার পাঁচেক ছুঁড়ে হঠাৎ খুব জোরে ছুঁড়ে আর হাত এগিয়ে দিলেন না। হাত নেড়ে দেখিয়ে দিলেন, হাতে কিছু নেই। কলম আকাশে উঠে হাওয়া হয়ে গেছে।
লোক কয়টি বিস্মিত এবং স্তম্ভিত। তাদের চোখ বড় হয়ে উঠেছে।
এঙলিঙ সবার বিস্মিত বিহ্বল মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, “দিঙ্কিং ওয়াতাল। দল, দল খাবো। আ-তেষ্টা-দল-দল-আই মিন ওয়াতাল।” হাতের ঈশারায় জলপান করার ভঙ্গী করে দেখালেন।
তিনি জল চাইছেন তা সবার আগে বুঝতে পারলো নতুন বৌটি।
কয়েক মাস হয় বিয়ে করে স্বামীর ঘর করতে এসেছে। বিষ্ণুপুরের মেয়ে। তাদের গ্রাম শহরের প্রান্তে। তাই দু’একজন চীনা যাদুকর দেখার অভিজ্ঞতা আছে। তাই সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় নি।
তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর চলে গেল। এক গ্লাস জল আর থালায় দু’টি বাতাসা সাজিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। পর পুরুষের কাছে যাবে না বলে বুড়ীর হাতে ধরিয়ে দিল। বাউরী বুড়ি একটু ইতঃস্তত করে সামনে এগিয়ে এল। তাঁর সামনে ধরলো।
এঙলিঙ থালা থেকে বাতাসা দুটি তুলে টপ করে মুখে পুরে ফেললেন। গ্লাস নিয়ে জল খেলেন। গ্লাস ফেরত দিয়ে বললেন, “থ্যাঙ্কু।” কথাটা বলেই একটা পা একটু সামনে এগিয়ে দৌড় দেবার ভঙ্গীতে দাঁড়ালেন। মাথা পিছনে হেলিয়ে হাত উপরে তুলে হাঁক দিলেন, “আও—”
দু’ তিনবার কাকে যেন ডাকলেন আকাশ থেকে নামতে। দু’বার তুড়ি বাজালেন। হঠাৎ খপ করে কি যেন মুঠো করে ধরলেন শূন্য থেকে। হাতের মুঠো খুলে দেখালেন সবাইকে। তাঁর দু’ আঙ্গুলের মাঝখানে সেই কলম।
কলমটা পকেটে পুরে ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে একটু হাসলেন। মাথা নামিয়ে ‘থ্যাঙ্কু’ বলে বিহ্বল লোকগুলির চোখের উপর রাস্তায় নেমে এলেন। লোকগুলো তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের রোদে এমন বিচিত্র মানুষ এবং তাঁর যাদুর খেলা দেখার কথা তাদের স্বপ্নেও ছিল না।