» » একটি প্রলাপের জন্ম

বর্ণাকার

বিনোদ ঘোষাল

ডানাওলা মানুষ

একটি প্রলাপের জন্ম

সবাই জানে আমার দিদি পাগলি। আমিও জানি। কিন্তু আমি জানি আমার দিদি পুরো পাগল নয়। সারাদিন ধরে দিদি খুব সুন্দর। কিন্তু বিকেল হতেই অন্যরকম হয়ে যায়। বারান্দায় চুপটি করে বসে আকাশ দেখে। দেখতেই থাকে। কোথায় যেন হারিয়ে যায়! হাজার ডাকলেও সাড়া দেয় না। আকাশে চাঁদ উঠলে দিদি অস্থির হয়ে পড়ে। পূর্ণিমার রাতে দিদিকে কিছুতেই শোয়ানো যায় না। সারারাত বসে থাকে। আকাশ দেখে। সাদা ধবধবে মেঘ দেখে। আর মাঝেমধ্যে বলে ওঠে—’ওই ওই বৃষ্টি এল। ওই যে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে…শিব ঠাকুরের বিয়ে—হি-হি-হি।’

দিদির এরকম হাসিতে আমি চমকে উঠি। তখন দিদিকে বড় অচেনা লাগে। আমি গুটিয়ে যাই। কীসের বৃষ্টি, কে শিব ঠাকুর আমি বুঝতে পারি না। আমি প্রত্যেকবার একই ভয়েতে নতুনভাবে কেঁপে উঠি। একা লাগে। দিদি বলতে থাকে—’শিব ঠাকুর ওই দেখ সোনা শিব ঠাকুর…’

সোনা আমার নাম। আমার বাবা নেই। গত বছর মারা গেছে। খুব বড় অফিসে চাকরি করত। সুইসাইড করেছিল রেললাইনে। মর্গ থেকে বাবাকে যখন বাড়িতে আনা হয়েছিল মা কাঁদেনি। আমি কেঁদেছিলাম, দিদি কেঁদেছিল। বাবার মুখটা একটা সবুজ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। আমি বাবার মুখ দেখতে চেয়েছিলাম। কেউ দেয়নি। বলেছিল, ‘দেখিস না।’ আমি জানি কেন দেখতে দেয়নি। বাবার মুখটা…

আমি জানি না বাবা কেন সুইসাইড করেছিল। আমি জানি না আমার দিদি কেন এমন হয়ে গেলে। আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। আমার দিদি যখন ভালো ছিল তখন কাকুর সঙ্গে বেড়াতে যেত। আমি একদিন চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছিল। রঞ্জনকাকুর সঙ্গে থাকলে দিদি খুব হাসত। আমি একদিন রঞ্জনকাকুকে আমার মাকে আদর করতে দেখেছিলাম। আমার ভাল্লাগেনি। আমি দেখতে পেয়েছিলাম বলে মা আমায় খুব বকেছিল। তারপর বাবা আর দিদিকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল। আমি বাবাকে বলিনি। কিন্তু দিদিকে বলে ফেলেছিলাম। আমার মনে কেন জানি খুব কষ্ট হয়েছিল। তার পরেই আমার বাড়িতে সবাই সবার সঙ্গে খুব ঝগড়া করত। দিদি কেমন হয়ে গেল। এখন আমার মা চাকরি করে। আমি জানি মা-র চাকরিটা রঞ্জনকাকু করে দিয়েছে। আমার মা রঞ্জনকাকুর সঙ্গে বেড়াতে যায়। আমি জানি রঞ্জনকাকু মাঝেমধ্যে মাকে টাকা দেয়। আমি বড় হয়ে চাকরি করলে ওই টাকা নিতে মাকে বারণ করব।

রঞ্জনকাকু খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারত। আমিও ছবি আঁকতে পারি। কিন্তু আমি রঞ্জনকাকুকে একদম ভালোবাসি না। কিছুতেই বাসি না। আমি দিদিকে ভালোবাসি। আমার দিদি আকাশ দেখে, এক দুই তিন তারা গোনে। তারপর হঠাৎ বলে ‘ধুৎ—হারিয়ে যাচ্ছে। সোনা, এই সোনামুনি ওই তারাটা আমার এনে দিবি?’

আমি বলি, ‘কোনটা?’

