লীলা মজুমদার
শুধু গল্প নয়
অভিযান
আমি অত ছোটদের গল্প বড়দের গল্পের তফাৎ বুঝি না। চারদিকে যেমন দেখি তেমন লিখি। তার চেয়েও বেশি শিখি। যে-সব কথা সন্দেহ করি, কিংবা আঁচ করি, তাও লিখি। সম্ভাব্য সব কথাই লিখি। সম্ভাব্য বলতেও শুধু যে-সব ব্যাপার হয়ে ঘটে চুকেবুকে গেছে, সেটুকুমাত্র বুঝি না। আমার কাছে যা হয়নি, অন্তত হয়েছে বলে শুনিনি, কিন্তু যে-কোনো সময়ে হলেও হতে পারে, তাও সম্ভব, তাও সত্যি।
ব্যাপারটা আগাগোড়া আমাদের পাড়ার নালুঠাকুরঝির মুখে শোনা, তবে ছেলেগুলোকে আমিও দেখেছি। বল খেলে আমাদের জানলা-টানলা ভাঙে। তা ছ-বছর আগে পুজোর ছুটিতে ওদের মধ্যে সবচেয়ে জবরদস্ত গোটা পাঁচেক ছেলে ঠিক করল সাইকেল চেপে গিরিডি যাবে। বয়স সব ১৬-১৭-১৮, কেউ দশের পরীক্ষা দেবে, কেউ বারোর, কেউ সবে পাশ করেছে। তাদের মধ্যে নালু- ঠাকুরঝির নাতি গনাও ছিল। সে আবার মাধ্যমিকে ফেল করেছিল। তবে তাতে নাকি হিংসুটে পরীক্ষকদের হাত ছিল, ঠাকুরঝি বললেন।
গেরস্তবাড়ির ছেলে সবাই। রেল ভাড়া হোটেল খরচা দিয়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়, এতে খালি পথের খাওয়া-দাওয়া বাবদ সামান্য হাতখরচা ছাড়া কোনো বালাই নেই। কাজেই কারো বাড়ি থেকে কোনো আপত্তি হল না। গনাটার উৎসাহ দেখে কে। কার কাছ থেকে একটা রোড-ম্যাপও জোগাড় করে ফেলল। বর্ধমান অবধি গ্র্যাণ্ড ট্রাংক রোড ধরে সোজা পথ। বর্ধমানে পুলুর দাদার শ্বশুরবাড়ি, সেখানে রাত কাটানো। বর্ধমানের পর একটু ঘুরো পথ। মধ্যিখানে মস্ত বন। স্থানীয় লোকেরা তার একটা বিশ্রী নাম দিয়েছে—রক্তখাগীর বন। তাই শুনে ওদের উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বিপদ না থাকলে আবার অ্যাডভেঞ্চার কিসের? নালুঠাকুরঝি বললেন, ‘তা ভয়টা কিসের? গনার কোমরে লোহার ঘুনসি আছে। গুরুদেব দিয়েছেন।’
পাঁচজনের পাঁচটি পুরনো সাইকেল। নিজেরাই মেরামত করে চৌকোস করে রেখেছে। ঘটুর কাকার সাইকেল মেরামতের দোকান আছে পদ্মপুকুরে। শনি-রবি খুড়ো ছুটি নেন, ঘটু চার্জে থাকে। সাইকেল সারানোর কিছু জানতে ওদের বাকি নেই। পথের যাবতীয় সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মোকাবিলা করবার জন্য নানা রকম যন্ত্রপাতি, আঠা, তেল ইত্যাদিকে একটা খোপকাটা খাকি ন্যাকড়ার থলিতে পরিপাটি করে জড়িয়ে বেঁধে ঘটু ক্যারিয়ারে আটকে নিয়েছিল। বলা বাহুল্য কাকা পরেও এ বিষয়ে ঘুণাক্ষরে টের পাননি। একটা বাড়তি শার্ট পেণ্টেলুন, একটা করে তুলোর কম্বল, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। আবার কি চাই?
