8
একগাল ধোঁয়া উদ্গার করতে করতে পটলমামা ফিরে এসে খাটিয়ায় বসলেন। তাঁর কপালের চিন্তার রেখা অন্য দু’জনে লক্ষ্য করলেন না। পটলমামা বসেই বললেন, “এবার বলুন। শুনতে চাই দেশমাতৃকা থেকে আপনার কালীমাতায় আসার গল্প।”
সাধুজী একটু কাশলেন। কাশি থামিয়ে বললেন, “তেমন করে বলার মত কিছু নেই। আপনি দারোগা মানুষ, বোলচাল দিয়ে লাভ নেই। বিপ্লবী দলে ভিড়েছিলাম সেটা এমন কিছু নয়। দেশ স্বাধীন হবার পর করার আর কিছু রইল না।”
সাধুজী থামলেন। খড়মে খট্ খট্ আওয়াজ তুলে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। এক গ্লাস জল খেয়ে বিড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলেন। নিজের আসনে বসে একটা বিড়ি নিজের মুখে গুঁজলেন। অন্য বিড়িটি এগিয়ে ধরলেন এঙলিঙের দিকে।
এঙলিঙ হাত বাড়িয়ে বিড়ি নিলেন। ঠোঁটের মাঝখানে বিড়ি গুঁজে ঘাড় একটু কাত করে বললেন, “থ্যাঙ্কু ইউ।” মুখটি এগিয়ে ধরলেন সামনের দিকে। বিড়ি ধরিয়ে দিক তাই বোধ হয় চেয়েছিলেন।
বিড়ি ধরিয়ে দিলেন সাধুজী। নিজেরটাও ধরালেন। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “ভেবেছিলাম দেশের কাজ করবো। আমাদের ডাকা হল না। দেশ সংগ্রামীরা ক্ষমতায় এসে যে ভাবে লুটে নিতে থাকলেন তাতে আমাদের মত মানুষদের ডাক পড়ার কথাও নয়। দেখতে দেখতে স্বদেশীরা চড়-চড় করে বড়লোক হয়ে গেলেন।”
আবার থামলেন। বিড়িতে কয়েকটা টান দিয়ে বললেন, “ভাবলাম, গ্রামে ফিরে কিছু কাজ করবো। ফিরে এসে দেখি, চারিদিকের লুঠপাট দেখে তাদের চরিত্রও পাল্টে গেছে। করার কিছু নেই। তা মশায় বনের মোষ তাড়ানো যাদের অভ্যাস তারা চুপ-চাপ থাকতে পারে কি?”
পটলমামা পাইপ কামড়ে ধরে বললেন, “তাই এই ছায়া সুনিবিড় আশ্রয়টি গড়ে তুললেন।”
সাধুজী মাথা নাড়লেন। বললেন, “অত সহজে একটা মানুষ পাল্টায় না। গ্রামের ছেলেগুলোকে গড়ে তোলার কথা ভাবলাম। তাদের নিয়েই গড়ে তুলেছিলাম এই ছায়া সুনিবিড়….” কথাটা শেষ করলেন না। একটু থেমে সখেদে বললেন, “সবাই একে একে পালিয়ে গেল।”
পটলমামা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “দেশের কথা কারো মাথায় আর আসে না। দেশ তলিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশের দিকে। দেশ চোর-বাট পাড়ের দেশে পরিণত হবে তা কখনো ভাবি নি।”
সাধুজী বললেন, “আমরা প্রাণ দিতে এগিয়েছিলাম কতগুলি অসাধু মানুষকে বড়লোক করতে!”
পটলমামা আবার ঝট্ করে উঠে দাড়ালেন। দু’ পা এগোতেই দেখতে পেলেন মানুষের মাথা। ঝপ্ করে ঝোপ-ঝাপের আড়ালে চলে গেল।
সাধুজী অবাক হয়ে বললেন, “কি হল?”
পটলমামা ফিরে এসে আবার বসলেন খাটিয়ায়। বললেন, “এখান থেকে নদী দেখতে কিন্তু দারুণ লাগছে। আপনার পোঁতা গাছগুলি সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁক থেকে দেখা যায় নদীর জল। মনে হচ্ছে যেন রূপোর পাতের টুকরো গাছপালার মাঝখানে পাতা আছে।”
সাধুজী একটু হাসলেন।
সাধুজী বললেন, “আপনারা নতুন লোক, কোথায় উঠেছেন?”