দিদি আঙুল দিয়ে দেখায়, ‘ওই যে ওইটা।’ আমি হঠাৎ বড় হয়ে যাই। গম্ভীর হয়ে বলি, ‘এখন না, কাল সকালে দেব। তুই ঘুমোতে যাবি চল।’

‘ধুৎ পাগল, সকালে হারিয়ে যাবে। সকালে সব হারিয়ে যাবে।’ আমার বাবাকে সকালে পাওয়া গেছিল, রেললাইনের ধারে। আমার মা বাবাকে ভালোবাসত না। কাওয়ার্ড বলত। আমি কাওয়ার্ড মানে জানি। বাবা মাকে হোর বলত। আমি মানে বলব না। কিছুতেই বলব না। আমার দিদি আকাশ দেখে। আকাশ থেকে বৃষ্টি দেখে। আমাকে অ্যাই সোনামুনি বলে ডাকে। সেই ডাকে আমার ঘুম এসে যায়। ঘুম…ঘুমের মধ্যে আমি বড় হয়ে যাই।

এই শহরকে আমি পূর্ণিমার রাত্রে ভালোবাসি। রাত্রিবেলা যখন লম্বা লম্বা বাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা গলি বেয়ে আমি বাড়ির দিকে ফিরতে থাকি তখন ঝুপ করে শহরের সব বাতি নিভে যায়। শুধু চাঁদের আলো রাস্তায়, বাড়িগুলোর গায়ে মেখে থাকে, তখন এই শহর আমার কাছে অচেনা হয়ে ওঠে। মানে আমি সেই ওয়ান্ডার ল্যান্ডের অ্যালিস, আমি ভালোবেসে ফেলি এই অচেনা শহরকে। রাস্তায় প্রতিটি পাথর, দেওয়ালের প্রতিটি ইট আমার সঙ্গে তখন কথা বলে। আমি তাদের আমার প্রেমের কথা বলি। তারা আমায় ইতিহাসের কথা শোনায়। মামুদ, শাহজাহান, চার্ণকের গল্প বলে। আমি বাবার কথা বলি, মা-র কথা বলি। তারা শোনে। চুপ করে শোনে। তাদের নি:শ্বাসে আমি দু:খের শব্দ শুনি। আমার জন্য দু:খের শব্দ শুনি, আমার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না তখন। ইচ্ছে হয় ওই দেওয়ালগুলোর ভেতর ঢুকে পড়ি। আমি জানি ওই দেয়ালগুলোর ভেতরে একটা অন্য জগৎ আছে। আমি দু-হাতে শ্যাওলা ধরা দেয়াল জড়িয়ে ধরি। বহু পুরোনো ইটের গন্ধ নিই।…গন্ধ…হঠাৎ লাইট চলে আসে। সব নিভে যায়। আমি বাড়ি ফিরে আসি।

আমার মা রঞ্জন ব্যানার্জির সঙ্গে চলে গেছে। আমার দিদির চুল সাদা। বদ্ধ পাগল। যখন-তখন শাড়ি খুলে ফেলে। আমি আবার পরিয়ে দিই। আমার দিদি সারাদিন একটা ঘরের ভেতর থাকে। জানলার গরাদ ধরে আকাশ দেখে। দিদি আর গাইতে পারে না। আমি ছবি আঁকতে ভুলে গেছি। আমি দিদির ঘরের বাইরে তালা দিয়ে বের হই। আমার চাকরি নেই। কয়েকটা টিউশন করি। আমি দিদির সঙ্গে থাকি, এই শহরের সঙ্গে থাকি। এই ইট, শহর, চাঁদের সঙ্গে কথা বলি। আমার এদের কথা লিখতে ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে করে। আমি লিখব।

আমি একটা গল্প লিখব। লিখতেই হবে। সহস্র কথা আমার নাড়িভুঁড়ি বের করে আনছে। ওদের না লিখতে পারলে আমি শেষ হয়ে যাব। আমি খুঁজতে থাকি আমার গল্পের শুরু শেষ মাঝখান…

‘শ্যামলকাকু আছেন?’ বছর পয়ঁত্রিশ-ছত্রিশের মহিলাকে জিগ্যেস করলাম আমি।

‘না উনি তো নেই?’ ভদ্রমহিলার চোখে-মুখে গভীর শোকের ছায়া।

আমি বেশ সদ্ধিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘উনি মানে কখন আসবেন…’

‘আপনি জানেন না ওর কী হয়েছে?’

বুকের ভেতর সপাং করে উঠল। এত ভালো লোকটা, এত সুন্দর কবিতা লেখে, কী হল? আমি দুরুদুরু ভাবে বললাম—’না তো, কী হয়েছে?’