এই সমস্ত কথাই নালুঠাকরুণ সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এসে বলে গেলেন। শেষের রাতটা থাকা হবে রক্তখাগীর বনে ঢুকবার আধ কিলোমিটার আগে গনার বড়মামার খামারবাড়িতে। তিনি পেনশন নিয়ে ওখানে সস্তায় জমি কিনে মস্ত গোয়াল আর আখের খামার করেছেন ৷ নাকি চমৎকার দোতলা মাটির বাংলো করেছেন। সেখানে ছেলেরা নিশ্চয় আদর-যত্ন পাবে গনার মামার কাছ থেকে। তা বেয়াইমশাই যতই বজ্জাত হোন না কেন, সত্যি কথা আমি বলবই।
এটা কিছু ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, তবে পটভূমিকাটা তো দেওয়া দরকার, তাই এত কথা। এদিকে সব তো হল। মায় প্রত্যেকের পিঠের ব্যাগে বিস্কুট, চিঁড়ে-মুড়ি-নাডু ইত্যাদি। হেনকালে যাকে সাহেবরা বলে—একাদশ ঘণ্টায় বাধা পড়ল। গনার দাদামশাই এসে ওর ঠাকুরদাকে বললেন—’ফেল করে আবার নাকি হতভাগা আমোদ করতে যাচ্ছেন! তুমি কি বলে মত দিলে বুঝলাম না। ও সব হবেটবে না, জগা, তোমার এ জন্মে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না দেখছি।’ ব্যাস হয়ে গেল! বুড়োও অমনি বেঁকে বসল। নালুঠাকুরঝির কি রাগ! ‘বলিনি বজ্জাৎ বুড়ো! ওষুধ না খেলে ঘুম হয় না, ইয়ে হয় না, ও মত দিতে আসবার কে! আর ইনিও তেমনি, বেয়াইয়ের কথায় ওঠেন বসেন। কারণ এক সময় বেয়াই ওনাদের টিমে স্কুল-ক্যাপ্টেন ছিলেন!’
দাদুকে যখন কিছুতেই মত করানো গেল না, তখন গনা অগত্যা কালো মুখ এবং অতি বিচ্ছিরি বানানের একটা চিঠি নিয়ে ওদের হাতে দিল, যাতে বড়মামার বাড়িতে অসুবিধা না হয়। নালুঠাকুরঝিও সেই রাতের ট্রেনেই কাশীতে বোনের বাড়ি গেলেন। সংসারে তাঁর ঘেন্না ধরে গেছিল। বাকি ঘটনা খবরের কাগজেই বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নানা কারণে চেপে যাওয়া হয়েছিল।
নির্ধারিত দিনের ভোরবেলায় বাকি চারজন রওনা হয়ে গেল। পুলু, ঘটু, বেচু আর কানাই। এত চমৎকার ভ্রমণ যে একটু পরেই ওরা গনার কথা বেমালুম ভুলেই গেল। মাঝে মাঝে দোকানে থামা, বোয়েমের বিস্কুট আর ভাঁড়ের চা খাওয়া। যথাসময়ে বর্ধমানে পুলুর দাদার শ্বশুরবাড়িতে চিঠি ও কড়াপাকের সন্দেশ পৌঁছে দিয়ে রাজোচিত আদর-যত্ন লাভ। বেশি বর্ণনা দিতে পারলাম না, কারণ নালুঠাকুরঝি তেমন কিছু বলতে পারলেন না ৷ তাছাড়া গল্পের এ জায়গাটার তেমন গুরুত্ব নেই।
পরদিনের যাত্রাপথ আরেকটু কষ্টকর। উঁচুনিচু এবড়ো-খেবড়ো। দু-একবার বাড়তি থামা। একটু-আধটু মেরামতি। পুলুর চেন ছিড়ল, ভাগ্যিস ঘটুর থলিতে বাড়তি একটা ছিল। শেষ পর্যন্ত পা যখন আর চলে না, পথের ধারে ঠিক গনা যেমন বলেছিল, চমৎকার এক খামারবাড়ি। নিজেদের ডাইনামোর বিজলী বাতি, পেছনদিকে খামারবাড়ি।
সকলে যেন হাতে চাঁদ পেল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। হাঁকডাক করে যদি বা গেট খোলানো গেল, সাইকেল ঠেলে ভেতরে পা দেবার আগেই গেঞ্জি পরা বিকট বেঘো-চেহারার এক আধাবয়সী ভদ্রলোক দোতলার ঝোলা বারান্দায় বেরিয়ে এসে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন— ‘বলি, লজ্জা নেই তোদের? গনাটাকে ভালোমানুষ পেয়ে, তার মাথা তো চিবিয়েছিসই, আবার এখানে এসে হানা দিয়েছিস! বেরো বলছি! ন্যাপা, ওদের গেটের বার করে দিয়ে আয়! এক্ষুনি!’ তাঁর বেঘো হালচাল দেখে এবারে কারো মুখে কথাই সরল না, ঐ হরিব্ল্ বানানের চিঠি বের করা দূরের কথা।
সঙ্গে সঙ্গে তেলচিটে চেহারার রোগা কালো এক যুবক একতলার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওদের বলল— ‘একটু এদিকে এসে শোন, ভাই।’ লোকটা ওদের অচেনা হলেও গনার সঙ্গে চেহারার মিল দেখে বোঝা গেল এ-ই হল গনার কুখ্যাত ছোটমামা। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে, কাজকম্ম করে না। তা হতে পারে, কিন্তু মনটা যে ভালো তাতে সন্দেহ নেই। আড়ালে নিয়ে গিয়ে সে বলল, ‘দাদা আমাকে দিয়েই খবরটা পাঠিয়েছে বলে আমি দুঃখিত, লজ্জিত।’ তারপর বলল—’তা রাতে কোথায় থাকা হবে?’
