বিনোদ ঘোষাল
ডানাওলা মানুষ
দৃষ্টিবদল
‘পঃবঃ, স্বর্ণবণিক, 32/5′-4″, বি এ, উত্তর কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি, পৈতৃক ব্যবসা, অনূর্ধ্ব সাতাশ-এর জন্য নূন্যতম উ: মা: ফরসা সুন্দরী পাত্রী ব্যতীত পত্রালাপ নিষ্প্রয়োজন। দাবি নাই। বক্স নং…।’
লাল কালি দিয়ে এই অংশটুকু গোল করা রবিবারের সেই কাগজটি এখনও হয়তো হিন্দমোটরের ৭নং দেবাই পুকুর রোডের বাড়িতে খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মিতা আর সেই বাড়িতে নেই। সপ্তাহ দুয়েক হল ও এখন ৩৭/বি নিবেদিতা লেন, বাগবাজারের একটা দোতলা বাড়িতে। বাইরে থেকে বাড়িটাকে দেখলে মনে হবে কোনও আশি বছরের বুড়ো পান খেয়ে দাঁত বার করে হাসছে।
মোটা কাঠের সদর দরজা ঠেলে ঢুকতেই বেমক্কা অন্ধকার। তারপর খাড়া সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে চোখ সইয়ে নিতে নিতে উঠে যেতে হবে দোতলার দিকে। সিঁড়ি শেষ হলে লম্বা বারান্দায় মোটামুটি আলো। মেঝেতে মোজাইক টালিগুলোর অধিকাংশই ঢকঢক করে। বারান্দা লাগোয়া দুটো বিশাল ঘর। বারান্দার শেষ কোণে ম্যাসোনাইট দিয়ে ঘেরা রান্নাঘর, আর শুধু রাত্রে ব্যবহারের জন্য একটা বাথরুম। সারাদিনের বাথরুম-পায়খানা নীচে। সেটাও ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের বেলাতেও একটা পঁচিশ ওয়াটের বালব জ্বলে, পায়খানার প্যানটা গোল, পাদানি দুটো বিশাল উঁচু, নড়বড়ে টিনের দরজার নীচের অংশের অনেকটা জং ধরে খেয়ে গেছে। বিশ্রী স্যাঁতসেতে কলতলা আর বাড়ির কার্নিশে বট-অশ্বত্থের চারায় ছড়াছড়ি। ছাদে ওঠার সিঁড়িটি কাঠের। ওঠানামা করতে গেলে অল্প দোলে, বড় রাস্তা দিয়ে ট্রাম গেলে দোতলার মেঝে থরথর করে কাঁপে।
ফুলশয্যার পরদিন সকালেই মিতা ওর বর শংকরকে জিগ্যেস করছিল, ‘মেঝেটা এমন কাঁপে, ভিত নষ্ট হয়ে যাবে না?’
শংকর হ্যা হ্যা করে হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘ধ্যার মাইরি, অ্যাদ্দিনে এ-বাড়ির ভিত আর আছে নাকি?’
ভিত নেই! থমকে গিয়েছিল মিতা!