ভদ্রমহিলার মুখে একটা অসহায়তায় ছায়া আরও গভীর, তীব্র হয়ে উঠল। বললেন, ‘উনি তো এই মাসে রিটায়ার করে গেছেন। এখন বাড়ি ফেরা, বেরোনো কোনও ঠিক নেই।’

শ্যামলকাকু বিয়ে করেনি। একটা এক্সপোর্ট কোম্পানির সুপারভাইজার ছিলেন। ওর বেকার ভাই শ্যামলকাকুর মাইনের ভরসায় বিয়ে করে নিয়েছিল। ভদ্রমহিলা সেই ভাইয়ের বউ। শ্যামলকাকুর রিটায়ার করা অথবা মৃত্যু মহিলার কাছে এক হয়ে গেছে।

কিংবা;

মা চিৎকার করে উঠল—’ইউ আর এ কাওয়ার্ড। গুড ফর নাথিং।’

বাবাও হিসহিস করে উঠল—’শাট আপ ইউ হোর। গো টু হেল।’ আমি বিছানায় দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছি।

অথবা,

মা টাকাগুলো গুনে নিয়ে রঞ্জনকাকুকে বলল, ‘এ মাসে আর একটু বেশি দিলে ভালো হত।’

রঞ্জন বলল, ‘একটু চেপে চালাও। দুটো ফ্যামিলি আমায় এই বাজারে মেনটেইন করতে হচ্ছে।’

মা বলল, ‘মেয়েটার ওষুধের পেছনেই তো একগাদা চলে যায়।’

‘কী দরকার অত…ফ্রুটলেস।’ বলে রঞ্জন মাকে পোষা একটা বেড়ালের মতো জড়িয়ে ধরল।

বা,

দিদি অদ্ভুত মিষ্টি সুরে বলল, ‘অ্যাই সোনামুনি, ওই তারাটা আমায় এনে দিবি?’

আমি তিনশো বছরের শ্যাওলা ধরা ইটের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, দিদির শাড়ি খুলে মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে। আমি শাড়িটা তুলে দিদির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘কোনটা রে দিদি?’

‘ওই যে, ওই তারাটা থেকে বৃষ্টি পড়ছে। দে না এনে। শিব ঠাকুরের বিয়ে শিব ঠাকুরের বিয়ে—হি-হি।’

এখন আরও অযুত-নিযুত সংলাপ, চরিত্র আমাকে পাগলা মোষের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি প্রাণপণে ছুটতে-ছুটতে খুঁজে চলেছি একটা গল্প, আমার মুখ দিয়ে গ্যাঁজ উঠছে ঘোড়ার মতো, পা অবশ হয়ে আসছে। আমার আয়ু কাঁপছে শেষ হয়ে আসা মোমবাতির মতো। এই শহরে কোনও গল্প নেই?…নেই?

আমি পারিনি। সামনের এ-শহরে কোনও গল্প নেই। এই নি:ঝুম শহরে মানুষের কোনও গল্প নেই। কতগুলো অগোছালো চরিত্র, সংলাপ শুধু। ওই আকাশ, চাঁদ, শ্যাওলা ধরা ইট দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার সামনে টেবিলে রাখা বিষ। এক শিশি বিষ। আমি আর পারছি না। আজীবন যন্ত্রণা নিতে। আজ একেবারে শেষ করে দেব। বিষের পাশে রাখা প্যাড আর কলম। আমার বাবা লেখেনি কিন্তু আমি সুইসাইড নোট লিখব।

কী লিখব? সিলভিয়া প্লাথ—

‘Dying is art

I do it exceptionally well’