বাকিটা সত্যি আরব্য উপন্যাসের মতো। ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে সে বলল– ‘বেশ তো গায়েপায়ে আছ। মনেও যদি তেমনি সাহস থাকে, তাহলে আমার সঙ্গে রক্তখাগীর বনে চল। সেখানে নাকি আস্তানা পাওয়া যেতে পারে। আমার বন্ধু বটু বলেছিল ওখানে কেউ থাকে না, এ ধারণা ভুল। যাবে তো চল। আমাকে রডে বসিয়ে নাও। বেশি দূর নয়। আমার অনেক দিনের শখ। হাঁটতে-টাটতে পারব না।’
ওকে নিয়ে ওরা বিনা বাক্যব্যয়ে বনের পথ ধরল। তখনো অন্ধকার হয়নি, যদিও বিকেল শেষ হয়ে এসেছে। ভালো পথ ছিল, এখন লতাপাতায় ঢেকে গেছে। এ পথে কেউ হাঁটা-চলা অন্তত এদানীং যে করেছে, তা মনে হল না। মনে একটু খটকা লাগলেও, ন্যাপামামার উৎসাহ দেখে ওরা ঘাবড়াল না। ওদের মধ্যে পুলুই বড়। সে একবার বলেছিল বটে—’ঠিক পথে যাচ্ছি তো মামা? এদিকে সাত বছরে কেউ হাঁটেনি মনে হচ্ছে যে।’ ন্যাপা হাসল— ‘পাগল! না জেনে কি আর ভরসন্ধ্যেয় তোমাদের এই আঘাটায় এনে ফেলি। এ বনটা এতকাল প্রাইভেট প্রপার্টি ছিল, এখন সরকার অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে। আসল মালিক সাব্যস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে তবে দখল নিতে হবে। নইলে মহা ঝামেলা হতে পারে। এটা বন-সংরক্ষণের আওতায় পড়বে। ভালো ভালো গাছ আছে।’
কানাই পড়াশুনোয় ভালো ছিল। সে অবাক হয়ে বলল,— ‘মামা, এত কথা জানলেন কি করে?’ ন্যাপা হাসল—’আমি জানব না? বলে বটু এক দিক থেকে দেখতে গেলে আমার উড্-বি শালা। মানে ওর বোনের সঙ্গে ইয়ে—’ বলে ন্যাপা একটু সলজ্জ হেসে চুপ করল। পুলু ঘটু কানাই বেচু সকলে উদ্গ্রীব— ‘থামলেন কেন, মামা? বোনের সঙ্গে— তারপর?’ ন্যাপা গম্ভার হয়ে গেল— ‘সে বড় দুঃখের কথা রে ভাই। মাসে দুশো টাকা আয় দেখাতে না পারলে ওর বাবার মত নেই।’ বেচুর রডেই বসেছিল ন্যাপা। তবে বনে ঢুকে ইস্তক সাইকেল ঠেলে হাঁটতে হচ্ছিল। বলা বাহুল্য বেচুর সাইকেলটা ন্যাপাই ঠেলছিল। বেচু তার পিঠ চাপড়ে সাহস দিয়ে বলল— ‘চিয়ার আপ মামা, দুশো টাকা আমরা আপনাকে সহজেই পাইয়ে দেব।’
সহানুভূতির চোটে আসল কথাটা আরেকটু হলে চাপাই পড়ে যাচ্ছিল। পুলু বলল— ‘বটু মামা কি বলেছেন? তিনি এর মধ্যে এলেন কি করে?’ ন্যাপা অবাক হল ‘—আরে সে জানবে না? সে তো ঐ বন বিভাগেই চাকরি করে। বনের অবস্থা দেখতে এসে ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেছিল। বজ্রবিদ্যুৎ হলে গাছতলায় কি বিপজ্জনক অবস্থা জানোই বোধ হয়। এদিকে অন্ধকার নেমে গেল, পথ হারিয়ে গেল। হয়তো ভয়েই মরে যেত। হঠাৎ আবছা দেখল ছোট একটা টিলার ওপর একটা লম্ফ জ্বলছে! উঠিপড়ি করে দেখে একটা চমৎকার কাঠের বাড়ি। দরজায় ঘা দিতেই পাল্লা খুলে গেল। দেখা গেল পরমা সুন্দরী এক ফিরিঙ্গি মেয়ে। খুব ফরসা না হলেও যেমন রূপ, তেমনি দয়া! সেই মেয়ে ওদের ডেকে নিয়ে গা মুছবার তোয়ালে, শুকনো জামা, গরম চা, সব দিল। ওরা তিনজন গায়ে নতুন প্রাণ পেল।