তারপর প্রায় দিন চোদ্দো পেরিয়ে যাওয়ার পরেও নতুন এই বাড়িটাকে কিছুতেই অভ্যেসে আনতে পারল না ও। এখানকার ব্যাপার-স্যাপার যেন কেমন ধরনের। শ্বশুর গত হয়েছে মিতার বিয়ের বছর তিনেক আগে। বাড়িতে লোক বলতে শংকর, মিতা আর শাশুড়ি। নিয়তি কর্মকার, ভয়ংকর অ্যাপিয়ারেন্স মহিলার। সামনে এসে দাঁড়ালে হাওয়াও থমকে যায়। গাঁক গাঁক করে কথা বলে। আর কথায় কথায় বিচ্ছিরি সব ভাষা। শংকরও মায়ের মতো, মুখের কোনও আগল নেই। মিতার বাড়িতে জীবনে কেউ কখনও ‘শালা’ শব্দটা উচ্চারণ করেনি। তাই মাঝেমধ্যেই ও চমকে ওঠে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার শাশুড়ির হাবভাব ঠিক মা-মা নয়। ছেলের সামনে কেমন হিরোইন গোছের হয়ে থাকে। গা ঘিনঘিন করে মিতার। কিন্তু কিছু করার নেই। বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে শংকর যখন ওর ভারী চেহারা নিয়ে নিজের ‘আভরণ’ নামের সোনার দোকানে বসে টেবিল ফ্যানের সামনে সারাদিন বিনবিন করে ঘামে, তখন মিতাকে বাড়িতে এই মহিলার সঙ্গেই থাকতে হয়। মিতার বিয়ের আগে নীচের তলায় এক ঘর ভাড়াটে ছিল। অনেক পুরোনো, ষাট টাকা ভাড়া। মায়ে-পোয়েতে না কি প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে ওদের তুলেছে। এখন ঘরটায় ভাঙাচোরা টেবিল-চেয়ার, তিন পায়া চৌকি, শংকরের ছোটবেলায় জংধরা লজঝড়ে সাইকেল থেকে শুরু করে ফুটো লোহার বালতি, টিভির বাক্স, দড়ি, ফাটা জলের পাইপ সব কিছু গুছিয়ে রাখা আছে। মিতা আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে, শাশুড়ি মাঝেমধ্যেই ওর দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে চেয়ে থাকে। গা শিরশির করে। দম বন্ধ হয়ে আসে মিতার। বাবা যে কেন বেছে বেছে এই বাড়িটাই জুটিয়েছিল! হয়তো আর উপায়ও ছিল না। অথেনটিক ফার্মাসিউটিকালের সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্ট বাবা। রিটায়ার করার পর থেকেই বড় অস্থির হয়ে পড়েছিল। ভাই বেকার, মায়ের বারো মাসের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, মিতার ছাব্বিশ প্লাস আর রিটায়ারমেন্টের এক বিঘত পুঁজি নিয়ে সব বাঙালি বাবার মতো মিতার বাবাও আগে কন্যাদায় মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণে ঝাঁপ দিয়েছিল ‘পাত্রী চাই’-এর পাতায়। সেখানে ’32/5”-8”’, এবং ‘দাবি নাই’-এর শংকর যে শাঁসালো পাত্র সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। মিতাও মেনে নিয়েছিল।