পটলমামা স্পষ্ট জবাব দিলেন না। নিজের আসল নাম যে শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী কোথাও তা বলেন না। খ্যাতি অনেক বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠে। তাই বললেন, “জায়গাটি ভালোই লাগছে।”
সাধুজী গলায় শব্দ করলেন, “অ—।” বললেন, “সে গড়বেতা আর নেই। নিত্য নতুন খুনোখুনি,—আর ভালো লাগে না।”
পটলমামা স্থির চোখে সাধুজীকে দেখলেন। বললেন, “দেশ, দেশের মানুষকে না জেনে না বুঝে কোন বিপ্লবই সফল হয় না।”
সাধুজীর ভুরু টান-টান হয়ে গেল। বললেন, “ছেলেগুলো বিপথগামী।”
পটলমামা একটু হাসলেন। বললেন, “মত ও পথ নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে, থাকেও। কিন্তু সবার আগে জানা চাই এই বিচিত্র দেশের বিচিত্র মানুষগুলিকে। না জেনে না বুঝে এগোলে কি হয়?”
পটলমামা প্রশ্ন করে তাকিয়ে রইলেন।
এঙলিঙ বুড়ো আঙুল তুলে সাধুজীর মুখের সামনে নাড়িয়ে দিলেন। সাধুজী অস্ফুট গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কচু?”
আলোচনা বন্ধ হ’ল।
৫
দুটি গাঁয়ের লোক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। আদুল গা। গায়ের রং কালো। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত খারে কাঁচা কাপড়ে ঢাকা। মাথার চুলে চক্চকে তেল। গালে খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি। বুকের খাঁচা অনেকটাই অনাবৃত। চোয়াল ঠেলে ওঠা। চোখ দুটি কপালের খাঁজের মধ্যে ঢুকে আছে। গ্রামের দু’জন দরিদ্র চাষী। পা ভেজা দেখে বোঝা যায় শিলাবতী পার হয়ে এসেছে। গড়বেতার সর্বমঙ্গলার মন্দিরে যাবে।
তারা উপরে এসে মা কালীর সামনে গড় হয়ে প্রণাম করলো। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।
সাধুজী পটলমামার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের কাছে মিথ্যে কথা বলবো না। বিশেষ করে মিঃ এঙলিঙ যখন আছেন। এখানে কালীমূর্তি আছে বলে দু’চারজন মানুষ আসেন। আমি একা থাকলে এদিকে কোন লোক পা ফেলতো না। এখানকার লোকেরা দেশের কথা শুনতে চায় না। আমি অন্য কিছু জানি না যে বলতে পারি।”
পটলমামা বললেন, “আপনি সত্য কথাই বলছেন। মানুষ ভয়ানক আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এই বাঙালী ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ ধর্ম বলে মানতো তা ভাবাই যায় না।”
সাধুজী একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। দু’বার বিড়িতে টান দিয়ে বললেন, “লোক দুটি নদীর ওপারে থাকে। ওরা ভিখ্নগর থেকে এসেছে।”
ভিখ্নগর শুনেই এঙলিঙ চমকে উঠলেন। বললেন, “হোয়াত্?”
সাধুজী বললেন, “ভিখ্নগর।” কথাটা বলেই ভাবলেন হয়তো এঙলিঙ তাঁর কথা বুঝতে পারলেন না। বললেন, “নদীর ওপারে ভিখ্নগর বলে একটা গ্রাম আছে। পঞ্চ পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসে এসে ঐ গ্রামটিতেই প্রথম ভিক্ষা করেছিলেন। তাই গ্রামের নাম ভিখ্নগর।”
পটলমামা মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বললেন, “সঙ্গে কে ছিল? সাক্ষী রেখে অজ্ঞাত জীবনে ভিক্ষে তো করে নি পাণ্ডবরা। তবে সবাই জানলো কি ভাবে?”