তারপর বৃষ্টি থেমে গেল, মেঘ সরে গেল, দেখা গেল তখনো দিন আছে। সেই মেয়েকে কি বলে ধন্যবাদ দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। মেয়েটিই বলল—’কিছু বলতে হবে না মাই ডিয়ারস্, খালি আমার এই চিঠিটি শহরের ডাকে দিয়ে দিও। আমার বাড়ির লোকেরা বড় নিষ্ঠুর, জোর করে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান বড়লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে। তাই আমি যাকে বিয়ে করতে চাই সে আমাকে এখানে লুকিয়ে রেখেছে। একটু মাইনে বাড়লেই নিয়ে যাবে। কাঠুরেরা খাবার-দাবার বিক্রি করে যায়। আমি বাইরে বেরোই না। পাছে বাড়ির লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু সে কেন আসে না?’ বলে কেঁদে ফেলল। বটুরা আর ওদিকে যায়নি, তবে চিঠিটা ডাকে ফেলে দিয়েছিল। কে এক কিরীটীনারায়ণ বসুকে লেখা। এতদিনে তাদের নিশ্চয় বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু বাড়িটা নিশ্চয় আছে। বাড়ি থাকলে আশ্রয়ও আছে।’
পুলু একটু হৃদয়হীন প্যাটার্নের। সে বলল— ‘বা বা মামা, বেড়ে গল্প ফেঁদে ফেললেন তো মুখে মুখে। ঐরকম মাসে গোটা দুত্তিন ছেপে বেরুলেই তো দুশো টাকা এবং বটুকে শ্যালকরূপে পেয়ে যাবেন।’ কি বিশ্রী কথা পুলুর যে বলা যায় না। কিন্তু ঠিক সেই সময়, ওর মুখে ছাই দিয়ে অনতিদূরে টিলার ওপর লম্ফর আলো দেখা গেল। দরজার কড়াও নাড়তে হল না। সবাই দেখল দরজা খুলে লম্ফ হাতে পরমাসুন্দরী সেই ফিরিঙ্গি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিরীটীনারায়ণ তাহলে এখনো তাকে নিয়ে যায়নি!
বনের মধ্যে এমন সুন্দর বাড়ি কেউ ভাবতেও পারে না। টিলার ওপর গাছপালা কম; তারার আলোয় মরশুমী ফুলে ঘেরা বাড়িটাকে অপরূপ দেখাচ্ছে। আগাগোড়া কাঠের তৈরি, চারদিকে কাচের জানলা, বিলিতী বইতে যেমন থাকে। এরা চারজন কস্মিনকালেও এমন দেখেনি। এ বাড়িতে রাতে ওরা থাকবে কি করে ঐ ধুলোয় ধূসর চেহারা নিয়ে। চৌকাঠ ডিঙোতেই লজ্জা করছিল। কিন্তু মেয়েটি ভাঙা ভাঙা গলায় ইংরিজিতে বলল – ‘এসো, তোমরা ভিতরে এসো। হাত পা ধোও, বিছানা পাতাই আছে। কি খেতে দেব তোমাদের? বাড়িতে যে কিছু নেই। আমি ছাড়া কেউ নেই। কাল আমিও থাকব না।’
ওরা চমকে উঠল। কত দুঃখে কথাগুলো বলা হল তা বোঝা গেল। ছিমছাম বিলিতী কায়দায় সাজানো বসবার ঘর। ন্যাপা সকলের হয়ে বলল— ‘তাতে কি হয়েছে, ম্যাডাম? আমরা খেয়ে এসেছি।’ আসলে আসেনি খেয়ে, মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ও-কথা বলল। এরাও সায় দিল— ‘হ্যাঁ, পরটা, কাবাব, দই। এইসব খেয়েছি। একটু শোবার জায়গা পেলেই আমরা খুশি। কাল সকালে চলে যাব।’
মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে ওদের বুক ধড়াস্ করে উঠল। অনেক দুঃখে অনেক কাঁদলে তবে কারো ও-রকম মুখের চেহারা হয়। একটা ফুলের যেন জলে ধুয়ে ধুয়ে সব রং উঠে গেছে।
ন্যাপার বেশ বয়স, তা চব্বিশ-টব্বিশ তো হবেই। সে বলল— ‘আপনি কেন চলে যাবেন এমন সুন্দর বাড়ি ছেড়ে?’ তার চোখ দিয়ে আরো খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে বলল— ‘মালিক বাড়ি বেচে দিয়েছেন। কাল তারা দখল নেবে।’
‘আর—আর কিরীটীনারায়ণ?’