সাতাশের জীবনে একটা প্রেমও করতে পারেনি মিতা। হয়তো প্রেম করা সবার দ্বারা হয় না বলে। ইচ্ছে থাকলেও নয়। ভালোবাসতে পারলেও নয়। কোথায় যেন একটা আটকে যায়। জট পাকিয়ে যায় সব।
আরও বছর দুয়েক
‘আ-হ রাতদিন ট্যাঁ ট্যাঁ…পাগল করে দিল শালা।…জানলাটা বন্ধ করো তো।’ বিছানায় শুয়ে থেকে বলল শংকর। মিতা জলের জগটা খাটের পাশে টেবিলের ওপর রেখে জানলাটা বন্ধ করে দিল। মিতা জানে শংকরের বিরক্তির আসল কারণ মিতার উপস্থিতি। পাশের বাড়ির বাচ্চাটার কান্না নয়। ইদানীং ওকে যেন সহ্যই করতে পারে না শংকর। সামনে এলেই অকারণ খিটমিট শুরু করে দেয়। মিতা উত্তর দেয় না। কী হবে ঝুটমুট কথা বাড়িয়ে? পাশের বাড়ির দীপেনের গতবছর বিয়ে হয়ে এ বছরের মধ্যে একটা ছেলে হয়েছে। দেখতে যদিও খুব একটা সুবিধার হয়নি। দীপেনের মতোই ভ্যাপসা কালো। তবু তাকেই, ফুঁ দিলে উড়ে যায়, এমন পাতলা একটা সোনার আংটি দিয়ে মুখ দেখে এসে শাশুড়ি মিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বাড়ির কাজের লোক হারুর মাকে বলেছিল, ‘দেখতে যেমনি হোক, হয়েছে তো। বংশটা তো মিটে যাবে না আমাদের মতো।’
এই দু-বছরে চেষ্টা অবশ্য কিছু কম করা হয়নি। বহু গাইনির কাছে বহুবার পাক খাওয়া হয়েছে। অমুক ব্রত, তমুক পুজো, কোমরে লাল সুতোয় বাঁধা পাঁচ-ছ’টা শিকড় মিতাকে উঠতে-বসতে খোঁচা দেয়। তবু কলসি ভরেনি। বছর দেড়েক হল মিতারও ওর মায়ের মতো অম্বলের রোগ ধরেছে। গলা-বুকের মতো আগে গোটা শরীরটাও জ্বলত সারাদিন, সারারাত। এখন শরীর শুকিয়ে গিয়ে বাজপড়া সুপুরি গাছের মতো। চুল পাতলা, চোখের তলায় কালো ছোপ। বহুদিন হল শংকর ওকে আর ছুঁয়েও দেখে না। মিতাও অনাত্মীয় নিষ্প্রাণ দুটো মাংস চামড়ার ঘষাঘষি থেকে রেহাই পেয়ে বেঁচেছে। মিতা বোঝে ওর নিজের এমন ন্যাতানো চেহারা আর শংকরের সঙ্গে ওর দূরত্বটায় শাশুড়ি দারুণ আনন্দ পায় মনে মনে। এমনকী ওদের কোনও ইস্যু না হাওয়াটাও মহিলাটির কাছে ভীষণ আরাম।…ঠিক কী-ই যে চায় মানুষটা? কিন্তু আশ্চর্য মজা, স-অ-ব কিছু কেমন যেন সয়ে গেছে। ঘা-টা থাকলেও নুন ছিটোলে তেমন আর জ্বলে না। সেই ছোট্টবেলায় বড়কাকুর সঙ্গে রেল-ইঞ্জিন তৈরির কারখানা দেখতে গিয়েছিল যখন। কতকগুলো লোককে ভয়ংকর আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করতে দেখে প্রায় আতঁকে উঠে জিগ্যেস করেছিল ‘কাকু, এত গরমে ওদের কষ্ট হয় না?’
কাকু হেসে উত্তর দিয়েছিল ‘আগে হত নিশ্চয়ই, এমন অভ্যেস হয়ে গেছে।’ ঠিক সেই রকম একটা অভ্যেস।
কড়িবরগার থেকে মান্ধাতার আমলের সিলিং ফ্যানটা ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরছে। রেগুলেটর একেও যা পাঁচেও তাই। মিতা জিগ্যেস করল, ‘খাবার বাড়ব?’