সাধুজী বললেন, “তাতো জানি না। এ ভাবে ভাবি নি।”
পটলমামা একটু হাসলেন। বললেন, “ভাববার কথা নয়। গল্প গল্পই। এমনি কত গল্প বাঙলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে।”
সাধুজী বললেন, “এসব তো ঐতিহাসিক সত্য।”
পটলমামা বললেন, “না। এগুলো গল্প। বাঙালীর মনে রামায়ণ মহাভারতের কোন কোন নায়কের বিশেষ প্রভাব আছে। খোল্সা করে বললে বলতে হয় কিছু আদর্শবাদী ও ক্ষমতাবান্ মানুষকে বাঙালী ভালোবাসে। তাদের নাম, স্মৃতি নানা ভাবে ব্যবহার করে খুশি হতে চায়। এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।”
সাধুজী বললেন, “মহাভারতে আছে ভীমের বঙ্গ বিজয়….” কথাটা শেষ করলেন না। তাঁকে একটু বিভ্রান্ত মনে হল।
পটলমামা বললেন, “ভীম এবং রঘু ‘বঙ্গদেশ’ বিজয় করেছিল তা রামায়ণ মহাভারতে বলা আছে। অনেকে মনে করেন গঙ্গাই ছিল ভারতীয় বণিকদের একমাত্র যাতায়াতের পথ। তাই উত্তর ভারতীয় বণিকদের সুবিধার জন্য রঘুকে হয়তো বঙ্গ জয় করতে হয়েছিল। তাই বলে শীলাবতী নদীর তীরে পাণ্ডবরা প্রথম ভিক্ষে করবে—তার স্মৃতি রক্ষা করতে ভিখ্ নগর বলে গ্রামের নাম হবে তা হতে পারে না।” পটলমামা এক নিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলে থামলেন।
সাধুজী আরো বিভ্রান্ত হয়ে গাল চুলকোতে থাকলেন। কোন কথা বলতে পারলেন না।
পটলমামা আবার নিজেই হয়তো কথা শুরু করতেন। কিন্তু তার আগেই এঙলিঙ মুখ খুললেন। বললেন, “ইউ থি, নগল। আই মিন ভিখ্ নগল, এ থিতি।”
পটলমামা বললেন, “নগর শব্দ যখন নামের সঙ্গে তখন ধরে নিতেই হবে এক সময় নগর ছিল। তবে সে নগর আজকের নগর নয়। আর বাংলাদেশে বড় নগর কোন কালেই ছিল না। পাকা ইটের বাড়ীর সংখ্যা যে কোন সময়েই ব্যাপক হয়েছিল তা হয় নি। হয়তো ছোট কোন বৌদ্ধ নগরের স্মৃতি নামের পিছনে আছে।”
সাধুজী চমকে উঠে বললেন, “বৌদ্ধ নগর!”
পটলমামা ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। বাঙালী এক সময় ব্যাপক হারে বৌদ্ধ হয়েছিল। তাম্রলিপ্ত ছিল এক সময় বিখ্যাত বন্দর। যতগুলি স্থলপথ ছিল তার একটা ছিল গড়বেতার কাছাকাছি দিয়ে। তাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ করা অস্বাভাবিক নয়।”
সাধুজী বললেন, “তাই বলে ভিখ্ নগর?”
পটলমামা বললেন, “হ্যাঁ।” পকেট হাতড়ে দিয়াশলাই বের করলেন। নিভে যাওয়া পাইপ ধরিয়ে বললেন,“বৌদ্ধরা দু’রকম। একদল ছিল ভিখারী বৌদ্ধ, অন্য দল গার্হস্থ্য বৌদ্ধ। তারা ভিক্ষে করতো না। ভিক্ষু বৌদ্ধরা সংঘরাম তৈরী করে এক জায়গায় বাস করতো। তারা সঞ্চয় করতে পারতো না। প্রতিদিন নিজের যতটুকু দরকার ততটুকু ভিক্ষে করতো। ফিরে এসে ধ্যান, অধ্যায়ন নিয়ে থাকতো। তারা গ্রাম-গ্রামান্তরে গিয়ে মানুষকে সদাচার শিক্ষা দিত। তাই জনসাধারণ আদর করে তাদের বসতে দিত।”
পটলমামা থামলেন। পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে বললেন, “ভিক্ষে সহজলভ্য হলে অনেক অলস লোক ভিখারী হয়ে যায়। আবার উৎসাহী একদল বেশি সংখ্যক ভিক্ষু এক জায়গায় থাকলে তাদের কেন্দ্র করে একটা জমজমাট জনপদ গড়ে উঠতে পারে। বেশি লোক ভিক্ষে করে বলে ভিখ্ গাঁও, ভিখ্ গ্রাম, ভিখ্ নগর হতে পারে। আবার নগরের সব থেকে প্রভাবশালী মানুষটি বৌদ্ধ শীল নিয়ে সব দান করে দিয়ে ভিক্ষুক হল। এতো হতে পারে?”