অন্তত মৃত্যুটা আমি মহান করে যেতে চাই। একটা কবিতার মধ্যে দিয়ে শেষ। আমি জানি না দিদির কী হবে। কেউ জানে না কার কী হবে। আমি আর পারছি না। I hate all the bitrayers। সবাই ঠকিয়েছে আমায়, আমি এক নিশ্বাসে লিখে ফেলি কবিতার লাইন ক’টা। শিশিটা হাতে নিতেই একবার দিদির কথা মনে পড়ে; শেষ একবার দিদিকে দেখতে ইচ্ছে হয়। আমি শিশিটা টেবিলে রেখে দিদির ঘরে যাই। অন্ধকার ঘর। লাইট জ্বালাই। দিদি ঘুমোচ্ছে। আমি কতদিন দিদিকে এমনি করে ঘুমোতে দেখিনি। এত শান্ত, এত সুন্দর। দিদির মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিই। তারপর দিদির পাশে শুয়ে ওর শুকনো বুকে মুখ রাখি। বহু পুরোনো কেমন দুধ দুধ গন্ধ আসে নাকে। একটা রেলগাড়ির শব্দ শুনতে পাই দিদির বুকের ভেতর। আমি তাকিয়ে দেখি একটা লাল রঙের ট্রেন বৃষ্টির মতো ঝমঝম শব্দ করতে করতে যাচ্ছে। আমি হুস করে ঢুকে পড়ি দিদির বুকের ভেতরে। ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে থাকি। পাহাড়-মাঠ-জঙ্গল পেরিয়ে। হঠাৎ রেলগাড়িটা ঘোড়া হয়ে যায়। আমি ওর ওপর চেপে বসি। ঘোড়াটা আকাশে লাফ দেয়। উড়তে থাকে। এটা কি পক্ষীরাজ! বিশাল, বি-শা-ল আকাশ। দিদির বুকে রয়েছি ভুলেই যাই। আমি উড়তে থাকি কুচকুচে অন্ধকারের মধ্যে হীরের মতো ছড়িয়ে থাকা তারাদের পাশ দিয়ে। ঝনঝন ছুটতে ছুটতে ঘোড়াটা হঠাৎ আমার দিকে তাকায়। রঞ্জনকাকুর মতো মুখ!

‘ইউ হোর’, বলে ঘোড়াটা আমায় লেজের ঝাপটা মেরে পেছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে সোজা উঠে দাঁড়ায়। আমি কেঁপে উঠে পড়ে যাই। পড়ে যেতে থাকি।…মা-আ-আ…অন্ধকার আরও অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে আমি আছড়ে পড়ি দিদির বুকের বাইরে। আমি আবার কেঁপে উঠি। দিদি জেগে যায়। আমাকে দেখে একটুও চমকে ওঠে না। আমার মাথায় আলতো হাত রেখে কী সুন্দর করে বলে—’কী হয়েছে সোনা, জল তেষ্টা পেয়েছে?’ ঝুপ করে শহরের বাতি নিভে যায়। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর লাফিয়ে ঢুকে পড়ে ডোরাকাটা চাঁদের আলো। হাওয়ায় হিমের গন্ধ আসে। আমি দিদির বুকে মুখ রেখে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকাই। ছাদটা উধাও হয়ে যায়। চৌকো আকাশটাকে দেখতে পাই। আমি অবাক হয়ে দেখি ঝকঝকে, ঘন সাদা মেঘের মতো আমি আমার স-ব চরিত্রদের দেখতে পাই। সেই গল্প, শ্যামলকাকু; তার ভাইয়ের বউ, দিদি, মা, বাবা রঞ্জনকাকু, আমার আকাশলীনা। এই শহরে অচেনা কত অঢেল চরিত্র—সবাই লিখে চলেছে। আমি দেখতে পাই তাদের লেখা প্রতিটি অক্ষর। যাদেরকে আমি লিখব ভেবেছিলাম তারাই সকলে নি:শব্দে লিখে চলেছে আমাকে! আমার জীবন আমার মৃত্যুকে লিখছে, কাটছে, তাদের লেখা প্রতিটি শব্দে জন্ম হচ্ছে আমার!…

আমি একটা শব্দে পাশ ফিরে তাকাই। বিষের শিশিটা আমার ঘর থেকে দিদির ঘরে চলে এসেছে। ও ফিসফিস করে খানিকটা বিষণ্ণভাবে বলল—’কী হল এসো, আমি অপেক্ষা করছি।’

আমি বলি, ‘তুমি যাও। আমি আসছি।’

সে ফিরে যায় আমার ঘরে।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠি। দিদির দিকে তাকাই। দিদি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে কখন। একবার জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াই। বোধহয় শেষরাত। শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে।

আমি আমার ঘরে যাই। দেখি শিশিটা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। আমি খাঁটি প্রেমিকের মতো তার চিবুকে হাত রেখে মুখটা আমার সামনে তুলে ধরি। তারপর বলি, ‘আসলে তুমিও খুব অসহায়। একটু শান্ত হয়ে বসো এখানে। তোমার কি কাউকে কিছু বলার আছে?’

বিহান

বইমেলা ২০০৫