‘নাহ, খেয়ে এসেছি।’ শংকর চোখ বুজেই উত্তর দিল।
কী খেয়ে এসেছে সেটা বোঝা খুব কষ্টের নয়। ঘর ভরতি তার গন্ধ, মাঝেমধ্যের ব্যাপার। ইদানীং একটু বেশি। মিতা আর কথা বাড়াল না। ঘরে টিউবলাইটটা নিভিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়ল। বেশ কিছু দিন হল শংকরের ফিরতে বেশ রাত হচ্ছে। গোড়ার দিকে দু-একদিন জিগ্যেস করেছিল মিতা। একই উত্তর পেয়েছে ‘কাজের চাপ ছিল’। কী কাজের কেমন চাপ জানার আগ্রহ আসেনি।
শংকর ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখটা সামান্য হাঁ করে রয়েছে বলে ঘরের ভেতর গন্ধটা আরও তীব্রভাবে ছড়াচ্ছে। মিতা উলটো দিকে পাশ ফিরে সুইচবোর্ডের প্লাগে গোঁজা অল আউটের ছোট্ট লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকল। রোজ রাত্রে শোওয়ার পর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসা পর্যন্ত ও এমনিভাবে তাকিয়ে থাকে। তারপর এক সময় ধীরে ধীরে আলোটা যেন চোখের সামনে থিরথির করে কাঁপতে শুরু করে। শুধু এক জোড়া চোখ আর বহু দূরে এক বিন্দু আলো। মাঝখানে নিকষ অন্ধকার।…কাঁপুনি বাড়তে থাকে। একসময় চূড়ান্তভাবে কাঁপতে কাঁপতে আলোটা আবছা হতে শুরু করে,…আরও আবছা…ঘুমিয়ে পড়ে মিতা।
আজকেও সবে আলোটা কাঁপতে শুরু করেছিল তখনই…‘মমতা…আহ…আ-আ…মমতা, প্লিজ…আরেকটু…তোর মধ্যে শাহ জাদু…’ শংকরের গোঙানোয় মিতার প্রত্যেকটা রোমকূপে যেন আগুন ছুঁয়ে গেল। মিতা উঠে যেতে গিয়েও উঠল না। শুধু ওর বাঁহাতের তর্জনীর নখটা তীব্রভাবে গেঁথে যেতে থাকল বালিশের মধ্যে। আর শংকর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মাঝে-মাঝেই গুঙিয়ে বলে চলল তার মমতার কথাই।
‘না-নাহ, পাগল না কি যে দুনিয়ার সব পাগল-ছাগল এনে বাড়িতে জমা করব? তারপর বাড়িভর্তি হেগেমুতে একশা করবে।’ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মিতার দিকে একঝলক তাকিয়ে চিৎকার করে বলল শংকরের মা।
‘না-না, বউদি সেসব চিন্তা নেই। আমি ওকে সকালবেলায় ওসব করিয়েই বার হই। আর পেচ্ছাপ পেলে ও আগে আমাকে ডাকে। শুধু তো একটা বেলা। আমি যতক্ষণ বাইরে থাকি, এক কোণে চুপটি করে বসে থাকবে। এট্টুও জ্বালাবে না।’
মিতা বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে নীচে দেখল হারুর মা আর শাশুড়ির মাঝখানে একটা ছেলে কলতলার সামনে বসে আছে। এত কথায় কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথা নীচু করে একমনে আঙুল দিয়ে জলের দাগ কাটছে। মিতা বুঝতে পারল ছেলেটা হারু। যার কথা এতদিন শুনে এসেছে। হারু মানসিক প্রতিবন্ধী। নিজে উঠে দাঁড়াতেও পারে না।
শংকর পায়খানা থেকে বেরিয়ে হাতের লোহার বালতিটা ঠং করে কলের সামনে রেখে জিগ্যেস করল, ‘কী হল সাতসকালে?’
‘এই দ্যাখ, হারুর মা বলছে এটাকে না কি সকালবেলায় এখানে রাখবে।’
শংকর বলল, ‘কত দিন?’