পটলমামা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সাধুজীর দিকে।
সাধুজী ঘাড় কাত করে জানিয়ে দিলেন তা হতে পারে।
পটলমামা বললেন, “বৌদ্ধ যুগে অনেক বিত্তশালী লোক ভিক্ষু হয়ে যে সব সম্পত্তি সংঘকে দান করে দিয়েছে তার অনেক কাহিনী আছে। তেমন কোন ঘটনার স্মৃতি অক্ষয় করার জন্য ভিখ্ নগর নাম হতে পারে।”
সাধুজী বিড়ি টানতে ভুলে গেলেন। তাঁর মুখ থেকে বিড়ি খসে পড়ে গেল। শুধু বললেন, “আশ্চর্য।”
৬
প্রসঙ্গ হয়তো আরো এগোত। কিন্তু এগোল না। হঠাৎ পটলমামা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “পরে কথা হবে।” ঝড়ের বেগে সিঁড়ি বেয়ে নীচের দিকে নামতে থাকলেন। এঙলিঙ কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর তিনিও পটলমামার পিছু পিছু নেমে এলেন। সাধুজী বিহ্বল হয়ে বসে রইলেন চেয়ারে। তিনি কিছু বুঝতেই পারছেন না যেন।
পটলমামা সোজা চলে এলেন শ্মশান পার হয়ে শীলাবতী নদীর তীরে। থমকে দাঁড়ালেন। কোন মানুষ দেখতে পেলেন না। সোজা জলের মধ্যে নামলেন। জুতো পর্যন্ত খুললেন না। ওপারের বালিতে উঠে দাড়ালেন। দাঁড়িয়ে রইলেন।
এঙলিঙ কোনরকমে জল পাড়ি দিয়ে বালি ঠেলে এসে পটলমামার সামনে দাঁড়ালেন। গড়বেতার দিকে চোখ যেতেই বিহ্বল হয়ে পড়লেন। সারি দিয়ে চলেছে ঢিপি। নদী সোজা তার খাদ নামিয়ে দিয়েছে। লাল মাটি দেখা যাচ্ছে। রুক্ষ, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন। নদীর তীর এমন হৃদয়হীন লাল রঙের রুক্ষ স্বভাবের হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
হঠাৎ পটলমামা এঙলিঙকে ধাক্কা মারলেন। তিনি পড়ে গেল বালির উপর। কি যেন সাঁ করে চলে গেল তাঁর কানের পাশ দিয়ে। তীরের ফলার মত এক পোঁচে বাতাসের বুক চিঁড়ে দিয়ে চলে গেল।
এঙলিঙ কিছু বুঝতে পারার আগেই পটলমামা তাঁকে টেনে তুললেন। টানতে টানতে নিয়ে গেলেন গাছের আড়ালে। পাশেই কয়েকটা বাঁশ পোঁতা। একটা ডোঙ্গা। চাষী এই ডোঙ্গায় করে শীলাবতীর জল তুলে ক্ষেতে দেয়। পাশেই ধান ক্ষেত। তার পাশেই পথ। পটলমামা তাঁকে টেনে নিয়ে ধান ক্ষেতের পথ ধরলেন।
এঙলিঙ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “হোয়াত! হোয়াত!”
পটলমামা বললেন, “নাথিং।”
এঙলিঙের চোখ দুটি পিট্ পিট্ করা শুরু করলো। কিছু হয় নি তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। কি ঘটলো তা বুঝতেও পারলেন না।
পটলমামা ঝুঁকে মাটির উপর পড়ে থাকা গুলিটাকে তুলে নিলেন। আপন মনে বললেন, “এরা কারা? আমাদের পিছনে কেন?”