‘তার সঙ্গে নতুন মালিকের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। চল, ঘর দেখিয়ে দিই। সাইকেল বারান্দায় থাক। কেউ নেবে না।’
এমনিতে ওরা এত কথা বলে, এখন কারো মুখে একটা শব্দ জোগাল না। ওরা মেয়েটির পিছন পিছন সুন্দর একটা শোবার ঘরে ঢুকল। পাশেই স্নানের ঘর দেখিয়ে দিয়ে সে চলে গেল।
শেষ রাতে পুলুর ঘুম ভেঙে গেল। কিসের কটু গন্ধ? কিসের ঝিলিক দিচ্ছে, অদ্ভুত একটা চাপা গন্গন্ শব্দ। পুলু লাফিয়ে উঠল—’আগুন! আগুন!’ কেমন যেন নিশ্বাস ফেলার কষ্ট হচ্ছিল। ওর চেঁচামেচিতে সবাই জেগে উঠল। জিনিসপত্র, জুতো, সাইকেল সব পড়ে রইল, ওরা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে— ‘ও ম্যাডাম্! ও, মিস্!’— করে পাগলের মতো এ-ঘর ও-ঘর করবার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও তাকে পেল না। সব জায়গায় যেতেও পারল না। দেখতে দেখতে সব ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। সোলার টুকরোর মতো শুকনো কাঠের পুরনো বাড়িটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ও বাড়িতে সে সুন্দর মেয়ে আর নেই। হয় চলে গেছে, নয় তো— মোট কথা এখন আর কারো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
আরো ঘণ্টা দুই পরে যখন পাঁচটি দিগ্ভ্রান্ত মানুষ রক্তখাগীর বনের বাইরে ন্যাপার বড়দাদার খামারবাড়ির দরজার ওপর আছড়ে পড়ল, তাদের দেখে বড়মামার চক্ষু চড়কগাছ। ন্যাপা তক্ষুণি মুচ্ছো গেল। বাকিদের ভাঙা ভাঙা কথা জুড়ে একটা অস্পষ্ট মানে করে বড়মামাও পড়ে যান আর কি। ‘বনের মধ্যে টিলার ওপর কাঠের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ড! তোরা বলিস কি রে! এমন তো কখনো শুনিনি। আচ্ছা, এবেলা খেয়েদেয়ে জিরিয়ে নে তো। গনাও কান্নাকাটি করে এসে গেছে কাল রাতের গাড়িতে। আমি না-হয় বনে একটু পরেই লোক পাঠাচ্ছি। অত ব্যস্ত হোস্ নে, বাপ।’
কালকের সে বেঘো চেহারার চিহ্নমাত্র নেই! সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছতে মুছতে গনাও এসে হাজির হল। চা-জলখাবারের পর ওরা কারো কথা শুনল না। ন্যাপা, গনা, বড়মামা, জনাচারেক খামারের লোক মিলে মস্ত এক দল করে ওদের সঙ্গে খামারের ছোট ট্রাকে বনের সীমানা পর্যন্ত গিয়ে, পায়ে হেঁটে দু-ঘণ্টা ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে বাড়ির কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। তবে আগাছায় ঢাকা একটা টিলার ওপর চড়ে অবাক হয়ে দেখল সেখানে ওদের সাইকেল, থলি, কম্বল, জুতো ধুলোর উপর পড়ে আছে। ধুলোটার রং কেমন কালচে, যেন বহুদিন আগেকার পোড়া ছাই মেশানো।