হারুর মা তড়বড় করে উত্তর দিল ‘শুধু দিন কয়ের জন্য গো। কিছু অসুবিধা করবে না হারু। আসলে ওর বাবার কয়দিন হল সকালে ডিউটি পড়েছে। বড্ড সমস্যায় পড়েছি ছেলেটাকে নিয়ে। একা যে বাড়িতে রেখে আসব তাও পারি না…’
শংকর একটু চুপ থাকল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক আছে থাকুক, তবে দেখো, বাড়িঘর যেন নোংরা না করে।’ বলে ও হিরোর মতো গিয়ে পায়খানার বালতিটা কলের নলের সামনে টেনে এনে কল খুলে দিল। শাশুড়ি আর কথা না বাড়িয়ে ওপরে এসে রান্নাঘরে ঢুকল। মিতা দেখল হারুর মা হারুর দুই বগলের তলায় হাত দিয়ে ওকে প্রায় টেনে দাঁড় করিয়ে খুব ধীরে ধীরে নিয়ে চলল সদরের দিকে। আর শংকর মুখের ভেতর পাঁচটা আঙুল ঢুকিয়ে অ্যা-অ্যা-হ্যাঁক…থু…থু শুরু করল। মিতা সরে এল। শংকরের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন কৃমির মতো মনে হচ্ছে লোকটাকে। রান্নাঘরে এল। শাশুড়ি চা বসিয়েছে। মিতা ঢুকতেই শাশুড়ি বলে উঠল, ‘দেখলে তো হারুর মা-র কাণ্ডটা, নরম জায়গা পেয়ে দিব্যি কেমনে হারুকে গছিয়ে দিয়ে গেল। দাঁড়াও না, আমাকেও চেনে না। একবার মুতলেই লাথি মেরে দূর করব ওটাকে।’
মিতা চুপ, মুখের ভেতরটা বিস্বাদ লাগছে। অ্যাসিড হয়েছে বোধহয়। শাশুড়ি গ্যাসের ওপর বসানো সসপ্যানে দু-চামড় চা ঢেলে বলল, ‘শঙ্কু রাজি না হলে আমি দিতাম নাকি ওটাকে রাখতে? বুঝেছে ছেলেটার মন নরম, ব্যস দিব্যি রাজি করিয়ে নিল…মহা শয়তান এই ছোটলোকগুলো… কাপগুলো এদিকে একটু এগিয়ে দাও তো।’
মিতা কাপ এগিয়ে দিল।
‘শঙ্কুটা তো চিরকালই নরমমনা।’ শাশুড়ির গলায় সুযোগ্য পুত্রের জন্য গর্ব ঠেলা মেরে বেরিয়ে আসছে। ‘একবার তো ছোটবেলায় জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ওর বাপের একটা নতুন ধুতি ভিখিরিকে দান করে বসেছিল। যে ভাগ্যি আমি দেখতে পেয়ে আবার ফেরত নিয়ে আসি। এখনও একইরকম ছেলেমানুষ রয়ে গেল। তুমি আসার আগেও তো আমাকে প্রায়ই ভাত গ্রাস করে মুখে তুলে দিতে হত।’ বলে চা ছেঁকে কাপে ঢালতে ঢালতে মিতার দিকে তাকিয়ে পান খাওয়া ছোঁপ দাঁত দেখিয়ে হ্যা হ্যা করে বিচ্ছিরি একগাল হাসল। মিতা চুপ।
‘যাও, এটা দিয়ে এসো।’
মিতা না বলতে গিয়েও পারল না। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে চায়ের দিকে একবার দেখল মিতা। ঘন কালচে লাল রং। বিষের রং কি চায়ের সঙ্গে মিশে যায়?
ঘরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে খালি গায়ে তোয়ালে পরে দাঁড়িয়ে শংকর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বুকে পাউডার ঢালছে। তারপর বডি স্প্রেটা নিয়ে স্যাক স্যাক করে কানের নীচে, বগলে স্প্রে করল।
মিতা চায়ের কাপ টেবিলে রেখেই চলে যাচ্ছিল। শংকর বলল, ‘আমার লাল পাঞ্জাবিটা একটু বার করে দাও তো।’
যন্ত্রের মতো গিয়ে আলমারি খুলে পাঞ্জাবি বার করে খাটের ওপর রাখল মিতা।
‘বুঝলে রাজিই হয়ে গেলাম…থাক গে। গরিব মানুষ, একেবারে হেল্পলেস হয়ে পড়েছে।’ শংকর তোয়ালের ওপর লুঙ্গি গলিয়ে লুঙ্গিটাকে কামড়ে ধরে ভেতরের তোয়ালেটা ছাড়তে ছাড়তে গোঁ-গোঁ করে বলল। মিতা নিষ্ক্রিয় রোবট হয়ে দাঁড়িয়ে। শংকর চায়ের কাপে চুমুক দিল। মিতা একঝলক শংকরের মুখের দিকে তাকাল। চায়ে বিষ থাকলে শংকরের মুখটা এখন কেমন হত? সিনেমায় যেমন দেখায়, দু-হাতে নিজের গলা চেপে ঠিকরে পড়া চোখ নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ত মিতার সামনে?