এঙলিঙ পটলমামার হাতে গুলি দেখে চমকে উঠলেন। বললেন, “হোয়াত?”
পটলমামা দু’ আঙুলের মধ্যে গুলিটিকে ধরে এগুলিঙকে দেখালেন।
এঙলিঙ চোখ বিস্ফারিত করে দেখলেন। তাঁর কপালের রেখাগুলি কিলবিলিয়ে উঠে স্থির হল। মুখটা অস্বাভাবিক লাল দেখালো। চিবুকের নীচের দু’গাছা চুল থর থর করে কাঁপতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “এতেম্ত্ তু মার্দাল।”
পটলমামা বললেন, “না, মেরে ফেলতে চায় নি। মানুষ মারার অনেক ঝঞ্ঝাট। ওরা বোধহয় ভয় দেখাতে চায়। কিন্তু কেন তা বুঝতে পারছি না।”
৭
ধানের ক্ষেত পার হতেই গ্রাম। শীলাবতীর এদিকে পাথর নেই। উঁচু-নীচু ঢিপি নেই। নেই বুক চেরা খাড়ি। লাল কাঁকর মাটি নয়। নরম মাটি। গাছ-গাছালির সারি। মাঝে মাঝে পুকুর। খেজুর আর তাল গাছ। কাজুবাদামের গাছও আছে। পুকুরে গাছের গুড়ি ফেলে ঘাট তৈরী। তার পাশেই চালা ঘর। আতা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। আতা গাছে টিয়া পাখী।
পটলমামা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একখানা ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। মাটির ছোট ঘর। মাথায় বিচালীর চাল। দরজার দু’পাশে সাদা রং দিয়ে যত্ন করে ছবি আঁকা। নদীর লহরের মত লম্বা লতা চলেছে। লতার ভাঁজে ভাঁজে সাদা ফুল। দরজার মাঝখানে মন্দিরের ছবি। দু’পাশে পাখী। মেয়েদের হাতের কাজ। সহজ সরল কিন্তু স্নিগ্ধ। ঘরের দিকে তাকালে প্রাণ জুড়িয়ে যাবার কথা।
উঠোনে পা দিতেই বৃদ্ধ চাষী উঠে এল। একপাশে বসে কাঠ চিরছিল। হাঁটুর উপর ময়লা কাপড়। মুখে বসন্তের দাগ। তার উপর কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। চোখে ক্লান্তি। হাত জোড় করে এসে দাঁড়ালো সামনে। বললো, “বাবু….”
লোকটি প্যাণ্ট-সার্ট পরা লোক দেখে ঘাবড়ে গেছে যে তা পটলমামা বুঝতে পারলেন। বললেন, “আমরা সরকারের লোক নই। তোমাদের গ্রাম দেখতে এসেছি।”
লোকটি অবাক হয়ে বললো, “গাঁ দেখার কি রয়েছে বাবু। হেথায় মানুষ থাকে নি।”
পটলমামা একটু হাসলেন। বললেন, “তোমরা কি মানুষ নও?”
লোকটি বললো, “আমরা বাউরী বাবু।” এমন ভাবে কথাটা বললো যে মনে হল বাউরীরা মানুষ নয়।
এঙলিঙ তার কথা শুনে ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “বাক্লী অল্সো ম্যান। বিগ ম্যান। ইউ নো হিত্থ্রি।”
হিস্ট্রিকে তিনি হিত্থ্রি, বলে উচ্চারণ করলেন। অবশ্য হিস্ট্রী বললেও লোকটি বুঝতে পারতো না। সে দেশ ও তার নিজের জাতির ইতিহাস জানে না, খোঁজও রাখে না।
পটলমামা বললেন, “বাউরীরা খুব বড় জাত। তোমরা ভুলে গেছ তোমাদের পরিচয়।”
লোকটি বিনয়ে অবনত হল। বললো, “বাবুরা বসবেন নি।”
এঙলিঙ বললেন, “থিওর বথবো। থিন্টি মিন্টি…”
লোকটি এঙলিঙের বিচিত্র ভাষার অর্থ বুঝতে পারলো না। কিন্তু লোক দুটি বসতে রাজী তা বুঝতে পারলো। একটা খাটিয়া পেতে দিল।
পটলমামা খাটিয়ায় জাঁকিয়ে বসলেন। তখন তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে খানিক আগে তাঁর প্রাণ সংশয় হয়েছিল।
পটলমামা উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বাড়ীর শেষ প্রান্তে দাঁড়ালেন। পাইপ টানতে টানতে কি যেন ভাবছেন। এঙলিঙ সেই সুযোগে লোকটির সঙ্গে আলাপ করা শুরু করলেন। বললেন, “থুমি একজন বাক্লী আছো, খুব ভালো আছো।”
লোকটি তার ভুল সংশোধন করে দিল। বললো, “বাবু, আমরা বাক্লী লয়, বাউরী।”
“দ্যাত্থ্, লাইত্” এঙলিঙ বললেন, “বাক্লী খুব ভালো জাত আছে। মেডিনীপুল, ঘলবেতায় এতো এতো ঘটনা ঘটাইয়াছে। আই নো, বাক্লী খুব জোয়ান আছে। লত্থে পালে। ইউ নো তুয়াল?”
লোকটি আবার তাঁর ভুল সংশোধন করার জন্য বললো, “বাবু, আমরা বাউরী। ঘলবেতা লয় গড়বেতা।”
এঙলিঙ বললেন, “নো-নো। ছোট জাত কেনো হোবে? বাক্লী খুব বলো জাতি আছে। ইউ নো তুয়াল?”
‘তুয়াল’ কি তা বুঝতে পারলো না লোকটি। হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল।
এঙলিঙ তখন দেখতে পেল লোকটির ছেলেকে। বারান্দায় এসে হাঁ করে বাপের মতই তাকিয়ে আছে। নিজের চোখ দুটিকে বিশ্বাস করবে কিনা বুঝতে পারছে না। এমন বিচিত্র মানুষ এর আগে সে দেখে নি। এঙলিঙের মাথায় চুল নেই। মাথার শেষ প্রান্তে কানের পাশে কয়েকগাছা লাল চুল আছে। রোদ পরে চুল ক’গাছা চক্-চক্ করছে। ভুরুতে ও গোঁফে চুল নেই। গায়ের রং ফর্সা। চোখ দুটি ছোট। ছোট চোখ দুটির উপর নিকেলের চশমা। নাকটি থ্যাবরা। নাকের শেষ প্রান্তে কয়েকগাছা লাল চুল লম্বা হয়ে ঝুলে আছে।
তিনি লোকটিকে ছেড়ে ছেলেটিকে নিয়ে পড়লেন। বললেন, “আই খকা, খেলা হবে। আয় – যাদু খেলা হবে, আ…”
ছেলেটি ভয় পেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
তিনি চটে গেলেন। বললেন, “ভয়! হাউ ফানি। বাক্লীলা খাওয়ার্দ! মিত্থিরিয়াত!” একখানা হাত উপরে তুলে তিনি তাঁর হতাশা আর আফশোষ প্রকাশ করলেন।
পটলমামা শুনতে পেলেন। এসে আবার বসলেন।
লোকটি বিনয়ের সঙ্গে বললো, “উনি আমাদের বাক্লী বলছেন। আমরা বাক্লী লয় বাউরী।”
পটলমামা হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “উনি তিব্বতের মানুষ। তাই বাংলা উচ্চারণ ঠিকমত করতে পারেন না।”
লোকটি অবাক হয়ে বললো, “তিব্বত?”
পটলমামা বললেন, “তিব্বতের নাম শোন নি?”
লোকটি বললো, “সেটি কোথায় আছেন?”