শংকর চায়ের কাপে নিশ্চিন্তে আরও দুটো চুমুক দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে টেবিলের ওপর রাখা খবরের কাগজটা বাঁহাত দিয়ে তুলে প্রথম পাতাটা দেখেই বলল, ‘ধ্যাস শাহ খালি খুন আর রেপ,…এ ছাড়া কোনও খবরই থাকে না…না না না—হুঁ হুঁ…’ মিতা বুঝল, সাতসকালে হঠাৎ একটা দয়াদাক্ষিণ্য করে এখন ফূর্তির তাল সামলাতে পারছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিতা।
শংকর বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ দোকানে গেল। শাশুড়ি দুপুরে খেয়েদেয়ে পাশে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ার পর গোটা বাড়িটা চুপ। নীচে শুধু হারুর মা বাসন মাজার শব্দ করছে। তখন গতরাত থেকে শরীরের ভেতর ছোটাছুটি করতে থাকা জ্বালাটা নিস্তব্ধতায় আরও প্রচণ্ড হয়ে উঠল মিতার। সব জ্বালাই তো সয়ে গিয়েছিল এতদিনে। কিন্তু কাল থেকে যেন…কেন যেন…তীব্র একটা অপমান…, মিতা বালিশ আঁকড়ে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ,…অসহ্য! উঠে গিয়ে আলমারির মাথার ওপর তোলা বিয়েতে পাওয়া ভিআইপি বাক্সটা নামাল,…কিন্তু কোথায়? কোন চুলোয়? বাবা গত বছর ফার্স্ট স্ট্রোকেই আর ফিরতে পারেনি। মা আলসারে বিছানায়। ভাইটা বাড়ির এক পোরশন ভাড়া দিয়ে আর দিনরাত টিউশন করে সংসারে তাপ্পি মারছে। বাক্সটা আবার তুলে রাখল মিতা। গলার ভেতরে যেন একমুঠো বালি আটকে রয়েছে, জল খেল। তারপর অস্থিরভাবে নেমে এল নীচে। সদর দরজার সামনে হারু বসে আছে। তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখল মিতা। রোগা ফর্সা চেহারা। বসে থাকলেও বোঝা যায় বেশ লম্বা। মাথা ভরতি তেল চুপচুপে ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল। মুখ ভরতি দাড়ি-গোঁফ। কিন্তু মুখটায় ভারি সারল্য মাখানো। চুপচাপ বসে থাকলে কে বলবে ছেলেটা প্রতিবন্ধী? হারু একমনে মেঝেতে আঙুল দিয়ে কী সব লিখছে, আর বিড়বিড় করছে। ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ মিতাকে খেয়াল করল না। তারপর একবার চোখ তুলে মিতাকে দেখতেই যেন চমকে উঠল। দীর্ঘ চোখ দুটো দিয়ে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকল মিতার দিকে। কীরকম সেই তাকানো! ভিতরে শিরশির করে উঠল মিতার। পা দুটো যেন মাটিতে কামড়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর প্রায় নিজেকে হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেল হারুর অমন ডুবিয়ে দেওয়া তাকানো থেকে।
সেই দিন
গতকাল বিকেল থেকে টাইমকালে জল আসছে না। বাথরুমে চৌবাচ্চায় জমানো যেটুকু জল ছিল আজ সকালে শংকর আর ওর মা স্নান করে শেষ করে দিয়েছে। শংকর দোকানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শাশুড়িও সেজেগুজে বেরিয়ে গেল। শোভাবাজারে তার কোন পুরোনো বান্ধবী দিল্লি থেকে এসেছে। তার সঙ্গে দেখা করে দুপুরে সেখানে খেয়েদেয়ে বিকেলে ফিরবে। অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকল মিতা। ক’দিন ধরে বুকের ভিতরে হঠাৎ করে ধড়ফড় করে উঠছে। শরীরটা ভীষণ দুর্বল। মাঝেমধ্যেই নিশ্বাস আটকে আসে যেন। অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর উঠল মিতা। নড়তে-চড়তে ইচ্ছে করছে না। স্নানের কথা ভাবলেই মনে পড়ছে বাথরুমে এক ফোঁটা জল নেই। নীচে কলতলায় আরও একটা চৌবাচ্চা আছে। বাসন মাজার জন্য জল ভরা থাকে। আজকে বিকেলে হারুর মা এসে ওই জল দিয়েই বাসন মাজবে। তা হলে স্নান…নিমেষে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দার তারে ঝোলানো নিজের গামছাটা ছোঁ মেরে নিল মিতা। সিঁড়ি বেয়ে এক ছুটে নেমে এল নীচে। চৌবাচ্চাটার সামনে এসে দাঁড়াল। শ্যাওলাপড়া চৌবাচ্চার ভেতর শিরশিরে কালচে পুরোনো জল। আঙুল ডোবাল মিতা। গোটা শরীর যেন ভিজে গেল সেই ছোঁয়াতে। এইটুকু জলেই আজ সারাদিন হয়তো বা আগামীকালও চালাতে হবে। কথাটা মনে হতেই কলকতলায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মিতা। মগে জল তুলে মাথায় ঢেলে দিল। ঝিনঝিন করে উঠল গোটা শরীর। আর এক মগ ঢালতেই ‘ওঁ-হ’ শব্দে সদর দরজার দিকে তাকাল মিতা। হারু বসে রয়েছে। গায়ে জামা নেই পাজামা হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। ভুরু কুঁচকে মিতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ছেলেটার কথা খেয়ালই ছিল না। মিতা গামছাটা টেনে বুকের ওপর চাপিয়ে নিল। তারপর আবার মগে করে জল তুলল। পুরো জলটা শেষ করতে হবে। একটুকু যেন পড়ে না থাকে। এক ফোঁটাও নয়। জল ঢালতে থাকে মিতা। একসময় আবার তাকাল হারুর দিকে। হারু অস্থিরভাবে মিতাকে দেখছে। মাছের গন্ধ পাওয়া বেড়ালের মতো দৃষ্টি। আচমকা বুকের ওপর থেকে গামছাটা ছুড়ে ফেলে দেয় মিতা। হারুর দিকে ঘুরে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে মগ উঁচু করে জল ঢালে মাথায়। গোটা শরীর বেয়ে জল নামে। ভিজে শাড়িটা মিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। মিতা চোখ বুজে ফেলে। তবু যেন দেখতে পায় হারু কীভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে মগের পর মগ জল ঢালতে থাকে মাতালের মতো…
সব জলটুকু শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও চোখ বুজে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে মিতা। ধীরে ধীরে একসময় চোখ খোলে। ক্লান্ত নিশ্বাসে বুক ওঠা-নামা করছে। গোটা শরীরটা কেমন যেন চ্যাটচ্যাট করছে। হারুর ঠোঁটের কষ বেয়ে নামা গঁদের আঠার মতো লাল যেন লেগে রয়েছে তার গোটা গায়ে। মিতা প্রচণ্ড ঘেন্না নিয়ে আর একবারের জন্য হারুর দিকে তাকাতেই গোটা শরীরে যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। হারুর জায়গায় মিতা স্পষ্ট শংকরকে দেখছে। শংকরের চোখে দাউদাউ দৃষ্টি। কিন্তু নিষ্ফল, অসহায়, বেচারা!
সানন্দা
ডিসেম্বর ২০০৬