পটলমামা হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন। এঙলিঙের মুখের উপর চোখ রেখে বললেন, “দুর্ভাগ্য মিঃ এঙলিঙ ! বাঙ্গালী তিব্বতের নাম ভুলে গেছে।” পটলমামার গলা বিষণ্নতায় ডুবে গেল।
এঙলিঙের চোখ দুটি পিট্ পিট্ করতে লাগলো। ঠোঁট দুটি কাঁপছে। ঠোঁটের সঙ্গে কাঁপছে চিবুকের শেষ প্রান্তে ঝুলে থাকা লাল চুল ক’গাছা।
পটলমামা অসহায় হয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন, “বাঙ্গালী তিব্বতকে জানে না। অথচ এক সময় তিব্বত থেকে বহু ছাত্র আসতো বাংলা দেশে বিদ্যা শিক্ষা নিতে। বাঙ্গালী পণ্ডিতরা তিব্বতে চলে যেতেন শিক্ষক হয়ে। শিল্পকলার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কতরকম বিনিময় হত। তিব্বতের গ্রন্থাগার থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে কত লুপ্ত পুঁথি। তিব্বতী দার্শনিক তারানাথ নাম লিখে না রাখলে হয়তো আজকেও আমরা জানতে পারতাম না শিল্পের গৌড়ীয় আঙ্গিকের কথা। ধীমান বীতপালের মত শিল্পীরা অজ্ঞাত থেকে যেত।”
পটলমামার গলা ভারী হয়ে এল। মুখে নেমে এল বিষণ্ন কালিমা। খাটিয়ার উপর বসলেন। নীরবে পাইপ টানতে থাকলেন।
পটলমামা খানিক সময় আপন মনে পাইপ টেনে নিজের মনেই বলতে লাগলেন,
“আগে চলে বার ঘণ্টা পতাকা নিশান
ছাব্বিশ হাজার ঘোড়া চলে কানে কান॥
সাজিল প্রধান ঢালি বুড়া কুম্ভকার….”
পটলমামা তাঁর আওড়ানো কবিতা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই এঙলিঙ হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে হাতে তালি দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সুর করে বললেন,
“আঘ দোম বাঘ দোম ঘোলা দোম থাজে।
ধাল মঘর ঘাঘন ভাজে ….”
পটলমামা তাঁকে থামালেন। থামিয়ে তাঁর বলা ছড়াটি আবার নিজে বললেন। ছড়াটি এঙলিঙের ভয়ানক প্রিয়। তবে উচ্চারণের দোষে শ্রোতারা বুঝতে পারে না। তাই পটলমামা শুরু করতেই হাতে তালি দিয়ে তাল রাখা শুরু করলেন।
“আগে ডোম বাগে ডোম ঘোড়া ডোম সাজে
দাল মেঘর ঘাঘর বাজে….”
ছড়া বলতে বলতে থামলেন। তাঁর মুখ ভয়ানক গম্ভীর মনে হল। গাঢ় গলায় বললেন, “বাংলার ধীবর, বাউরী, ডোম, সাঁওতাল এরাই হল ভূমিজ সন্তান। এদের অতীতের ইতিহাস উজ্জ্বল। অনেক কীর্তি আর সংগ্রামের ইতিহাস আছে যা বলবার মত, শোনবার মত। নানা রাষ্ট্রবিপ্লব উত্থান-পতনের পথে সে সব ইতিহাস লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন এরা পরাজিত, অবহেলিত। অথচ এরাই ছিল বাংলার ইতিহাসের নায়ক, সভ্যতার স্রষ্টা।”
বৃদ্ধ চাষীটি এত সময় নীরবে পটলমামার কথা শুনছিল। এবার হাত জোর করে বললো, “আমরা ছোটনোক। ন্যাকাপড়া শিখা হয় নি।”
পটলমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, “কে বলে তোমরা ছোট মানুষ? তোমরাই মানুষ। মানুষের জন্য মানুষের যে কল্পিত দেশ তোমরাই তার নায়ক। আদর্শ মানুষের আচরণ এখনও তোমরাই বাঁচিয়ে রেখেছো। মানুষকে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারার জন্য গৌতম বুদ্ধ পাঁচ পাঁচটি শীল দিয়েছিলেন। সে পাঁচটি শীলের আচরণ তোমাদের মধ্যেই বেঁচে আছে।…”
“….আর আমরা?” পটলমামা একটু থামলেন। পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আমরা মানুষের চেহারায় অমানুষ। দেশ এক শ্রেণী চতুর লোকের অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্র। ঠগ, জোচ্চোর, ভ্রষ্টচারীরা এখন সমাজের নায়ক। এমন সুন্দর দেশ এই বাংলা মনুষ্যত্বের শ্মশানে পরিণত।”
পটলমামার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তিনি কেঁদে ফেলবার ভয়ে থামলেন।